হজ সফরে সহজ গাইড হজ মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান ২৮ টি
  • ইহরাম করা; হজের নিয়ত করা।
  • আরাফায় অবস্থান করা; উকুফে আরাফা করা।
  • তাওয়াফুল ইফাদাহ বা যিয়ারাহ করা; হজের ফরয তাওয়াফ করা।
  • সাফা-মারওয়া সা‘ঈ করা; হজের ফরয সা‘ঈ করা।

উপরোক্ত ফরয কাজগুলো ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নির্দিষ্ট স্থানে ও নির্দিষ্ট সময়ে পালন করতে হবে। উপরোক্ত ফরয বা রুকনের কোনো একটি বাদ গেলে (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) হজ সম্পন্ন হবে না। কোনো ক্ষতিপূরণ বা দম দিয়ে কাজ হবে না। হজ বাতিল হয়ে যাবে। পরবর্তীতে পুনরায় নতুন করে হজ করতে হবে।

  • মীকাত থেকে ইহরাম করা।
  • সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা।
  • মুযদালিফায় অবস্থান করা; মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করা।
  • রামি করা; জামরাতসমূহে‎ কংকর নিক্ষেপ করা।
  • হাদীর পশু যবেহ করা।
  • কসর বা হলক্ব করা; চুল ছেঁটে ফেলা অথবা মাথা মুণ্ডন করা।
  • আইয়ামে তাশরীকের রাতগুলোতে মিনায় রাত্রিযাপন করা।
  • তাওয়াফে বিদা করা; হজ শেষে মক্কা ত্যাগের পূর্বে বিদায়ী তাওয়াফ করা।

* পরিস্থিতি বা কারণ সাপেক্ষে কিছু কাজের ছাড় বা ব্যতিক্রম রয়েছে।

হজের কোনো একটি ওয়াজিব যদি বাদ পড়ে (ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত) তাহলে হজ বাতিল হবে না। তবে এজন্য হারাম এলাকার মধ্যে একটি পশু জবাই করে (দম) সম্পূর্ণ মাংস বিতরণ করা কাফফারা হিসাবে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যাবে। বিনা ওজরে হজের কোনো একটি ওয়াজিব বাদ দেওয়া গুনাহের কাজ। দম দিয়ে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি আল্লাহর তা‘আলার কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থণা করা বাঞ্চণীয়।

হজের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সুন্নাতগুলো হল:

  • ইহরাম বাঁধার আগে গোসল করা।
  • পুরুষের ক্ষেত্রে দুই খণ্ড সাদা ইহরামের কাপড় পরা।
  • উচ্চস্বরে তালবিয়া পাঠ করা।
  • ৮ যিলহজ যোহর থেকে ৯ যিলহজ ফজর পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা।
  • মধ্যম ও ছোট জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর দো‘আ পাঠ করা।

হজের কোনো একটি সুন্নাত ওজরবশত বাদ দিলে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়ে গেলে অসুবিধা নেই। দম দেওয়া জরুরি নয়। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে সুন্নাত বাদ দেওয়া মন্দ কাজ।

ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতের বিষয়ে সচেতনতা
  • আমার হজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাদেরকে বলতে চাই। মক্কা ও মিনায় অবস্থানকালে আমি লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন দলের অনুসারী হজযাত্রীরা হজের ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাত বিষয়গুলো তাদের নিজ নিজ নিয়ম অনুসারে পালন করছেন।
  • উদাহরণস্বরূপ; মিনায় ১১, ১২ ও ১৩ যিলহজ রাতে অবস্থান করা; কিছু লোক বলছেন এটা ওয়াজিব! আবার কিছু লোক বলছেন এটা সুন্নাত!

এর ফলে সাধারণ হজযাত্রীরা যারা হজ সম্পর্কে খুব বেশি পড়াশোনাও করেন নি বা তেমন কোনো জ্ঞান নেই তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যান এবং তারা যে দলের সাথে এসেছেন তাদের দেখাদেখি অন্ধের মতো সবকিছু পালন করেন। সাধারণত সকলেই চান কম কষ্টে সহজ উপায়ে হজ পালন করতে।

  • সকলের উদ্দেশ্যে আমার কথা হলো; এটা আপনার হজ, আপনার ফরয ইবাদাত, আপনি এর জন্য অর্থ ব্যয় করেছেন, হয়তো একবারই আপনি এটা পালন করবেন। ধরুন, হজ পালন করে আসার পর জানতে পারলেন হজে আপনি একটি বিধান ভুল করেছেন, তখন আপনার কেমন লাগবে? এজন্য কি উত্তম নয় সর্তকতা অবলম্বন করা বা নিরাপদে থাকা?
  • আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি করেছেন, তাই যে কোনো ইবাদাত পালনের আগে সে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। তাই হজ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বই থেকে জানুন এবং সে বইকে অন্যান্য ভালো বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই করুন। একইভাবে আমার লেখা গাইডও যাচাই করুন। অন্ধের মতো এটা পড়বেন না ও অনুসরণ করবেন না। আপনার বিচক্ষণতা ও জ্ঞান দিয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বন করুন।
  • হজে যাওয়ার আগে কি কি কর্মকাণ্ড সম্পাদন করতে হবে সে সম্পর্কে মনে মনে নিশ্চিত হোন, এমনকি সেটা যদি আপনার দল থেকে ভিন্ন হয় তাহলেও! বিশ্বাস করুন; আমি আমার দল থেকে ভিন্ন উপায়ে হজের কিছু বিধান পালন করেছি। আমি ভালোভাবে তাদেরকে শুধু বলেছি, আমি আমার জ্ঞান দিয়ে হজের এই বিধানটি পালন করতে চাই এবং তারা তা মেনে নিয়েছে, বলেছে এতে তাদের কোনো সমস্যা নেই। ইনশাআল্লাহ আপনাকে কেউ কোনো বিধান পালন করার জন্য ওখানে বাধ্য/জোর প্রদান করবে না।
  • আপনি যদি আপনার নিজস্ব জ্ঞান ও জানাশোনার ওপর ভিত্তি করে হজের কোনো বিধানে কোনো ভুল করে ফেলেন, তাহলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং সে ভুল ওয়াজিব পর্যায়ের হলে কাফফারা হিসাবে একটি পশু জবাই করে দিন। আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই আপনার মনের খবর জানেন - আপনি যে সঠিক উপায়েই সবকিছু করতে চেয়েছিলেন এবং আপনার জ্ঞান অনুসারে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আপনি যদি একনিষ্ঠভাবে ক্ষমা চান তাহলে ইনশা-আল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করবেন, কারণ তিনি পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল।

মক্কা ও মদীনায় আপনি আপনার নিজস্ব জ্ঞান ও বিবিধ মাসলা সঠিক কি না তা যাচাই করে নিতে পারেন। আপনি বেশ কিছু ইসলামিক জ্ঞান আদান-প্রদান বুথ পাবেন অথবা মক্কা লাইব্রেরিতে আপনি কিছু বাংলা ও হিন্দি ভাষী বিদ্বান শাইখ/আলেম ব্যক্তি পাবেন যাদেরকে প্রশ্ন করে আপনি আপনার মনের সন্দেহ দুর করতে পারবেন। তাঁরা আপনার সাথে কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসারেই কথা বলবেন এবং বিভিন্ন মাযহাবের মতামত উল্লেখ করে এর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে যথার্থ ও উত্তম তাও বলে দেবেন।

হিজরী ক্যালেন্ডারের দিবা-রাত্রি ধারণা

অনেকেই হজের দিনগুলোর (৮, ৯, ১০.. যিলহজ) কথা বলতে গিয়ে ইংরেজী দিন-রাত্রির হিসাবের সাথে হিজরী দিন-রাত্রির হিসাব মিলিয়ে গুলিয়ে ফেলেন। তাই এ মূল ধারণাটি আগেভাগেই পরিস্কার করে নেওয়া ভালো। ইংরেজী ক্যালেন্ডার হিসাবে রাত ১২টা পর থেকে দিন শুরু ধরা হয়। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা হিসাব হবে - প্রথমে ৬ ঘন্টা রাত্রি, পরে ১২ ঘন্টা দিন ও পরে ৬ ঘন্টা রাত্রি। আর হিজরী হিসাবে সূর্যাস্তের পর থেকে দিন শুরু ধরা হয়। অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা হিসাব হবে - প্রথমে ১২ ঘন্টা রাত্রি ও পরে ১২ ঘন্টা দিন।

  • এ দিনের মূল কাজ হলো সূর্যোদয়ের পর মক্কা থেকে হজের ইহরাম বেঁধে মিনায় গিয়ে তাবুতে দিবা-রাত্রি যাপন করা ও পরবর্তী পাঁচ ওয়াক্ত সালাত মিনায় আদায় করা।
  • ৮ যিলহজ ইহরাম বাঁধার আগে আপনি আপনার ব্যাগ গুছিয়ে নিন। ছোট একটি ব্যাগ নেবেন যাতে সহজেই ব্যাগটি বহন করতে পারেন। কারণ এ ব্যাগ নিয়ে কয়েক মাইল হাঁটতেও হতে পারে। আপনি কিছু শুকনো খাবার, একটি বিছানার চাদর, বায়ু বালিশ, প্লেট-গ্লাস, এক সেট ইহরামের কাপড়, সাবান, তোয়ালে, টয়লেট পেপার, কাপড় ঝোলানোর হ্যাঙার, পানির বোতল, দুই সেট সাধারণ পোশাক, কুরআন শরীফ ও কিছু বই সঙ্গে নিতে পারেন। মূল্যবান জিনিসপত্র ও অতিরিক্ত টাকা-পয়সা সাবধানে ঘরে রেখে তালা দিয়ে যান অথবা সৌদি মু‘আল্লিম অফিসে জমা দিয়ে রসিদ নিয়ে রাখুন।
  • রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পালনীয় নিয়ম অনুযায়ী সুন্নাহ হলো ৮ যিলহজ মক্কায় ফজরের সালাত আদায় করার পর সকালে মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। কিন্তু বর্তমানে যদি ২৫-৩০ লক্ষ হজযাত্রী সকাল বেলায় ৮-১০ হাজার বাস গাড়ি নিয়ে ৭-৮ কিমি রাস্তা যাওয়ার চেষ্টা করেন তবে কেমন অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
  • তাই এখন সৌদি মু‘আল্লিমগণ ৮ যিলহজ মধ্যরাত হতেই হজযাত্রীদের মিনায় নিয়ে যাওয়া শুরু করেন। এতে হজের কোনো ক্ষতি হবে না। তাই আপনি জেনে নিন আপনাকে কখন মিনায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন আপনার এজেন্সি ও সৌদি মু‘আল্লিম। সে অনুযায়ী আপনি ইহরাম বাঁধার প্রস্তুতি নিন। সাধারণত যাত্রা শুরু করার ২-৩ ঘন্টা আগে ইহরাম বাঁধার প্রস্তুতি শুরু করা উত্তম।
  • ৮ যিলহজ ইহরামের কাপড় পরিধানের পূর্বে সাধারণ পরিচ্ছন্নতার কাজ (যদি কুরবানী করার ইচ্ছা না থাকে তবে) নখ কাটা, লজ্জাস্থানের চুল পরিস্কার, গোঁফ ছোট করা সেরে নিন। তবে দাঁড়ি ও চুল কাটবেন না। পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো করা মুস্তাহাব।[1]
  • এরপর গোসল করা উত্তম, যদি গোসল করা সম্ভব না হয় তাহলে অবশ্যই অযু করতে হবে। ঋতুবর্তী মহিলারা গোসল করে সাধারণ কাপড় পরে নিবেন এবং হজ এর সকল বিধি-বিধান পালন করবেন, তবে ঋতু শেষ না হওয়া পর্যন্ত মসজিদে হারামে প্রবেশ করবেন না এবং সালাত আদায় করবেন না। ঋতু শেষ হলে তাওয়াফ করে নিবেন ও সালাত আদায় করবেন।[2]
  • পুরুষরা ইহরামের কাপড় পরার আগে চুলে তেল বা ‘তালবিদ’ (কোনো কিছু দিয়ে চুল জমাট করে রাখা; যাতে তা না উড়ে, সুতরাং তালবিদ) দিতে পারেন এবং শরীরে, মাথায় ও দাঁড়িতে সুগন্ধী ব্যবহার করতে পারেন; তবে ইহরাম বাঁধার পর পারবেন না। সুগন্ধী যেন আবার ইহরামের কাপড়ে না লাগে সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। লেগে গেলে তা ধুয়ে ফেলবেন। মহিলারা কখনই কোনো অবস্থাতেই সুগন্ধী ব্যবহার করবেন না। মহিলাদের সুগন্ধী ব্যবহার করা হারাম।[3]
  • পুরুষরা ইহরামের কাপড় সুবিধা মতো উপায়ে পরতে পারেন; তবে এমনভাবে পরবেন যাতে নাভির উপর থেকে হাটুর নিচ পর্যন্ত আবৃত হয়ে যায় এবং ইহরামের কাপড় দিয়ে কাঁধ ও শরীর আবৃত থাকে। মহিলারা মুখমণ্ডল এবং হাতের কব্জি খোলা রাখবেন, নেকাব দ্বারা মুখমণ্ডল সবসময় ঢাকা রাখা যাবে না। তবে না-মাহরাম পুরুষদের সামনে বা মাঝে গেলে তখন মুখমণ্ডল আবৃত করবেন।
  • উত্তম হলো কোনো ফরয সালাতের পূর্বে ইহরামের কাপড় পরা ও সালাত আদায় করা এবং তারপর ইহরাম করা। আর কোনো ফরয সালাতের সময় না হলে ইহরামের কাপড় পড়ে তাহিয়্যাতুল ওযুর ২ রাকাত সালাত পড়া। সালাতের পর ইহরাম করা মুস্তাহাব। যদি কোনো ফরয সালাতের পর ইহরাম করা হয়, তাহলে স্বতন্ত্র সালাতের প্রয়োজন নেই। অন্য সময় ইহরাম করলে ২ রাকাত সালাত তাহিয়াতুল অযুর নিয়তে আদায় করে নিবেন।
  • মক্কায় আপনার হোটেল অথবা বাসা থেকে ইহরামের কাপড় পরবেন এবং এখান থেকেই আপনি ইহরাম বাঁধবেন। এমনটি করা ওয়াজিব। ইহরাম করার জন্য আপনাকে এখন কোনো মীকাতে যেতে হবে না। সৌদি স্থানীয় লোকেরাও তাদের নিজ নিজ আবাসস্থল থেকে হজের জন্য ইহরাম বাঁধবেন। শুধুমাত্র যারা মীকাতে বাইরে থেকে আসবেন তারা মীকাত থেকে হজের নিয়ত ও ইহরাম বেঁধে প্রবেশ করবেন।[4]
  • এখন যেহেতু আপনি ইহরামের কাপড় পরে ফেলেছেন এবং সালাতও আদায় করেছেন সেহেতু এখন আপনি হজের নিয়ত করতে পারেন অর্থাৎ ইহরাম করতে পারেন। এমনকি ঋতুবর্তী মহিলারাও হজের নিয়ত করবেন।
  • আপনি বলুন: “লাববাইকা হাজ্জাহ’’

‘‘আমি হজ করার জন্য হাযির’’।

  • এবার স্বশব্দে তাওহীদ সম্বলিত তালবিয়াহ পাঠ শুরু করুন এবং জামরাতুল ‘আকা‘বায় কংকর নিক্ষেপের আগ পর্যন্ত এ তালবিয়াহ পাঠ চলতে থাকবে।

لَبَّيْكَ اَللهم لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيْكَ لَكَ

‘‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাববাইকা লা শারিকা লাকা লাববায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’’।

‘‘আমি হাযির, হে আল্লাহ! আমি হাযির। আমি হাযির, তোমার কোনো শরীক নেই, আমি হাযির”।

নিশ্চয় সকল প্রশংসা ও নি‘আমত তোমারই এবং রাজত্বও তোমারই, তোমার কোনো শরীক নেই”।[5]

  • হজ সম্পন্ন করতে না পারার ভয় থাকলে (যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা, বাধা অথবা অসুস্থতার কারণে না পারেন) তবে এ দো‘আ পাঠ করবেন:

فَإِنْ حَبَسَنِيْ حَابِسٌ فَمَحِلِّيْ حَيْثُ حَبَسْتَنِيْ

‘‘ফাইন হাবাসানী হা-বিসুন, ফা মাহিল্লী হায়ছু হাবাসতানি’’।

‘‘যদি কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হই, তাহলে যেখানে তুমি আমাকে

বাধা দিবে, সেখানেই আমার হালাল হওয়ার স্থান হবে”।[6]

  • তালবিয়াহ একটু উচু আওয়াজে পাঠ করা উত্তম। তবে তালবিয়াহ খুব উচ্চস্বরে অথবা সমস্বরে পাঠ করবেন না যা অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনভাবে তালবিয়াহ পাঠ করাও সুন্নাত নয়, বরং বিদ‘আত। আর মহিলারা তালবিয়াহ পাঠ করবেন কোমল স্বরে অথবা মনে মনে। এখন আপনার হজের নিয়ত করা ও ইহরাম করা হয়ে গেছে; এ ইহরাম করার কাজটি ছিল ফরয।
  • মনে রাখবেন এখন আপনি ইহরাম অবস্থায় আছেন। এখন আপনার ওপর ইহরামের সকল বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য। ইহরাম অবস্থায় কি কি কাজ অনুমোদিত আর কি কি নিষিদ্ধ তা পৃষ্ঠা----- থেকে দেখে মনে রাখুন।
  • ইহরাম করার পরে ইহরামকে কেন্দ্র করে কোনো নির্দিষ্ট সালাত নেই। ইহরাম করার পরে ৮ যিলহজ কা‘বা শরীফ তাওয়াফ বা সাফা-মারওয়ায় সা‘ঈ করার ব্যাপারেও কোনো নির্দেশনা হাদীসে কোথাও পাওয়া যায় না। তাই এমন অতিরিক্ত কিছু ভিত্তিহীন আমল নেকীর আশায় করতে যাওয়া ঠিক হবে না।
  • আপনার হজ এজেন্সি ইতিমধ্যেই মু‘আল্লিম অফিস থেকে মিনার তাবু কার্ড সংগ্রহ করে ফেলবেন ও আপনাদেরকে বুঝিয়ে দিবেন এবং আপনাদের সৌদি মু‘আল্লিম অফিস সবার মিনায় যাওয়ার জন্য পরিবহণের ব্যবস্থাও করবেন।
  • হজ সফর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি তথ্য আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই যাতে আপনি এ সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বুঝতে পারেন। হজের পূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন হজ এজেন্সি বা দল হজের বিভিন্ন সেবা বিষয়ে চুক্তি করেন সৌদি সরকার কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত সৌদি আরবের বিভিন্ন সৌদি মু‘আল্লিম এর সাথে। আপনি হজে যাবেন একটি দল বা এজেন্সির সাথে, যার একজন গাইড আপনাদের সদা বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করবেন পুরো হজ সফর ধরে। কিন্তু এ হজ গাইড এর ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে অবস্থানকালে এ হজ গাইড তার নিজ দায়িত্বে পাসপোর্ট, ভিসা, বিমান টিকিট এর কাজ করেন। কিন্তু যখনই আপনি সৌদি আরবে যাবেন তখন এ হজ গাইড আবার সকল বিষয়ের ব্যবস্থাপনার জন্য নির্ভরশীল সৌদি মু‘আল্লিম এর উপর। আপনাদের বাস সার্ভিস, খাওয়া-দাওয়া, হোটেল, তাবু ইত্যাদি সৌদি মু‘আল্লিম এর ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল। এক একজন সৌদি মু‘আল্লিম আবার ৫/১০ টি দল ম্যানেজ করেন। তাই অনেক সময় আপনার গাইড তার দেওয়া বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেন না সৌদি মুআল্লিমের কারণে। যেমন উদাহরন: সৌদি মু‘আল্লিম আপনাদের হজ গাইডকে বলবেন, আপনার সকল হাজীদের প্রস্তুত হতে বলেন, মিনায় যাওয়ার বাস আসবে রাত ২টায়। এরপর দেখবেন ৫টা বেজে গেছে কিন্তু বাসের খবর নেই! আপনি দোষ দিবেন গাইডকে, কিন্তু গাইডের করার কিছু নেই। গাইড খুব জোর মু‘আল্লিমকে একটু তাগাদা দিতে পারেন, অনুরোধ করতে পারেন।
  • আপনি যখন হজ সফরের জন্য আপনার নিজ বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন তখন আপনাকে কিন্তু ৩টি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ব্যাগে নিতে বলা হয়েছিল! ধৈর্য, ত্যাগ ও ক্ষমা! আপনার হজকে সহজ করার জন্য এ ৩টি বিষয় প্রয়োগ করা খুব বেশি প্রয়োজন পড়বে। হজের সফরে বিভিন্ন চরিত্র ও মেজাজের লোকের সাথে একসাথে থাকতে হয় তাই অনেক সময় অনেক কথা ও কাজে মতপার্থক্য হয়। তাই রাগারাগি বা কথা কাটাকাটি না করে ধৈর্য্যের সাথে বনিবনা করে পার করতে হবে।
  • ৮ যিলহজ বাসযোগে আপনার দলসহ মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন এবং আশা করা যায় ২-৩ ঘন্টার মধ্যেই তাবুতে পৌঁছে যাবেন। যানজটের কারণে মিনায় পৌঁছতে আপনাকে কিছুটা পথ হাঁটতেও হতে পারে। অনেকে পায়ে হেঁটে প্যডেস্ট্রিয়ান টানেলের (সুড়ঙ্গ পথ) রাস্তা দিয়ে মিনায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। যদি তাবু জামারাতের কাছাকাছি হয় ও সাথে পূর্বে হজ করা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক থাকে তবে তার সাথে পায়ে হেঁটে যেতে পারেন। তবে পুরোটা পথ পায়ে হেঁটে না যাওয়াই উত্তম, কারণ এতে আপনি পরিশ্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন। রাস্তায় চলতে চলতে তালবিয়াহ পাঠ অব্যাহত রাখুন। সবসময় দলবদ্ধ হয়ে থাকার চেষ্টা করুন। এ সময়ই কিন্তু অনেক লোক দলছাড়া হয়ে হারিয়ে যান। তাই সাবধান থাকুন।
  • তাবু কার্ডের মাধ্যমে আপনার তাবুটি খুঁজে বের করুন। তাবুর ভিতরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম ও খাবার গ্রহণ করুন। তাবুর ভিতরে কুরআন তিলাওয়াত, তসবিহ তাহলিল, ইসতিগফার, দো‘আ, যিকিরের মাধ্যমে সময়কে কাজে লাগান। তালবিয়াহ পাঠ অব্যাহত রাখুন। মিনায় অবস্থান করা সাদা-সিধে জীবন যাপনের প্রতীক। মিনায় আজকে রাত্রিযাপন করা মুস্তাহাব বা সুন্নাত।
  • এখন পরবর্তী পাঁচ ওয়াক্ত সালাত (যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর) মিনাতেই আদায় করবেন। হজের সময় মিনা, আরাফা ও মুজদালিফায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার ভিতরের ও বাইরের লোকদের নিয়ে কসর করে সকল সালাত পড়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি মুকিম ও মুসাফিরের মধ্যে কোনো পার্থক্য করেন নি অর্থাৎ মক্কার লোকদের চার রাকাত করে পড়তে বলেন নি। এমন কসর করে সালাত পড়া সুন্নাত। সকল চার রাকাত বিশিষ্ট ফরয সালাতসমূহকে দুই রাকাআতে সংক্ষিপ্ত করে পড়বেন মানে কসর করে পড়বেন (মাগরিব ও ফজর ব্যতীত)। কোনো সুন্নাত সালাত আদায়ের প্রয়োজনীয়তা নেই কসর অবস্থায়। তবে এ সালাত গুলো কাজা করে অথবা দুই ওয়াক্ত সালাতকে একত্রে জমা করে পড়া যাবে না। শুধুমাত্র ফজরের দুই রাকাত সুন্নাত এবং এশার পরে এক/তিন.. রাকাত বিতর সালাত আদায় করবেন।
  • তাবুর ভিতরে গ্রুপ জামাআত করা উত্তম অথবা একা একাও সালাত পড়তে পারেন। খাইফ মসজিদের কাছাকাছি তাবুর অবস্থান হলে মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করা সবচেয়ে উত্তম। মিনার খাইফ মসজিদ ঐতিহাসিক মসজিদ।

৯ যিলহজ সূর্যোদয় পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করা সুন্নাত। তারপর আরাফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে। মিনায় অবস্থান করে সালাত আদায় করা, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলিল, দো‘আ ও যিকির করা ছাড়া আর কোনো বিশেষ কাজ নেই। তাই তাবুর মধ্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অথবা গল্পগুজব ও ঘুরাঘুরি না করে মিনার এ মূল্যবান সময়গুলোকে কাজে লাগানো উত্তম।

[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৪৬৪

[2] মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ

[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৩৫

[4] মুসনাদে আহমদ-৬/৪২১; সহীহ বুখারী ও মুসলিম

[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৪৬০, ৫৯১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৮৪

[6] মিশকাত, হাদীস নং ২৭১১
  • মিনার সকল তাবুতে এয়ার কন্ডিশন (এসি) সুবিধা রয়েছে। একটি তাবুতে প্রায় ৩০-৫০ জন হজযাত্রী থাকতে পারে। প্রত্যেকের জন্য এক কুনুই মাপের ছোট ম্যাট্রেসের বিছানা ও বালিশ দেওয়া থাকে।
  • টয়লেট ও অযুর ব্যবস্থা খুবই কম সংখ্যক। অনেক সময় টয়লেটে যাওয়ার জন্য ২০-৪০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তাই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আর এখানে গোসল করার কোনো ব্যবস্থা নেই।
  • মোবাইল ফোন চার্জ করার জন্য ২/৩ পিনের মাল্টিপ্লাগ সঙ্গে নিন, তাবুর খুটিতে মোবাইল ফোন চার্জ করার ব্যবস্থা আছে। সবসময় সাথে ২০/৪০ রিয়ালের মোবাইল রিচার্জ কার্ড সঙ্গে রাখুন। বিপদে কাজে লাগতে পারে।
  • হজের আইডি কার্ড ও তাবু কার্ড সবসময় আপনার সাথে রাখবেন। তাবুর বাইরের রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করুন এবং আশেপাশের জায়গার সঙ্গে পরিচিত হোন। তবে একা একা তাবু থেকে খুব বেশি দূরে যাবেন না।
  • আপনার তাবু নাম্বার, রোডের নাম ও নং এবং জোন নং জেনে রাখুন। কারণ মিনায় হারিয়ে যাওয়া খুব সাধারণ ব্যাপার। মিনার একটি ম্যাপ সংগ্রহ করে আপনার তাবুর লোকেশন চিনে রাখুন। বর্তমানে মিনায় জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মুযদালিফার একাংশ মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
  • আপনার মু‘আল্লিম প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মিনায় দুই/তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন। এছাড়া তাবুর বাইরে মেইন রোডের পাশে প্রচুর অস্থায়ী খাবারের দোকান পাওয়া যাবে। সেখান থেকে খাবার কিনে খেতে পারেন।
  • তাবুর বাইরে কন্টেইনার জারে খাবার পানি পাওয়া যাবে। কিছু বোতলে করে খাবার পানি ধরে রাখুন। পানির সংকট দেখা দেয় অনেক সময়।
  • হজের সময় আপনি মিনায় ও আরাফায় আকাশে টহল হেলিকপ্টার দেখতে পাবেন। রাস্তায় অনেক গাড়ি থেকে পানি, জুস, লাবান ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হয় হাজীদের আপ্যায়ন হিসাবে।
  • হজ পালনের স্থানসমূহে‎র এলাকা অর্থাৎ মিনা, আরাফা ও মুযদালিফা উচুঁ সাইনবোর্ড দ্বারা চিহ্নিত করা থাকে। যেমন, মিনায়: Mina starts here, Mina ends here. আরাফায়: Arafah starts here, Arafah ends here.
  • এখানেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ঈসমাইল আলাইহিস সালামকে যবেহ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন ও শয়তান জামরাত এলাকায় তাঁকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছিল।

সূরা কাওছার মিনায় অবতীর্ণ হয়েছে।

  • তাবুতে সালাত আদায় করার পর অনেকে দলবদ্ধ হয়ে মিলাদ পড়েন, দলবদ্ধ উচ্চস্বরে যিকির করেন এবং অন্যদের যিকর-ইবাদতে বিরক্ত করেন।
  • তাবুতে দলবদ্ধ হয়ে বসে অনেকে আলোচনা করেন; যাদের অনেকেরই ইসলাম সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই এবং তারা কোনো এক পীর/সূফির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন।
  • তাবুতে অনেকে সালাতের পরে অনির্ভরযোগ্য বই পড়েন যাতে অনেক জাল ও যয়ীফ হাদীস থাকে।
  • অনেকে আবার তাবুর মধ্যে ২/৩টি গ্রুপ করেন। এক গ্রুপ হজের বিষয়ে একভাবে ফাতাওয়া দেন; আরেক গ্রুপ আবার অন্যভাবে ফাতাওয়া প্রদান করেন। এতে সাধারণ মানুষ পড়ে যান দ্বিধা-দ্বন্দ্বে।
  • অনেকে আবার সময় কাটানোর জন্য অনর্থক গল্পগুজবে মেতে উঠেন, অনেকে ঘুমিয়ে সময় কাটান।
  • অনেক পুরুষ আবার মহিলা তাবুতে গিয়ে তাদের পরিচিত মহিলাদের সাথে কথা বলেন, যা অন্য মহিলাদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • অনেকে আবার তাবুর পানি জারের খাবার পানি দিয়ে অযু করে খাবার পানির সঙ্কট তৈরি করেন। অনেকে যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলেন।

সকল ডাস্টবিন আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে যায়, আর পরিচ্ছন্নতা কর্মীও পর্যাপ্ত নেই। সে কারণে এ স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ে।

  • এ দিনের মূল কাজ হলো সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফায় গমন করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা ও দো‘আ, যিকির, ইসতেগফার করা। আরাফায় যোহর-আছর সালাত একসাথে পরপর কসর করে আদায় করা এবং সূর্যাস্তের পর আরাফা ত্যাগ করে মুযদালিফায় গমন করা।
  • আরাফা ময়দান বিচার দিবসের হাশরের ময়দানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; যেখানে সমগ্র মানবজাতি একত্রিত হবে সুবিস্তৃত এক ময়দানে। এ দিবস সবচেয়ে বেশি আশির্বাদপ্রাপ্ত দিবস এবং এ দিবস আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ক্ষমাশীলতা, রহমত ও দয়া উপস্থাপন করেন। আরাফার ময়দান হারাম এলাকার সীমানার বাইরে অবস্থিত। আরাফার চর্তুদিকে সীমানা-নির্ধারণমূলক উঁচু ফলক রয়েছে। ১০.৪ কি.মি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত আরাফা ময়দান। মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ২২ কি.মি দূরে অবস্থিত আরাফার ময়দান। এ আরাফার ময়দানের প্রান্তে দাঁড়িয়েই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন, ‘‘হজের সব হলো আরাফায়”।[1]
  • আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘আরাফা ব্যাতীত আর কোনো দিবস নেই যে দিন আল্লাহ তাঁর অধিক বান্দাহকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করেন এবং তিনি খুব সন্নিকটে চলে আসেন এবং ফিরিশতাদের সামনে তার বান্দাহদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘তারা আমার কাছে কী চায়?”[2]
  • শয়তান এ দিনে সকল মানুষের আল্লাহর প্রতি যিকর, দো‘আ ও ইসতেগফার দেখে সবচেয়ে বেশি হীন ও লাঞ্ছিত হয়ে যায়। শয়তান ক্রোধান্বিত ও বেদনা বিধুর হয়ে যায়।
  • ৯ যিলহজ মিনায় ফজরের সালাত আদায়ের পর আরাফার উদ্দেশে দলবদ্ধ হয়ে রওয়ানা হওয়া ভালো। এসময় একাকি অথবা ছোট দল হয়ে পাঁয়ে হেঁটে আরাফায় যাওয়ার চিন্তা না করাই উত্তম। কারণ আরাফা ময়দান অনেক বড় জায়গা ও এখানে মিনার মতো তাবু নম্বর, জোন, রোড নম্বর লেখা ফলক তুলনামূলক কম আছে। অনেক সময় বাস ড্রাইভাররাই তাবু লোকেশন ঠিক মতো বুঝতে পারেন না ও অনেক ঘুরাঘুরি করে তাবু খুঁজে বের করেন। তাই বাসে যাওয়া উত্তম। বাসে যেতে যেতে তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকুন। সম্ভব হলে আরাফায় প্রবেশের পূর্বে বা পরে গোসল করে নেওয়া উত্তম।
  • বর্তমানে হজযাত্রী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে ৯ যিলহজ মধ্যরাত থেকে আরাফায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটা নিশ্চয় সুন্নতের খেলাফ; তবে যেহেতু সমস্যার কারণে এ কাজ করা হচ্ছে তাই এ সুন্নাতটি ছুটে গেলে ক্ষতি হবে না ইন-শাআল্লাহ।
  • আরাফার সীমানার ভিতর প্রবেশ করে মুস্তাহাব হলো নামিরা মসজিদে ইমামের খুতবা শোনা এবং যোহরের আযানের পর যোহরের আউয়াল ওয়াক্তেই যোহর-আসর সালাত ইমামের পিছনে জামাআতে আদায় করা।
  • তবে যেহেতু সকল লোকের একত্রে মসজিদে নামিরায় একত্রিত হওয়া সম্ভব নয় তাই আরাফার ময়দানের যে কোনো স্থানে তাবুতে অবস্থান গ্রহণ করা ও যোহরের ওয়াক্তেই যোহর-আসর সালাত তাবুতে জামাআত করে আদায় করা অথবা কেউ চাইলে একাকীও আদায় করতে পারেন।
  • গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো; নিশ্চিতভাবে আরাফার সীমানার ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে অন্যথায় হজ হবে না। আরাফার ময়দানের চর্তুদিকে সীমানা-নির্ধারণমূলক উঁচু ফলক বা সাইনবোর্ড রয়েছে যা আপনাকে অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্য করবে। নামিরা মসজিদের সামনের দিকের কিছু অংশ আরাফার সীমানার বাইরে, তাই সেখানে অবস্থান গ্রহণ করা যাবে না। আবার আরাফা ও মুযদালিফার মধ্যবর্তী ‘উরানাহ’ উপত্যকা এলাকা আরাফার সীমানার বাইরে, তাই সেখানেও অবস্থান গ্রহণ করা যাবে না।
  • এখানে সালাত আদায়ের নিয়ম হলো; যোহরের সালাতের আউয়াল ওয়াক্তেই এক আযান ও দুই ইকামাতে যথাক্রমে যোহর (২ রাকাত ফরয) ও আসর (২ রাকাত ফরয) কসর করে পরপর আদায় করা। এ দুই সালাতের আগে, মধ্যে ও পরে কোনো সুন্নাত পড়ার নিয়ম নেই।[3]
  • রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই মক্কার মুকিম ও মুসাফিরদের নিয়ে কসর করে পরপর সালাত আদায় করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে মুকিম ও মুসাফিরদের জন্য আলাদা কোনো নিয়মের কথা উল্লেখ করেন নি। নামিরা মসজিদের ইমামও এইভাবেই সালাত পড়ান। তাবুতে সকল লোকদের এ একইভাবে একাকী বা জামাআতে সালাত আদায় করা উচিত। যদি দিনটি শুক্রবার হয় তবে জুমআর সালাত পড়ার দরকার নেই তবে কসর সালাত আদায় করতে হবে।
  • আরাফার দিবসের রোজা, পূর্বের এক বছরের ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। তবে এ সাওম হাজীদের জন্য নয়, বরং যারা হজ করতে আসেন নি তাদের জন্য। আপনার পরিবারবর্গকে বাড়িতে এ দিনে সাওম রাখতে বলুন। হাজীদের জন্য আরাফার দিনে সাওম রাখা মাকরূহ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার দিনে সাওম রাখেননি। তিনি সবার সন্মুখে দুধ পান করেছেন।[4]
  • আরাফার ময়দানে আপনি যে কোনো স্থানে দাঁড়াতে পারেন বা বসতে পারেন অথবা শুয়েও থাকতে পারেন। আরাফার ময়দানে এ অবস্থান করাকে বলা হয় উকুফে আরাফাহ। আরাফার দিনে জাবালে রহমত পাহাড়ে উঠার বিষয়ে বিশেষ কোনো ফযিলত বা সাওয়াবের বর্ণনা হাদীসে কোথাও পাওয়া যায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবশ্য জাবালে রহমত তথা আরাফার পাহাড়ের নীচে উকুফ বা অবস্থান করেছেন কিন্তু তিনি বলেছেন, ‘‘আমি এখানে উকুফ করলাম, কিন্তু আরাফার পুরো এলাকা উকুফের স্থান”।[5]
  • সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে গেলে (পূর্বে উল্লেখিত নিয়মে যোহর-আছর সালাতের পর) অত্যন্ত বিনয়ী ও তাকওয়ার সাথে আল্লাহর কাছে দো‘আ শুরু করুন। এখন আল্লাহর কাছে দৃঢ়-প্রত্যয়ী হয়ে আপনার আবেদন জানানোর সময়। এ দো‘আর গুরুত্ব অপরিসীম, এর জন্যই আপনার আরাফায় আসা। কিবলার দিকে মুখ করে দুই হাত উচুঁ করে (বগল উন্মুক্ত করে) চোখের পানি বিসর্জন দিয়ে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন, ক্ষমা চান, দয়া কামনা করুন, আপনার মনের আকাঙ্ক্ষা আল্লাহ তা‘আলার কাছে ব্যক্ত করুন। আল্লাহর গুণবাচক নামসমূহ‎, দুরূদ ইবরাহীম, তালবিয়াহ, তাকবীর, যিকর, ইসতিগফার ও দো‘আ করতে থাকুন বেশি বেশি করে। যে কোনো দো‘আ পাঠ করার সময় ৩ বার করে পাঠ করা উত্তম। প্রথমে নিজের জন্য ও পরে পরিবার-আত্মীয়স্বজনদের জন্য অতঃপর প্রতিবেশী-পরিচিতজনদের জন্য এবং শেষে পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য দো‘আ করুন। দো‘আ করার সময় কোনো সন্দেহ না করা, ইতস্তত না করা ও সীমালঙ্ঘন না করা। দো‘আ শেষে ‘আমিন’ বলুন।[6]
  • সব দো‘আ-যিকর যে আরবীতে করতে হবে তার কোনো নিয়ম নেই, যে ভাষা আপনি ভালো বোঝেন ও আপনার মনের ভাব প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দো‘আ করুন। তবে মনে রাখবেন; আওয়াজ করে, জোরে শব্দ করে বা দলবদ্ধ হয়ে কোনো দো‘আ পাঠ করা সুন্নাত নিয়ম এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এতে অন্যদের মনযোগ নষ্ট হয়। তবে কেউ দো‘আ পাঠ করলে তার পিছনে ‘আমিন’ বলা জায়েয আছে। দো‘আ করবেন আবেগ ও মিনতির সাথে মনে মনে। দো‘আর সময় তাওহীদকে জাগ্রত করুন। আরাফায় দো‘আর সময় ওযু অবস্থায় থাকা উত্তম তবে কেউ অযু বিহীন অবস্থায় থাকলেও সমস্যা নেই। এ বইয়ের শেষে কুরআন ও হাদীস থেকে বেশ কিছু দো‘আ সংযোজন করা হয়েছে যা আরাফার ময়দানে পড়তে পারেন। যে সব মহিলারা ঋতু অবস্থায় থাকবেন তারাও অন্যান্য হাজীদের মতো দো‘আ-যিকির করবেন - তারা শুধু সালাত আদায় করা, কুরআন স্পর্শ করা ও কা‘বা তাওয়াফ করা থেকে বিরত থাকবেন।[7]
  • আরাফার দিনে এ দো‘আ পড়া উত্তম :

لا إله إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ، لَا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَئْيٍ قَدِيْرِ

‘‘লা ইলাহা ইল্লালাহু ওআহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু্, ওয়া হুয়া আ’লা কুল্লি শায়য়িন ক্বদির।’’

‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। সকল সার্বভৌমত্ব ও প্রশংসা একমাত্র তাঁরই। তিনি সর্ব বিষয়ের ওপর সর্বশক্তিমান”।[8]

  • ৯ যিলহজ আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ফরয। দুপুরের সূর্য পশ্চিমে ঢলে যাওয়ার পর থেকে আরাফাতে অবস্থানের প্রকৃত সময় শুরু হয়। আরাফার ময়দানে মধ্যপ্রহর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। আর তার সময় শেষ হয় আরাফার দিবাগত রাত্রির শেষে দশ তারিখের সূর্য উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। কারো পক্ষে হতে অন্য কাউকে আরাফায় পাঠানো যাবে না, প্রত্যেকে স্বশরীরে আরাফায় উপস্থিত হতে হবে।
  • অনিবার্য কারণবশত যদি আরাফায় দিনের বেলায় পৌছা না যায় এবং ঐ দিন রাতের বেলায় পৌছায় তবে রাতের কিছু অংশ আরাফায় অবস্থান করে মুযদালিফায় গিয়ে রাতের বাকি অংশ যাপন করলে তার হজ হয়ে যাবে। আবার কেউ যদি তার দেশ থেকে সরাসরি ৯ যিলহজ আরাফার ময়দানে চলে যায় তাহলেও তার হজ হয়ে যাবে।[9]
  • আরাফার ময়দানে সূর্যাস্তের পর লাল-হলুদ আভা বিলীন হওয়া পর্যন্ত ধীরস্থির অবস্থান করতে হবে এবং মাগরিবের আযানের পর সালাত আদায় না করেই মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে। মাগরিব সালাত আদায় করবেন মুযদালিফায় গিয়ে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটাই করেছেন। অনেকে সূর্যাস্ত হওয়ার আগেই রাস্তার জানজট কাটানোর জন্য আগেই বাসে উঠে রওনা হয়ে যান আর আরাফার ময়দান পার হতে হতে সূর্যাস্ত করেন। বুদ্ধিটি নিঃসন্দেহে ভাল! কিন্ত ইবাদতের বিষয়ে শর্টকার্ট, চটজলদি বা চালাকি বেশি খাটানো উচিৎ হবে না।
[1] মুসনাদে আহমদ (৪/৩৩৫)

[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৩৪৮

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮; সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৬২

[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১২৩

[5] আবু দাউদ, নাসাঈ

[6] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৬০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২১৩৭

[7] সূরা আল-আ‘রাফ: ২০৫

[8] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৮৫; আহমদ, হাদীস নং ৬৯৬১

[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১২১১
  • আরাফার তাবুগুলোতে এসি সুবিধা নেই। তবে মিনার তাবুগুলো থেকে আরফার তাবু আকারে বড় হয়। এখানে ম্যাট্রেস সাধারণত থাকে না, তবে মেঝেতে কার্পেট থাকে। আরাফার কিছু জায়গায় তাবুর চারদিকে অনেক নিম গাছ রয়েছে, এ গাছগুলো ভালো শীতল ছায়া দেয়।
  • মিনার মতো এখানেও টয়লেট ও অযুর ব্যবস্থা খুবই সামান্য। এখানে মোবাইল ফোনে চার্জ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
  • আপনার আইডি কার্ড ও তাবু কার্ড সবসময় সঙ্গে রাখবেন। আরাফার দিনে তাবুর ভিতরে বাইরে অযথা ঘোরাফেরা না করে যিকির ও দো‘আ করে সময় কাজে লাগান। একা একা তাবু থেকে দূরে কোথাও যাবেন না।
  • আপনার মু‘আল্লিম প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরাফায় আপনাকে একবেলা বা দুইবেলা খাবার খেতে দিতে পারেন। এছাড়া তাবুর বাইরে রোডের পাশে প্রচুর অস্থায়ী খাবারের দোকান পাওয়া যাবে। কোথাও দেখবেন ট্রাক থেকে বিনামূল্যে খাবার/পানি বিতরণ করা হচ্ছে। আপনি ইচ্ছে করলে এ খাবার নিতে পারেন। তবে ধাক্কাধাক্কি করে এসব খাবার আনতে না যাওয়াই উত্তম কারণ এতে আপনি আহত হতে পারেন; বা খালি পকেট হয়ে যেতে পারেন।

মিনা থেকে আরাফা ও মুযদালিফায় যাওয়ার জন্য শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি হয়। তবে সমস্যা হলো অনেকে টিকিট না নিয়েই ট্রেনে উঠে পড়েন। রেলওয়ের প্লাটফরম সবসময়ই হজযাত্রীদের ভিড়ে জনাকীর্ণ থাকে। ভিড় সামলানোর জন্য ব্যবস্থাপনা ও টিকিট চেক করা খুবই কঠিন কাজ এখানে। অনেকে আহত হন এখানে।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »