الاستدلال على أسماء الله وصفاته من القرأن الكريم
কুরআনুল কারীম থেকে আল্লাহ তাআলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করার দলীলের পদ্ধতি:
১- الجمع بين النفي والإثبات في وصفه تعالى
১- একই সাথে নেতিবাচক ও ইতিবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সিফাত সাব্যস্ত করা অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তা হতে সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি নাকোচ করা এবং তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য পূর্ণতার গুণাবলী সাব্যস্ত করণ:
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
قَدْ دَخَلَ فِي هَذِهِ الْجُمْلَةِ مَا وَصَفَ اللَّهُ بِهِ نَفْسَهُ فِي سُورَةِ الْإِخْلَاصِ الَّتِي تَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ حَيْثُ يَقُولُ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
নাবোধক ও হ্যাঁবাচক বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা নিজেকে যেসমস্ত সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তার মধ্যে কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান সূরা ইখলাসে বর্ণিত গুণাবলী অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ‘‘বলোঃ তিনি আল্লাহ্ একক। আল্লাহ্ অমূখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি, কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’’।
ব্যাখ্যা: এখানে শাইখুল ইসলাম পূর্বোক্ত বাক্যের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সেই বাক্যটি হচ্ছে,وَهُوَ سُبْحَانَهُ قَدْ جَمَعَ فِيمَا وَصَفَ وَسَمَّى بِهِ نَفْسَهُ بَيْنَ النَّفْيِ وَالْإِثْبَات অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং তিনি নিজেকে যেসব নামে নামকরণ করেছেন, তাতে তিনি নফী এবং ইছবাতকে একত্রিত করেছেন। আর এখানে তিনি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে তার উপর দলীল পেশ করা শুরু করেছেন। সূরা ইখলাসের অনেক ফযীলত থাকার কারণে তিনি সর্বপ্রথম এই সূরাকেই উল্লেখ করেছেন। এই সূরাকে সূরা ইখলাস হিসাবে নামকরণ করার কারণ হলো এটিকে আল্লাহর সিফাতের জন্য খালেস (বাছাই ও নির্দিষ্ট) করা হয়েছে এবং যে ব্যক্তি সূরা ইখলাস পাঠ করে, সূরা ইখলাস তাকে শির্ক থেকে মুক্ত করে। সে হিসাবে ইখলাস অর্থ মুক্ত করা।
الَّتِي تَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান: সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান। কারণ কুরআনে যেসব ইলমের সমাহার ঘটেছে, তা মূলতঃ তিন প্রকার। (১) তাওহীদের জ্ঞান (২) অতীতের জাতিসমূহের ঘটনাবলী ও ভবিষ্যতের খবরাদি এবং (৩) হালাল-হারামসহ বিভিন্ন হুকুম-আহকাম।
সূরা ইখলাসের মধ্যে শুধু আল্লাহ তাআলার সিফাতের বর্ণনা রয়েছে। তাই এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশ। তার দলীল হলো যেমন সহীহ বুখারীতে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে,
أَنَّ رَجُلاً سَمِعَ رَجُلاً يَقْرَأُ: ﴿قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ﴾ يُرَدِّدُهَا. فَلَمَّا أَصْبَحَ جَاءَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَذَكَرَ ذَلِكَ لَهُ، وَكَأَنَّ الرَّجُلَ يَتَقَالُّهَا، فَقََالَ رَسُولُ اللَّهِ :্রوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ إِنَّهَا لَتَعْدِلُ ثُلُثَ الْقُرْآنِ
‘‘এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে ((قل هوالله أحد তথা সূরা ইখলাস বার বার পাঠ করতে শুনল। সকাল হলে সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বিষয়টি জানালো। লোকটি শুধু সূরা ইখলাস পাঠকে খুব অল্প মনে করছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই ইহা কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান’’। [1]
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান হওয়ার হাদীছগুলো প্রায় মুতাওয়াতের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
সূরা ইখলাসে মহান আল্লাহ বলেনঃ قل অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! তুমি বলো। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কুরআন আল্লাহর কালাম। কেননা এটি যদি মুহাম্মাদের বা অন্যের কালাম হতো তাহলে আল্লাহ তাআলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে قل শব্দটি প্রয়োগ করতেন না।
اللَّهُ أَحَدٌ আল্লাহ এককঃ অর্থাৎ আল্লাহ এক, তাঁর কোন সমকক্ষ, সহযোগী, সদৃশ এবং শরীক নেই।
الله الصمد আল্লাহ অমূখাপেক্ষীঃ অর্থাৎ আল্লাহ এমন মর্যাদাবান নেতা যিনি স্বীয় নেতৃত্বে, মর্যাদায় এবং মহত্ত্বে পরিপূর্ণ হয়েছেন। আল্লাহ তাআলার এই ‘সামাদ’[2] নামের মধ্যে সমস্ত পূর্ণতার গুণাবলী বিদ্যমান। কেউ কেউ বলেছেন, সামাদ বলা হয় এমন সত্তাকে যার প্রতি সমস্ত মাখলুখের প্রয়োজন হয় এবং তারা সকলেই নিজ নিজ প্রয়োজনে তাঁর দিকেই ধাবিত হয় ও তাঁকেই উদ্দেশ্য করে।
لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নিঃ অর্থাৎ তাঁর কোন সন্তান নেই, পিতাও নেই। এতে ইহুদী, নাসারা এবং আরবের ঐসব মুশরিকদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা আল্লাহর জন্য সন্তান নির্ধারণ করত। ইহুদীরা উযাইরকে এবং খৃষ্টানরা ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলে থাকে। আর আরবের মুশরিকরা বলতঃ ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা সন্তান। আল্লাহ তাআলা তাদের কথার অনেক উর্ধ্বে।
وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই: অর্থাৎ তাঁর সমান, সদৃশ ও সমকক্ষ নেই।
মোটকথা, সূরা ইখলাস থেকে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, উহা আল্লাহ তাআলার সিফাতের ক্ষেত্রে নফী বা নাকোচ ও ইছবাত বা সাব্যস্ত করণকে একসাথে একত্রিত করেছে। আল্লাহ তাআলার বাণী:اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ ‘‘আল্লাহ্ একক। তিনি অমূখাপেক্ষী’’ এতে আল্লাহ তাআলার তাওহীদ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর আল্লাহ তাআলার বাণী:لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ ‘‘তিনি কাউকে জন্ম দেন নি, কেউ তাকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’’-এতে মুশরিকদের শির্ক নাকোচ করা হয়েছে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ
وَمَا وَصَفَ بِهِ نَفْسَهُ فِي أَعْظَمِ آيَةٍ فِي كِتَابِهِ حَيْثُ يَقُولُ ﴿اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ﴾ ولهذا كان من قرأ هذه الآية في ليلة لم يزل عليه من الله حافظ حتى يصبح
আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের সর্বাধিক মর্যাদাবান আয়াতে নিজেকে যেই সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেনঃ ‘‘তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনা। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সব তাঁরই। এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। তাঁর জ্ঞান থেকে কোন কিছুই তারা পরিবেষ্টন করতে পারেনা। কিন্তু তিনি যে জিনিসের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান, সেটুকুর কথা ভিন্ন। তার কুরসী আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তাঁর জন্য মোটেই কঠিন নয়। আর তিনি সমুন্নত, মহান’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৫)
এই আয়াতে আল্লাহর বড় বড় সিফাতের আলোচনা হয়েছে বলেই যে ব্যক্তি রাতে ইহা পাঠ করবে, সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তাঁর নিকট কোন শয়তান আসতেই পারবেনা।
ব্যাখ্যা: وَمَا وَصَفَ بِهِ نَفْسَهُ فِي أَعْظَمِ آيَةٍ فِي كِتَابِهআল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ আয়াতে নিজেকে সুমহান গুণে গুণান্বিত করেছেন: অর্থাৎ পূর্বোক্ত বাক্যে নফী ও ইছবাতের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি অতিক্রান্ত হয়েছে। কুরআনের সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ আয়াত তথা আয়াতুল কুরসীতে আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্মানিত সত্তাকে যেসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তাও নফী ও ইছবাতের মাধ্যমেই করেছেন। অর্থাৎ তাতে যেমন আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য সু্উচ্চ ও সমুন্নত গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন, ঠিক তেমনি তাঁর পবিত্র সত্তা হতে সকল প্রকার মানবীয় দোষ-ত্রুটি দূরিভূত করেছেন।
الأية -এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে চিহ্ন, নিদর্শন ইত্যাদি। কুরআনের একাধিক শব্দ দ্বারা গঠিত এমন বাক্যকে আয়াত বলা হয়, যাকে একটি فاصلة (বিরামচিহ্ন)এর মাধ্যমে পূর্বাপর বাক্য থেকে আলাদা করা হয়। তবে এখানে যেই আয়াতটির কথা চলছে, তাকে আয়াতুল কুরসী বলা হয়। কারণ এতে কুরসীর উল্লেখ রয়েছে।
আয়াতুল কুরসী কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদাবান আয়াত হওয়ার বিষয়টি সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। সহীহ মুসলিমে ইমাম মুসলিম (রঃ) উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছটি হচ্ছে, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনে কা’বকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কুরআনে সবচেয়ে বড় আয়াত কোন্টি? জবাবে উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বললেনঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত। উবাই কয়েকবার কথাটি পুনরাবৃত্তি করার পর বললেনঃ উহা হলো আয়াতুল কুরসী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন তাঁর জন্য দুআ করে বললেনঃ হে আবুল মুনযির! তোমার জন্য এই ইলম সুখকর ও তৃপ্তিদায়ক হোক![3]
মর্যাদার দিক দিয়ে আয়াতুল কুরসী কুরআনের সবচেয়ে বড় আয়াত হওয়ার কারণ হলো উহাতে এমন বিষয় বর্ণিত হয়েছে, যা আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম নাম ও সুমহান গুণাবলীকে সাব্যস্ত করেছে এবং আল্লাহর সত্তাকে এমনসব মন্দ বৈশিষ্ট থেকে পবিত্র করেছে, যা তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার শানে শোভনীয় নয়।
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেইঃ অর্থাৎ তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং তিনি ব্যতীত যেসব মাবুদের এবাদত করা হয়, তা একদম বাতিল। আল্লাহ তাআলার অন্যতম অতি সুন্দর নাম الحي (চিরজীবন্ত)। এর অর্থ আল্লাহ তাআলা এমন চিরবিদ্যমান সত্তা, যার জন্য রয়েছে পূর্ণতম জীবন। আল্লাহ তাআলার হায়াত যেহেতু পূর্ণাঙ্গ, তাই তাঁর হায়াত কখনো শেষ হবেনা। আল্লাহর আরেকটি নাম الْقَيُّومُ (সবকিছুর ধারক)। যিনি নিজে নিজেই প্রতিষ্ঠিত, স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং অন্যকে প্রতিষ্ঠাকারী তিনিই হচ্ছেন আল কাইয়্যুম। সুতরাং কোন মাখলুকের প্রতিই আল্লাহ তাআলার কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ সমস্ত মাখলুকই তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী।
বর্ণিত হয়েছে যে, الْحَيُّ الْقَيُّومُ হচ্ছে ইসমে আযম, যা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করলে আল্লাহ তাআলা সেই দুআ কবুল করেন এবং এর উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে তিনি তা দান করেন। الْحَيُّ الْقَيُّومُ ইসমে আযম হওয়ার কারণ হলো ‘আলহাই’ নামটি আল্লাহর সিফাতে যাতীয়ার উপর প্রমাণ বহন করে। তথা এটি আল্লাহর ঐ সব সিফাতের অন্তর্ভূক্ত যা, কখনোই আল্লাহর পবিত্র সত্তা হতে আলাদা হয়না। আর ‘আলকাইয়্যুম’ নামটি আল্লাহর সিফাতে ফেলিয়া অর্থাৎ তাঁর কর্ম সম্পর্কীয় সিফাত থাকার প্রমাণ করে। সুতরাং আল্লাহর সকল সিফাতের মূলভীত্তি হচ্ছে এই দুইটি সম্মানিত ও মহান নাম।[4]
لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারেনাঃ তিনিই যেহেতু সকল সৃষ্টির সার্বক্ষণিক ধারক ও বাহক, তাই তন্দ্রা ও নিদ্রা তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেনা। হালকা ঘুমকে ‘সিনাহ’ বলা হয়। এটি শুধু চোখের মধ্যেই হয়। আর ঘুম তন্দ্রা থেকে অধিক গভীর ও শক্তিশালী হয়। ঘুম মৃত্যুর ছোট ভাই। এই প্রকার ঘুম অন্তরে হয়।
لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সব তাঁরইঃ অর্থাৎ আসমান ও যমীনে যত মাখলুক রয়েছে, তাদের সকলের স্রষ্টা একমাত্র তিনি, এগুলোর মালিকানাও একমাত্র তাঁর এবং সকলেই তার অনুগত। সুতরাং তিনি উর্ধ্ব জগৎ এবং নিম্ন জগতের সবকিছুরই মালিক।
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করবে? অর্থাৎ বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট সুপারিশ করার মত কেউ নেই। الشفاعة শব্দটি الشفع (যুক্ত করা) থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি الوتر (বেজোড়) এর বিপরীত। শাফাআতকারী যেহেতু স্বীয় প্রার্থনার সাথে অন্যের জন্য প্রার্থনা করাকেও যুক্ত করে নেয়, তাই সুপারিশকারীকে الشافع (সুপারিশকারী) বলা হয়। তাই যার জন্য সুপারিশ করা হয়, সেই লোক প্রথমে বেজোড় (একা) থাকার পর সুপারিশকারী তাকে নিজের সাথে মিলিয়ে নিয়ে জোড়ে পরিণত করে দেয়। আর পারিভাষিক অর্থে শাফাআত অর্থ হচ্ছে سؤال الخير للغير অন্যের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করা। অর্থাৎ মুমিন ব্যক্তি তাঁর রবের কাছে অন্যান্য মুমিনের জন্য এই দুআ করবে যে, তিনি যেন তাদের গুনাহ ও অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেন। তবে শাফাআতের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর মালিকানাধীন। আল্লাহর অনুমতি ও আদেশ ব্যতীত শাফাআত হবেনা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বড়ত্ব ও মর্যাদার কারণেই অনুমতি ছাড়া কেউ তাঁর নিকট কিয়ামতের দিন অন্য কারো জন্য সুপারিশ নিয়ে অগ্রসর হতে পারবেনা।
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইলম অতীত ও ভবিষ্যতের সকল বিষয়কে পরিবেষ্টন করে আছে। অতীত ও ভবিষ্যতের কোন জিনিষই আল্লাহর জ্ঞানের বাইরে নয়।
وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ তার জ্ঞান থেকে কোন কিছুই তারা পরিবেষ্টন করতে পারেনা। কিন্তু তিনি নিজে যে জিনিষের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান, সেটুকুর কথা ভিন্নঃ অর্থাৎ আল্লাহর বান্দাগণ তাঁর ইলম থেকে কিছুই জানতে পারেনা। তবে তারা শুধু সেটুকুই জানতে পারে, যা তিনি রাসূলদের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেন।
وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ তার কুরসী সমস্ত আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেঃ আল্লাহর কুরসী সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। কেউ বলেছেঃ উহা হচ্ছে আল্লাহর আরশ। অর্থাৎ আরশ ও কুরসী একই জিনিষ। কেউ বলেছেনঃ কুরসী আর আরশ এক নয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস এবং অন্যান্য সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, কুরসী হচ্ছে আল্লাহর দুই পা রাখার স্থান। সেটি এমন কুরসী, যার বিশালতা ও প্রশস্ততা সমস্ত আসমান-যমীন পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।[5]
[1] - সহীহ বুখারীতে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, জনৈক আনসারী সাহাবী মসজিদে কুবায় ইমামতি করতেন। যখনই তিনি সূরা ফাতিহার পর কোন সূরা দিয়ে কিরাত আরম্ভ করতেন তখন প্রথমে সূরা ইখলাস পড়ে নিতেন। তারপর অন্য কোন সূরা পড়তেন। আর এরূপ তিনি প্রতি রাকাআতেই করতেন। মুসল্লীগণ তাকে বললেনঃ আপনি প্রথমে এই সূরা দিয়ে কিরাত শুরু করছেন তারপর তা যথেষ্ট নয় ভেবে অন্য সূরা পাঠ করছেন। আপনি হয় শুধু এই সূরাটি পাঠ করুন অথবা এটা ছেড়ে অন্য কোন সূরা পাঠ করুন। তিনি বললেনঃ আমি উহা পরিত্যাগ করতে রাজি নই। তোমরা যদি চাও তাহলে এভাবেই তোমাদের ইমামতি করবো। আর যদি অপছন্দ কর তবে তোমাদের ইমামতি ছেড়ে দিবো। তারা মনে করতেন, তিনি তাদের মাঝে সর্বাধিক যোগ্য ব্যক্তি এবং অন্য কেউ তাদের ইমামতি করুক এটাও অপছন্দ করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা তাদের নিকট আগমণ করলেন। তারা ব্যাপারটি তাঁর কাছে পেশ করলেন। তিনি সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘‘হে অমুক! তোমার সাথীরা তোমাকে যে পরামর্শ দিচ্ছে, তা গ্রহণ করতে কিসে তোমাকে বাধা দিচ্ছে? আর কেনইবা তুমি উক্ত সূরাটি প্রতি রাকআতে পাঠ করছ? জবাবে তিনি বললেনঃ আমি উহাকে খুব ভালবাসি। তিনি বললেনঃ ‘‘এই ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’’
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে অপর বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা তাঁর সাহাবীদেরকে বললেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউ কি একরাতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পাঠ করতে পারে? সাহাবীদের কাছে বিষয়টি খুব কঠিন মনে হলো। তারা বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে কার এমন সাধ্য আছে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ সূরা ইখলাস, যাতে রয়েছে আল্লাহ্ এক অদ্বিতীয় এবং অমূখাপেক্ষী- কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান
[2] - সামাদ শব্দের আরো অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। কেউ কেউ বলেনঃ যার পেট নেই তাকে সামাদ বলা হয়। সুতরাং যার পেট নেই তাঁর খাদ্য গ্রহণ বা দুনিয়ার অন্য কোন বস্ত্তর প্রতি কোন প্রয়োজন নেই।
আবার কেউ কেউ বলেছেন الله الصمد এর ব্যাখ্যা হচ্ছে পরবর্তী আয়াত, الذي لم يلد ولم يولد। কুরআন দ্বারা কুরআনের ব্যাখ্যা করাই কুরআনের ব্যাখ্যা করার সর্বাধিক বিশুদ্ধ পদ্ধতি। সামাদ শব্দের ব্যাখ্যায় আরো যা বলা হয়েছে, তার মধ্যেঃ ১) এমন জমাট জিনিস, যার পেট নেই। ২) যে লক্ষ্যের দিকে যেতে মনস্থ করা হয়; যে সবল জিনিসের মধ্যে কোন দুর্বলতা নেই। ৩) এমন গৃহ, প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য যার আশ্রয় নিতে হয়। ৪) উঁচু ইমারত। ৫) আলী (রাঃ) ইকরামা ও কা'ব আহবার বলেছেন: সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা যাঁর উপরে আর কেউ নেই। ৬) আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ও আবু ওয়ায়েল শাকীক ইবনে সালামাহ বলেছেন: তিনি এমন সরদার, নেতা ও সমাজপতি, যাঁর নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। লোকেরা কোন বিপদে-আপদে যার দিকে সাহায্য লাভের জন্য এগিয়ে যায়, তিনিই হচ্ছেন সামাদ। ৭) যে সরদার তার নেতৃত্ব, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, ধৈর্য, সংযম, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতায় পূর্ণতার অধিকারী, তিনিই সামাদ। ৮) আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন: যিনি কারো উপর নির্ভরশীল নন, সবাই যার উপর নির্ভরশীল, তিনিই সামাদ। ৯) যার মধ্য থেকে কোনো জিনিষ কোনো দিন বের হয়নি এবং যে পানাহার করে না, সে-ই সামাদ। ১০) সুদ্দী বলেছেন: আকাংখিত বস্ত্ত লাভ করার জন্য লোকেরা যার কাছে যায় এবং বিপদে সাহায্য লাভের আশায় যার দিকে হাত বাড়ায়, তাকেই সামাদ বলা হয়। ১১) সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেছেন: যিনি নিজের সকল গুণ ও কাজে পূর্ণতার অধিকারী হন, তিনিই সামাদ। ১২) রাবী ইবনে আনাস বলেছেন: যার উপর কখনো বিপদ-আপদ আসেনা, তিনিই সামাদ। ১৩) মুকাতেল ইবনে হাইয়ান বলেছেন: যিনি সকল প্রকার দোষ ত্রুটি মুক্ত। ১৪) ইবনে কাইসান বলেছেন: অন্য কেউ যার গুণাবলীর ধারক হয় না, তিনিই সামাদ। ১৫) হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেছেন: যে বিদ্যমান থাকে এবং যার বিনাশ নেই, তিনিই সামাদ। ১৬) ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন: যার দিকে লোকেরা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য এগিয়ে যায়, তিনিই সামাদ। ১৭) আবু বকর আমবারী বলেছেন: সামাদ এমন এক সরদারকে বলা হয়, যার উপরে আর কোন সরদার নেই এবং লোকেরা নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে ও নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য যার শরণাপন্ন হয়, তিনিই হচ্ছেন সামাদ। ১৮) যার উপর এসে নেতৃত্ব খতম হয়ে গেছে এবং নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য প্রত্যেকে যার শরণাপন্ন হয়, তাকেই বলা হয় সামাদ। (আল্লাহই অধিক অবগত)
[3]- সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ২৫৮। আয়াতুল কুরসীর ফযীলতে যেসব হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে সহীহ বুখারীর এই হাদীছটিও অন্যতম। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে রামাযানের যাকাত পাহারা দেয়ার দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। এক আগন্তুক আমার নিকট এসে অঞ্জলি ভর্তি করে খাদ্য দ্রব্য তুলে নিতে লাগল। আমি তাকে গ্রেফতার করে ফেললাম এবং বললামঃ আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিয়ে যাব। সে বললঃ আমাকে ছেড়ে দাও। আমি অভাবগ্রস্ত, আমার উপর পরিবার-পরিজনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ন্যস্ত এবং আমার প্রয়োজন খুবই তীব্র। আবু হুরায়রা বলেনঃ তার প্রতি আমার দয়া হল। তাই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হে আবু হুরায়রা! তোমার গত রাতের বন্দীর খবর কি? আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহ আনহু বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! সে তীব্র অভাবের ও পরিবারের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করার কারণে তার প্রতি আমার দয়া হল। তাই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ সে তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা ‘‘সে আবার আসবে’’ এ থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, সে পুনরায় আসবে। আমি তার অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকলাম। দ্বিতীয় দিনও সে এসে অঞ্জলি ভর্তি করে খাদ্য দ্রব্য তুলে নিতে লাগল। আমি তাকে আবার গ্রেফতার করে ফেললাম এবং বললামঃ আল্লাহর শপথ! আমি তোমাকে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিয়ে যাব। সে বললঃ আমাকে ছেড়ে দাও। আমি অভাবগ্রস্ত। আমার উপর পরিবারের ভরণ-পোষণের ভার ন্যস্ত। আমি আর আসবনা। আবু হুরায়রা বলেনঃ তার প্রতি আমার দয়া হল। তাই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হে আবু হুরায়রা! তোমার গত রাতের বন্দীর খবর কী? তিনি বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! সে তীব্র অভাবের ও পরিবারের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করার কারণে তার প্রতি আমার দয়া হল। তাই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ সে তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। তৃতীয়বারও আমি তার আগমণের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকলাম। এবারও সে এসে অঞ্জলি ভর্তি করে খাদ্য দ্রব্য তুলে নিতে লাগল। আমি তাকে গ্রেফতার করে ফেললাম এবং বললামঃ আমি তোমাকে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিয়ে যাব। এ নিয়ে তিনবার হল। প্রত্যেকবারই তুমি বল যে আর আসবেনা। কিন্তু তুমি আবার আস। সে বললঃ আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে এমন কিছু বাক্য শিক্ষা দেব, যদ্বারা আল্লাহ তোমার উপকার করবেন। আবু হুরায়রা বলেনঃ আমি বললামঃ সেগুলো কি? সে বললঃ যখন তুমি শয্যা গ্রহণ করবে তখন আয়াতুল কুরসী তথা সূরা বাকারা ২৫৫ নং আয়াত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে। (তুমি যখন তা পাঠ করবে) তখন সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবেন। সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটেই আসবেনা। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। সকালে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হে আবু হুরায়রা! তোমার গত রাতের বন্দীর খবর কী? আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! সে বলেছে যে, আমি তোমাকে এমন কতিপয় বাক্য শিক্ষা দিবো যদ্বারা আল্লাহ আমার উপকার সাধন করবেন। তাই আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ সেটি কী? আমি বললামঃ সে আমাকে বললঃ যখন তুমি শয্যা গ্রহণ করবে তখন আয়াতুল কুরসী তথা সূরা বাকারা ২৫৫ নং আয়াত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করবে। (তুমি যখন তা পাঠ করবে) তখন থেকে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন রক্ষক থাকবেন। সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটেই আসবে না। আর সাহাবীগণ ছিলেন কল্যাণ অর্জনের প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ সে সত্য বলেছে অথচ সে মিথ্যুক। তুমি কি জান তিন রাত্রি যাবৎ তুমি কার সাথে কথা বলছিলে? আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেনঃ আমি বললামঃ না। তিনি বললেনঃ সে হল শয়তান।
অন্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, জান্নাতে যাওয়ার পথে মৃত্যু ব্যতীত তার সামনে অন্য বাধা থাকবেনা।
[4] - الحي والقيوم আল্লাহ তাআলার এই পবিত্র নাম দু’টিতে আল্লাহর দু’টি সুমহান সিফাত রয়েছে। একটি হচ্ছে হায়াত তথা আল্লাহর জীবন। আল্লাহর হায়াত হচ্ছে এমন পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত হায়াত, যাতে কোনো প্রকার ত্রুটি নেই। আল্লাহর হায়াতের সাথে সৃষ্টির হায়াতের কোন তুলনাই হতে পারেনা। সৃষ্টির হায়াতের শুরু রয়েছে এবং তার পরিসমাপ্তিও রয়েছে। রোগ-ব্যাধি, তন্দ্রা-নিদ্রা ইত্যাদির কারণে মাখলুকের জীবিত থাকার মধ্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি চলে আসে। মৃত্যুর মাধ্যমে সৃষ্টির দুনিয়ার হায়াত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহ হায়াতের কোন শুরু নেই, শেষও নেই। তাঁর হায়াত ও জীবন এত চূড়ান্ত ও পরিপূর্ণ যে, তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শই করতে পারেনা।
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর বিষয়ে এ কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ রাখা ও বুঝা আবশ্যক যে, হায়াত হচ্ছে আল্লাহর এমন একটি সিফাত, যার উপর বাকী সিফাতগুলো ভিত্তিশীল। এটি হচ্ছে আল্লাহর সত্তাগত সিফাত। তা কখনো আল্লাহর যাত থেকে আলাদা হয়না। আল্লাহর এই হায়াত বিশেষণ ছাড়া তাঁর বাকী সিফাতগুলো অকল্পনীয়।
আর আল্লাহর কাইয়্যুমিয়াত তথা সবকিছুকে ধারণ ও সংরক্ষণ করা তাঁর এমন একটি বিশেষণ, যার উপর আল্লাহর বাকীসব কর্মগত সিফাতের ভিত্তি। আল্লাহর এই সিফাতের ফলেই আসমান-যমীন এবং এতদোভয়ের মধ্যকার সকল সৃষ্টি টিকে আছে।
[5] - সুতরাং কেউ যেন এমন না ভাবে যে, কুরসী দ্বারা এখানে ঐরকম চেয়ার উদ্দেশ্য, যার উপর আমরা বসি। আল্লাহর কুরসীর ব্যাপারে এই রকম ধারণা করা ঠিক নয়। আল্লাহর কুরসী রয়েছে, এই কথা থেকে এমন ধারণা করা যাবেনা যে, তিনি চেয়ারে বসে আছেন। নাউযুবিল্লাহ। কুরসীর যেই বিবরণ কুরআন ও সুন্নায় এসেছে, উহাই বিশ্বাস করতে হবে। আরশের সাধারণ অর্থ রাজা-বাদশাহর সিংহাসন। কিন্তু আল্লাহর আরশ আল্লাহর সর্ববৃহৎ সৃষ্টি এবং তা সকল সৃষ্টির ছাদ। আরশের ব্যাপারেও এমন ধারণা ঠিক নয় যে, রাজা-বাদশাহগণ যেভাবে সিংহাসনে বসেন, আল্লাহ তাআলাও সেভাবে সিংহাসনে বসে আছেন। কুরআনের কিছু কিছু বাংলা অনুবাদে আল্লাহ আরশে সমাসীন বলে যেই অনুবাদ করা হয়েছে, তা ভুল। الرحمن على العرش استوى এই আয়াতের অনুবাদ কোন কোন অনুবাদ গ্রন্থে এভাবে করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন। এই অনুবাদ সঠিক নয়। সঠিক অনুবাদ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা আরশে উপর সমন্নত।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
ما السموات السبع والأرضون السبع في كف الرحمن إلا كحبة خردل في كف أحدكم
‘‘তোমাদের কারো হাতে একটা সরিষার দানা যেমন সামান্য স্থান দখল করে, সাত আসমান ও সাত যমীন আল্লাহ তাআলার হাতের তালুতে ঠিক তেমনই’’।[1]
ইবনে জারীর তাবারী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেন, আমার কাছে বর্ণনা করেছেন ইউনুস। ইউনুস বলেনঃ আমাকে সংবাদ দিয়েছেন ইবনে ওয়াহাব, ইবনে ওয়াহাব বলেনঃ ইবনে যায়েদ তার পিতা হতে বর্ণনা করেছেন। ইবনে যায়েদ বলেনঃ ‘‘আমার পিতা আমাকে বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,্র
ما السموات السبع فى الكرسى إلا كدراهم سبعة القيت فى ترس
‘‘কুরসীর মধ্যে সাত আসমানের অবস্থান ঠিক তেমনি, যেমন একটি ঢালের মধ্যে নিক্ষিপ্ত সাতটি দিরহামের অবস্থান’’।
তিনি আরো বলেনঃ ‘আবু যার (রাঃ) বলেছেনঃ ‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ
ما الكرسى فى العرش إلا كحلقه من حديد القيت بين ظهرى فلاة من الأرض
‘‘আরশের মধ্যে কুরসীর অবস্থান ঠিক সে রকমই যেমন ভূপৃষ্ঠের কোন উন্মুক্ত ময়দানে পড়ে থাকা একটি আংটি’’।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,
ما بين السماء الدنيا والتي تليها مسيرة خمس مئة عام ومابين كل سماء مسيرة خمس مائة عام وما بين السماء السابعة والكرسي مسيرة خمس مئة عام وما بين الكرسي والماء مسيرة خمس مئة عام والعرش على الماء والله عز و جل على العرش يعلم ما أنتم عليه
‘‘দুনিয়ার আকাশ এবং এর পরবর্তী আকাশের মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। আর এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এমনি সপ্তমাকাশ এবং কুরসীর মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। কুরসী এবং পানির মাঝখানে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। আরশ হচ্ছে পানির উপরে। আর আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে। তোমাদের আমলের কোন কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়’’।
হাম্মাদ বিন সালামা হতে এই হাদীছ ইবনে মাহদী বর্ণনা করেন আসেম হতে, আসেম বর্ণনা করেন যির্ হতে, তিনি বর্ণনা করেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে। অনুরূপ বর্ণনা করেন মাসউদী আসেম হতে, তিনি আবি ওয়ায়েল হতে এবং তিনি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন।
ইমাম যাহাবী (রঃ) উপরোক্ত সনদ বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেনঃ অনেক সনদে এই বর্ণনা এসেছে।
আববাস বিন আবদুল মুত্তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ্র
هَلْ تَدْرُونَ كَمْ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ قَالَ قُلْنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَال্َর بَيْنَهُمَا مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَمِنْ كُلِّ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَكِثَفُ كُلِّ سَمَاءٍ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ وَبَيْنَ السَّمَاءِ السَّابِعَةِ وَالعَرْشِ بَحْرٌ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ وَاللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَوْقَ ذَلِكَ وَلَيْسَ يَخْفَى عَلَيْهِ مِنْ أَعْمَالِ بَنِى آدَمَ شَىْءٌ
‘‘তোমরা কি জানো, আসমান ও যমীনের মধ্যকার দূরত্ব কত?’’ আমরা বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে অধিক জানেন। তিনি বললেন, ‘‘আসমান ও যমীনের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ বছরের পথ। এক আকাশ থেকে অন্য আকাশের দূরত্ব হচ্ছে পাঁচশ’ বছরের পথ। প্রত্যেক আকাশের ঘনত্বও (পুরুত্ব) পাঁচশ’ বছরের পথ। সপ্তমাকাশ ও আরশের মধ্যখানে রয়েছে একটি সাগর। যার উপরিভাগ ও তলদেশের মাঝে দূরত্ব হচ্ছে আকাশ ও যমীনের মধ্যকার দূরত্বের সমান। আল্লাহ তাআলা এর উপরে রয়েছেন। আদম সন্তানের কোন কর্মকান্ডই তাঁর অজানা নয়’’। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[2]
আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের হাদীছটি লেখক এখানে সংক্ষিপ্ত করে উল্লেখ করেছেন। আবু দাউদের বর্ণনাটি ঠিক এ রকম, আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) বলেন,্র
كُنْتُ فِى الْبَطْحَاءِ فِى عِصَابَةٍ فِيهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَمَرَّتْ بِهِمْ سَحَابَةٌ فَنَظَرَ إِلَيْهَا فَقَالَ مَا تُسَمُّونَ هَذِهِ قَالُوا السَّحَابَ قَالَ وَالْمُزْنَ قَالُوا وَالْمُزْنَ قَالَ وَالْعَنَانَ قَالُوا وَالْعَنَانَ قَالَ أَبُو دَاوُدَ لَمْ أُتْقِنِ الْعَنَانَ جَيِّدًا قَالَ هَلْ تَدْرُونَ مَا بُعْدُ مَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ قَالُوا لاَ نَدْرِى قَالَ إِنَّ بُعْدَ مَا بَيْنَهُمَا إِمَّا وَاحِدَةٌ أَوِ اثْنَتَانِ أَوْ ثَلاَثٌ وَسَبْعُونَ سَنَةً ثُمَّ السَّمَاءُ فَوْقَهَا كَذَلِكَ حَتَّى عَدَّ سَبْعَ سَمَوَاتٍ ثُمَّ فَوْقَ السَّابِعَةِ بَحْرٌ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ فَوْقَ ذَلِكَ ثَمَانِيَةُ أَوْعَالٍ بَيْنَ أَظْلاَفِهِمْ وَرُكَبِهِمْ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ عَلَى ظُهُورِهِمُ الْعَرْشُ بَيْنَ أَسْفَلِهِ وَأَعْلاَهُ مِثْلُ مَا بَيْنَ سَمَاءٍ إِلَى سَمَاءٍ ثُمَّ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى فَوْقَ ذَلِكَ
‘‘আমি একদা একদল সাহাবীর সাথে খোলা ময়দানে বসা ছিলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেখানে ছিলেন। তখন তাদের উপর দিয়ে এক খন্ড মেঘ অতিক্রম করার সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিকে তাকিয়ে বললেনঃ তোমরা এটিকে কী বলো? তারা বললোঃ السحاب ‘‘এটিকে আমরা মেঘ বলি’’। তিনি তখন বললেনঃ والمزن (আলমুয্ন)। সাহাবীরা বললোঃ আমরা এটিকে মুয্নও বলি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ والعنان (আলআনান)। সাহাবীগণ বললোঃ আমরা আনানও বলি। ইমাম আবু দাউদ (রঃ) বলেনঃ আমি আনান শব্দটি ভালভাবে বুঝতে পারিনি। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তোমরা কি জানো আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানের দূরত্ব কতটুকু? সাহাবীগণ বললোঃ আমরা জানিনা। তিনি বললেনঃ উভয়ের মধ্যে রয়েছে হয় একাত্তর বছরের, না হয় বাহাত্তর বছরের না হয় তেহাত্তর বছরের দূরত্ব। এমনি প্রত্যেক আকাশ ও তার পরবর্তী আকাশের মধ্যবর্তী দূরত্ব হচ্ছে একই রকম। এভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাতটি আসমান গণনা করলেন। সপ্তম আকাশের উপর রয়েছে একটি সাগর। সাগরের উপর হতে নীচের দূরত্ব (গভীরতা) হচ্ছে এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যকার দূরত্বের সমান। সাগরের উপরে রয়েছে আটটি ওয়াল (বিশাল আকারের আট ফেরেশতা)। তাদের হাঁটু থেকে পায়ের খুর পর্যন্ত দূরত্ব এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। তাদের পিঠে রয়েছে আল্লাহর আরশ। আরশ এত বিশাল যে, তার নীচের অংশ হতে উপরের ছাদ পর্যন্ত দূরত্ব হচ্ছে এক আসমান থেকে অন্য আসমানের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। আর আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরশের উপরে’’।[3] অনুবাদকের সংযুক্তি এখানেই শেষ।
وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তাঁর জন্য মোটেই কঠিন নয়ঃ আসমান-যমীনসহ উর্ধ্বজগৎ ও নিম্নজগতের সবকিছু সংরক্ষণ করা আল্লাহর জন্য মোটেই কঠিন ও ভারী অনুভব হয়না। কেননা তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত।
وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ আর তিনি সর্বোচ্চ ও মহান সত্তাঃ অর্থাৎ সকল দিক থেকেই আল্লাহ তাআলার জন্য সৃষ্টির উপরে হওয়া সুপ্রমাণিত ও সুসাব্যস্ত। আল্লাহর যাত সুউচ্চ। অর্থাৎ তিনি সকল সৃষ্টির উপরে। তিনি আরশেরও উপরে।
আল্লাহর মর্যাদা ও বড়ত্ব সর্বোচ্চ। সুতরাং তাঁর জন্য রয়েছে পরিপূর্ণ সিফাতসমূহ এবং সুমহান গুণাবলী।
আল্লাহ তাআলার শক্তি এবং ক্ষমতাও সর্বোচ্চ। তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান, সকল সৃষ্টির পরিচালক এবং কোন কিছুই তাঁর জন্য অসম্ভব নয়।
الْعَظِيمُ (সুমহান) হচ্ছেন এমন সত্তা, যার মধ্যে বড়ত্বের সকল সিফাতই বিদ্যমান। সুতরাং নবী, ফেরেশতা এবং মুমিন বান্দাদের অন্তরে রয়েছে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সম্মান।
সুতরাং আয়াতুল কুরসীর মধ্যে যেহেতু আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মর্যাদার এতগুলো গুণ বিদ্যমান, তাই এটি কুরআনের সর্বাধিক মর্যাদাবান আয়াত হওয়ার দাবী রাখে এবং এটি তার পাঠকারীকে সকল প্রকার অকল্যাণ ও শয়তান থেকে হেফাজতকারী হিসাবে পরিগণিত হওয়ারও হকদার।
আয়াতুল কুরসী থেকে এই দলীল পাওয়া গেল, আল্লাহ তাআলা নিজেকে যেসব গুণে গুণান্বিত করেছেন এবং নিজেকে যেসব নামে নামকরণ করেছেন, সে ক্ষেত্রে তিনি আয়াতুল কুরসীতে শির্কের নেতিবাচক বক্তব্য এবং তাওহীদের ইতিবাচক বক্তব্য একত্রিত করেছেন। আয়াতুল কুরসী আল্লাহর জন্য একদিকে যেমন সুমহান, সর্বোচ্চ ও পরিপূর্ণ গুণাবলী সাব্যস্ত করেছে, অন্যদিকে তাঁর পবিত্র সত্তা হতে সকল দোষ-ত্রুটি এবং অশোভনীয় বৈশিষ্টগুলোকে দূর করে দিয়েছে।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ ‘‘তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই’’ এতে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য এবাদত অস্বীকার করা হয়েছে এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য এবাদতকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণী:
﴿الْحَيُّ الْقَيُّومُ﴾
‘‘তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক’’ এতে সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহর জন্য রয়েছে হায়াত (পূর্ণ জীবন), অবিনশ্বরতা এবং সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ ও ধারণ করার গুণাবলী। আল্লাহ তাআলার বাণী﴾: لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ﴿ ‘‘তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারেনা’’ এতে আল্লাহ তাআলা থেকে তন্দ্রা ও নিদ্রাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণীঃ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ‘‘আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সব তাঁরই’’ এতে উর্ধ্ব জগতের এবং নিম্ন জগতের পূর্ণ মালিকানা কেবল আল্লাহর জন্যই সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার বাণী: ﴾ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ﴿ ‘‘এমন কে আছে যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে?’’ আল্লাহর জন্য যেহেতু রয়েছে পূর্ণ বড়ত্ব, মর্যাদা এবং তিনি যেহেতু তাঁর সৃষ্টি হতে সম্পূর্ণ অমূখাপেক্ষী, তাই বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট শাফাআত অস্বীকার করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: ﴿يَعْلَم مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ﴾ ‘‘তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন’’ এতে আল্লাহর জন্য প্রত্যেক বস্ত্ত, ঘটনা এবং বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত ইলম সাব্যস্ত করা হয়েছে। চাই তা অতীতের বিষয় হোক কিংবা ভবিষ্যতের। আল্লাহর বাণী:
﴿ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ﴾
‘‘তাঁর জ্ঞান থেকে কোন কিছুই তারা পরিবেষ্টন করতে পারেনা। কিন্তু তিনি নিজে যে জিনিষের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান, সেটুকুর কথা ভিন্ন’’ সমস্ত মাখলুক যে আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী এবং কোন সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর যে কোন প্রয়োজন নেই- এখানে তা সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ‘‘তাঁর কুরসী আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে’’ এখানে আল্লাহর জন্য কুরসী এবং পূর্ণ বড়ত্ব সাব্যস্ত করা হয়েছে। সেই সাথে আরো সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলার তুলনায় সৃষ্টি খুবই ছোট ও নগণ্য। আল্লাহর বাণী:﴿وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا﴾ ‘‘আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তাঁর জন্য মোটেই কঠিন নয়’’ এতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা থেকে অক্ষমতা, অপারগতা এবং ক্লান্তি অস্বীকার করা হয়েছে। আল্লাহর বাণী: وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘‘আর তিনি সুউচ্চ, সমুন্নত ও মহান’’ এতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য সকল মাখলুকের উপরে থাকা, সমুন্নত হওয়া এবং বড়ত্বের গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে।
অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আয়াতুল কুরসীতে আল্লাহর বড় বড় সিফাতের আলোচনা হয়েছে বলেই যে ব্যক্তি রাতে ইহা পাঠ করবে, সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তাঁর নিকট শয়তান আসতেই পারবেনাঃ এই বক্তব্যের দ্বারা শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) ঐ হাদীছের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা ইমাম বুখারী (রঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। তাতে এই কথা রয়েছে, যখন তুমি বিছানায় আশ্রয় নিবে তথা শয্যা গ্রহণ করবে, তখন তুমি আয়াতুল কুরসী তথা ....اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ পাঠ করো। কেননা তুমি যদি উহা পাঠ করো, তাহলে সারা রাত আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার জন্য একজন প্রহরী নিযুক্ত থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত তোমার নিকট শয়তান আসতেই পারবেনা।
জিন ও ইনসানের মধ্য হতে প্রত্যেক বিদ্রোহী ও সীমালংঘনকারীকে শয়তান বলা হয়। شطن থেকে شيطان এর উৎপত্তি হয়েছে। شطَن অর্থ بعُد (দূর হয়েছে)। শয়তান আল্লাহর রহমত থেকে অনেক দূরে চলে গেছে বলেই তাকে শয়তান বলা হয়। অথবা شيطان এর উৎপত্তি হয়েছে شاط يشيط হতে। যখন কোনো জিনিষ খুব কঠিন ও শক্ত হয়, তখনই কেবল তাকে উদ্দেশ্য করে এ রকম কথা বলা হয়।
[1] - সহীহ হাদীছে يد الله (আল্লাহর হাত), كف الله (আল্লাহর হাতের তালু), كف الرحمن (রাহমানের হাতের তালু) এবং আল্লাহ তাআলার সিফাত সংক্রান্ত ইত্যাদি আরো অনেক বিষয়ই বর্ণিত হয়েছে। এ জাতিয় বিষয়ে ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেনঃ আলেমগণ আল্লাহর সুউচ্চ সিফাত সম্পর্কিত হাদীছগুলো এবং দুনিয়ার আসমানে আল্লাহ তাআলার নেমে আসা সম্পর্কিত বর্ণনাগুলো সুসাব্যস্ত ও সুপ্রমাণিত বলেছেন। আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, কোন প্রকার ধারণা করা যাবেনা এবং এ কথা বলা যাবেনা যে, كيف (তা কিভাবে?)। ইমাম মালেক, সুফিয়ান বিন উয়াইনা এবং আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রঃ) থেকে এভাবেই বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীছগুলোর ব্যাপারে কথা হচ্ছে أمروها بلا كيف অর্থাৎ যেভাবে এসেছে, সেভাবেই ছেড়ে দাও। এ কথা বলোনা যে, কিভাবে? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের কথাও তাই।
কিন্তু জাহমীয়ারা এই বর্ণনাগুলোকে অস্বীকার করেছে। তাদের কথা হচ্ছে এগুলো আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হলে সৃষ্টির সাথে তাশবীহ (তুলনা) হয়ে যায়। (নাউযুবিল্লাহ) অথচ আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক জায়গায় আল্লাহর হাত, চোখ, শ্রবণ, দৃষ্টি ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন। জাহমীয়ারা এই আয়াতগুলোর তাবীল (ব্যাখ্যা) করেছে। আলেমগণ এগুলোর যেই ব্যাখ্যা করেছেন, তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা করেছে। তাদের কথা আল্লাহ তাআলা আদমকে স্বীয় হাত দিয়ে সৃষ্টি করেননি। তাদের কথা হচ্ছে হাত অর্থ কুদরত (শক্তি)!! ইসহাক বিন ইবরাহীম বলেনঃ তাশবীহ (তুলনা) তখনই হবে, যখন বলা হবে আল্লাহর হাত মাখলুকের হাতের মতই, আল্লাহর হাত বান্দার হাতের মতই। এমনিভাবে আল্লাহর শ্রবণ, আল্লাহর দৃষ্টি বান্দার দৃষ্টির মতই। এটি তাশবীহ।
আর আল্লাহ যেমন বলেছেন, সেভাবেই বলা হবে অর্থাৎ হাত, শ্রবণ, দৃষ্টি এবং এই প্রশ্ন করা হবেনা যে, তা কিভাবে? অথবা এটি বলা হবেনা যে, আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মতই এবং শ্রবণ শ্রবণের মতই, তখন কোনো তাশবীহ হবেনা। তখন কেবল তেমনই হবে যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃلَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْرُ ‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি শুনেন এবং দেখেন’’। (সূরা শুরাঃ ১১) (দেখুনঃ তাফসীরে তাবারী, (৬/২০) ঈষৎ পরিবর্তিত))
[2] - ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন, দেখুনঃ শরহুল আকীদুত্ তাহাবীয়া, (১/৩০৫)।
[3] - তিরমিযী, অধ্যায়ঃ কিতাবুত্ তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ, (১/২০৬)। আলেমগণ হাদীছটি সহীহ ও যঈফ হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম হাদীছটি সহীহ বলেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ হাদীছটি হাসান গরীব। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা, হাদীছ নং- ১২৪৭। যঈফ হওয়া সত্ত্বেও আলেমগণ আসমানের উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া প্রমাণ করতে গিয়ে হাদীছটিকে উল্লেখ করেছেন। তবে আল্লাহ্ তাআলা উপরে হওয়ার বিষয়ে অনেক বিশুদ্ধ দলীল-প্রমাণ থাকার পরও এ ধরণের যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল গ্রহণ না করাই উত্তম।
এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা এই যে, أوعال (আওআল) শব্দটি وعل এর বহুবচন। এর অর্থে আলেমগণ থেকে একাধিক উক্তি পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেছেনঃ এরা হচ্ছেন বিশাল আকারের ফেরেশতা। কুরআনে ফেরেশতা কর্তৃক আরশ বহনের কথা সুস্পষ্ট করেই বলা হয়েছে।
আবার কেউ কেউ বলেছেনঃ আওআল হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ এমন এক সৃষ্টি, যার প্রকৃত রূপ আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কেউ জানেনা। কেউ কেউ বলেছেনঃ আওআল হচ্ছে বিশাল আকারের ষাঁড়। আবার কেউ বলেছেনঃ বিরাট আকৃতির শকুন। মোট কথা এগুলো পৃথিবীর পরিচিত কোনো প্রাণী নয়; বরং ফেরেশতা। আল্লাহই অধিক জানেন
২- الجمع بين علوه وقربه وأزليته وأبديته
আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে হওয়া ও নিকটবর্তী হওয়া এবং সকল সৃষ্টির পূর্বে ও সকল সৃষ্টির শেষে বিদ্যমান থাকা:
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
وَقَوْلُهُ سُبْحَانَهُ ﴿ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘‘তিনিই الأَوَّلُ (প্রথম), তিনিই الآخِرُ (সর্বশেষ), তিনিই الظَّاهِرُ (সবকিছুর উপরে), তিনিই الْبَاطِنُ (মাখলুকের অতি নিকটে), আর তিনি সর্ব বিষয়ে عَلِيم (মহাজ্ঞাণী)’’। (সূরা হাদীদ ৩)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তাআলার বাণী: هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ ‘‘তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ’’- সহীহ মুসলিমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত দুআর মাধ্যমে এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি তাঁর দুআয় বলেছেন, «اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ» ‘‘হে আল্লাহ! তুমিই أَوَّل (সর্বপ্রথম)। তোমার পূর্বে কেউ ছিলনা। তুমিই آخِر (সর্বশেষ), তোমার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। তুমিই ظَاهِر (সকল সৃষ্টির উপরে), তোমার উপরে আর কিছুই নেই। তুমিই بَاطِن (মাখলুকের অতি নিকটে এবং জ্ঞানের মাধ্যমে সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী), তোমার চেয়ে অধিক নিকটে আর কিছুই নেই’’।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর এই চারটি নামের সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন। এই বরকত সম্পন্ন নামগুলোর মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল সৃষ্টিকে সকল দিক থেকেই পরিবেষ্টন করে আছেন।
আল্লাহ তাআলার নাম: هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ ‘‘তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ’’ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সমস্ত যামানাকে পরিবেষ্টন করে আছেন। অর্থাৎ তিনি যামানা ও কালসীমার উর্ধ্বে। সবকিছুর আগে তিনি একাই ছিলেন এবং সবকিছু শেষ হওয়ার পরও তিনি থাকবেন।
আর আল্লাহ তাআলার নামঃ وَالظَّاهِرُوَالْبَاطِنُ ‘‘তিনি সকল সৃষ্টির উপরে এবং তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী’’ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা যেমন সকল যামানাকে বেষ্টন করে আছেন তেমনি সকল স্থানকে পরিবেষ্টন করে আছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলার এই চারটি নাম পরস্পর বিপরীত অর্থবোধক। চারটি নামের মধ্যে الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ এই দু’টি নাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অবিনশ্বরতা ও চিরস্থায়িত্বের জন্য। আর الظَّاهِرُوَالْبَاطِنُ এই দু’টি নাম দ্বারা আল্লাহ তাআলা মাখলুকের উপরে হওয়া ও তাদের নিকটে হওয়া বুঝায়।
সুতরাং আল্লাহ তাআলা ব্যতীত প্রথম থেকেই যেসব বস্ত্ত রয়েছে, তার প্রত্যেকটি বস্ত্ত সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই আল্লাহ তাআলা রয়েছেন। অর্থাৎ যেসব বস্ত্ত সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই আল্লাহ আছেন।[2] আর আল্লাহ ব্যতীত যত বস্ত্ত আছে, তার প্রত্যেকটি শেষ হওয়ার পরেও আল্লাহ তাআলা থাকবেন। সুতরাং আল্লাহই প্রথম এই কথার অর্থ হচ্ছে সবকিছুর পূর্বে আল্লাহ বিদ্যমান থাকা আর আল্লাহই শেষ, এ কথার অর্থ হচ্ছে সবকিছুর পর আল্লাহর অবশিষ্ট থাকা।[3]
আর আল্লাহ তাআলা الظاهر (প্রকাশমান) হওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি প্রত্যেক সৃষ্ট বস্ত্তর উপরে। الظهور থেকে আল্লাহ তাআলার জন্য الظاهر নামটি গ্রহণ করা হয়েছে। যুহুর শব্দটির ভাষাগত দাবী হচ্ছে উপরে হওয়া। বস্ত্তর উপরের অংশকেই যাহের বলা হয়।[4]
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বাতেন হওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি নিম্নজগতের (পৃথিবী ও তার মধ্যকার) প্রত্যেক সৃষ্টিকে এমনভাবে বেষ্টন করে আছেন যে, তিনি মাখলুকের আপন নফসের চেয়েও অধিক নিকটে। এটি হচ্ছে সকল সৃষ্টির নিকটবর্তী হওয়ার অর্থ।[5]
[1] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুয্ যিক্র ওয়াদ্ দু’আ। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আলউছাইমীন বলেছেন, الباطن অর্থ হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সমস্ত সৃষ্টির উপরে হওয়ার সাথে সাথে তিনি তাদের অতি নিকটে। মূলতঃ আল্লাহ তাআলার উপরে হওয়া মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়ার বিরোধী নয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়াকে আল্লাহর ইলম ও ক্ষমতা দ্বারা ব্যাখ্যা করা হলেও মূলত আল্লাহর জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আল্লাহর সিফাত ও কর্মকে মাখলুকের সিফাত ও কর্ম দ্বারা বুঝা অসম্ভব। কোন সৃষ্টির জন্য একই সময় ছাদের উপরে ও ছাদের নীচে সশরীরে থাকা এবং একই সময় সিংহাসনের উপরে থাকা ও সিংহাসনের নীচে থাকা অসম্ভব। কোন রাজা যখন তার সিংহাসন ছেড়ে বাইরে যায়, তখন তার সিংহাসন খালি হয়ে থাকে। কারণ তার জন্য একই সময় ও একই সাথে সিংহাসনে থাকা এবং দেশের বাইরে থাকার ধারণা অকল্পনীয়। কিন্তু সুমহান ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাআলার জন্য একই সময় ও একই সাথে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া এবং রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা অসম্ভব কিছু নয়। মাখলুকের নিকটবর্তী হলে আরশ খালি হওয়া জরুরী নয়। যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে, তারা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা দ্বারা আল্লাহর বিশাল সিফাত ও ক্ষমতাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছে বলেই বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে।
[1] - এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। তা এই যে, কুরআন মাজীদে জান্নাত ও জাহান্নাম বাসীদের জন্য যে চিরস্থায়ী জীবনের কথা বলা হয়েছে, তা কি ‘আল্লাহ তাআলাই সর্বশেষ’ এই কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
এই প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে যে, কোন সৃষ্টিরই নিজস্ব স্থায়িত্ব নেই। যদি কোন জিনিষ স্থায়ী হয় বা স্থায়ী থাকে তাহলে আল্লাহ তাআলা স্থায়ী রাখার কারণেই তা স্থায়ী হয় এবং থাকতে পারে। অন্যথায় আল্লাহ ছাড়া স্ব স্ব ক্ষেত্রে আর সবাই নশ্বর ও ধ্বংসশীল। আখেরাতে আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্টে জান্নাত বা দোযখ চিরস্থায়িত্ব লাভ করবে- এমনটি নয়। বরং সেখানে তার স্থায়িত্ব লাভ করার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা তাকে চিরস্থায়ী জীবন দান করবেন। ফেরেশতাদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। তারা আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্টে অবিনশ্বর নয়। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেছেন তখন তারা অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং যত সময় পর্যন্ত তিনি চাইবেন তত সময় পর্যন্তই তারা বেঁচে থাকবে। পরিশেষে ফেরেশতারাও ধ্বংস হবেন।
কিন্তু জান্নাতবাসীগণ ও জান্নাতের নেয়ামতসমূহে এবং জাহান্নামী কাফেররা ও জাহান্নামের আযাবে চিরকাল থাকার বিষয়টি কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল দ্বারা প্রমানিত।
[2] - ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ غَيْرُهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ وَكَتَبَ فِى الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ
‘‘আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিষ লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং আসমান ও যমীন সৃষ্টি করলেন। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩১৯১)
[3] - সৃষ্টিজগতের ছোট বড় প্রত্যেক বস্ত্তরই একটি সূচনা ও শুরু রয়েছে। সেই বস্ত্তটি যত পুরাতনই হোক কিংবা যার বয়স যতই বেশী হোক, তার একটা শুরু রয়েছে। অতীতের যে সময়টাতে তার সৃষ্টি হয়েছে, তার পূর্বে সেই বিষয়টির কোন অস্তীত্ব ছিলনা। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্ত্তর পূর্বেই আরেকটি সৃষ্ট বস্ত্ত রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে যেটিকে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অস্তীত্বহীন থেকে প্রথম অস্তীত্বে এসেছে। আল্লাহ তাআলাই সেটিকে প্রথম অস্তীত্বে এনেছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, আমার সৃষ্টির পূর্বে আমার কোন অস্তীত্ব ছিলনা, আপনার বেলাতেও না। পিতামাতার মাধ্যমে আমরা সৃষ্টি হয়েছি। এভাবে আদম (আঃ) পর্যন্ত গিয়ে মানব সৃষ্টির ক্রমধারা শেষ হয়। আদমকে আল্লাহ তাআলা অস্তিত্বহীন থেকে অস্তীত্বে এনেছেন। এমনি সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রে একই কথা। এই পৃথিবী কখন সৃষ্টি হয়েছে কিংবা এর বয়স কত বিজ্ঞানীরা অনুমান করে বললেও তার সঠিক বয়স আমরা জানিনা। কিন্তু এটি অতীতের নির্দিষ্ট এমন একটি সময়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, যার পূর্বে এই পৃথিবীর কোন অস্তীত্বই ছিলনা।
কিন্তু আল্লাহ তাআলার এমন কোন শুরু ও সূচনা নেই, যেখান থেকে তিনি অস্তীত্বে এসেছেন এবং যেই সময়ের পূর্বে তিনি ছিলেন না। কেননা তিনি হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা। তাই সকল সৃষ্টির পূর্বে তাঁর অস্তীত্ব থাকা এবং তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু ধ্বংস হওয়ার পরও তাঁর বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। এক কথায় তিনি সময়ের সীমারেখার অনেক উর্ধ্বে।
[4] - প্রত্যেক সৃষ্টি স্বীয় ফিতরাতের (প্রকৃতি ও সৃষ্টিগত স্বভাবের) দাবীতেই উপরের দিকে হাত উঠায়। এ বিষয়ে তাকে শিক্ষা না দেয়া হলেও সে উপরের দিকেই হাত উঠায়। হাত না উঠালেও অন্তর উপরের দিকে ধাবিত করে। কারণ সকল সৃষ্টির উপরে আল্লাহ তাআলা। আর সকল মাখলুক তাঁর নীচে। উপরের দিকে হাত উঠানো শুধু মানুষের সাথে খাস নয়। এমনকি জীবজন্তু এবং কীট-পতঙ্গও অনুভব করে যে, তার সৃষ্টিকর্তা ও রিযিক দাতা উপরে। তাই স্বীয় প্রয়োজনে সে উপরের দিকে হাত ও অন্তর ধাবিত করে।
ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী একদা মিম্বারে উঠে আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে দারস দিচ্ছিলেন এবং আল্লাহর যাত ও সিফাত সম্পর্কে মানুষের আকীদাহ কী হওয়া উচিৎ, তা শিখাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে ﴾ ﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহা: ৫) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি এর ব্যাখ্যা করতে করতে বলতে লাগলেন, كان الله ولاعرش وهو الآن على ما كان অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহই ছিলেন। তখন কোনো আরশ ছিল না। এখনো তিনি সেভাবেই আছেন, যেভাবে আরশ সৃষ্টির আগে ছিলেন।
ইমামুল হারামাইনের সেই দারসে উপস্থিত ছিলেন আবু জা’ফর আলহামদানী (রঃ)। হামদানী বলেন, আমি ইমামুল হারামাইনকে বললাম, আপনি যেদিকে ইঙ্গিত করছেন, আমি তা বুঝতে পেরেছি। তবে যেসব বিষয়ের ইলম অন্তরে দৃঢ়ভাবে বসে যায়, তুমি কি তা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সরাতে পারবে? কোনো মানুষই কি তা সরাতে পারে? প্রত্যেক মানুষই এমন কিছু বিষয় অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে, যা সে কখনোই অন্তর থেকে সরাতে পারে না।
এবার ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী হামদানীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এ কথার মানেটা কী? তুমি কোন্ দিকে ইঙ্গিত করছো? হামাদানী বলেন, আমি বললাম, দেখুন, যখনই কোনো আরেফ বিল্লাহ (আল্লাহতে বিশ্বাসী লোক) يا رب হে আল্লাহ! হে আমার রব বলে ডাক দেয়, তখন তার জবান চালু হওয়ার আগেই অন্তরের গভীরের ইচ্ছা ও প্রার্থনাটা ডানদিকে কিংবা বাম দিকে না গিয়ে সরাসরি উপরের দিকে উঠে যায়। আপনি কি অন্তরের এ জরুরী ইচ্ছাটা দূর করতে পারবেন? আরিফের (ভক্তের) অন্তরের এ তাওয়াজ্জুহ (ধাবিত হওয়া) দূর করার জন্য আপনার কোনো কৌশল জানা আছে কি? অন্তরের এ তাওয়াজ্জুহ আমরা কিভাবে দূর করবো? এটি দূর করার জন্য কোন যুক্তি-তর্ক যদি আপনার কাছে থাকে, তাহলে তা নিয়ে আসুন। আল্লাহ উপরে না নীচে, এই তর্ক থেকে আমরা বের হতে চাই।
এমনি আরো অনেক প্রশ্ন সম্ভবত হামদানী করেছিলেন, যা আমরা জানি না। পরিশেষে হামদানী বলেন, আপনি যদি আমাদের অন্তরকে উপরের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে ফিরাতে না পারেন, তাহলে আমরা মনে করবো যে, আপনি আল্লাহর যাত ও সিফাত সম্পর্কে এমন বিশ্বাস পোষণ করছেন এবং তা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন, যা যুক্তিবাদীরা মুসলিম জাতির নিকট আমদানী করেছে। আর আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং আমাদের অন্তর-মন তার বিরোধীতা করছে ও তা মেনে নিতে অস্বীকার করছে।
হামদানী বলেন, এ কথা বলার পর আমি কাঁদতে লাগলাম। মসজিদে উপস্থিত লোকেরাও কাঁদতে লাগলো। ঐদিকে ইমামুল হারামাইন তার জামার আস্তীন দ্বারা মিম্বারে আঘাত করতে লাগলেন এবং চিল্লানো শুরু করলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি, আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি ইত্যাদি বলতে বলতে তিনি তার শরীরের জামা খুলে ফেললেন এবং তা ছিড়ে ফেললেন। মসজিদে সেদিন যা হওয়ার তা হয়েই গেল। পরিশেষে হামদানীর প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই তিনি মিম্বার থেকে নেমে পড়লেন। তিনি শুধু একটি কথাই বার বার বলছিলেন, حيرني االهمداني حيرني الهمداني হামাদানী আমাকে হয়রান করে ফেলেছে, হামাদানী আমাকে হয়রান করে ফেলেছে।
ঘটনার সূত্র: ইমাম আলবানী (রঃ) এই ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ঘটনার সনদ সহীহ। হাফেযদের থেকে ধারাবাহিক সনদে তা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইবনে তাইমীয়া মাজমুআয়ে ফতোয়ার (৪/৪৪) এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উম্মতের নিকট নির্ভরযোগ্য অন্যান্য আলেম এ ঘটনা তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন।
উল্লেখ করা হয় যে, পরবর্তীতে ইমামুল হারামাইন তার আকীদাহ সংশোধন করে সালাফে সালেহীনের মাজহাবের দিকে ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহ তার উপর রহম করুন! আমীন।
পূর্বেই বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট দুআ করার সময় উপরের দিকে হাত উঠানো এবং নিজের প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তার কাছে পেশ করার সময় অন্তরকে উপরের দিকে ধাবিত করা শুধু মানুষের স্বভাব নয়; বরং অন্যান্য জীব-জন্তু এবং কীটপতঙ্গও প্রয়োজনের সময় উপরের দিকে হাত-পা ও অন্তর ধাবিত করে।
আল্লাহর নবী সুলায়মান বিন দাউদ (আঃ) একদা তাঁর অনুসারীদেরকে নিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য বের হলেন। পথিমধ্যে তিনি দেখলেন একটি পীপড়া চিৎ হয়ে পিঠের উপর শয়ন করে আকাশের দিকে পাগুলো উঠিয়ে আল্লাহর কাছে এ বলে বৃষ্টি প্রার্থনা করছে, اَللَّهُمَّ إِنَّا خَلْقٌ مِنْ خَلْقِكَ, لَيْسَ بِنَا غِنًى عَنْ سُقْيَاكَ হে আল্লাহ! আমরা তোমার সৃষ্টি। তোমার বৃষ্টির (রহমতের) পানি ছাড়া আমাদের বেচে থাকা সম্ভব নয়। পীপড়ার এ কথা শুনে তিনি ফেরত আসছিলেন। অনুসারীরা তাকে ফেরত আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তোমরা ফেরত যাও। কারণ অন্যদের দুআর বদৌলতেই তোমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হবে। তারা বললো, আমরা তো কাউকে দুআ করতে দেখিনি। তখন তিনি তাদেরকে আকাশের দিকে পা উঠিয়ে একটি পীপড়ার আল্লাহর কাছে বৃষ্টি চেয়ে দুআ করার কথা জানালেন। (সুবুলুস সালাম, হাদীছ নং- ৪৮৬)
এ হাদীছের উপর ভিত্তি করে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেন, এ পীপড়াটি এবং তার দলের অন্যান্য পীপড়াগুলো আল্লাহর সিফাতে অবিশ্বাসী জাহমীয়া সম্প্রদায়ের লোকদের চেয়ে আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে অধিক অবগত। আল্লামা শাইখ ডঃ সালেহ ফাওযান বলেন, জাহমীয়াদের চেয়ে পীপড়াই অধিক উত্তম।
[5] - সুতরাং কেউ যেন এরূপ মনে না করে, আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে থেকে তার কাজ-কর্ম এবং অন্তরের ইচ্ছা ও নিয়ত সম্পর্কে অবগত নন। আল্লাহ আরশের উপর থেকেও মাখলুকের সবকিছুই অবহিত। আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে হওয়া সৃষ্টির নিকটবর্তী হওয়ার পরিপন্থী নয়।
আল্লাহ্ তাআলার বাণী: আর তিনি সর্ব বিষয়ে অবগত: অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ইলম অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল বিষয়কে পূর্ণরূপে পরিবেষ্টন করে আছে। উর্ধ্ব জগতের এবং নিম্নজগতের কোন কিছু্ই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য সবকিছুই তিনি অবহিত। আসমান ও যমীনে একটি সরিষার দানা পরিমাণ জিনিষও তাঁর ইলম থেকে অনুপস্থিত নয়।
উপরের আয়াত থেকে আল্লাহর জন্য এমন চারটি সম্মানিত নাম সাব্যস্ত হলো, যার দাবী হচ্ছে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক সৃষ্টিকে ঘিরে আছেন। তিনি অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যৎ তথা সকল যামানা ও তার মধ্যে আল্লাহ যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তার সবকিছুকেই জ্ঞানের মাধ্যমে বেষ্টন করে আছেন। সেই সাথে সকল স্থান ও তাতে ছোট-বড় যত প্রকার মাখলুক রয়েছে, সে সম্পর্কেও তিনি অবহিত।
অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,
وقوله سبحانه ﴿وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ﴾ وقوله ﴿وَهُوَ الْحَكِيمُ الخَبِيْرُ﴾
আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘‘তুমি সেই চিরজীবন্ত সত্তার উপর ভরসা করো, যিনি কখনোই মৃত্যু বরণ করবেন না’’। (সূরা ফুরকানঃ ৫৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ তিনি প্রজ্ঞাবান ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা সাবাঃ ১)
ব্যাখ্যা: অর্থাৎ তোমার সকল বিষয় সেই চিরজীবন্ত সত্তার নিকট সোপর্দ করে দাও, যার কখনোই মৃত্যু হবে না।
التوكل (তাওয়াক্কুল)এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে التفويض তথা অন্যের নিকট কোন বস্ত্ত সোপর্দ করা। আরবরা বলে থাকে, وكلت أمري إلى فلان أي فوضته অর্থাৎ আমার বিষয়টি অমুকের নিকট সোপর্দ করলাম।
আর পরিভাষায় উপকারী বস্ত্ত অর্জন করার জন্য এবং ক্ষতিকর জিনিষ দূর করার জন্য অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে توكل বলা হয়। অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা এবাদতের অন্যতম একটি প্রকার। সুতরাং বান্দার সকল কাজে আল্লাহর উপর ভরসা করা অপরিহার্য।[1]
কল্যাণ অর্জনের জন্য কিংবা অকল্যাণ দূর করার জন্য উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা আল্লাহর উপর ভরসা করার পরিপন্থী নয়; বরং পরিশ্রম ও চেষ্টা করার সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করার পূর্ণ মিল রয়েছে। তাওয়াক্কুলের ব্যাপারে আল্লাহর হায়াতকে খাস করার মধ্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যিনি চিরজীবন্ত, কল্যাণ লাভের জন্য কেবল তাঁর উপরই ভরসা করা উচিৎ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ছাড়া অন্য কেউ চিরজীবন্ত নয় কিংবা অন্য কারো হায়াত চিরস্থায়ী নয়। মাখলুকের হায়াত যেহেতু মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যায়, তাই যে ব্যক্তি মাখলুকের উপর ভরসা করে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মোট কথা, এই আয়াতে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য হায়াতে কামেলা (পূর্ণাঙ্গ জীবন) সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং একই সাথে তাঁর পবিত্র সত্তার মৃত্যু হওয়াকে অস্বীকার করা হয়েছে। সুতরাং এই আয়াতের মধ্যেও আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করার বেলায় নফী ও ইছবাতকে একত্র করা হয়েছে।
[1] - শুধু তাই নয়, আল্লাহর উপর ভরসা করা ঈমান বিশুদ্ধ হওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন, ﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾ ‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো।’’ (সূরা মায়িদাঃ ২৩) কুরআনের আরো অনেক স্থানে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, মুমিনদের কেবল আল্লাহর উপরই ভরসা করা আবশ্যক। সুতরাং কল্যাণ অর্জনের নিয়তে কিংবা অকল্যাণ দূর করার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি তার অন্তরে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের সাথে সম্পর্ক কায়েম করল, সে বিনা সন্দেহে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক নির্ধারণ করল।
তবে দুনিয়ার কাজ-কর্ম অন্যকে দিয়ে সম্পাদন করানোকে অন্যের উপর توكل তথা ভরসা করা বলেনা। ইহাকে توكيل তথা উকীল বানানো বলা হয়। কোন মানুষকে উকীল বানিয়ে কর্ম সম্পাদন করা জায়েয। তবে উকীলের উপর ভরসা করা যাবেনা। উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য অন্তর দিয়ে কেবল আল্লাহর উপরই ভরসা করতে হবে।
وَهُوَ الْحَكِيمُ الخَبِيْرُ আল্লাহ তাআলা প্রজ্ঞাবান ও সর্বজ্ঞঃ আল্লাহ তাআলার অন্যতম নাম الحكيم এর দু’টি অর্থ রয়েছে। হাকীমের এক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা তাঁর মাখলুকের মধ্যে সৃষ্টিগত ও শরীয়তগত উভয় প্রকার আদেশের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে ফয়সালাকারী।
আর হাকীমের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে محكِم অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা পূর্ণ প্রজ্ঞাবান এবং সকল বস্ত্তকে যথাযথ স্থানে মজবুতভাবে স্থাপনকারী। সে হিসাবে এটি الحكمة থেকে গৃহীত। প্রত্যেক বিষয়কে তার নিজ নিজ স্থানে স্থাপন করাকে হিকমত বলা হয়। সুতরাং আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলাই তাঁর বান্দাদের মধ্যে ফয়সালাকারী। তিনি যা সৃষ্টি করেন এবং তাঁর সৃষ্টিকে তিনি যেই আদেশ করেন, তাতে রয়েছে আল্লাহ তাআলার বিশেষ একটি হিকমত (রহস্য ও উদ্দেশ্য)। আল্লাহ তাআলা কোন সৃষ্টিকেই অযথা সৃষ্টি করেননি। মানুষের জন্য যা কিছু কল্যাণকর, তিনি কেবল তাই ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
আল্লাহ তাআলার الخبير নামটি الخبرة থেকে গৃহীত। الخبرة অর্থ হলো বস্ত্তসমূহের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল অবস্থা জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে থাকা। বলা হয় خبرت الشيئ إذا عرفته على حقيقته আমি জিনিষটি সম্পর্কে অবগত আছি। ইহা আপনি ঠিক ঐ সময় বলে থাকেন, যখন আপনি উহাকে তার আসল অবস্থাসহ জানতে পারেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন الخبير অর্থাৎ তিনি এমন সত্তা, যিনি স্বীয় ইলম ও ক্ষমতার মাধ্যমে সকল বস্ত্তর অপ্রকাশ্য ও গোপন অবস্থা ঠিক সেভাবেই অবগত আছেন, যেভাবে তিনি সেগুলোর প্রকাশ্য অবস্থা সম্পর্কে অবহিত।[1] উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার সম্মানিত নামসমূহ থেকে দু’টি নাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। একটি হচ্ছে الحكيم (প্রজ্ঞাবান) অপরটি হচ্ছে الخبير (সর্বজ্ঞ)। একই সাথে এই নাম দু’টি আল্লাহর সিফাতসমূহ থেকে দু’টি সিফাতও সাব্যস্ত করছে। তা হচ্ছে হিকমত ও খিবরাত তথা আল্লাহ তাআলার প্রজ্ঞা ও চাক্ষুস জ্ঞান।
৩- إحاطة علمه بجميع مخلوقاته
আল্লাহ তাআলার ইলম সকল সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে:
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنزِلُ مِنْ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا﴾
‘‘তিনি জানেন যা যমীনে প্রবেশ করে, যা তা হতে বের হয় এবং আকাশ হতে যা অবতীর্ন হয় ও যা কিছু আকাশে উঠে। (সূরা সাবাঃ ২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لَا يَعْلَمُهَا إِلَّا هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ﴾
‘‘গায়েব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে। তিনি ছাড়া আর কেউ তা অবগত নয়, জলভাগের সবকিছুই তিনি অবগত রয়েছেন। তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরেনা এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারে এমন একটি শস্য দানাও নেই, যে সম্পর্কে তিনি অবগত নন। এমনিভাবে শুষ্ক ও আদ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। (সূরা আন-আম: ৫৯)
ব্যাখ্যাঃ যমীনে যা প্রবেশ করে, তার অন্যতম হচ্ছে বৃষ্টির পানি, শস্যের দানাসমূহ, গুপ্ত ধনসমূহ, মৃত ব্যক্তিদের লাশ ইত্যাদি। আর যমীন হতে যা বের হয় তার মধ্যে রয়েছে, উদ্ভিদ, বিভিন্ন খনিজ সম্পদ ইত্যাদি। আসমান থেকে যা নাযিল হয় তার মধ্যে রয়েছে বৃষ্টি, ফেরেশতা, আল্লাহর হুকুম-আহকাম এবং অন্যান্য বিষয়। আর বনী আদমের আমল ও আল্লাহর ফেরেশতাগণ আকাশে উঠে।
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ইলম সাব্যস্ত করা হয়েছে। সব কিছুকেই তিনি জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে আছেন।
وَعِنْدَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ ‘‘গায়েব বা অদৃশ্যের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছেঃ অর্থাৎ অদৃশ্যের ভান্ডারসমূহ অথবা গায়েব সম্পর্কে ইলম অর্জনের চাবিকাঠি একমাত্র আল্লাহর নিকটেই। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ উহা জানেনা। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলমে গায়েব থেকে কিছু জানার দাবী করল, সে কুফরী করল। বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছে গায়েবের চাবিসমূহের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
مفاتحُ الْغَيْبِ خَمْسٌ لا يَعْلَمُهَا إِلا اللَّهُ ثم قرأى هذه الأية ﴿إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ﴾
‘‘গায়েবের চাবি হচ্ছে পাঁচটি। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ তা জানেনা। কিয়ামতের জ্ঞান শুধু আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। গর্ভাশয়ে যা থাকে, তা তিনিই জানেন।[1] কেউ জানেনা, সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানেনা, সে কোন্ যমীনে মৃত্যু বরণ করবে’’। (সূরা লুকমানঃ ৩৪)
স্থলভাগে যা আছে তিনি তা জানেন। অর্থাৎ পৃথিবীর বসতী এলাকায় এবং খালী জায়গায় যে সমস্ত বাসিন্দা, উদ্ভিদ, প্রাণী এবং অন্যান্য যেসব রয়েছে, তা তিনি অবগত আছেন। এমনি জলভাগে যেসব প্রাণী, মূল্যবান মনি-মুক্তা এবং অনুরূপ মাখলুক রয়েছে, তাও তিনি জানেন।
وَمَا تَسْقُطُ مِنْ وَرَقَةٍ إِلَّا يَعْلَمُهَا তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরেনাঃ স্থলভাগ, জলভাগ এবং অন্যান্য স্থানের বৃক্ষসমূহের কোন পাতাই আল্লাহর অবগতি ছাড়া ঝরে পড়েনা। এমনি বৃক্ষের পাতাসমূহ কখন ও কোথায় পড়ে, তাও তিনি জানেন।
وَلَا حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الْأَرْضِ ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারে এমন একটি দানাও নেই, যে সম্পর্কে তিনি অবগত ননঃ অর্থাৎ যমীনের অন্ধকারচ্ছন্ন স্থানসমূহে কিংবা মাটির নীচের শস্যদানা বা ক্ষুদ্রতম দানা পরিমাণ বস্ত্ত সম্পর্কে তিনি অবগত।
وَلَا رَطْبٍ وَلَا يَابِسٍ إِلَّا فِي كِتَابٍ مُبِينٍ শুষ্ক ও আদ্র সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ আছেঃ অর্থাৎ সকল সৃষ্টি সম্পর্কেই তিনি অবগত। এটি خاص-এর পর عام স্বরূপ। অর্থাৎ প্রথমে কিছু খাস বস্ত্ত উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে যে, শুষ্ক ও আদ্র সকল বস্ত্ত সম্পর্কেই তিনি জানেন। এগুলো থেকে যাই হোক না কেন, তার সবই লাওহে মাহফুযে লিখিত রয়েছে।
উপরোক্ত আয়াতে সাব্যস্ত করা হয়েছে গায়েবের ইলম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে নেই। আল্লাহ তাআলার ইলম প্রত্যেক বস্ত্তকে পরিবেষ্টন করে আছে। এতে তাকদীর এবং লাওহে মাহফুযে তা লিখার কথাও প্রমাণিত হয়।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿وَاللَّهُ خَلَقَكُم مِّن تُرَابٍ ثُمَّ مِن نُّطْفَةٍ ثُمَّ جَعَلَكُمْ أَزْوَاجًا وَمَا تَحْمِلُ مِنْ أُنثَىٰ وَلَا تَضَعُ إِلَّا بِعِلْمِهِ ۚ وَمَا يُعَمَّرُ مِن مُّعَمَّرٍ وَلَا يُنقَصُ مِنْ عُمُرِهِ إِلَّا فِي كِتَابٍ ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾
‘‘আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তারপর শুক্র থেকে। এরপর তোমাদের জুটি বানিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর মধ্যে বন্ধন তৈরী করেছেন৷ কোন নারী গর্ভধারণ এবং সন্তান প্রসব করলে কেবল আল্লাহর জানা মতেই তা করে থাকে৷ কোন আয়ু লাভকারী আয়ু লাভ করলে এবং কারো আয়ু কিছু কম করা হলে তা অবশ্যই একটি কিতাবে লিখা আছে৷ আল্লাহর জন্য এসব খুবই সহজ’’।[2] (সূরা ফাতিরঃ ১১) আল্লাহ তাআলা সূরা তালাকের ১২ নং আয়াতে আরো বলেন,
﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا﴾
‘‘আল্লাহ সেই সত্তা, যিনি সাত আসমান বানিয়েছেন এবং যমীনের শ্রেণী থেকেও ঐগুলোর অনুরূপ৷ ঐগুলোর মধ্যে হুকুম নাযিল হতে থাকে৷ এ কথা তোমাদের এ জন্য বলা হচ্ছে, যাতে তোমরা জানতে পারো, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতা রাখেন এবং আল্লাহর জ্ঞান সব কিছুকে বেষ্টন করে আছে’’।
ব্যাখ্যা: অর্থাৎ আল্লাহর অবগতি ব্যতীত কোন নারী বা অন্য কোন প্রাণীর গর্ভধারণ এবং প্রসব হয়না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কোন জিনিষই আল্লাহর ইলম ও তদবীরের বাইরে নয়। কোন্ দিন কোন্ নারী বা অন্য কোন প্রাণীর গর্ভে সন্তান ও বাচ্চা আসবে, কোন্ দিন সে তা প্রসব করবে এবং ছেলে সন্তান প্রসব করবে? না মেয়ে সন্তান? আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাও জানেন।
لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবানঃ এখানে لام এর সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পূর্বোক্ত বাণীঃخَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ এর সাথে। অর্থাৎ তিনি সাত আসমান ও সাত যমীন সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা আল্লাহ তাআলার পূর্ণ ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারো।
وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا এবং যাতে আরো জানতে পারো যে, আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছেঃ অর্থাৎ যাতে তোমরা এই কথা জানতে পারো যে, আল্লাহর ইলম সবকিছুকে ঘিরে আছে। সৃষ্টির কোন কিছুই তাঁর ইলমের বাইরে নয়। সেটি যাই হোক না কেন।
علمٌا শব্দটি تمييز হিসাবে অথবা مفعول مطلق হিসাবে মানসুব হয়েছে। কেননা أحاط অর্থ علم যার অর্থ তিনি অবগত হয়েছেন।
উপরের দু’টি আয়াত থেকে আল্লাহর এমন ইলম প্রমাণিত হচ্ছে, সকল বস্ত্তকে পরিবেষ্টন করে আছে। সেই সাথে সকল বস্ত্তর উপর আল্লাহর ক্ষমতাও প্রমাণিত হলো।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿مَا أُرِيدُ مِنْهُم مِّن رِّزْقٍ وَمَا أُرِيدُ أَن يُطْعِمُونِ إِنَّ اللَّهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ﴾
‘‘আমি তাদের কাছে কোন রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাইনা৷ আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা, শক্তিধর ও প্রবল ক্ষমতার অধিকারী’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৭-৫৮)
ব্যাখ্যা: আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন রিযিক দাতা নেই। তিনি সকল সৃষ্টিকেই রিযিক দেন এবং তাদের কল্যাণে সবকিছুই সরবরাহ করেন। তিনি বিনা হিসাবে সকল প্রাণীর রিযিকের ব্যবস্থা করেন। সুতরাং তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যের এবাদত করোনা।
ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِينُ প্রবল শক্তিধর ও পরাক্রমশালী: অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা পূর্ণ শক্তির অধিকারী। তাঁর শক্তিতে কোন প্রকার দুর্বলতা অনুপ্রবেশ করতে পারেনা। আর المتين অর্থ হচ্ছে তিনি সর্বোচ্চ শক্তি ও প্রবল ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং তাঁর কাজে কোন কষ্ট, ক্লান্তি এবং দুর্বলতা অনুভব হয়না। আল্লাহ তাআলার المتين নামটি المتانة ক্রিয়ামূল থেকে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে কঠিন ও শক্তিমান হওয়া।
উপরোক্ত আয়াতে কারীমা থেকে আল্লাহর রায্যাক নামটি প্রমাণিত হলো। সেই সাথে আল্লাহ তাআলার জন্য এমন সিফাত তথা পূর্ণ শক্তি ও ক্ষমতা প্রমাণিত হলো যাতে কোন প্রকার দুর্বলতা ও ক্লান্তি আসতে পারেনা। একই সাথে এই আয়াতগুলো দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা আবশ্যক। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই।
[2] - অর্থাৎ যে ব্যক্তিই দুনিয়ায় জন্মলাভ করে তার সম্পর্কে প্রথমেই লিখে দেয়া হয় সে দুনিয়ায় কত বছর বাঁচবে। কেউ দীর্ঘায়ু হলে তা হয় আল্লাহর হুকুমে এবং স্বল্পায়ু হলেও হয় আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ী।
আমাদের সমাজের কতিপয় লোক বলে থাকে যে, পূর্বে নবজাত শিশুদের মৃত্যুর হার ছিল বেশী এবং বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি এ মৃত্যুর হার কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এই যুক্তি কেবল তখনই পেশ করা যেত যখন কোন উপায়ে আমরা জানতে পারতাম যে, আল্লাহ অমুক ব্যক্তির আয়ু লিখেছিলেন দু বছর এবং আমাদের চিকিৎসা উপকরণ তার বয়স ৫০ বছর বৃদ্ধি করে দিয়েছে। এ ধরনের কোন জ্ঞান যেহেতু কারো কাছে নেই, তাই সে কখনোই এই ধরণের কথা বলতে পারেনা। গণনার দিক দিয়ে শিশু মৃত্যুর হার এখন কমে গেছে অথবা আগের তুলনায় মানুষের গড় আয়ু এখন বেশী হচ্ছে, এটি একটি নিছক ধারণা মাত্র। সংখ্যা ও গণনা তথ্যের উপর ভিত্তি করে একথা বলা যায়না যে, মানুষ এবার আল্লাহর ফায়সালা বদলে দেবার শক্তি অর্জন করেছে। আল্লাহ বিভিন্ন যুগে জন্মলাভকারী মানুষের আয়ু বিভিন্নভাবে নির্ধারণ করেছেন। এটিও মহা পরাক্রমশালী আল্লাহর ফয়সালা যে, অমুক যুগে মানুষকে অমুক রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা দান করা হবে এবং অমুক যুগে মানুষকে জীবনী শক্তি বৃদ্ধির অমুক উপায় দান করা হবে। (আল্লাহই ভাল জানেন)
৪- إثبات السمع والبصر لله سبحانه وتعالى
৪- আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার শ্রবণ ও দৃষ্টি:
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر ‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শুরাঃ ১১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ ﴿إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সর্বোত্তম উপদেশ দান করেন৷ আর আল্লাহ সবকিছুই শোনেন ও দেখেন’’। (সূরা নিসাঃ ৫৮)
ব্যাখ্যা:وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر ليس كمثله شيئ এ আয়াতের প্রথম অংশ হচ্ছে﴿فَاطِرُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ جَعَلَ لَكُم مِّنْ أَنفُسِكُمْ أَزْوَاجًا وَمِنَ الْأَنْعَامِ أَزْوَاجًا يَذْرَؤُكُمْ فِيهِ﴾ ‘‘আল্লাহ তাআলা আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, তিনি তোমাদের নিজ থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, অনুরূপ অন্যান্য জীব-জন্তুর জোড়া বানিয়েছেন এবং এই নিয়মে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার ঘটান’’।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ যিনি সকল মানুষকে জোড়া জোড়া করে সৃষ্টি করেছেন এবং অনুরূপ অন্যান্য জীবজন্তুর জোড়া বানিয়েছেন, তার মত আর কিছুই নেই। কেননা তিনি সেই একক অমূখাপেক্ষী সত্তা, যার কোনো নযীর (সদৃশ) নেই। তিনি السميع (সর্বশ্রোতা), যিনি সকল ভাষার সকল আওয়াজই শুনেন। তিনি البصير (সর্বদ্রষ্টা), তিনি সবকিছুই দেখেন। আসমান ও যমীনের কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়।[1]
ইমাম শাওকানী (রঃ) তাঁর তাফসীরে বলেনঃ যে ব্যক্তি ভালভাবে এই আয়াতটি বুঝতে সক্ষম হবে এবং যথাযথভাবে তা নিয়ে গবেষণা করবে, আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে মতভেদকারীদের মতভেদ করা সত্ত্বেও সে উজ্জল ও সুস্পষ্ট পথে চলতে পারবে। সে যদি আল্লাহর বাণী: وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر (তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা) নিয়ে চিন্তা করে, তাহলে তার জ্ঞান আরো বৃদ্ধি পাবে। কেননা আল্লাহর অনুরূপ কোন জিনিষ হওয়াকে পরিহার করার পর আল্লাহর জন্য উপরোক্ত দু’টি নাম ও সিফাত সাব্যস্ত করার দ্বারা আল্লাহর আসমা ও সিফাতের প্রতি বিশ্বাস মুমিনের অন্তরে প্রশান্তি আনয়ন করে, অন্তর থেকে সকল ব্যাধি সরিয়ে দেয় এবং হৃদয়কে শীতল করে তুলে।
সুতরাং হে সত্যের সন্ধানী! তুমি এই উজ্জল প্রমাণ এবং মজবুত দলীলের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করো। এর মাধ্যমেই তুমি অনেক বিদআতকে ভেঙ্গে চুরমার করতে পারবে, গোমরাহীর ইমামদের ভিত্তিকে ধ্বংস করতে পারবে এবং যুক্তিবাদীদের নাকে মাটি লাগাতে পারবে। বিশেষ করে যখন তুমি আল্লাহ তাআলার এই বাণীকে তার সাথে যুক্ত করবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃيَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا তিনি লোকদের সামনের ও পেছনের সব অবস্থা জানেন। তারা তাদের জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে পারবেনা।
[1] - আল্লাহর শ্রবণ ও দৃষ্টি সম্পর্কে নিম্নে আরো কয়েকটি আয়াত উল্লেখ করা হলো। আওস ইবনে সাবেতের স্ত্রী খাওলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿قَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّتِي تُجَادِلُكَ فِي زَوْجِهَا وَتَشْتَكِي إِلَى اللَّهِ وَاللَّهُ يَسْمَعُ تَحَاوُرَكُمَا إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾
‘‘যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে তোমার সাথে বাদানুবাদ করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহর দরবারে, আল্লাহ তার কথা শুনেছেন। আল্লাহ তোমাদের উভয়ের কথা শুনেন। সব কিছু দেখেন এবং শুনেন’’। (সূরা মুজাদালাহঃ ০১) আল্লাহ ইহুদীদের প্রতিবাদ করে বলেনঃ
﴿لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمْ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ﴾
‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে যে, আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্ত আর আমরা বিত্তবান। এখন আমি তাদের কথা এবং যেসব নবীকে তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, তা লিখে রাখব, অতঃপর বলবঃ ‘আস্বাদন কর জ্বলন্ত আগুনের আযাব। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿أَمْ يَحْسَبُونَ أَنَّا لَا نَسْمَعُ سِرَّهُمْ وَنَجْوَاهُمْ بَلَى وَرُسُلُنَا لَدَيْهِمْ يَكْتُبُونَ﴾
‘‘তারা কি মনে করে যে আমি তাদের গোপন বিষয় গোপন পরামর্শ শুনিনা? হাঁ, শুনি। আমার প্রেরিত দূতগণ তাদের নিকটে থেকে লিপিবদ্ধ করে’’। (যুখরুফঃ ৮০) আল্লাহ তা’লা মূসা ও তাঁর ভাই হারূন (আঃ)কে লক্ষ্য করে বলেন: قَالَ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمَا أَسْمَعُ وَأَرَى ‘‘আল্লাহ বললেনঃ তোমরা ভয় করনা, আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি শুনি ও দেখি। (সূরা তোহা: ৪৬)
উপরোক্ত আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, বাস্তবেই আল্লাহর শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি রয়েছে। তবে তাঁর দেখা ও শুনা কোন সৃষ্টিজীবের মত নয়। কোন মানুষ যখন বন্ধ ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে তখন সে বাহিরের কিছুই দেখতে পায়না এবং বাহিরের কোন কথাও শুনতে পায়না। কিন্তু মহান আল্লাহ আরশের উপর থেকে মাখলুকের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বস্ত্তই দেখতে পান এবং সকল কথাই শুনেন।
إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُم بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সর্বোত্তম উপদেশ দান করেন৷ আর আল্লাহ সবকিছুই শোনেন ও দেখেনঃ এটি সূরা নিসার ৫৮ নং আয়াতের শেষাংশ। পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে,
﴿إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَى أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا﴾
‘‘হে মুসলিমগণ! আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেবার নির্দেশ দিচ্ছেন৷ আর লোকদের মধ্যে ফায়সালা করার সময় ‘‘আদল’’ ও ন্যায়নীতি সহকারে ফায়সালা করো৷ আল্লাহ তোমাদের বড়ই উৎকৃষ্ট উপদেশ দান করেন৷ আর আল্লাহ সবকিছুই শোনেন ও দেখেন’’।
نعم শব্দটি প্রশংসার জন্য ব্যবহৃত শব্দসমূহের অন্যতম। এর শেষে যুক্ত ما সম্পর্কে একাধিক কথা রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন এটি হচ্ছে نكرة موصوفة। সম্ভবত বাক্যটি এ রকম ছিল, نعم شيئا يعظكم به একটি উত্তম বিষয় দ্বারা তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন।
কেউ কেউ বলেছেন এখানে ما মাওসুল হিসাবে এসেছে। আসল বাক্যটি এ রকম ছিল, نعم الشيئ الذي يعظكم به অর্থাৎ যেই বিষয়টি দ্বারা তোমাদেরকে উপদেশ দেয়া হচ্ছে, তা কতই না উত্তম! يعظكم (উপদেশ দিচ্ছেন) অর্থ হলো তিনি তোমাদেরকে আমানত আদায় করার এবং মানুষের মাঝে ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করার আদেশ দিচ্ছেন।
إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টাঃ অর্থাৎ তোমরা যা কিছু বল আল্লাহ তাআলা তা শুনেন এবং যা কিছু করো, তা তিনি দেখেন।
উপরের আয়াত দু’টি থেকে আল্লাহর শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রমাণিত হলো। আয়াত দু’টির প্রথমটিতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা কোন মাখলুকের অনুরূপ নন এবং তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। উহাতে আল্লাহ তাআলার সিফাতের ক্ষেত্রে নফী ও ইছবাতকে একত্র করা হয়েছে। অর্থাৎ একই সাথে আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তা হতে ত্রুটি ও দোষযুক্ত বৈশিষ্টগুলো পরিহার করা হয়েছে এবং তাঁর যাতে পাকের জন্য অতি উত্তম ও সুউচ্চ গুণাবলী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৫- إثبات المشيئة والإرادة لله سبحانه وتعالى
৫- আল্লাহ তাআলার জন্য ইচ্ছা বিশেষণ সাব্যস্ত করা:
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿وَلَوْلَا إِذْ دَخَلْتَ جَنَّتَكَ قُلْتَ مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ﴾
‘‘তুমি যখন তোমার বাগানে প্রবেশ করলে তখন মাশা-আল্লাহ (আললাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে) বললে না কেন? আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন শক্তি নেই’’।[1] (সূরা কাহাফঃ ৩৯) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلَ الَّذِينَ مِن بَعْدِهِم مِّن بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَلَٰكِنِ اخْتَلَفُوا فَمِنْهُم مَّنْ آمَنَ وَمِنْهُم مَّن كَفَرَ ۚ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا وَلَٰكِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يُرِيدُ﴾
‘‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে রাসূলদের আগমণের পর এবং তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ আসার পর তারা কখনো পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হতোনা। কিন্তু তারা পরস্পর মতবিরোধ করলো, তারপর তাদের মধ্য থেকে কেউ ঈমান আনলো আর কেউ কুফরীর পথ অবলম্বন করলো৷ আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা কখনো যুদ্ধে লিপ্ত হতোনা, কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ ۗ إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ﴾
‘‘তোমাদের জন্য চতুষ্পদ গৃহপালিত সব পশুই হালাল করা হয়েছে। তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের জানানো হবে সেগুলো ছাড়া৷ কিন্তু ইহ্রাম অবস্থায় শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়োনা৷ নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেন’’। (সূরা মায়িদাঃ ১)
ব্যাখ্যাঃ لَوْلاَ শব্দটি এখানে هلا অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ তুমি তোমার বাগানে প্রবেশ করার সময় مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ বললেনা কেন? অর্থাৎ আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার সামনে তোমার নিজের অক্ষমতা ও অপারগতা প্রকাশ করতঃ আল্লাহর জন্য পূর্ণ ক্ষমতার স্বীকৃতি দিয়ে এই কথা বললেনা কেন যে, আল্লাহ যা চেয়েছেন, তাই হয়েছে।
কোন কোন সালাফ বলেছেন, যার কাছে কোন জিনিষ ভাল লাগে, সে যেন বলেمَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ
وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতো না: অর্থাৎ আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলা যদি ইচ্ছা করতেন, তারা যুদ্ধ না করুক, তাহলে তারা পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ করতনা। কেননা আল্লাহর রাজ্যে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছু হওয়া অসম্ভব। আল্লাহর হুকুম প্রতিহত করার মত কেউ নেই এবং তাঁর ফয়সালা ঠেকানোরও কেউ নেই।[2]
أُحِلَّتْ لَكُم بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ তোমাদের জন্য চতুষ্পদ গৃহপালিত সব পশুই হালাল করা হয়েছে: এখানে মুমিনদেরকে লক্ষ্য করে এই কথা বলা হয়েছে। চতুষ্পদ গৃহপালিত পশু বলতে এখানে উট, গরু, ছাগল এবং ভেড়া উদ্দেশ্য।
إِلَّا مَا يُتْلَىٰ عَلَيْكُمْ তবে সামনে যেগুলো সম্পর্কে তোমাদের জানানো হবে সেগুলো ছাড়াঃ এই বাক্যটি بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ থেকে মুস্তাছনা বা স্বতন্ত্র অর্থাৎ যেগুলোর আলোচনা সামনে আসছে, সেগুলোর মাংস খাওয়া তোমাদের জন্য হালাল নয়। ঐ হারাম পশুগুলো উক্ত আয়াতের সামান্য পরেই অর্থাৎ ৩নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
﴿حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَن تَسْتَقْسِمُوا بِالْأَزْلَامِ ۚ ذَٰلِكُمْ فِسْقٌ ۗ الْيَوْمَ يَئِسَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن دِينِكُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ ۚ الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ۚ فَمَنِ اضْطُرَّ فِي مَخْمَصَةٍ غَيْرَ مُتَجَانِفٍ لِّإِثْمٍ ۙ فَإِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ﴾
‘‘তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে মৃতজীব, রক্ত, শূকরের গোশ্ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর নামে যবেহকৃত প্রাণী এবং কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে, আহত হয়ে, উপর থেকে পড়ে গিয়ে বা ধাক্কা খেয়ে মরা অথবা কোন হিংস্র প্রাণী চিরে ফেলেছে এমন প্রাণী, তবে তোমরা জীবিত পেয়ে যাকে যবেহ করেছ সেটি ছাড়া৷ আর যা কোন বেদীমূলে (পূজার ঘরে, অলী-আওলীয়ার নামে, কবর ও মাজারের উদ্দেশ্যে) যবেহ করা হয়েছে তাও তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও শুভ-অশুভ নির্ধারনের তীর নিক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নির্ণয় করাও তোমাদের জন্য জায়েয নয়৷ এগুলো ফাসেকী তথা আনুগত্য বহির্ভূত কাজ৷ আজ তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে কাফেররা পুরোপুরি নিরাশ হয়ে পড়েছে৷ কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করোনা বরং আমাকে ভয় করো৷ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে পছন্দ করে নিয়েছি (কাজেই তোমাদের উপর হালাল ও হারামের যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা মেনে চলো৷) তবে যদি কোন ব্যক্তি ক্ষুধার জ্বালায় বাধ্য হয়ে ঐগুলোর মধ্য থেকে কোন একটি জিনিষ খেয়ে নেয় গুনাহের প্রতি কোন আকর্ষণ ছাড়াই, তাহলে নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী’’।
غَيْرَ مُحِلِّي الصَّيْدِ وَأَنتُمْ حُرُمٌ কিন্তু ইহ্রাম বাধাঁ অবস্থায় শিকার করা নিজেদের জন্য হালাল করে নিয়োনাঃ এই বাক্যটি بَهِيمَةُ الْأَنْعَامِ থেকে আরেকটি স্বতন্ত্র বিষয়। অর্থাৎ গৃহপালিত চতুষ্পদ সব জন্তুই তোমাদের জন্য হালাল। তবে এগুলো থেকে যেগুলো বন্য, সেগুলো শিকার করে ভক্ষণ করাও হালাল। কিন্তু যখন তোমরা ইহরাম অবস্থায় থাকবে, তখন এগুলো শিকার করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। আল্লাহর বাণীঃ وأنتم حرم হাল (অবস্থা জ্ঞাপক) হিসাবে নসব বা যবরের স্থানে রয়েছে। যারা হজ্জ কিংবা উমরাহ অথবা উভয়টির ইহরাম বেঁধেছে, তাদেরকে حرم বলা হয়। ইহা محرم এর বহুবচন।
إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ مَا يُرِيدُ নিঃসন্দেহে আল্লাহ যা ইচ্ছা আদেশ করেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ যা ইচ্ছা হালাল করেন এবং যা ইচ্ছা হারাম করেন।[3] তাঁর ইচ্ছায় ও কর্মে আপত্তি উত্থাপন করার কেউ নেই।
উপরের আয়াতগুলোতে আল্লাহর সিফাত হিসাবে ইচ্ছা, শক্তি এবং আদেশ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এগুলো আল্লাহ তাআলার অন্যতম সিফাত। আল্লাহর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই এগুলো তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা জরুরী।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَٰلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ﴾
‘‘আল্লাহ যাকে সত্যপথ দেখাবার ইচ্ছা করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন৷ আর যাকে তিনি গোমরাহীতে নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ খুব সংকীর্ণ করে দেন। যাতে মনে হয় সে কষ্ট করে আকাশের দিকে উঠার চেষ্টা করছে। এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা অবিশ্বাসীদের উপর অপবিত্রতা চাপিয়ে দেন’’। (সূরা আনআমঃ ১২৫) অর্থাৎ জোর খাটিয়ে যেমন আকাশের দিকে উঠা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি আল্লাহ যার বক্ষকে সংকীর্ণ করে দেন তার মধ্যে ঈমান ও তাওহীদের আলো ঢুকানো সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা তার বক্ষকে ইসলামের জন্য খুলে না দেয়া পর্যন্ত তাতে ঈমান ও তাওহীদ প্রবেশ করেনা।
ব্যাখ্যা: فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ আল্লাহ যাকে সত্যপথ দেখাবার ইচ্ছা করেনঃ অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যাকে ঈমান ও তাওহীদ কবুলের তাওফীক দেন এবং তার অন্তরকে সত্য কবুলের জন্য উপযুক্ত করেন, তার অন্তরকে উহার জন্য প্রশস্ত করে দেন।[4] منْ শব্দটি فعل مضارع কে জযমদাতা এবং ইসমে শর্ত। يُرِدْ -ফেলে মুযারেটি ফেলে শর্ত হিসাবে জযম যুক্ত। আর يشرح صدره للإسلام বাক্যটি শর্তের জবাব হিসাবে مجزوم (জযম যুক্ত)। الشرح অর্থ হচ্ছে الشق (বিদীর্ণ করা, চেরা, ফাটানো ইত্যাদি)। এর মূল অর্থ হচ্ছে التوسعة (প্রশস্ত করা)। বলা হয়ে থাকে شرحت الأمر তথা বিষয়টিকে প্রশস্ত করলাম। এই কথা আপনি ঠিক ঐ সময় বলেন, যখন আপনি তা প্রশস্ত করে বর্ণনা করেন এবং খোলাখুলি বয়ান করেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যাকে ঈমান ও তাওহীদ কবুলের তাওফীক দেন এবং তার অন্তরকে সত্য কবুলের জন্য উপযুক্ত করেন, তার অন্তরকে আল্লাহ তাআলা সত্য দ্বীন ইসলামের জন্য উন্মুক্ত ও প্রশস্ত করে দেন। এর ফলে সে উন্মুক্ত হৃদয়ে ইসলাম কবুল করে নেয়।
আর যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সত্য কবুল করা হতে ফিরিয়ে রাখতে চান, তার অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেন। ফলে তা সত্য কবুল করার জন্য উন্মুক্ত হয়না। حرجا অর্থাৎ একদম সংকীর্ণ করে দেন, যার ফলে অন্তরে ঈমান ও হেদায়াত প্রবেশের কোন রাস্তাই থাকেনা। ضيقا শব্দের অর্থকে জোরালো করার জন্য حرجا শব্দটি আনয়ন করা হয়েছে।
كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ মনে হয় সে কষ্ট করে আকাশের দিকে উঠার চেষ্টা করছেঃ يصعد শব্দটি মূলতঃ يتصعد ছিল। تا-কে সোয়াদ দ্বারা পরিবর্তন করে সোয়াদের মধ্যে ইদগাম করা হয়েছে। অর্থাৎ যার অন্তরকে সংকীর্ণ করে দেয়া হয়েছে, তার জন্য হেদায়াত কবুল করে নেয়ার বিষয়টি ঠিক ঐ ব্যক্তির ন্যায় কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কোন অসম্ভব কাজ সম্পাদন করার জন্য বার বার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে তা সম্পাদন করতে পারছেনা। যেমন কেউ আকাশে উঠার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। যেই কাফেরের উপর ঈমান কবুল করে নেয়া খুব ভারী অনুভব হয়, তাকে ঐ ব্যক্তির সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে আকাশে উঠার মত সাধ্যাতীত কাজ সম্পাদন করতে চায়।
উপরের আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য ইরাদাহ (ইচ্ছা) সাব্যস্ত হলো। কাউকে হেদায়াত করা আবার কাউকে গোমরাহ করা উভয়টিই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হেদায়াতের ইচ্ছা করেন। বিশেষ উদ্দেশ্যে আবার কারো জন্য অমোঘ বিধানগত দিক থেকে গোমরাহীরও ইচ্ছা করেন।[5] অর্থাৎ যার অন্তরে ঈমান ও হেদায়াতের প্রতি কোন আগ্রহ থাকেনা এবং যে ব্যক্তি নবী-রাসূলদের দ্বীনকে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাকে হেদায়াত থেকে মাহরুম করে দেন।
[1] - সূরা কাহাফের ৩২ নং থেকে ৪৩ নং আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তাআলা মক্কাবাসী হঠকারী কাফেরদের জন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। যুগে যুগে যে কোন অহংকারী, আল্লাহদ্রোহী এবং পরকালীন জীবনে অবিশ্বাসীর জন্য এটি একটি বিরাট শিক্ষণীয় ঘটনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা আসেনি। সুতরাং কুরআন যা বলেছে, তার অতিরিক্ত কিছু যুক্ত করার কোন সুযোগ নেই। তাই আমরা ইসরাঈলী কিংবা দুর্বল বর্ণনা পরিত্যাগ করে শুধু কুরআনের আলোকে সেই ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করবো।
কুরআন বলছে, অতীতকালে দু’জন লোক ছিল। তাদের মধ্যে আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কও ছিল। তাদের একজন ছিল মুমিন এবং অন্যজন ছিল কাফের। তবে কুরআন ও হাদীছ তাদের নাম, তারা কোথায় এবং কোন সময় ছিল, তা বলেনি।
মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার ধন-সম্পদ থেকে তেমন কিছু না দিলেও তাকে দিয়েছিলেন সর্ববৃহৎ একটি নেয়ামত। তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসী, তাঁর ফয়সালা ও তকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট এবং আখেরাতে আল্লাহর নেয়ামত অর্জনই ছিল তার সকল কাজ-কর্ম ও চিন্তা-চেতনার মূলকেন্দ্র বিন্দু। মূলতঃ এটি এমন সম্পদ, যা দুনিয়ার কোন মূল্য দ্বারাই মূল্যায়ন করা যায়না।
তার সেই কাফের বন্ধুটির জন্য আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন। তার ছিল প্রচুর সম্পদ, বাগ-বাগিচা এবং সন্তান-সন্ততি। কোন মানুষকে এ সবকিছু দেয়ার পিছনে আল্লাহ তাআলার হিকমত ও ইচ্ছা হলো তিনি তাকে পরীক্ষা করতে চান। সে কি এগুলো পেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে? না কি অকৃতজ্ঞ হয়? সে কি সীমালংঘন করে? না কি আল্লাহর আনুগত্য করে?
আল্লাহ তাআলা সেই অবিশ্বাসী লোকটিকে দু’টি বাগান দিয়েছিলেন। বাগানে ছিল আঙ্গুর, খেজুরসহ বিভিন্ন ফলমূলের বৃক্ষাদি। বাগানের মধ্যে ঝর্ণাও প্রবাহিত ছিল। আল্লাহ তাআলা এই বাগান দু’টির বর্ণনা দিয়ে বলেনঃ
﴿جَعَلْنَا لِأَحَدِهِمَا جَنَّتَيْنِ مِنْ أَعْنَابٍ وَحَفَفْنَاهُمَا بِنَخْلٍ وَجَعَلْنَا بَيْنَهُمَا زَرْعًا كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا وَلَمْ تَظْلِم مِّنْهُ شَيْئًا ۚ وَفَجَّرْنَا خِلَالَهُمَا نَهَرًا﴾
‘‘তাদের একজনকে আমি দুটি আংগুর বাগান দিয়েছিলাম এবং সেগুলোর চারদিকে খেজুর গাছের বেড়া দিয়েছিলাম আর তার মাঝখানে রেখেছিলাম কৃষি ক্ষেত৷ দুটি বাগানই ভালো ফল দান করতো এবং ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে তারা সামান্যও ত্রুটি করতোনা৷ এ বাগান দুটির মধ্যে আমি একটি নদী প্রবাহিত করেছিলাম’’। (সূরা কাহাফঃ ৩২-৩৩)
এসব কিছু পেয়ে একদিন সে তার দরিদ্র ভাইয়ের সাথে কথা প্রসংগে বললো, ‘‘আমি তোমার চেয়ে বেশী ধনশালী এবং আমার জনশক্তি তোমার চেয়ে বেশী৷ অহংকার ও গর্বের সাথে এ সব কথা বলতে বলতে সে তাকে নিয়ে বাগানে প্রবেশ করল। সে বলতে লাগলঃ এগুলো সবসময়ই আমার কাছে থাকবে, আমি মনে করিনা যে, আমার এই সম্পদগুলো কোন দিন ধ্বংস হবে। তার দাপট ও অহংকার এখানেই শেষ হলোনা; বরং সে অহংকার বশত কিয়ামতকেও অস্বীকার করে বললঃ আমি মনে করিনা যে, কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। সে আরো বললঃ কিয়ামত যদিও সংঘটিত হয় এবং আমাকে যদি কখনো আমার রবের সামনে ফিরিয়ে নেয়া হয় তাহলে নিশ্চয়ই আমি এর চেয়েও বেশী জমকালো জায়গা পাবো৷ যদি পরকাল থেকেই থাকে তাহলে আমি সেখানে এখানকার চেয়েও বেশী সচ্ছল থাকবো। কারণ এখানে আমার সচ্ছল ও ধনাঢ্য হওয়া একথাই প্রমাণ করে যে, আমি আল্লাহর প্রিয়।
দুনিয়া পূজারী আখেরাতে অবিশ্বাসী লোকদের অবস্থা এ রকমই হয়ে থাকে। তারা দুনিয়ার ভোগসামগ্রী পেয়ে আখেরাতকে ভুলে যায়। সে মনে করে, তার সম্পদ তাকে চিরস্থায়ী করে রাখবে এবং তার ধন-সম্পদ কখনো শেষ হবেনা।
যাই হোক তার দরিদ্র সাথী কথাবার্তার মধ্যে তাকে বললো, ‘‘তুমি কি কুফরী করছো সেই সত্তার সাথে যিনি তোমাকে মাটি থেকে তারপর শুক্র থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাকে একটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ বানিয়ে দাঁড় করিয়েছেন? আর আমার ব্যাপারে বলবো, আমার রব তো সেই আল্লাহই এবং আমি তার সাথে কাউকে শরীক করিনা৷
এবার দরীদ্র বন্ধু বাগান ওয়ালাকে নসীহত করতে গিয়ে বললঃ বরং তোমার উচিৎ ছিল যেই আল্লাহ তোমাকে এই সম্পদ দিয়েছেন, তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং অহংকার বর্জন করা। তোমার সম্পদ টিকিয়ে রাখার জন্য এবং তোমার রবকে খুশী করার এটিই একমাত্র উত্তম পন্থা। আর যখন তুমি নিজের বাগানে প্রবেশ করছিলে তখন একথা বলা উচিৎ ছিল, مَا شَاءَ اللَّهُ لَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللَّهِ ‘‘আল্লাহ যা চান তাই হয়, তাঁর প্রদত্ত শক্তি ছাড়া আর কোনো শক্তি নেই।
এরপর মুমিন লোকটি তার সাথীকে অহংকার, সীমালংঘন ও তাকাববরী করার ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললঃ আর তুমি যদি সম্পদ ও সন্তানের দিক দিয়ে আমাকে তোমার চেয়ে কম পেয়ে থাকো, তাহলে জেনে রেখো আল্লাহ তাআলা সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান। এটি অসম্ভব নয় যে, আমার রব আমাকে তোমার বাগানের চেয়ে ভালো কিছু দেবেন এবং তোমার বাগানের উপর আকাশ থেকে এমন কোনো আপদ পাঠাবেন, যার ফলে তোমার বাগান দু’টি বৃক্ষলতাহীন প্রান্তরে পরিণত হবে৷ অথবা তোমার বাগানের নদীর পানি ভূগর্ভে নেমে যাবে এবং তুমি তাকে কোনোক্রমেই উঠাতে পারবেনা৷
পরিশেষে তার বাগানের উপর বিরাট এক বিপর্যয় চলে আসল। চতুর্দিক থেকে বিপদ এসে বাগানের সমস্ত ফল ও ফসল বিনষ্ট করল এবং সে নিজের বাগানকে লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে থাকতে দেখে নিজের নিয়োজিত পুঁজির জন্য আফসোস করতে থাকলো এবং বলতে লাগলো, ‘‘হায়! যদি আমি আমার রবের সাথে কাউকে শরীক না করতাম’’৷
এবার সে তার পূর্বোক্ত কথার জন্য অনুতপ্ত হলো। সে সময় আল্লাহ ছাড়া তাকে সাহায্য করার মতো কোনো গোষ্ঠীও ছিলনা, আর সে নিজেও এ বিপদের মুকাবেলা করতে সক্ষম ছিল না৷
[2] - অর্থাৎ রাসূলদের মাধ্যমে তাওহীদ, রেসালাত এবং শরীয়তের জ্ঞান লাভ করার পরও মানুষের মধ্যে যে কুফরী ও পাপাচার, সীমালংঘন দেখা যাচ্ছে, ও মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এবং মতবিরোধ থেকে আরো এগিয়ে গিয়ে ব্যাপক যুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছে, এর কারণ এ ছিলনা যে, (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ তাদেরকে তা থেকে বিরত রাখতে অক্ষম ছিলেন। পৃথিবীতে যে কুফুরী, সীমালংঘন, আল্লাহর নাফরমানী, যুলুম ও মতবিরোধ যুদ্ধ-বিগ্রহ হচ্ছে তা থেকে মানুষকে বিরত রাখার পরিপূর্ণ শক্তি আল্লাহ তাআলার রয়েছে। তিনি চাইলে নবীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সাধ্য কারো ছিল না। কেউ কুফরী ও বিদ্রোহের পথে চলতে পারতোনা। আল্লাহর দুনিয়ায় বিপর্যয় সৃষ্টি করার ক্ষমতা কারো থাকতোনা। তবে মানুষের কাছ থেকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি ছিনিয়ে নিয়ে তাকে আনুগত্যের পথ অবলম্বন করতে বাধ্য করা তাঁর ইচ্ছাই ছিলনা। তিনি পরীক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে মানুষকে এ পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। তাই তাকে বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে নির্বাচন ও বাছাই করার স্বাধীনতা দান করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় ঈমান ও আনুগত্যের পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়। নবী-রাসূলদেরকে তিনি মানুষের উপর দারোগা বানিয়ে পাঠাননি। কিন্তু মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অপব্যবহার করেছে এবং আল্লাহর আনুগত্যের পথ বর্জন করে কুফরী ও সীমালংঘনকেই বেছে নিচ্ছে। ঐদিকে নবী-রাসূলগণ তাদেরকে জোর জবরদস্তি করে তাদেরকে ঈমান ও আনুগত্যের পথে টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেননি। কারণ জোর করে আনুগত্যের পথে এনে তাদেরকে দিয়ে আনুগত্যের কাজ করিয়ে নিয়ে পুরস্কার দেয়ারও কোন অর্থ হয়না। বরং নবীদেরকে তিনি পাঠান যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আহবান জানাবার জন্য। সুতরাং যারা জেনেবুঝে এবং আল্লাহ প্রদত্ত ইচ্ছা শক্তিকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে আল্লাহর পছন্দনীয় কাজে আত্মনিয়োগ করবে, তাদেরকে তিনি অফুরন্ত নেয়ামত দান করবেন। আর যারা নিজেদের ইচ্ছা ও স্বাধীনতাকে বিপথে পরিচালিত করবে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই আল্লাহ তাদেরকে পরকালে শাস্তি দিবেন।
কাজেই পৃথিবীতে যত যুলুম, পাপকাজ, মতবিরোধ ও যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে, তার পেছনে একটি মাত্র বিষয় কাজ করেছে যে, আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দান করেছেন। আর মানুষ স্বীয় ইচ্ছা শক্তি, বিবেক-বুদ্ধি ও স্বাধীনতা দিয়ে ভাল-মন্দের যে কোন একটি নির্বাচন করে বলেই কিয়ামতের দিন তাকে পুরস্কার বা শাস্তি দেয়া আল্লাহর জন্য ইনসাফপূর্ণ হবে। তিনি যদি সৎকাজে বাধ্য করে পুরস্কার দেন কিংবা অন্যায় কাজ যদি শুধু আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয় (নাউযুবিল্লাহ) এবং এতে যদি বান্দার কোন ইচ্ছা, স্বাধীনতা ও সংকল্প না থাকে, তাহলে পাপকাজ করার কারণে কাউকে শাস্তি দেয়া আল্লাহর জন্য যুলুম বলে বিবেচিত হত এবং আল্লাহর আদলের ব্যাঘাত ঘটতো। অথচ আল্লাহ তাআলা যুলুম থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।
[3] - যাতে মানুষের জন্য উপকার ও কল্যাণ রয়েছে এবং যা পবিত্র আল্লাহ তাআলা তা হালাল করেন। আর ক্ষতিকর এবং যাতে অকল্যাণ রয়েছে, তা হারাম করেন। যেমন শূকর, মৃত জন্তু ইত্যাদি মানুষের জন্য ক্ষতিকর বলেই হারাম করেছেন।
[4] - অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমান ও হেদায়াতকে ভালবাসে এবং সেদিকে স্বীয় ইচ্ছাকে ধাবিত করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য ঈমানের পথ সহজ করে দেন ও তাকে সীরাতুল মুস্তাকীমের উপর চলতে সাহায্য করেন। আর যে ব্যক্তি ঈমান ও আনুগত্যের কাজকে পছন্দ করেনা, কুরআন-হাদীছের কথা যার কাছে ভাল লাগেনা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের আলোচনার প্রতিও যে কর্ণপাত করেনা, আল্লাহ তাআলা তাকে সৎপথে চলার তাওফীক দেন না এবং তাকে সাহায্যও করেন না।
[5] - অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা মানুষের আগ্রহের অনুরূপ ব্যবহারই করে থাকেন। কেউ যদি কল্যাণের দিকে ঝুকে পড়ে আল্লাহ তাকে কল্যাণের দিকেই নিয়ে যান। আর যদি খারাপ পথে ধাবিত হয়, তাকে শ্বাস্তি স্বরূপ সেদিকেই নিয়ে যান।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন দরিদ্র মুসলিমদের থেকে বিমুখ হয়ে মক্কার নের্তৃস্থানীয় কাফেরদের হেদায়াতের প্রতি গুরুত্ব দিলেন, তখন আল্লাহ তাআলা তাঁকে ধমক দিয়ে এই আয়াতগুলো নাযিল করেনঃ
﴿عَبَسَ وَتَوَلَّى (১) أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى (২) وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى (৩) أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى (৪) أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى (৫) فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى (৬) وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى (৭) وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى (৮) وَهُوَ يَخْشَى (৯) فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى (১০) كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ (১১) فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ﴾
‘‘ভ্রুকুঁঞ্চিত করলো ও মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ সেই অন্ধ লোকটি তার কাছে এসেছে। তুমি কী জানো, হয়তো সে শুধরে যেত। অথবা উপদেশের প্রতি মনোযোগী হতো এবং উপদেশ দেয়া তার জন্য উপকারী হতো।
আর যে ব্যক্তি বেপরোয়া ভাব দেখায়। তুমি তার প্রতি মনোযোগী হও। অথচ সে যদি শুধরে না যায় তাহলে তোমার উপর এর কোন দায়িত্ব থাকেনা। আর যে নিজে তোমার কাছে দৌড়ে আসে এবং সে ভীত হচ্ছে। তার দিক থেকে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো। কখনো নয়, এটি তো একটি উপদেশ। যার ইচছা এটি গ্রহণ করবে’’। (সূরা আবাসাঃ ১-১২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
﴿إِنَّ سَعْيَكُمْ لَشَتَّىٰ فَأَمَّا مَنْ أَعْطَى وَاتَّقَى (৫) وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَى (৬) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَى (৭) وَأَمَّا مَنْ بَخِلَ وَاسْتَغْنَى (৮) وَكَذَّبَ بِالْحُسْنَى (৯) فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْعُسْرَى﴾
‘‘আসলে তোমাদের প্রচেষ্টা নানা ধরনের৷ কাজেই যে (আল্লাহর পথে) ধন সম্পদ দান করেছে এবং আল্লাহকে ভয় করেছে ও আল্লাহর নাফরমানি থেকে দূরে থেকেছে। এবং সত্য কথাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। অচিরেই তাকে আমি সহজ পথের সুযোগ-সুবিধা দেবো। অর্থাৎ তাকে আনুগত্যের কাজ করার তাওফীক দিবো এবং তার জন্য উহা সহজ করে দিবো। আর যে কৃপণতা করেছে, আল্লাহ থেকে বেপরোয়া হয়ে গেছে। এবং সত্যকে মিথ্যা গণ্য করেছে। অচিরেই তাকে আমি কঠিন পথের সন্ধান দেবো’’৷ (সূরা লাইলঃ ৫-১০) অর্থাৎ আমি তাকে কুফরী ও নাফরমানীর পথ সহজ করে দেবো। ফলে তার জন্য ঈমান ও আনুগত্যের পথে চলা দুষ্কর হয়ে যায়।
কুরআনের অনেক স্থানেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যখন কোন ব্যক্তি ভাল ও ন্যায় পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তাআলা তার উপর অনুগ্রহ করেন এবং তাকে সেই পথে চলার তাওফীক দান করেন।
আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কুফরী ও নাফরমানীর পথে চলে, আল্লাহ তাকে তার অবস্থাতেই ছেড়ে দেন এবং এটি সেই তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে, যা আল্লাহ তাআলা স্বীয় ইলম মোতাবেক আগেই লিখে রেখেছেন। (ইবনে কাছীর)