শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ২ - আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে হওয়া ও নিকটবর্তী হওয়া এবং সকল সৃষ্টির পূর্বে ও সকল সৃষ্টির শেষে বিদ্যমান থাকা ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে হওয়া ও নিকটবর্তী হওয়া এবং সকল সৃষ্টির পূর্বে ও সকল সৃষ্টির শেষে বিদ্যমান থাকা

২- الجمع بين علوه وقربه وأزليته وأبديته

আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে হওয়া ও নিকটবর্তী হওয়া এবং সকল সৃষ্টির পূর্বে ও সকল সৃষ্টির শেষে বিদ্যমান থাকা:

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

وَقَوْلُهُ سُبْحَانَهُ ﴿ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ﴾

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন, ‘‘তিনিই الأَوَّلُ (প্রথম), তিনিই الآخِرُ (সর্বশেষ), তিনিই الظَّاهِرُ (সবকিছুর উপরে), তিনিই الْبَاطِنُ (মাখলুকের অতি নিকটে), আর তিনি সর্ব বিষয়ে عَلِيم (মহাজ্ঞাণী)’’। (সূরা হাদীদ ৩)

ব্যাখ্যা: আল্লাহ তাআলার বাণী: هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ ‘‘তিনিই প্রথম, তিনিই শেষ’’- সহীহ মুসলিমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত দুআর মাধ্যমে এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তিনি তাঁর দুআয় বলেছেন, «اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ» ‘‘হে আল্লাহ! তুমিই أَوَّل (সর্বপ্রথম)। তোমার পূর্বে কেউ ছিলনা। তুমিই آخِر (সর্বশেষ), তোমার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকবেনা। তুমিই ظَاهِر (সকল সৃষ্টির উপরে), তোমার উপরে আর কিছুই নেই। তুমিই بَاطِن (মাখলুকের অতি নিকটে এবং জ্ঞানের মাধ্যমে সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী), তোমার চেয়ে অধিক নিকটে আর কিছুই নেই’’।[1]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর এই চারটি নামের সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছেন। এই বরকত সম্পন্ন নামগুলোর মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সকল সৃষ্টিকে সকল দিক থেকেই পরিবেষ্টন করে আছেন।

আল্লাহ তাআলার নাম: هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ ‘‘তিনিই প্রথম এবং তিনিই শেষ’’ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সমস্ত যামানাকে পরিবেষ্টন করে আছেন। অর্থাৎ তিনি যামানা ও কালসীমার উর্ধ্বে। সবকিছুর আগে তিনি একাই ছিলেন এবং সবকিছু শেষ হওয়ার পরও তিনি থাকবেন।

আর আল্লাহ তাআলার নামঃ وَالظَّاهِرُوَالْبَاطِنُ ‘‘তিনি সকল সৃষ্টির উপরে এবং তিনিই সবকিছুকে পরিবেষ্টনকারী’’ দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা যেমন সকল যামানাকে বেষ্টন করে আছেন তেমনি সকল স্থানকে পরিবেষ্টন করে আছেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলার এই চারটি নাম পরস্পর বিপরীত অর্থবোধক। চারটি নামের মধ্যে الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ এই দু’টি নাম আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার অবিনশ্বরতা ও চিরস্থায়িত্বের জন্য। আর الظَّاهِرُوَالْبَاطِنُ এই দু’টি নাম দ্বারা আল্লাহ তাআলা মাখলুকের উপরে হওয়া ও তাদের নিকটে হওয়া বুঝায়।

সুতরাং আল্লাহ তাআলা ব্যতীত প্রথম থেকেই যেসব বস্ত্ত রয়েছে, তার প্রত্যেকটি বস্ত্ত সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই আল্লাহ তাআলা রয়েছেন। অর্থাৎ যেসব বস্ত্ত সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সৃষ্টি হওয়ার পূর্ব থেকেই আল্লাহ আছেন।[2] আর আল্লাহ ব্যতীত যত বস্ত্ত আছে, তার প্রত্যেকটি শেষ হওয়ার পরেও আল্লাহ তাআলা থাকবেন। সুতরাং আল্লাহই প্রথম এই কথার অর্থ হচ্ছে সবকিছুর পূর্বে আল্লাহ বিদ্যমান থাকা আর আল্লাহই শেষ, এ কথার অর্থ হচ্ছে সবকিছুর পর আল্লাহর অবশিষ্ট থাকা।[3]

আর আল্লাহ তাআলা الظاهر (প্রকাশমান) হওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি প্রত্যেক সৃষ্ট বস্ত্তর উপরে। الظهور থেকে আল্লাহ তাআলার জন্য الظاهر নামটি গ্রহণ করা হয়েছে। যুহুর শব্দটির ভাষাগত দাবী হচ্ছে উপরে হওয়া। বস্ত্তর উপরের অংশকেই যাহের বলা হয়।[4]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বাতেন হওয়ার অর্থ হচ্ছে তিনি নিম্নজগতের (পৃথিবী ও তার মধ্যকার) প্রত্যেক সৃষ্টিকে এমনভাবে বেষ্টন করে আছেন যে, তিনি মাখলুকের আপন নফসের চেয়েও অধিক নিকটে। এটি হচ্ছে সকল সৃষ্টির নিকটবর্তী হওয়ার অর্থ।[5]


[1] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুয্ যিক্র ওয়াদ্ দু’আ। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আলউছাইমীন বলেছেন, الباطن অর্থ হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সমস্ত সৃষ্টির উপরে হওয়ার সাথে সাথে তিনি তাদের অতি নিকটে। মূলতঃ আল্লাহ তাআলার উপরে হওয়া মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়ার বিরোধী নয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়াকে আল্লাহর ইলম ও ক্ষমতা দ্বারা ব্যাখ্যা করা হলেও মূলত আল্লাহর জন্য কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আল্লাহর সিফাত ও কর্মকে মাখলুকের সিফাত ও কর্ম দ্বারা বুঝা অসম্ভব। কোন সৃষ্টির জন্য একই সময় ছাদের উপরে ও ছাদের নীচে সশরীরে থাকা এবং একই সময় সিংহাসনের উপরে থাকা ও সিংহাসনের নীচে থাকা অসম্ভব। কোন রাজা যখন তার সিংহাসন ছেড়ে বাইরে যায়, তখন তার সিংহাসন খালি হয়ে থাকে। কারণ তার জন্য একই সময় ও একই সাথে সিংহাসনে থাকা এবং দেশের বাইরে থাকার ধারণা অকল্পনীয়। কিন্তু সুমহান ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাআলার জন্য একই সময় ও একই সাথে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া এবং রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা অসম্ভব কিছু নয়। মাখলুকের নিকটবর্তী হলে আরশ খালি হওয়া জরুরী নয়। যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে, তারা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা দ্বারা আল্লাহর বিশাল সিফাত ও ক্ষমতাকে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছে বলেই বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে।

[1] - এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। তা এই যে, কুরআন মাজীদে জান্নাত ও জাহান্নাম বাসীদের জন্য যে চিরস্থায়ী জীবনের কথা বলা হয়েছে, তা কি ‘আল্লাহ তাআলাই সর্বশেষ’ এই কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয়?

এই প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে যে, কোন সৃষ্টিরই নিজস্ব স্থায়িত্ব নেই। যদি কোন জিনিষ স্থায়ী হয় বা স্থায়ী থাকে তাহলে আল্লাহ তাআলা স্থায়ী রাখার কারণেই তা স্থায়ী হয় এবং থাকতে পারে। অন্যথায় আল্লাহ ছাড়া স্ব স্ব ক্ষেত্রে আর সবাই নশ্বর ও ধ্বংসশীল। আখেরাতে আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্টে জান্নাত বা দোযখ চিরস্থায়িত্ব লাভ করবে- এমনটি নয়। বরং সেখানে তার স্থায়িত্ব লাভ করার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা তাকে চিরস্থায়ী জীবন দান করবেন। ফেরেশতাদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। তারা আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্টে অবিনশ্বর নয়। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেছেন তখন তারা অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং যত সময় পর্যন্ত তিনি চাইবেন তত সময় পর্যন্তই তারা বেঁচে থাকবে। পরিশেষে ফেরেশতারাও ধ্বংস হবেন।

কিন্তু জান্নাতবাসীগণ ও জান্নাতের নেয়ামতসমূহে এবং জাহান্নামী কাফেররা ও জাহান্নামের আযাবে চিরকাল থাকার বিষয়টি কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল দ্বারা প্রমানিত।

[2] - ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ غَيْرُهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ وَكَتَبَ فِى الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ

‘‘আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিষ লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং আসমান ও যমীন সৃষ্টি করলেন। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩১৯১)

[3] - সৃষ্টিজগতের ছোট বড় প্রত্যেক বস্ত্তরই একটি সূচনা ও শুরু রয়েছে। সেই বস্ত্তটি যত পুরাতনই হোক কিংবা যার বয়স যতই বেশী হোক, তার একটা শুরু রয়েছে। অতীতের যে সময়টাতে তার সৃষ্টি হয়েছে, তার পূর্বে সেই বিষয়টির কোন অস্তীত্ব ছিলনা। প্রত্যেক সৃষ্ট বস্ত্তর পূর্বেই আরেকটি সৃষ্ট বস্ত্ত রয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে যেটিকে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে, তা অস্তীত্বহীন থেকে প্রথম অস্তীত্বে এসেছে। আল্লাহ তাআলাই সেটিকে প্রথম অস্তীত্বে এনেছেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, আমার সৃষ্টির পূর্বে আমার কোন অস্তীত্ব ছিলনা, আপনার বেলাতেও না। পিতামাতার মাধ্যমে আমরা সৃষ্টি হয়েছি। এভাবে আদম (আঃ) পর্যন্ত গিয়ে মানব সৃষ্টির ক্রমধারা শেষ হয়। আদমকে আল্লাহ তাআলা অস্তিত্বহীন থেকে অস্তীত্বে এনেছেন। এমনি সৃষ্টিজগতের সকল সৃষ্টির ক্ষেত্রে একই কথা। এই পৃথিবী কখন সৃষ্টি হয়েছে কিংবা এর বয়স কত বিজ্ঞানীরা অনুমান করে বললেও তার সঠিক বয়স আমরা জানিনা। কিন্তু এটি অতীতের নির্দিষ্ট এমন একটি সময়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, যার পূর্বে এই পৃথিবীর কোন অস্তীত্বই ছিলনা।

কিন্তু আল্লাহ তাআলার এমন কোন শুরু ও সূচনা নেই, যেখান থেকে তিনি অস্তীত্বে এসেছেন এবং যেই সময়ের পূর্বে তিনি ছিলেন না। কেননা তিনি হচ্ছেন সবকিছুর স্রষ্টা। তাই সকল সৃষ্টির পূর্বে তাঁর অস্তীত্ব থাকা এবং তাঁর ইচ্ছাতেই সবকিছু ধ্বংস হওয়ার পরও তাঁর বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। এক কথায় তিনি সময়ের সীমারেখার অনেক উর্ধ্বে।

[4] - প্রত্যেক সৃষ্টি স্বীয় ফিতরাতের (প্রকৃতি ও সৃষ্টিগত স্বভাবের) দাবীতেই উপরের দিকে হাত উঠায়। এ বিষয়ে তাকে শিক্ষা না দেয়া হলেও সে উপরের দিকেই হাত উঠায়। হাত না উঠালেও অন্তর উপরের দিকে ধাবিত করে। কারণ সকল সৃষ্টির উপরে আল্লাহ তাআলা। আর সকল মাখলুক তাঁর নীচে। উপরের দিকে হাত উঠানো শুধু মানুষের সাথে খাস নয়। এমনকি জীবজন্তু এবং কীট-পতঙ্গও অনুভব করে যে, তার সৃষ্টিকর্তা ও রিযিক দাতা উপরে। তাই স্বীয় প্রয়োজনে সে উপরের দিকে হাত ও অন্তর ধাবিত করে।

ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী একদা মিম্বারে উঠে আল্লাহ তাআলার সিফাত সম্পর্কে দারস দিচ্ছিলেন এবং আল্লাহর যাত ও সিফাত সম্পর্কে মানুষের আকীদাহ কী হওয়া উচিৎ, তা শিখাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে ﴾ ﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহা: ৫) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি এর ব্যাখ্যা করতে করতে বলতে লাগলেন, كان الله ولاعرش وهو الآن على ما كان অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহই ছিলেন। তখন কোনো আরশ ছিল না। এখনো তিনি সেভাবেই আছেন, যেভাবে আরশ সৃষ্টির আগে ছিলেন।

ইমামুল হারামাইনের সেই দারসে উপস্থিত ছিলেন আবু জা’ফর আলহামদানী (রঃ)। হামদানী বলেন, আমি ইমামুল হারামাইনকে বললাম, আপনি যেদিকে ইঙ্গিত করছেন, আমি তা বুঝতে পেরেছি। তবে যেসব বিষয়ের ইলম অন্তরে দৃঢ়ভাবে বসে যায়, তুমি কি তা যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সরাতে পারবে? কোনো মানুষই কি তা সরাতে পারে? প্রত্যেক মানুষই এমন কিছু বিষয় অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে, যা সে কখনোই অন্তর থেকে সরাতে পারে না।

এবার ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী আল-জুওয়াইনী হামদানীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এ কথার মানেটা কী? তুমি কোন্ দিকে ইঙ্গিত করছো? হামাদানী বলেন, আমি বললাম, দেখুন, যখনই কোনো আরেফ বিল্লাহ (আল্লাহতে বিশ্বাসী লোক) يا رب হে আল্লাহ! হে আমার রব বলে ডাক দেয়, তখন তার জবান চালু হওয়ার আগেই অন্তরের গভীরের ইচ্ছা ও প্রার্থনাটা ডানদিকে কিংবা বাম দিকে না গিয়ে সরাসরি উপরের দিকে উঠে যায়। আপনি কি অন্তরের এ জরুরী ইচ্ছাটা দূর করতে পারবেন? আরিফের (ভক্তের) অন্তরের এ তাওয়াজ্জুহ (ধাবিত হওয়া) দূর করার জন্য আপনার কোনো কৌশল জানা আছে কি? অন্তরের এ তাওয়াজ্জুহ আমরা কিভাবে দূর করবো? এটি দূর করার জন্য কোন যুক্তি-তর্ক যদি আপনার কাছে থাকে, তাহলে তা নিয়ে আসুন। আল্লাহ উপরে না নীচে, এই তর্ক থেকে আমরা বের হতে চাই।

এমনি আরো অনেক প্রশ্ন সম্ভবত হামদানী করেছিলেন, যা আমরা জানি না। পরিশেষে হামদানী বলেন, আপনি যদি আমাদের অন্তরকে উপরের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে ফিরাতে না পারেন, তাহলে আমরা মনে করবো যে, আপনি আল্লাহর যাত ও সিফাত সম্পর্কে এমন বিশ্বাস পোষণ করছেন এবং তা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন, যা যুক্তিবাদীরা মুসলিম জাতির নিকট আমদানী করেছে। আর আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং আমাদের অন্তর-মন তার বিরোধীতা করছে ও তা মেনে নিতে অস্বীকার করছে।

হামদানী বলেন, এ কথা বলার পর আমি কাঁদতে লাগলাম। মসজিদে উপস্থিত লোকেরাও কাঁদতে লাগলো। ঐদিকে ইমামুল হারামাইন তার জামার আস্তীন দ্বারা মিম্বারে আঘাত করতে লাগলেন এবং চিল্লানো শুরু করলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি, আমি হয়রান হয়ে গিয়েছি ইত্যাদি বলতে বলতে তিনি তার শরীরের জামা খুলে ফেললেন এবং তা ছিড়ে ফেললেন। মসজিদে সেদিন যা হওয়ার তা হয়েই গেল। পরিশেষে হামদানীর প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়েই তিনি মিম্বার থেকে নেমে পড়লেন। তিনি শুধু একটি কথাই বার বার বলছিলেন, حيرني االهمداني حيرني الهمداني হামাদানী আমাকে হয়রান করে ফেলেছে, হামাদানী আমাকে হয়রান করে ফেলেছে।

ঘটনার সূত্র: ইমাম আলবানী (রঃ) এই ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ঘটনার সনদ সহীহ। হাফেযদের থেকে ধারাবাহিক সনদে তা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম ইবনে তাইমীয়া মাজমুআয়ে ফতোয়ার (৪/৪৪) এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উম্মতের নিকট নির্ভরযোগ্য অন্যান্য আলেম এ ঘটনা তাদের কিতাবে বর্ণনা করেছেন।

উল্লেখ করা হয় যে, পরবর্তীতে ইমামুল হারামাইন তার আকীদাহ সংশোধন করে সালাফে সালেহীনের মাজহাবের দিকে ফিরে এসেছিলেন। আল্লাহ তার উপর রহম করুন! আমীন।

পূর্বেই বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট দুআ করার সময় উপরের দিকে হাত উঠানো এবং নিজের প্রয়োজন সৃষ্টিকর্তার কাছে পেশ করার সময় অন্তরকে উপরের দিকে ধাবিত করা শুধু মানুষের স্বভাব নয়; বরং অন্যান্য জীব-জন্তু এবং কীটপতঙ্গও প্রয়োজনের সময় উপরের দিকে হাত-পা ও অন্তর ধাবিত করে।

আল্লাহর নবী সুলায়মান বিন দাউদ (আঃ) একদা তাঁর অনুসারীদেরকে নিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য বের হলেন। পথিমধ্যে তিনি দেখলেন একটি পীপড়া চিৎ হয়ে পিঠের উপর শয়ন করে আকাশের দিকে পাগুলো উঠিয়ে আল্লাহর কাছে এ বলে বৃষ্টি প্রার্থনা করছে, اَللَّهُمَّ إِنَّا خَلْقٌ مِنْ خَلْقِكَ, لَيْسَ بِنَا غِنًى عَنْ سُقْيَاكَ হে আল্লাহ! আমরা তোমার সৃষ্টি। তোমার বৃষ্টির (রহমতের) পানি ছাড়া আমাদের বেচে থাকা সম্ভব নয়। পীপড়ার এ কথা শুনে তিনি ফেরত আসছিলেন। অনুসারীরা তাকে ফেরত আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তোমরা ফেরত যাও। কারণ অন্যদের দুআর বদৌলতেই তোমরা বৃষ্টিপ্রাপ্ত হবে। তারা বললো, আমরা তো কাউকে দুআ করতে দেখিনি। তখন তিনি তাদেরকে আকাশের দিকে পা উঠিয়ে একটি পীপড়ার আল্লাহর কাছে বৃষ্টি চেয়ে দুআ করার কথা জানালেন। (সুবুলুস সালাম, হাদীছ নং- ৪৮৬)

এ হাদীছের উপর ভিত্তি করে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেন, এ পীপড়াটি এবং তার দলের অন্যান্য পীপড়াগুলো আল্লাহর সিফাতে অবিশ্বাসী জাহমীয়া সম্প্রদায়ের লোকদের চেয়ে আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে অধিক অবগত। আল্লামা শাইখ ডঃ সালেহ ফাওযান বলেন, জাহমীয়াদের চেয়ে পীপড়াই অধিক উত্তম।

[5] - সুতরাং কেউ যেন এরূপ মনে না করে, আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টির উপরে থেকে তার কাজ-কর্ম এবং অন্তরের ইচ্ছা ও নিয়ত সম্পর্কে অবগত নন। আল্লাহ আরশের উপর থেকেও মাখলুকের সবকিছুই অবহিত। আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে হওয়া সৃষ্টির নিকটবর্তী হওয়ার পরিপন্থী নয়।