ফাতাওয়া ও প্রশ্নোত্তর রমাদান (রোযা) বিষয়ক আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল ৩ টি
রমজান মাসে কতিপয় বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যক্রম

এখানে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে:

১) রমজানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে বিদআত
২) ভোর রাতের বিদআত: শেষ রাতে মাইকে কুরআন তেলাওয়াত, গজল, ইসলামি সঙ্গীত, অনবরত ডাকাডাকি, সম্মিলিত কণ্ঠে গজল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায়।
- তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে এ ক্ষেত্রে সুন্নত কী?
৩) সেহেরি খাওয়ার সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত
- নিয়ত কী বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
৪) বিলম্বে ইফতার করা
৫) তারাবীহ নামাজ সংক্রান্ত বিদআত
৬) তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়া।
৭) বদর দিবস পালন করা বিদআত
৮) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা
৯) জুমুআতুল বিদা পালনের বিদআত
১০) ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নাতের বরখেলাপ



উপরোক্ত বিষয়গুলো ধারাবাহিকবাবে আলোচনা করা হল:
রমজান মাসে সমাজে একধিক বিদ্‌আত প্রচলিত রয়েছে। যেগুলো এক জায়গায় এক রোকম, অন্য জায়গায় আর এক রোকম। এক দেশের লোকাচার অন্য দেশ থেকে ভিন্ন। নিম্নে আমরা আমাদের দেশে প্রচলিত এ সংক্রান্ত কিছু বিদআতী কাজের চিত্র তুলে ধরব।


১) রমজানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে বিদআত:
রামাযানের নতুন চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু লোক চাঁদের দিকে হাত উঁচু করে শাহাদাত আঙ্গুলী দ্বারা ইশারা করে থাকে। এটা বিদআত। কেননা, কুরআন-সুন্নাহতে এর কোন ভিত্তি নাই।
তবে নতুন চাঁদ দেখলে নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করা সুন্নাত:


اللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالإِيمَانِ وَالسَّلاَمَةِ وَالإِسْلاَمِ رَبِّى وَرَبُّكَ اللَّهُ

আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলাম। রাব্বী ওয়া রাব্বুকাল্লাহ”। [ মুসনাদ আহমাদ, তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ থেকে বর্ণিত (৩/৪২০), তিরমিযী, অনুচ্ছেদ: চাঁদ দেখার সময় কী বলবে? আল্লামা আলবানী রাহ. বলেন, হাদিসটি সহীহ।]
অর্থ: হে আল্লাহ, এ চাঁদকে আমাদের মাঝে বরকত, ঈমান, শান্তি-নিরাপত্তা ও ইসলামের সাতে উদিত কর। আমার ও তোমার রব আল্লাহ।”


২) সেহেরি সংক্রান্ত বিদআত:
দেখা যায়, রমজান মাসে শেষ রাতে মুআযযিনগণ মাইকে উচ্চ আওয়াজে কুরআন তিলাওয়াত, গজল, ইসলামি সঙ্গীত ইত্যাদি গাওয়া শুরু করে। অথবা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে বক্তাদের ওয়াজ, গজল বাজাতে থাকে। সেই সাথে চলতে থাকে ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, উঠুন, সেহেরির সময় হয়েছে, রান্না-বান্না করুন, খাওয়া-দাওয়া করুন” ইত্যাদি বলে অনবরত ডাকাডাকি। অথবা কোথাওবা কিছুক্ষণ পরপর উঁচু আওয়াজে হুইশেল বাজানো হয়।
এর থেকে আরো আজব কিছু আচরণ দেখা যায়। যেমন, এলাকার কিছু যুবক রামাযানের শেষ রাতে মাইক নিয়ে এসে সম্মিলিত কন্ঠে গযল বা কাওয়ালী গেয়ে মানুষের বাড়ির দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। অথবা মাইক বাজিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। এ ছাড়াও এলাকা ভেদে বিভিন্ন বেদআতী কার্যক্রম দেখা যায়।
আমাদের জানা উচিত, শেষ রাতে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিচের আসমানে নেমে আসেন। এটা দুআ কবুলের সময়। আল্লাহ তাআলার নিকট এ সময় কেউ দুআ করলে তিনি তা কবুল করেন। মুমিন বান্দাগণ এ সময় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন, কুরআন তেলাওয়াত করেন, মহান আল্লাহ তাআলা তাআলার দরবারে রোনাজারি করে থাকেন। সুতরাং এ সময় মাইক বাজিয়ে, গযল গেয়ে বা চাঁদা তুলে এ মূল্যবান সময়ে ইবাদতে বিঘ্নিত করা নিঃসন্দেহে গুনাহর কাজ। এতে মানুষের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো হয়। যার ফলে অনেকের সেহেরি এমনকি ফজরের নামাজ পর্যন্ত ছুটে যায়। এই কারণে অনেক রোযাদারগণ সেহেরির শেষ সময় পর্যন্ত বিলম্ব না করে আগে ভাগে সেহেরি শেষ করে দেয়। এ সবগুলোই গুনাহের কাজ।
তাহলে আমাদেরকে জানতে হবে ক্ষেত্রে সুন্নত কী?
এ ক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে, ফজরের আগে সেহেরির জন্য আলাদা একটি আজান দেওয়া। এই আজান হল সেহেরি খাওয়ার জন্য এবং তারপর ফজর সালাতের জন্য আরেকটি আজান দেওয়া। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে দুজন মুআযযিনও নিয়োগ করা ছিল। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,


« إِنَّ بِلاَلاً يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ ، فَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يُؤَذِّنَ ابْنُ أُمِّ مَكْتُومٍ »

“বেলাল রাতে আজান দেয়। অত:এব তোমরা বেলালের আজান শুনলে পানাহার করতে থাক ইবনে উম্মে মাকতুমের আজান দেওয়া পর্যন্ত।” [বুখারী, অনুচ্ছেদ: ফজরের আগে আজান দেওয়া। মুসলিম: অনুচ্ছেদ: ফজর উদিত হলে রোযা শুরু হবে……।]
সুনানুন নাসাঈর হাদিসে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,


إِنَّ بِلَالًا يُؤَذِّنُ بِلَيْلٍ لِيُوقِظَ نَائِمَكُمْ وَلِيَرْجِعَ قَائِمَكُمْ وَلَيْسَ أَنْ يَقُولَ هَكَذَا يَعْنِي فِي الصُّبْحِ

“বেলাল আজান দেয় এজন্য যে, যেন ঘুমন্ত লোক জাগ্রত হয় আর তাহাজ্জুদ আদায়কারী ফিরে আসে অর্থাৎ নামাজ বাদ দেয় এবং সেহেরি খায়।”
সুতরাং এ দুটির বেশি কিছু করতে যাওয়া বিদআত ছাড়া অন্য কিছু নয়। এজন্যই ওলামাগণ বলেছেন, “যেখানে একটি সুন্নত উঠে যায় সেখানে একটি বিদআত স্থান করে নেয়।” আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। সুন্নত উঠে গিয়ে সেখানে নিজেদের মনগড়া পদ্ধতি স্থান দখল করে নিয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে পুনরায় সুন্নতের দিকে ফিরে আসার তাওফীক দান করুন। আমীন।
তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যে এলাকায় দুটি আজান দেওয়ার প্রচলন নেই সেখানে রমজান মাসে হঠাৎ করে দুটি আজান দেওয়া ঠিক নয়। কেননা, এতে মানুষের মাঝে সেহেরি খাওয়া ও ফজর সালাতের সময় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।


৩) সেহেরি খাওয়ার সময় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বিদআত:
সেহেরি খাওয়া একটি ইবাদত। আর যে কোন ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য নিয়ত অপরিহার্য শর্ত। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,


« إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ »

সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল।” (সহীহ বুখারী) তাই রোযা রাখার জন্য নিয়ত থাকা অপরিহার্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,


مَنْ لَمْ يُبَيِّتْ الصِّيَامَ قَبْلَ الْفَجْرِ فَلَا صِيَامَ لَهُ

“যে রাতে (ফজরের আগে) রোযা রাখার নিয়ত করে নি তার রোযা হবে না।” (সুনান নাসাঈ, আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।) কিন্তু জানা দরকার, নিয়ত কী বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
নিয়ত কী বা কিভাবে নিয়ত করতে হয়?
ইমাম নববী রাহ. বলেন, মনের মধ্যে কোন কাজের ইচ্ছা করা বা সিদ্ধান্ত নেয়াকেই নিয়ত বলা হয়। সুতরাং রোযা রাখার কথা মনে মধ্যে সক্রিয় থাকাই নিয়তের জন্য যথেষ্ট। মুখে উচচ্চারণ করার প্রয়োজন নেই। কেননা, ইসলামি শরিয়তে কোন ইবাদতের নিয়ত মুখ দিয়ে উচ্চারণের কথা আদৌ প্রমণিত নয়।
অথচ আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ওযুর নিয়ত, নামাযের নিয়ত, সেহেরি খাওয়ার নিয়ত ইত্যাদি চর্চা করা হয়। নামাজ শিক্ষা, রোযার মাসায়েল শিক্ষা ইত্যাদি বইতে এ সব নিয়ত আরবীতে অথবা বাংলা অনুবাদ করে পড়ার জন্য জনগণকে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্ত আমাদের একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দ্বীনের মধ্যে এভাবে নতুন নতুন সংযোজনের পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেন,


« مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ »

“যে আমাদের এই দ্বীনে এমন নতুন কিছু তৈরি করল যা তার অন্তর্ভূক্ত নয় তা পরিত্যাজ্য।” (বুখারী ও মুসলিম)
তাই মুসলমানদের কর্তব্য হল, দলীল-প্রমাণ ছাড়া গদবাধা নিয়ত সহ সব ধরণের বিদআতী কার্যক্রম পরিত্যাগ করা এবং সুন্নতকে শক্তভাবে ধারণ করা। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন


৪) বিলম্বে ইফতার করা:
কিছু রোযাদারকে দেখা যায়, স্পষ্টভাবে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অতি সর্তকতার কারণে আরও কিছুক্ষণ পরে ইফতার করে। এটি স্পষ্ট সুন্নত বিরোধীতা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:


« لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ »

মানুষ ততদিন কল্যাণে উপর থাকবে যতদিন তাড়াতাড়ি ইফতার করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)


৫) তারাবীহ নামাজ সংক্রান্ত বিদআত:
অনেক মসজিদে দেখা যায়, তারাবীহর নামাযের প্রতি চার রাকাত শেষে মুসল্লীগণ উঁচু আওয়াজে ‘সুবাহানা যিল মুলকে ওয়াল মালাকূতে…” দুআটি পাঠ করে থাকে। এভাবে নিয়ম করে এই দুয়া পাঠ করা বিদআত। অনুরূপভাবে এ সময় অন্য কোন দুআ এক সাথে উঁচু আওয়াজে পাঠ করাও বিদআত। কারণ, এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদিস নেই। বরং নামাজ শেষে যে সকল দুআ সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে সেগুলো পাঠ করা সুন্নত। যেমন, তিনবার আস্‌তাগফিরুল্লাহ”, একবার আল্লাহুম্মা আন্‌তাস সালাম ওয়ামিন্‌কাস সালাম, তাবারাক্‌তা ইয়া যাল জালালি ওয়াল ইকারাম” ইত্যাদি। এ দুয়াগুলো প্রত্যেকেই চুপিস্বরে নিজে নিজে পাঠ করার চেষ্টা করবে।


৬) তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়া।
অনেক মসজিদে রামাযানে তারাবীর নামাযে খুব তাড়াতাড়ি কুরআন তেলাওয়াত করা বা তাড়াহুড়া করে নামাজ শেষ করা। যার কারণে তেলাওয়াত ঠিক মত বুঝাও যায় না। নামাযে ঠিকমত দুআ-যিকিরও পাঠ করা যায় না। এটা নি:সন্দেহে সুন্নত পরিপন্থী। কেননা, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রাতের কিয়ামুল লাইল হত অনেক দীর্ঘ এবং ধীরস্থির।


৭) বদর দিবস পালন করা বিদআত:
২য় হিজরীর রামাযনের সতের তারিখে বদরের প্রান্তরে মক্কার মুশরিক সমম্প্রদায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার জানবাজ সাহসী সাহাবয়ে কেরামের মাঝে এক যুগান্তকারী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধ ছিল অস্ত্র-সম্ভার এবং জনবলে এক অসম যুদ্ধ। মুসলমানগণ অতি নগণ্য সংখ্যক জনবল আর খুব সামান্য অস্ত্র-শস্ত্র সহকারে কাফেরদের বিশাল অস্ত্র সজ্জিত বাহিনীর প্রতিরোধ করেছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা সে দিন অলৌকিকভাবে মুসলমানদেরকে বিজয় দান করেছিলেন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে সত্য মিথ্যার মাঝে চুড়ান্ত পার্থক্য সূচিত হয়েছিল।
এতো ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু প্রতি বছর রামাযানের সতের তারিখে এ ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করার জন্য লোকজন একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। তারপর বদরের বিভিন্ন ঘটনা, সাহবিদের সাহসীকতা ইত্যাদি আলাচনা করা হয়। এভাবে প্রতি বছর এই দিনে ‘বদর দিবস’ পালন করা হয়। এটি যদিও আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটির প্রচলন তেমন নেই। কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশের কিছু ইসলামি সংগঠন প্রতি বছর বেশ জোরে শোরে সাংগঠনিক কার্যক্রম হিসেবে এই বিদআত পালন করে থাকে। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার সর্বোত্তম আদর্শ সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন এবং সালাফে সালেহীন থেকে এ জাতীয় অনুষ্ঠান পালনের কোন ভিত্তি নাই। বদরের এ ঘটনা নি:সন্দেহে মুসলমানদের প্রেরণার উৎস। এ সম্পর্কে জ্ঞান অজর্ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এভাবে দিবস পালন করা শরিয়ত সম্মত নয়।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াত জীবনে রয়েছে অনেক বক্তৃতা, সন্ধি-চুক্তি এবং বিভিন্ন বড় বড় ঘটনা, যেমন, বদর, হুনাইন, খন্দক, মক্কা বিজয়, হিজরত মূহুর্ত, মদীনায় প্রবেশ, বিভিন্ন বক্তৃতা যেখানে তিনি দ্বীনের মূল ভিত্তিগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও তিনি তো এ দিনগুলোকে আনন্দ-উৎসব হিসেবে পালন করা আবশ্যক করেন নি। বরং এ জাতীয় কাজ করে খৃষ্টানরা। তারা ঈসা আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে উৎসব হিসেবে পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে ইহুদিরাও এমনটি করে। ঈদ-উৎসব হল শরিয়তের একটি বিধান। আল্লাহ তাআলা শরিয়ত হিসেবে যা দিয়েছেন তা অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় এমন নতুন কিছু আবিস্কার করা যাবে না যা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়।”[28]
মূলত: এ জাতীয় কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের শরিয়ত থেকে দূরে রাখার একটি অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং শরিয়ত যে কাজ করতে আদেশ করে নি তা হতে দূরে অবস্থান করে রমজান মাসে অধিকহারে কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামাজ আদায় করা, জিকির-আযকার এবং অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি বেশি বেশি করা দরকার। কিন্তু মুসলমানদের অন্যতম সমস্যা হল শরিয়ত অনুমোদিত ইবাদত বাদ দিয়ে নব আবিস্কৃত বিদআতী আমল নিয়ে ব্যস্ত থাকা। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।


৮) ইতিকাফ সংক্রান্ত ভুল ধারণা:
আমাদের দেশে মনে করা হয় যে, সমাজের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তিকে অবশ্যই ইতিকাফে বসতে হবে তা না হলে সবাই গুনাহগার হবে। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। কারণ, ইতিকাফ হল একটি সুন্নত ইবাদাত। যে কোন মুসলমানই তা পালন করতে পারে। যে ব্যক্তি তা পালন করবে সে অগণিত সোওয়াবের অধিকারী হবে। সবার পক্ষ থেকে একজনকে ইতিকাফে বসতেই হবে এমন কোন কথা শরিয়তে নেই।


৯) জুমাতুল বিদা পালনের বিদআত:
আমাদের দেশে দেখা যায়, রামাযানের শেষ শুক্রবারে জুমুআতুল বিদা পালন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে জুমুআর নামাযে প্রচুর ভিড় পরিলক্ষীত হয়। অথচ কুরআন সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন ধারণা পাওয়া যায় না। আমাদের কর্তব্য প্রত্যেক জুমাকে গুরুত্ব দেওয়া। শেষ জুমার বিশেষ কোন ফযিলত আছে বলে কোন প্রমাণ নাই।


১০) ফিতরা প্রদানের ক্ষেত্রে সুন্নাতের বরখেলাপ:
খাদ্য দ্রব্য না দিয়ে টাকা দিয়ে অথবা কাপড় কিনে ফিতরা দেওয়া সুন্নতের বরখেলাপ। কারণ, হাদিসে ফিতরা হিসেবে খাদ্য দ্রব্য প্রদান করার কথাই বর্ণিত হয়েছে। যেমন: ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,


فَرَضَ رَسُولَ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ ، عَلَى كُلِّ حُرٍّ أَوْ عَبْدٍ ، ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى ، مِنَ الْمُسْلِمِينَ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদের প্রত্যেক স্বাধীন, দাস, পুরুষ অথবা নারী সকলের উপর এক সা (প্রায় আড়াই কেজি) পরিমান খেজুর অথবা জব যাকাতুল ফিতর হিসেবে আবশ্যক করেছেন।” (বুখারী ও মুসলিম) এখানে খাদ্য দ্রব্যের কথা সুস্পষ্ট।
তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগেও দিনার-দিরহামের প্রচলন ছিল কিন্তু তিনি অথবা তার কোন সাহাবী দিনার-দিরহাম দ্বারা ফিতরা আদায় করেছেন বলে কোন প্রমাণ নাই। তাই সুন্নত হল, আমাদের দেশের প্রধান খাদ্য দ্রব্য (যেমন চাউল) দ্বারা ফিতরা আদায় করা।
আরেকটি বিষয় হল: হাদিসে বর্ণিত এক সা’র পরিবর্তে আধা সা ফিতরা দেওয়াও সুন্নতের বরখেলাপ। যেমনটি উপরোক্ত হাদিসে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হচ্ছে। যদিও আমাদের সমাজে আধা সা ফিতরা দেওয়ার মাসয়ালাই দেওয়া হয়।
আল্লাহ তাআলা সকল ক্ষেত্রে তার নবীর সুন্নতকে যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন এবং সকল বিদআত ও সুন্নত বিরোধী কার্যকলাপ থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

‘সেহেরি’ সঠিক হবে নাকি ‘সাহরি/সাহারি’? এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,


تَسَحَّرُوا فَإِنَّ فِي السَّحُورِ بَرَكَةً

“তোমরা সাহুর (সেহেরি) করো, কারণ সাহুরে (সেহেরিতে) বরকত রয়েছে।” (বুখারি ও মুসলিম)
উক্ত হাদিসে ভোর রাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহুর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তা সেহেরি/সেহেরী/সেহরি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ শব্দটি এখন বাংলা। এটাই যুগে যুগে বাংলা সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস, পুঁথি-কবিতা ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং সর্বস্তরের মানুষের নিকট সুপরিচিত।

আর বাংলা ব্যাকরণের দৃষ্টিতে বিদেশী কোন শব্দ যখন বাংলা ভাষায় ‘আত্তীকরণ’ হয় তখন সেটাকে পরিবর্তন করা ভাষা বিকৃতির শামিল। যেমন: ইংরেজিতে Table (টেবল) কিন্তু সেটা বাংলায় টেবিল। Apple (এ্যাপল) বাংলায় আপেল। এমন বহু বিদেশী শব্দ বাংলায় প্রবেশ করেছে। এখন কোন অতি পণ্ডিত ব্যক্তি এসে যদি বাংলায় কথা বলার সময় টেবিলকে ‘টেবল’ আর আপেলকে ‘এ্যাপল’ বলা শুরু করে তাহলে তা নি:সন্দেহে হাস্যকর ও ভাষা বিকৃতির শামিল বলে গণ্য হবে।
 সে কারণে প্রচলিত ‘সেহেরি/সেহরি’ শব্দকে ভুল আখ্যা দিয়ে ‘সাহারি' বলা অনুচিত বলে মনে করি। কারণ সেহেরি শব্দটি বহুল প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ বাংলা। তাছাড়া প্রকৃতপক্ষে ভোররাতের খাওয়া বুঝাতে হাদিসে ‘সাহুর; শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে; সাহারি নয়।
সুতরাং কেউ হুবহু হাদিসের শব্দ ব্যবহার করতে চাইলে ‘সাহুর’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারে; সেহেরি বা সাহারি কোনটাই নয়।
বাংলা অভিধান (ব্যবহারিক বাংলা অভিধান মতে, সেহেরি/সেহেরী/সেহরি অর্থ: রোজা রাখার জন্য মুসলমানগণ সুবেহ সাদিকের আগে যে খাবার গ্রহণ করেন। এখানে  সাহারি বা সাহারী কোনও বানান নেই।


‘সেহেরি’ মানে কি যাদু?
অনেকেই বলছেন, ‘সেহেরি’ মানে না কি যাদু। কিন্তু এ কথা সঠিক নয়। বরং আরবিতে 'সাহরুন' বা 'সিহরুন' উভয় শব্দের অর্থ: যাদু। যেমন: আরবি অভিধানে লেখা হয়েছে,


سحَرَ يَسحَر ، سَحْرًا وسِحْرًا ، فهو ساحِر ، والمفعول مَسْحور

আর ‘আস সাহারু’ অর্থ: শেষ রাত-ফজরের পূর্ব মূহুর্ত।


السَّحَرُ :آخرُ الليل قبيل الفجر

সুতরাং দেখা গেল, ‘সেহেরি’ শব্দটির অর্থ 'যাদু' বলা অভিধান সঙ্গত নয়।

ভোররাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহরি’ শব্দটি শুদ্ধ নয়:
ভোর রাতের খাবার বুঝাতে ‘সাহরী' শব্দটি শুদ্ধ নয়। কারণ হল, হাদিসে ‘সাহরী’ শব্দের অর্থ: আমার বক্ষ বা সিনা। যেমন: নিম্নোক্ত হাদিসটি,
আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি প্রায়ই বলতেন,


تُوُفِّيَ فِيْ بَيْتِيْ وَفِيْ يَوْمِيْ وَبَيْنَ سَحْرِيْ وَنَحْرِيْ

“আমার প্রতি আল্লাহর এটা নি'য়ামাত যে, আমার ঘরে, আমার পালার দিনে এবং আমার গণ্ড ও সিনার মাঝে রসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকাল হয়।” [সহিহ বুখারি, হা/ ৪৪৪৯]
সর্বোপরি, এটা এমন কোন শব্দ নয় যে, পরিবর্তন করলে তা শরিয়ত পরিপন্থী কাজ হবে বা গুনাহ হবে। যেমন: কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম ইত্যাদি।এগুলো পরিবর্তন করা শরিয়ত সম্মত নয়।
মোটকথা, সর্বস্তরের বাংলাভাষী মানুষ যে শব্দটি উচ্চারণ করে ও বুঝে এবং বাংলা ভাষা সাহিত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সে শব্দটি অবিকৃত রাখাই ভালো মনে করি। সুতরাং ‘সাহরি’ নয় বরং ‘সেহেরি/সেহরি/সেহেরী’ বলাই অধিক উপযুক্ত। এটি একান্তই আমার ব্যক্তিগত অভিমত। এ ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে যে কেউ দ্বিমত করার অধিকার রাখে। আল্লাহু আলাম।

ঋতুমতী নারীর রোজা রাখার বিধান কি? বাড়িতে পুরুষ থাকার কারণে লজ্জা বশত: কোনও ঋতুমতী নারী যদি রোজা রাখে তাহলে কি তার গুনাহ হবে?

প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর মাসিক ঋতুস্রাব বা পরিয়ড হওয়া খুব স্বাভাবিক বিষয়। এটি তার শারীরিক সুস্থতা এবং গর্ভধারণে সক্ষমতার আলামত। পিরিয়ডের দিনগুলো অন্য স্বাভাবিক দিনগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন রকম থাকে। হরমোনের কারণে কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে৷ এই সময় মেয়েদের শরীর অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশি দুর্বল থাকে। অনেকের জরায়ু নিচের দিকে নেমে আসে, তলপেট স্ফীত হয়! ব্যথা করে৷এমনকি বমিও হয়।
তাই এ অবস্থায় তাদের কষ্ট লাঘবে দয়াময় আল্লাহ নামাজ-রোজার বিধান রহিত করেছেন। সুতরাং এ সময় তাদের জন্য নামাজ-রোজা করা জায়েজ নাই।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,


أليس إذا حاضت المرأة لم تصل ولم تصم؟

“এমন কি নয় যে, ঋতু কালীন সময়ে একজন নারী সালাত পড়ে না ও রোজা রাখে না”? [সহীহ বুখারী, হা/২৯৮; সহীহ মুসলিম, হা/৮০]
তবে ঋতুমতী নারী পবিত্র হলে শুধু রোজাগুলো কাজ করবে; নামাজগুলো কাজা করবে না।

মা-জননী আয়েশা রা. বলেন,


كنا نحيض على عهد رسول الله صلى الله عليه وسلم فكنا نؤمر بقضاء الصوم، ولا نؤمر بقضاء الصلاة

“আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঋতুমতী হতাম। আমাদেরকে তখন রোজাগুলো কাজা করার নির্দেশ প্রদান করা হত; কিন্তু নামাজ গুলো কাজা করার নির্দেশ দেওয়া হত না”।[সহীহ বুখারী, হা/৩১৫, সহীহ মুসলিম, হা/৩৩৫]

সুতরাং নারীদের জন্য ঋতুস্রাব অবস্থায় নামাজ-রোজা করা জায়েজ নাই। আর লোকলজ্জার কারণে ঋতুস্রাব অবস্থায় নামাজ-রোজা অব্যাহত রাখলে সেগুলো শুধু বাতিল বলেই গণ্য হবে না বরং এ জন্য গুনাহগারও হতে হবে।
তবে কোন মেয়ে যদি তার ঋতুস্রাব হওয়ার বিষয়টি কোন পুরুষের নিকট প্রকাশিত হওয়াতে লজ্জাবোধ করে বা শরিয়ত সম্মত কোনও কারণে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে চায় আর এ কারণে সে তাদের সামনে রোজার ভান ধরে বা সেহেরি বা ইফতারের সময় পরিবারের সবার সাথে খাওয়া-দাওয়া করে তাহলে তাতে কোন গুনাহ নেই। তবে রোজার নিয়ত করবে না। অন্যথায় তা গুনাহের কারণ হবে।
শাইখ বিন বায রাহ. কে প্রশ্ন করা হয়, কোনও মহিলা যদি মাসিক ঋতুস্রাবের কারণে লজ্জাবশত রমজানের রোজা রাখার ভান করে তাহলে তার গুনাহ হবে কি?
তিনি বলেন,


 ليس عليها إثم إذا ما بينت أنها حائض، لكن لا تصم لا تنو الصيام، أما إذا سكتت ولم تقل: إني حائض ولم تقل: إني مفطرة ما يضرها ذلك، لكن إذا كانت تنوي الصوم هذا لا يجوز هذا منكر الصوم باطل

“এতে তার কোন গুনাহ নেই যদি সে প্রকাশ না করে যে, সে ঋতুমতী। কিন্তু সে রোজা রাখবে রাখবে না বা রোজার নিয়ত করবে না। কিন্তু যদি সে চুপ থাকে- বলেনা যে, আমি ঋতুমতী আবার এও বলেন না যে, আমি রোজা ভঙ্গকারী। এতে তার কোনও ক্ষতি নেই। তবে যদি সে রোজা রাখার নিয়ত করে করে তবে তা জায়েজ হবে না। এটা গর্হিত কাজ আর এই রোজাও বাতিল।” [binbaz]
আল্লাহু আলাম।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৩ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে