যদি কোনো প্রশ্নকারী এ প্রশ্ন করে যে: তাবিলপন্থীদের মাযহাব যে বাতিল তা আমরা সিফাত অধ্যায়ে বুঝতে পেরেছি। আর এটা জানা যে আশ‘আরী সম্প্রদায় তাবিলপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত। তাহলে কি আশ‘আরীদের মাযহাব বাতিল? অথচ বলা হয়ে থাকে যে, মুসলিমদের মধ্যে শতকরা পঁচানব্বই জনই আশ‘আরী।

যেখানে ইমাম আবুল হাসান আল-আশ‘আরী, আশ‘আরীদের অনুসরণীয় আদর্শ, সেখানে তাদের মাযহাব কি করে বাতিল হতে পারে? তাদের মাযহাব কি করে বাতিল হতে পারে, যেখানে তাদের মধ্যে অমুক অমুক আলেম রয়েছেন, যারা আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর কিতাব, তাঁর রাসূল, মুসলিমদের ইমামগণ ও সাধারণ মুসলিমদের জন্য কল্যাণপ্রত্যাশী ছিলেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব যে, অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনায় আশ‘আরীদের সংখ্যা এত বিশাল হবে এটি এমন একটি দাবি যা প্রমাণ করার জন্য সূক্ষ্ণ পরিসংখ্যান প্রয়োজন।

যদি আমরা মেনেও নিই যে আশ‘আরীদের সংখ্যা উল্লিখিত পরিমাণেই আছে, অথবা তার চেয়েও বেশি, তবু আমরা বলতে পারি না যে তারা ভুল থেকে মুক্ত। কারণ যা ভুলমুক্ত তা হলো মুসলিমদের ইজমা, সংখ্যায় অধিক হলেই ভুলমুক্ত হবে, তা জরুরি নয়। আর মুসলিমগণ প্রাচীনকালে যে বিষয়ে ইজমা করেছেন তা তাবিলপন্থীদের বিপরীত। সালাফে সালেহীন যারা এই উম্মতের পুরোভাগে ছিলেন - যেমন সাহাবায়ে কেরাম, তাবে‘ঈন এবং তৎপরবর্তী হিদায়েতের দিশারি ইমামগণ তারা সকলেই এ ব্যাপারে ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের জন্য যে নাম ও সিফাতসমূহ সাব্যস্ত করেছেন, অথবা আল্লাহ তা‘আলার জন্য তাঁর রাসূল যেসব নাম ও সিফাতসমূহ সাব্যস্ত করেছেন, তা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা হবে। আর এ সংক্রান্ত মূলবক্তব্যকে আল্লাহর জন্য উপযোগীভাবে তার বাহ্যিক অর্থেই নেওয়া হবে, কোনো বিকৃতিসাধন, বাতিলকরণ, ধরন-ধারণ নির্ধারণকরণ ও উদাহরণ নির্ণয়করণ ব্যতীতই।

আর তারা হলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা অনুযায়ী, উত্তম যুগের মানুষ। তাদের ঐকমত্য আবশ্যিকভাবে মান্য প্রমাণ। কেননা তাদের ইজমায় প্রতিফলিত হয়েছে কুরআন-সুন্নাহর দাবি। সিফাত-বিষয়ক মূলবক্তব্যে আলোচনাকালে চতুর্থ নম্বর মূলনীতিতে তাদের ইজমার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে।

ইমাম আবুল হাসান আশ‘আরী এবং অন্যান্য ইমামগণ নিজেদেরকে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে মনে করতেন না। বরং তারা তো দ্বীনের ইমাম বনার মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন নিজেদের কদর যথার্থরূপে বুঝা এবং নিজেদেরকে যথার্থ স্থানে রাখতে পারার কারণেই। তাদের অন্তরে ছিল আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নতের তা‘যীম। যার কারণেই তারা ইমাম হওয়ার যোগ্য হয়েছিলেন। ইরশাদ হয়েছে:

﴿ وَجَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُواْۖ وَكَانُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا يُوقِنُونَ ٢٤ ﴾ [السجدة: ٢٤]

আর আমি তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা করেছিলাম, তারা আমার আদেশানুযায়ী সৎপথ প্রদর্শন করত, যখন তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তারা আমার আয়াতসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখত। (সূরা আস্সাজদাহ: ৩২: ২৪)

আল্লাহ তা‘আলা ইব্রাহীম আ. সম্পর্কে বলেন:

﴿ إِنَّ إِبۡرَٰهِيمَ كَانَ أُمَّةٗ قَانِتٗا لِّلَّهِ حَنِيفٗا وَلَمۡ يَكُ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ١٢٠ شَاكِرٗا لِّأَنۡعُمِهِۚ ٱجۡتَبَىٰهُ وَهَدَىٰهُ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ١٢١ ﴾ [النحل: ١٢٠، ١٢١]

নিশ্চয় ইব্রাহীম ছিলেন এক উম্মত[1], আল্লাহর একান্ত অনুগত ও একনিষ্ঠ। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। সে ছিল তার নিয়ামতের শুকরকারী। তিনি তাকে বাছাই করেছেন এবং তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। (সূরা আন-নাহল: ১৬: ১২০- ১২১)

>
[1] তিনি উম্মত বা জাতি ছিলেন, এই অর্থে যে, একটি জাতির মাঝে যে সমস্ত গুণাবলি পাওয়া যায়, ব্যক্তি ইব্রাহীমের মাঝেই তা বিদ্যমান ছিল। কারও কারও মতে এর অর্থ ‘আদর্শ পুরুষ’ ‘‘ইমাম’ বা কল্যাণের শিক্ষক।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পরবর্তীযুগে যারা এসেছে এবং নিজেদেরকে ইমাম আশ‘আরীর অনুসারী বলে দাবি করে, তারা মূলত ইমাম আশ‘আরীকে যথার্থরূপে অনুসরণ করেনি; কারণ ইমাম আশ‘আরীর আকীদা তিনটি পর্যায় দিয়ে অতিক্রম করেছে।

প্রথম পর্যায়: মুতাযিলা মতবাদ পর্যায়: অর্থাৎ ইমাম আশ‘আরী চল্লিশ বছর পর্যন্ত মুতাযিলা সম্প্রদায়ের মতবাদ পোষণ করে চলেছেন। এ সময় তিনি মুতাযিলা মতবাদের পক্ষে অন্যদের সঙ্গে বিতর্ক করেছেন। এরপর তিনি মুতাযিলা মতবাদ থেকে ফিরে আসেন এবং মুতাযিলাদের গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করে কঠোরভাবে তাদের যুক্তিতর্ক খণ্ডন করেন।[1]

দ্বিতীয় পর্যায়: মুতাযিলা ও আহলে সুন্নতের মাঝামাঝি পর্যায়।

এ পর্যায়ে তিনি আবু মুহাম্মদ আবদুল্লাহ ইবনে কুল্লাব এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘আশ‘আরী এবং তার মতো যারা আছেন তারা হলেন সালাফ এবং জাহমিয়াদের মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থিত। তারা সালাফদের কাছ থেকে বিশুদ্ধ কথা গ্রহণ করেছেন এবং জাহমিয়াদের কাছ থেকে যুক্তিভিত্তিক মতবাদসমূহ গ্রহণ করেছেন, যা তাদের কাছে বিশুদ্ধ বলে মনে হতো, কিন্তু আসলে তা ছিল অশুদ্ধ।’[2]

তৃতীয় পর্যায়: আহলে সুন্নতের মতাদর্শ আপন করে নেয়ার পর্যায়, যাদের ইমাম হলেন আহমদ ইবনে হাম্বল রা.। ইমাম আশ‘আরী এ কথাটি তার সর্বশেষ কিতাব الإبانة في أصول الديانة (আল ইবানাহ ফী উসূলিদ্দিয়ানাহ) তে উল্লেখ করেছেন।

ইমাম আশ‘আরী র. এ কিতাবের ভুমিকায় বলেছেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সম্মানিত কিতাব নিয়ে আমাদের কাছে এসেছেন। যে কিতাবের আগে-পিছে কোনো বাতুলতা আসে না। যা প্রজ্ঞাময়, সপ্রশংসিত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। যে কিতাবে পূর্বের সকল ইলম একত্র হয়েছে। যে কিতাব দ্বারা দ্বীন ও অবশ্য পালনীয় বিধানসমূহ পরিপূর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। আর তা আল্লাহ তা‘আলার সরল পথ। শক্ত রজ্জু। যে এ কিতাবকে আঁকড়ে ধরবে সে নাজাত পাবে। আর যে তার বিপক্ষে যাবে সে পথভ্রষ্ট ও গোমরাহ হয়ে যাবে, অজ্ঞতায় নিপতিত হবে। আর আল্লাহ তা‘আলা তার এ কিতাবে রাসূলের সুন্নত আঁকড়ে ধরার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ﴾ [الحشر: ٧]

রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও। (সূরা আল হাশর ৫৯: ৭)

ইমাম আশ‘আরী র. তাঁর ভুমিকায় আরো বলেছেন যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাঁর রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর নিজের আনুগত্য করার। অনুরূপভাবে তিনি তাঁর কিতাব অনুযায়ী আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে যারা ভাগ্যহারা, শয়তান যাদের ওপর চড়াও হয়েছে, তারা আল্লাহর নবীর সুন্নতকে পেছনে ছুড়ে মেরেছে, পরিত্যাগ করেছে। তারা তাদের কিছু পূর্বসূরির প্রতি ধাবিত হয়েছে যাদের মতাদর্শ তারা অন্ধভাবে মেনে অনুসরণ করেছে, যাদের দ্বীনকে তারা নিজেদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করেছে এবং তারা রাসূলের সুন্নতকে বাতিল করে দিয়েছে, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অস্বীকার করেছে। তারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটনা করতে গিয়েই এরূপ করেছে। অতএব কুরআনের ভাষায় (তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।) (সূরা আন-আনআম: ৬: ১৪০)

এরপর ইমাম আশ‘আরী র. বিদআতপন্থীদের একটি নীতির কথা উল্লেখ করেন এবং তা বাতিল বলে ইঙ্গিত করেন। তারপর তিনি বলেন:

‘যদি কেউ আমাকে এ প্রশ্ন করে বলে যে, আপনি তো মুতাযিলা, জাহমিয়াহ, হারুরিয়া, রাফেযা, মুরজিয়াহ- এদের সকলের কথাকে অস্বীকার করলেন। তাহলে আপনার নিজস্ব বক্তব্য এবং আপনি যে মতাদর্শ বহন করেন সে ব্যাপারে কি আমাদের বলবেন?

এ জাতীয় প্রশ্নকারীর উত্তর দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যে কথা বলি এবং মতাদর্শ বহন করি তা হলো - আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা, আমাদের নবীর সুন্নতকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, হাদীসের ইমামগণ যা বলেছেন তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা। আমরা এগুলোকে শক্তভাবে ধরে থাকি। আর আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল- আল্লাহ তার চেহারা উজ্জ্বল করুন, তার দরজা বুলন্দ করুন, তাকে অঢেল প্রতিদানে ভূষিত করুন- যা বলতেন আমরাও তা বলি। আর যারা তার বিপরীতে যায় আমরা তাদের এড়িয়ে চলি; কেননা তিনি একজন মর্যাদাবান ইমাম ও পূর্ণাঙ্গ নেতা।’

এরপর তিনি ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল র. এর মাধ্যমে যে সত্য প্রকাশিত হয়েছে তার জন্য তার প্রশংসা করেন এবং সিফাতসমূহ আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত হওয়া, তাকদীর সম্পর্কে কিছু মাসআলা, শাফাআত এবং কিছু ওহীনির্ভর বিষয়ের কথা উল্লেখ করেন এবং তিনি তা ওহী ও যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত করেন।

পরবর্তী যুগে যারা এসেছে এবং ইমাম আশ‘আরীর অনুসারী বলে দাবি করেছে তারা তার আকীদাগত জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কথাগুলো নিয়েছে এবং সকল সিফাতের ক্ষেত্রে তাবীলের পথ বেছে নিয়েছে। তারা কেবল সাতটি সিফাত আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছে যা নিম্নোক্ত কবিতায় সন্নিবিষ্ট:

حــي عليـم قدير والكلام لـــه إرادة وكذلك السمع والبصر

অর্থাৎ -চিরঞ্জীব, সর্বজ্ঞ, সর্বক্ষমতাবান, কথা, ইচ্ছা, শ্রবণ ও দর্শন।

এ সিফাতগুলো সাব্যস্ত করার ধরণ কি হবে সে ব্যাপারেও আহলে সুন্নত ও তাদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।

আশ‘আরিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করে ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. বলেন: ‘যারা আশ‘আরিয়াদের সমালোচনা করেছেন তাদের উদ্দেশ্য হলো ওইসব আশ‘আরী যারা আল্লাহ তা‘আলার ওইসব সিফাতসমূহকে নাকচ করে দেয় যার সংবাদ কুরআন-সুন্নাহয় এসেছে। আর ইমাম আশ‘আরী তাঁর শেষ জীবনে ‘আল ইবানা’ নামক যে গ্রন্থটি লিখেছিলেন সে গ্রন্থের বক্তব্য যারা মেনে নেয় তারা আহলে সুন্নতের মধ্যে শামিল।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৫৯)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া এর পূর্বে পৃষ্ঠা নং ৩১০-এ বলেছেন: ‘আশআরিয়ারা হলো তাদের বিপরীত (অর্থাৎ ইমাম আবুল হাসান আল আশ‘আরীর প্রকৃত অনুসারীদের বিপরীত)। তাদের কথা তা‘তীল (আল্লাহর সিফাত বাতিল করে দেওয়া)-কে আবশ্যক করে দেয়। তারা বলে যে, আল্লাহ তা‘আলা না এ মহাবিশ্বের ভিতরে, না তার বাইরে। তারা বলে যে আল্লাহর সকল কথার অর্থ এক। আয়াতুল কুরসী যে অর্থ ব্যক্ত করে, ঋণ বিষয়ক আয়াতও অভিন্ন অর্থ ব্যক্ত করে। তাওরাত ও ইঞ্জীলও একই অর্থ বহন করে। আর এটা স্পষ্ট বাতিল কথা।’

ইমাম ইবনুল কাইয়েম তার এক কবিতায় বলেন:

واعلم بأن طريقهم عكس الـ ـطريق المستقيم لمن له عينان

জেনে রাখুন যে তাদের পথ সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে আলাদা

দুচোখ আছে যার তার কাছে।[3]

শায়খ মুহাম্মদ আমীন আশ্শানকিতী তার তাফসীর গ্রন্থ ‘আদওয়াউল বায়ান’- এ সূরায়ে আ‘রাফে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক আরশের ওপরে ওঠা বিষয়ক আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘জেনে রাখুন যে, পরবর্তী যুগের অসংখ্য মানুষ এই বিষয়ে ভুল করেছে। তারা ধারণা করেছে যে, ‘ইস্তিওয়া’ এবং ‘হাত’ শব্দের বাহ্যিক যে অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে মাথায় আসে, তা সৃষ্টিজীবের গুণের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। তারা বলেছে যে, ‘এ শব্দদ্বয়কে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে নেওয়া ইজমায়ে উম্মত অনুযায়ী ওয়াজিব।’

তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির সামান্য আকল-বুদ্ধি আছে, তার কাছে এ কথাটি অত্যন্ত পরিস্কার যে, উল্লিখিত কথার মর্ম হলো, আল্লাহ তা‘আলা, আল কুরআনে, নিজেকে এমনসব গুণে গুণান্বিত করেছেন যার তাৎক্ষণিক বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর প্রতি কুফরী করা এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা বলা হিসেবে সাব্যস্ত হয় যা আল্লাহর ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ [النحل: ٤٤]

এবং আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার, যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৪৪)

সেই নবী এ ব্যাপারে একটি অক্ষরও স্পষ্ট করলেন না, অথচ নির্ভরযোগ্য আলেমদের ইজমা অনুযায়ী, যে সময় কোনো আয়াতের বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে হবে সে সময় থেকে স্পষ্টকরণ প্রক্রিয়াকে পিছিয়ে দেওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য জায়েয নয়। আর তা যদি আকীদার ব্যাপারে হয় যার বাহ্যিক অর্থ কুফরী এবং স্পষ্ট গোমরাহী, তবে তো স্পষ্ট করার গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট করলেন না, এমনকি পরিশেষে ওইসব অজ্ঞ লোকদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে যারা ধারণা করেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ওপর এমন সিফাত আরোপ করেছেন যার বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়টি অব্যক্ত রেখে গেলেন যে, এ বাণীগুলোর বাহ্যিক অর্থ কুফরী ও গোমারাহী। এটা কিছুতেই হতে পারে না। অতএব তারা যা করেছে তা কেবলই খেয়াল-খুশি মুতাবেক করেছে, তারা এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর আশ্রয়ে যায়নি। এটা এক মিথ্যাচার যা থেকে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র। এটা সবচেয়ে বড় গোমারাহী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর চরম মিথ্যাচার।

যে ব্যক্তির সামান্যতম আকলবুদ্ধি আছে, সে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করে না যে, প্রত্যেক ওই গুণ যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে গুণান্বিত করেছেন, অথবা যা দ্বারা রাসূল তাঁকে গুণান্বিত করেছেন, যে ব্যক্তির অন্তরে সামান্য পরিমাণ ঈমানও রয়েছে, এ গুণগুলো শোনামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে তার মাথায় যে বিষয়টি আসে তা হলো আল্লাহ তা‘আলার গুণকে মাখলুকের গুণের সাদৃশ্যতা থেকে পবিত্র মনে করে বাহ্যিক অর্থটাকে বুঝা। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টবস্তু থেকে সত্তায় ও গুণে সম্পূর্ণ আলাদা, এ বিষয়টি কি কেউ অস্বীকার করতে পারে? না, পারে না। যারা সত্যকে অমান্য করে তারা ব্যতীত এ বিষয়টিকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না।

আর ওই অজ্ঞ মিথ্যাচারী ব্যক্তি, যে মনে করে যে, সিফাত-বিষয়ক আয়াতের বাহ্যিক অর্থ আল্লাহর জন্যে উপযোগী নয়; কেননা তা তার কাছে কুফরী ও তাশবীহ (মাখলুকের সঙ্গে সাদৃশ্যকরণ), সে এরূপ কথা এ জন্য বলতে পেরেছে যে, তার অন্তর খালেক ও মাখলুকের মধ্যে সাদৃশ্যকরণের পঙ্কিলতায় নাপাক হয়ে আছে। তাই সাদৃশ্যকরণের আপদ তাকে আল্লাহর সিফাত অস্বীকার করার দিকে নিয়ে গেছে। আল্লাহর সিফাতের প্রতি ঈমান না আনার দিকে নিয়ে গেছে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং নিজেকে এসব গুণে গুণান্বিত করেছেন। অতএব এই জাহেল প্রথমে নিজে মুশাবিবহ তথা সাদৃশ্যকারী হয়েছে, এবং পরবর্তীতে মু‘আত্তিল তথা আল্লাহর সিফাত বাতিলকারী হয়েছে। অতএব আল্লাহর জন্য যা উপযোগী নয়, এমন কথা বলার পাপে সে শুরুতে যেমনি শেষেও তেমনি, জড়িয়ে পড়েছে। যদি তার অন্তর যথার্থরূপে আল্লাহ তা‘আলাকে চিনতে পারত। আল্লাহ তা‘আলাকে যথার্থরূপে তা‘যীম করতে জানত, তাহলে সে তাশবীহ (সাদৃশ্যকরণ) এর পঙ্কিলতা থেকে নিজেকে পবিত্র করে নিত। সে আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক বাণীসমূহের বাহ্যিক অর্থকে মাখলুকের সঙ্গে সকল সাদৃশ্যতা থেকে ঊর্ধ্বে বলে বিশ্বাস করত এবং তার অন্তর কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত আল্লাহ তা‘আলার সকল সিফাতে কামালের প্রতি ঈমান আনার জন্য প্রস্তুত থাকত। পাশাপাশি সে আল্লাহর সকল গুণকে মাখলুকের গুণের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ভাবা থেকে পবিত্র থাকত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]

তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (আশশূরা: ৪২: ১১)’[4]আর ইমাম আবুল হাসান আল আশ‘আরী র. তার শেষ জীবনে, আহলে সুন্নত ও আহলে হাদীসের মাযহাবের ওপর ছিলেন। আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের জন্য যেসব সিফাত সাব্যস্ত করেছেন অথবা রাসূলের মাধ্যমে যেসব সিফাত সাব্যস্ত করেছেন, সেসব সিফাতকে কোনো বিকৃতি সাধন, বাতিলকরণ, ধরন-ধারণ নির্ধারণকরণ এবং উদাহরণ নির্ণয়করণ ব্যতীতই মেনে নেওয়া। আর মানুষের মাযহাব হলো সেটা যা সে শেষ জীবনে লালন করে, যদি তার কথা এ ব্যাপারে পরিষ্কার থাকে যে, এর বাইরে তার কোনো বক্তব্য নেই, যেমনটি করেছেন আবুল হাসান আশ‘আরী র.। ‘আল ইবানা’ গ্রন্থে থাকা আশ‘আরী এর বক্তব্য থেকে আমরা এটাই বুঝতে পারি। অতএব পরিপূর্ণরূপে ইমাম আশ‘আরী র. এর অনুসরণ করতে হলে তিনি তার জীবনের শেষ ভাগে যার ওপর ছিলেন তার অনুসরণ করতে হবে। আর তা হলো আহলে সুন্নত ও আহলে হাদীসের মাযহাব অনুসরণ করা। কেননা এটাই হলো সঠিক মাযহাব যার অনুসরণ ইমাম আবুল হাসান আল আশ‘আরী র. করেছেন।

>
[1] - শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড. ৪, পৃষ্ঠা. ৭২

[2] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ১৬, পৃ. ৪৭১

[3] - আন-নুনিয়াহ, হাররাসের ব্যাখ্যাসহ, পৃ. ৩১২

[4]- তাফসীর আদওয়াউল বায়ান, ২/৩১৯।

তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর

দু‘ভাবে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যায়:

প্রথমত: সত্যকে ব্যক্তি দিয়ে মাপা হয় না, বরং ব্যক্তিকে সত্য দিয়ে মাপা হয়। আর এটাই হলো সঠিক মানদণ্ড। যদিও কোনো ব্যক্তির কথা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার অবস্থান ও পদমর্যাদার প্রভাব থাকে, সে হিসেবে ন্যায়বান ব্যক্তির কথা মেনে নেওয়া হয়, পক্ষান্তরে যে ফাসিক তার কথা মেনে নেওয়া হয় না। তবে এটা সর্বাবস্থায় মানদণ্ড হিসেবে খাটে না। কেননা মানুষ তো মানুষই। তারা পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হয়। পরিপূর্ণরূপে বুঝতে তারা কখনো ব্যর্থ হয়। কখনো এমন হয় ব্যক্তি খুব ধার্মিক, চরিত্রবান কিন্তু তার জ্ঞান অপূর্ণ, তার বুঝার ক্ষমতা দুর্বল। অথবা সে বিশেষ পদ্ধতিতে বড় হয়েছে, অথবা বিশেষ মাযহাবের ওপর বড় হয়েছে এবং সে অন্যকোনো মাযহাবকে জানে না। অতঃপর সে মনে করে যে, সে যা জানে তার মধ্যেই সত্য সীমিত।

দ্বিতীয়ত

আশ‘আরী মতবাদপন্থী আলেমদেরকে যদি সালাফপন্থী আলেমদের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, সালাফপন্থী আলেমগণ অধিক মর্যাদাবান, হিদায়েত ও সত্য পথে অধিক পরিচালিত; কেননা চার মাযহাবের চার ইমাম, যাদের মাযহাবকে অনুসরণ করা হয়, তারা আশ‘আরীপন্থী ছিলেন না।

আর যদি আপনি চার ইমামকে অতিক্রম করে আরো ওপরে যান তবে দেখতে পাবেন যে, তাবে‘ঈগণের কেউই আশ‘আরীপন্থী ছিলেন না।

যদি আপনি আরো ওপরে সাহাবায়ে কেরাম ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে যান তবে দেখতে পাবেন তাদের কেউই আল্লাহর নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রে পরবর্তী যুগের আশ‘আরীপন্থীরা যে মতাদর্শ পোষণ করে তা পোষণ করতেন না।

আমরা অস্বীকার করি না যে, আশ‘আরীপন্থী কিছু আলেম এমন আছেন ইসলামে যাদের অবস্থান খুব সুসংহত। ইসলাম প্রতিরক্ষা, আল্লাহর কিতাবের যত্ন নেয়া, সুন্নতের সার্বিক যত্ন নেয়া, মুসলিমদের হিদায়েত ও উপকার পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কাজ করে যাওয়ার বিষয়ে যাদের ভুমিকা স্বীকৃত। কিন্তু এর আবশ্যিক দাবি হিসেবে এটা আসে না যে, তারা ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে এবং তাদের সকল কথাই গ্রহণযোগ্য। পাশাপাশি এটাও আবশ্যক নয় যে, তাদের ভুলত্রুটি দেখিয়ে দেওয়া যাবে না এবং সত্যকে বয়ান করা যাবে না অথবা মানুষকে সঠিক পথ দেখানো যাবে না।

আমরা এটাও অস্বীকার করি না যে কিছু আলেমের কাছে সঠিক ধারণা অস্পষ্ট থাকার ফলে, সদিচ্ছাবশতই তাদের মতাদর্শ লালন করে যাচ্ছেন। তবে কথা হলো, কোনো বক্তব্যকে গ্রহণ করে নেওয়ার জন্য, বক্তার সদিচ্ছা থাকাটাই মূল বিষয় নয়। বরং এক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলো বক্তার বক্তব্য শরীয়তসম্মত হওয়া। আর যদি শরীয়তসম্মত না হয় তবে বক্তা যেই হোন না কেন, তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা ওয়াজিব; কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন:

«من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد»

যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করলো যে ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশ নেই, তবে তা প্রত্যাখ্যাত।[1]
এরপর যদি বক্তা এমন হন যিনি কল্যাণকামী ও সত্যানুসন্ধানে ঐকান্তিক হওয়ার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ, তাহলে সে যে সত্যের বিপরীতে কথা বলছে, সে ব্যাপারে তাকে অপারগ মনে করা হবে। এর অন্যথা হলে তার অসৎ ইচ্ছা এবং সত্যের বিরোধিতার কারণে সে যে ধরনের আচরণের উপযোগী তার সঙ্গে সে ধরনের আচরণই করা হবে।

>
[1] - বর্ণনায় বুখারী, কিতাবুল ইতিসাম, অনুচ্ছেদ শিরোনাম : যখন কেউ ইজতিহাদ করে; মুসলিম কিতাবুল আকযিয়াহ, হাদীস নং (১৭১৮)

যদি কোনো প্রশ্নকারী বলে যে, আপনারা কি তাবিলপন্থীদের কাফির বা ফাসিক বলেন? তাহলে এর উত্তরে বলব যে, কাউকে কাফির বা ফাসিক হুকুম জারি করার আধিকার আমাদের নেই। তা বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অধিকার। অতএব এ জাতীয় হুকুমের উৎস হলো একমাত্র কুরআন-সুন্নাহ। সুতরাং এ ব্যাপারে খুব সতর্কতা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের যাচাই বাছাই করতে হবে এবং এমন ব্যক্তিকে কখনো কাফির বা ফাসিক বলা যাবে না যার কুফরী বা ফিসক কুরআন অথবা সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত নয়।

আর এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, যে মুসলিম বাহ্যত আদেল তথা ন্যায়পরায়ণ, তার আদালত তথা ন্যায়পরায়ণতা ততক্ষণ পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে না যতক্ষণ না শরীয়তের কোনো দলিলের দাবি তা বিলুপ্ত করে দেয়। আর যখন শরীয়তের কোনো দলিল তার আদালত-সততাকে বিলুপ্ত করে দেবে, তখন তাকে কাফির কিংবা ফাসিক বলার ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা দেখানো যাবে না; কাফির কিংবা ফাসিক বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দু‘কারনে জরুরি:

এক. এই হুকুমের ব্যাপারে আল্লাহর ওপর মিথ্যাচারিতা এবং যে ব্যক্তির ওপর কুফরী বা ফিসকের হুকুম লাগানো হলো তার ওপরও মিথ্যাচারিতা।

দুই. যে ব্যক্তির ওপর কুফরী ও ফিসকের হুকুম লাগানো হলো সে যদি প্রকৃত অর্থে কাফের বা ফাসিক না হয়ে থাকে, তা হলে যে হুকুম লাগাল সেই তাতে পতিত হবে। সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إذا كفر الرجل أخاه فقد باء بها أحدهما»

যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে হুকুম লাগায়, তবে এ হুকুমটি তাদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনের প্রতি ফিরে আসবে।[1]

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে:

«إن كان كما قال وإلا رجعت عليه»

সে যা বলেছে ওই ব্যক্তি যদি তার উপযোগী হয় তো হলোই, অন্যথায় তা বক্তার প্রতি ফিরে আসবে।

সহীহ মুসলিমে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من دعا رجلا بالكفر أو قال عدو الله وليس كذلك إلا حار عليه»

যে ব্যক্তি কোনো এক ব্যক্তিকে কাফির বলে ডাকল অথবা বলল যে সে আল্লাহর শত্রু, অথচ সে বাস্তবে সে রকম নয়, তাহলে তা বুমেরাং হয়ে তার প্রতিই ফিরে আসবে।[2]

অতএব একজন মুসলিমকে কাফির বা ফাসিক বলে ডাকার আগে দুটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে:

এক. কুরআন অথবা সুন্নাহয় এ ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে যে এই কথাটি বললে বা এই কাজটি করলে অনিবার্যভাবে ব্যক্তি কাফির বা ফাসিক হয়ে যায়।

দুই. সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, যে কুফরীপূর্ণ অথবা ফিসকপূর্ণ কোনো কথা বলেছে বা এ জাতীয় কোনো কাজ করেছে, তার ওপর এই হুকুমটি বর্তানো। অর্থাৎ কাফির অথবা ফাসিক হওয়ার সকল শর্ত ওই ব্যক্তির মধ্যে উপস্থিত থাকা এবং এ হুকুম লাগানোর পথে কোনো বাধা না থাকা।

যেসব শর্তসমূহ উপস্থিত থাকতে হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ব্যাপারে ব্যক্তির জ্ঞান থাকা যে, সে যা বলছে বা করছে, তার অনিবার্য পরিণতি হলো কাফির বা ফাসিক হয়ে যাওয়া। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء: ١١٥]

আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ১১৫)

﴿ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِلَّ قَوۡمَۢا بَعۡدَ إِذۡ هَدَىٰهُمۡ حَتَّىٰ يُبَيِّنَ لَهُم مَّا يَتَّقُونَۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٌ ١١٥ إِنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۚ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٖ ١١٦ ﴾ [التوبة: ١١٥، ١١٦]

আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি কোনো সম্প্রদায়কে হিদায়াত দানের পর তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন। যতক্ষণ না তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করবেন, যা থেকে তারা সাবধান থাকবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ। নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর জন্যই আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্য না আছে কোন অভিভাবক, না আছে কোন সাহায্যকারী। (সূরা আত্-তাওবাহ: ৯: ১১৫ -১১৬)

এ কারণেই আলেমগণ বলেছেন: ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি দিনের নয়, এমন কোনো ব্যক্তি যদি ফরজকর্মসমূহ অস্বীকার করে তবে তাকে কাফির বলা হবে না যতক্ষণ না তাকে স্পষ্টরূপে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

আর কাফের বা ফাসিক হিসেবে হুকুম লাগানোর পথে যেসব বাধা থাকে তার মধ্যে একটি হলো, অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো পক্ষ থেকে কুফরী বা ফিসক সংঘটিত হওয়া। আর তা কয়েকভাবে হতে পারে:

যেমন: কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করা হলো, অতঃপর তার অন্তর ঈমানে ভরপূর থাকা সত্ত্বেও সে বাধ্য হয়ে কুফরী করল। এমতাবস্থায় তাকে কাফির বলে হুকুম দেওয়া হবে না। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ مَن كَفَرَ بِٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِهِۦٓ إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦ ﴾ [النحل: ١٠٦]

যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছে, তাদের উপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১০৬)

আরেকটি বাধা হলো কারও চিন্তাশক্তি থেমে যাওয়া। এমন হয়ে যাওয়া যে, সে কি বলছে বা না বলছে তা অনুভব করতে পারছে না। এটা হতে পারে সীমাতীত খুশির আতিশায্যে, অথবা প্রচণ্ডভাবে চিন্তাগ্রস্ত বা ভীত হয়ে পড়ার কারণে।

এর দলিল সহীহ মুসলিমে আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

(নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তাওবায়, যখন সে তাওবা করে তাঁর কাছে ফিরে আসে, ওই ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন যে মরুভূমিতে তার বাহনের ওপর থাকে, অতঃপর বাহনটি -যার ওপর তার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় ছিল - তার হাতছাড়া হয়ে যায় এবং সে তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ে। অতঃপর সে একটি গাছের কাছে আসে এবং এর ছায়ায় শুয়ে পড়ে, এ অবস্থায় যে সে তার বাহনটি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে একেবারে নিরাশ। এরপর সে হঠাৎ করে দেখে যে বাহনটি তার কাছেই দাঁড়ানো। অতঃপর সে তার লাগামটি হাতে নেয় এবং সীমাতীত আনন্দে বলে ওঠে: হে আল্লাহ, তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার রব। সে প্রচণ্ড আনন্দের কারণে ভুল করে ফেলে।)[3]

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘কাউকে কাফির বলে হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি হলো, যে ব্যক্তি সত্যকে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল এবং সদিচ্ছা বহন করল, কিন্তু সে ভুল করল, তাহলে তাকে কাফির বলা হবে না। বরং তার ভুলটিকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। তবে যে ব্যক্তির সামনে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তা স্পষ্ট হয়ে গেল, কিন্তু সে হিদায়েত স্পষ্ট হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধাচরণ করল এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্যপথ অনুসরণ করল, তাহলে সে কাফির। আর যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করল এবং সত্যানুসন্ধানে শিথিলতা দেখালো এবং অজ্ঞতাবশত কথা বলল, তাহলে সে পাপী, গোনাহগার। এরপর সে হতে পারে ফাসিক অথবা তার পুণ্যের সংখ্যা পাপের চেয়ে অধিক।’[4]

তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্য আমি সব সময়ই সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে কাফির, ফাসিক বা গোনাহগার হিসেবে আখ্যায়িত করার ঘোর বিরোধী থেকেছি - যারা আমার কাছে বসে তারা আমার এ অবস্থান সম্পর্কে জানে -। হ্যাঁ, যদি ওই ব্যক্তির ওপর রিসালতের হুজ্জত[5] কায়েম হওয়ার বিষয়টি জানা থাকে, যার বিপক্ষে গেলে মাত্রা বুঝে ব্যক্তি কখনো কাফির, কখনো ফাসিক এবং কখনো গোনাহগার হয়ে যায়, তবে তার কথা আলাদা। আর আমি স্বীকার করি যে, আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতের ভুলত্রুটি নিশ্চয় ক্ষমা করে দিয়েছেন, হোক তা কথাজাত মাসাইল সংক্রান্ত যা ওহীর মাধ্যমে আমরা পেয়েছি, অথবা প্রায়োগিক কোনো মাসাইল সংক্রান্ত। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এসব মাসাইল বিষয়ে বিতর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন, কিন্তু তাদের কেউ কাউকে কাফির, ফাসিক বা গোনাহগার বলে আখ্যায়িত করেননি।’[6]

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ র. এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলেন: ‘আমি এটা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতাম যে, এই এই বললে কোনো ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে বলে সালাফ ও ইমামগণ যে বক্তব্য দিতেন তাও সত্য। তবে সাধারণভাবে কাফির বলা এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যক্তিকে কাফির বলার মধ্যে পার্থক্য করা অত্যাশ্যক।’

তিনি বলেন: ‘তাকফীর তথা কাফির হয়ে যাওয়ার হুকুম লাগানো একটি হুঁশিয়ারি। কারণ যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কথাকে অস্বীকার করল, হতে পারে যে সে নও-মুসলিম (ইসলামের সঙ্গে যার সম্পর্ক নতুন) অথবা হতে পারে যে সে দূরবর্তী কোনো মরুভূমিতে বড় হয়েছে। এমন ব্যক্তি যদি ইসলামের কোনো কিছু অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কাফির বলা হবে না যতক্ষণ না তার ওপর হুজ্জত কায়েম হবে। এমনও হতে পারে যে, ব্যক্তি যেসব বিষয় অস্বীকার করল সেসব বিষয় সংক্রান্ত পবিত্র মূলবক্তব্য সে শোনেনি। অথবা শুনেছে কিন্তু তার কাছে তা প্রমাণিত হয়নি। অথবা ওই সব টেক্সটের বিপক্ষে তার কাছে অন্যকোনো টেক্সট আছে, যার কারণে সে এসব টেক্সটকে তাবিল করেছে, যদিও সে এক্ষেত্রে ভুল করেছে।

আর আমি সব সময়ই বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করতাম যেখানে একব্যক্তি বলেছেন যে: আমি যখন মারা যাব, আমাকে তোমরা জ্বালিয়ে দিও এরপর আমাকে পিশে ফেলিও, এরপর আমাকে সাগরে ছিটিয়ে দিও। আল্লাহর কসম! আল্লাহ যদি আমাকে ধরতে সক্ষম হন তাহলে তিনি আমাকে এমন শাস্তি দেবেন যা তিনি এ মহাবিশ্বে অন্যকাউকে দেননি। লোকেরা তার কথামতোই কাজ করল। আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তিকে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা কি জন্য করেছ। লোকটি বলল, আপনার ভয়ে আমি এরূপ করেছি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে মাফ করে দিলেন।[7]

এই লোকটি আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপারে সন্দেহ করেছে। তাকে সাগরে ছিটিয়ে দিলে আল্লাহ তাকে একত্র করে পুনরায় জীবন দানের ক্ষমতা রাখেন এ ব্যাপারে সে সন্দেহ করেছে। বরং সে বিশ্বাস করেছে যে, সে পুনরুত্থিত হবে না। আর এ ধরণের সন্দেহ বা বিশ্বাস মুসলিমদের ঐক্যমত্য অনুযায়ী কুফরী। তবে লোকটি জাহেল ছিল, এ ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল না। সাথে সাথে সে মুমিন ছিল, সে আল্লাহকে ভয় করত যে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন। আর সে কারণেই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আর যে ব্যক্তি ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখে এবং সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণের ব্যাপারেও আগ্রহী, সে যদি তাবিল করে তাহলে উল্লিখিত ব্যক্তির চেয়েও ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে অধিক হকদার।’

এ থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, বক্তব্য ও বক্তা, কর্ম ও কর্মসম্পাদনকারীর মধ্যে পার্থক্য আছে। অতএব যেকোনো কুফরীপূর্ণ বা ফিসকপূর্ণ কথা বা কাজ, বলামাত্র বা করামাত্রই, বক্তা বা কর্মসম্পাদনকারীকে কাফির বা ফাসিক বলা যাবে না।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. মাজমুউল ফাতাওয়ায় বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো এই যে, যে কথাটি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা অনুযায়ী কুফরী, সে ব্যাপারে সাধারণভাবে বলা হবে যে তা কুফরী, শরঈ দলিল যেভাবে কুফরী প্রমাণিত করেছে ঠিক সেভাবে; কারণ ঈমান হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে আহরিত বিধানসমূহের একটি। ঈমানের ব্যাপারে মানুষের ধারণা ও খেয়াল-খুশি মুতাবিক হুকুম লাগানো যাবে না। আর যে ব্যক্তি কোনো কুফরী কথা বলল, সে কাফির হয়ে গিয়েছে এ হুকুম ততক্ষণ পর্যন্ত লাগানো যাবে না যতক্ষণ না কাফির হয়ে যাওয়ার সকল শর্ত তার ওপর বর্তাবে এবং এ বিষয়ক সকল বাধা দূরিভূত হবে। উদাহরণত, যদি কেউ বলে যে মদ অথবা সূদ হালাল, আর সে ইসলামে নতুন প্রবেশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, অথবা সে দূরবর্তী কোনো মরুভূমিতে বড় হয়ে থাকে, অথবা সে কোনো একটি বাণী শুলন কিন্তু সে বিশ্বাস করল না যে তা আল কুরআনের বাণী, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু এর হাদীস, যেমন সালাফদের কেউ কেউ কোনো কোনো বিষয় অস্বীকার করতেন যতক্ষণ না তাদের কাছে প্রমাণিত হত যে রাসূলুল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বলেছেন।’[8]

এরপর তিনি বলেছেন, এইসব লোকদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত কাফির বলা হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের ওপর রিসালতের হুজ্জত কায়েম হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ ﴾ [النساء: ١٦٥]

যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ১৬৫)

আর আল্লাহ তাআল এ উম্মতের ভুলত্রুটি ও ভুলে যাওয়াকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব বুঝা গেল যে, কথা বা কাজ কখনো কুফরী হয় এবং কখনো ফিসক। তবে যে ব্যক্তি এহেন কথা বলল বা এ জাতীয় কোনো কাজ করল তার কাফির বা ফাসিক হয়ে যাওয়া আবশ্যক নয়। হয়তো কাফির বা ফাসিক হওয়ার শর্ত নাকচ হওয়ার কারণে অথবা কোনো শরঈ বাধা আসার কারণে। তবে যারা ইসলাম ব্যতীত অন্যকোনো ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের, এ পৃথিবীতে, কাফের হওয়ার হুকুম দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তির সম্মুখে সত্য প্রকাশিত হলো কিন্তু সে তার উল্টো চলতে দৃঢ়তা প্রদর্শন করল -কোনো বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে যা সে পূর্ব থেকেই বহন করে আসছে, অথবা তার কোনো গুরুর অনুসরণ করতে গিয়ে যাকে সে তা‘যীম করে, অথবা দুনিয়ার লোভে- তাহলে সে এই উল্টো চলার কারণে মাত্রা বুঝে কাফির অথবা ফাসিক হয়ে যাবে। অতএব মুমিনের ওপর জরুরি যে, সে তার আকীদা ও আমলকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে। কুরআন-সুন্নাহকে সে তার ইমাম বানাবে যা থেকে সে আলো সংগ্রহ করবে। কুরআন-সুন্নাহর পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে চলবে। এটাই হলো সিরাতে মুস্তাকীম যার নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াতে দিয়েছেন:

﴿ وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٥٣ ﴾ [الانعام: ١٥٣]

আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা আল আন‘আম: ৬: ১৫৩)

যারা তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও আমলকে সুনির্দিষ্ট মাযহাবের ওপর স্থিত করেন, তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত যে, তারা যখন কুরআন-সুন্নাহর কোনো মূলবক্তব্য দেখেন যা তাদের মাযহাবের বিপরীত, সেটাকে তারা অনুচিত ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের মাযহাবের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। অতঃপর তারা কুরআন-সুন্নাহকে অনুকরণীয় নয় বরং তাদের মাযহাবের অনুসারী বানিয়ে ফেলেন। কুরআন-সুন্নাহ ব্যতীত যা আছে সেগুলোকে তারা কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী বানান না। এটা হলো প্রবৃত্তিপূজারীদের পথ। এটা হিদায়েত অনুসারীদের পথ নয়। এই পথকে আল্লাহ তা‘আলা ভৎর্সনা করেছেন। তিনি বলেছেন:

﴿ وَلَوِ ٱتَّبَعَ ٱلۡحَقُّ أَهۡوَآءَهُمۡ لَفَسَدَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهِنَّۚ بَلۡ أَتَيۡنَٰهُم بِذِكۡرِهِمۡ فَهُمۡ عَن ذِكۡرِهِم مُّعۡرِضُونَ ٧١ ﴾ [المؤمنون: ٧١]

আর যদি সত্য তাদের কামনা-বাসনার অনুগামী হত, তবে আসমানসমূহ, জমিন ও এতদোভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে যেত; বরং আমি তাদেরকে দিয়েছি তাদের উপদেশবাণী (কুরআন)। অথচ তারা তাদের উপদেশ হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। (সূরা আল মুমিনূন: ২৩: ৭১)

এ ক্ষেত্রে মানুষের অবস্থা যে পর্যবেক্ষণ করতে যাবে সে আজব ধরনের বিষয় দেখতে পাবে। সে বুঝতে পারবে যে, হিদায়েত ও সত্যের ওপরে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা এবং গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া একজন বান্দার জন্য কতোই না প্রয়োজন।

আর যে ব্যক্তি সত্য হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছে নিজের অপারগতা প্রকাশ করবে -আল্লাহ তা‘আলার অমুখাপেক্ষিতার ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান রেখে এবং সে যে আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী তা অন্তরে অনুভব করে -তাহলে অবশ্যই আশা করা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার বান্দার এ প্রার্থনাকে কবুল করবেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ ١٨٦ ﴾ [البقرة: ١٨٦]

আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে। (সূরা আল বাকারা: ২: ১৮৬)

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের ওই লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা সত্যকে সত্য হিসেবে দেখে এবং তার অনুসরণ করে। এবং অসত্যকে অসত্য হিসেবে দেখে এবং তা বর্জন করে চলে। তিনি যেন আমাদেরকে হিদায়েতকারী ও হিদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি যেন আমাদের সৎ ও সংস্কারকারী বানান। তিনি যেন আমাদেরকে হিদায়েত করার পর আমাদের অন্তরকে সত্যচ্যুত না করেন। তিনি যেন আমাদেরকে রহমত দান করেন, নিশ্চয় তিনি সর্বদাতা।

সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি সৃষ্টিকুলে রব। যার অনুকম্পা ও নিয়ামতে সকল ভালো কাজ সম্পন্ন হয়। আর সালাত ও সালাম রহমতের নবীর ওপর, যিনি উম্মতকে প্ররাক্রমশালী ও সপ্রংশ আল্লাহ তা‘আলার পথ দেখিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই। সালাত ও সালাম তার পরিবারবর্গের প্রতি, সাহাবীগণের প্রতি এবং যারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করবেন তাদের সকলের প্রতি।


১৫ শাওয়াল, ১৪০৪ হি. তারিখে এ বইটি লেখার কাজ সম্পন্ন হলো

আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষীমুহাম্মদ আস-সালেহ আল উসাইমীন।

>
[1] মুসলিম, হাদীস নং ১১১।

[2] - বর্ণনায় মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ওইব্যক্তির ঈমানের অবস্থা যে তার ভাইকে ‘ হে কাফির’ বলে ডাকল, হাদীস নং (৬১৬০)

[3] - বর্ণনায় মুসলিম, তাওবা অধ্যায়, হাদীস নং ( ২৭৪৫-২৭৪৭)

[4] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ১২, পৃ. ১৮০

[5] - রিসালতের হুজ্জত বলতে বুঝায় রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বিধান নিয়ে এসেছেন তা স্পষ্টরূপে কারো কাছে পৌঁছে দেয়া।

[6] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৩, পৃ. ২২৯

[7] - বুখারী, আহাদীসুল আম্বীয়া অধ্যায়, হাদীস নং (৩৪৭৮); মুসলিম, তাওবা অধ্যায়, হাদীস নং (২৭৫৬, ২৭৫৭)

[8] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৩৫, পৃ.১৬৫
সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত ‘মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ’ পত্রিকায় ছাপা প্রবন্ধের কপি - ১

 বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তার প্রশংসা করি। তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। তার কাছে ক্ষমা চাই এবং তার কাছে তাওবা করি। আমাদের নিজ নাফসের খারাবি এবং আমাদের কর্মসমূহের মধ্যে যা অসাধু তা থেকে আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। যাকে আল্লাহ হিদায়েত দান করেন তাকে গোমরাহকারী কেউ নেই, আর যাকে তিনি গোমরাহ করেন তাকে হিদায়েতকারী কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি, তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি, তাঁর সাহাবীগণের প্রতি এবং যারা সততার সাথে তাদের অনুসরণ করেছেন তাদের প্রতি সালাত বর্ষণ করুন এবং তাদেরকে উত্তম শান্তিতে ভূষিত করুন।

আমার কিছু মজলিসে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বান্দার ‘সঙ্গে থাকা’ বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা থেকে কেউ কেউ এমন কিছু বুঝল যা আমার উদ্দেশ্য ছিলনা, যা আমার আকীদাও নয়। ফলে এ ব্যাপারে মানুষের প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা বেড়ে গেল যে, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের ‘সঙ্গে থাকা’র ব্যাপারে কি বলা হবে?

আমি:

(ক) যাতে কেউ আল্লাহ কর্তৃক মাখলুকের সঙ্গে থাকার ব্যাপারে কোনো ভুল বিশ্বাসে নিপতিত না হয়।

(খ) যাতে কেউ আমার ব্যাপারে মিথ্যাচার করতে না পারে, এমন কথা বলে যা আমি বলিনি, অথবা কোনো ধারণাকারী এমন কথার ধারণা করতে না পারে যা আমি উদ্দেশ্য করিনি।

(গ) আল্লাহ তা‘আলার এই মহান সিফাত যা তিনি নিজের জন্য বেশ কয়েকটি আয়াতে সাব্যস্ত করেছেন, এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন তা যাতে স্পষ্টভাবে বয়ান করতে পারি তার জন্য আমি নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো গুরুত্বসহ উল্লেখ করছি:

প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকার বিষয়টি কুরআন, সুন্নাহ ও সালাফদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত একটি বিষয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ﴾ [الحديد: ٤]

আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা আল হাদীদ: ৫৭: ৪)

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨]

নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮)

আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউনের কাছে পাঠাবার সময় মূসা ও হারুন আলাইহিমাস্সালামকে লক্ষ্য করে বলেন:

﴿ قَالَ لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦]

তোমরা ভয় করো না। আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬)

তিনি তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে বলেন:

﴿ إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ ٱللَّهُ إِذۡ أَخۡرَجَهُ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ ثَانِيَ ٱثۡنَيۡنِ إِذۡ هُمَا فِي ٱلۡغَارِ إِذۡ يَقُولُ لِصَٰحِبِهِۦ لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ﴾ [التوبة: ٤٠]

যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা উভয়ে পাহাড়ের একটি গুহায় অবস্থান করছিল, সে তার সঙ্গীকে বলল, ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (সূরা আত-তাওবা: ৪০)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«أفضل الإيمان أن تعلم أن الله معك حيثما كنت»

সর্বোত্তম ঈমান হলো এই যে, তুমি জানবে যে, তুমি যেখানেই আছ, আল্লাহ তোমার সাথেই আছেন।[1]

হাদীসটিকে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়্যা’ গ্রন্থে হাসান বলেছেন। অবশ্য আলেমদের কেউ কেউ হাদীসটি দুর্বল বলেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবীর সাথে আছেন এ কথাটি ইতঃপূর্বে একটি আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। আর সালাফগণও এ ব্যাপারে ইজমা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন।

দ্বিতীয়ত: এ ‘সঙ্গে থাকা’র বিষয়টি তার যে প্রকৃত অর্থ সে অর্থেই সত্য। তবে তা এমন ‘সঙ্গে থাকা’ যা আল্লাহর জন্য উপযোগী এবং যা এক মাখলুক কর্তৃক অন্য মাখলুকের সঙ্গে থাকার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়; কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজ সম্পর্কে বলেছেন:

﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]

তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা। (সূরা আশ্-শূরা: ৪২: ১১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

﴿هَلۡ تَعۡلَمُ لَهُۥ سَمِيّٗا ٦٥ ﴾ [مريم: ٦٥]

তুমি কি তাঁর সমতুল্য কাউকে জান? (সূরা মারইয়াম: ১৯: ৬৫)

তিনি আরো বলেন:

﴿ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ٤ ﴾ [الاخلاص: ٤]

আর তাঁর কোনো সমকক্ষও নেই। (সূরা আল ইখলাস: ১১২: ৪)

‘সঙ্গে থাকা’র সিফাত অন্যান্য সিফাতের মতোই প্রকৃত অর্থেই আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত, আল্লাহর ক্ষেত্রে যেভাবে উপযোগী সেভাবে। আর তা মাখলুকের সিফাতের সাথে সাদৃশ্যবিহীন।

ইবনে আবদুল বার বলেছেন, ‘আহলে সুন্নত কুরআন-সুন্নাহয় উল্লিখিত সকল সিফাতের ওপর ঈমান আনা এবং সেগুলোকে রূপক অর্থে নয় বরং প্রকৃত অর্থে বহন করার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবে তারা এ সিফাতসমূহের কোনোটারই ধরন-ধারণ কি বা বাস্তবতা কি তা উল্লেখ করেন না।[2]

ইমাম ইবনে তাইমিয়া আল ফাতওয়া আল হামাবিয়ায় বলেন, ‘কোনো ধারণাকারী এটা ধারণা করতে পারে না যে, কুরআন সুন্নাহয় যা এসেছে তার একটির সঙ্গে অপরটির সংঘর্ষ হতে পারে। যেমন কেউ বলল যে, আল্লাহর কিতাবে ও রাসূলের সুন্নাহয় আল্লাহ তা‘আলার আরশের ওপরে থাকার যে কথা এসেছে, তার বাহ্যিক অর্থ নিম্নোক্ত আয়াতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ﴾ [الحديد: ٤]

আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (সূরা আল হাদীদ: ৫৭: ৪)

অথবা নিম্নবর্ণিত হাদীসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, আর তা হলো:

«إذا قام أحدكم إلى الصلاة فإن الله قبل وجهه»

যখন তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ায় তখন আল্লাহ তা‘আলা নিশ্চয় তাঁর সম্মুখেই থাকেন।

এবং এ জাতীয় অন্যান্য হাদীস।

এরকম মনে করাটা ভুল; কারণ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে আছেন এবং তিনি আরশের ওপরও প্রকৃত অর্থে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা এ উভয় বিষয়কে নিম্নবর্ণিত আয়াতে একত্র করে উল্লেখ করেছেন:

﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ وَمَا يَعۡرُجُ فِيهَاۖ وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٤ ﴾ [الحديد: ٤]

তিনিই আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশের ওপর উঠেছেন। তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (আল হাদীদ: ৫৭: ৪)

এখানে তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে তিনি আরশের ওপরে আছেন এবং প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত এবং আমরা যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসুল আও‘আলে বলেছেন:

«والله فوق العرش، وهو يعلم ما أنتم عليه»

আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে, তবে তোমরা যে অবস্থায় আছ সে ব্যাপারে তিনি সম্যক অবগত।[3]

এর ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, আরবী ভাষায়مع (সঙ্গে) শব্দটি যখন ব্যবহৃত হয় তখন এর বাহ্যিক অর্থ হয় সাধারণভাবে তুলনা করা, যা আবশ্যিকভাবে পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ অথবা একে অন্যের ডানে বা বামে থাকাকে দাবি করে না। যদি ‘সঙ্গে থাকা’র অর্থকে বিশেষ কোনো অর্থে সীমিত করে উল্লেখ করা হয়, তবে তা সে বিশেষ অর্থ-কেন্দ্রিক তুলনাকে বুঝাবে। বলা হয় যে, আমরা এখনও চলছি আর চাঁদ আমাদের সঙ্গে, অথবা তারকা আমাদের সঙ্গে। আরও বলা হয় যে ‘এ বস্তুটি আমার সঙ্গে’ যদিও তা আপনার মাথার ওপরে। কেননা আপনার উদ্দেশ্য হলো এ বস্তুর সঙ্গে আপনার স্পৃক্ততা বয়ান করা। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলাও প্রকৃত অর্থেই তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন যদিও তিনি প্রকৃত অর্থেই তাঁর আরশের ওপরে আছেন।)[4]

তৃতীয়ত: আল্লাহ কর্তৃক মাখলুকের সঙ্গে থাকার দাবি হলো, তিনি তাঁর ইলম ও ক্ষমতায়, শ্রবণ ও দর্শনে, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণে এবং রুবুবিয়াতের অন্যান্য অর্থে মাখলুককে পরিবেষ্টন করে আছেন। যদি ‘সঙ্গে থাকা’ বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গুণকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত না হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ﴾ [الحديد: ٤]

আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। (আল হাদীদ: ৫৭: ৪)

﴿مَا يَكُونُ مِن نَّجۡوَىٰ ثَلَٰثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمۡ وَلَا خَمۡسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمۡ وَلَآ أَدۡنَىٰ مِن ذَٰلِكَ وَلَآ أَكۡثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمۡ أَيۡنَ مَا كَانُواْۖ﴾ [المجادلة: ٧]

তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না, আর পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এর চেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সংগেই আছেন। (সূরা আল মুজাদালা: ৫৮: ৭)

আর যদি ‘সঙ্গে থাকা’র বিষয়টি বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা গুণকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত হয়, তখন উল্লিখিত অর্থগুলোর সঙ্গে যোগ হবে- সাহায্য সহযোগিতা করা, তাওফীক দেওয়া এবং সঠিক পথ দেখানো।

আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বিশেষ কোনো ব্যক্তির সঙ্গে থাকার উদাহরণ হলো মূসা ও হারূন আলাইহিমাস্ সালামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার কথা:

﴿لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦]

আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬)

﴿لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ ﴾ [التوبة: ٤٠]

তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (আত-তাওবা: ৪০)

বিশেষ কোনো গুণের সঙ্গে থাকার উদাহরণ হলো, আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ٤٦ ﴾ [الانفال: ٤٦]

আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সূরা আল আনফাল: ৪৬)

আল কুরআনে এ জাতীয় আরো বহু উদাহরণ রয়েছে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. ‘ফাতওয়া আল হামাবিয়া’তে বলেন, ‘প্রসঙ্গের ভিন্নতা অনুযায়ী ‘সঙ্গে থাকা’র ভিন্ন ভিন্ন হুকুম হয়ে থাকে। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যখন বলেন:

﴿يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ وَمَا يَعۡرُجُ فِيهَاۖ وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٤ ﴾ [الحديد: ٤]

তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (আল হাদীদ: ৪)

[1] - তাবারানী, আল আওসাত (৮৮/৩৩৬), হাদীস নং ৮৭৯৬

[2] - ইমাম ইবনুল বারর এর বরাত দিয়ে এ কথাটি ইমাম ইবনে তাইমিয়া তার গ্রন্থ আল ফাতওয়া আল হামুবিয়াতে উল্লেখ করেন, দ্রঃ মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৫, পৃ. ৮৭.

[3] - এ হাদীসটির উৎস বর্ণনা পূর্বে গিয়েছে।

[4] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৫, পৃ. ১০২
সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত ‘মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ’ পত্রিকায় ছাপা প্রবন্ধের কপি - ২

এই বাণীর বাহ্যিক অর্থ যা নির্দেশ করছে তা হলো, এই ‘সঙ্গে থাকা’র হুকুম ও দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবহিত, তিনি তোমাদের ওপর সাক্ষী এবং তিনি তোমাদের ওপর আধিপত্যকারী ও তোমাদের ব্যাপারে জ্ঞানী। এটাই হলো সালাফদের কথার অর্থ যে: তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তোমাদের সঙ্গে আছেন। আর এটাই হলো উল্লিখিত বাণীর বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের গুহায় তাঁর সাথীকে বললেন: ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ তখন এটাও তার বাহ্যিক অর্থেই এবং অবস্থার পারিপার্শ্বিকতা থেকে বুঝা যায় যে, এখানে ‘সঙ্গে থাকা’র অর্থ সম্যকভাবে অবহিত থাকা, সাহায্য-সহযোগিতা করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨]

নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮)

অনুরূপভাবে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস্ সালামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ قَالَ لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦]

ভয় করোনা, আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬)

এখানে ‘সঙ্গে থাকা’ বাহ্যিক অর্থেই। আর এসব স্থলে সঙ্গে থাকার অর্থ হলো: সাহায্য-সহযোগিতা।

পরিশেষে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘সঙ্গে থাকার অর্থ ও তার চাহিদার মধ্যে পার্থক্য আছে। আর হতে পারে যে, যা সঙ্গে থাকার চাহিদা তাই তার অর্থ, যা স্থানভেদে ভিন্ন হয়।’[1]

মুহাম্মাদ ইবনুল মুওসিলী ইমাম ইবনুল কাইয়েম র. এর গ্রন্থ استعجال الصواعق المرسلة على الجهمية والمعطلة এর নবম উদাহরণে (পৃষ্ঠা নং ৩০৯) বলেন: مع (সঙ্গে) শব্দটি যে অর্থ বুঝায় তা হলো সঙ্গ দেওয়া, সম্মতি জ্ঞাপন করা। অতএব যদি সাধারণভাবে বলা হয় যে, আল্লাহ তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন, তবে এর দাবিগত আবশ্যিক অর্থ হবে, তিনি তাঁর মাখলুক বিষয়ে সম্যক অবহিত, তিনি তাদের রক্ষণা-বেক্ষণ করছেন এবং তিনি তাদের ওপর ক্ষমতাবান। আর যদি বিশেষভাবে বলা হয়, যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে:

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨]

নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮)

তাহলে তার দাবিগত আবশ্যিক অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য- সহযোগিতা ও সমর্থনদানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আছেন।

অতএব আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দার সঙ্গে থাকা দুই প্রকার: সাধারণভাবে সঙ্গে থাকা এবং বিশেষভাবে সঙ্গে থাকা। আর আল কুরআনে উভয় প্রকারের কথাই উল্লিখিত রয়েছে।

ইমাম নববী রচিত ‘চল্লিশ হাদীস’ গ্রন্থের ঊনিশ নম্বর হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব র. বলেন যে, ‘বিশেষভাবে সঙ্গে থাকার দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য, সমর্থন, সুরক্ষা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সঙ্গে থাকেন। আর সাধারণভাবে সঙ্গে থাকার অর্থ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান, অবগত থাকা এবং তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে থাকেন।’

ইমাম ইবনে কাছীর র. সূরায়ে মুজাদালায় ‘সঙ্গে থাকা বিষয়ক’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‘এ কারণেই একাধিক আলেম এ ব্যাপারে ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন যে, এখানে সঙ্গে থাকার অর্থ ‘জ্ঞানের মাধ্যমে সঙ্গে থাকা’। এ অর্থ নেওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীত। তবে জ্ঞান ও দৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তার মাখলুকের সঙ্গে থাকার পাশাপাশি তিনি শ্রবণের মাধ্যমেও তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টিকুল সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত এবং তাদের কোনো কিছুই তাঁর কাছে অদৃশ্য নয়।’

চতুর্থত: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের ‘সঙ্গে থাকা’ এটা দাবি করে না যে তিনি তাদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন, অথবা তিনি তাদের স্থানে অবস্থান করছেন। এটা কোনোভাবেই বোঝায় না। কেননা এ জাতীয় অর্থ বাতিল অর্থ যা আল্লাহর ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য নয়। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী এমন অর্থবোধক হতে পারে না যা আল্লাহর ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য হতে পারে না।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. তাঁর ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন,‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন’ এর অর্থ এটা নয় যে তিনি মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন। ভাষার ব্যবহার পদ্ধতি এ অর্থকে আবশ্যক করে না। বরং চাঁদ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন এবং তার সৃষ্টিসমূহের মধ্যে ছোট্ট একটি সৃষ্টি। চাঁদ আকাশে স্থাপিত এবং তা মুসাফির এবং অমুসাফির সবার সঙ্গেই আছে, সে যেখানেই থাক না কেন।’

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন বা মাখলুকের সঙ্গে অবস্থান করছেন এটি হলো ‘সঙ্গে থাকা’র বাতিল অর্থ। এ বাতিল অর্থটিকে প্রাচীন জাহমিয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ বলেনি। এই জাহমিয়া সম্প্রদায় বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ সকল স্থানে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কথা থেকে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। ‘বড় মারাত্মক কথা, যা তাদের মুখ থেকে বের হয়। মিথ্যা ছাড়া তারা কিছুই বলে না!’ (সূরা আল কাহ্ফ: ১৮: ৫)

তাদের এ কথাকে সালাফগণ অস্বীকার করেছেন। ইমামগণ অস্বীকার করেছেন; কেননা এ কথার এমন কিছু বাতিল দাবি আছে যা আল্লাহ তা‘আলাকে অপূর্ণাঙ্গ বলে গুণান্বিত করে। আল্লাহ তা‘আলা যে মাখলুকের ঊর্ধ্বে আছেন তা অস্বীকার করে।

কোনো ব্যক্তি এটা কি করে বলতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ সকল স্থানে আছেন অথবা তিনি তাঁর মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র মহান যিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন:

﴿وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۖ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

তাঁর কুরসী আসমানসমূহ ও জমিন পরিব্যাপ্ত করে আছে। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৫)

﴿وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ﴾ [الزمر: ٦٧]

অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। (সূরা আয্-যুমার: ৩৯: ৬৭)

পঞ্চমত

এই ‘সঙ্গে থাকা’ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের ঊর্ধ্বে থাকা এবং আরশের ওপরে থাকার সাথে সাংঘর্ষিক নয়; কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে নিরঙ্কুশ ঊর্ধ্বতা প্রমাণিত, হোক তা সত্তাগত অথবা সিফাতগত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ ٢٥٥ ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

আর তিনি সুউচ্চ, মহান। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৫)

তিনি অন্যত্র বলেন:

﴿ سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى ١ ﴾ [الاعلى: ١]

তুমি তোমার সুমহান রবের নামের তাসবীহ পাঠ কর। (সূরা আল আলা: ৮৭: ১)

অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:

﴿وَلِلَّهِ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٦٠ ﴾ [النحل: ٦٠]

আল্লাহর জন্য রয়েছে মহান উদাহরণ। আর তিনিই পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৬০)

আর কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, আকল এবং ফিতরতের দলিল এ ব্যাপারে একত্র হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বোর্ধ্বে।

এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর দলিল তো গুণে শেষ করার মতো নয়। যেমন:

﴿فَٱلۡحُكۡمُ لِلَّهِ ٱلۡعَلِيِّ ٱلۡكَبِيرِ ١٢ ﴾ [غافر: ١٢]

অতএব হুকুম কেবল আল্লাহ তা‘আলার যিনি সুউচ্চ, সুমহান। (গাফের: ৪০: ১২)

﴿ وَهُوَ ٱلۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهِۦۚ﴾ [الانعام: ١٨]

আর তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান। (সূরা আল আনআম: ৬: ১৮)

﴿ أَمۡ أَمِنتُم مَّن فِي ٱلسَّمَآءِ أَن يُرۡسِلَ عَلَيۡكُمۡ حَاصِبٗاۖ فَسَتَعۡلَمُونَ كَيۡفَ نَذِيرِ ١٧ ﴾ [الملك: ١٧]

যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের উপর পাথর নিক্ষেপকারী ঝড়ো হাওয়া পাঠানো থেকে তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছ? (সূরা আল মুলক: ৬৭: ১২)

﴿ تَعۡرُجُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ إِلَيۡهِ﴾ [المعارج: ٤]

ফেরেশতাগণ ও রূহ ঊর্ধ্বগামী হয় আল্লাহর পানে। (সূরা আল মাআরিজ: ৭০: ৪)

﴿ قُلۡ نَزَّلَهُۥ رُوحُ ٱلۡقُدُسِ مِن رَّبِّكَ﴾ [النحل: ١٠٢]

বল, রুহুল কুদস (জীবরীল) একে (কোরআন) তোমার রবের পক্ষ হতে নাযিল করেছেন। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১০২)

এ জাতীয় আরো বহু আয়াত।

আর হাদীস থেকে দলিল হলো- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

«ألا تأمنوني وأنا أمين من في السماء»

তোমরা কি আমাকে বিশ্বস্ত ভাববে না, আর আমি হলাম যিনি আকাশে আছেন তার বিশ্বস্ত।[2]

«والعرش فوق الماء، والله فوق العرش»

আরশ হলো পানির ওপর, আর আল্লাহ হলেন আরশের ওপর।[3]

«ولا يصعد إلى الله إلا الطيب»

উত্তম ব্যতীত অন্যকিছু আল্লাহর পানে ঊর্ধ্বারোহণ করে না।[4]

হাদীস থেকে আরেকটি উদাহরণ হলো, আরাফার দিন আকাশের দিকে ইশারা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اللهم اشهد (হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন।)[5]

অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম যখন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের বিধান পৌঁছে দিয়েছেন, তখন তাদের এ স্বীকারোক্তির ওপর আকাশের দিকে ইশারা করে আল্লাহ তা‘আলাকে সাক্ষী থাকতে বলেছিলেন।

হাদীস থেকে আরেকটি উদাহরণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা এক দাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলেছিল, তিনি আসমানে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথাকে মেনে নিয়ে বললেন: তাকে আযাদ করে দাও, সে মুমিনা।এ ছাড়াও আরো অন্যান্য হাদীস।

>
[1] - মাজমুউল ফাতাওয়া, পৃ. ১০৩

[2] - এ হাদীসটির তথসূত্র পূর্বে গিয়েছে।

[3] - তাবারানী, আল কাবীর (৯/২২৮); ইবনে খুযায়মা, আত-তাওহীদ : হাদীস নং ৬৪৯ এবং ১৫০; বাইহাকী, আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ. ৪০১; আয-যাহাবী, আল উলুউ, পৃ. (৬৬৪); ইবনুল কাইয়েম তার ‘ইজতিমাউল জুয়ুশ আল ইসলামিয়া’ গ্রন্থে এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন, পৃ. (১০০)।

[4] - বুখারী তাওহীদ অধ্যায়, হাদীস নং (৭৪২৯)

[5] - এ হাদীসটির তথ্যসূত্র পূর্বে গিয়েছে।
সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত ‘মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ’ পত্রিকায় ছাপা প্রবন্ধের কপি - ৩

 ইজমার ব্যাপারে বলা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বতার ব্যাপারে একাধিক আলেম ইজমা সম্পন্ন হওয়ার কথা বলেছেন।

আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বতার ব্যাপারে আকল বা যুক্তিগত দলিল হলো এই যে, সর্বোর্ধ্বতা হলো পূর্ণাঙ্গতাবাচক একটি গুণ, আর নিম্নতা হলো অপূর্ণাঙ্গতাবাচক একটি গুণ। আর আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণাঙ্গতার গুণে গুণান্বিত এবং অপূর্ণাঙ্গতার গুণ থেকে পবিত্র।

ফিতরাতের দলিল হলো: এমন কোনো দো‘আ-প্রার্থনাকারী নেই আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকার সময় যার অন্তরাত্মা ঊর্ধ্বমুখি হয় না, যদিও কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে তার কোনো পড়াশোনা না থাকে, যদিও কোনো শিক্ষক তাকে শিখিয়ে না থাকে।

অকাট্য দলিলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার জন্য প্রমাণিত এই ঊর্ধ্বতার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের সঙ্গে থাকার কোনো সংঘর্ষ নেই। আর তা কয়েক কারণে:

প্রথমত: আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে- যা বৈপরীত্য থেকে মুক্ত - এ দুটি বিষয়কে নিজের জন্য একত্র করে উল্লেখ করেছেন। অতএব এ দুটি যদি সাংঘর্ষিক হতো তবে আল কুরআন এ দুটোকে একত্র করে উল্লেখ করত না।

আর আল কুরআনের কোনো বিষয় যদি আপনার কাছে বৈপরীত্যপূর্ণ বলে মনে হয়, তাহলে তা বারবার ঘেঁটে দেখুন, যতক্ষণ না আপনার কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে না যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء: ٨٢]

তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ৮২)

দ্বিতীয়ত

‘সঙ্গে থাকা’ এবং উচুতে থাকা সৃষ্টিবস্তুর জন্যেও সম্ভব। যেমন চাদ। অতএব কেউ যদি রাতের বেলায় পথ চলার সময় বলে আমরা এ অবস্থায় চলছি যে, এখনো চাদ আমাদের সঙ্গেই আছে, তবে এটাকে বিপরীতমুখী কথা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হবে না। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যারা পথ চলে তারা জমিনে, আর চাদ হলো আকাশে। অতএব যদি একটি মাখলুখের ক্ষেত্রে এরূপ সম্ভব হয় তবে যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁর ক্ষেত্রে এরূপ কেন সম্ভব হবে না।

‘বরং চাদ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন, সে আল্লাহর ছোট্ট মাখলুকের মধ্যে একটি। সে মুসাফির এবং অমুসাফিরের সঙ্গে আছে তারা যেখানেই থাক না কেন।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. এর এ কথার ব্যাখ্যায় শাইখ মুহাম্মদ খালীল আল হাররাস বলেন, ‘তিনি চাদের উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়েছেন যা আকাশে স্থাপিত। চাদ মুসাফির ও অমুসাফির সবার সঙ্গেই আছে, তারা যেখানেই থাক না কেন। যদি এটা চাদের বেলায় সম্ভব হয় যা আল্লাহ তা‘আলার ছোট্ট মাখলুকের মধ্যে একটি, তাহলে যিনি সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবহিত, যিনি তাঁর বান্দাদের সকল বিষয় জানেন এবং তাদের সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান, যার হাতে আকাশ ও পৃথিবী ও সমগ্র মহাবিশ্ব ঠিক আমাদের হাতে থাকা ছোট্ট একটি গুটির মতো, তাঁর ব্যাপারে কি এটা বলা ঠিক হবে না যে তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন যদিও তিনি তাদের ঊর্ধ্বে, তাদের থেকে আলাদা এবং আরশের ওপরে?’[1]

তৃতীয়ত: যদি ধরে নিই যে ঊর্ধ্বতা এবং সঙ্গে থাকা এ দুটি বিষয় কোনো মাখলুকের ক্ষেত্রে একত্র হওয়া সম্ভব নয়, তবে এর দ্বারা এটা আবশ্যক হয় না যে, তা সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রেও অসম্ভব; কারণ আল্লাহ তা‘আলা হলেন উদাহরণহীন। তাঁর মতো কোনো জিনিস নেই।

﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]

তাঁর মত কিছু নেই, আর তিনি হলেন সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।[2] (সূরা আশ-শূরা:১১)

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. আল আকীদা আল ওয়াসিতিয়া গ্রন্থে বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক মাখলুকের নিকটতা ও সঙ্গে থাকার ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় যা এসেছে তা আল্লাহর সর্বোর্ধ্বতা ও সর্বোচ্চতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়; কারণ সকল গুণের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা হলেন উদাহরণবিহীন। তিনি নিকটে থাকা সত্ত্বেও সর্বোর্ধ্বে, কাছে থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চতায়।’[3]

এ বিষয়ে খোলাসা কথা হলো:

১. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকার কুরআন, সুন্নাহ এবং সালাফদের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।

২. সঙ্গে থাকার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার জন্য উপযোগিভাবে প্রকৃত অর্থেই এবং তা কোনো মাখলুক কর্তৃক অন্যকোনো মাখলুকের সঙ্গে থাকার সদৃশ নয়।

৩. আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দাদের সঙ্গে থাকার দাবি হলো, তিনি তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতা দ্বারা, শ্রবণ ও দর্শন দ্বারা, আধিপত্য ও ব্যবস্থাপনা দ্বারা এবং রুবুবিয়াতের অন্যান্য অর্থে, যদি সঙ্গে থাকার বিষয়টি অনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। আর যদি সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি অথবা গুণের সঙ্গে থাকার কথা উল্লিখিত হয় তখন ওপরে বর্ণিতভাবে সঙ্গে থাকার পাশাপাশি সাহায্য-সমর্থন করা, তাওফীক ও সঠিক পথ দেখানো ইত্যাদিও সঙ্গে থাকার অর্থে সন্নিবিষ্ট হবে।

৪. সঙ্গে থাকা এটা দাবি করে না যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে থাকেন অথবা তাদের স্থলে অবস্থান করেন। ‘সঙ্গে থাকা’ কোনোভাবেই এ অর্থ বুঝায় না।

৫. ওপরে যা বর্ণিত হলো তা যদি অনুধাবন করে দেখি তবে আমরা জানতে পারি যে, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রকৃত অর্থে তাঁর মাখলুকের সঙ্গে থাকা এবং প্রকৃত অর্থে আরশের ওপরে থাকা এ দুয়ের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। পবিত্র মহান আল্লাহ তা‘আলা যার প্রশংসা করে আমরা শেষ করতে পারব না, তিনি নিজে যেভাবে নিজের প্রশংসা করেছেন তিনি ঠিক সে রকমই। সালাত ও সালাম মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও সকল সাহাবীর প্রতি।

আল্লাহর মুখাপেক্ষী মুহাম্মাদ সালেহ আল উছাইমীন কর্তৃক রচিত।তারিখ: ২৭/১১/১৪০৩ হি.

[1] - শায়খ মুহাম্মদ খালীল আল হাররাস, শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া, পৃ. ১১৫

[2] - দেখুন, মুহাম্মদ ইবনে আমীন আশ্শানকিতী, আদওয়াউল বয়ান, ------

[3] - শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া, পৃ. ১১৬
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৭ পর্যন্ত, সর্বমোট ৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে