সৌদি আরব থেকে প্রকাশিত ‘মাজাল্লাতুদ দাওয়াহ’ পত্রিকায় ছাপা প্রবন্ধের কপি - ২

এই বাণীর বাহ্যিক অর্থ যা নির্দেশ করছে তা হলো, এই ‘সঙ্গে থাকা’র হুকুম ও দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ব্যাপারে সম্যক অবহিত, তিনি তোমাদের ওপর সাক্ষী এবং তিনি তোমাদের ওপর আধিপত্যকারী ও তোমাদের ব্যাপারে জ্ঞানী। এটাই হলো সালাফদের কথার অর্থ যে: তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তোমাদের সঙ্গে আছেন। আর এটাই হলো উল্লিখিত বাণীর বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ। ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড়ের গুহায় তাঁর সাথীকে বললেন: ‘তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ তখন এটাও তার বাহ্যিক অর্থেই এবং অবস্থার পারিপার্শ্বিকতা থেকে বুঝা যায় যে, এখানে ‘সঙ্গে থাকা’র অর্থ সম্যকভাবে অবহিত থাকা, সাহায্য-সহযোগিতা করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨]

নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮)

অনুরূপভাবে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস্ সালামকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ قَالَ لَا تَخَافَآۖ إِنَّنِي مَعَكُمَآ أَسۡمَعُ وَأَرَىٰ ٤٦ ﴾ [طه: ٤٦]

ভয় করোনা, আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি’। (সূরা তাহা: ২০: ৪৬)

এখানে ‘সঙ্গে থাকা’ বাহ্যিক অর্থেই। আর এসব স্থলে সঙ্গে থাকার অর্থ হলো: সাহায্য-সহযোগিতা।

পরিশেষে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘সঙ্গে থাকার অর্থ ও তার চাহিদার মধ্যে পার্থক্য আছে। আর হতে পারে যে, যা সঙ্গে থাকার চাহিদা তাই তার অর্থ, যা স্থানভেদে ভিন্ন হয়।’[1]

মুহাম্মাদ ইবনুল মুওসিলী ইমাম ইবনুল কাইয়েম র. এর গ্রন্থ استعجال الصواعق المرسلة على الجهمية والمعطلة এর নবম উদাহরণে (পৃষ্ঠা নং ৩০৯) বলেন: مع (সঙ্গে) শব্দটি যে অর্থ বুঝায় তা হলো সঙ্গ দেওয়া, সম্মতি জ্ঞাপন করা। অতএব যদি সাধারণভাবে বলা হয় যে, আল্লাহ তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন, তবে এর দাবিগত আবশ্যিক অর্থ হবে, তিনি তাঁর মাখলুক বিষয়ে সম্যক অবহিত, তিনি তাদের রক্ষণা-বেক্ষণ করছেন এবং তিনি তাদের ওপর ক্ষমতাবান। আর যদি বিশেষভাবে বলা হয়, যেমন নিম্নোক্ত আয়াতে:

﴿ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَواْ وَّٱلَّذِينَ هُم مُّحۡسِنُونَ ١٢٨ ﴾ [النحل: ١٢٨]

নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সাথে, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১২৮)

তাহলে তার দাবিগত আবশ্যিক অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য- সহযোগিতা ও সমর্থনদানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আছেন।

অতএব আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর বান্দার সঙ্গে থাকা দুই প্রকার: সাধারণভাবে সঙ্গে থাকা এবং বিশেষভাবে সঙ্গে থাকা। আর আল কুরআনে উভয় প্রকারের কথাই উল্লিখিত রয়েছে।

ইমাম নববী রচিত ‘চল্লিশ হাদীস’ গ্রন্থের ঊনিশ নম্বর হাদীসের ব্যাখ্যায় ইবনে রজব র. বলেন যে, ‘বিশেষভাবে সঙ্গে থাকার দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা সাহায্য, সমর্থন, সুরক্ষা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সঙ্গে থাকেন। আর সাধারণভাবে সঙ্গে থাকার অর্থ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞান, অবগত থাকা এবং তাদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে থাকেন।’

ইমাম ইবনে কাছীর র. সূরায়ে মুজাদালায় ‘সঙ্গে থাকা বিষয়ক’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,‘এ কারণেই একাধিক আলেম এ ব্যাপারে ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন যে, এখানে সঙ্গে থাকার অর্থ ‘জ্ঞানের মাধ্যমে সঙ্গে থাকা’। এ অর্থ নেওয়ার বিষয়টি সন্দেহাতীত। তবে জ্ঞান ও দৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তার মাখলুকের সঙ্গে থাকার পাশাপাশি তিনি শ্রবণের মাধ্যমেও তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন। অতএব আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টিকুল সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত এবং তাদের কোনো কিছুই তাঁর কাছে অদৃশ্য নয়।’

চতুর্থত: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের ‘সঙ্গে থাকা’ এটা দাবি করে না যে তিনি তাদের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন, অথবা তিনি তাদের স্থানে অবস্থান করছেন। এটা কোনোভাবেই বোঝায় না। কেননা এ জাতীয় অর্থ বাতিল অর্থ যা আল্লাহর ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য নয়। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বাণী এমন অর্থবোধক হতে পারে না যা আল্লাহর ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য হতে পারে না।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. তাঁর ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন,‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন’ এর অর্থ এটা নয় যে তিনি মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন। ভাষার ব্যবহার পদ্ধতি এ অর্থকে আবশ্যক করে না। বরং চাঁদ আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন এবং তার সৃষ্টিসমূহের মধ্যে ছোট্ট একটি সৃষ্টি। চাঁদ আকাশে স্থাপিত এবং তা মুসাফির এবং অমুসাফির সবার সঙ্গেই আছে, সে যেখানেই থাক না কেন।’

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন বা মাখলুকের সঙ্গে অবস্থান করছেন এটি হলো ‘সঙ্গে থাকা’র বাতিল অর্থ। এ বাতিল অর্থটিকে প্রাচীন জাহমিয়া সম্প্রদায় ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কেউ বলেনি। এই জাহমিয়া সম্প্রদায় বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ সকল স্থানে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কথা থেকে পবিত্র ও ঊর্ধ্বে। ‘বড় মারাত্মক কথা, যা তাদের মুখ থেকে বের হয়। মিথ্যা ছাড়া তারা কিছুই বলে না!’ (সূরা আল কাহ্ফ: ১৮: ৫)

তাদের এ কথাকে সালাফগণ অস্বীকার করেছেন। ইমামগণ অস্বীকার করেছেন; কেননা এ কথার এমন কিছু বাতিল দাবি আছে যা আল্লাহ তা‘আলাকে অপূর্ণাঙ্গ বলে গুণান্বিত করে। আল্লাহ তা‘আলা যে মাখলুকের ঊর্ধ্বে আছেন তা অস্বীকার করে।

কোনো ব্যক্তি এটা কি করে বলতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ সকল স্থানে আছেন অথবা তিনি তাঁর মাখলুকের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে আছেন। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র মহান যিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন:

﴿وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۖ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

তাঁর কুরসী আসমানসমূহ ও জমিন পরিব্যাপ্ত করে আছে। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৫)

﴿وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ﴾ [الزمر: ٦٧]

অথচ কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবীই থাকবে তাঁর মুষ্টিতে এবং আকাশসমূহ তাঁর ডান হাতে ভাঁজ করা থাকবে। (সূরা আয্-যুমার: ৩৯: ৬৭)

পঞ্চমত

এই ‘সঙ্গে থাকা’ আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর মাখলুকের ঊর্ধ্বে থাকা এবং আরশের ওপরে থাকার সাথে সাংঘর্ষিক নয়; কেননা আল্লাহ তা‘আলার জন্যে নিরঙ্কুশ ঊর্ধ্বতা প্রমাণিত, হোক তা সত্তাগত অথবা সিফাতগত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ ٢٥٥ ﴾ [البقرة: ٢٥٥]

আর তিনি সুউচ্চ, মহান। (সূরা আল বাকারা: ২: ২৫৫)

তিনি অন্যত্র বলেন:

﴿ سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى ١ ﴾ [الاعلى: ١]

তুমি তোমার সুমহান রবের নামের তাসবীহ পাঠ কর। (সূরা আল আলা: ৮৭: ১)

অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে:

﴿وَلِلَّهِ ٱلۡمَثَلُ ٱلۡأَعۡلَىٰۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٦٠ ﴾ [النحل: ٦٠]

আল্লাহর জন্য রয়েছে মহান উদাহরণ। আর তিনিই পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ৬০)

আর কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা, আকল এবং ফিতরতের দলিল এ ব্যাপারে একত্র হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বোর্ধ্বে।

এ ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহর দলিল তো গুণে শেষ করার মতো নয়। যেমন:

﴿فَٱلۡحُكۡمُ لِلَّهِ ٱلۡعَلِيِّ ٱلۡكَبِيرِ ١٢ ﴾ [غافر: ١٢]

অতএব হুকুম কেবল আল্লাহ তা‘আলার যিনি সুউচ্চ, সুমহান। (গাফের: ৪০: ১২)

﴿ وَهُوَ ٱلۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهِۦۚ﴾ [الانعام: ١٨]

আর তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান। (সূরা আল আনআম: ৬: ১৮)

﴿ أَمۡ أَمِنتُم مَّن فِي ٱلسَّمَآءِ أَن يُرۡسِلَ عَلَيۡكُمۡ حَاصِبٗاۖ فَسَتَعۡلَمُونَ كَيۡفَ نَذِيرِ ١٧ ﴾ [الملك: ١٧]

যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের উপর পাথর নিক্ষেপকারী ঝড়ো হাওয়া পাঠানো থেকে তোমরা কি নিরাপদ হয়ে গেছ? (সূরা আল মুলক: ৬৭: ১২)

﴿ تَعۡرُجُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ إِلَيۡهِ﴾ [المعارج: ٤]

ফেরেশতাগণ ও রূহ ঊর্ধ্বগামী হয় আল্লাহর পানে। (সূরা আল মাআরিজ: ৭০: ৪)

﴿ قُلۡ نَزَّلَهُۥ رُوحُ ٱلۡقُدُسِ مِن رَّبِّكَ﴾ [النحل: ١٠٢]

বল, রুহুল কুদস (জীবরীল) একে (কোরআন) তোমার রবের পক্ষ হতে নাযিল করেছেন। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১০২)

এ জাতীয় আরো বহু আয়াত।

আর হাদীস থেকে দলিল হলো- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

«ألا تأمنوني وأنا أمين من في السماء»

তোমরা কি আমাকে বিশ্বস্ত ভাববে না, আর আমি হলাম যিনি আকাশে আছেন তার বিশ্বস্ত।[2]

«والعرش فوق الماء، والله فوق العرش»

আরশ হলো পানির ওপর, আর আল্লাহ হলেন আরশের ওপর।[3]

«ولا يصعد إلى الله إلا الطيب»

উত্তম ব্যতীত অন্যকিছু আল্লাহর পানে ঊর্ধ্বারোহণ করে না।[4]

হাদীস থেকে আরেকটি উদাহরণ হলো, আরাফার দিন আকাশের দিকে ইশারা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اللهم اشهد (হে আল্লাহ আপনি সাক্ষী থাকুন।)[5]

অর্থাৎ সাহাবায়ে কিরাম যখন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের বিধান পৌঁছে দিয়েছেন, তখন তাদের এ স্বীকারোক্তির ওপর আকাশের দিকে ইশারা করে আল্লাহ তা‘আলাকে সাক্ষী থাকতে বলেছিলেন।

হাদীস থেকে আরেকটি উদাহরণ হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা এক দাসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহ কোথায়? সে বলেছিল, তিনি আসমানে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ কথাকে মেনে নিয়ে বললেন: তাকে আযাদ করে দাও, সে মুমিনা।এ ছাড়াও আরো অন্যান্য হাদীস।

>
[1] - মাজমুউল ফাতাওয়া, পৃ. ১০৩

[2] - এ হাদীসটির তথসূত্র পূর্বে গিয়েছে।

[3] - তাবারানী, আল কাবীর (৯/২২৮); ইবনে খুযায়মা, আত-তাওহীদ : হাদীস নং ৬৪৯ এবং ১৫০; বাইহাকী, আসমা ওয়াস সিফাত, পৃ. ৪০১; আয-যাহাবী, আল উলুউ, পৃ. (৬৬৪); ইবনুল কাইয়েম তার ‘ইজতিমাউল জুয়ুশ আল ইসলামিয়া’ গ্রন্থে এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন, পৃ. (১০০)।

[4] - বুখারী তাওহীদ অধ্যায়, হাদীস নং (৭৪২৯)

[5] - এ হাদীসটির তথ্যসূত্র পূর্বে গিয়েছে।