আল্লাহ তা‘আলার নান্দনিক নাম ও গুণসমগ্র: কিছু আদর্শিক নীতিমালা পঞ্চম অধ্যায়: পরিশিষ্ট, আশা‘য়েরা (মাতুরিদিয়্যাহ) এবং তাদের মত যারা অপব্যাখ্যা করে তাদের সন্দেহের অপনোদন: ইসলামহাউজ.কম
তাবিলকারীদের বিধান

যদি কোনো প্রশ্নকারী বলে যে, আপনারা কি তাবিলপন্থীদের কাফির বা ফাসিক বলেন? তাহলে এর উত্তরে বলব যে, কাউকে কাফির বা ফাসিক হুকুম জারি করার আধিকার আমাদের নেই। তা বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অধিকার। অতএব এ জাতীয় হুকুমের উৎস হলো একমাত্র কুরআন-সুন্নাহ। সুতরাং এ ব্যাপারে খুব সতর্কতা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ের যাচাই বাছাই করতে হবে এবং এমন ব্যক্তিকে কখনো কাফির বা ফাসিক বলা যাবে না যার কুফরী বা ফিসক কুরআন অথবা সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত নয়।

আর এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো, যে মুসলিম বাহ্যত আদেল তথা ন্যায়পরায়ণ, তার আদালত তথা ন্যায়পরায়ণতা ততক্ষণ পর্যন্ত বিলুপ্ত হবে না যতক্ষণ না শরীয়তের কোনো দলিলের দাবি তা বিলুপ্ত করে দেয়। আর যখন শরীয়তের কোনো দলিল তার আদালত-সততাকে বিলুপ্ত করে দেবে, তখন তাকে কাফির কিংবা ফাসিক বলার ক্ষেত্রে কোনো শিথিলতা দেখানো যাবে না; কাফির কিংবা ফাসিক বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা দু‘কারনে জরুরি:

এক. এই হুকুমের ব্যাপারে আল্লাহর ওপর মিথ্যাচারিতা এবং যে ব্যক্তির ওপর কুফরী বা ফিসকের হুকুম লাগানো হলো তার ওপরও মিথ্যাচারিতা।

দুই. যে ব্যক্তির ওপর কুফরী ও ফিসকের হুকুম লাগানো হলো সে যদি প্রকৃত অর্থে কাফের বা ফাসিক না হয়ে থাকে, তা হলে যে হুকুম লাগাল সেই তাতে পতিত হবে। সহীহ মুসলিমে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«إذا كفر الرجل أخاه فقد باء بها أحدهما»

যদি কোনো ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে হুকুম লাগায়, তবে এ হুকুমটি তাদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনের প্রতি ফিরে আসবে।[1]

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে:

«إن كان كما قال وإلا رجعت عليه»

সে যা বলেছে ওই ব্যক্তি যদি তার উপযোগী হয় তো হলোই, অন্যথায় তা বক্তার প্রতি ফিরে আসবে।

সহীহ মুসলিমে আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«من دعا رجلا بالكفر أو قال عدو الله وليس كذلك إلا حار عليه»

যে ব্যক্তি কোনো এক ব্যক্তিকে কাফির বলে ডাকল অথবা বলল যে সে আল্লাহর শত্রু, অথচ সে বাস্তবে সে রকম নয়, তাহলে তা বুমেরাং হয়ে তার প্রতিই ফিরে আসবে।[2]

অতএব একজন মুসলিমকে কাফির বা ফাসিক বলে ডাকার আগে দুটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে:

এক. কুরআন অথবা সুন্নাহয় এ ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে যে এই কথাটি বললে বা এই কাজটি করলে অনিবার্যভাবে ব্যক্তি কাফির বা ফাসিক হয়ে যায়।

দুই. সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, যে কুফরীপূর্ণ অথবা ফিসকপূর্ণ কোনো কথা বলেছে বা এ জাতীয় কোনো কাজ করেছে, তার ওপর এই হুকুমটি বর্তানো। অর্থাৎ কাফির অথবা ফাসিক হওয়ার সকল শর্ত ওই ব্যক্তির মধ্যে উপস্থিত থাকা এবং এ হুকুম লাগানোর পথে কোনো বাধা না থাকা।

যেসব শর্তসমূহ উপস্থিত থাকতে হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এ ব্যাপারে ব্যক্তির জ্ঞান থাকা যে, সে যা বলছে বা করছে, তার অনিবার্য পরিণতি হলো কাফির বা ফাসিক হয়ে যাওয়া। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء: ١١٥]

আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ১১৫)

﴿ وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِلَّ قَوۡمَۢا بَعۡدَ إِذۡ هَدَىٰهُمۡ حَتَّىٰ يُبَيِّنَ لَهُم مَّا يَتَّقُونَۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٌ ١١٥ إِنَّ ٱللَّهَ لَهُۥ مُلۡكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ يُحۡيِۦ وَيُمِيتُۚ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِن وَلِيّٖ وَلَا نَصِيرٖ ١١٦ ﴾ [التوبة: ١١٥، ١١٦]

আর আল্লাহ এমন নন যে, তিনি কোনো সম্প্রদায়কে হিদায়াত দানের পর তাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন। যতক্ষণ না তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করবেন, যা থেকে তারা সাবধান থাকবে। নিশ্চয় আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ। নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর জন্যই আসমানসমূহ ও জমিনের রাজত্ব। তিনি জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্য না আছে কোন অভিভাবক, না আছে কোন সাহায্যকারী। (সূরা আত্-তাওবাহ: ৯: ১১৫ -১১৬)

এ কারণেই আলেমগণ বলেছেন: ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি দিনের নয়, এমন কোনো ব্যক্তি যদি ফরজকর্মসমূহ অস্বীকার করে তবে তাকে কাফির বলা হবে না যতক্ষণ না তাকে স্পষ্টরূপে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

আর কাফের বা ফাসিক হিসেবে হুকুম লাগানোর পথে যেসব বাধা থাকে তার মধ্যে একটি হলো, অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো পক্ষ থেকে কুফরী বা ফিসক সংঘটিত হওয়া। আর তা কয়েকভাবে হতে পারে:

যেমন: কাউকে কুফরী করতে বাধ্য করা হলো, অতঃপর তার অন্তর ঈমানে ভরপূর থাকা সত্ত্বেও সে বাধ্য হয়ে কুফরী করল। এমতাবস্থায় তাকে কাফির বলে হুকুম দেওয়া হবে না। এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ مَن كَفَرَ بِٱللَّهِ مِنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِهِۦٓ إِلَّا مَنۡ أُكۡرِهَ وَقَلۡبُهُۥ مُطۡمَئِنُّۢ بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَٰكِن مَّن شَرَحَ بِٱلۡكُفۡرِ صَدۡرٗا فَعَلَيۡهِمۡ غَضَبٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَلَهُمۡ عَذَابٌ عَظِيمٞ ١٠٦ ﴾ [النحل: ١٠٦]

যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর কুফরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছে, তাদের উপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত। (সূরা আন্-নাহল: ১৬: ১০৬)

আরেকটি বাধা হলো কারও চিন্তাশক্তি থেমে যাওয়া। এমন হয়ে যাওয়া যে, সে কি বলছে বা না বলছে তা অনুভব করতে পারছে না। এটা হতে পারে সীমাতীত খুশির আতিশায্যে, অথবা প্রচণ্ডভাবে চিন্তাগ্রস্ত বা ভীত হয়ে পড়ার কারণে।

এর দলিল সহীহ মুসলিমে আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন:

(নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তাওবায়, যখন সে তাওবা করে তাঁর কাছে ফিরে আসে, ওই ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন যে মরুভূমিতে তার বাহনের ওপর থাকে, অতঃপর বাহনটি -যার ওপর তার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় ছিল - তার হাতছাড়া হয়ে যায় এবং সে তার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ে। অতঃপর সে একটি গাছের কাছে আসে এবং এর ছায়ায় শুয়ে পড়ে, এ অবস্থায় যে সে তার বাহনটি ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে একেবারে নিরাশ। এরপর সে হঠাৎ করে দেখে যে বাহনটি তার কাছেই দাঁড়ানো। অতঃপর সে তার লাগামটি হাতে নেয় এবং সীমাতীত আনন্দে বলে ওঠে: হে আল্লাহ, তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার রব। সে প্রচণ্ড আনন্দের কারণে ভুল করে ফেলে।)[3]

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘কাউকে কাফির বলে হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি হলো, যে ব্যক্তি সত্যকে পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করল এবং সদিচ্ছা বহন করল, কিন্তু সে ভুল করল, তাহলে তাকে কাফির বলা হবে না। বরং তার ভুলটিকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। তবে যে ব্যক্তির সামনে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তা স্পষ্ট হয়ে গেল, কিন্তু সে হিদায়েত স্পষ্ট হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধাচরণ করল এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্যপথ অনুসরণ করল, তাহলে সে কাফির। আর যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করল এবং সত্যানুসন্ধানে শিথিলতা দেখালো এবং অজ্ঞতাবশত কথা বলল, তাহলে সে পাপী, গোনাহগার। এরপর সে হতে পারে ফাসিক অথবা তার পুণ্যের সংখ্যা পাপের চেয়ে অধিক।’[4]

তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্য আমি সব সময়ই সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে কাফির, ফাসিক বা গোনাহগার হিসেবে আখ্যায়িত করার ঘোর বিরোধী থেকেছি - যারা আমার কাছে বসে তারা আমার এ অবস্থান সম্পর্কে জানে -। হ্যাঁ, যদি ওই ব্যক্তির ওপর রিসালতের হুজ্জত[5] কায়েম হওয়ার বিষয়টি জানা থাকে, যার বিপক্ষে গেলে মাত্রা বুঝে ব্যক্তি কখনো কাফির, কখনো ফাসিক এবং কখনো গোনাহগার হয়ে যায়, তবে তার কথা আলাদা। আর আমি স্বীকার করি যে, আল্লাহ তা‘আলা এই উম্মতের ভুলত্রুটি নিশ্চয় ক্ষমা করে দিয়েছেন, হোক তা কথাজাত মাসাইল সংক্রান্ত যা ওহীর মাধ্যমে আমরা পেয়েছি, অথবা প্রায়োগিক কোনো মাসাইল সংক্রান্ত। আমাদের পূর্বপুরুষগণ এসব মাসাইল বিষয়ে বিতর্ক অব্যাহত রেখেছিলেন, কিন্তু তাদের কেউ কাউকে কাফির, ফাসিক বা গোনাহগার বলে আখ্যায়িত করেননি।’[6]

ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ র. এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বলেন: ‘আমি এটা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করতাম যে, এই এই বললে কোনো ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে বলে সালাফ ও ইমামগণ যে বক্তব্য দিতেন তাও সত্য। তবে সাধারণভাবে কাফির বলা এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যক্তিকে কাফির বলার মধ্যে পার্থক্য করা অত্যাশ্যক।’

তিনি বলেন: ‘তাকফীর তথা কাফির হয়ে যাওয়ার হুকুম লাগানো একটি হুঁশিয়ারি। কারণ যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কথাকে অস্বীকার করল, হতে পারে যে সে নও-মুসলিম (ইসলামের সঙ্গে যার সম্পর্ক নতুন) অথবা হতে পারে যে সে দূরবর্তী কোনো মরুভূমিতে বড় হয়েছে। এমন ব্যক্তি যদি ইসলামের কোনো কিছু অস্বীকার করে, তাহলে তাকে কাফির বলা হবে না যতক্ষণ না তার ওপর হুজ্জত কায়েম হবে। এমনও হতে পারে যে, ব্যক্তি যেসব বিষয় অস্বীকার করল সেসব বিষয় সংক্রান্ত পবিত্র মূলবক্তব্য সে শোনেনি। অথবা শুনেছে কিন্তু তার কাছে তা প্রমাণিত হয়নি। অথবা ওই সব টেক্সটের বিপক্ষে তার কাছে অন্যকোনো টেক্সট আছে, যার কারণে সে এসব টেক্সটকে তাবিল করেছে, যদিও সে এক্ষেত্রে ভুল করেছে।

আর আমি সব সময়ই বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করতাম যেখানে একব্যক্তি বলেছেন যে: আমি যখন মারা যাব, আমাকে তোমরা জ্বালিয়ে দিও এরপর আমাকে পিশে ফেলিও, এরপর আমাকে সাগরে ছিটিয়ে দিও। আল্লাহর কসম! আল্লাহ যদি আমাকে ধরতে সক্ষম হন তাহলে তিনি আমাকে এমন শাস্তি দেবেন যা তিনি এ মহাবিশ্বে অন্যকাউকে দেননি। লোকেরা তার কথামতোই কাজ করল। আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তিকে বললেন, ‘তুমি যা করলে তা কি জন্য করেছ। লোকটি বলল, আপনার ভয়ে আমি এরূপ করেছি। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে মাফ করে দিলেন।[7]

এই লোকটি আল্লাহর ক্ষমতার ব্যাপারে সন্দেহ করেছে। তাকে সাগরে ছিটিয়ে দিলে আল্লাহ তাকে একত্র করে পুনরায় জীবন দানের ক্ষমতা রাখেন এ ব্যাপারে সে সন্দেহ করেছে। বরং সে বিশ্বাস করেছে যে, সে পুনরুত্থিত হবে না। আর এ ধরণের সন্দেহ বা বিশ্বাস মুসলিমদের ঐক্যমত্য অনুযায়ী কুফরী। তবে লোকটি জাহেল ছিল, এ ব্যাপারে তার জ্ঞান ছিল না। সাথে সাথে সে মুমিন ছিল, সে আল্লাহকে ভয় করত যে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন। আর সে কারণেই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

আর যে ব্যক্তি ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখে এবং সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণের ব্যাপারেও আগ্রহী, সে যদি তাবিল করে তাহলে উল্লিখিত ব্যক্তির চেয়েও ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে অধিক হকদার।’

এ থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, বক্তব্য ও বক্তা, কর্ম ও কর্মসম্পাদনকারীর মধ্যে পার্থক্য আছে। অতএব যেকোনো কুফরীপূর্ণ বা ফিসকপূর্ণ কথা বা কাজ, বলামাত্র বা করামাত্রই, বক্তা বা কর্মসম্পাদনকারীকে কাফির বা ফাসিক বলা যাবে না।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. মাজমুউল ফাতাওয়ায় বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো এই যে, যে কথাটি কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা অনুযায়ী কুফরী, সে ব্যাপারে সাধারণভাবে বলা হবে যে তা কুফরী, শরঈ দলিল যেভাবে কুফরী প্রমাণিত করেছে ঠিক সেভাবে; কারণ ঈমান হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল থেকে আহরিত বিধানসমূহের একটি। ঈমানের ব্যাপারে মানুষের ধারণা ও খেয়াল-খুশি মুতাবিক হুকুম লাগানো যাবে না। আর যে ব্যক্তি কোনো কুফরী কথা বলল, সে কাফির হয়ে গিয়েছে এ হুকুম ততক্ষণ পর্যন্ত লাগানো যাবে না যতক্ষণ না কাফির হয়ে যাওয়ার সকল শর্ত তার ওপর বর্তাবে এবং এ বিষয়ক সকল বাধা দূরিভূত হবে। উদাহরণত, যদি কেউ বলে যে মদ অথবা সূদ হালাল, আর সে ইসলামে নতুন প্রবেশকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়, অথবা সে দূরবর্তী কোনো মরুভূমিতে বড় হয়ে থাকে, অথবা সে কোনো একটি বাণী শুলন কিন্তু সে বিশ্বাস করল না যে তা আল কুরআনের বাণী, অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু এর হাদীস, যেমন সালাফদের কেউ কেউ কোনো কোনো বিষয় অস্বীকার করতেন যতক্ষণ না তাদের কাছে প্রমাণিত হত যে রাসূলুল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা বলেছেন।’[8]

এরপর তিনি বলেছেন, এইসব লোকদেরকে ততক্ষণ পর্যন্ত কাফির বলা হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের ওপর রিসালতের হুজ্জত কায়েম হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى ٱللَّهِ حُجَّةُۢ بَعۡدَ ٱلرُّسُلِۚ ﴾ [النساء: ١٦٥]

যাতে আল্লাহর বিপক্ষে রাসূলদের পর মানুষের জন্য কোন অজুহাত না থাকে। (সূরা আন্-নিসা: ৪: ১৬৫)

আর আল্লাহ তাআল এ উম্মতের ভুলত্রুটি ও ভুলে যাওয়াকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অতএব বুঝা গেল যে, কথা বা কাজ কখনো কুফরী হয় এবং কখনো ফিসক। তবে যে ব্যক্তি এহেন কথা বলল বা এ জাতীয় কোনো কাজ করল তার কাফির বা ফাসিক হয়ে যাওয়া আবশ্যক নয়। হয়তো কাফির বা ফাসিক হওয়ার শর্ত নাকচ হওয়ার কারণে অথবা কোনো শরঈ বাধা আসার কারণে। তবে যারা ইসলাম ব্যতীত অন্যকোনো ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের, এ পৃথিবীতে, কাফের হওয়ার হুকুম দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তির সম্মুখে সত্য প্রকাশিত হলো কিন্তু সে তার উল্টো চলতে দৃঢ়তা প্রদর্শন করল -কোনো বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে যা সে পূর্ব থেকেই বহন করে আসছে, অথবা তার কোনো গুরুর অনুসরণ করতে গিয়ে যাকে সে তা‘যীম করে, অথবা দুনিয়ার লোভে- তাহলে সে এই উল্টো চলার কারণে মাত্রা বুঝে কাফির অথবা ফাসিক হয়ে যাবে। অতএব মুমিনের ওপর জরুরি যে, সে তার আকীদা ও আমলকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করবে। কুরআন-সুন্নাহকে সে তার ইমাম বানাবে যা থেকে সে আলো সংগ্রহ করবে। কুরআন-সুন্নাহর পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে চলবে। এটাই হলো সিরাতে মুস্তাকীম যার নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা নিম্নোক্ত আয়াতে দিয়েছেন:

﴿ وَأَنَّ هَٰذَا صِرَٰطِي مُسۡتَقِيمٗا فَٱتَّبِعُوهُۖ وَلَا تَتَّبِعُواْ ٱلسُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمۡ عَن سَبِيلِهِۦۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٥٣ ﴾ [الانعام: ١٥٣]

আর এটি তো আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা তার অনুসরণ কর এবং অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, তাহলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা আল আন‘আম: ৬: ১৫৩)

যারা তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও আমলকে সুনির্দিষ্ট মাযহাবের ওপর স্থিত করেন, তাদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত যে, তারা যখন কুরআন-সুন্নাহর কোনো মূলবক্তব্য দেখেন যা তাদের মাযহাবের বিপরীত, সেটাকে তারা অনুচিত ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের মাযহাবের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। অতঃপর তারা কুরআন-সুন্নাহকে অনুকরণীয় নয় বরং তাদের মাযহাবের অনুসারী বানিয়ে ফেলেন। কুরআন-সুন্নাহ ব্যতীত যা আছে সেগুলোকে তারা কুরআন-সুন্নাহর অনুসারী বানান না। এটা হলো প্রবৃত্তিপূজারীদের পথ। এটা হিদায়েত অনুসারীদের পথ নয়। এই পথকে আল্লাহ তা‘আলা ভৎর্সনা করেছেন। তিনি বলেছেন:

﴿ وَلَوِ ٱتَّبَعَ ٱلۡحَقُّ أَهۡوَآءَهُمۡ لَفَسَدَتِ ٱلسَّمَٰوَٰتُ وَٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهِنَّۚ بَلۡ أَتَيۡنَٰهُم بِذِكۡرِهِمۡ فَهُمۡ عَن ذِكۡرِهِم مُّعۡرِضُونَ ٧١ ﴾ [المؤمنون: ٧١]

আর যদি সত্য তাদের কামনা-বাসনার অনুগামী হত, তবে আসমানসমূহ, জমিন ও এতদোভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে যেত; বরং আমি তাদেরকে দিয়েছি তাদের উপদেশবাণী (কুরআন)। অথচ তারা তাদের উপদেশ হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। (সূরা আল মুমিনূন: ২৩: ৭১)

এ ক্ষেত্রে মানুষের অবস্থা যে পর্যবেক্ষণ করতে যাবে সে আজব ধরনের বিষয় দেখতে পাবে। সে বুঝতে পারবে যে, হিদায়েত ও সত্যের ওপরে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা এবং গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়া একজন বান্দার জন্য কতোই না প্রয়োজন।

আর যে ব্যক্তি সত্য হৃদয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, আল্লাহর কাছে নিজের অপারগতা প্রকাশ করবে -আল্লাহ তা‘আলার অমুখাপেক্ষিতার ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান রেখে এবং সে যে আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী তা অন্তরে অনুভব করে -তাহলে অবশ্যই আশা করা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার বান্দার এ প্রার্থনাকে কবুল করবেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ ١٨٦ ﴾ [البقرة: ١٨٦]

আর যখন আমার বান্দাগণ তোমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আমি তো নিশ্চয় নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই, যখন সে আমাকে ডাকে। সুতরাং তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান আনে। আশা করা যায় তারা সঠিক পথে চলবে। (সূরা আল বাকারা: ২: ১৮৬)

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের ওই লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন যারা সত্যকে সত্য হিসেবে দেখে এবং তার অনুসরণ করে। এবং অসত্যকে অসত্য হিসেবে দেখে এবং তা বর্জন করে চলে। তিনি যেন আমাদেরকে হিদায়েতকারী ও হিদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি যেন আমাদের সৎ ও সংস্কারকারী বানান। তিনি যেন আমাদেরকে হিদায়েত করার পর আমাদের অন্তরকে সত্যচ্যুত না করেন। তিনি যেন আমাদেরকে রহমত দান করেন, নিশ্চয় তিনি সর্বদাতা।

সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য যিনি সৃষ্টিকুলে রব। যার অনুকম্পা ও নিয়ামতে সকল ভালো কাজ সম্পন্ন হয়। আর সালাত ও সালাম রহমতের নবীর ওপর, যিনি উম্মতকে প্ররাক্রমশালী ও সপ্রংশ আল্লাহ তা‘আলার পথ দেখিয়েছেন আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশেই। সালাত ও সালাম তার পরিবারবর্গের প্রতি, সাহাবীগণের প্রতি এবং যারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসরণ করবেন তাদের সকলের প্রতি।


১৫ শাওয়াল, ১৪০৪ হি. তারিখে এ বইটি লেখার কাজ সম্পন্ন হলো

আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষীমুহাম্মদ আস-সালেহ আল উসাইমীন।

>
[1] মুসলিম, হাদীস নং ১১১।

[2] - বর্ণনায় মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ : ওইব্যক্তির ঈমানের অবস্থা যে তার ভাইকে ‘ হে কাফির’ বলে ডাকল, হাদীস নং (৬১৬০)

[3] - বর্ণনায় মুসলিম, তাওবা অধ্যায়, হাদীস নং ( ২৭৪৫-২৭৪৭)

[4] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ১২, পৃ. ১৮০

[5] - রিসালতের হুজ্জত বলতে বুঝায় রাসূলুল্লা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বিধান নিয়ে এসেছেন তা স্পষ্টরূপে কারো কাছে পৌঁছে দেয়া।

[6] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৩, পৃ. ২২৯

[7] - বুখারী, আহাদীসুল আম্বীয়া অধ্যায়, হাদীস নং (৩৪৭৮); মুসলিম, তাওবা অধ্যায়, হাদীস নং (২৭৫৬, ২৭৫৭)

[8] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৩৫, পৃ.১৬৫