-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩১. আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অনুগত হবে এবং সৎকাজ করবে তাকে আমরা পুরস্কার দেব দু'বার। আর তার জন্য আমরা প্ৰস্তুত রেখেছি সম্মানজনক রিযিক।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৩১) তোমাদের মধ্যে যে কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের প্রতি অনুগতা হবে ও সৎকাজ করবে, তাকে আমি দ্বিগুণ পুরস্কার দান করব।[1] আর তার জন্য আমি সম্মানজনক জীবিকা প্রস্তুত রেখেছি।
[1] অর্থাৎ, যেমন শাস্তি দ্বিগুণ হবে অনুরূপ পুণ্য বা নেকীও দ্বিগুণ দেওয়া হবে। যেমন নবী (সাঃ) কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, إذًا لاَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ অর্থাৎ, ‘‘তখন আমি তোমাকে ইহজীবন ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তি আস্বাদন করাতাম।’’ (বানী ইসরাঈল ৭৫ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩২. হে নবী-পত্নিগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর সুতরাং পর-পুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, কারণ এতে যার অন্তরে ব্যাধি আছে, সে প্ৰলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায়সংগত কথা বলবে।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৩২) হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও;[1] যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়।[2] আর তোমরা সদালাপ কর। (স্বাভাবিকভাবে কথা বল।)[3]
[1] অর্থাৎ, তোমাদের বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা সাধারণ নারীদের মত নয়; বরং আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে রসূল-পত্নী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন, যার ফলে তোমরা এক উচ্চস্থান ও মর্যাদার অধিকারিণী, তাই রসূল (সাঃ)-এর মত তোমাদেরকেও উম্মতের জন্য আদর্শবতী হতে হবে। এখানে নবী-পত্নীগণকে তাঁদের উচ্চস্থান ও মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে তাঁদেরকে কিছু নির্দেশ দান করা হচ্ছে। এ সব নির্দেশাবলীতে সম্বোধন যদিও পবিত্রা স্ত্রীগণকে করা হয়েছে, যাঁদের প্রত্যেককে ‘উম্মুল মু’মিনীন’ (মু’মিনদের মাতা) বলা হয়েছে, তবুও বর্ণনা ভঙ্গীতে প্রকাশ পাচ্ছে যে, উদ্দেশ্য সমগ্র মুসলিম নারীকে বোঝানো ও সতর্ক করা। অতএব উক্ত নির্দেশাবলী সমগ্র মুসলিম নারীর জন্য মান্য ও পালনীয়।
[2] আল্লাহ তাআলা যেরূপভাবে নারী জাতির দেহ-বৈচিত্রে পুরুষের জন্য যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন (যা থেকে হেফাযতের বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে নারী পুরুষের জন্য ফেতনার কারণ না হয়ে পড়ে।) অনুরূপভাবে তিনি নারীদের কণ্ঠস্বরেও প্রকৃতিগতভাবে মন কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা, কোমলতা ও মধুরতা রেখেছেন, যা পুরুষকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে। সুতরাং সেই কণ্ঠস্বর ব্যবহার করার ব্যাপারেও এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, পরপুরুষের সাথে বাক্যালাপের সময় ইচ্ছাপূর্বক এমন কণ্ঠ ব্যবহার করবে, যাতে কোমলতা ও মধুরতার পরিবর্তে সামান্য শক্ত ও কঠোরতা থাকে। যাতে ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরবিশিষ্ট লোক কণ্ঠের কোমলতার কারণে তোমাদের দিকে আকৃষ্ট না হয়ে পড়ে এবং তাদের মনে কুবাসনার সঞ্চার না হয়।
[3] অর্থাৎ, এই কর্কশতা ও কঠোরতা শুধু কণ্ঠস্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, অর্থাৎ মুখে এমন বাক্য আনবে না, যা অসঙ্গত ও সচ্চরিত্রতার পরিপন্থী। إِنِ اتَّقَيْتُنَّ (যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর) বলে আল্লাহ তাআলা ইঙ্গিত করেছেন যে, এই কথা এবং অন্যান্য নির্দেশাবলী যা সামনে বর্ণনা করা হবে, তা মুত্তাক্বী নারীদের জন্য (যারা আল্লাহকে ভয় করে)। কারণ তাদেরই আশঙ্কা থাকে যে, যাতে তাদের আখেরাত বরবাদ না হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যাদের হৃদয় আল্লাহর ভয়শূন্য তাদের সাথে এই নির্দেশাবলীর কোন সম্পর্ক নেই। তারা কখনোও এর পরোয়া করবে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩৩. আর তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে(১) এবং প্রাচীন জাহেলী যুগের প্রদর্শনীর মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়াবে না। আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্ৰদান কর এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের অনুগত থাক।(২) হে নবী-পরিবার!(৩) আল্লাহ তো শুধু চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।
(১) আয়াতের অর্থ দাঁড়ায়, নারীর আসল অবস্থানক্ষেত্র হচ্ছে তার গৃহ। কেবলমাত্র প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সে গৃহের বাইরে বের হতে পারে। [ইবন কাসীর মুয়াসসার] আয়াতের শব্দাবলী থেকেও এ অর্থ প্রকাশ হচ্ছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস একে আরো বেশী সুস্পষ্ট করে দেয়। মুজাহিদ তো তখনই স্থিরচিত্তে আল্লাহর পথে লড়াই করতে পারবে যখন নিজের ঘরের দিক থেকে সে পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে, তার স্ত্রী তার গৃহস্থালী ও সন্তানদেরকে আগলে রাখবে এবং তার অবর্তমানে তার স্ত্রী কোন অঘটন ঘটাবে না, এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি আশংকামুক্ত থাকবে। যে স্ত্রী তার স্বামীকে এ নিশ্চিন্ততা দান করবে। সে ঘরে বসেও তার জিহাদে পুরোপুরি অংশীদার হবে। অন্য একটি হাদীসে এসেছে, “নারী পৰ্দাবৃত থাকার জিনিস। যখন সে বের হয় শয়তান তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে এবং তখনই সে আল্লাহর রহমতের নিকটতর হয় যখন সে নিজের গৃহে অবস্থান করে।” [সহীহ ইবন খুযাইমাহ: ১৬৮৫, সহীহ ইবন হিব্বান: ৫৫৯৯]
(২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রীগণের প্রতি কুরআনের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম হেদায়েত হলো, সালাত প্রতিষ্ঠা কর, যাকাত প্ৰদান কর এবং মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। [ইবন কাসীর]
(৩) এ আয়াতে আহলে বাইত বা নবী পরিবার বলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদেরকে বুঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৩) তোমরা স্বগৃহে অবস্থান কর[1] এবং (প্রাক-ইসলামী) জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না।[2] তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর ও যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অনুগতা হও;[3] হে নবী-পরিবার![4] আল্লাহ তো কেবল তোমাদের মধ্য থেকে অপবিত্রতা দূর করতে চান এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে চান।
[1] অর্থাৎ, তোমরা ঘরে অবস্থান কর এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বাইরে যেও না। এতে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, নারীদের কর্ম রাজনীতি, দুনিয়া পরিচালনা ও পরিশ্রম-উপার্জন করা নয়। বরং তাদের প্রধান কাজ হল, ঘরের চার দেওয়ালের মাঝে সুরক্ষিত থেকে গৃহকর্ম দেখাশোনা করা।
[2] এখানে নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার আদব বর্ণনা করে দেওয়া হয়েছে যে, যদি প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বের হতে হয়, তবে তোমরা যেন সাজসজ্জা করে বাইরে না যাও কিংবা এমনভাবে বের না হও, যাতে তোমাদের সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। যেমন বেপর্দা হয়ে এমনভাবে বের না হও, যাতে তোমাদের মাথা, চেহারা, ঘাড় ও বুক ইত্যাদি পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বরং সুগন্ধি ব্যবহার না করে সাধারণ পোশাকে আবৃত হয়ে পর্দার সাথে বের হবে। ‘تبرج’ এর অর্থ হল বেপর্দা হওয়া, সৌন্দর্য প্রকাশ ও প্রদর্শন করা। কুরআন এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, ‘تَبَرُّجْ’ (পর্দাহীনতা) হল জাহেলী যুগের প্রথা; যা ইসলামের পূর্বে ছিল এবং ভবিষ্যতে যখন তা বেছে নেওয়া হবে, তখন তা জাহেলী প্রথাই গণ্য হবে। তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, তাতে তার নাম যতই সুন্দর ও মনলোভা (নারী-স্বাধীনতা, নারী-প্রগতি, সভ্যতা ইত্যাদি) রাখা হোক না কেন।
[3] পূর্বের নির্দেশগুলি পাপকর্ম থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে ছিল। এই সকল নির্দেশাবলী পুণ্যকর্ম বেছে নেওয়ার ব্যাপারে দেওয়া হচ্ছে।
[4] ‘আহলে বায়ত’ (নবী-পরিবার) বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? এতে কিছু মতভেদ রয়েছে। অনেকে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণকে বুঝিয়েছেন, যেমন এখানে কুরআনের পূর্ব বর্ণনায় প্রকাশ হচ্ছে। কুরআন এ স্থানে তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণকেই ‘আহলে বায়ত’ বলেছে। কুরআনের অন্য স্থানেও নবী (সাঃ)-এর স্ত্রীগণকেই ‘আহলে বায়ত’ বলা হয়েছে। যেমন সুরা হূদের ৭৩ আয়াতে। সুতরাং তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের ‘আহলে বায়ত’ হওয়া কুরআনী দলীল দ্বারা প্রমাণিত। অনেকে হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘আহলে বায়ত’ বলতে আলী, ফাতেমা এবং হাসান-হুসাইন (রাঃ)-কে ধরেন এবং নবী-পত্নীগণকে তার বাইরে মনে করেন। পক্ষান্তরে পূর্বোক্ত উলামাগণ এই চারজনকে আহলে বায়তের বাইরে মনে করেন। তবে মধ্যপন্থা এই যে, উভয় শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গই ‘আহলে বায়ত’। নবী-পত্নীগণ কুরআনের দলীলের ভিত্তিতে এবং মেয়ে-জামাই ও তাঁদের পুত্রগণ সেই সহীহ বর্ণনার ভিত্তিতে ‘আহলে বায়ত’ যাতে নবী (সাঃ) তাঁদেরকে নিজের চাদরে ঢেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বায়ত।’’ যার অর্থ হল যে, এরাও আমার আহলে বায়তের মধ্যে শামিল। অথবা তা দু’আ ছিল যে, ‘‘হে আল্লাহ! এদেরকেও আমার পত্নীগণের মত আমার আহলে বায়তে শামিল করে নাও।’’ আর এইভাবে সকল দলীলগুলি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে যায়। (বিস্তারিত জানার জন্য আল্লামা শাওকানীর ফাতহুল ক্বাদীর দ্রষ্টব্য)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩৪. আর আল্লাহর আয়াত ও হিকমত থেকে যা তোমাদের ঘরে পাঠ করা হয়, তা তোমরা স্মরণ রাখবে(১); নিশ্চয় আল্লাহ্ অতি সুক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।
(১) মূলে وَاذْكُرْنَ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এর দু'টি অর্থ: ‘স্মরণ রেখো’ এবং ‘বৰ্ণনা করো’। প্রথম অর্থের দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য এই দাঁড়ায়: হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা কখনো ভুলে যেয়ো না যে, যেখান থেকে সারা দুনিয়াকে আল্লাহর আয়াত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার শিক্ষা দেয়া হয় সেটিই তোমাদের আসল গৃহ। তাই তোমাদের দায়িত্ব বড়ই কঠিন। তোমাদের গৃহে যেসব বিষয় আলোচনা হয় সেসব বিষয় স্বয়ং স্মরণ রেখো —যার ফলশ্রুতি ও পরিচয় হলো এগুলোর উপর আমল করা। দ্বিতীয় অর্থটির দৃষ্টিতে এর তাৎপর্য হয়: হে নবীর স্ত্রীগণ! তোমরা যা কিছু শোনো এবং দেখো তা লোকদের সামনে বর্ণনা করতে থাকো। কারণ রাসূলের সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থানের কারণে এমন অনেক বিধান তোমাদের গোচরীভূত হবে যা তোমাদের ছাড়া অন্য কোন মাধ্যমে লোকদের জানা সম্ভব হবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে যেসব শিক্ষা প্রদান করেছেন, উম্মতের অন্যান্য লোকদের সঙ্গে সেসবের আলোচনা করা এবং তাদেরকে সেগুলো পৌছে দেয়া তাদের দায়িত্ব।
এ আয়াতে দু'টি জিনিসের কথা বলা হয়েছে। এক, আল্লাহর আয়াত, দুই, হিকমাত বা জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। আল্লাহর আয়াত অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কিতাবের আয়াত। কিন্তু হিকমাত শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। সকল প্রকার জ্ঞানের কথা এর অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদেরকে শেখাতেন। আল্লাহর কিতাবের শিক্ষার ওপরও এ শব্দটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র তার মধ্যেই একে সীমিত করে দেবার সপক্ষে কোন প্রমাণ নেই। কুরআনের আয়াত শুনানো ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহ্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পবিত্র জীবন ও নৈতিক চরিত্র এবং নিজের কথার মাধ্যমে যে হিকমাতের শিক্ষা দিতেন তাও অপরিহার্যভাবে এর অন্তর্ভুক্ত। [দেখুন: তাবারী, ফাতহুল কাদীর; কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৪) আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানের কথা যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয়, তা তোমরা স্মরণ রাখ।[1] নিঃসন্দেহে আল্লাহ সমস্ত গোপন রহস্য জানেন, খবর রাখেন সর্ববিষয়ের।
[1] অর্থাৎ, তার উপর আমল কর। ‘حكمة’ (জ্ঞানের কথা)র অর্থ হাদীস বা নবী (সাঃ)-এর সুন্নত। উক্ত আয়াত থেকে দলীল নিয়ে অনেকে বলেন যে, কুরআনের মত হাদীসকেও নেকীর উদ্দেশ্যে পড়া যাবে। এ ছাড়া এ আয়াতও নবী-পত্নীগণের ‘আহলে বায়ত’ হওয়ার কথা প্রমাণ করে। কারণ অহীর অবতরণ, যার বর্ণনা এই আয়াতে হয়েছে, তা নবী-পত্নীগণের গৃহেই হত; বিশেষ করে আয়েশা (রাঃ) -র গৃহে, যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩৫. নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সওম পালনকারী পুরুষ সওম পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী নারী, আল্লাহ্কে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহ্কে অধিক স্মরণকারী নারী—তাদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৫) নিশ্চয়ই আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) পুরুষ ও আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) নারী,[1] বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, রোযা পালনকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী (সংযমী) পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী (সংযমী) নারী, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী --এদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান রেখেছেন।
[1] একদা উম্মে সালামা এবং অন্যান্য সাহাবী মহিলাগণ বললেন যে, কি ব্যাপার, আল্লাহ তাআলা সর্বস্থানে মহিলাদেরকে ছেড়ে কেবল পুরুষদেরকেই সম্বোধন করেন। তখন এই আয়াতটি অবতীর্ণ হল। (মুসনাদ আহমদ, ৬/৩০১, তিরমিযী ৩২১১নং) এতে মহিলাদের মন জয় করা হয়েছে। তাছাড়া সকল আহ্কামে পুরুষদের সাথে মহিলারাও শামিল, শুধু তাদের কিছু বিশেষ আহকাম ছাড়া যা তাদেরই জন্য নির্দিষ্ট। এই আয়াত ও অন্যান্য আয়াতসমূহ দ্বারা পরিষফুটিত হয় যে, ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্য এবং পরকালের মান-মর্যাদায় পুরুষ ও নারীর মাঝে কোন পার্থক্য নেই। উভয়ের জন্য একই ভাবে সে ময়দান খোলা আছে এবং উভয়েই বেশি বেশি নেকী ও সওয়াব অর্জন করতে পারে। কেবল জাতিভেদে তাদের মাঝে কোন কম-বেশি করা হবে না। এ ছাড়া মুসলমান ও মু’মিনের পৃথক পৃথক বর্ণনা করাতে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, এই দুই-এর মাঝে পার্থক্য আছে। ঈমানের স্থান ইসলামের ঊর্ধ্বে; যেমন কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য দলীল দ্বারা তাই প্রমাণ হয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩৬. আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফয়সালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোন (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়। আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল সে স্পষ্টভাবে পথভ্ৰষ্ট হলো।(১)
(১) আলোচ্য আয়াতে কয়েকটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে এক ঘটনা হচ্ছে, যায়েদ ইবন হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা। ঘটনার সংক্ষিপ্ত রূপ এই যে, যায়েদ ইবন হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু একজন স্বাধীন লোক ছিলেন। কিন্তু জাহেলী যুগে কিছু লোক তাকে অল্প বয়সে ধরে এনে ওকায বাজারে বিক্রি করে দেয়, খাদিজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সে লোক থেকে তাকে খরদ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে দান করেন। আর আরব দেশের প্রথানুযায়ী তাকে পোষ্য-পুত্রের গৌরবে ভূষিত করে লালন-পালন করেন। মক্কাতে তাকে ‘মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামপুত্র যায়েদ’ নামে সম্বোধন করা হত। কুরআনে কারীম এটাকে অজ্ঞতার যুগের ভ্রান্ত রীতি আখ্যায়িত করে তা নিষিদ্ধ করে দেয় এবং পোষ্যপুত্রকে তার প্রকৃত পিতার সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে নির্দেশ দেয়। যায়েদ ইবন হারেসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যৌবনে পদার্পনের পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ ফুফাত বোন যয়নব বিনতে জাহশকে তার নিকট বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব পাঠান।
যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যেহেতু মুক্তিপ্রাপ্ত দাস ছিলেন সুতরাং যয়নব ও তাঁর ভ্রাতা আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ এ সম্বন্ধ স্থাপনে এই বলে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন যে, আমরা বংশ মর্যাদায় তার চাইতে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত। মুজাহিদ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আয়াত নাযিল হয়। যাতে এ দিকনির্দেশনা রয়েছে যে, যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো প্রতি বাধ্যতামূলকভাবে কোন কাজের নির্দেশ দান করেন, তবে সে কাজ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। শরীয়তানুযায়ী তা না করার অধিকার থাকে না। শরীয়তে একাজ যে লোক পালন করবে না, আয়াতের শেষে একে স্পষ্ট গোমরাহ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যয়নব ও তার ভাই এ আয়াত শুনে তাদের অসম্মতি প্রত্যাহার করে নিয়ে বিয়েতে রাযী হয়ে যায়। অত:পর বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। [বাগাভী]
এ আয়াত সম্পর্কে দ্বিতীয় যে ঘটনাটি বর্ণনা করা হয় তা হলো, জুলাইবীব রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জন্য কোন এক আনসার সাহাবীর মেয়ের সাথে বৈবাহিক সম্বদ্ধ স্থাপন করতে ইচ্ছক ছিলেন। এই আনসার ও তার পরিবার-পরিজন এ সম্বন্ধ স্থাপনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেন। কিন্তু এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর সবাই রাযী হয়ে যান এবং যথারীতি বিয়েও সম্পন্ন হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য পর্যাপ্ত জীবিকা কামনা করে দো'আ করলেন। সাহাবায়ে কেরাম বলেন যে, তার গৃহে এত বরকত ও ধন-সম্পদের এত আধিক্য ছিল যে, মদীনার গৃহসমূহের মধ্যে এ বাড়ীটিই ছিল সর্বাধিক উন্নত ও প্রাচুর্যের অধিকারী এবং এর খরচের অঙ্কই ছিল সবচাইতে বেশী। পরবর্তীকালে জুলাইবীব রাদিয়াল্লাহু আনহু এক জিহাদে শাহাদত বরণ করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দাফনকাফন নিজ হাতে সম্পন্ন করেন। [দেখুন: ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৬) আল্লাহ ও তাঁর রসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন বিশ্বাসী পুরুষ কিংবা বিশ্বাসী নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না।[1] কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের অবাধ্য হলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।
[1] এই আয়াতটি যয়নাব (রাঃ) -এর বিবাহের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ) যদিও তিনি প্রকৃত পক্ষে আরবী ছিলেন, কিন্তু কেউ তাঁকে শৈশবকালে জোর করে ধরে দাস হিসাবে বিক্রি করে দিয়েছিল। নবী (সাঃ)-এর সাথে খাদীজা (রাঃ) -র বিবাহের পর খাদীজা (রাঃ) তাঁকে রসূল (সাঃ)-কে দান করে দেন। তিনি তাঁকে মুক্ত করে আপন পোষ্যপুত্র বানিয়ে নিয়েছিলেন। একদা নবী (সাঃ) তাঁর বিবাহের জন্য আপন ফুফাতো বোন যয়নাব (রাঃ) -কে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। যাতে তাঁর ও তাঁর ভায়ের বংশ-মর্যাদার ফলে মনে চিন্তা হল যে, যায়েদ (রাঃ) একজন মুক্ত দাস এবং আমাদের সম্পর্ক এক উচ্চ বংশের সাথে। (সুতরাং এ প্রস্তাব কিভাবে গ্রহণ করা যায়?) এই চিন্তা-ভাবনার ফলে উক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। যার উদ্দেশ্য হল যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ফায়সালার পর কোন মু’মিন পুরুষ ও নারীর এ এখতিয়ার ও অধিকার নেই যে, সে নিজের ইচ্ছামত চলবে। বরং তার জন্য অপরিহার্য যে, সে মাথা নত করে তা মেনে নেবে। সুতরাং এ আয়াত শ্রবণ করার পর যয়নাব ও অন্যান্যরা নিজেদের অসম্মতি প্রত্যাহার করে নিয়ে সম্মত হয়ে যান। অতঃপর বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* فَلَمَّا قَضَىٰ زَيْدٌ مِّنْهَا وَطَرًا এর আভিধানিক অর্থ হল: তার (স্ত্রীর) ব্যাপারে যায়েদের প্রয়োজন যখন শেষ হল। ভাবার্থ হল: বিয়ের প্রয়োজনীয়তা শেষে যায়েদ যখন তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিল। যায়েদ ইবন হারিসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাস ছিলেন; আল্লাহ ইসলামের পথে হিদায়াত দানে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মুক্ত করে পালক পুত্র ঘোষণা দিয়ে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন। যায়েদ বিয়ে করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ফুফাতো বোন যয়নব বিন্ত জাহশকে। তাদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় যায়েদ যয়নবকে তালাক দেন। পরে আল্লাহর নির্দেশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যয়নবকে বিয়ে করেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা পালক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করার ব্যাপারে সামাজিক নিষেধাজ্ঞা দূরীভূত করেন।
৩৭. আর স্মরণ করুন, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনি তাকে বলেছিলেন, তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে বজায় রাখ এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর(১) আর আপনি আপনার অন্তরে গোপন করছিলেন এমন কিছু যা আল্লাহ প্রকাশ করে দিচ্ছেন(২); এবং আপনি লোকদেরকে ভয় করছিলেন, অথচ আল্লাহকেই ভয় করা আপনার পক্ষে অধিকতর সংগত। তারপর যখন যায়েদ তার (স্ত্রীর) সাথে প্রয়োজন শেষ করল(৩), তখন আমরা তাকে আপনার নিকট বিয়ে দিলাম(৪), যাতে মুমিনদের পোষ্য পুত্রদের স্ত্রীদেরকে (স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে) কোন সমস্যা না হয় যখন তারা (পোষ্য পুত্ররা) নিজ স্ত্রীর সাথে প্রয়োজন শেষ করবে (এবং তালাক দিবে)। আর আল্লাহ্র আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।
(১) অর্থাৎ “স্মরণ করুন যখন আল্লাহ ও আপনি নিজে যার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তাকে বলছিলেন যে, তুমি নিজের স্ত্রীকে তোমার বিবাহাধীনে থাকতে দাও।” এ ব্যক্তি হলো যায়েদ। আল্লাহ তাকে ইসলামে দীক্ষিত করে তার প্রতি প্রথম অনুগ্রহ প্ৰদৰ্শন করেন। যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যায়নাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার সম্পর্কে ভাষাগত শ্রেষ্ঠত্ব, গোত্ৰগত কৌলিন্যভিমান এবং আনুগত্য ও শৈথিল্য প্রদর্শনের অভিযোগ উত্থাপন করতেন। একদিন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খেদমতে এসব অভিযোগ পেশ করতে গিয়ে যায়নবকে তালাক দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেনঃ “নিজ স্ত্রীকে তোমার বিবাহধীনে থাকতে দাও এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর।” [দেখুন: বাগভী; ফাতহুল কাদীর; তাবারী]
(২) এর ব্যাখ্যা এই যে, আপনি অন্তরে যে বিষয় গোপন রেখেছেন তা এ বাসনা যে, যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু যয়নবকে তালাক দিলে পরে আপনি তাকে বিয়ে করবেন। [ফাতহুল কাদীর; বাগভী]
(৩) অর্থাৎ যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং তার ইদ্দত পুরা হয়ে গেলো। “প্রয়োজন পূর্ণ করলো” শব্দগুলো স্বতঃস্ফৰ্তভাবে একথাই প্রকাশ করে যে, তার কাছে যায়েদের আর কোন প্রয়োজন থাকলো না। [মুয়াস্সার; ফাতহুল কাদীর]
(৪) অর্থাৎ আপনার সাথে তার বিয়ে স্বয়ং আমরা সম্পন্ন করে দিয়েছি। এর ফলে একথা বোঝা যায় যে, এ বিয়ে স্বয়ং আল্লাহ নিজেই সম্পন্ন করে দেয়ার মাধ্যমে বিয়ে-শাদীর সাধারণভাবে প্রচলিত শর্তাবলীর ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এ বিয়ের প্রতি বিশেষ মর্যাদা আরোপ করেছেন। [তাবারী; বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৭) স্মরণ কর, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং তুমিও যার প্রতি অনুগ্রহ করেছ, তুমি তাকে বলেছিলে, ‘তুমি তোমার স্ত্রীকে ত্যাগ করো না এবং আল্লাহকে ভয় কর।’ আর তুমি তোমার অন্তরে যা গোপন করছিলে আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিচ্ছেন; তুমি লোককে ভয় করছিলে, অথচ আল্লাহকেই ভয় করা তোমার পক্ষে অধিকতর সঙ্গত।[1] অতঃপর যায়েদ যখন তার (স্ত্রী যয়নাবের) সাথে বিবাহ-সম্পর্ক ছিন্ন করল,[2] তখন আমি তোমার সাথে তার বিবাহ দিলাম;[3] যাতে বিশ্বাসীদের পোষ্যপুত্রগণ নিজ স্ত্রীদের সাথে বিবাহসূত্র ছিন্ন করলে সে সব রমণীকে বিবাহ করায় তাদের কোন বিঘ্ন না থাকে।[4] আর আল্লাহর আদেশ কার্যকর হয়েই থাকে।[5]
[1] কিন্তু যেহেতু তাঁদের মন-মানসিকতায় পার্থক্য ছিল, স্ত্রীর মনে বংশ-মর্যাদা ও আভিজাত্য বাসা বেঁধেই ছিল, অন্য দিকে যায়েদের সমভ্রমে ছিল দাসত্বের দাগ। ফলে তাঁদের আপোসে কলহ লেগেই থাকত, যা যায়েদ (রাঃ) মাঝে মাঝে নবী (সাঃ)-এর নিকট প্রকাশ করতেন এবং ত্বালাক দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। কিন্তু নবী (সাঃ) তাঁকে ত্বালাক দিতে নিষেধ করতেন ও কোন রকম ভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য বলতেন। অপর দিকে আল্লাহ তাআলা নবী (সাঃ)-কে অহীর মাধ্যমে এই ভবিষ্যদ্বাণী করে দিয়েছিলেন যে, যায়েদের পক্ষ থেকে ত্বালাক হবে এবং তারপর যয়নাবের সাথে তোমার বিয়ে হবে; যাতে জাহেলিয়াতের পোষ্যপুত্র রাখার প্রথার উপর জোর কুঠারাঘাত হেনে প্রকাশ করে দেওয়া হবে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে পোষ্যপুত্র আপন পুত্রের মত নয় এবং তার ত্বালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করা বৈধ। উক্ত আয়াতে এই কথার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যায়েদ (রাঃ)-এর উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই ছিল যে, তিনি তাঁকে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করার তাওফীক দান করেন এবং দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। আর নবী (সাঃ)-এর তাঁর প্রতি দয়া এই ছিল যে, তিনি তাঁকে দ্বীনী তরবিয়ত দান করেন ও তাঁকে স্বাধীন করে আপন পুত্র বানিয়ে নেন এবং আপন ফুফু উমাইমা বিনতে আব্দুল মুত্তালেবের মেয়ের সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন করেন। অন্তরে গোপন করা কথা তাই ছিল, যা তাঁকে যয়নাবের সাথে তাঁর নিজের বিয়ের ব্যাপারে অহী দ্বারা জানানো হয়েছিল। নবী (সাঃ) এই কথার ভয় করতেন যে, লোকে বলবে, ছেলের স্ত্রীকে (পুত্রবধূকে) বিয়ে করে নিয়েছে। অথচ যখন আল্লাহ তাঁর দ্বারা এই প্রথার মূল উৎপাটন করতে চান, তখন মানুষকে ভয় করার কোন প্রয়োজন ছিল না। নবী (সাঃ)-এর যদিও এটা প্রকৃতিগত ভয় ছিল, তবুও তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ করার অর্থ হল যে, এ বিবাহ হবে, যাতে এ ব্যাপারে সকলে অবগত হয়ে যায়।
[2] অর্থাৎ, বিয়ের পর ত্বালাক দিল এবং যয়নাব ইদ্দত পূর্ণ করল।
[3] অর্থাৎ, এ বিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাকের আদেশে সাধারণ বিয়ে-শাদীর প্রচলিত নিয়ম ও শর্তাবলী থেকে ব্যতিক্রম ভাবে সুসম্পন্ন হয়। অর্থাৎ ঈজাব-কবুল, অলী (অভিভাবক), মোহর এবং কোন সাক্ষী ছাড়াই।
[4] এটি হল যয়নাবের সাথে নবী (সাঃ)-এর বিয়ের কারণ। আর তা এই যে, আগামীতে কোন মুসলিম যেন এই ব্যাপারে কোন সংকীর্ণতা বোধ না করে এবং প্রয়োজনে পোষ্যপুত্রের ত্বালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিবাহ করতে পারে।
[5] অর্থাৎ, পূর্ব থেকে তকদীরে লেখা ছিল। যা যে কোন অবস্থাতেই হওয়ার ছিল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিবাহ করা।
৩৮. নবীর জন্য সেটা (করতে) কোন সমস্যা নেই যা আল্লাহ বিধিসম্মত করেছেন তার জন্য। আগে যারা চলে গেছে তাদের ক্ষেত্রেও এটাই ছিল আল্লাহর বিধান।(১) আর আল্লাহর ফয়সালা সুনির্ধারিত, অবশ্যম্ভাবী।
(১) এ আয়াতের মাধ্যমে এ বিয়ের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সন্দেহসমূহের উত্তরের সূচনা এরূপভাবে করা হয়েছে যে, অন্যান্য পুণ্যবতী স্ত্রীগণ থাকা সত্বেও এ বিয়ের পেছনে কি উদ্দেশ্য নিহিত ছিল? এরশাদ হয়েছে যে, এটা আল্লাহ্ তা'আলার চিরন্তন বিধান যা কেবল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর জন্য নির্দিষ্ট নয়; আপনার পূৰ্ববতী নবীগণের কালেই দ্বীনি স্বার্থ ও মঙ্গলামঙ্গলের কথা বিবেচনা করে বহু সংখ্যক স্ত্রীলোককে বিয়ে করার অনুমতি ছিল। যন্মধ্যে দাউদ ও সুলায়মান আলাইহিস সালাম-এর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। [বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৮) আল্লাহ নবীর জন্য যা বিধিবদ্ধ করেছেন, তা করতে তার জন্য কোন বাধা নেই।[1] পূর্বে যে সব নবী অতীত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও এটিই ছিল আল্লাহর বিধান।[2] আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত।[3]
[1] এখানে পূর্বোক্ত ঘটনা যয়নাবের বিয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং উক্ত বিয়ে তাঁর জন্য হালাল ছিল। যার ফলে তাতে কোন পাপবোধ বা নিজের মাঝে সংকীর্ণতা বোধ করার কোন কারণ নেই।
[2] অর্থাৎ, পূর্বের নবীগণ সেই কর্মে কোনরূপ সংকীর্ণতা বোধ করতেন না, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদের উপর ফরয করা হত; যদিও তা জাতি ও জনসাধারণের মাঝে প্রচলিত প্রথার উলটা হত।
[3] অর্থাৎ, (আল্লাহ তাআলার কাজ) এক বিশেষ হিকমত ও কল্যাণের ভিত্তিতে পূর্ণ হয়, দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের মত সাময়িক ও আশু প্রয়োজনের তাকীদে হয় না। অনুরূপ তার সময়ও নির্ধারিত থাকে, যা সেই সময় অনুসারেই সংঘটিত হয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* এ বাক্যটি পূর্বোল্লিখিত নবীদের বিশ্লেষণ।
৩৯. তারা আল্লাহর বাণী প্রচার করত, আর তাঁকে ভয় করত এবং আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় করত না।(১) আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আল্লাহই যথেষ্ট।
(১) নবী আলাইহিমুস সালামগণের যে অপর এক গুণ বৈশিষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে তা এই যে, এসব মহাত্মবৃন্দ আল্লাহকে ভয় করেন এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করেন না। [মুয়াস্সার, ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩৯) ওরা আল্লাহর বাণী প্রচার করত; ওরা তাঁকে ভয় করত এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাকেও ভয় করত না।[1] আর হিসাব গ্রহণে আল্লাহই যথেষ্ট। [2]
[1] যার ফলে কারোর ভয় বা প্রতাপ তাঁদেরকে আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে না বাধা দিতো, আর না কারো মন্তব্য, নিন্দাবাদ, সমালোচনা ইত্যাদির তাঁরা পরোয়া করতেন।
[2] অর্থাৎ, তিনি সর্বত্র তাঁর ইলম ও ক্ষমতা নিয়ে বিদ্যমান, যার ফলে তিনি তাঁর বান্দাদের সাহায্যের জন্য যথেষ্ট এবং আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত-তবলীগে তাঁদের যে সমস্যা আসে তাতে তিনি সাহায্য করেন এবং শত্রুদের নাপাক বাসনা ও সম্মিলিত অসৎ প্রচেষ্টা থেকে তাঁদেরকে রক্ষা করেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী; তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না-এ বিষয়টি আল-কুরআনের এই আয়াত দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
৪০. মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন(১); বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্বকিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
(১) উল্লেখিত আয়াতে সেসব লোকের ধারণা অপনোদন করা হয়েছে যারা বর্বর যুগের প্রথা অনুযায়ী যায়েদ বিন হারেসাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সন্তান বলে মনে করতো এবং তিনি যায়নবকে তালাক দেয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে তার বিয়ে সংঘটিত হওয়ায় তার প্রতি পুত্রবধুকে বিয়ে করেছেন বলে কটাক্ষ করত। এ ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট ছিল যে, যায়েদের পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নন। বরং তার পিতা হারেসা। কিন্তু এ বিষয়টির প্রতি বিশেষ তাকীদ দেয়াচ্ছলে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যকার কোন পুরুষের পিতা নন’। যে ব্যক্তি সন্তান-সন্তুতিদের মধ্যে কোন পুরুষ নেই, তার প্রতি এরূপ কটাক্ষ করা কিভাবে যুক্তিসংগত হতে পারে যে, তার পুত্র রয়েছে এবং তার পরিত্যক্ত স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পুত্রবধূ বলে তার জন্য হারাম হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্ত্রী খাদিজার গর্ভস্থ তিন পুত্র-সন্তান কাসেম, তাইয়্যেব ও তাহের এবং মারিয়ার গর্ভস্থ এক সন্তান ইবরাহীম—মোট চার পুত্র-সন্তান ছিলেন। কিন্তু এরা সবাই শৈশবাবস্থায় মারা যান। [দেখুন: কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর; বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪০) মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নয়,[1] বরং সে আল্লাহর রসূল ও শেষ নবী।[2] আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।
[1] এই জন্য তিনি যায়েদ বিন হারেসা (রাঃ)-এরও পিতা নন, যার ফলে তাঁকে মন্তব্যের নিশানা বানানো যাবে যে, তিনি আপন পুত্রবধূকে কেন বিয়ে করলেন? বরং শুধু যায়েদ কেন তিনি কোন পুরুষেরই পিতা নন। কারণ যায়েদ তো হারেসার পুত্র ছিলেন। নবী (সাঃ) তো তাঁকে শুধু পোষ্যপুত্র বানিয়েছিলেন এবং জাহেলী নিয়মে তাঁকে যায়েদ বিন মুহাম্মাদ বলা হত মাত্র। প্রকৃতপক্ষে তিনি নবী (সাঃ)-এর পুত্র ছিলেন না। যার ফলে (اُدْعُوْهُمْ لآبآئِهم) আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার পর তাঁকে যায়েদ বিন হারেসা নামেই ডাকা হত। এ ছাড়া খাদীজার গর্ভে নবী (সাঃ)-এর তিন ছেলে; ক্বাসেম, ত্বাহের ও ত্বাইয়েব জন্ম নিয়েছিলেন। আর মারিয়া কিবত্বিয়ার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন ইবরাহীম। কিন্তু সকলেই শিশু অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। তাঁরা কেউ পুরুষত্বের বয়স পাননি। সুতরাং নবী (সাঃ)-এর পুত্রদের কেউ পুরুষ হননি; যাঁর তিনি পিতা ছিলেন। (ইবনে কাসীর)
[2] خَاتَمٌ মোহরকে বলা হয়। আর মোহর সর্বশেষ কর্মকে বলা হয়। (যেমন পত্রের শেষে মোহর মারা হয়।) অর্থাৎ নবী (সাঃ) থেকে নবুঅত ও রিসালাতের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর পর যে কেউ নবী হওয়ার দাবী করবে, সে নবী নয়; বরং মিথ্যুক ও দাজ্জাল বলে পরিগণিত হবে। উক্ত বিষয়ে হাদীস গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাতে সকল উম্মত একমত। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ হবে, যা সহীহ ও সূত্রবহুল প্রসিদ্ধ বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। তবে তিনি নবী হয়ে আসবেন না; বরং শেষ নবী (সাঃ)-এর উম্মত হয়ে আসবেন। যার ফলে তাঁর অবতরণ হওয়া ‘খাতমে নবুঅত’-এর আকীদার পরিপন্থী নয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান