২২২১

পরিচ্ছেদঃ ২. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - কিরাআতের ভিন্নতা ও কুরআন সংকলন প্রসঙ্গে

২২২১-[১১] আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযায়ফাহ্ ইবনু ইয়ামান, খলীফা ’উসমান (রাঃ)-এর কাছে মদীনায় এলেন। তখন হুযায়ফাহ্ ইরাকিদের সাথে থেকে আরমীনিয়্যাহ্ (আরমেনিয়া) ও আযরাবীজান (আযারবাইজান) জয় করার জন্য শামবাসীদের (সিরিয়াবাসীদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। এখানে তাদের অমিল কুরআন তিলাওয়াত তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি ’উসমান (রাঃ)-কে বললেন, হে আমীরুল মু’মিনীন! ইয়াহূদী-খৃষ্টানদের মতো আল্লাহর কিতাবে ভিন্নতা আসার আগে আপনি এ জাতিকে রক্ষা করুন। তাই ’উসমান(রাঃ) উম্মুল মু’মিনীন হাফসাহ্’র নিকট রক্ষিত মাসহাফ (কুরআন মাজীদ) তার নিকট পাঠিয়ে দেবার জন্য খবর পাঠালেন। তিনি বললেন, আমরা সেটাকে বিভিন্ন মাসহাফে অনুলিপি করে আবার আপনার নিকট তা পাঠিয়ে দিব। হাফসাহ্(রাঃ) সে সহীফাহ্ ’উসমানের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। ’উসমান(রাঃ) সাহাবী যায়দ ইবনু সাবিত, ’আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র, সা’ঈদ ইবনু ’আস ও ’আবদুল্লাহ ইবনু হারিস ইবনু হিশামকে এ সহীফা কপি করার নির্দেশ দিলেন।

হুকুম মতো তারা এ সহীফার অনেক কপি করে নিলেন। সে সময় ’উসমান কুরায়শী তিন ব্যক্তিকে বলে দিয়েছিলেন, কুরআনের কোন স্থানে যায়দ-এর সাথে আপনাদের মতভেদ হলে তা কুরায়শদের রীতিতে লিখে নিবেন। কারণ কুরআন মূলত তাদের রীতিতেই নাযিল হয়েছে। তারা নির্দেশ মতো কাজ করলেন। সর্বশেষ সমস্ত সহীফাহ্ বিভিন্ন মাসহাফে কপি করে নেবার পর ’উসমান মূল সহীফাহ্ হাফসাহ্’র নিকট ফেরত পাঠালেন। তাদের কপি করা সহীফাহসমূহের এক এক কপি রাজ্যের এক এক এলাকায় পাঠিয়ে দিলেন। এ কপি ছাড়া অন্য সব আগের সহীফায় লিখিত কুরআনকে জ্বালিয়ে ফেলতে নির্দেশ জারী করেছিলেন।

ইবনু শিহাব যুহরী বলেন, যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ) এর ছেলে খারিজাহ্ আমাকে জানিয়েছেন, তিনি তাঁর পিতা যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, আমরা যখন কুরআন নকল করি, সূরা আল আহযাব-এর একটি আয়াত খুঁজে পেলাম না। এ আয়াতটি আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পড়তে শুনেছি। তাই আমরা তা খোঁজ করতে লাগলাম। খুযায়মাহ্ ইবনু সাবিত আল আনসারী-এর নিকট অবশেষে আমরা তা পেলাম। এরপর আমরা তা মাসহাফে সংযোজন করে দিলাম। আর সে আয়াতটি হলো, ’’মিনাল মু’মিনীনা রিজা-লুন সদাকূ মা- ’আ-হাদুল্ল-হা ’আলায়হি’’ (অর্থাৎ- মু’মিনদের মধ্যে কতক লোক আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে)- (সূরা আল আহযাব ৩৩ : ২৩)। (বুখারী)[1]

وَعَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ: أَنَّ حُذَيْفَةَ بْنَ الْيَمَانِ قَدِمَ عَلَى عُثْمَانَ وَكَانَ يُغَازِي أَهْلَ الشَّامِ فِي فَتْحِ أَرْمِينِيَّةَ وَأَذْرَبِيجَانَ مَعَ أَهْلِ الْعِرَاقِ فَأَفْزَعَ حُذَيْفَةَ اخْتِلَافُهُمْ فِي الْقِرَاءَةِ فَقَالَ حُذَيْفَةُ لِعُثْمَانَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ أَدْرِكْ هَذِهِ الْأُمَّةَ قَبْلَ أَنْ يَخْتَلِفُوا فِي الْكِتَابِ اخْتِلَافَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى فَأَرْسَلَ عُثْمَانُ إِلَى حَفْصَةَ أَنْ أَرْسِلِي إِلَيْنَا بِالصُّحُفِ نَنْسَخُهَا فِي الْمَصَاحِفِ ثُمَّ نَرُدُّهَا إِلَيْكِ فَأَرْسَلَتْ بِهَا حَفْصَةُ إِلَى عُثْمَانَ فَأَمَرَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ وَعَبْدَ اللَّهِ بْنَ الزبير وَسَعِيد بن الْعَاصِ وَعبد الرَّحْمَن بْنَ الْحَارِثِ بْنِ هِشَامٍ فَنَسَخُوهَا فِي الْمَصَاحِفِ وَقَالَ عُثْمَانُ لِلرَّهْطِ الْقُرَشِيِّينَ الثَّلَاثِ إِذَا اخْتَلَفْتُمْ فِي شَيْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ فَاكْتُبُوهُ بِلِسَانِ قُرَيْشٍ فَإِنَّمَا نَزَلَ بِلِسَانِهِمْ فَفَعَلُوا حَتَّى إِذَا نَسَخُوا الصُّحُفَ فِي الْمَصَاحِفِ رَدَّ عُثْمَانُ الصُّحُفَ إِلَى حَفْصَةَ وَأَرْسَلَ إِلَى كُلِّ أُفُقٍ بِمُصْحَفٍ مِمَّا نَسَخُوا وَأَمَرَ بِمَا سِوَاهُ مِنَ الْقُرْآنِ فِي كُلِّ صَحِيفَةٍ أَوْ مُصْحَفٍ أَنْ يُحْرَقَ قَالَ ابْن شهَاب وَأَخْبرنِي خَارِجَة بن زيد بن ثَابت سَمِعَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ قَالَ فَقَدْتُ آيَةً مِنَ الْأَحْزَابِ حِينَ نَسَخْنَا الْمُصْحَفَ قَدْ كُنْتُ أَسْمَعُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْرَأُ بِهَا فَالْتَمَسْنَاهَا فَوَجَدْنَاهَا مَعَ خُزَيْمَةَ بْنِ ثَابِتٍ الْأَنْصَارِيِّ (مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا الله عَلَيْهِ)
فَأَلْحَقْنَاهَا فِي سُورَتِهَا فِي الْمُصْحَفِ. رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ

وعن انس بن مالك ان حذيفة بن اليمان قدم على عثمان وكان يغازي اهل الشام في فتح ارمينية واذربيجان مع اهل العراق فافزع حذيفة اختلافهم في القراءة فقال حذيفة لعثمان يا امير المومنين ادرك هذه الامة قبل ان يختلفوا في الكتاب اختلاف اليهود والنصارى فارسل عثمان الى حفصة ان ارسلي الينا بالصحف ننسخها في المصاحف ثم نردها اليك فارسلت بها حفصة الى عثمان فامر زيد بن ثابت وعبد الله بن الزبير وسعيد بن العاص وعبد الرحمن بن الحارث بن هشام فنسخوها في المصاحف وقال عثمان للرهط القرشيين الثلاث اذا اختلفتم في شيء من القران فاكتبوه بلسان قريش فانما نزل بلسانهم ففعلوا حتى اذا نسخوا الصحف في المصاحف رد عثمان الصحف الى حفصة وارسل الى كل افق بمصحف مما نسخوا وامر بما سواه من القران في كل صحيفة او مصحف ان يحرق قال ابن شهاب واخبرني خارجة بن زيد بن ثابت سمع زيد بن ثابت قال فقدت اية من الاحزاب حين نسخنا المصحف قد كنت اسمع رسول الله صلى الله عليه وسلم يقرا بها فالتمسناها فوجدناها مع خزيمة بن ثابت الانصاري من المومنين رجال صدقوا ما عاهدوا الله عليهفالحقناها في سورتها في المصحف رواه البخاري

ব্যাখ্যা: হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেন, ‘উসমান (রাঃ) এর শাসনামলে আরমেনিয়া ও আযারবায়জান যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে সিরিয়া ও ইরাক্বের অধিবাসী অংশগ্রহণ করেছিল। ‘উসমান (রাঃ) ইরাকবাসীর আমীর হিসেবে সালমান বিন রবী‘আহ্ আল বাহিলীকে এবং সিরিয়াবাসীর আমীর হিসেবে হাবীব বিন মাসলামাহ্ আল ফিহরী-কে নিযুক্ত করেন।

রশাত্বীয়ু (রহঃ) বলেন, আরমেনিয়ার যুদ্ধ ‘উসমান (রাঃ)-এর খিলাফাতে ২৪ হিজরীতে সালমান বিন রবী‘আহ্-এর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়।

ইবনুল ‘আরাবী (রহঃ) বলেন, আযারবায়জান আরমেনিয়ার পাশের এলাকা। এ দু’টি যুদ্ধ একই বছরে সংঘটিত হয়েছিল। এ যুদ্ধে ইরাকবাসী ও সিরিয়াবাসী ভিন্ন ভিন্নভাবে কুরআন তিলাওয়াত করত। কোন বর্ণনায় এসেছে, ইরাকবাসী ‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ (রাঃ)-এর কিরাআতে তিলাওয়াত করতেন। আর সিরিয়াবাসী উবাই বিন কা‘ব (রাঃ)-এর নিয়মানুসারে তিলাওয়াত করতো। এতে তাদের মাঝে যেন এক ধরনের ফিতনা শুরু হয়েছিল। ফলে তারা পরস্পরের তিলাওয়াতকে অস্বীকার করে বসত। একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, তারা উভয়ে وَأَتِمُّوا الْحَجَّ وَالْعُمْرَةَ لِلهِ [البقرة: 196] আয়াতকে নিয়ে মতানৈক্য করে। তাদের কেউ বলে وأتموا الحج والعمرة للبيت পড়লে হুযায়ফাহ্ রাগান্বিত হলেন। এমনকি তার চোখ লাল হয়ে গেল। তিনি বলেন, যদি আমি আমিরুল মু’মিনীনের নিকট যাই তবে আমি তাকে কুরআনকে একই কিরাআতের উপর একত্রিত করার জন্য অনুরোধ করব। কেননা এর দ্বারা কুরআন নিয়ে ইয়াহূদী নাসারাদের মতো এই উম্মাতগণ মতভেদে জড়িয়ে পড়বে। তাই ‘উসমান (রাঃ) হুযায়ফাহ্ (রাঃ)-এর অনুরোধ হাফসাহ্ বিনতু ‘উমার-এর নিকট আবূ বাকর-এর সংকলিত মাসহাফটি চেয়ে পাঠান। এরপর আনসারী সাহাবী যায়দ বিন সাবিত এবং কুরায়শ সাহাবী ‘আবদুল্লাহ বিন যুবায়র, সা‘ঈদ বিন ‘আস-কে দিয়ে লিখিয়ে নেন। কারণ যায়দ ছিলেন শ্রেষ্ঠ লেখক ও সা‘ঈদ ছিলেন স্পষ্টভাষী।

হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ) বলেন, ১২ জন সংকলকের মধ্যে ৯ জনকে আমরা চিনতাম। যাদের মধ্যে সূচনা হয়েছিল যায়দ ও সা‘ঈদ এর মাধ্যমে দিয়ে।

‘উসমান (রাঃ) তাদেরকে কুরায়শদের ভাষায় কুরআনকে লিখতে বলেন কুরায়শের সম্মান প্রকাশের জন্য। কারণ আল্লাহ বলেছেন, إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآنًا عَرَبِيًّا ‘‘আমি ওটাকে (কুরআনকে) করেছি ‘আরাবী ভাষায়’’- (সূরা আয্ যুখরুফ ৪৩ : ৩)। ‘আরাবী ভাষা অনেক গোত্রের রয়েছে, যেমন কুরায়শ, মুযার, রবী‘আহ্ ইত্যাদি। তাই কোন গোত্রের সাথে নির্দিষ্ট করতে স্পষ্ট দলীলের দরকার হয়। অন্যথায় নির্দিষ্ট ভাবে বলা যাবে না। এ ব্যাখ্যাটি করেছেন কাযী আবূ বাকর ইবনু আল বাকিলানী।

আবূ শামাহ (রহঃ) বলেন, ‘উসমান কুরায়শ বংশের সাথে নির্দিষ্ট করার কারণ হলো সর্বপ্রথম কুরআন কুরায়শদের ভাষায় নাযিল হয়। এরপর সহজতর জন্য বা পড়ার সুবিধার জন্য সাত পদ্ধতিতে নাযিল হয়। যখন কুরআনকে একটি ভাষায় একত্রিত করলেন তখন এটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সাত রীতির মধ্যে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরায়শ বংশের ভাষা উত্তম। ফলে মানুষ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষা হওয়ায় আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে। আসলে আবূ বাকর (রাঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল কুরআনকে সমস্ত শারী‘আত সম্মত রীতিতে সংকলন করা। আর ‘উসমানের কুরায়শের ভাষায় কুরআনকে সংকলন করার উদ্দেশ্য ছিল কুরআনের ব্যাপারে মানুষের মতভেদের রাস্তাকে বন্ধ করে দেয়া।

‘উসমান (রাঃ) হাফসাহ্’র নিকট থেকে প্রাপ্ত কপিগুলো থেকে লিখার পর আবার তার নিকটে ফেরত পাঠান এবং লিখিত পাণ্ডুলিপি ছাড়া অন্য সব পাণ্ডুলিপিকে পোড়ানোর নির্দেশ দেন। ইবনুল বাত্বাল (রহঃ) এ হাদীসকে লক্ষ্য করে বলেন, আল্লাহর নাম উল্লেখ আছে এমন বই-পত্র আগুনে পুড়িয়ে দেয়া জায়িয। এটাই হচ্ছে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং মানুষের পায়ে পদদলিত হওয়া থেকে রক্ষার উপায়।

ইবনু ‘আতিয়্যাহ্ বলেন, পাণ্ডুলিপি পুড়ানো সেই সময়ে প্রযোজ্য ছিল। তবে এখন প্রয়োজন হলে সেগুলোকে ধৌত করা উত্তম। হানাফীগণ বলেন, কোন কুরআনের মাসহাফ পুরাতন হওয়ার কারণে উপকৃত না হওয়া গেলে মানব চলাচলের রাস্তা থেকে দূরের কোন পবিত্র স্থানে পুঁতে দেয়া জায়িয। কারী বলেন, পুরাতন পাণ্ডুলিপি ধৌত করে পানিগুলোকে পান করতে হবে।

তিরমিযীর ব্যাখ্যাকার আমাদের বিজ্ঞ-পণ্ডিত ‘আল্লামা ‘আয়নী (রহঃ)-এর কথা নকল করে বলেন, যদি চিন্তা করা যায় তবে পুড়ানোই সর্বোত্তম পথ বলে মনে হবে। তাই ‘উসমান (রাঃ) পুড়িয়েছেন। তিনি আরো বলেন, পাণ্ডুলিপিকে ধৌত করা অসম্ভব। তাই এটা স্পষ্ট বিবেকবিরোধী মত।

আবূ বাকর (রাঃ)-এর যুগে সংকলনের সময়ে সূরা তাওবার দু’টি আয়াত পাওয়া যাচ্ছিল না। যা খুযায়মাহ্ বিন সাবিত-এর নিকটে পাওয়া গেল। আর ‘উসমানের এর যুগে সূরা আহযাব-এর একটি আয়াত পাওয়া যাচ্ছিল না। এরূপ মত ব্যক্ত করেছেন হাফেয ইবনু হাজার আসকালানী (রহঃ)। তিনি আরো বলেন, উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, যায়দ বিন সাবিত কুরআন সংকলনের জন্য শুধু জানা বা মুখস্থ থাকার উপর নির্ভর করেননি বরং তিনি তাদের নিকট লিখা আছে কিনা লক্ষ্য করতেন।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৮: কুরআনের মর্যাদা (كتاب فضائل القراٰن)