রাহে বেলায়াত দ্বিতীয় অধ্যায় - বেলায়াতের পথে যিকরের সাথে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
চ. আত্মশুদ্ধিমূলক মানসিক ও দৈহিক কর্ম - (১) জাগতিক জীবনের অস্থায়িত্ব স্মরণ

কুরআন-হাদীসের আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, কিছু মানসিক বা দৈহিক কর্ম আছে যা অতি সহজে আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য, সাওয়াব, রহমত ও বরকত লাভে সাহায্য করে। এ সকল কর্ম পালন করতে পারলে যাকির অতি অল্প আমলে অধিক সাওয়াব অর্জন করতে পারেন। আমাদের উচিত এগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখা।


(১) জাগতিক জীবনের অস্থায়িত্ব স্মরণ

মানব জীবনে জাগতিক, সাংসারিক কর্মকান্ড, ব্যস্ততা ও চিন্তাভাবনা থাকবেই। আল্লাহ মানুষকে এসকল কর্মকান্ডে জড়িত থাকার জন্যই সৃষ্টি করেছেন। তবে এই ব্যস্ততা ও কর্ম নিজের, পরিবারের ও সমাজের সকলের পৃথিবীতে সুন্দররূপে বাঁচার ও পারলৌকিক জীবনে মুক্তি ও আল্লাহর সানিধ্যে অফুরন্ত নিয়ামত লাভের জন্য। কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর অফুরন্ত নিয়ামত ও বরকত অর্জন করে নিজে বাঁচতে হবে এবং অন্যকে বাঁচতে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনা ও মানবীয় দুর্বলতার কারণে আমরা সৃষ্টি ও কর্মের উদ্দেশ্যের একেবারে বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করি। আমরা স্বার্থপর হয়ে যাই এবং নিজের অপ্রয়োজনীয় ও অবৈধ স্বার্থরক্ষার জন্য অন্যান্যদের অকল্যাণ, ক্ষতি বা ধ্বংস কামনা করি বা সে জন্য চেষ্টা করি। এভাবে আমরা মূলত নিজেদেরকেও ধ্বংস করি। লোভ, লালসা, হিংসা, হানাহানি আমাদের হৃদয় ও জীবনকে বিষাক্ত ও কলুষিত করে, আমাদেরকে স্রষ্টার প্রেম, করুণা ও বরকত থেকে বঞ্চিত করে, তাঁর শাস্তির মধ্যে নিপতিত করে এবং সর্বোপরি আমাদের পারলৌকিক জীবনের কঠিন ধ্বংস ও ক্ষতি নিশ্চিত করে।


এই ক্ষতিকর পরিণতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য যুগে যুগে অনেক মানুষ সন্যাস, বৈরাগ্য বা সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবন বেছে নিয়েছেন। এভাবে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাহত করেছেন। ইসলামে বৈরাগ্য বা সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবন নিষিদ্ধ। সমাজের মধ্যে বসবাস করে, সকল কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজের হৃদয়কে মোহমুক্ত রাখায় ইসলামী বৈরাগ্য। আর এই অবস্থা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম প্রতিনিয়ত এই জাগতিক জীবনের অস্থায়িত্ব, মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা নিজেকে স্মরণ করানো। কুরআন ও হাদীসে এজন্য বারবার মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই পৃথিবীতে নিজেকে প্রবাসী বা পথিক হিসাবে গণ্য করতে বলা হয়েছে। এই স্মরণ আমাদের জন্য অগণিত সাওয়াব অর্জনের পাশাপাশি আমাদের হৃদয়গুলিকে লোভ, হিংসা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির কঠিন ভার থেকে মুক্ত করবে। আমাদের জীবনকে হানাহানি ও হিংস্রতা থেকে মুক্ত করবে।


দিনের বিভিন্ন অবসরে ও বিশেষ করে সকালে, সন্ধ্যা বা রাতে নির্ধারিত সময়ে নিজেকে স্মরণ করান : যে মানুষের পরবর্তী নিশ্বাসের নিশ্চয়তা নেই সে কী জন্য হানাহানিতে লিপ্ত হবে? কিজন্য সে লোভ করবে। সেতো পথিক। চলার পথের প্রয়োজনীয় কাজগুলি সম্পন্ন করা ও পাথেয় সংগ্রহই তো তার কাজ। চলার পথে যদি কেউ কষ্ট দেয় তাকে সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিই না কেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই তো তাকে আর দেখব না। রাস্তায়, ফেরীতে, রেলস্টেশনে বা এয়ারপোর্টে বসার চেয়ার, ট্রলি, খাবারের পেলট, সামান্য ধাক্কাধাক্কির জন্য কি আমরা সময় নষ্ট করে মারামারিতে লিপ্ত হই? এই জীবন তো এ সকল অস্থায়ী স্থানেরই একটু বিস্তৃত রূপ। চেষ্টা করি না কেন এই ক্ষণস্থায়ী জীবনকে ক্ষমা, ভালবাসা ও সেবায় ভরে দিতে। তাতে জীবন হবে আল্লাহর রহমতে ধন্য আর আমি অর্জন করব আখেরাতের অমূল্য পাথেয়।

পার্থিব স্বার্থপরতা বা লোভের জন্য প্রভুর নির্দেশনার বাইরে কাজ করছি? কি লাভ হবে তাতে? সে লাভ কি ভোগ করতে পারব? পারলে কতদিন। তারপর তো আমাকে প্রভুর কাছেই ফিরে যেতে হবে। অমুকের খুশির জন্য, তমুকের কাছে বড় হওয়ার জন্য, আরেকজনের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য আমি এই কাজটি করতে চাচ্ছি। কি লাভ তাতে? সে আমাকে কী দেবে? যা দেবে তা থেকে কি আমি লাভবান হতে পারব? আমাকে তো আমার প্রভুর কাছে একাকীই চলে যেতে হবে। আমার তো বাস্তব্বাদী হওয়া উচিত। নিজের জাগতিক ও পরকালীন জীবনের জন্য যে কাজে আমার রব খুশি সেই কাজই তো আমার করা উচিত।


সুপ্রিয় পাঠক, এভাবে আমাদের উচিত প্রতিদিন নিজেদের সকল কর্ম বিচার করা। ক্ষণস্থায়ী প্রবাসের জন্য ও চিরস্থায়ী আবাসের জন্য যা প্রয়োজনীয় সেগুলিই করা। এ চিন্তা আমাদেরকে উপরে বর্ণিত ক্ষমাময় ও হিংসাহীন হৃদয় অর্জনেও সাহায্য করবে। এই চিন্তাগুলি বেলায়াত ও ইহসানের পথে আমাদের মহামূল্য পাথেয়।