হজের ফরযসমূহ :

১. ইহরাম তথা হজের নিয়ত করা। যে ব্যক্তি হজের নিয়ত করবে না তার হজ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى».

‘নিশ্চয় আমলসমূহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেকের জন্য তাই হবে, যা সে নিয়ত করে।’[1]

২. উকূফে আরাফা বা আরাফায় অবস্থান।[2] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«الْحَجُّ عَرَفَةُ».

‘হজ হচ্ছে আরাফা’[3]

৩. তাওয়াফে ইফাযা বা তাওয়াফে যিয়ারা (বাইতুল্লাহ্‌র ফরয তাওয়াফ)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

«وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ»

‘আর তারা যেন প্রাচীন ঘরের[4] তাওয়াফ করে।’[5]

সাফিয়্যা রা. যখন ঋতুবতী হলেন, তখন নবীজী বললেন, ‘সে কি আমাদেরকে আটকিয়ে রাখবে?। আয়েশা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে তো ইফাযা অর্থাৎ বায়তুল্লাহ্‌র তাওয়াফ করেছে। তাওয়াফে ইফাযার পর সে ঋতুবতী হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে এখন যাত্রা কর।[6] এ থেকে বুঝা যায়, তাওয়াফে ইফাযা ফরয।

৪. সাফা ও মারওয়ায় সাঈ করা।[7] অধিকাংশ সাহাবী, তাবিঈ ও ইমামের মতে এটা ফরয।[8] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«اسْعَوْا فَإِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَيْكُمُ السَّعْي».

‘তোমরা সাঈ কর, কেননা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর সাঈ ফরয করেছেন।’[9] আয়েশা রা. বলেন,

فَلَعَمْرِى مَا أَتَمَّ اللَّهُ حَجَّ مَنْ لَمْ يَطُفْ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ.

‘আমার জীবনের কসম! আল্লাহ কখনো সে ব্যক্তির হজ পরিপূর্ণ করবেন না যে সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করে না।’[10]

মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি কোন একটি ফরয ছেড়ে দেবে, তার হজ হবে না।

হজের ওয়াজিবসমূহ :

১. মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ মীকাত অতিক্রমের আগেই ইহরাম বাঁধা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীকাতগুলো নির্ধারণ করার সময় বলেন,

«هُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ لِمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَة».

‘এগুলো তাদের জন্য এবং যারা অন্যত্র থেকে ওই পথে আসে হজ ও উমরা আদায়ের ইচ্ছা নিয়ে তাদের জন্যও।’[11]

২. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা।

যে ব্যক্তি আরাফার ময়দানে দিনে উকূফ করবে, তার ওপর ওয়াজিব হচ্ছে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানে দিনে উকূফ করেছেন এবং সূর্যাস্ত পর্যস্ত সেখানে অবস্থান করেছেন। মিসওয়ার ইবন মাখরামা রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফায় আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা করার সময় বললেন, মুশরিক ও পৌত্তলিকরা সূর্যাস্তের সময় এখান থেকে প্রস্থান করত, যখন সূর্য পাহাড়ের মাথায় পুরুষের মাথায় পাগড়ির মতই অবস্থান করত। অতএব আমাদের আদর্শ তাদের আদর্শ থেকে ভিন্ন’।[12] সুতরাং সূর্যাস্তের পর আরাফা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্থান মুশরিকদের আচারের সাথে ভিন্নতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই ছিল।

৩. মুযদালিফায় রাত যাপন।

ক. কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় রাত যাপন করেছেন এবং বলেছেন,

«لِتَأْخُذْ أُمَّتِي نُسُكَهَا ، فَإِنِّي لاَ أَدْرِي لَعَلِّي لاَ أَلْقَاهُمْ بَعْدَ عَامِي هَذَا».

‘আমার উম্মত যেন হজের বিধান শিখে নেয়। কারণ আমি জানি না, এ বছরের পর সম্ভবত তাদের সাথে আমার আর সাক্ষাত হবে না।’

খ. তিনি অর্ধরাতের পর দুর্বলদেরকে মুযদালিফা প্রস্থানের অনুমতি দিয়েছেন। এ থেকে বুঝা যায়, মুযদালিফায় রাত যাপন ওয়াজিব। কারণ অনুমতি তখনই প্রয়োজন হয় যখন বিষয়টি গুরুত্বের দাবী রাখে।

গ. আল্লাহ তা‘আলা মাশ‘আরে হারামের নিকট তাঁর যিকর করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ [البقرة: ١٩٨]

‘সুতরাং যখন তোমরা আরাফা থেকে বের হয়ে আসবে, তখন মাশ‘আরে হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ কর।’[13]

৪. তাশরীকের রাতগুলো মিনায় যাপন।

১০ তারিখ দিবাগত রাত ও ১১ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় যাপন করতে হবে। ১২ তারিখ যদি মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে যায় তাহলে ১২ তারিখ দিবাগত রাতও মিনায় যাপন করতে হবে। ১৩ তারিখ কঙ্কর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করতে হবে।

আয়েশা রা. বলেন,

أَفَاضَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ آخِرِ يَوْمِهِ حِينَ صَلَّى الظُّهْرَ ثُمَّ رَجَعَ إِلَى مِنًى فَمَكَثَ بِهَا لَيَالِىَ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সালাত মসজিদুল হারামে আদায় ও তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করে মিনায় ফিরে এসেছেন এবং তাশরীকের রাতগুলো মিনায় কাটিয়েছেন।’[14]

হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করানোর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিনার রাতগুলো মক্কাতে যাপনের অনুমতি দিয়েছেন এবং উটের দায়িত্বশীলদেরকে মিনার বাইরে রাতযাপনের অনুমতি দিয়েছেন। এই অনুমতি প্রদান থেকে প্রতীয়মান হয়, মিনার রাতগুলোতে মিনাতে যাপন করা ওয়াজিব।

৫. জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা।

১০ যিলহজ জামরাতুল আকাবায় (বড় জমারায়) কঙ্কর নিক্ষেপ করা। তাশরীকের দিনসমূহ যথা, ১২, ১২ এবং যারা ১৩ তারিখ মিনায় থাকবেন, তাদের জন্য ১৩ তারিখেও। যথাক্রমে ছোট, মধ্য ও বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন। জাবের রা. বলেন,

رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَرْمِى عَلَى رَاحِلَتِهِ يَوْمَ النَّحْرِ وَيَقُولُ «لِتَأْخُذُوا مَنَاسِكَكُمْ فَإِنِّى لاَ أَدْرِى لَعَلِّى لاَ أَحُجُّ بَعْدَ حَجَّتِى هَذِهِ ».

‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি কুরবানীর দিন তিনি তাঁর বাহনের ওপর বসে কঙ্কর নিক্ষেপ করছেন এবং বলেছেন, তোমরা তোমাদের হজের বিধান জেনে নাও। কারণ আমি জানি না, সম্ভবত আমার এ হজের পর আমি আর হজ করতে পারব না।’[15]

৬. মাথা মুন্ডান বা চুল ছোট করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করার আদেশ দিয়ে বলেন, وَلْيُقْصِرْ ، وَلْيُحِلل অর্থাৎ সে যেন মাথার চুল ছোট করে এবং হালাল হয়ে যায়।[16] আর তিনি মাথা মুণ্ডনকারিদের জন্য তিনবার মাগফিরাতের দো‘আ করেছেন এবং চুল ছোটকারিদের জন্য একবার মাগফিরাতের দো‘আ করেছেন।

৭. বিদায়ী তাওয়াফ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়ী তাওয়াফের আদেশ দিয়ে বলেন,

«لاَ يَنْفِرَنَّ أَحَدٌ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ بِالْبَيْت».

‘বাইতুল্লাহ্‌র সাথে তার শেষ সাক্ষাত না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন না যায়।’[17]

ইবন আব্বাস রা. বলেন,

أُمِرَ النَّاسُ أَنْ يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِمْ بِالْبَيْتِ إِلاَّ أَنَّهُ خُفِّفَ عَنِ الْمَرْأَةِ الْحَائِضِ.

‘লোকদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদের শেষ কাজ যেন হয় বাইতুল্লাহ্‌র সাক্ষাত। তবে তিনি ঋতুবতী মহিলার জন্য ছাড় দিয়েছেন।’[18]

উল্লেখ্য, যে এসবের একটিও ছেড়ে দেবে, তার ওপর দম ওয়াজিব হবে অর্থাৎ একটি পশু যবেহ করতে হবে।

ইবন আব্বাস রা. বলেন,

مَنْ نَسِىَ شَيْئًا مِنْ نُسُكِهِ أَوْ تَرَكَهُ فَلْيُهْرِقْ دَمًا.

‘যে ব্যক্তি তার হজের কোন কাজ করতে ভুলে যায় অথবা ছেড়ে দেয় সে যেন একটি পশু যবেহ করে।’[19]

[1]. বুখারী : ১।

[2]. হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম আ. এর আদর্শের অনুকরণ করেছেন। তিনি মুশরিকদের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে বলছেন, ‘هَدْيُنَا مُخَالِفٌ لِهَدْيِهِمْ ‘আমাদের আদর্শ তাদের আদর্শ থেকে ভিন্ন’। সুতরাং তিনি মুসলমানদেরকে নিয়ে আরাফার ময়দানে অবস্থান করলেন এবং এ-ক্ষেত্রেও কুরাইশদের বিপরীত করলেন। কেননা কুরাইশরা মুযদালিফা অতিক্রম করত না; বরং মুযদালিফাতেই অবস্থান করত এবং বলত, আমরা হারাম এলাকা ছাড়া অন্য জায়গা থেকে প্রস্থান করব না। উল্লেখ্য, আরাফা হারামের সীমারেখার বাইরে। (বায়হাকী : আস-সুনানুল-কুবরা : ৫/১২৫)।

[3]. এরওয়াউল গালীল। ৪/২৫৬।

[4] الْبَيْتِ الْعَتِيق বা পুরাতন ঘর বলতে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য তৈরিকৃত সবচাইতে পুরাতন ঘর তথা কা‘বা ঘরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ ইবাদাতের জন্য নির্মিত এটাই যমীনের বুকে সর্বপ্রথম ঘর।

[5]. হজ : ২৯।

[6]. বুখারী : ৪২৮।

[7]. জাহেলী যুগে আনসারদের কিছু লোক মূর্তির উদ্দেশে হজ পালন করত এবং মনে করত যে, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করা বৈধ নয়। তাঁরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ করতে আসল, তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থাপন করল। তিনি বললেন, ‘সাঈ কর, কেননা আল্লাহ তোমাদের ওপর সাঈ ফরয করেছেন।’ (বিস্তারিত দেখুন বুখারী : ১৬৪৩ )

[8]. ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতে এটি ওয়াজিব।

[9]. মুসনাদে আহমদ : ৪২১।

[10]. মুসলিম : ৯২৮।

[11]. বুখারী : ১৫২৪; মুসলিম : ১১৮১।

[12]. বায়হাকী, আস-সুনানুল-কুবরা : ৫/১২৫।

[13]. বাকারা : ১৯৮।

[14]. আবূ দাউদ: ১৬৮৩।

[15]. মুসলিম : ১২৯৭; আবূ দাউদ : ১৯৭০।

[16]. বুখারী : ১৬৯১; মুসলিম : ১২২৭।

[17]. মুসলিম : ২৩৫০।

[18]. মুসলিম : ২৩৫১।

[19]. মুআত্তা মালেক : ৮৯০; দারাকুতনী : ২/২৪৪।