আর-রাহীকুল মাখতূম মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ (غَزْوَةُ فَتْحِ مَكَّةَ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
সঙ্গোপণে যুদ্ধ প্রস্তুতি (التَّهِيؤُ لِلْغَزْوَةِ وَمُحَاوَلَةِ الْإِخْفَاءِ):

ইমাম তাবারানীর বর্ণনা সূত্রে জানা যায় যে, অঙ্গীকার ভঙ্গের তিন দিন পূর্বেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আয়িশাহ (রাঃ)-কে সফরের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় প্রস্তুতি সঙ্গোপনে সম্পন্ন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। কিন্তু এ খবর কেউ জানতেন না। আয়িশাহ (রাঃ) যখন প্রস্তুতি পর্বে ব্যাপৃত ছিলেন তখন আবূ বাকর (রাঃ) সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘কন্যা! এ কিসের প্রস্তুতি?’

উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না।’

আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘এ তো বনু আসফার অর্থাৎ রোমকদের সাথে যুদ্ধের সময় নয়। তাহলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইচ্ছা আবার কোন দিকের? আয়িশাহ বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার জানা নেই।’

তৃতীয় দিবসে প্রত্যুষে ‘আমর বিন সালিম খুযা’য়ী ৪০ জন ঘোড়সওয়ার সহ মদীনায় এসে উপস্থিত হলেন এবং পূর্বেকার কবিতাটি পড়লেন, ........ শেষ পর্যন্ত। তখন সাধারণ লোকেরা জানতে পারলেন যে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা হয়েছে। এরপর এল বুদাইল। অতঃপর আবূ সুফইয়ান এল। অবস্থার প্রেক্ষাপটে জনগণ পরিস্থিতির প্রকৃতি অনুধাবন করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে বললেন, ‘মক্কা যেতে হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ প্রার্থনাও করলেন যে, ‏(‏اللّٰهُمَّ خُذِ الْعُيُوْنَ وَالْأَخْبَارَ عَنْ قُرَيْشٍ حَتّٰى نَبَغْتُهَا فِيْ بِلاَدِهَا‏)‏‏ ‘হে আল্লাহ! গোয়েন্দাদের এবং কুরাইশদের নিকট এ সংবাদ পৌঁছতে বাধার সৃষ্টি কর এবং থামিয়ে দাও যাতে আমরা তাদের অজানতেই একেবারে তাদের মাথার উপর গিয়ে পৌঁছতে পারি।’

অতঃপর অত্যন্ত সঙ্গোপনে উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে ৮ম হিজরী রমাযান মাসের প্রথম ভাগে আবূ ক্বাতাদাহ বিন রিব’য়ী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে আট জন মুজাহিদ সমন্বয়ে গঠিত একটি ছোট বাহিনীকে বাতনে আযমের দিকে প্রেরণ করেন। এ স্থানটি যী খাশাব এবং যিল মারওয়াহর মধ্যস্থলে মদীনা হতে প্রায় ৩৬ আরবী মাইল দূরত্বে অবস্থিত। উদ্দেশ্য ছিল এ অভিযান প্রত্যক্ষ করে সাধারণ মানুষ যেন ধারণা করে যে, নাবী কারীম (ﷺ) এ অঞ্চল অভিমুখে যাত্রা করবেন এবং শেষ পর্যন্ত খবরটি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু এ দলটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন তখন তাঁরা জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। অতঃপর তাঁরাও গিয়ে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে মিলিত হলেন।[1]

এদিকে হাতিব বিন আবী বালতাআ’হ কুরাইশের নিকট এক পত্র লিখে এ সংবাদ প্রেরণ করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা আক্রমণ করতে যাচ্ছেন। বিনিময় প্রদানের প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে তিনি এক মহিলার মাধ্যমে পত্রটি প্রেরণ করেন। মহিলা তাঁর চুলের খোঁপার মধ্যে পত্রটি রেখে পথ চলছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আসমান হতে ওহীর মাধ্যমে হাতেবের এ গতিভঙ্গী ও ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কে অবহিত হলেন। এ প্রেক্ষিতে তিনি আলী (রাঃ), মিক্বদাদ (রাঃ), যুবাইর এবং আবূ মারসাদ গানাভী (রাঃ)-কে এ বলে প্রেরণ করলেন যে, ‘তোমরা ‘খাখ’ নামক উদ্যানে গিয়ে সেখানে একটি হাওদানশীন মহিলাকে দেখতে পাবে, সে পত্রটি তার কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে। উল্লেখিত সাহাবীগণ ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মহিলার নাগাল পাওয়ার জন্য ছুটে চললেন। তাঁদের অগ্রাভিযানের এক পর্যায়ে তাঁরা উটের পিঠে আরোহণকারিণী মহিলাটির নাগাল পেলেন। তাঁরা তাঁকে উটের পিঠ থেকে অবতরণ করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তার কাছে কোন পত্র আছে কিনা। কিন্তু সে তার নিকট পত্র থাকার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। তার উটের হাওদা তল্লাশী করেও তাঁরা কোন পত্র না পাওয়ায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অবশেষে আলী (রাঃ) বললেন, ‘আমি আল্লাহর কসম করে বলছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিথ্যা বলেন নি, কিংবা আমরাও মিথ্যা বলছিনা। হয় তুমি পত্রখানা বাহির করে দেবে, নতুবা আমরা তোমাকে একদম উলঙ্গ করে তল্লাশী চালাব। সে যখন তাদের দৃঢ়তা অনুধাবন করল, তখন বলল, ‘আচ্ছা তাহলে তোমরা অন্য দিকে মুখ ফিরাও।’ অন্য দিকে মুখ ফেরালে মহিলা তার খোঁপা থেকে পত্রখানা বের করে তাঁদের নিকট সমর্পণ করল। তাঁরা পত্রখানা নিয়ে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট গিয়ে পৌঁছল। পত্রখানা খুলে পড়া হল। তাতে লেখা ছিল,

হাতিব বিন বালতাআ’হর পক্ষ হতে কুরাইশদের প্রতি, অতঃপর কুরাইশগণকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ দেয়া হয়েছিল।[2]

নাবী কারীম (ﷺ) হাতিবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন তুমি এহেন গুরুতর কাজ করেছ?

তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এ ব্যাপারে আমার বিরুদ্ধে তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন না। আল্লাহর কসম! আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে। আমি স্বধর্মত্যাগী হই নি এবং আমার মধ্যে কোন পরিবর্তনও আসেনি। কুরাইশদের সঙ্গে আমার কোন রক্তের সম্পর্কও নেই। তবে কথা হচ্ছে, কোন ব্যাপারে আমি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম এবং আমার পরিবারের সদস্য এবং সন্তান-সন্ততিরা সেখানেই আছে। তাদের সঙ্গে আমার এমন কোন আত্মীয়তা বা সম্পর্ক নেই যে, তারা আমার পরিবারের লোকজনদের দেখাশোনা করবে। পক্ষান্তরে আপনার সঙ্গে যাঁরা রয়েছেন মক্কায় তাঁদের সকলেরই আত্মীয় স্বজন রয়েছে। যাঁরা তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। যদিও সম্পূর্ণ বেআইনী ও অধিকার বহির্ভূত তবুও ঐ একই উদ্দেশ্যের প্রেক্ষাপটে আমি কুরাইশদের জন্য একটু এহসানি করতে চেয়েছিলাম যার বিনিময়ে তারা আমার আত্মীয় স্বজনদের প্রতি যত্নশীল হবে।

এ কথাবার্তার প্রেক্ষিতে উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন আমি তার গ্রীবা কর্তন করে ফেলি। কারণ, সে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং সে মুনাফিক্ব হয়ে গিয়েছে। রাসূলে কারীম (ﷺ) তখন বললেন,

‏(‏إِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْراً، وَمَا يُدْرِيْكَ يَا عُمَرُ لَعَلَّ اللهُ قَدْ اِطَّلَعَ عَلٰى أَهْلِ بَدْرٍ فَقَالَ‏:‏ اِعْمَلُوْا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ‏)

‘হে উমার! তুমি কি জান না যে, সে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। আর হতে পারে আল্লাহ তা‘আল্লাহ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সামনে প্রকাশিত হয়ে বলে দিয়েছেন যে, ‘তোমরা যা চাও তা কর, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি।’

এ কথা শ্রবণ করে উমার (রাঃ)-এর চক্ষুদ্বয় অশ্রু সজল হয়ে উঠল। অতঃপর বললেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) ভাল জানেন।[3]

এভাবে আল্লাহ তা‘আলা গোয়েন্দাদের গ্রেফতার করিয়ে দেন এবং মুসলিমগণের যুদ্ধ প্রস্তুতি সংক্রান্ত কোন খবর কুরাইশদের নিকট পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দেন।

[1] এটা ওই বাহিনী যাদের সঙ্গে আমর বিন আহবতের দেখা হলে সে ইসলামী ক্বায়দায় সালাম করে। কিন্তু মোহাল্লাম বিন জোসামা পুর্বের ক্রোধের কারণে তাকে হত্যা করেন এবং তার্ উট ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিজ দখলে নিয়ে নেন। এ প্রেক্ষিতে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘ওয়ালা তাকুলু লিমান আলকা ইলাই কুমুস সালা মা লাসতা মু’মিনা’... শেষ পর্যন্ত।

অর্থ: যিনি তোমাদের প্রতি সালাম করেন তাকে তুমি ‘মুমিন নও’ বোলনা। আয়ত নাজিল হওয়ার কারণে সাহাবা কেরাম মোহাল্লামকে নাবী (সাঃ)-এর দরবারে নিয়ে আসলেন এ হেতু যে, নাবী (সাঃ) তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। কিন্তু মোহাল্লাম যখন নাবী (সাঃ)-এর খিদমতে উপস্থিত হলেন তখন তিনি তিন বার বললেন, ‘হে আল্লাহ মোহাল্লামকে ক্ষমা কর না।’ এ কথা শুনে মোহল্লাম নিজ কাপড়ের অাঁচলে অশ্রু মুছতে মুছতে সেখান থেকে্ উঠে গেলেন। ইবনু ইসাহাকের বর্ণনা থেকে জানা যায়, তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছেন যে, পরে আল্লাহর নাবী (সাঃ) তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যাদুল মা’আদ ২য় খন্ড ১৫০ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬২২, ৬২৭ ও ৬২৮ পৃঃ।

[2] ইমাম সুহাইলী কতকগুলো যুদ্ধের ঐতিহাসিক বিবরণের উদ্ধৃতি পূর্বক এ পত্রের বিবরণ দিয়েছেন,তার বিষয়বস্তু হচ্ছে, ‘অতৎপর, হে কুরাইশগণ রাসূলে কারীম (সাঃ) তোমাদের আক্রমণের উদ্দেশ্যে রাত্রির অন্ধকারে প্রবাহিত সমুদ্র স্রোতের ন্যায় অগণিত সৈন্য সম্পদ নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেন। আল্লাহর কসম! তিনি যদি একাকীও তোমাদের নিকটে যান তাহলেও আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করে তাঁর ওয়াদা পূরণ করবেন। অতএব, নিজেদের ব্যাপার তোমরা চিন্তা করে নিও। তোমাদের প্রতি আমার সালাম। ইমাম ওয়াক্বিদী একটি মুরসাল সনদে বর্ণিত বিষয়বস্তু উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, হাতেব সোহাইল বিন আমর, সাফওয়ান বিন উমাইয়া এবং একরামার নিকট এ পত্র লিখেছিলেন যে, নাবী কারীম (সাঃ) লোকদের মাঝে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। আমি তোমাদের ছাড়া অন্য কারো ধারণা করি না এবং আমি চাচ্ছি যে, আমার দ্বারা তোমাদের একটি উপকার হোক । ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৫২১ পৃঃ।

[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৪২২, ২য় খন্ড ৬১২ পৃঃ। যুবাইর এবং আবূ মুরশেদের নামের অতিরিক্ত উল্লেখ সহীহুল বুখারীর অন্য বর্ণনায় উল্লেখিত হয়েছে।