আর-রাহীকুল মাখতূম মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ (غَزْوَةُ فَتْحِ مَكَّةَ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
নতুনভাবে সন্ধিচুক্তির জন্য আবূ সুফইয়ানের মদীনা আগমন (أَبُوْ سُفْيَانَ يَخْرُجُ إِلَى الْمَدِيْنَةِ لِيُجَدِّدَ الصُّلْحَ):

এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কুরাইশ এবং তার সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ দল যা করেছিল তা ছিল প্রকাশ্য অঙ্গীকারভঙ্গ এবং সন্ধিচুক্তির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাদের এ ধরণের কাজকর্মকে কোনক্রমেই সঠিক কিংবা সঙ্গত বলা যেতে পারে না। এ কারণে কুরাইশরাও সঙ্গে সঙ্গে এটা অনুধাবন করল যে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করে সত্যি সত্যিই তারা অন্যায় করেছে এবং এর ফলাফল অত্যন্ত তিক্ত ও ভয়াবহ হতে পারে। এ আশঙ্কায় তারা একটি পরামর্শ বৈঠকের আয়োজন করে। এ বৈঠকে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, চুক্তির পুনরুজ্জীবনের জন্য দলের পরিচালক আবূ সুফইয়ানকে অনতিবিলম্বে মদীনায় প্রেরণ করা হোক।

সন্ধি চুক্তি ভঙ্গের পর কুরাইশগণ কী করতে পারে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবা কেরামের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। এমন অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিনি তাঁদের বললেন, ‏(‏كَأَنَّكُمْ بِأَبِيْ سُفْيَانَ قَدْ جَاءَكُمْ لِيَشُدُّ الْعَقْدَ، وَيَزِيْدُ فْي الْمُدَّةِ‏) ‘আমি যেন আবূ সুফইয়ানকে দেখছি যে, অঙ্গীকারনামা পুন: দৃঢ়তর করা এবং সন্ধিচুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সে মদীনায় এসে গিয়েছে।

এদিকে কুরাইশদের পরামর্শ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবূ সুফইয়ান যখন উসফান নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন বুদাইল বিন ওয়ারাক্বার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়ে গেল। বুদাইল মদীনা হতে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। আবূ সুফইয়ান বুঝতে পারল যে, সে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট থেকে ফিরে আসছে। ‘সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বুদাইল! কোথা থেকে আসছ?’

বুদাইল বলল, ‘আমি খুযা’আহর সঙ্গে এ পার্শ্ববর্তী তীরে এবং উপত্যকায় গিয়েছিলাম।’

আবূ সুফইয়ান জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট গিয়েছিলে? ’

সে বলল, ‘না’।

কিন্তু বুদাইল যখন মক্কার দিকে রওয়ানা হয়ে গেল তখন আবূ সুফইয়ান বলল, ‘সে যদি মদীনায় গিয়ে থাকে তাহলে সেখানে তার উটকে যে ফলের আঁটি খাইয়েছিল তা থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। অতৎপর সে বুদাইল যেখানে তার উটকে বসিয়েছিল সেখানে গেল এবং উটের বিষ্টায় খেজুরের বীচি দেখতে পেল। খেজুরের বীচি পরখ করে সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! বুদাইল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট গিয়েছিল।

যাহোক, আবূ সুফইয়ান মদীনায় গিয়ে পৌঁছল এবং নিজ কন্যা উম্মুল মু’মিনীন হাবীবা (রাঃ)-এর ঘরে গেল। সে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিছানায় বসার ইচ্ছা করল তখন তিনি বিছানা জড়িয়ে নিলেন। এ অবস্থা দেখে আবূ সুফইয়ান বলল, ‘হে আমার কন্যা! তুমি কি মনে করছ যে, এ বিছানা আমার জন্য উপযু্ক্ত নয়, না আমি এ বিছানার উপযুক্ত নই?’

উম্মুল মু’মিনীন বললেন, ‘এ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিছানা, আপনি হচ্ছেন অপবিত্র মুশরিক।’

শুনে আবূ সুফইয়ান বলতে লাগল, ‘আল্লাহর কসম! আমার পরে তোমার অমঙ্গল রয়েছে।’

অতঃপর আবূ সুফইয়ান সেখান থেকে বের হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট গেল এবং কথাবার্তা বলল। নাবী কারীম (ﷺ) তার কোন কথারই উত্তর দিলেন না। এর পর সে আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে কথা বলতে বলল। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য কেন সুপারিশ করব?’ আল্লাহর কসম! আমি যদি একটি লাঠি ছাড়া অন্য কিছু না পাই তাহলে তার দ্বারাই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব, তবুও তোমাদের ক্ষমা করব না।’

অতঃপর সে আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ)-এর নিকট গেল। সেখানে ফাতিমাহ এবং হাসানও (রাঃ) ছিলেন। হাসান (রাঃ) তখনো ছোট ছিলেন এবং লাফালাফি করে বেড়াচ্ছিলেন। আবূ সুফইয়ান বলল, ‘হে আলী! অন্যান্যদের তুলনায় তোমাদের সঙ্গে আমার গাঢ় বংশীয় সম্পর্ক আছে। আমি এখন একটি বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। এমনটি যেন না হয় যে, আমাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়। তুমি আমার জন্য মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট সুপারিশ কর। আলী (রাঃ) বললেন, ‘আবূ সুফইয়ান! তোমার উপর দুঃখ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি কথার উপর কৃতসংকল্প হয়ে গিয়েছেন। সে ব্যাপারে আমরা তাঁর নিকট কোন কথাই বলতে পারব না। এরপর সে ফাতিমাহ (রাঃ)-কে লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনি কি আমার জন্য এতটুকু করতে পারবেন যে, আপনার এ ছেলেকে নির্দেশ করবেন যেন সে লোকজনের মাঝে আমার আশ্রয়ের ব্যাপারে ঘোষণা দিয়ে সর্ব সময়ের জন্য আরবের নেতা হয়ে যাবে। ফাতিমাহ বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমার এ ছেলে তেমন উপযুক্ত হয় নি যে, সে লোকজনের মাঝে কারো আশ্রয়ের জন্য ঘোষণা করতে পারবে। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপস্থিতিতে অন্য কেউ ঘোষণা দিতেও পারবে না।

উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়ে আবূ সুফইয়ানের সামনে পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল। অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত্র চিন্তিত ও নৈরাশ্যজনক অবস্থায় সে বলল, ‘হে হাসানের পিতা! আমি অনুধাবন করছি যে অবস্থা অত্যন্ত কঠিন ও সঙ্গীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব, আমাকে ভবিস্যৎকর্মপন্থার ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত প্রদান কর।’

আলী (রাঃ) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমার উপকারে আসতে পারে এমন কোন পথ আমি দেখছি না। তবে যেহেতু তুমি বনু কিনানাহর সর্দার, সেহেতু জনগণের সম্মুখে দন্ডায়মান হয়ে আশ্রয়ের ঘোষণা করে দাও। অতঃপর আপন দেশে প্রত্যাবর্তন কর।

আবূ সুফইয়ান বলল, ‘তুমি কি মনে করছ যে, এটা আমার জন্য ফলপ্রসূ হবে।’

আলী (রাঃ) বললেন, ‘না, আল্লাহর কসম! তোমার জন্য এটা ফলপ্রসূ হবে আমি তা মনে করি না। কিন্তু এর বিকল্প অন্য কোন কিছুই আমার মনে আসছেনা। এরপর আবূ সুফইয়ান মসজিদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করল, ‘হে জনগণ! সকলের মাঝে আমি আশ্রয়ের ঘোষণা করছি। অতঃপর স্বীয় উটের পিঠে আরোহণ করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল।

অতঃপর সে যখন কুরাইশদের নিকট গিয়ে পৌঁছল তখন কুরাইগণ তার পিছনের অবস্থা সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল। আবূ সুফইয়ান বলল, ‘আমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট গিয়ে কথাবার্তা বললাম, কিন্তু আল্লাহর কসম! তিনি কোন উত্তর দেন নি। এরপর আবূ কোহাফার ছেলের নিকট গেলাম, কিন্তু তাঁর মধ্যে কোন মঙ্গল দেখতে পেলাম না। সেখান থেকে উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট গেলাম। তাঁকে পেলাম সব চাইতে শত্রুর ভূমিকায়। অতঃপর গেলাম আলীর নিকটে, মন মানসিকতার ক্ষেত্রে তাঁকে পেলাম সব চাইতে নরম অবস্থায়। সে আমাকে কিছু পরামর্শ দিল এবং সেই মোতাবেক কাজ করলাম। কিন্তু কার্যকর হবে কিনা তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। লোকেরা বলল, ‘সে পরামর্শটা কী?’

আবূ সুফইয়ান বলল, ‘তাঁর পরামর্শ ছিল, আমি জনগণের নিকট আশ্রয়ের ঘোষণা করে দেই। পরে আমি তাই করলাম।’

কুরাইশগণ বলল, ‘তাহলে কি মুহাম্মাদ (ﷺ) তা বাস্তবায়ন করে মেনে নিয়েছে।’

লোকেরা বলল, ‘তুমি ধ্বংস হও। ঐ ব্যক্তি (আলী) তোমার সঙ্গে কেবল রহস্যই করেছে।

আবূ সুফইয়ান বলল, ‘আল্লাহর কসম! এ ছাড়া অন্য কোন উপায়ই ছিল না।’