ফরয নামায শুদ্ধ হওয়ার জন্য এক শর্ত হল, তা যথা সময়ে আদায় করা। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া ভিন্ন সময়ে নামায হয় না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,

إنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ كِتَاباً مَّوْقُوْتاً

অর্থাৎ, নির্ধারিত সময়ে যথাযথভাবে নামায পড়া মু’মিনদের কর্তব্য। (কুরআন মাজীদ ৪/১০৩)

কুরআন মাজীদে কতিপয় আয়াতে নামাযের ৫টি ওয়াক্তের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে; যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “আর নামায কায়েম কর দিনের দু’ প্রান্তভাগে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরেবের সময়) ও রাতের প্রথমাংশে (অর্থাৎ এশার সময়)। (কুরআন মাজীদ ১১/১১৪)

“সূর্য ঢলে যাওয়ার পর হতে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত (অর্থাৎ যোহ্‌র, আসর, মাগরেব ও এশার) নামায কায়েম কর, আর কায়েম কর ফজরের নামায।” (কুরআন মাজীদ ১৭/৭৮)

“আর সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজরে) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসরে) তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর রাত্রির কিছু সময়ে (এশায়) এবং দিনের প্রান্তভাগগুলিতে (ফজর, যোহ্‌র ও মাগরেবে), যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার।” (কুরআন মাজীদ ২০/১৩০)

পাঁচ ওয়াক্তকে নির্দিষ্ট করতে আল্লাহর তরফ হতে স্বয়ং জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) এসে ইমাম হয়ে রসূল (ﷺ)কে সঙ্গে নিয়ে নামায পড়েন। নবী (ﷺ) বলেন, “কা’বাগৃহের নিকট জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) আমার দু’বার ইমামতি করেন; প্রথমবারে তিনি আমাকে নিয়ে যোহরের নামায তখন পড়লেন, যখন সূর্যঢলে গিয়ে তার ছায়া জুতোর ফিতের মত (সামান্য) হয়েছিল। অতঃপর তিনি আমাকে নিয়ে আসরের নামায পড়লেন যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়েছিল। অতঃপর আমাকে নিয়ে মাগরেবের নামায পড়লেন তখন, যখন রোযাদার ইফতার করে ফেলেছিল। (অর্থাৎ সূর্যাস্তের সাথে সাথে।) অতঃপর এশার নামায তখন পড়লেন, যখন (সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশের অস্তরাগ) লাল আভা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আর আমাকে নিয়ে ফজরের নামায তখন পড়লেন, যখন রোযাদারের জন্য পানাহার হারাম হয়ে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিনে তিনি আমাকে নিয়ে যোহরের নামায তখন পড়লেন যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়েছিল। আসরের নামাযে আমার ইমামতি তখন করলেন, যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হয়েছিল। অতঃপর আমাকে নিয়ে মাগরেবের নামায তখন পড়লেন, যখন রোযাদার ইফতার করে ফেলেছিল। অতঃপর রাতের এক তৃতীয়াংশ গত হলে তিনি এশার নামায পড়লেন। আর আমাকে নিয়ে ফজরের নামায তখন পড়লেন, যখন (ভোর) ফর্সা হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর তিনি আমার প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, ‘হে মুহাম্মাদ! এ হল আপনার পূর্বে সকল নবীগণের ওয়াক্ত। আর এই দুই ওয়াক্তের মধ্যবর্তী ওয়াক্তই হল নামাযের ওয়াক্ত।’ (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৮৩নং)

শেষ অক্তে নামায যদিও শুদ্ধ, তবুও প্রথম (আওয়াল) অক্তে নামায পড়া হল শ্রেষ্ঠ আমল। আল্লাহর রসূল (ﷺ) কে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ?’ উত্তরে তিনি বললেন, “আওয়াল অক্তে নামায পড়া।” (সহীহ আবূদাঊদ, সুনান ৪৫২, সহীহ তিরমিযী, সুনান ১৪৪, মিশকাত ৬০৭নং)

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) শেষ জীবন পর্যন্ত দ্বিতীয় বার কখনো শেষ অক্তে নামায পড়েন নি।’ (সহীহ তিরমিযী, সুনান ১৪৬, মিশকাত ৬০৮নং)

সুবহে সাদেক উদিত হলে ফজরের নামাযের সময় শুরু হয় এবং রোযাদারের জন্য পানাহার হারাম হয়ে যায়। (সুবহে সাদেক বলা হয় সেই সময়কে, যে সময়ে ভোরের আভা পূর্ব আকাশে উত্তর-দক্ষিণে বিস্থির্ণ অবস্থায় দেখা যায়।) আর এর শেষ সময় হল সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত।

তবে এই নামায প্রথম অক্তে ‘গালাসে’ (একটু অন্ধকারে কাক ভোরে) পড়া উত্তম।

মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর রসূল (ﷺ) ফজরের নামায পড়তেন। অতঃপর মহিলারা তাদের চাদর জড়িয়েই নিজ নিজ বাসায় ফিরে যেত। কিন্তু অন্ধকারের জন্য তাদেরকে চেনা যেত না।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫৯৮নং)

আবূ মূসা (রাঃ) বলেন, ‘একদা আল্লাহর রসূল (ﷺ) তখন ফজরের নামায পড়লেন, যখন কেউ তার পাশ্ববর্তী সঙ্গীর চেহারা চিনতে পারত না অথবা তার পাশে কে রয়েছে তা জানতে পারত না।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৫, ৩৯৮নং)

আবূ মাসঊদ আনসারী (রাঃ) বলেন, তিনি [নবী (ﷺ)] একবার ফজরের নামায অন্ধকারে (খুব ভোরে) পড়লেন। অতঃপর দ্বিতীয় বার ফর্সা করে পড়লেন। এরপর তাঁর ফজরের নামায অন্ধকারেই হত। আর ইন্তেকাল অবধি কোন দিন পুনর্বার (ফজরের নামায) ফর্সা করে পড়েন নি।’ (আবূদাঊদ, সুনান ৩৯৪নং)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “তোমরা ফজরের নামায ফর্সা করে পড়। কারণ, তাতে সওয়াব অধিক।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৬১৪নং)

এই হাদীসের ব্যাখ্যা এই যে, ‘ফজর স্পষ্টরুপে প্রকাশ হতে দাও, নিশ্চিতরুপে ফজর উদিত হওয়ার কথা না জেনে নামাযের জন্য তাড়াহুড়া করো না।’ অথবা ‘তোমরা ফজরের নামায লম্বা ক্বিরাআত ধরে ফর্সা করে পড়। এতে অধিক সওয়াব লাভ হবে।’ আর এ কথা বিদিত যে, মহানবী (ﷺ) নিজে এই নামাযে (কখনো কখনো) ৬০ থেকে ১০০ আয়াত পর্যন্ত পাঠ করতেন এবং যখন নামায শেষ করতেন, তখন প্রত্যেকে তার পাশের সাথীকে চিনতে পারত। (বুখারী ৫৯৯নং)

অথবা ‘ চাঁদনী রাতে একটু ফর্সা হতে দাও। যাতে ফজর হওয়া স্পষ্ট ও নিশ্চিতরুপে বুঝা যায়।’ (আলমুমতে’, শারহে ফিক্‌হ, ইবনে উষাইমীন /১১৪-১১৫)

যেহেতু তাঁর আমল মৃত্যু পর্যন্ত ফজরের নামায ফর্সা করে ছিল না, বরং এ নামায একটু অন্ধকার থাকতেই শুরু করতেন, সেহেতু উক্ত হাদীসের এই সব ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই যুক্তিযুক্ত।

সূর্য পশ্চি আকাশের দিকে ঢলে গেলেই যোহরের আওয়াল ওয়াক্ত শুরু হয়। আর প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হলে তার সময় শেষ হয়ে যায়।

সূর্য মধ্য রেখায় থাকলে কোন খোলা জায়গায় একটি সরল কাঠি বা শলাকা সোজাভাবে গাড়লে যখন তার ছায়া তার দেহে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পর পূর্ব দিকে পড়ে লম্বা হতে লাগবে, তখনই হবে যোহরের সময়। এইভাবে তার ছায়া তার সমপরিমাণ হলে যোহরের সময় শেষ হয়ে যাবে।

অন্যথা সূর্য মধ্যরেখায় না থাকলে, কোন গোলার্ধে থাকার ফলে যে অতিরিক্ত ছায়া পড়ে, তা বাদ দিয়ে মাপতে হবে। কাঠির ছায়া কমতে কমতে ঠিক মধ্যাহ্নকালে আবার বাড়তে শুরু হবে। ঐ বাড়া অংশটি মাপলে যোহ্‌র-আসরের সময় নির্ণয় করা যাবে।

প্রত্যেক নামায তার প্রথম অক্তে পড়াই হল উত্তম। কিন্তু গ্রীষ্মকালে কঠিন গরমের দিনে যোহরের নামায একটু ঠান্ডা বা দেরী করে পড়া আফযল।

আবূ যার (রাঃ) বলেন, একদা আমরা নবী (ﷺ) এর সাথে এক সফরে ছিলাম। যোহরের সময় হলে মুআযযিন আযান দিতে চাইল। নবী (ﷺ) বললেন, “ঠান্ডা কর।” এইরুপ তিনি দুই অথবা তিন বার বললেন। তখন আমরা দেখলাম যে, ছোট ছোট পাহাড়গুলোর ছায়া নেমে এসেছে। পুনরায় নবী (ﷺ) বললেন, “গ্রীষ্মের এই প্রখর উত্তাপ দোযখের অংশ। অতএব গরম কঠিন হলে নামায ঠান্ডা (দেরী) করে পড়।” (বুখারী ৫৩৯নং, মুসলিম, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান) গ্রীষ্মকালে নিজের ছায়া ৩ থেকে ৫ কদম হলে এবং শীতকালে ৫ থেকে ৭ কদম হলে যোহরের সময় নির্ণয় করা যায়। (আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৫৮৬নং) অবশ্য সকল দেশেই এ মাপ সঠিক হবে না।

যখন প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার সমপরিমাণ হয়ে যায়, তখন আসরের সময় শুরু হয়। (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ৫৮৩নং) শেষ হয় ঠিক সূর্যাস্তের পূর্বমুহূর্তে।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি সূর্য ডোবার পূর্বে আসরের এক রাকআত পেয়ে নেয়, সে আসর পেয়ে নেয়।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহ)

আসরের আওয়াল অক্তেই নামায পড়া মহানবী (ﷺ) এর আমল ছিল। আনাস (রাঃ) বলেন, ‘সূর্য যখন আকাশের উচ্চতায় প্রদীপ্ত থাকত, তখন আল্লাহর রসূল (ﷺ) আসরের নামায পড়তেন। তাঁর সাথে নামায পড়ে অনেকে মদ্বীনার পার্শ্ববর্তী বস্তীতে (কোন কাজে বা নিজের বাড়ি ফিরে) যেত, আর যখন সেখানে পৌঁছত তখনও সূর্য (অপেক্ষাকৃত) উচ্চতায় থাকত। পরন্তু কোন কোন ব স্তী মদ্বীনা থেকে প্রায় ৪ মীল (১৬ হাজার হাত, প্রায় ৭ কিমি) দূরে অবস্থিত ছিল।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫৯২নং)

রাফে’ বিন খাদীজ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রসূল (ﷺ) এর সাথে আসরের নামায পড়তাম। অতঃপর উট নহ্‌র (যবেহ্‌) করা হত, তারপর তার মাংস দশ ভাগ করা হত। সেই মাংস সূর্য ডোবার পূর্বেই রান্না করে খেতে পেতাম।’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬১৫নং)

বিনা ওজরে আসরের নামায শেষ সময়ে দেরী করে পড়া মাকরুহ। মহানবী (ﷺ) বলেন, “এটা তো মুনাফিকের নামায; যে সূর্যের অপেক্ষা করে যখন তা হলদে হয়ে শয়তানের দুই শিঙের মাঝে আসে, তখন সে উঠে (কাকের বা মুরগীর দানা খাওয়ার মত) চার রাকআত ঠকাঠক পড়ে নেয়। যাতে সে আল্লাহর যিক্‌র কমই করে থাকে।” (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ৫৯৩নং)

আল্লাহর রসূল (ﷺ) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি আসরের নামায ত্যাগ করে সে ব্যক্তির আমল পন্ড হয়ে যায়।” (বুখারী ৫৫৩, নাসাঈ)

অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “যে ব্যক্তির আসরের নামায ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন-মাল লুণ্ঠন হয়ে গেল।” (মালেক, বুখারী ৫৫২, মুসলিম ৬২৬ নং প্রমুখ)

সূর্য অস্ত গেলেই মাগরেবের সময় হয় এবং পশ্চিমাকাশে লাল আভা (অস্তরাগ) কেটে গেলেই এর সময় শেষ হয়ে যায়। (মুসলিম, সহীহ)

মাগরেবের নামাযও আওয়াল অক্তে পড়া আফযল এবং বিনা ওজরে দেরী করে পড়া মাকরুহ। কেননা, জিবরীল (আহমাদ, মুসনাদ) মহানবী (ﷺ) এর ইমামতি কালে ২ দিনই একই সময়ে আওয়াল অক্তে নামায পড়িয়েছিলেন- যেমন পূর্বেকার হাদীস হতে আমরা জানতে পেরেছি। তাছাড়া রাফে’ বিন খাদীজ (রাঃ) বলেন, ‘আমরা নবী (ﷺ) এর সাথে মাগরেবের নামায পড়তাম। অতঃপর নামায সেরে যদি আমাদের কেউ তীর মারত, তাহলে সে তার তীর পড়ার স্থানটি দেখতে পেত।’ (অর্থাৎ, বেশী অন্ধকার হত না।) (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫৯৬নং)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার উম্মতের লোকেরা ততক্ষণ পর্যন্ত ইসলামী ফিতরাত (প্রকৃতির) উপর থাকবে, যতক্ষণ তারা তারকারাজি (আকাশে) প্রকাশ হওয়ার পূর্বেই মাগরেবের নামায পড়ে নেবে।” (আহমাদ, মুসনাদ, ত্বাবারানী, মু’জাম, আবূদাঊদ, সুনান,হাকেম, মুস্তাদরাক, মিশকাত ৬০৯নং)

সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশ হতে লাল আভা কেটে গেলে এশার সময় উপস্থিত হয়। নু’মান বিন বাশীর (রাঃ) এর বর্ণনা অনুযায়ী (চাঁদের মাসের) তৃতীয় রাতে চাঁদ ডুবে গেলে এশার সময় হয়। (আবূদাঊদ, সুনান, দারেমী, সুনান, মিশকাত ৬১৩নং) সূর্য ডোবার পর থেকে ঘড়ি ধরে দেড় ঘন্টা অতিবাহিত হলে এই ওয়াক্ত আসে।

আর এর শেষ সময় অর্ধেক রাত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে। অবশ্য কোন ওযর ও বাধার ফলে ফজরের আগে পর্যন্ত এশার নামায পড়ে নিলে আদায় হয়ে যায়। যেহেতু মহানবী (ﷺ) বলেন, “কেউ ঘুমিয়ে যাওয়ার ফলে নামায না পড়লে তা শৈথিল্য বলে গণ্য হবে না। অবশ্য জাগ্রতাবস্থায় যদি কেউ নামায না পড়ে এবং অন্য নামাযের সময় উপস্থিত হয়ে যায়, তবে তার শৈথিল্যই ধর্তব্য।” (মুসলিম, সহীহ ৬৮১নং)

উক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আগামী নামাযের সময় এসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান নামাযের সময় অবশিষ্ট থাকে। অবশ্য ফজরের নামাযের সময় শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত। সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যায়। যোহ্‌র পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকে না। (ফিকহুস সুন্নাহ্‌ উর্দু৭৫পৃ:)

আওয়াল অক্তে নামায আফযল হলেও এক তৃতীয়াংশ বা মধ্যরাতে (শেষ অক্তে) এশার নামায পড়া আফযল। মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমার উম্মতের জন্য কষ্টসাধ্য না জানলে আমি এশার নামাযকে এক তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধরাত পর্যন্ত দেরী করে পড়তে তাদেরকে আদেশ দিতাম।” (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ৬১১নং)

প্রিয় রসূল (ﷺ) এশার নামাযকে এক তৃতীয়াংশ রাত্রি পর্যন্ত দেরী করে পড়তে পছন্দ করতেন এবং এশার পূর্বে ঘুমানো ও পরে কথাবার্তা বলাকে অপছন্দ করতেন। (বুখারী ৫৯৯, মুসলিম, প্রমুখ) যাতে এশা, তাহাজ্জুদ, বিতর ও ফজরের নামায যথা সময়ে পড়া সহজ হয়।

তবে দ্বীন অথবা জরুরী বিষয়ে কথাবার্তা বলা ও ইলম চর্চা করা দূষনীয় নয়। যেমন আল্লাহর রসূল (ﷺ) আবূ বকর ও উমারের সাথে এশার পর জনসাধারণের ভালো-মন্দ নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। (আহমাদ, মুসনাদ, তিরমিযী, সুনান ১৬৯নং)

নামাযের সময় নির্দিষ্টী করণের পশ্চাতে হিকমত

মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে এমন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি দান করেছেন, যাতে রুযী অনুসন্ধানের মাধ্যমে তাকে জীবনধারণ করতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন পরিশ্রমের। পরিশ্রম দেহ্‌-মনে ক্লান্তি, ব্যস্ততা ও শৈথিল্য আনে। ফলে পরিশ্রমে ছিন্ন হয় আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিশেষ যোগসূত্র। তাই তো যথাসময়ে সেই যোগসূত্র -একটানা নয় বরং মাঝে মাঝে কায়েম করে বান্দাকে আল্লাহ-মুখো করে রাখার উদ্দেশ্যে নামাযের ওয়াক্তের এই বিশেষ সময়াবলী নির্দিষ্ট করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে পরিশ্রম ও উপার্জনের জন্যও উদ্যম জরুরী। বিশেষ করে ফজরের সময়ে এমন কিছু অনুশীলনের দরকার, যার মাঝে নিদ্রার জড়তা ও আলস্য কেটে গিয়ে মনে স্ফূর্তি ফিরে আসে এবং যার ফলে এই বর্কতের সময়ে মানুষ নিজ নিজ কাজে মনোযোগী হতে পারে। তাই তো ফজরের নামাযের মাধ্যমে বান্দা তার নিদ্রা অবস্থায় নিরাপত্তা লাভের উপর আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে এবং আল্লাহর নিকট তওফীক ও সাহায্য কামনার মধ্য দিয়ে শুরু করে তার প্রাত্যহিক কর্মজীবন।

পরিশ্রম ও ব্যস্ততার মাঝে ঠিক দিন দুপুরে মানুষ পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে একটু বিরতির সাথে বিশ্রাম নিয়ে থাকে। এই বিশ্রামের সময় সে তার নিজ কর্মের উপর তওফীক লাভের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে আল্লাহর নিকট। অতঃপর আসরের সময় উপস্থিত হলে পুনরায় বান্দা তার বাকী দিনের কর্ম সম্পন্ন করার মানসে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। মাগরেবের সময় হলে বান্দা নিজ গৃহে ফিরে কর্ম সম্পাদন করার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনপূর্বক মাগরেবের নামায পড়ে। অতঃপর সময় আসে বিশ্রাম ও আরামের। এই সময় বান্দা প্রাত্যহিক কর্ম সেরে সারা দিনে আল্লাহর তরফ থেকে অবতীর্ণ অনুগ্রহের উপর শুক্‌র জানিয়ে এশার নামায পড়ে। আর এইভাবে সে প্রত্যহ্‌ কর্ম ও ইবাদতের মধ্য দিয়ে নিজের কাল যাপন করে থাকে। কোন সময় আত্মবি স্মৃ ত হয়ে পাপের প্রতিঢলে পড়লে নামায তাকে বাধা দেয়। আল্লাহর আযাব ভীষণ কঠিন এবং তাঁর অনুগ্রহ অনন্ত-অসীম -এ কথা প্রত্যহ্‌ পাঁপ-পাঁচ বার বান্দাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। (মাজমূউস স্বালাওয়াতি ফিল-ইসলাম, ড: শওকত উলাইয়ান ৯১-৯২পৃ:)

দিবারাত্রে পাঁচটি সময়ে নামায পড়া নিষিদ্ধ; মহানবী (ﷺ) বলেন,
(১) “আসরের নামাযের পর সূর্য না ডোবা পর্যন্ত আর কোন নামায নেই এবং
(২) ফজরের নামাযের পর সূর্য না ওঠা পর্যন্ত আর কোন নামায নেই।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১০৪১ নং)

উক্ববা বিন আমের (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রসূল (ﷺ) আমাদেরকে তিন সময়ে নামায পড়তে এবং মুর্দা দাফন করতে নিষেধ করতেন;

(৩) ঠিক সূর্য উদয় হওয়ার পর থেকে একটু উঁচু না হওয়া পর্যন্ত,
(৪) সূর্য ঠিক মাথার উপর আসার পর থেকে একটু ঢলে না যাওয়া পর্যন্ত এবং
(৫) সূর্য ডোবার কাছাকাছি হওয়া থেকে ডুবে না যাওয়া পর্যন্ত। (মুসলিম, আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান, নাসাঈ, সুনান, ইবনে মাজাহ্‌, সুনান, মিশকাত ১০৪০ নং) যেহেতু এই সময়গুলিতে সাধারণত: কাফেররা সূর্যের পূজা করে থাকে তাই। (মুসলিম, মিশকাত ১০৪২ নং)

নামায নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে এটি হল সাধারণ নির্দেশ। কিন্তু অন্যান্য হাদীস দ্বারা কিছু সময়ে কিছু নামাযকে ব্যতিক্রম করা হয়েছে। যেমন:-

১। ফরয নামায বাকী থাকলে তা আদায় করার সুযোগ হওয়া মাত্র যে কোন সময়ে সত্বর পড়ে নেওয়া জরুরী। মহানবী (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি সূর্য ডোবার পূর্বে আসরের এবং সূর্য ওঠার পূর্বে ফজরের এক রাকআত নামায পেয়ে যায়, সে (যথাসময়ে) নামায পেয়ে যায়।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০১নং)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি সূর্য ডোবার পূর্বে আসরের এক রাকআত নামায পায়, সে যেন (সূর্য ডুবে গেলেও) তার বাকী রাকআত নামায সম্পন্ন করে নেয়। আর যে ব্যক্তি সূর্য ওঠার পূর্বে ফজরের এক রাকআত নামায পায়, সে যেন (সূর্য উঠে গেলেও) তার বাকী রাকআত নামায সম্পন্ন করে নেয়।” (বুখারী, মিশকাত ৬০২নং)

২। অনুরুপ কোন ফরয নামায পড়তে ভুলে গিয়ে থাকলে তা স্মরণ হওয়া মাত্র সত্বর যে কোন সময়ে অথবা ঘুমিয়ে গিয়ে থাকলে জাগার পর উঠে সত্বর যে কোন সময়ে আদায় করা জরুরী। মহানবী (ﷺ) বলেন, “কেউ ঘুমিয়ে গেলে তা তার শৈথিল্য নয়। শৈথিল্য তো জাগ্রত অবস্থাতেই হয়ে থাকে। সুতরাং যখন কেউকোন নামায পড়তে ভুলে যাবে অথবা ঘুমিয়ে যাবে, তখন তার উচিৎ, তা স্মরণ (বা জাগ্রত) হওয়া মাত্র পড়ে নেওয়া। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমাকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তুমি নামায কায়েম কর।” (মুসলিম, মিশকাত ৬০৪নং, কুরআন মাজীদ ২০/১৪)

৩। দিন-দুপুরে মসজিদে জুমুআহ পড়তে এসে ইচ্ছামত নফল নামায পড়া বিধেয়। এ নামাযও নিষেধের আওতাভুক্ত নয়। (মিশকাত ১০৪৬নং)

৪। ফজরের ফরয নামাযের পূর্বে দু’ রাকআত সুন্নত পড়তে সময় না পেলে ফরযের পর তা পড়া যায়। আল্লাহর রসূল (ﷺ) একদা এক ব্যক্তিকে দেখলেন ফজরের ফরয নামাযের পর দু’ রাক্‌আত নামায পড়ল। তিনি তাকে বললেন, “ফজরের নামায তো দু’ রাকআত মাত্র!” লোকটি বলল, ‘আমি ফরযের পূর্বে দু’ রাকআত পড়তে পাই নি, এখন সেটা পড়ে নিলাম।’ এ কথা শুনে তিনি নীরব থাকলেন। (অর্থাৎ, মৌনসম্মতি জানালেন।) (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, মিশকাত ১০৪৪)

৫। কারণ-সাপেক্ষ যাবতীয় নামায যথার্থ কারণ উপস্থিত হওয়া মাত্র যে কোন সময়েই পড়া যায়। যেমন :-

ক- কা’বা শরীফের তওয়াফের পর দু’ রাকআত নামায। তওয়াফ শেষ হওয়ার পরেই যে কোন সময়ে ঐ নামায পড়া যায়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “হে আব্দে মানাফের বংশধর! দিবারাত্রের যে কোন সময়ে কেউএ গৃহের তওয়াফ করে নামায পড়লে তাকে তোমরা বাধা দিও না।” (আবূদাঊদ, সুনান, তিরমিযী, সুনান, নাসাঈ, সুনান, মিশকাত ১০৪৫ নং)

খণ্ড তাহিয়্যাতুল মাসজিদ (মসজিদ-সেলামী) দু’ রাকআত নামায। যে কোনও সময়ে মসজিদ প্রবেশ করে বসার ইচ্ছা করলে বসার পূর্বে এই নামায পড়তে হয়। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কেউমসজিদ প্রবেশ করলে সে যেন দু’ রাকআত নামায পড়ার পূর্বে না বসে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৭০৪নং)

গ- সূর্য বা চন্দ্র গ্রহণের নামায। মহানবী (ﷺ) বলেন, “সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। কারো জন্ম বা মৃত্যুর কারণে তাতে গ্রহণ লাগে না। সুতরাং গ্রহণ লাগা দেখলে তোমরা আল্লাহর নিকট দুআ কর, তকবীর পড়, নামায পড় এবং সদকাহ্‌ কর।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৪৮৩ নং)

ঘ- জানাযার নামায। আসর ও ফজর নামাযের পরও জানাযার নামায পড়া যাবে। অবশ্য শেষোক্ত তিন সময়ে এই নামায বৈধ নয়। যেমন পূর্বোক্ত হাদীসে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। (আজামে ১৩০-১৩১পৃ:)

সুতরাং সাধারণ নফল নামায উক্ত সময়গুলিতে নিষিদ্ধ। তবে আসরের পর সূর্য হ্‌লুদবর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ নয়। (সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ২৫৪৯ নং)

১। যে ব্যক্তি ওয়াক্ত শেষ হওয়ার পূর্বে এক রাকআত নামায পেয়ে নেবে সে ওয়াক্ত পেয়ে যাবে। অর্থাৎ, তার নামায যথা সময়ে আদায় হয়েছে এবং কাযা হয়নি বলে গণ্য হবে। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৬০১নং) বিধায় যে ব্যক্তি এক রাকআতের চেয়ে কম নামায পাবে, সে সময় পাবে না; অর্থাৎ তার নামায যথাসময়ে আদায় হবে না এবং তা কাযা বলে গণ্য হবে। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওজরে শেষ সময়ে নামায পড়া বৈধ নয়।

তদনুরুপ যদি কোন ব্যক্তি এক রাকআত নামায পড়ার মত সময়ের পূর্বেই মুসলমান হয় অথবা কোন মহিলা অনুরুপ সময়ে মাসিক থেকে পবিত্রা হয় তবে ঐ ওয়াক্তের নামায তাদের জন্য কাযা করা ওয়াজেব।

যেমন কোন ব্যক্তি যদি সূর্য ওঠার পূর্বে এমন সময়ে ইসলাম গ্রহণ করে, যে সময়ের মধ্যে মাত্র এক রাকআত ফজরের নামায পড়লেই সূর্য উঠে যাবে, তাহলে ঐ ব্যক্তির জন্য ফজরের ঐ নামায ফরয এবং তাকে কাযা পড়তে হয়। অনুরুপ যদি কোন পাগল জ্ঞান ফিরে পায় অথবা কোন মহিলার মাসিক বন্ধ হয়, তাহলে তাদের জন্যও ঐ ফজরের নামায ফরয।

ঠিক তদ্রুপই যদি কোন মহিলা মাগরেবের নামায না পড়ে থাকে এবং এতটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তার মাসিক শুরু হয়ে যায়, যার মধ্যে এক রাকআত নামায পড়া যেত, তাহলে ঐ মহিলার জন্য ঐ মাগরেবের নামায ফরয। মাসিক থেকে পাক হওয়ার পরে তাকে ঐ নামায কাযা পড়তে হবে। (রাসাইল ফিকহিয়্যাহ্‌, ইবনে উসাইমীন ২৩-২৪পৃ:)

২। এশার নামায অর্ধরাত্রি পর্যন্ত দেরী করে পড়া আফযল হলেও আওয়াল অক্তে জামাআত হলে জামাআতের সাথে আওয়াল অক্তেই পড়া আফযল। কারণ, জামাআতে নামায পড়া ওয়াজেব।

৩। ফজরের আযান হলে ২ রাকআত সুন্নাতে রাতেবাহ্‌ ছাড়া ফরয পর্যন্ত আর অন্য কোন নামায নেই। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তিকে যেন পৌঁছে দেয় যে, ফজরের (আযানের) পর দু’ রাকআত (সুন্নত) ছাড়া আর কোন (নফল) নামায পড়ো না।” (আহমাদ, মুসনাদ, আবূদাঊদ, সুনান ১২৭৮ নং)

৪। জামাআত খাড়া হলে ফরয নামায ছাড়া কোন প্রকারের নফল ও সুন্নত (অনুরুপ পৃথক ফরয) নামায পড়া বৈধ নয়। (মুসলিম, সহীহ প্রমুখ, মিশকাত ১০৫৮ নং)

৫। পৃথিবীর যে স্থানে দিন বা রাত্রি অস্বাভাবিক লম্বা (যেমন ৬ মাস রাত, ৬ মাস দিন) হয়, সে স্থানে ২৪ ঘন্টা হিসাব করে রাত-দিন ধরে হিসাব মত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়তে হবে। যে স্থানে দিন বা রাত অস্বাভাবিক ছোট সেখানেও আন্দাজ করে সকল নামায আদায় করা জরুরী। যেমন দাজ্জাল এলে দিন ১ বছর, ১ মাস ও ১ সপ্তাহ্‌ পরিমাণ লম্বা হলে, স্বাভাবিক দিন অনুমান ও হিসাব করে নামায পড়তে বলা হয়েছে। (মুসলিম, সহীহ ২১৩৭ নং)

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৯ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে