এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?

কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাদ?

যৌবনে পদার্পণ করার সাথে সাথে যৌনানুভূতি ও যৌন-চিন্তা সহ যৌন-উন্মাদনার মানসিক আন্দোলন প্রাণী-জগতের এক প্রকৃতিগত ব্যাপার। মনের ভিতর বেড়ে ওঠে যৌনক্ষুধা, কেমন এক প্রকার অস্থিরতা, ক্ষিপ্ততা ও অস্বস্তিকর চাঞ্চল্য। মন চায় কিছু ভাবতে, কাউকে কাছে পেতে এবং তার কাছে মনের কথা খুলে বলতে, মন চায় আকাশ-কুসুম কল্পনা করতে। হৃদয় যেন উছুল হতে চায়, চায় সকল প্রকার বাধা ও লাগাম অমান্য করতে কিন্তু না। ইসলাম এ সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণরেখা এঁকে দিয়েছে। এনেছে নৈতিকতা এবং শৃংখলতার বিভিন্ন বিধি-নিয়ম। তাই মুসলিম যুবক লাগামহীন উদ্ধৃঙ্খল নয়। নয় নিয়ন্ত্রণহারা খেয়াল-খুশীর পূজারী। আর “আল্লাহ তাআলা সেই যুবককেই পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন, যার যৌবনে কোন কুপ্রবৃত্তি ও ভ্রষ্টতা নেই।” (আহমাদ)

কিন্তু যুবকের বর্তমান পরিবেশ এমন যে, সেখানে তার যৌন-চেতনা বৃদ্ধি করা হয়। সময় হওয়ার পুর্বেই যুবকের যৌবন বেসামাল গতিতে এসে উপস্থিত হয় তার দেহ-মনে। যৌনানুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়। প্রলুব্ধ ও উত্তেজিত করা হয় তার কামনাময় হৃদয়কে। বাড়ির বাইরে, রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে, ট্রেনে-বাসে যুবতীর সৌন্দর্য অনায়াসে চোখে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুরভিতার দেহের সাথে দেহ স্পর্শ হয়। নগ্নতা ও পর্দাহীনতার ফলে মহিলার রূপ যুবকের হৃদয়-মনে ছোয়া দেয়, দোলা দেয়। বাড়িতে টিভির পর্দায় যা প্রদর্শিত হয় তাও নগ্নতা ও অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। কেউ কেউ সানুগ্রহে দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখে অভিনেত্রীদের অর্ধনগ্ন ছবি। প্রায় প্রত্যেক পণ্যদ্রব্যের প্যাকেটে ও প্রচারে ব্যবহার করা হয় অর্ধনগ্ন সুদর্শনা নারীর ছবি।

পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ তথা পাতায় পাতায় নজরে পড়ে ঐ একই দৃশ্য। তা পড়তে গিয়েও পাওয়া যায় বিভিন্ন শ্রেণীর যৌন-উত্তেজনামূলক কাল্পনিক গল্প, কাহিনী ও ঘটনা। স্কুল-কলেজে যুবক-যুবতীর অবাধ সংসর্গ ও মিলামেশা। অফিসে গেলেও ঐ একই অবস্থা। ফলে যুবকের জন্য সুচিন্তায় মনকে ধরে রাখা এত কঠিন হয়েছে যে, তার চাইতে হাতে আগুনের আঙ্গার রাখা অতি সহজ ব্যাপার। কচিন্তা করবে না বলে মনকে সুদৃঢ় করলেও তার উপায়-উপকরণ এত সহজলব্ধ যে, তার গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যই সুকঠিন।

যুবক বন্ধু! যদি তোমার জীবনে এমন কঠিন পরীক্ষা এসেই থাকে, তবে ঐ কুচিন্তাকে যেন মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়ে বসো না। পাথরের উপর থেকে যেমন বৃষ্টির পানি অতি সহজে গড়িয়ে যায়, ঠিক তেমনি ঐ নারী বা যৌন-চিন্তাও যেন তোমার মনের পাথরে স্থান না পায়। চলার পথে কোন নারী যদি তোমার মনে কুচিন্তার সূত্রপাত করেই যায়, তবুও তুমি সেই সুতো নিয়ে যেন নির্জনে থেকে কোন কামনার জাল বুনতে শুরু করে দিও না। তোমার মনকে ধরার জন্য যদি কেউ জাল বিছিয়ে অপেক্ষাও করতে থাকে, তবুও তুমি ‘ফাদ-ছাড়া বক’এর মত অবশ্যই নিজেকে বাঁচিয়ে নিও। খবরদার! ঐ কুচিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করো না। নচেৎ ঐ চিন্তার পথে মনের লাগাম ছেড়ে দিলে, সে লাগাম শয়তানের হস্তগত হয়ে তোমাকে এমন স্থানে যেতে বাধ্য করবে, যেখানে তোমার ধ্বংস অনিবার্য।

মনের জল্পনা-কল্পনা তোমার সম্মুখে উড়ন্ত একটি পাখির মত। পাখিটিকে উড়তে দিলে সে তার উড়ার পথ অবশ্যই অতিক্রম করবে। আর যদি তাকে উড়তে না দিয়ে শিকার করে অথবা পিঞ্জরাবদ্ধ করে ফেল, তাহলে সে তোমার আয়ত্তাধীন হয়ে যাবে।

অতএব তোমার মনের ভিতরে কোন মন্দ কম্পনা এলে তা সত্বর দূর করে ফেল, যদি তা না কর তাহলে জেনে রেখো, তা চিন্তায় পরিণত হবে। চিন্তাকেও মনে বিচরণ করার সুযোগ দিও না, নচেৎ তা বাসনা ও কামনায় পর্যবসিত হয়ে যাবে। যদি তা হয়েই থাকে, তাহলে সে কামনাকেও নিবৃত্ত কর, নচেৎ তা দৃঢ়-সংকল্পে পরিণত হবে। এই পরিকল্পনাকেও পরাভূত কর, নচেৎ তা কর্মে পরিণত হয়ে যাবে। আবার কর্মকেও প্রতিহত না করতে পারলে তা অভ্যাসে পরিণত হবে। আর কোন কর্ম অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে কখনো তুমি তার কবল থেকে রেহাই পেতে পারবে । (আল-ফাওয়াইদ, ইবনুল কাইয়েম)।

হ্যা, সত্যই তো। কল্পনার চারাগাছ, যা এইমাত্র বেড়ে উঠেছে, তাকে সহজেই হাত দিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলতে পার। কিন্তু সেই বটবৃক্ষ বড় হওয়ার পর তাকে ক্রেন লাগিয়ে তুলতে পারবে না। মনের মাটি থেকেও এমন অভ্যাসের বনস্পতি তোলা কম দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়।

হে কল্পনাবিহারী যুবক বন্ধু! ফিরিস্তার জ্ঞান আছে, কিন্তু প্রবৃত্তি নেই। পশুর জ্ঞান নেই, কিন্তু প্রবৃত্তি আছে। আর মানুষের জ্ঞান ও প্রবৃত্তি দুই আছে। সুতরাং যার প্রবৃত্তি সংযত ও নিয়ন্ত্রিত এবং জ্ঞান আলোকিত, সে হল ফিরিস্তার মত মানুষ। পক্ষান্তরে যার জ্ঞান অনুজ্জ্বল এবং প্রবৃত্তি উদ্ধৃঙ্খল, সে হল পশুর মত জীব। অতএব তুমি চেষ্টা কর, যাতে ফিরিস্তার গুণের কাছাকাছি মানুষ হতে পার।

যখনই তোমার মন তোমার খেয়ানত করতে চায় এবং কোন পাপ করার পরিকল্পনা করে, তখনই মনকে আল্লাহর স্মরণ দিয়ে ক্ষান্ত কর। কিন্তু তাতে যদি তোমার মন ক্ষান্ত না হতে চায়, তাহলে সৎচরিত্রবাণ মানুষদের চরিত্র স্মরণ করিয়ে নিবৃত্ত কর। তাতেও যদি নিবৃত্ত না হতে চায়, তাহলে এই ভেবে তাকে পরাস্ত কর যে, তোমার এই পাপ-পরিকল্পনার কথা লোক-সমাজে প্রকাশ পেলে তুমি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। তোমার ও তোমার বংশের দুর্নাম রটবে। এখনো যদি তুমি তোমার মনকে ক্ষান্ত না করতে সক্ষম হও এবং পার্থিব অপমানেরও যদি ভয় তোমার মনে না আসে, তাহলে জেনে নিও যে, তোমার মনোবৃত্তি এবারে পশুবৃত্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। (হাকযা অ্যালামতনিল হায়াহ ২৭পৃঃ)

সুতরাং মন্দ চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা থেকে দুরে থাক। যখনই কোন প্রকার যৌন-চিন্তা তোমার হৃদয় মাঝে প্রবেশ করতে চায়, তখনই তুমি তোমার হৃদয়দ্বার বন্ধ করে দাও। আর সেই চিন্তা শুরু করে দাও, যা তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে কাজে দেবে। চিন্তা কর, আল্লাহর বড় বড় সৃষ্টি নিয়ে; বিশাল সমুদ্র, সুউচ্চ পর্বতমালা, দিগন্তু-প্রসারী মেঘমালা, ভয়াবহ বসু-বিদ্যুত ও আগ্নেয়গিরী, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জলপ্রপাত, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্ররাজি ইত্যাদি নিয়ে। আল্লাহর বড়ত্ব ও শক্তিমত্তা নিয়ে, আখেরাত ও কবর নিয়ে এবং মুসলিম জাতির বর্তমান দুঃখজনক পরিস্থিতি নিয়ে।