ঢেউ খেলানো যৌবনের সাথে সাথে যে মন-মাতানো গান-বাজনায় যুবকের মন তালেতালে গেয়ে ও নেচে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বহু যুবককে দেখা যায় যে, সুর-ঝংকার ও বাজনার তালে-তালে গা ও মাথা হিলিয়ে থাকে; যদিও বা সে গানের ভাষা বা অর্থ না বোঝে। কখনো বা বেসামাল হয়ে হাততালি সহ ‘ড্যান্স’ শুরু করে থাকে। কিন্তু এমন কাজ অস্বাভাবিক হল একজন মুসলিমের জন্য। কারণ, মুসলিমের প্রকৃতি হল। ইসলামের প্রকৃতি। আর সে প্রকৃতিতে এ শ্রেণীর প্রবৃত্তি পূজা তথা ‘ধেই-ধেইনি’ একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য রুচিবিরুদ্ধ কর্ম।

পক্ষান্তরে যে সকল পথ দিয়ে শয়তান মানুষের মনের কোণে আসন পেতে নিতে পারে, তার মধ্যে তিনটি প্রধান পথ হল, মানুষের ঔদাস্য, ক্রোধ ও কাম। একটু উদাসীন অথবা ক্রোধান্বিত হলে শয়তান যেমন সত্বর মনের সিংহাসনে আরোহণ করে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে বিপদে ফেলে থাকে, ঠিক তেমনি কাম ও কামনার ছিদ্রপথে প্রবেশ করে শয়তান প্রবৃত্তি-পূজায় লিপ্ত করে মানুষকে। তার মনে নতুন নতুন বাসনা সৃষ্টি করে এবং সেই বাসনা চরিতার্থ করার বিভিন্ন উপায়-উপকরণও বাতলে দেয়। গান-বাজনা এমনই এক শয়তানী উপকরণ, যার মাধ্যমে মানুষ তার কামনা-বাসনায় পরিপূর্ণ জ্বালাময় হৃদয়ে অপূর্ব শান্তির দিশা পায়। নিরানন্দ চিত্তে আনন্দের তুফান আনতে সক্ষম হয়। আর এরই মাঝে শয়তান ঐ মানুষের মনে গাফলতি ও ঔদাস্য সৃষ্টি করতে আরো সহজ রাস্তা পায়।

এর ফলে ধীরে-ধীরে সে মানুষকে তার আসল প্রভুর স্মরণ ও দাসত্ব থেকে দূরে সরিয়ে এনে নিজের দাস বানিয়ে নিতে কৃতার্থ হয়। কিছু যুবক আছে; যাদেরকে দ্বীনের কাজে আসতে বললে তারা বলে, কি করি? সময় পাই । অথচ যখন তাকে তাস, কেরাম বা দাবা খেলাতে অথবা গান-বাজনা শুনতে দেখে যদি বলা হয় যে, এ কাজ কেন করছ? এ তো হারাম!' তখন চট করে সে বলে, কি করি বলুন? সময় তো কাটাতে হবে!' এমন মানুষ দ্বীনের কথা শোনার জন্য সময় পায় না, আবার তার হাতে এত জ্বালাময় সময় আছে যে, তা কোন মন-মাতানো, হৃদয়-ভুলানো উদাসকারী বিষয় ছাড়া কাটতেই চায় না। এমন মানুষের মনে শয়তানের বড় প্রভাব থাকে।

এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী জবাব দিয়ে সে শুধুমাত্র পিছল কেটে নিজ দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি সাধন করে থাকে। কখনো বা গান-বাজনার নেশায় সংসারের কাজ ও কর্তব্য ভুলে বা ছেড়ে বসে। অবহেলা প্রদর্শন করে সামাজিক কাজেও। এস, এবারে দেখা যাক কোন্ কিতাবে আছে রে ভাই হারাম বাজনা-গান? কুরআন শরীফের সূরা লুকমানের ৬নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অন্ধভাবে অসার বাক্য ক্রয় করে (বেছে নেয়) এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”

প্রায় সকল তফসীর-কিতাবে এই আয়াতের তফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মসউদ (রাঃ) তিন তিনবার কসম খেয়ে খেয়ে বলেছেন, 'উক্ত আয়াতে ‘অসার বাক্য বলতে ‘গান’কে বুঝানো হয়েছে। অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) এবং জাবের (রাঃ) ও ইকরামা (রহঃ) হতে। গান হল অসার, অবান্তর, অশ্লীল ও যৌন-উত্তেজনামূলক অথবা শির্কী ও বিদআতী কথামালাকে কবিতাছন্দে সুললিত ও সুরেলি কণ্ঠে গাওয়া শব্দধ্বনির নাম। যা ইসলামে হারাম। হারাম তা গাওয়া এবং হারাম তা শোনাও। গানে হৃদয় উদাস হয়, রোগাক্রান্ত ও কঠোর হয়। গান হল ‘ব্যভিচারের মন্ত্র’, অবৈধ ভালোবাসার আজব আকর্ষণ সৃষ্টিকারী যন্ত্র।

তাই তো “মহানবী (সা.) নগ্নতা ও পর্দাহীনতা এবং গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ৬৯১৪ নং) মিউজিক বা বাজনা শোনাও মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কারণ, বাজনা-ঝংকারও মানুষের মন মাতিয়ে তোলে, বিভোরে উদাস করে ফেলে এবং উন্মত্ততায় আন্দোলিত করে। সবচেয়ে শুদ্ধ হাদীসের কিতাব বুখারী শরীফে, মহানবী (সা.) বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় হবে; যারা ব্যভিচার, (পুরুষের জন্য) রেশমবস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার (হারাম হওয়া সত্ত্বেও) হালাল মনে করবে।” (বুখারী ৫৫৯০, আবু দাউদ, তিরমিযী, দারেমী, সহীহুল জামে ৫৪৬৬ নং)

তিনি বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে, তাদের মাথার উপরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হবে এবং নর্তকী নাচবে। আল্লাহ তাদেরকে মাটিতে ধসিয়ে দেবেন এবং বানর ও শূকরে পরিণত করবেন!” (ইবনে মাজাহ ইবনে হিব্বান, ত্বাবারানী, বাইহাকীর শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামে ৫৪৫৪ নং)।

তিনি আরো বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের মাঝে (কিছু লোককে) মাটি ধসিয়ে, পাথর বর্ষণ করে এবং আকার বিকৃত করে (ধ্বংস করা) হবে। আর এ শাস্তি তখন আসবে, যখন তারা মদ পান করবে, নর্তকী রাখবে এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাবে।” (সহীহুল জামে’ ৩৬৬৫, ৫৪৬৭ নং) প্রিয় নবী আরো বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য মদ, জুয়া, ঢোল-তবলা এবং বীণা-জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করেছেন।” (আহমাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭০৮ নং)

অন্য এক হাদীসে মহানবী (সা.) বলেন, “ফিরিশতা সেই কাফেলার সঙ্গী হন না; যে কাফেলায় ঘন্টার শব্দ থাকে।” (আহমাদ, সহীহুল জামে” ৭৩৪২ নং)

আর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “ঘন্টা বা ঘুঙুর হল শয়তানের বাশি।” (মুসলিম ২১১৪ আবু দাউদ ২৫৫৬ নং) সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, যে কাফেলা, অনুষ্ঠান, মিছিল, মিটিং, বিয়ে বা দাওয়াতে মিউজিক থাকে অথবা কোন বাদ্যযন্ত্র বা রেকর্ডের গান-বাজনা থাকে, সেখানে অবশ্যই ফিরিশ্যার স্থানে শয়তান আশ্রয় নেয়। তাই এমন শয়তানী অনুষ্ঠানে যোগদান করাও মুসলিমের জন্য অবৈধ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'ঢোলক হারাম, বাদ্যযন্ত্র হারাম, তবলা হারাম এবং বাঁশীও হারাম।' (বাইহাকী) হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন, 'ঢোলক মুসলিমদের ব্যবহার্য নয়। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মসউদের সহচরগণ ঢেলক দেখলে ভেঙ্গে ফেলতেন।' (দেখুন, তাহরীমু আলাতুত ত্বার্ব, আলবনী)

উল্লেখ্য যে, বহু জাহেল মনে করে থাকে যে, দাউদ নবী (আঃ) বাঁশীর সুরে জগতের মানুষকে মোহিত করতেন! অতএব বাঁশীর সুর বা মিউজিক হারাম হওয়ার কথা নয়।

এ কথা মনে রাখা দরকার যে, একজন নবীর উপর কলঙ্ক ও অপবাদ দেওয়া সাধারণ গোনাহর কাজ নয়। আর কেবলমাত্র ধারণা করে কথা বলাও মহাপাপ। বলা বাহুল্য, হযরত দাউদ (আঃ) বংশীবাদক ছিলেন না। তবে যবুর পাঠের সময় তার কণ্ঠ বড় মিষ্ট ছিল। আর তার সুরেই লোকে মোহিত হত।

তাছাড়া মহানবীর শরীয়তে যা হারাম ঘোষিত হয়েছে, তা পূর্ববর্তী কোন নবীর আমলে হালাল থাকলেও শেষ নবীর উম্মতীর জন্য তা হারাম।

পক্ষান্তরে সুর করে আযান দেওয়া, কুরআন পাঠ করা বা ইসলামী গজল আবৃত্তি করা বিধেয় ও বৈধ হলেই সুর করে অসার-অশ্লীল কথা গাওয়া বৈধ হতে পারে না। এ শ্রেণীর বক্তারা বলতে চায় যে, মদ যদি হারাম হল, তাহলে তোমরা কেন দুধ খাও বল?’ অর্থাৎ, দুধ পান হালাল হলে, মদ পানও হালাল। কারণ, উভয়ই তো পানীয়। কিন্তু জ্ঞানী সুধীজন ঐ শ্রেণীর প্রবৃত্তিপুজারীদের এমন হাস্যকর যুক্তি ভ্রান্ত বলেই আদৌ ভ্রূক্ষেপ ও গ্রাহ্য করেন না।

তারা অবশ্যই দুধ ও মদের মাঝে অতি সহজে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারেন।

এক হাদীসে সর্বশেষ নবী (সা.) বলেন, “ইহ-পরকালে দুটি শব্দ-ধ্বনি অভিশপ্ত; সুখ ও খুশীর সময় বাশীর শব্দ এবং মসীবত, শোক ও কষ্টের সময় হা-হুতাশ ধনি।” (সহীহুল জামে’ ৩৮০১, সিলসিলাহ সহীহাহ ৪২৭ নং) ‘গানে জ্ঞান বাড়ে' কথাটিও নিছক প্রবৃত্তিপূজকের তরফদারিমূলক যুক্তিহীন উক্তি। কারণ, জ্ঞানের উৎস গান নয়। জ্ঞানের উৎস হল কুরআন। অবশ্য অবৈধ প্রণয় ও ভালোবাসার জ্ঞান লাভ করার এক উপযুক্ত মাধ্যম ও প্রধান উৎস বটে।

অনেকের ধারণা যে, ‘গান হল রূহের খোরাক। দুশ্চিন্তা ও কষ্টের সময় জ্বালাময় হৃদয়ের পোড়া-ঘায়ের মলম!

অথচ প্রকৃতপ্রস্তাবে গান হল, ‘প্রেম-পীড়িত’ রূহের খোরাক। কারণ, প্রেমে থাকে মাদকতা। বনের ময়ুর নাচার মত হৃদয়ের মঞ্চে প্রেমের রুনুঝুনু নাচ আছে। আর সে নাচের সাথে তাল মিলায় ঐ গান-বাজনা। তাছাড়া অবৈধ প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে শয়তান। তাই শয়তানের বাণীর মাঝেই পিরীতের জ্বালাময় অন্তরে মিঠাপানির আস্বাদ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কুরআন হল রহমানের বাণী। আর তা হল মুসলিম রূহের একমাত্র খোরাক। বিরহ বেদনাহত বহু যুবক, যাদের স্ত্রী (কাছে) নেই, অনুরূপ বহু যুবতী, যাদের স্বামী (কাছে) নেই, তারা গান-বাজনা শুনে (অনেকে বা গেয়ে-বাজিয়ে) মনকে ‘ফ্রি’, স্থির ও সানিত করতে চায়। এরা কিন্তু আসলে মনের তাপকে গানের আগুন দিয়ে ঠান্ডা করতে চায়। যার ফলে সেই তাপ আরো বৃদ্ধি পায়।

কারণ, অধিকাংশ গান হল প্রেমমূলক; প্রেমকাহিনী, প্রেম-মিলন, বিরহ-বেদনা, মিলন-আবেদন, নারী-সৌন্দর্য প্রভৃতি যৌনজীবনের গাথা কথাই গানে গাওয়া হয়ে থাকে। যা শুনে যৌনক্ষুধা আরো বেড়ে যায়। ছাই-চাপা প্রেমের আগুন গানের বাতাসে গল্প করে জ্বলে উঠে ফিনকি উড়াতে শুরু করে। আর তখনই মন চুরি করে গোপনে স্বামী বা স্ত্রীর খেয়ানত করে বসে অথবা করতে চায়! মনের জ্বালা মিটাবার জন্য দুরের বন্ধুর প্রতীক্ষা করতে আর ধৈর্য থাকে না।

বলা বাহুল্য, এ জন্যই সুবিজ্ঞ সাহাবী বলেন, 'গান হল ব্যভিচারের মন্ত্র। অতএব গানে কক্ষনই মন সানিত হয় না; বরং আরো বিক্ষিপ্ত, চিন্তিত ও উত্তেজিত হয়। দগ্ধ, অস্থির ও ব্যাকুল মনকে শান্ত ও স্থির করতে হলে মনের সৃষ্টিকর্তার প্রেকিশন’ নিতে হবে। তিনি বলেন, “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকরে (স্মরণে) প্রশান্ত থাকে। আর জেনে রাখ, আল্লাহর যিকরেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” (সূরা রা'দ ২৮ আয়াত)

পক্ষান্তরে যারা এর বিপরীত কাজ করে, তাদের ফলও হয় উল্ট। মহান আল্লাহ সে কথাও বলেন যে, “যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর যিকর (স্মরণে) বিমুখ হয়, তিনি তার জন্য নিয়োজিত করেন এক শয়তানকে। অতঃপর সেই হয় তার সহচর। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ হতে বিরত রাখে, অথচ মানুষ মনে করে তারা সৎপথে পরিচালিত হচ্ছে। যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে, 'হায়! আমার ও তোমার মাঝে যদি পুর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান হত! কত নিকৃষ্ট সে সহচর।” (সূরা যুখরুফ ৩৬-৩৮ আয়াত)