بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ৪/ আন-নিসা | An-Nisa | ٱلنِّسَاء আয়াতঃ ১৭৬ মাদানী
৪ : ৫১ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ اُوۡتُوۡا نَصِیۡبًا مِّنَ الۡكِتٰبِ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡجِبۡتِ وَ الطَّاغُوۡتِ وَ یَقُوۡلُوۡنَ لِلَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا هٰۤؤُلَآءِ اَهۡدٰی مِنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا سَبِیۡلًا ﴿۵۱﴾
الم تر الی الذین اوتوا نصیبا من الكتب یؤمنون بالجبت و الطاغوت و یقولون للذین كفروا هؤلآء اهدی من الذین امنوا سبیلا ﴿۵۱﴾
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছে? তারা জিবত* ও তাগূতের প্রতি ঈমান আনে এবং কাফিরদেরকে বলে, এরা মুমিনদের তুলনায় অধিক সঠিক পথপ্রাপ্ত।

-আল-বায়ান

যারা কিতাবের জ্ঞানের একাংশ প্রদত্ত হয়েছে, সেই লোকদের প্রতি তুমি কি লক্ষ্য করনি, তারা অমূলক যাদু, প্রতিমা ও তাগূতের প্রতি বিশ্বাস করে এবং কাফিরদের সম্বন্ধে বলে যে তারা মু’মিনগণের তুলনায় অধিক সঠিক পথে রয়েছে।

-তাইসিরুল

তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি যাদেরকে গ্রন্থের একাংশ প্রদত্ত হয়েছে? তারা মূর্তি ও শাইতানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কাফিরদেরকে বলে, মুসলিমদের অপেক্ষা তারাই অধিকতর সুপথগামী।

-মুজিবুর রহমান

Have you not seen those who were given a portion of the Scripture, who believe in superstition and false objects of worship and say about the disbelievers, "These are better guided than the believers as to the way"?

-Sahih International

* জিবত (الجبت) অর্থ: মূর্তি , প্রতিমা, যাদুকর, ভেলকিবাজ, যাদু, ভেলকি ইত্যাদি।

৫১. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছিল, তারা জিব্‌ত ও তাগুতে বিশ্বাস করে?(১) তারা কাফেরদের সম্বন্ধে বলে, এদের পথই মুমিনদের চেয়ে প্রকৃষ্টতর।(২)

(১) আয়াতে ‘জ্বিবত’ ও ‘তাগূত’ শীর্ষক দুটি বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। শব্দ দুটির মর্ম সম্পর্কে তাফসীরকার মনীষীবৃন্দের বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আবিসিনীয় ভাষায় জ্বিবত বলা হয় জাদুকরকে। আর তাগূত বলা হয় গণক বা জ্যোতিষীকে। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, জ্বিবত অর্থ জাদু এবং তাগুত অর্থ শয়তান। মালেক ইবন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, আল্লাহ ব্যতীত যে সমস্ত জিনিসের উপাসনা করা হয়, সে সবই তাগূত বলে অভিহিত হয়। ইমাম কুরতুবী বলেন যে, মালেক ইবন আনাস এর উক্তিটিই অধিক পছন্দনীয়। তার কারণ, কুরআন থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাগুত থেকে বেঁচে থাক। [সূরা আন-নাহ্‌ল: ৩৬]

কিন্তু উল্লেখিত বিভিন্ন মতের মাঝে কোন বিরোধ নেই। কাজেই এর যে কোনটিই গ্রহণ করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ‘জ্বিবত' প্রতিমাকেই বোঝাত, পরে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য পূজ্য বস্তুতে এর প্রয়োগ হতে আরম্ভ করে। [রুহুল মা'আনী] তাগূতের অর্থ ও প্রকারভেদ এবং প্রধান প্রধান তাগুত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা সূরা আল-বাকারাহর ২৫৬ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় করা হয়েছে।

(২) ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, ইয়াহুদীদের সর্দার হুইয়াই ইবন আখতাব ও কাব ইবন আশরাফ ওহুদ যুদ্ধের পর নিজেদের একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে কুরাইশদের সাথে সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে মক্কায় এসে উপস্থিত হয়। ইয়াহুদী সর্দার কাব ইবন আশরাফ আবু সুফিয়ানের কাছে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তাদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন মক্কাবাসীরা কাব ইবন আশরাফকে বলল, তোমরা হলে একটি প্রতারক সম্প্রদায়। সত্য সত্যই যদি তোমরা তোমাদের এই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে সত্য হয়ে থাক, তবে আমাদের এ দুটি মূর্তির (জ্বিবত ও তাগূতের) সামনে সিজদা কর।

সুতরাং সে কুরাইশদেরকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাই করল। তারপর কা'ব কুরাইশদেরকে বলল, তোমাদের মধ্য থেকে ত্রিশ জন এবং আমাদের মধ্য থেকে ত্ৰিশ জন লোক এগিয়ে আস, যাতে আমরা সবাই মিলে কা'বার প্রভূর সামনে দাঁড়িয়ে এ ওয়াদা করে নিতে পারি যে, আমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। কা’বের এ প্রস্তাব কুরাইশরাও পছন্দ করল এবং সেভাবে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যজোট গঠন করল। অতঃপর আবু সুফিয়ান কা’বকে বলল, তোমরা হলে শিক্ষিত লোক; তোমাদের নিকট আল্লাহর কিতাব রয়েছে, কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ মূর্খ।

সুতরাং তুমিই আমাদেরকে বল, প্রকৃতপক্ষে আমরা ন্যায়ের উপর রয়েছি, নাকি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ন্যায়ের উপর রয়েছেন? তখন কাব জিজ্ঞেস করল, তোমাদের দ্বীন কি? আবু সুফিয়ান উত্তরে বলল, আমরা হজের জন্য নিজেদের উট জবাই করি এবং সেগুলোর দুধ খাওয়াই, মেহমানদিগকে দাওয়াত করি, নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখি এবং বায়তুল্লাহ (আল্লাহর ঘর)-এর তাওয়াফ করি, পক্ষান্তরে এর বিপরীতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পৈত্রিক দ্বীন পরিহার করেছেন, নিজের আত্মীয়-স্বজন থেকে পৃথক হয়ে গেছেন এবং সর্বোপরি তিনি আমাদের সনাতন দ্বীনের বিরুদ্ধে নিজের এক নতুন দ্বীন উপস্থাপন করেছেন। এসব কথা শোনার পর কা’ব ইবন আশরাফ বলল, তোমরাই ন্যায়ের উপর রয়েছ। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোমরাহ হয়ে গেছেন। এরই প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য আয়াতটি নাযিল করে ওদের মিথ্যা ও প্রতারণার নিন্দা করেন। [দেখুনঃ সহীহ ইবন হিব্বানঃ ৬৫৭২]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫১) তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছিল? তারা জিব্‌ত (শয়তান, শিরক, যাদু প্রভৃতি) ও তাগূত (বাতিল উপাস্যে) বিশ্বাস করে এবং অবিশ্বাসী (কাফের)দের সম্বন্ধে বলে যে, এদের পথ বিশ্বাসী (মুমিন)দের অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর। [1]

[1] এই আয়াতে ইয়াহুদীদের আর এক কর্মের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করা হচ্ছে। তারা কিতাবধারী হওয়া সত্ত্বেও ‘জিব্‌ত’ (শয়তান, মূর্তি, গণক অথবা যাদুকর) এবং ‘তাগূত’ (মিথ্যা উপাস্য)-এর উপর বিশ্বাস রাখে এবং মক্কার কাফেরদেরকে মুসলিমদের চেয়ে বেশী হিদায়াতপ্রাপ্ত মনে করে। উল্লিখিত সব অর্থেই ‘জিব্‌ত’ শব্দ ব্যবহার হয়। একটি হাদীসে এসেছে যে, ‘‘পাখি উড়িয়ে এবং রেখা টেনে শুভাশুভ নির্ণয় করা হল জিবতের (প্রতি ঈমানের) অন্তর্ভুক্ত।’’ (আবূ দাউদ) অর্থাৎ, এগুলো সব শয়তানী কাজ। ইয়াহুদীদের মধ্যে এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। ‘তাগূত’এর একটি অর্থ শয়তানও করা হয়েছে। আসলে বাতিল মা’বুদের পূজা করার অর্থই হল শয়তানের আনুগত্য করা। কাজেই শয়তান অবশ্যই তাগূতের মধ্যে শামিল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫২ اُولٰٓئِكَ الَّذِیۡنَ لَعَنَهُمُ اللّٰهُ ؕ وَ مَنۡ یَّلۡعَنِ اللّٰهُ فَلَنۡ تَجِدَ لَهٗ نَصِیۡرًا ﴿ؕ۵۲﴾
اولٓئك الذین لعنهم الله و من یلعن الله فلن تجد لهٗ نصیرا ﴿۵۲﴾
এরাই তারা যাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেছেন। আর আল্লাহ যাকে লা‘নত করেন তুমি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবে না।

-আল-বায়ান

এরা সেই লোক, যাদেরকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন এবং যাকে আল্লাহ অভিশাপ দেন, তুমি কক্ষনো তার সাহায্যকারী পাবে না।

-তাইসিরুল

এদেরই প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন; এবং আল্লাহ যাকে অভিসম্পাত করেন, তুমি তার জন্য কোনই সাহায্যকারী খুঁজে পাবেনা।

-মুজিবুর রহমান

Those are the ones whom Allah has cursed; and he whom Allah curses - never will you find for him a helper.

-Sahih International

৫২. এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ লা'নত করেছেন(১) এবং আল্লাহ যাকে লা'নত করেন আপনি কখনো তার কোন সাহায্যকারী পাবেন না।(২)

(১) আল্লাহর অভিসম্পাত দুনিয়া ও আখেরাতের অপমানের কারণ। লা'নত ও অভিসম্পাত এর অর্থ হল, আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরে সরে পড়া- চরম অপমান, অপদস্থতা। যার উপর আল্লাহর লা'নত পতিত হয় সে কখনো আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে না। তাদের সম্পর্কে অতি কঠিন ভৎসনার কথা বলা হয়েছে। অন্যত্র বলা হয়েছে, “যাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত হয়েছে, তাদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই নিহত অথবা ধৃত হবে।” [সূরা আল-আহযাব: ৬১] এটা তাদের পার্থিব অপমান। আখেরাতে তাদের অপমান এর চেয়েও কঠিন হবে।

(২) এ আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে, যার উপর আল্লাহর লা'নত বর্ষিত হয়, তার কোন সাহায্যকারী থাকে না। এখন চিন্তা করার বিষয় এই যে, আল্লাহর লানতের যোগ্য কারা? এক হাদীসে আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহীতা এবং সুদ দাতা, সুদ সংক্রান্ত দলীল সম্পাদনকারী এবং সুদের লেনদেনের সাক্ষী সবার প্রতিই অভিসম্পাত করেছেন। এদের সবাই পাপের ক্ষেত্রে সমান। [মুসলিমঃ ১৫৯৮] অন্য এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে লোক লুত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের অনুরূপ কর্মে লিপ্ত হবে সে অভিশপ্ত হবে।’ [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ৪/৩৯৬) অতঃপর তিনি বলেছেন, আল্লাহ্ তাআলা চোরদের প্রতিও অভিসম্পাত করেন। যে ডিম কিংবা রশির মত সাধারণ বস্তুও চুরি থেকে বিরত থাকে না, তারও হাত কাটা হয়। [বুখারীঃ ৬৪০১]

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, সুদ গ্রহীতা ও দাতার উপর আল্লাহ তা'আলার লা'নত এবং সে সমস্ত নারীর উপর যারা নিজেদের শরীর কেটে উল্কি আকে, যে অন্যের শরীর কেটেও উল্কি একে দেয়, তেমনিভাবে চিত্রকারের উপরও আল্লাহর লা'নত। [বুখারীঃ ১৯৮০] অপর এক হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহ্ তা'আলা লা'নত করেন মদ্যপায়ীর প্রতি, মদ যে ব্যক্তি পান করায় তার প্রতি, তার বিক্রেতা ও ক্রেতার প্রতি, যে মদের নির্যাস বের করে তার প্রতি এবং যারা মদ্য বহন করে তাদের সবার প্রতি। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/৩৭]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫২) এরাই তো তারা, যাদেরকে আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন। আর আল্লাহ যাকে অভিসম্পাত করেন, তুমি কখনো তার জন্য কোন সাহায্যকারী পাবে না।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৩ اَمۡ لَهُمۡ نَصِیۡبٌ مِّنَ الۡمُلۡكِ فَاِذًا لَّا یُؤۡتُوۡنَ النَّاسَ نَقِیۡرًا ﴿ۙ۵۳﴾
ام لهم نصیب من الملك فاذا لا یؤتون الناس نقیرا ﴿۵۳﴾
তবে কি তাদের জন্য রাজত্বে কোন অংশ আছে? তাহলে তখনতো তারা মানুষকে খেজুরবীচির উপরের আবরণ পরিমাণও কিছু দেবে না।

-আল-বায়ান

তাদের কি শাসন ক্ষমতায় কোন অংশ আছে? তা থাকলে তারা লোকেদেরকে তিল পরিমাণও দিত না।

-তাইসিরুল

তাহলে কি রাজত্বে তাদের কোন অংশ রয়েছে? বস্তুতঃ তখন তারা লোকদেরকে কণা পরিমাণও প্রদান করবেনা।

-মুজিবুর রহমান

Or have they a share of dominion? Then [if that were so], they would not give the people [even as much as] the speck on a date seed.

-Sahih International

৫৩. তবে কি রাজশক্তিতে তাদের কোন অংশ আছে? সে ক্ষেত্রেও তো তারা কাউকে এক কপর্কও দেবে না(১)।

(১) ইবনে আব্বাস বলেন, খেজুরের দানার উপরে বিন্দুর মত যে ছিদ্র থাকে তাকেই আরবীতে نقير নাকীর’ বলা হয়। [তাবারী] মোটকথা: সামান্যতম জিনিস বোঝানোর জন্যই এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৩) তবে কি (আল্লাহর) রাজ্যে তাদের কোন অংশ আছে? (যদি থাকত) তাহলে তো তারা লোককে (খেজুরের আঁটির পিঠে) বিন্দু পরিমাণও দান করত না। [1]

[1] এখানে জিজ্ঞাসাসূচক বাক্যটি অস্বীকৃতিসূচক। অর্থাৎ, তাঁর রাজ্যে তাদের কোন অংশ নেই। এতে তাদের কোন অংশ থাকলে এই ইয়াহুদীরা এত কৃপণ কেন যে, তারা মানুষকে বিশেষ করে মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে একটি ‘নাক্বীর’ পরিমাণও কিছু দেয় না। আর نَقِيْرٌ (নাক্বীর) বলা হয় খেজুরের আঁটির পিঠের বিন্দুকে। (ইবনে কাসীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৪ اَمۡ یَحۡسُدُوۡنَ النَّاسَ عَلٰی مَاۤ اٰتٰهُمُ اللّٰهُ مِنۡ فَضۡلِهٖ ۚ فَقَدۡ اٰتَیۡنَاۤ اٰلَ اِبۡرٰهِیۡمَ الۡكِتٰبَ وَ الۡحِكۡمَۃَ وَ اٰتَیۡنٰهُمۡ مُّلۡكًا عَظِیۡمًا ﴿۵۴﴾
ام یحسدون الناس علی ما اتهم الله من فضلهٖ فقد اتینا ال ابرهیم الكتب و الحكمۃ و اتینهم ملكا عظیما ﴿۵۴﴾
বরং তারা কি লোকদেরকে হিংসা করে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে? তাহলে তো আমি ইবরাহীমের বংশধরকে কিতাব ও হিকমত দান করেছি এবং তাদেরকে দিয়েছি বিশাল রাজত্ব।

-আল-বায়ান

কিংবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে লোকেদেরকে যেসব নি‘মাত দান করেছেন, সেজন্য কি এরা তাদের হিংসা করে, আমি ইবরাহীমের বংশধরদেরকেও তো কিতাব ও হিকমাত দিয়েছিলাম, তাদেরকে সুবিশাল রাজ্যও প্রদান করেছিলাম।

-তাইসিরুল

তাহলে কি তারা লোকদের প্রতি এ জন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় সম্পদ হতে কিছু দান করেছেন? ফলতঃ নিশ্চয়ই আমি ইবরাহীম বংশীয়গণকে গ্রন্থ ও বিজ্ঞান দান করেছি এবং তাদেরকে বিশাল সাম্রাজ্য প্রদান করেছি।

-মুজিবুর রহমান

Or do they envy people for what Allah has given them of His bounty? But we had already given the family of Abraham the Scripture and wisdom and conferred upon them a great kingdom.

-Sahih International

৫৪. অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন সে জন্য কি তারা তাদেরকে ঈর্ষা করে?(১) তবে আমরা তো ইবরাহীমের বংশধরকেও কিতাব ও হিকমত দিয়েছিলাম এবং আমরা তাদেরকে বিশাল রাজ্য করেছিলাম।

(১) এ আয়াতে ইয়াহুদীদের হিংসার কঠোর নিন্দা করা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যে জ্ঞানৈশ্বর্য ও শান-শওকত দান করেছিলেন, তা দেখে ইয়াহুদীরা হিংসার অনলে জ্বলে মরত। আল্লাহ্ তাআলা এখানে তাদের সে হিংসা বিদ্বেষের কঠোর নিন্দা করেছেন এবং তাদের বিদ্বেষকে একান্ত অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করে পরবর্তী আয়াতগুলোতে তার কারণ বর্ণনা করেছেন। তা হল এই যে, তোমাদের এই হিংসা ঈর্ষা ও বিদ্বেষের কারণটা কি? যদি এ কারণ হয়ে থাকে যে, তোমরাই প্রকৃত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী অথচ তা তোমাদের হাতে না এসে তিনি পেয়ে গেছেন, তাহলে তোমাদের এ ধারণা যে একান্তই ভ্রান্ত তা সুস্পষ্ট।

কারণ এখন তোমরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু তোমরা যদি তা থেকে কোন অংশ প্রাপ্ত হতে, তাহলে তোমরা তো অন্য কাউকে একটি কড়িও দিতে না। পক্ষান্তরে যদি তোমাদের এ বিদ্বেষ এ কারণে হয়ে থাকে যে, রাজ-ক্ষমতা না হয় আমরা নাই পেলাম, কিন্তু তার হাতে যাবে কেন? রাষ্ট্রের সাথে তার কি সম্পর্ক? তাহলে তার উত্তর হল এই যে, ইনিও নবীগণেরই বংশধর, যাদের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পূর্ব থেকেই ছিল। কাজেই রাষ্ট্র কোন অপাত্রে অর্পিত হয়নি। অতএব, তোমাদের ঈর্ষা একান্তভাবেই অযৌক্তিক।

এখন জানা দরকার ঈর্ষা কি? আর তার পরিণামই বা কি? আলেমগণ বলেন, হাসাদ বা ঈর্ষা হচ্ছে, অন্যের প্রাপ্ত নেয়ামতের অপসারণ কামনা করা। যা হারাম ও নিন্দনীয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পরের প্রতি মুখ ফিরিয়ে রেখো না; বরং আল্লাহর বান্দা ও পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও। আর কোন মুসলিম ভাইয়ের পক্ষে অন্য মুসলিম ভাইয়ের প্রতি তিন দিনের বেশী সময় পর্যন্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে রাখা জায়েয নয়। [বুখারী: ৬০৭৬; মুসলিমঃ ২৫৫৮]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৪) অথবা আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, সে জন্য কি তারা তাদের হিংসা করে?[1] ইব্রাহীমের বংশধরকেও তো ধর্মগ্রন্থ ও প্রজ্ঞা প্রদান করেছিলাম এবং তাদেরকে বিশাল রাজ্য দান করেছিলাম।

[1] اَم (নাকি, অথবা) بَل (বরং) অর্থেও ব্যবহার হতে পারে। অর্থাৎ, বরং এরা এই বলে হিংসা করে যে, মহান আল্লাহ বানী-ইসরাঈলদেরকে বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্য থেকে (সর্বশেষ) নবী কেন বানালেন? আর এ কথা বিদিত যে, নবুঅত হল আল্লাহর সব থেকে বড় অনুগ্রহ।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৫ فَمِنۡهُمۡ مَّنۡ اٰمَنَ بِهٖ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ صَدَّ عَنۡهُ ؕ وَ كَفٰی بِجَهَنَّمَ سَعِیۡرًا ﴿۵۵﴾
فمنهم من امن بهٖ و منهم من صد عنه و كفی بجهنم سعیرا ﴿۵۵﴾
অতঃপর তাদের অনেকে এর প্রতি ঈমান এনেছে এবং অনেকে এ থেকে বিরত থেকেছে। আর দগ্ধকারী হিসেবে জাহান্নামই যথেষ্ট।

-আল-বায়ান

অতঃপর তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার উপর ঈমান আনল এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখল, (দগ্ধ করার জন্য) প্রজ্জ্বলিত জাহান্নামই যথেষ্ট।

-তাইসিরুল

অনন্তর তাদের মধ্যে অনেকে ওর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং অনেকেই ওটা হতে বিরত রয়েছে; এবং (তাদের জন্য) শিখা বিশিষ্ট জাহান্নামই যথেষ্ট।

-মুজিবুর রহমান

And some among them believed in it, and some among them were averse to it. And sufficient is Hell as a blaze.

-Sahih International

৫৫. অতঃপর তাদের কিছু সংখ্যক তাতে ঈমান এনেছিল এবং কিছু সংখ্যক তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল(১); আর দগ্ধ করার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।

(১) মুজাহিদ বলেন, অর্থাৎ তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান এনেছিল। আর কেউ কেউ রাসূলের পথ থেকে মানুষকে বিরত রাখছিল। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৫) অতঃপর তাদের কিছু লোক তাতে বিশ্বাস করেছে এবং কিছু তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। [1] বস্তুতঃ দগ্ধ করার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট।

[1] অর্থাৎ, ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর বানী-ইস্রাঈলদেরকে আমি নবুঅত এবং বিশাল রাজত্ব ও বাদশাহীও দিয়েছি। তা সত্ত্বেও ইয়াহুদীদের সমস্ত লোক তাঁদের উপর ঈমান আনেনি। কিছু লোক ঈমান এনেছিল এবং কিছু লোক ঈমান আনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ, হে মুহাম্মাদ! এদের আপনার নবুঅতের উপর ঈমান না আনা কোন নতুন কথা নয়। ওদের ইতিহাস তো নবীদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করায় পরিপূর্ণ; এমন কি নিজেদের বংশোদ্ভূত নবীদের উপরও ঈমান আনেনি। কেউ কেউ آمَنَ بِهِ তে ‘হি’ সর্বনাম থেকে নবী করীম (সাঃ)-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, এই ইয়াহুদীদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক মানুষ নবী করীম (সাঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে এবং কিছু সংখ্যক মানুষ অস্বীকার করেছে। নবুঅতের এই অস্বীকারকারীদের পরিণাম হল জাহান্নাম।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৬ اِنَّ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا بِاٰیٰتِنَا سَوۡفَ نُصۡلِیۡهِمۡ نَارًا ؕ كُلَّمَا نَضِجَتۡ جُلُوۡدُهُمۡ بَدَّلۡنٰهُمۡ جُلُوۡدًا غَیۡرَهَا لِیَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَزِیۡزًا حَكِیۡمًا ﴿۵۶﴾
ان الذین كفروا بایتنا سوف نصلیهم نارا كلما نضجت جلودهم بدلنهم جلودا غیرها لیذوقوا العذاب ان الله كان عزیزا حكیما ﴿۵۶﴾
নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাব আগুনে। যখনই তাদের চামড়াগুলো পুড়ে যাবে তখনই আমি তাদেরকে পালটে দেব অন্য চামড়া দিয়ে যাতে তারা আস্বাদন করে আযাব। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

-আল-বায়ান

যারা আমার আয়াতসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে আগুনে দগ্ধ করব, যখন তাদের গায়ের চামড়া দগ্ধ হবে, আমি সেই চামড়াকে নতুন চামড়া দ্বারা বদলে দেব যেন তারা (শাস্তির পর) শাস্তি ভোগ করে। আল্লাহ নিশ্চয়ই পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞানময়।

-তাইসিরুল

যারা আমার নিদর্শনসমূহের প্রতি অবিশ্বাসী হয়েছে তাদেরকে অবশ্যই আমি জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাব। যখন তার চর্ম বিদগ্ধ হবে, আমি তৎপরিবর্তে তাদের চর্ম পরিবর্তন করে দিব, যেন তারা শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করে, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রান্ত, হিকমাতের অধিকারী।

-মুজিবুর রহমান

Indeed, those who disbelieve in Our verses - We will drive them into a Fire. Every time their skins are roasted through We will replace them with other skins so they may taste the punishment. Indeed, Allah is ever Exalted in Might and Wise.

-Sahih International

৫৬. নিশ্চয় যারা আমাদের আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে অবশ্যই তাদেরকে আমরা আগুনে পোড়াব; যখনই তাদের চামড়া পুড়ে পাকা দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চামড়া বদলে দেব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে(১)। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

(১) এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে মু'আয রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে, তাদের শরীরের চামড়াগুলো যখন জ্বলে-পুড়ে যাবে, তখন সেগুলো পাল্টে দেয়া হবে এবং এ কাজটি এত দ্রুতগতিতে সম্পাদিত হবে যে, এক মুহুর্তে শতবার চামড়া পাল্টানো যাবে। হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আগুন তাদের চামড়াকে একদিনে সত্তর হাজার বার খাবে। যখন তাদের চামড়া খেয়ে ফেলবে, অমনি সেসব লোককে বলা হবে, তোমরা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাও। সাথে সাথে সেগুলো পূর্বের মত হয়ে যাবে। [ইবন কাসীরঃ ১/৫১৪]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৬) নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করে তাদেরকে আমি অচিরেই আগুনে প্রবিষ্ট করব।[1] যখনই তাদের চর্ম দগ্ধ হবে, তখনই ওর স্থলে নূতন চর্ম সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে থাকে।[2] নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

[1] অর্থাৎ, জাহান্নামে কেবল কিতাবধারীদের অস্বীকারকারীরাই যাবে না, বরং অন্য সমস্ত কাফেরদের ঠিকানাও হবে জাহান্নাম।

[2] এখানে রয়েছে জাহান্নামের শাস্তি ও আযাবের ভয়াবহতা, তাঁর বিরতিহীনতা এবং তার একাধারে অব্যাহত থাকার বর্ণনা। কোন কোন সাহাবী থেকে বর্ণিত উক্তিতে এসেছে যে, চামড়ার এই পরিবর্তনের কাজ দিনে কয়েক শতবার হবে। (যেহেতু উষ্ণতা ও দগ্ধের জ্বালা ত্বকেই বেশী অনূভূত হয়, তাই মহান আল্লাহর এই ব্যবস্থা।) বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনায় এসেছে যে, জাহান্নামীরা জাহান্নামে এত মোটা হয়ে যাবে যে, তাদের এক কাঁধ হতে অন্য কাঁধের দূরত্ব হবে দ্রুতগামী সওয়ারীর তিন দিনের পথ। তাদের চামড়ার স্থূলতা হবে সত্তর হাত এবং চোয়ালের দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের মত।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৭ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ سَنُدۡخِلُهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَاۤ اَبَدًا ؕ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ۫ وَّ نُدۡخِلُهُمۡ ظِلًّا ظَلِیۡلًا ﴿۵۷﴾
و الذین امنوا و عملوا الصلحت سندخلهم جنت تجری من تحتها الانهر خلدین فیها ابدا لهم فیها ازواج مطهرۃ و ندخلهم ظلا ظلیلا ﴿۵۷﴾
আর যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে, অচিরেই আমি তাদেরকে প্রবেশ করাব জান্নাতসমূহে, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে নহরসমূহ। সেখানে তারা হবে স্থায়ী। সেখানে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র স্ত্রীগণ এবং তাদেরকে আমি প্রবেশ করাব বিস্তৃত ঘন ছায়ায়।

-আল-বায়ান

যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করব যার নিম্নে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরবাসী হবে, তাতে তাদের জন্য থাকবে পবিত্র স্ত্রী এবং আমি তাদেরকে চির স্নিগ্ধ ঘন ছায়ায় দাখিল করব।

-তাইসিরুল

আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে সৎ কার্যাবলী সম্পাদন করেছে, নিশ্চয়ই আমি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাব, যার নিম্নে স্রোতস্বিনীসমূহ প্রবাহিতা, তন্মধ্যে তারা চিরকাল অবস্থান করবে; সেখানে তাদের জন্য পবিত্রা সহধর্মিণীগণ রয়েছে এবং আমি তাদেরকে সুবিস্তৃত ছায়া শীতল স্থানে প্রবেশ করাব।

-মুজিবুর রহমান

But those who believe and do righteous deeds - We will admit them to gardens beneath which rivers flow, wherein they abide forever. For them therein are purified spouses, and We will admit them to deepening shade.

-Sahih International

৫৭. আর যারা ঈমান আনে এবং ভাল কাজ করে, অচিরেই আমরা তাদেরকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাব, যার পাদদেশে নদী-নালাসমূহ প্রবাহিত; যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে, সেখানে তাদের জন্য পবিত্র স্ত্রী থাকবে এবং তাদেরকে আমরা চিরস্নিগ্ধ ছায়ায় প্রবেশ করাব।(১)

(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে এর ছায়ায় যদি কোন আরোহণকারী ভ্রমণ করতে চায় তাহলে একশত বছর ভ্রমণ করতে পারবে। তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াত পড়তে পার “আর সম্প্রসারিত ছায়া।” [সূরা আল ওয়াকিয়াঃ ৩০, বুখারীঃ ৩২৫২]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৭) আর যারা বিশ্বাস করে ও ভাল কাজ করে[1] তাদেরকে বেহেশ্তে প্রবেশ করাব; যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী আছে এবং তাদেরকে চিরস্নিগ্ধ ঘন ছায়ায় স্থান দান করব। [2]

[1] কাফেরদের বিপরীত ঈমানদারদের জন্য জান্নাতে নিরবচ্ছিন্ন যে নিয়ামত হবে এই আয়াতে তার আলোচনা করা হচ্ছে। তবে ঈমানদার বলতে এমন ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ যাদের থাকবে অধিকহারে সৎকর্মের সম্বল। – جَعَلَنَا اللهُ مِنْهُم - মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদের প্রত্যেক স্থানে ঈমানের সাথে সাথে সৎকর্মের কথা উল্লেখ করে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এরা (ঈমান ও সৎকর্ম) আপোসে একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নেক আমল ছাড়া ঈমান হল ঐরূপ, যেরূপ সুবাসবিহীন ফুল এবং ফলবিহীন গাছ। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এবং ইসলামের স্বর্ণযুগের মুসলিমরা এ কথা অনুধাবন করে নিয়েছিলেন। তাই তাঁদের জীবন ছিল ঈমানের ফল আমল দ্বারা পরিপূর্ণ। সে যুগে আমলবিহীন বা মন্দ আমলের সাথে ঈমানের কথা কল্পনাই করা যেত না। পক্ষান্তরে বর্তমানে কেবল মৌখিক জমা-খরচের নাম হয়েছে ঈমান। ঈমানের দাবীদারদের ঝুলি নেক আমল থেকে খালি।-هَدَانَا اللهُ تَعَالى- আবার অনেকে সততা, আমানতদারী, দয়া-দাক্ষিণ্য এবং অপরের দুঃখ মোচনের কাজ সহ আরো অনেক নৈতিকতার এমন কাজ করে, যা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু ঈমানের মূলধন থেকে সে বঞ্চিত থাকে। ফলে তার এই কর্মসমূহ দুনিয়াতে তার প্রসিদ্ধি এবং সুনামের মাধ্যম সাব্যস্ত হলেও আখেরাতে আল্লাহর নিকট তার কোন মূল্য থাকবে না। কারণ, নেক আমলকে আল্লাহর নিকট লাভদায়ক সাব্যস্তকারী ঈমানই তার মধ্যে নেই। বরং তার নেক আমলের ভিত্তি ছিল পার্থিব স্বার্থ অথবা জাতিগত অভ্যাস ও নৈতিকতা।

[2] চিরস্নিগ্ধ ঘন এবং পবিত্র ছায়া বলতে পরিপূর্ণ আরামকে বুঝানো হয়েছে। একটি হাদীসে এসেছে যে, ‘‘জান্নাতে একটি গাছ আছে; যার ছায়া এত সুদীর্ঘ যে, এক সওয়ার শত বছর চলার পরও তা অতিক্রম করতে পারবে না। এটা হল, ‘শাজারাতুল খুলদ’ (চিরস্থায়িত্বের গাছ)।’’

(মুসনাদ আহমদ ২/৪৫৫ এর মূল অংশ বুখারীতে জান্নাতের বিবরণ অধ্যায় রয়েছে।)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৮ اِنَّ اللّٰهَ یَاۡمُرُكُمۡ اَنۡ تُؤَدُّوا الۡاَمٰنٰتِ اِلٰۤی اَهۡلِهَا ۙ وَ اِذَا حَكَمۡتُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ اَنۡ تَحۡكُمُوۡا بِالۡعَدۡلِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ نِعِمَّا یَعِظُكُمۡ بِهٖ ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ سَمِیۡعًۢا بَصِیۡرًا ﴿۵۸﴾
ان الله یامركم ان تؤدوا الامنت الی اهلها و اذا حكمتم بین الناس ان تحكموا بالعدل ان الله نعما یعظكم بهٖ ان الله كان سمیعا بصیرا ﴿۵۸﴾
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে তখন ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে কতইনা সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

-আল-বায়ান

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের কাছে পৌঁছে দিতে। তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে কত উত্তম উপদেশই না দিচ্ছেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।

-তাইসিরুল

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করছেন, গচ্ছিত বিষয় ওর অধিকারীকে অর্পণ কর; এবং যখন তোমরা লোকদের মধ্যে বিচার মীমাংসা কর তখন ন্যায় বিচার কর; অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম উপদেশ দান করছেন; নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, পরিদর্শক।

-মুজিবুর রহমান

Indeed, Allah commands you to render trusts to whom they are due and when you judge between people to judge with justice. Excellent is that which Allah instructs you. Indeed, Allah is ever Hearing and Seeing.

-Sahih International

৫৮. নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানত(১) তার হকদারকে ফিরিয়ে দিতে।(২) তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে(৩)। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা কত উৎকৃষ্ট(৪)! নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।(৫)

(১) আলোচ্য আয়াতগুলোর মধ্যে প্রথম আয়াতটি নাযিল হওয়ার একটি বিশেষ ঘটনা রয়েছে। তা হল এই যে, ইসলাম-পূর্বকালেও কা'বা ঘরের সেবা করাকে এক বিশেয মর্যাদার কাজ মনে করা হত। কাবার কোন বিশেষ খেদমতের জন্য যারা নির্বাচিত হত, তারা গোটা সমাজ তথা জাতির মাঝে সম্মানিত ও বিশিষ্ট বলে পরিগণিত হত। সে জন্যই বায়তুল্লাহর বিশেষ খেদমত বিভিন্ন লোকের মাঝে ভাগ করে দেয়। হত। জাহেলিয়াত আমল থেকেই হজের মওসুমে হাজীদেরকে যমযম কূপের পানি পান করানোর সেবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতৃব্য আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উপর ন্যস্ত ছিল। একে বলা হত ‘সিকায়া’।

অনুরূপই কাবা ঘরের চাবি নিজের কাছে রাখা এবং নির্ধারিত সময়ে তা খুলে দেয়া ও বন্ধ করার ভার ছিল উসমান ইবন তালহার উপর। এ ব্যাপারে স্বয়ং উসমান ইবন তালহার ভাষ্য হল এই যে, জাহেলিয়াত আমলে আমরা সোমবার ও বৃহস্পতিবার দিন বায়তুল্লাহর দরজা খুলে দিতাম এবং মানুষ তাতে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য অর্জন করত। হিজরতের পূর্বে একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় সাহাবীসহ বায়তুল্লাহর উদ্দেশ্যে গেলে উসমান (যিনি তখনো পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেননি) তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ধৈর্য ও গাম্ভীর্য সহকারে উসমানের কটুক্তিসমূহ সহ্য করে নিলেন।

অতঃপর বললেন, হে উসমান হয়ত তুমি এক সময় বায়তুল্লাহর এই চাবি আমার হাতেই দেখতে পাবে। তখন যাকে ইচ্ছা এই চাবি অর্পণ করার অধিকার আমারই থাকবে। উসমান ইবন তালহা বলল, তাই যদি হয়, তবে সেদিন কুরাইশরা অপমানিত অপদস্থ হয়ে পড়বে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তা নয়। তখন কুরাইশরা আযাদ হবে, তারা হবে যথার্থ সম্মানে সম্মানিত। এ কথা বলতে বলতে তিনি বায়তুল্লাহর ভিতরে প্রবেশ করলেন।

(উসমান বললেন) তারপর আমি যখন আমার মনের ভিতর অনুসন্ধান করলাম, তখন আমার যেন নিশ্চিত বিশ্বাস হয়ে গেল যে, তিনি যা কিছু বললেন, তা অবশ্যই ঘটবে। সে মুহুর্তেই আমি মুসলিম হয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে নিলাম। কিন্তু আমি আমার সম্প্রদায়ের মতিগতি পরিবর্তিত দেখতে পেলাম। তারা আমাকে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করতে লাগল। কাজেই আমি আর আমার (মুসলিম হওয়ার) সংকল্প বাস্তবায়িত করতে পারলাম না। অতঃপর মক্কা বিজিত হয়ে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বায়তুল্লাহর চাবি চাইলেন। আমি তা পেশ করে দিলাম। তখন তিনি পুনরায় আমার হাতেই সে চাবি ফিরিয়ে দিলেন এবং বললেনঃ এই নাও, এখন থেকে এ চাবি কেয়ামত পর্যন্ত তোমার বংশধরদের হাতেই থাকবে। অন্য যে কেউ তোমাদের হাত থেকে ফিরিয়ে নিতে চাইবে, সে হবে যালেম, অত্যাচারী। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদের হাত থেকে এ চাবি ফিরিয়ে নেবার কোন অধিকার কারোরই থাকবে না। [দেখুন- তাবারানী ১১/১২০]

আয়াতের সারমর্ম হচ্ছে এই যে, যার দায়িত্বে কোন আমানত থাকবে, সে আমানত প্রাপককে পৌছে দেয়া তার একান্ত কর্তব্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানত প্রত্যপণের ব্যাপারে বিশেষ তাকীদ প্রদান করেছেন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এমন খুব কম হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ভাষণ দিয়েছেন অথচ তাতে একথা বলেননি – ‘যার মধ্যে আমানতদারী নেই তার মধ্যে ঈমান নেই। আর যার মধ্যে প্রতিশ্রুতি রক্ষার নিয়মানুবর্তিতা নেই, তার দ্বীন নেই’। [মুসনাদে আহমাদ ৩/১৩৫] তাছাড়া আমানতদারী না থাকা মুনাফেকীর একটি আলামত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন মুনাফেকীর লক্ষণসমূহ বর্ণনা প্রসঙ্গে একটি লক্ষণ এটাও বলেছিলেন যে, যখন তার কাছে কোন আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে। [বুখারী ৩৩; মুসলিম: ৫৯]

(২) এখানে লক্ষণীয় যে, কুরআনুল কারীম আমানতের বিষয়টিকে أَمَانَات বহুবচনে উল্লেখ করেছে। এতে ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে যে, কারো নিকট অপর কারো কোন বস্তু বা সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধুমাত্র আমানত নয়, যাকে সাধারণতঃ আমানত বলে অভিহিত করা হয় এবং মনে করা হয়; বরং আমানতের আরো কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। আয়াতের শানে-নুযূল প্রসঙ্গে উপরে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে, তাও কোন বস্তুগত আমানত ছিল না। কারণ, বায়তুল্লাহর চাবি বিশেষ কোন বস্তু নয়, বরং তা ছিল বায়তুল্লাহর খেদমতের একটা পদের নিদর্শন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, রাষ্ট্রীয় যত পদ ও পদমর্যাদা রয়েছে, সেসবই আল্লাহ তা'আলার আমানত।

যাদের হাতে নিয়োগ-বরখাস্তের অধিকার রয়েছে সে সমস্ত কর্মকর্তা ও অফিসারবৃন্দ হলেন সে পদের আমানতদার। কাজেই তাদের পক্ষে কোন পদ এমন কাউকে অর্পণ করা জায়েয নয়, যে লোক তার যোগ্য নয়, বরং প্রতিটি পদের জন্য নিজের ক্ষমতা ও সাধ্যানুযায়ী যোগ্য ব্যক্তির অনুসন্ধান করা কর্তব্য। যোগ্যতা ও পরিপূর্ণ শর্ত মোতাবেক কোন লোক পাওয়া না গেলে উপস্থিত লোকদের মধ্যে যোগ্যতা ও আমানতদারী তথা সততার দিক দিয়ে যে সবচেয়ে অগ্রবর্তী হবে, তাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমানতের গুরুত্ব লক্ষ্য করে এক বর্ণনায় এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদ সমস্ত গোনাহের কাফফারা হলেও আমানতের কাফফারা হয় না। জিহাদে শহীদ ব্যক্তিকে সেদিন হাজির করে বলা হবে, আমানত আদায় কর, সে বলবে, কোথেকে তা আদায় করব? দুনিয়া তো শেষ হয়ে গেছে।

তখন তাকে হাবীয়া জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। সে সেখানে গেলে আমানতকে যেদিন ত্যাগ করেছিল সেদিনের রূপে দেখতে পাবে। সে তখন তা ধরে কাধে নিয়ে আসতে চাইবে, যখনি সেখান থেকে সে বের হতে যাবে, তখন আমানত পালিয়ে যাবে, আর এভাবে সে আমানতের পিছনে সবসময় ছুটতে থাকবে। তারপর আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু উপরোক্ত আয়াত পাঠ করলেন। [আল-মাতালিবুল আলীয়া, হিলইয়াতুল আউলিয়া, মাকারিমুল আখলাক] এ আমানতের পরিচয় সম্পর্কে আবুল আলীয়া বলেন, যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যা নিষেধ করা হয়েছে তা সবই আমানত। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

(৩) এ আয়াতে ইসলামের কয়েকটি মৌলিক নীতির আলোচনাও এসে গেছে। প্রথমতঃ প্রকৃত হুকুম ও নির্দেশ দানের মালিক আল্লাহ তা'আলা। পৃথিবীর শাসকবর্গ তার আজ্ঞাবহ। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শাসনক্ষেত্রে সার্বভৌমত্বের মালিকও একমাত্র আল্লাহ্ তা'আলাই। দ্বিতীয়তঃ সরকারী পদসমূহ অধিবাসীদের অধিকার নয়, যা জনসংখ্যার হারে বন্টন করা যেতে পারে; বরং এগুলো হল আল্লাহ প্রদত্ত আমানত, যা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের পক্ষে যোগ্য ও যথার্থ লোককেই দেয়া যেতে পারে। তৃতীয়তঃ পৃথিবীতে মানুষের যে শাসন, তা শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি ও আমানতদার হিসেবেই হতে পারে।

তারা দেশের আইন প্রণয়নে সে সমস্ত নীতিমালার অনুসরণে বাধ্য থাকবে যা একক ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে বাতলে দেয়া হয়েছে। চতুর্থতঃ তাদের নিকট যখন কোন মোকদ্দমা আসবে, তখন বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা এমনকি দ্বীন ও মতবাদের পার্থক্য না করে সঠিক ও ন্যায়সংগত মীমাংসা করে দেয়া শাসন কর্তৃপক্ষের উপর ফরয। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, শাসনকর্তৃপক্ষের উপর ওয়াজিব হলো, আল্লাহর আইন অনুসারে বিচার করা, আমানত আদায় করা। যদি তারা সেটা করে তবে জনগনের উপর কর্তব্য হবে তার কথা শোনা, আনুগত্য করা, তার আহবানে সাড়া দেয়া। [তাবারী]

(৪) এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তোমাদিগকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা খুবই উত্তম। কারণ, আল্লাহ্ তা'আলা সবার ফরিয়াদই শোনেন এবং যে লোক বলার কিংবা ফরিয়াদ করার সামর্থ্য রাখে না, তিনি তার অবস্থাও উত্তমভাবে দেখেন। অতএব তার রচিত নীতিমালাই সর্বদা সকল রাষ্ট্রের জন্য সর্বযুগে উপযোগী হতে পারে। পক্ষান্তরে মানব রচিত নীতিমালা শুধুমাত্র নিজেদের পরিবেশেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেগুলোরও পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

(৫) এ আয়াতের তাফসীর ইমাম আবু দাউদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি তার কানের উপর রাখলেন এবং পরবর্তী আঙ্গুলটি রাখলেন তার চোখের উপর। অর্থাৎ আল্লাহর চোখ ও কান রয়েছে। [আবু দাউদ: ৪৭২৮]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৮) নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আমানত তার মালিককে প্রত্যর্পণ করবে।[1] আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচার-কার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।[2] আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন, তা কত উৎকৃষ্ট![3] নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।

[1] অধিকাংশ মুফাসসিরীনদের নিকট এই আয়াত উসমান বিন ত্বালহা (রাঃ)-এর ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। তিনি বংশগতভাবেই কা’বা শরীফের তত্ত্বাবধায়ক এবং তার চাবি-রক্ষক ছিলেন। তিনি হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর রসূল (সাঃ) কা’বা শরীফে উপস্থিত হয়ে তওয়াফ ইত্যাদি সেরে নিয়ে উসমান বিন ত্বালহা (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। অতঃপর তাঁর হাতে কা’বা শরীফের চাবি হস্তান্তর করে বললেন, এগুলো তোমার চাবি। আজকের দিন হল, অঙ্গীকার পূরণ ও পুণ্যের দিন। (ইবনে কাসীর) কোন বিশেষ কারণে আয়াত অবতীর্ণ হলেও তার নির্দেশ সাধারণ এবং এতে সাধারণ ব্যক্তিবর্গ ও শাসকশ্রেণী উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। উভয়কে তাকীদ করা হয়েছে যে, আমানতসমূহ তাদের প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। এতে প্রথমতঃ এমন আমানতও শামিল যা কারো কাছে হিফাযতের জন্য রাখা হয়। এতে খিয়ানত না করে চাওয়ার সময় হিফাযতের সাথে যেন তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়তঃ পদ ও দায়িত্ব যোগ্য লোকদেরকেই যেন দেওয়া হয়। কেবল রাজনৈতিক ভিত্তিতে অথবা বংশ, দেশ ও জাতিগত ভিত্তিতে কিংবা আত্মীয়তা ও কোটা ভিত্তিক নিয়মে পদ ও দায়িত্ব দেওয়া এই আয়াতের পরিপন্থী।

[2] এতে বিশেষ করে শাসকদেরকে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখার এবং সুবিচার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি হাদীসে এসেছে যে, ‘‘বিচারক যতক্ষণ পর্যন্ত যুলুম করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তার সাথে থাকেন। অতঃপর সে যখন যুলুম শুরু করে দেয়, তখন আল্লাহ তাকে তার নিজের উপর ছেড়ে দেন।’’ (ইবনে মাজা)

[3] অর্থাৎ, আমানতসমূহ তাদের প্রাপকদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার বজায় রাখার উপদেশ।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৫৯ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡكُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ كُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِكَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا ﴿۵۹﴾
یایها الذین امنوا اطیعوا الله و اطیعوا الرسول و اولی الامر منكم فان تنازعتم فی شیء فردوه الی الله و الرسول ان كنتم تؤمنون بالله و الیوم الاخر ذلك خیر و احسن تاویلا ﴿۵۹﴾
হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর তাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখ। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।

-আল-বায়ান

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর অনুগত হও এবং রসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের; যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রসূলের (নির্দেশের) দিকে ফিরিয়ে দাও যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখিরাত দিবসের প্রতি ঈমান এনে থাক; এটাই উত্তম এবং সুন্দরতম মর্মকথা।

-তাইসিরুল

হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর ও রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের জন্য যারা বিচারক তাদের; অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে কোন মতবিরোধ হয় তাহলে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক; এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর পরিসমাপ্তি।

-মুজিবুর রহমান

O you who have believed, obey Allah and obey the Messenger and those in authority among you. And if you disagree over anything, refer it to Allah and the Messenger, if you should believe in Allah and the Last Day. That is the best [way] and best in result.

-Sahih International

৫৯. হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের(১), অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।

(১) ‘উলুল আমর’ আভিধানিক অর্থে সে সমস্ত লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে। সে কারণেই ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা, মুজাহিদ ও হাসান বসরী রাহিমাহুমাল্লাহ প্রমূখ মুফাসসিরগণ ওলামা ও ফোকাহা সম্প্রদায়কে ‘উলুল আমর’ সাব্যস্ত করেছেন। তারাই হচ্ছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নায়েব বা প্রতিনিধি ৷ তাদের হাতেই দ্বীনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত। মুফাসসিরীনের অপর এক জামা'আত-যাদের মধ্যে আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রমূখ সাহাবায়ে কেরামও রয়েছেন-বলেছেন যে, ‘উলুল আমর’ এর অর্থ হচ্ছে সে সমস্ত লোক, যাদের হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। ইমাম সুদ্দী এ মত পোষণ করেন। এছাড়া তাফসীরে ইবন কাসীরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ শব্দটির দ্বারা (ওলামা ও শাসক) উভয় শ্রেণীকেই বোঝায়। কারণ, নির্দেশ দানের বিষয়টি তাদের উভয়ের সাথেই সম্পর্কিত। আল্লামা আবু বকর জাসসাস এতদুভয় মত উদ্ধৃত করার পর বলেছেন, সঠিক ব্যাপার হলো এই যে, এতদুভয় অর্থই ঠিক। কারণ, ‘উলুল আমর’ শব্দটি উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অবশ্য এতে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন যে, উলুল আমর বলতে ফকীহগণকে বোঝানো যেতে পারে না। তার কারণ, أُولُو الْأَمْر (উলুল আমর) শব্দটি তার শাব্দিক অর্থের দিক দিয়ে সে সমস্ত লোককে বোঝায়, যাদের হুকুম বা নির্দেশ চলতে পারে। বলাবাহুল্য, এ কাজটি ফকীহগণের নয়। প্রকৃত বিষয় হলো এই যে, হুকুম চলার দুটি প্রেক্ষিত রয়েছে। (এক) জবরদস্তিমূলক। এটা শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠী বা সরকার দ্বারাই সম্ভব হতে পারে। (দুই) বিশ্বাস ও আস্থার দরুন হুকুম মান্য করা। আর সেটা ফকীহগণই অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং যা সর্বযুগে মুসলিমদের অবস্থার দ্বারা প্রতিভাত হয়। দ্বীনী ব্যাপারে সাধারণ মুসলিমগণ নিজের ইচ্ছা ও মতামতের তুলনায় আলেম সম্প্রদায়ের নির্দেশকে অবশ্য পালনীয় বলে সাব্যস্ত করে থাকে। তাছাড়া শরীআতের দৃষ্টিতেও সাধারণ মানুষের জন্য আলেমদের হুকুম মান্য করা ওয়াজিবও বটে। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রেও ‘উলুল আমর’-এর প্রয়োগ যথার্থ হবে।

তাফসীরে জাকারিয়া

(৫৯) হে বিশ্বাসিগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর, তাহলে তোমরা আল্লাহর অনুগত হও, রসূল ও তোমাদের নেতৃবর্গ (ও উলামা)দের অনুগত হও।[1] আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। এটিই হল উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।[2]

[1] اُولُو الأمر (উলুল আম্র) বলতে কেউ বলেছেন, নেতা ও শাসকগণ। কেউ বলেছেন, উলামা ও ফুক্বাহাগণ। অর্থের দিক দিয়ে উভয় শ্রেণীর মান্যবরদেরকেই বুঝানো যেতে পারে। উদ্দেশ্য এই যে, প্রকৃত আনুগত্য তো আল্লাহর প্রাপ্য। কারণ তিনি বলেছেন, أَلاَ لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ ‘‘জেনে রাখো, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ।’’ (আ’রাফঃ ৫৪) [اِنِ الْحُكْمُ إلاَّ للهِ] ‘‘বিধান দেওয়ার অধিকার শুধু আল্লাহরই।’’ (ইউসুফঃ ৪০) কিন্তু রসূল (সাঃ) যেহেতু মহান আল্লাহর ইচ্ছার এক নিষ্ঠাবান প্রকাশক এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথগুলো (মানুষের কাছে) তুলে ধরার ব্যাপারে তিনি তাঁর প্রতিনিধি, এ জন্যই মহান আল্লাহর স্বীয় আনুগত্যের সাথে সাথে রসূল (সাঃ)-এর আনুগত্য করাকেও ওয়াজেব করে দেন এবং বলেন যে, রসূলের আনুগত্য করলে প্রকৃতপক্ষে তাঁরই আনুগত্য করা হয়। [مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ] ‘‘যে ব্যক্তি রসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল।’’ (নিসাঃ ৮০) এ থেকে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হাদীসও কুরআনের মত দ্বীনের দলীল। এ ছাড়া আমীর ও শাসকের আনুগত্য করাও জরুরী। কারণ, হয় তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশের বাস্তবায়ন করেন অথবা সকল মানুষের কল্যাণ সাধনের ব্যবস্থাপনা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আমীর ও শাসকের আনুগত্য করা জরুরী হলেও তা একেবারে শর্তহীনভাবে নয়, বরং তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্যের শর্তসাপেক্ষ। আর এই কারণেই أَطِيْعُوا الله এর পরই أَطِيْعُوا الرَّسُوْل বলেছেন। কেননা, এই উভয় আনুগত্যই স্বতন্ত্র ও ওয়াজেব। পক্ষান্তরে وَأَطِيْعُوا أُولِي الأَمْر বলেননি, কারণ উলুল আম্র বা শাসকদের আনুগত্য স্বতন্ত্র নয়। আর হাদীসে বলা হয়েছে যে, (لا طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِي مَعْصِيَةِ الخَالِقِ) ‘‘আল্লাহর অবাধ্যাচরণে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’’ (মিশকাত ৩৬৯৬, আল্লামা আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।) মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে, ‘‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই।’’ (মুসলিম ১৮৪০নং) বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, (إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي المَعْرُوْفِ) ‘‘আনুগত্য হবে কেবল ভালো কাজে।’’ (বুখারী ৭১৪৫) ‘শাসকের কথা শুনতে হবে ও তাঁর আনুগত্য করতে হবে যতক্ষণ না (আল্লাহ ও তাঁর রসূলের) অবাধ্যতা হবে।’ আলেম-উলামার ব্যাপারটাও অনুরূপ। (যদি তাঁদেরকে শাসকদের মধ্যে শামিল করা হয়) অর্থাৎ, তাঁদের আনুগত্য এই জন্যই করতে হবে যে, তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের যাবতীয় বিধি-বিধান বর্ণনা করেন এবং তাঁর দ্বীনের জন্য পথ-প্রদর্শকের কাজ করেন। বুঝা গেল যে, দ্বীনি বিষয়ে এবং দ্বীন সম্পর্কীয় কার্যকলাপে আলেম-উলামা শাসকদের মতই এমন কেন্দ্রীয়-মর্যাদাসম্পন্ন যে, জনসাধারণ তাঁদের প্রতি রুজু করে থাকে। তবে তাঁদের আনুগত্য ততক্ষণ পর্যন্ত করা যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা জনসাধারণকে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা শুনাবেন। কিন্তু তাদের বিপথগামী (বা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীতগামী) হওয়ার কথা স্পষ্ট হলে তাঁদের আনুগত্য করা যাবে না। বরং এই অবস্থায় তাঁদের আনুগত্য করলে বড় অপরাধ ও গুনাহ হবে।

[2] আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ, কুরআনের দিকে রুজু করা এবং এখন রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ হল, (সহীহ) হাদীসের দিকে রুজু করা। বিবাদী সমস্যার সমাধানের জন্য এটা হল অতি উত্তম এক মৌলিক নীতি। আর এই মৌলিক নীতি থেকে এ কথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তৃতীয় কোন ব্যক্তিত্বের আনুগত্য ওয়াজেব নয়। যেমন, ব্যক্তি অনুকরণ অথবা নির্দিষ্ট করে কারো অন্ধানুকরণ করার সমর্থকরা তৃতীয় আর এক আনুগত্যকে জরুরী সাব্যস্ত করেছে। আর কুরআনের আয়াতের প্রকাশ্য বিরোধী তৃতীয় এই আনুগত্য মুসলিমদেরকে ঐক্যবদ্ধ এক উম্মতে পরিণত করার পরিবর্তে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন উম্মতে পরিণত করেছে এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াকে প্রায় অসম্ভব করে দিয়েছে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৪ : ৬০ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ یَزۡعُمُوۡنَ اَنَّهُمۡ اٰمَنُوۡا بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡكَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَ مِنۡ قَبۡلِكَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَحَاكَمُوۡۤا اِلَی الطَّاغُوۡتِ وَ قَدۡ اُمِرُوۡۤا اَنۡ یَّكۡفُرُوۡا بِهٖ ؕ وَ یُرِیۡدُ الشَّیۡطٰنُ اَنۡ یُّضِلَّهُمۡ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا ﴿۶۰﴾
الم تر الی الذین یزعمون انهم امنوا بما انزل الیك و ما انزل من قبلك یریدون ان یتحاكموا الی الطاغوت و قد امروا ان یكفروا بهٖ و یرید الشیطن ان یضلهم ضللا بعیدا ﴿۶۰﴾
তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে তার উপর, যা নাযিল করা হয়েছে তোমার প্রতি এবং যা নাযিল করা হয়েছে তোমার পূর্বে। তারা তাগূতের কাছে বিচার নিয়ে যেতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাকে অস্বীকার করতে। আর শয়তান চায় তাদেরকে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত করতে।

-আল-বায়ান

তুমি কি সেই লোকেদের প্রতি লক্ষ্য করনি, যারা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ কিতাবের এবং তোমার আগে অবতীর্ণ কিতাবের উপর ঈমান এনেছে বলে দাবী করে, কিন্তু তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, অথচ তাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, শয়ত্বান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে বহুদূরে নিয়ে যেতে চায়।

-তাইসিরুল

তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি যারা দাবী করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তৎপ্রতি তারা বিশ্বাস করে? অথচ তারা নিজেদের মুকাদ্দামা তাগুতের নিকট নিয়ে যেতে চায়, যদিও তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল যেন তাকে অবিশ্বাস করে; পক্ষান্তরে শাইতান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

-মুজিবুর রহমান

Have you not seen those who claim to have believed in what was revealed to you, [O Muhammad], and what was revealed before you? They wish to refer legislation to Taghut, while they were commanded to reject it; and Satan wishes to lead them far astray.

-Sahih International

৬০. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা ঈমান এনেছে, অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও সেটাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(৬০) তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা ধারণা (ও দাবী) করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে তারা বিশ্বাস করে? অথচ তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়; যদিও তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ৫১ থেকে ৬০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৭৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 7 · · · 15 16 17 18 পরের পাতা »