-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫১. যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছি(১) যিনি তোমাদের কাছে আমাদের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন। আর তা শিক্ষা দেন যা তোমরা জানতে না।
(১) এ পর্যন্ত কেবলা পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা চলে আসছিল। এখানে বিষয়টিকে এমন এক পর্যায়ে এনে সমাপ্ত করা হয়েছে, যাতে বিষয়টির ভূমিকায় কা’বা নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দো'আর বিষয়টিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশধরদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদায় মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব। এতে এ বিষয়েও ইংগিত করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবে কা'বা নির্মাতার দো'আরও একটা প্রভাব রয়েছে। কাজেই তার কেবলা যদি কা'বা শরীফকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিংবা অস্বীকারের কিছু নেই।
(كَمَا أَرْسَلْنَاكَ) বাক্যে উদাহরণসূচক যে ‘কাফ (ك) বর্ণটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার একটি ব্যাখ্যা তো উল্লেখিত তাফসীরের মাধ্যমেই বুঝা গেছে। এছাড়াও আরেকটি বিশ্লেষণ রয়েছে, যা কুরতুবী গ্রহণ করেছেন। তা হলো এই যে, ‘কাফ’ এর সম্পর্ক হলো পরবর্তী আয়াত (فَاذْكُرُونِي) এর সাথে। অর্থাৎ আমি যেমন তোমাদের প্রতি কেবলাকে একটি নেয়ামত হিসাবে দান করেছি অতঃপর দ্বিতীয় নেয়ামত দিয়েছি রাসূলের আবির্ভাবের মাধ্যমে, তেমনি আল্লাহর যিকরও আরেকটি নেয়ামত। সুতরাং এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর, যাতে এসব নেয়ামতের অধিকতর প্রবৃদ্ধি হতে পারে। [তাফসীরে মা'আরিফুল কুরআন]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫১) যেভাবে[1] আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদেরই একজনকে রসূল করে পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াত (বাক্য)সমূহ তোমাদের কাছে পাঠ করে, তোমাদেরকে (শিরক হতে) পবিত্র করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়।
[1] كَمَا (যেভাবে) এর সম্পর্ক পূর্বের বক্তব্যের সাথে। অর্থাৎ, উক্ত অনুগ্রহের পরিপূর্ণতা এবং হিদায়াতের তওফীক তোমরা ঐভাবেই পেয়েছ, যেভাবে এর আগে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করা হয়েছে, যে তোমাদেরকে পবিত্র করে, তোমাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয় এবং এমন বিষয়ও শিক্ষা দেয় যা তোমরা জানতে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫২. কাজেই তোমরা আমাকে স্মরণ কর(১), আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ে না।
(১) যিকর আরবী শব্দ। এর বেশ কয়েকটি অর্থ হতে পারে-
(ক) মুখ থেকে যা উচ্চারণ করা হয়।
(খ) অন্তরে কোন কিছু স্মরণ করা।
(গ) কোন জিনিস সম্পর্কে সতর্ক করা।
শরী'ঈ পরিভাষায় যিকর হচ্ছে, বান্দা তার রবকে স্মরণ করা। হোক তা তার নাম নিয়ে, গুণ নিয়ে, তার কাজ নিয়ে, প্রশংসা করে, তার কিতাব তিলাওয়াত করে, তার একত্ববাদ ঘোষণা করে, তার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে অথবা তার কাছে কিছু চেয়ে।
যিকর দুই প্রকার। যথা - কওলী বা কথার মাধ্যমে যিকর ও আমলী বা কাজের মাধ্যমে যিকর। প্রথম প্রকার যিকরের মধ্যে রয়েছে - কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম ও সিফাতসমূহের আলোচনা ও স্মরণ, তার একত্ববাদ ঘোষণা ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় প্রকারে রয়েছে - ইলম অর্জন করা ও শিক্ষা দেয়া, আল্লাহর হুকুম-আহকাম ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি। প্রথম প্রকার যিকরের মধ্যে কিছু যিকর আছে যা সময়, অবস্থা এবং সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, সকাল ও সন্ধ্যার যিকর, সালাতের পরের যিকর, খাওয়ার শুরু-শেষ, কাপড় পরিধান, মসজিদে প্রবেশ-বাহির ইত্যাদি সহ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ-কর্মের দোআ বা যিকরসমূহ। যে সকল যিকর অবস্থা, সময় ও সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোর সংখ্যা, সময় অথবা অবস্থা কোনটিরই পরিবর্তন করা জায়েয নেই। যে সকল যিকর এ তিনটির সাথে সম্পৃক্ত নয় অর্থাৎ সাধারণ যিকর, সেগুলো সময়, সংখ্যা অথবা অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করাও জায়েয নেই। ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘মৌখিক যিকরের জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হওয়া এবং নির্দিষ্ট শব্দ নির্ধারণ করা বিদ'আত’। [ইবনুল হুমাম, শরহে ফাতহুল কাদীরঃ ২/৭২]
যিকর এর ফযীলত অসংখ্য। তন্মধ্যে এটাও কম ফযীলত নয় যে, বান্দা যদি আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহও তাকে স্মরণ করেন। আবু উসমান নাহদী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, আমি সে সময়টির কথা জানি, যখন আল্লাহ তা'আলা আমাদিগকে স্মরণ করেন। উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কেমন করে জানতে পারেন? বললেন, তা এজন্য যে, কুরআনুল কারীমের ওয়াদা অনুসারে যখন কোন মুমিন বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ নিজেও তাকে স্মরণ করেন। কাজেই বিষয়টি জানা সবার জন্যই সহজ যে, আমরা যখন আল্লাহর স্মরণে আত্মনিয়োগ করব, আল্লাহ্ তা'আলাও আমাদের স্মরণ করবেন।
সাঈদ ইবনে যুবায়ের রাহিমাহুল্লাহ যিকরুল্লাহ'র তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যিকরের অর্থই হচ্ছে আনুগত্য এবং নির্দেশ মান্য করা। তার বক্তব্য হচ্ছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করে না, সে আল্লাহর যিকরই করে না; প্রকাশ্যে যতবেশী সালাত এবং তাসবীহই সে পাঠ করুক না কেন। মূলত: যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা'আলার আনুগত্য করে অর্থাৎ তার হালাল ও হারাম সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর অনুসরণ করে, সেই আল্লাহকে স্মরণ করে, যদি তার নফল সালাত ও সিয়াম কিছু কমও হয়। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে সে সালাত-সিয়াম, তাসবীহ-তাহলীল প্রভৃতি বেশী করে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহকে স্মরণ করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ যে ব্যক্তি যিকর করে এবং যে ব্যক্তি যিকর করেনা তাদের উপমা হচ্ছে জীবিত ও মৃতের ন্যায়। [বুখারীঃ ২০৮]
অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদেরকে কি এমন একটি উত্তম আমলের সংবাদ দেব যা তোমাদের মালিকের নিকট অধিকতর পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক, স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যয় করা থেকেও তোমাদের জন্য উত্তম, শক্রর সাথে মোকাবেলা করে গর্দান দেয়া-নেয়া থেকে উত্তম? তারা বলল, হ্যাঁ অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন, যিকরুল্লাহ। [তিরমিযীঃ ৫/৪৫৯]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত এক হাদীসে-কুদসীতে আছে, আল্লাহ্ তাআলা বলেন, বান্দা যে পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করতে থাকে বা আমার স্মরণে যে পর্যন্ত তার ঠোট নড়তে থাকে, সে পর্যন্ত আমি তার সাথে থাকি। [বুখারীঃ ৭৪০৫] মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আল্লাহর আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মানুষের কোন আমলই যিকরুল্লাহর সমান নয়।” যুন্নুন মিসর বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি প্রকৃতই আল্লাহকে স্মরণ করে সে অন্যান্য সবকিছুই ভুলে যায়। এর বদলায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলাই সবদিক দিয়ে তাকে হেফাজত করেন এবং সবকিছুর বদলা তাকে দিয়ে দেন’।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫২) অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর কৃতঘ্ন হয়ো না।[1]
[1] অতএব এই অনুগ্রহ ও নিয়ামতের দরুন তোমরা আমার যিকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। অকৃতজ্ঞ হয়ে নিয়ামতকে অস্বীকার করো না। আর যিকর (স্মরণ) করার অর্থ হল, সদা-সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা। অর্থাৎ, ‘তাসবীহ’ (সুবহানাল্লাহ), ‘তাহলীল’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ) এবং ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতে থাকো। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার অর্থ হল, আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও সামর্থ্যকে তাঁর (পক্ষ থেকেই আগত মনে করে তাঁরই সন্তুষ্টি ও) আনুগত্যের পথে ব্যয় করা। আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিকে তাঁর অবাধ্যতায় ব্যয় না করা। (এবং মুখে আল্লাহর প্রশংসার সাথে তা বয়ান করা।) এ রকম করলে আল্লাহর অকৃতজ্ঞ তথা নিয়ামতের কুফরী করা হয়। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে আরো অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ এবং অকৃতজ্ঞ হলে কঠিন শাস্তি পাওয়ার কথা এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দান করব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সূরা ইবরাহীম ৭ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
*পবিত্র কুরআনের অনেক স্থানে আল্লাহ নেককারদের সাথে আছেন, ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন ইত্যাদি বলা হয়েছে। তিনি আরশের উপর থেকেও বান্দাকে সাহায্য সহযোগিতা করার মাধ্যমে তার সাথে রয়েছেন বলে বুঝে নিতে হবে।
১৫৩. হে ঈমানদারগণ! তোমরা সাহায্য চাও সবর(১) ও সালাতের মাধ্যমে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সবরকারীদের সাথে আছেন।(২)
(১) ‘সবর’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সংযম অবলম্বন ও নফস্ এর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ লাভ। কুরআন ও হাদীসের পরিভাষায় ‘সবর’-এর তিনটি শাখা রয়েছে। (এক) নফসকে হারাম এবং না-জায়েয বিষয়াদি থেকে বিরত রাখা (দুই) ইবাদাত ও আনুগত্যে বাধ্য করা এবং (তিন) যেকোন বিপদ ও সংকটে ধৈর্যধারণ করা। অর্থাৎ যেসব বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয়, সেগুলোকে আল্লাহর বিধান বলে মেনে নেয়া এবং এর বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে প্রতিদান প্রাপ্তির আশা রাখা। [ইবনে কাসীর]।
‘সবর’-এর উপরোক্ত তিনটি শাখাই প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। সাধারণ মানুষের ধারণা সাধারণতঃ তৃতীয় শাখাকেই সবর হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম দুটি শাখা এ ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, সে ব্যাপারে মোটেও লক্ষ্য করা হয় না। এমনকি এ দু’টি বিষয়ও যে ‘সবর’-এর অন্তর্ভুক্ত এ ধারণাও যেন অনেকের নেই। কুরআন হাদীসের পরিভাষায় ধৈর্যধারণকারী বা সাবের সে সমস্ত লোককেই বলা হয়, যারা উপরোক্ত তিন প্রকারেই সবর অবলম্বন করে।
(২) সালাত এবং ‘সবর’-এর মাধ্যমে যাবতীয় সংকটের প্রতিকার হওয়ার কারণ এই যে, এ দু'পস্থায়ই আল্লাহ্ তা'আলার প্রকৃত সান্নিধ্য লাভ হয়। আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন বাক্যের দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সালাত আদায়কারী এবং সবরকারীগণের আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ হয়। মহান আল্লাহ আরশের উপর থেকেও তাঁর বান্দাদের সাথে থাকার অর্থ দুটি। প্রথম. সাধারন অর্থে সাথে থাকা। যা সমস্ত মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর তা হচ্ছে, সবাই মহান আল্লাহর জ্ঞানের ভিতরে থাকা। মহান আল্লাহর যত সৃষ্টি সবার যাবতীয় অবস্থা তাঁর গোচরিভূত।
তিনি ভাল করেই জানেন কে কোথায় কোন অবস্থায় কোন কাজে লিপ্ত। দ্বিতীয় প্রকার সাথে থাকা বিশেষ অর্থে। যা কেবলমাত্র তাঁর নেককার, সবরকারী, ইহসানকারী, মুত্তাকীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর সেটি হচ্ছে, সাহায্য-সহযোগিতা করা। মহান আল্লাহর পক্ষে কারও সাথে থাকার অর্থ কখনো এটা হতে পারে না যে, তিনি তার সাথে চলাফেরা করছেন বা কোন কিছুর ভিতরে প্রবেশ করে আছেন। অথবা তার সাথে লেগে আছেন। কারণ; মহান আল্লাহ তাঁর আরশের উপর রয়েছেন। তিনি স্রষ্টা হিসেবে সৃষ্টি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৩) হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন।[1]
[1] মানুষের দু'টি অবস্থা হয়, আরাম ও স্বস্তি এবং কষ্ট ও অস্বস্তি। আরাম ও স্বস্তির সময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং কষ্ট ও অস্বস্তির সময় ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর নিকট সাহায্য কামনার তাকীদ করা হয়েছে। হাদীসে এসেছে, মুমিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক। তার জন্য আনন্দের কোন কিছু হলে, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর ক্ষতিকর কোন কিছু হলে, সে ধৈর্য ধারণ করে। এই উভয় অবস্থা তার জন্য কল্যাণকর। (মুসলিম ২৯৯৯নং) ধৈর্য দু'প্রকারের। প্রথম হল, হারাম ও পাপ কাজ ত্যাগ করা ও তা থেকে দূরে থাকার উপর এবং লোভনীয় (অবৈধ) জিনিস বর্জন ও সাময়িক সুখ ত্যাগ করার উপর ধৈর্য ধারণ করা। দ্বিতীয় হল, আল্লাহর নির্দেশাবলী পালন করতে গিয়ে যে কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তা ধৈর্য ও সংযমের সাথে সহ্য করা। কেউ কেউ সবর ও ধৈর্যের ব্যাখ্যা এইভাবে করেছেন, আল্লাহর পছন্দনীয় কর্মসমূহ সম্পাদন করা; তাতে দেহ ও আত্মায় যতই কষ্ট অনুভব হোক না কেন। আর আল্লাহর অপছন্দনীয় কর্মসমূহ থেকে দূরে থাকা; তাতে প্রবৃত্তি ও কামনা তাকে সেদিকে যতই আকৃষ্ট করুক না কেন। (ইবনে কাসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৪. আর আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত(১); কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না।
(১) প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি আলমে-বরযখে বা কবরে বিশেষ ধরণের এক প্রকার হায়াত বা জীবন প্রাপ্ত হয় এবং সে জীবনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কবরের আযাব বা সওয়াব ভোগ করে থাকে। তবে সে জীবনের হাকীকত আমরা জানি না। যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় নিহত হন, তাদেরকে শহীদ বলা হয়। তাদের মৃত্যুকে অন্যান্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, মৃত্যুর পর প্রত্যেকেই বরযখের জীবন লাভ করে থাকে এবং সে জীবনের পুরস্কার অথবা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। কিন্তু শহীদগণকে সে জীবনের অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “শহীদগণের রূহ সবুজ পাখীর প্রতিস্থাপন করা হয়, ফলে তারা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। তারপর তারা আরশের নীচে অবস্থিত কিছু ঝাড়বাতির মধ্যে ঢুকে পড়ে। তখন তাদের রব তাদের প্রতি এক দৃষ্টি দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কি চাও? তারা বলে হে রব! আমরা কি চাইতে পারি? আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা তো আপনি আপনার কোন সৃষ্টিকে দেন নি। তারপরও তাদের রব আবার তাদের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে অনুরূপ প্রশ্ন করেন।
যখন তারা বুঝল যে, তারা কিছু চাইতেই হবে, তখন তারা বলে, আমরা চাই আপনি আমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে ফেরৎ পাঠান, যাতে আমরা পুনরায় আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে শহীদ হতে পারি। শহীদগণের সাওয়াবের আধিক্য দেখেই তারা এ কথা বলবে- তখন তাদের মহান রব তাদের বলবেন, আমি এটা পূর্বে নির্ধারিত করে নিয়েছি যে, এখান থেকে আর ফেরার কোন সুযোগ নেই।” [মুসলিম: ১৮৮৭]
তবে সাধারণ নিয়মে শহীদদেরকে মৃতই ধরা হয় এবং তাদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি ওয়ারিসগণের মধ্যে বন্টিত হয়, তাদের বিধবাগণ অন্যের সাথে পুনর্বিবাহ করতে পারে। যেহেতু বরযখের অবস্থা মানুষের সাধারণ পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব করা যায় না, সেহেতু কুরআনে শহীদের সে জীবন সম্পর্কে (لَا تَشْعُرُونَ) (তোমরা বুঝতে পার না) বলা হয়েছে। এর মর্মার্থ হলো এই যে, সে জীবন সম্পর্কে অনুভব করার মত অনুভূতি তোমাদের দেয়া হয়নি। এ আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হলো যে, শহীদেরা পার্থিব জীবনের মত জীবিত নন। তাদেরকে জীবিত বলা হয়েছে এজন্য যে, আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে বিশেষ এক জীবন বরযখে দিয়েছেন, যার হাকীকত বা বাস্তবতা সম্পর্কে আল্লাহই ভাল জানেন।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৪) যারা আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করে, তাদেরকে মৃত বলো না,[1] বরং তারা জীবিত; কিন্তু তা তোমরা উপলব্ধি করতে পার না।
[1] শহীদদেরকে মৃত না বলা তাঁদের শ্রদ্ধা ও সম্মানের জন্য। পক্ষান্তরে তাঁদের সে জীবন বারযাখের জীবন যা আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধির অনেক ঊর্ধ্বে। এই বারযাখী জীবন মর্যাদার স্তর অনুযায়ী আম্বিয়া, মুমিনগণ এমন কি কাফেররাও লাভ করবে। শহীদদের আত্মা এবং কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, মুমিনদের আত্মাও একটি পাখীর মধ্যে বা বুকে অবস্থান করে জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা বিচরণ করবে। (ইবনে কাসীর, দ্রষ্টব্যঃ আলে-ইমরান ১৬৯ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৫. আর আমরা তোমাদেরকে অবশ্যই পরিক্ষা করব(১) কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আর আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদেরকে।
(১) কোন বিপদে পতিত হওয়ার আগেই যদি সে সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে দেয়া হয়, তবে সে বিপদে ধৈর্যধারণ সহজতর হয়ে যায়। কেননা, হঠাৎ করে বিপদ এসে পড়লে পেরেশানী অনেক বেশী হয়। যেহেতু আল্লাহ্ তা'আলা সমগ্র উম্মতকে লক্ষ্য করেই পরীক্ষার কথা বলেছেন, সেহেতু সবার পক্ষেই অনুধাবন করা উচিত যে, এ দুনিয়া দুঃখ-কষ্ট সহ্য করারই স্থান। সুতরাং এখানে যেসব সম্ভাব্য বিপদ-আপদের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে অপ্রত্যাশিত কিছু মনে না করলেই ধৈর্যধারণ করা সহজ হতে পারে। পরীক্ষায় সমগ্র উম্মত সমষ্টিগতভাবে উত্তীর্ণ হলে পরে সমষ্টিগতভাবেই পুরস্কার দেয়া হবে; এছাড়াও সবর-এর পরীক্ষায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে যারা যতটুকু উত্তীর্ণ হবেন, তাদের ততটুকু বিশেষ মর্যাদাও প্রদান করা হবে।
মূলত: মানুষের ঈমান অনুসারেই আল্লাহ্ তা'আলা মানুষকে পরীক্ষা করে থাকেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা, বিপদাপদ-বালা মুসিবত নবীদেরকে প্রদান করেন। তারপর যারা তাদের পরের লোক, তারপর যারা এর পরের লোক, তারপর যারা এর পরের লোক।” [মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৬৯] অর্থাৎ প্রত্যেকের ঈমান অনুসারেই তাদের পরীক্ষা হয়ে থাকে। তবে পরীক্ষা যেন কেউ আল্লাহর কাছে কামনা না করে। বরং সর্বদা আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা কামনা করাই মুমিনের কাজ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক লোককে বলতে শুনেছেন যে, “হে আল্লাহ! আমাকে সবরের শক্তি দান কর। তখন তিনি বললেন, তুমি বিপদ কামনা করেছ, সুতরাং তুমি নিরাপত্তা চাও।” [মুসনাদে আহমাদ: ৫/২৩১,২৩৫] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, মুমিনের উচিত নয় নিজেকে অপমানিত করা। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, কিভাবে নিজেকে অপমানিত করে? রাসূল বললেন, এমন কোন বালা-মুসিবতের সম্মুখীন হয় যা সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই”। [তিরমিযী: ২২৫৪]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৫) নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধনপ্রাণ এবং ফলের (ফসলের) নোকসান দ্বারা পরীক্ষা করব; আর তুমি ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৬. যারা তাদের উপর বিপদ আসলে বলে, আমরা তো আল্লাহরই। আর নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী(১)।
(১) সবরকারীগণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা বিপদের সম্মুখীন হলে – ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পাঠ করে। এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, কেউ বিপদে পড়লে যেন এ দোআটি পাঠ করে। কেননা, এরূপ বলাতে একাধারে যেমন অসীম সওয়াব পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি যদি এ বাক্যের অর্থের প্রতি যথার্থ লক্ষ্য রেখে তা পাঠ করা হয়, তবে বিপদে আন্তরিক শান্তি লাভ এবং তা থেকে উত্তরণও সহজতর হয়ে যায়। দোআটির অর্থ হচ্ছে, “নিশ্চয় আমরা তো আল্লাহরই। আর আমরা তার দিকেই প্রতীবর্তন করব।” সুতরাং আল্লাহ্ তা'আলা যদি আমাদের কোন কষ্ট দেন তবে তাতে কোন না কোন মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। তার উদ্দেশ্যকে সম্মান করতে পারা একটি মহৎ কাজ। আর এটাই হচ্ছে, সবর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুমিনের কর্মকাণ্ড আশ্চর্যজনক। তার সমস্ত কাজই ভাল।
মুমিন ছাড়া আর কারও জন্য এমনটি হয় না। যদি তার কোন খুশীর বিষয় সংঘটিত হয় তবে সে শুকরিয়া আদায় করে, ফলে তা তার জন্য কল্যাণের হয়। আর যদি তার কোন ক্ষতিকর কিছু ঘটে যায় তবে সে সবর করে, ফলে তাও তার জন্য কলাণকর হয়।” [মুসলিম: ২৯৯৯] অপর হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ বিপদ-মুসিবতে পড়ে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ বলবে, এবং বলবে, হে আল্লাহ আমাকে এ মুসিবত থেকে উদ্ধার করুন এবং এর থেকে উত্তম বস্তু ফিরিয়ে দিন” অবশ্যই আল্লাহ তাকে উত্তম কিছু ফিরিয়ে দিবেন।” [মুসলিম ৯১৮]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৬) যারা তাদের উপর কোন বিপদ এলে বলে, ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চিতভাবে তারই দিকে ফিরে যাব।’
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৭. এরাই তারা, যাদের প্রতি তাদের রব-এর কাছ থেকে বিশেষ অনুগ্রহ এবং রহমত বর্ষিত হয়, আর তারাই সৎপথে পরিচালিত।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৭) এই সকল লোকের প্রতি তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা ও করুণা বর্ষিত হয়, আর এরাই হল সুপথগামী। [1]
[1] এই আয়াতগুলোতে রয়েছে ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য সুসংবাদ। হাদীসে বিপদের সময়
{إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ} এর সাথে (اللَّهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا) পড়ার ফযীলত ও তাকীদ এসেছে। (মুসলিম ৯১৮নং)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৮. নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের(১) অন্তর্ভুক্ত। কাজেই যে কেউ (কা’বা) ঘরের হজ(২) বা উমরা(৩) সম্পন্ন করে, এ দু'টির মধ্যে সাঈ করলে তার কোন পাপ নেই(৪)। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন সৎকাজ করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ্ উত্তম পুরস্কারদাতা, সর্বজ্ঞ।
(১) (شَعَائِرِ اللَّهِ) এখানে شعائر শব্দটি شعيرة শব্দের বহুবচন। এর অর্থ চিহ্ন বা নিদর্শন। (شَعَائِرِ اللَّهِ) বলতে সেসব আমলকে বুঝায়, যেগুলোকে আল্লাহ্ তা'আলা দ্বীনের নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
(২) حج এর শাব্দিক অর্থ ইচ্ছা পোষণ করা, সংকল্প করা। কুরআন-সুন্নাহর পরিভাষায় বিশেষ সময়ে বিশেষ অবস্থায় বায়তুল্লাহ শরীফে আল্লাহ্র ইবাদতের উদ্দেশ্যে গমন করে বিশেষ ধরনের কিছু কর্ম সম্পাদন করাকে হজ্ব বলা হয়ে থাকে।
(৩) عمرة শব্দের আভিধানিক অর্থ দর্শন করা। শরীআতের পরিভাষায়, ইহরামসহ আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে বায়তুল্লাহ্ শরীফে হাযির হয়ে তাওয়াফ-সায়ী প্রভৃতি বিশেষ কয়েকটি ইবাদাত সম্পাদনের নামই উমরাহ।
(৪) সাফা এবং মারওয়া বায়তুল্লাহর নিকটবর্তী দুটি পাহাড়ের নাম। হজ কিংবা উমরার সময় কাবাঘরের তওয়াফ করার পর এ দু'টি পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াতে হয় শরীআতের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘সায়ী’। জাহেলী যুগেও যেহেতু এ সায়ীর রীতি প্রচলিত ছিল এবং তখন এ দু’টি পাহাড়ের মধ্যে কয়েকটি মূর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, এ জন্য মুসলিমদের কারো কারো মনে একটা দ্বিধার ভাব জাগ্রত হয়েছিল যে, বোধহয় এ সায়ী জাহেলী যুগের কোন অনুষ্ঠান এবং ইসলাম যুগে এর অনুসরণ করা হয়ত গোনাহর কাজ। কোন কোন লোক যেহেতু জাহেলী যুগে একে একটা অর্থহীন কুসংস্কার বলে মনে করতেন, সেজন্য ইসলাম গ্রহণের পরও তারা একে জাহেলিয়াত যুগের কুসংস্কার হিসেবেই গণ্য করতে থাকেন। এরূপ সন্দেহের নিরসনকল্পে আল্লাহ্ তা'আলা যেভাবে বায়তুল্লাহ্ শরীফের কেবলা হওয়া সম্পর্কিত সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছেন, তেমনিভাবে এ আয়াতে বায়তুল্লাহ সংশ্লিষ্ট আরও একটি সংশয়ের অপনোদন করে দিয়েছেন। তাছাড়া রাসূলের বিভিন্ন হাদীস দ্বারাও সাফা-মারওয়ার মাঝখানের সায়ী প্রমাণিত। [দেখুন, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৪২১, ৪২২]
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৮) নিশ্চয় স্বাফা ও মারওয়া (পাহাড় দুটি) আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম।[1] সুতরাং যে কা’বাগৃহের হজ্ব কিংবা উমরাহ সম্পন্ন করে, তার জন্য এই (পাহাড়) দুটি প্রদক্ষিণ (সাঈ) করলে কোন পাপ নেই। [2] আর কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন পুণ্য কাজ করলে, আল্লাহ গুণগ্রাহী, সর্বজ্ঞাতা।
[1] شَعَائِرُ হল شَعِيْرَةٌ এর বহুবচন। যার অর্থ, নিদর্শন বা প্রতীক। এখানে নিদর্শনসমূহ বলতে হজ্জ আদায়ের সময় ইবাদতের বিভিন্ন স্থান (যেমন, মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা, সাঈ ও কুরবানীর স্থান) কে বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট।
[2] স্বাফা-মারওয়ার সাঈ করা হজ্জের একটি রুকন (প্রধান অঙ্গ)। কিন্তু কুরআনের শব্দ ‘কোন পাপ নেই’ থেকে কোন কোন সাহাবীর সন্দেহ হয়েছিল যে, স্বাফা-মারওয়ার সাঈ জরুরী নয়। আয়েশা (রাযিআল্লাহু আনহা) যখন এ ব্যাপারে অবগত হলেন, তখন বললেন, যদি এর অর্থ এই হত, (যা তোমরা মনে কর) তাহলে মহান আল্লাহ এইভাবে বলতেন,
{فَلا جُنَاحَ عَلَيْهِ أَنْ لاَ يَطَّوَّفَ بِهِمَا} (প্রদক্ষিণ বা সাঈ না করলে কোন পাপ নেই।) তারপর এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ বললেন যে, আনসার সাহাবীগণ ইসলাম গ্রহণ করার পূর্বে ‘মানাত’ মূর্তির নামে ‘তালবিয়া’ পড়ত এবং মুশাল্লাল পাহাড়ে তার পূজা করত। মক্কায় পৌঁছে এই ধরনের লোক স্বাফা-মারওয়ার সাঈ করাকে পাপ মনে করত। ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁরা রসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলে এই আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয়েছে, স্বাফা-মারওয়ার সাঈ করা গুনাহ নয়। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল হজ্জঃ পরিচ্ছেদঃ স্বাফা-মারওয়ার সাঈ ওয়াজিব) কেউ কেউ এর কারণ এইভাবে বর্ণনা করেছেন যে, জাহেলিয়াতে মুশরিকরা স্বাফা পাহাড়ে ‘ইসাফ’ এবং মারওয়ায় ‘নায়েলা’ নামক মূর্তি স্থাপন করেছিল। সাঈ করার সময় তারা এদেরকে চুম্বন বা স্পর্শ করত। যখন তারা ইসলাম কবুল করে, তখন তাদের মাথায় এই খেয়াল এল যে, মনে হয় স্বাফা-মারওয়ার সাঈ করলে গুনাহ হতে পারে। কারণ, ইসলামের পূর্বে তারা উক্ত দু’টি মূর্তির জন্য সাঈ করত। মহান আল্লাহ এই আয়াতে তাদের সন্দেহ ও মনের কিন্তুকে দূর করে দিয়েছেন। এখন (উমরাহ ও হজ্জে ৭ বার যাওয়া-আসার মাধ্যমে) এই সাঈ করা জরুরী। যার শুরু স্বাফা থেকে হবে এবং শেষ হবে মারওয়ায়। (আইসারুত্ তাফাসীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৫৯. নিশ্চয় যারা(১) গোপন করে আমরা যেসব সুস্পষ্ট নিদর্শন ও হেদায়াত নাযিল করেছি, মানুষের জন্য কিতাবে তা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করার পর(২), তাদেরকে আল্লাহ লা'নত করেন এবং লা'নতকারীগণও(৩) তাদেরকে লা'নত করেন(৪)।
(১) যারা আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান গোপন করত, তারা ছিল ইয়াহুদী আলেম সম্প্রদায়। তারা সর্বসাধারণ্যে প্রচার করার পরিবর্তে ইলমে দ্বীনকে একটি সীমিত ধর্মীয় পেশাদার গোষ্ঠীর মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছিল। সাধারণ জনগণকে এ জ্ঞান থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। এমনকি এ গোষ্ঠীর লোকগুলো নিজেদের জনপ্রিয়তা অব্যাহত রাখার জন্য ভ্রষ্টতা ও শরীআত বিরোধী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়তে নিজেদের কথা ও কাজের সাহায্যে অথবা নীরব সমর্থনের মাধ্যমে বৈধতার ছাড়পত্র দান করত। এ আয়াতে এ ধরণের প্রবণতা থেকে মুসলিমদেরকে দূরে থাকার তাকীদ দেয়া হয়েছে।
(২) এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর যে সমস্ত প্রকৃষ্ট হিদায়াত নাযিল হয়েছে, সেগুলো মানুষের কাছে গোপন করা এত কঠিন হারাম ও মহাপাপ, যার জন্য আল্লাহ্ তাআলা নিজেও লা'নত বা অভিসম্পাত করে থাকেন এবং সমগ্র সৃষ্টিও অভিসম্পাত করে। এতে কয়েকটি বিষয় জানা যায়ঃ এক. যে জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার বিশেষ জরুরী, তা গোপন করা হারাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যে লোক দ্বীনের কোন বিধানের বিষয় জানা সত্ত্বেও তা জিজ্ঞেস করলে গোপন করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা'আলা তার মুখে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেবেন’। [আবু দাউদঃ ৩৬৫৮, ইবনে মাজাহঃ ২৬৬, আহমাদঃ ২/২৬৩] দুই. জ্ঞানকে গোপন করার অভিসম্পাত সে সমস্ত জ্ঞান ও মাসআলা গোপন করার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যা কুরআন ও সুন্নাহতে পরিস্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে এবং যার প্রকাশ ও প্রচার করা কর্তব্য।
পক্ষান্তরে এমন সূক্ষ্ম ও জটিল মাসআলা সাধারণ্যে প্রকাশ না করাই উত্তম, যদ্বারা সাধারণ লোকদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। তখন তা জ্ঞানকে গোপন করার হুকুমের আওতায় পড়বে না। উল্লেখিত আয়াতে (مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ) বাক্যের দ্বারাও তেমনি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘তোমরা যদি সাধারণ মানুষকেএমন সবহাদীস শোনাও, যা তারা পরিপূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না, তবে তাদেরকে ফেতনা ফাসাদেরই সম্মুখীন করবে’। [বুখারী, কিতাবুল ইলম, ইমাম মুসলিম, মুকাদ্দিমা] আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে উদ্ধৃত রয়েছে, তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষের সামনে ইলমের শুধু ততটুকু প্রকাশ করবে, যতটুকু তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি ধারণ করতে পারে। মানুষ আল্লাহ ও রাসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করুক; তোমরা কি এমন কামনা কর? কারণ, যে কথা তাদের বোধগম্য নয়, তাতে তাদের মনে নানা রকম সন্দেহসংশয় সৃষ্টি হবে এবং তাতে করে তারা আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকারও করে বসতে পারে। [বুখারী, কিতাবুল ইলমঃ ৪৯ নং অধ্যায়]
(৩) যে কাফের কুফর অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেছে বলে নিশ্চিত নয়, তার প্রতি লা'নত করা বৈধ নয়। আর আমাদের পক্ষে যেহেতু কারো শেষ পরিণতির (মৃত্যুর) নিশ্চিত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হওয়ার কোন উপায় নেই, সেহেতু কোন কাফেরের নাম নিয়ে তার প্রতি লা'নত বা অভিসম্পাত করাও জায়েয নয়। বস্তুতঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সমস্ত কাফেরের নাম উল্লেখ করে লা'নত করেছেন, কুফর অবস্থায় তাদের মৃত্যু সম্পর্কে আল্লাহ্ তা'আলার পক্ষ থেকে তিনি অবহিত হয়েছিলেন। অবশ্য সাধারণ কাফের ও যালেমদের প্রতি অনির্দিষ্টভাবে লা'নত করা জায়েয। এতে এ কথাও সাব্যস্ত হয়ে যায় যে, লা'নতের ব্যাপারটি যখন এতই কঠিন ও নাযুক যে, কুফর অবস্থায় মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে কোন কাফেরের প্রতিও লা'নত করা বৈধ নয়, তখন কোন মুসলিম কিংবা কোন জীব-জন্তুর উপর কেমন করে লা'নত করা যেতে পারে?
সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আমাদের নারী সম্প্রদায় একান্ত গাফলতিতে পড়ে আছে। তারা কথায় কথায় নিজেদের আপনজনদের প্রতিও অভিসম্পাত বা লা'নত বাক্য ব্যবহার করতে থাকে এবং শুধু লা'নত বাক্য ব্যবহার করেই সন্তুষ্ট হয় না; বরং তার সমার্থক যে সমস্ত শব্দ জানা থাকে সেগুলোও ব্যবহার করতে কসুর করে না। লা'নতের প্রকৃত অর্থ হল, আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া। কাজেই কাউকে ‘মরদূদ’, ‘আল্লাহর অভিশপ্ত প্রভৃতি শব্দে গালি দেয়াও লা'নতেরই সমপর্যায়ভুক্ত। [মা'আরিফুল কুরআন]
(৪) এ আয়াতে কুরআনুল কারীম লা'নত বা অভিসম্পাতকারীদের নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেনি। মুফাসসিরগণ বলেন, এভাবে বিষয়টি অনির্ধারিত রাখাতে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, দুনিয়ার প্রতিটি বস্তু ও প্রতিটি সৃষ্টিই তাদের উপর অভিসম্পাত করে থাকে। মুজাহিদ ও আতা রাহিমাহুমাল্লাহ বলেন, এমনকি জীব-জন্তু, কীট-পতঙ্গও তাদের প্রতি অভিসম্পাত করে। [সুনান সাঈদ ইবনে মানসূর: ২/৬৩৮, ৬৩৯, বাইহাকী, শু'আবুল ঈমান: ৫/২৪] কারণ, তাদের অপকর্মের দরুন সেসব সৃষ্টিরও ক্ষতি সাধিত হয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(১৫৯) আমি যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য স্পষ্টভাবে আমি কিতাবে ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন করে, আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়। [1]
[1] মহান আল্লাহ যে সকল কথা কুরআন মাজীদে অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করা এত বড় অন্যায় যে, আল্লাহ ছাড়াও অন্যান্য অভিশাপকারীরা অভিশাপ দিতে থাকে। তাছাড়া হাদীসে আল্লাহর রসূল (সাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কোন ইলম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর তা গোপন করে সে ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন আগুনের একটি লাগাম পরানো হবে। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, বাইহাকী, হাকেম অনুরূপ।)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১৬০. তবে যারা তাওবা করেছে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করেছে এবং সত্যকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে। অতএব, এদের তাওবা আমি কবুল করব। আর আমি অধিক তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১৬০) কিন্তু যারা তওবা করে (ক্ষমা প্রার্থনা করে) আর নিজেদেরকে সংশোধন করে এবং (আল্লাহর আয়াতকে) স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে, এরাই তো তারা, যাদের তওবা আমি গ্রহণ করি। আর আমি তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান