بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ৩১/ লুকমান | Luqman | سورة لقمان আয়াতঃ ৩৪ মাক্কী
৩১ : ১১ هٰذَا خَلۡقُ اللّٰهِ فَاَرُوۡنِیۡ مَاذَا خَلَقَ الَّذِیۡنَ مِنۡ دُوۡنِهٖ ؕ بَلِ الظّٰلِمُوۡنَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۱۱﴾
هذا خلق الله فارونی ماذا خلق الذین من دونهٖ بل الظلمون فی ضلل مبین ﴿۱۱﴾
• এ আল্লাহর সৃষ্টি; অতএব আমাকে দেখাও, তিনি ছাড়া আর যারা আছে তারা কী সৃষ্টি করেছে! বরং যালিমরা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে রয়েছে।

-আল-বায়ান

• এগুলো আল্লাহর সৃষ্টি। কাজেই আমাকে দেখাও তিনি ছাড়া অন্যেরা কী সৃষ্টি করেছে। বরং যালিমরা সুস্পষ্ট গুমরাহীতে ডুবে আছে।

-তাইসিরুল

• এটা আল্লাহর সৃষ্টি! তিনি ছাড়া অন্যরা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও। সীমালংঘনকারীরাতো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

-মুজিবুর রহমান

• This is the creation of Allah. So show Me what those other than Him have created. Rather, the wrongdoers are in clear error.

-Sahih International

১১. এটা আল্লাহর সৃষ্টি! সুতরাং তিনি ছাড়া অন্যরা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও। বরং যালিমরা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।(১)

(১) অর্থাৎ যখন এরা এ বিশ্ব-জাহানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন সৃষ্টি চিহ্নিত করতে পারেনি এবং একথা সুস্পষ্ট যে, তারা তা করতে পারে না তখন তাদের যারা স্রষ্টা নয় এমন সত্ত্বকে আল্লাহর একচ্ছত্র ও সার্বভৌম কর্তৃত্বে শরীক করা, তাদের সামনে আনুগত্যের শিরা নত করা এবং তাদের কাছে প্রার্থনা করা ও অভাব মোচন করার জন্য আবেদন জানানোকে সুস্পষ্ট নিৰ্বদ্ধিতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

তাফসীরে জাকারিয়া

(১১) এ আল্লাহর সৃষ্টি![1] তিনি ব্যতীত অন্যেরা কি সৃষ্টি করেছে আমাকে দেখাও তো।[2] বরং সীমালংঘনকারীরা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।

[1] هٰذَا (এ) শব্দ দ্বারা আল্লাহর ঐ সকল সৃষ্টিকৃত বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যার উল্লেখ পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে রয়েছে।

[2] যাদের তোমরা ইবাদত কর এবং সাহায্যের জন্য যাদেরকে ডেকে থাকো তারা আকাশ ও পৃথিবীর কোন্ বস্তুটি সৃজন করেছে? তাদের সৃজনকৃত একটি বস্তুও দেখাও তো। অতএব যখন সকল বস্তুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা, তখন ইবাদতের একমাত্র অধিকারীও তিনিই। তিনি ছাড়া বিশ্বজগতে আর এমন কেউ নেই, যে ইবাদতের যোগ্য হতে পারে এবং তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা যেতে পারে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১২ وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا لُقۡمٰنَ الۡحِكۡمَۃَ اَنِ اشۡكُرۡ لِلّٰهِ ؕ وَ مَنۡ یَّشۡكُرۡ فَاِنَّمَا یَشۡكُرُ لِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ حَمِیۡدٌ ﴿۱۲﴾
و لقد اتینا لقمن الحكمۃ ان اشكر لله و من یشكر فانما یشكر لنفسهٖ و من كفر فان الله غنی حمید ﴿۱۲﴾
• আর আমি তো লুকমানকে হিকমাত* দিয়েছিলাম (এবং বলেছিলাম) যে, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় কর। আর যে শুকরিয়া আদায় করে সে তো নিজের জন্যই শুকরিয়া আদায় করে এবং যে অকৃতজ্ঞ হয় (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত’।

-আল-বায়ান

• আমি লুকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছিলাম। (তাকে বলেছিলাম) যে, তুমি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তা নিজের কল্যাণেই করে। আর কেউ অকৃতজ্ঞ হলে (সে জেনে রাখুক যে) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত।

-তাইসিরুল

• আমি অবশ্যই লুকমানকে জ্ঞান দান করেছিলাম এবং বলেছিলামঃ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সেতো তা করে নিজের জন্য এবং কেহ অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহতো অভাবমুক্ত, প্রশংসা।

-মুজিবুর রহমান

• And We had certainly given Luqman wisdom [and said], "Be grateful to Allah." And whoever is grateful is grateful for [the benefit of] himself. And whoever denies [His favor] - then indeed, Allah is Free of need and Praiseworthy.

-Sahih International

১২. আর অবশ্যই আমরা লুকমান(১) কে হিকমত(২) দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আর যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তো তা করে নিজেরই জন্য এবং কেউ অকৃতজ্ঞ হলে আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, চির প্রশংসিত।(৩)

(১) কোন কোন তাবে’ঈ আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত লুকমানকে আইয়্যুব আলাইহিস সালাম এর ভাগ্নে বলেছেন। আবার কেউ কেউ তার খালাতো ভাই বলে বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন তফসীরে রয়েছে যে, তিনি দীর্ঘায়ু লাভ করেছিলেন এবং দাউদ আলাইহিস সালাম-এর সময়েও বেঁচে ছিলেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, লুকমান ছিলেন একজন হাবশী গোলাম। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, মুজাহিদ, ইকরিমাহ ও খালেদ আর-রাবাঈও একথাই বলেন। জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি ছিলেন নূবার অধিবাসী। অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, লুকমান চেপ্টা নাকবিশিষ্ট, বেঁটে আকারের হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন।

সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের উক্তি হচ্ছে, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মুজাহিদ বলেন, তিনি ফাটা পা ও পুরু ঠোঁটবিশিষ্ট হাবশী ক্রীতদাস ছিলেন। এ বক্তব্যগুলো প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে। কারণ আরবের লোকেরা কালো বর্ণের মানুষদেরকে সেকালে প্রায়ই হাবশী বলতো। আর নূবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে এবং সুদানের উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা। তাই উক্ত বক্তব্যগুলোতে একই ব্যক্তিকে নূবী, মিসরীয় ও হাবশী বলা কেবলমাত্র শাব্দিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থের দিক দিয়ে এখানে কোন বিরোধ নেই। এ ব্যক্তি আসলে বাসিন্দা ছিলেন মাদয়ান ও আইল (বর্তমান আকাবাহ) এলাকার। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার বর্ণনা অনুযায়ী লুকমান কাঠ চেরার কাজ করতেন। আবার কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি দর্জি ছিলেন।

কোন কোন গবেষক লুকমানকে আদ জাতির অন্তর্ভুক্ত ইয়ামনের বাদশাহ মনে করতো। তাদের মতে আদ জাতির ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হূদ আলাইহিস সালামের সাথে তাদের যে ঈমানদার অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাঁদেরই বংশোদ্ভূত। ইয়ামনে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম শাসক ও বাদশাহ। কিন্তু প্ৰবীণ সাহাবী ও তাবেঈদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্য বর্ণনাগুলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সম্ভবত: এর কারণ হচ্ছে, ইতিহাসে লুকমান ইবন আদ নামক এক ব্যক্তি প্ৰসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। কোন কোন গবেষক তাকে এই লুকমান হাকীমই ধরে নিয়েছেন। আল্লামা সুহাইলী এ সন্দেহ অপনোদন করে বলেছেন যে, লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু'জন আলাদা ব্যক্তি। তাদেরকে এক ব্যক্তি মনে করা ঠিক নয়।

লুকমান কোন নবী ছিলেন না; বরং ওলী, প্রজ্ঞাবান ও বিশিষ্ট মনীষী ছিলেন। ইবনে কাসীর বলেন যে, প্রাচীন ইসলামী মনীষীবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি নবী ছিলেন না। কেবল ইকরিমা থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি নবী ছিলেন। কিন্তু এর বর্ণনাসূত্র বা সনদ দুর্বল। ইমাম বগবী বলেন, একথা সর্বসম্মত যে, তিনি বিশিষ্ট ফকীহ ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন, নবী ছিলেন না। ইবনে কাসীর আরো বলেন, তার সম্পর্কে কাতাদাহ থেকে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ লুকমানকে নবুওয়ত ও হেকমত বা প্রজ্ঞা-দুয়ের মধ্যে যে কোন একটি গ্রহণের সুযোগ দেন। তিনি হেকমতই গ্ৰহণ করেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, তাকে নবুওয়ত গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তিনি আরয করলেন যে, “যদি আমার প্রতি এটা গ্ৰহণ করার নির্দেশ হয়ে থাকে, তবে তা শিরোধার্য। অন্যথায় আমাকে ক্ষমা করুন।”

কাতাদাহ্‌ থেকে আরও বর্ণিত আছে যে, লুকমানের নিকট এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনি হেকমতকে নবুওয়ত থেকে সমধিক গ্রহণযোগ্য কেন মনে করলেন, যখন আপনাকে যে কোন একটা গ্ৰহণ করার অধিকার দেয়া হয়েছিল? তিনি বললেন যে, নবুওয়ত বিশেষ দায়িত্বপূর্ণ পদ। যদি তা আমার ইচ্ছা ব্যতীত প্রদান করা হতো, তবে স্বয়ং মহান আল্লাহ তার দায়িত্ব গ্রহণ করতেন যাতে আমি সে কর্তব্যসমূহ পালন করতে সক্ষম হই। কিন্তু যদি আমি তা স্বেচ্ছায় চেয়ে নিতাম, তবে সে দায়িত্ব আমার উপর বর্তাতো। বর্ণিত আছে যে, দাউদ আলাইহিস সালাম-এর আবির্ভাবের পূর্বে লুকমান শরীয়তী মাসআলাসমূহ সম্পর্কে জনগণের নিকট ফতোয়া দিতেন। দাউদ আলাইহিস সালাম-এর নবুওয়ত প্ৰাপ্তির পর তিনি এ ফতোয় প্রদান কার্য পরিত্যাগ করেন এই বলে যে, এখন আর তার প্রয়োজন নেই।

কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি ইসরাঈল গোত্রের বিচারপতি ছিলেন। লুকমানের বহু জ্ঞানগর্ভ বাণী লিপিবদ্ধ আছে। কোন কোন তাবেয়ী বলেন, আমি লুকমানের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দশ হাজারের চাইতেও বেশী অধ্যায় অধ্যায়ন করেছি। একদিন লুকমান এক বিরাট সমাবেশে উপস্থিত জনমণ্ডলীকে বহু জ্ঞানগর্ভ কথা শোনাচ্ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলো যে, আপনি কি সে ব্যক্তি -যে আমার সাথে অমুক বনে ছাগল চরাতো? লুকমান বলেন, হ্যাঁ-আমিই সে লোক। অতঃপর লোকটি বললো, তবে আপনি এ মর্যাদা কিভাবে লাভ করলেন যে, আল্লাহর গোটা সৃষ্টিকুল আপনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং আপনার বাণী শোনার জন্যে দূর-দূরান্ত থেকে এসে জমায়েত হয়? উত্তরে লুকমান বললেন যে, এর কারণ আমার দুটি কাজ-[এক] সর্বদা সত্য বলা, [দুই] অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা পরিহার করা। অপর এক বর্ণনায় আছে যে, লুকমান বলেছেন, এমন কতগুলো কাজ আছে যা আমাকে এর স্তরে উন্নীত করেছে। যদি তুমি তা গ্রহণ কর, তবে তুমিও এ মর্যাদা ও স্থান লাভ করতে পারবে। সে কাজগুলো এইঃ নিজের দৃষ্টি নিম্নমুখী রাখা এবং মুখ বন্ধ করা, হালাল জীবিকাতে তুষ্ট থাকা, নিজের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করা, সত্য কথায় অটল থাকা, অঙ্গীকার পূর্ণ করা, মেহমানের আদর-আপ্যায়ন ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, প্রতিবেশীর প্রতি সর্বদা লক্ষ্য রাখা এবং অপ্রয়োজনীয় কাজ ও কথা পরিহার করা। [ইবন কাসীর: আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ]

(২) হেকমত অর্থ প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, পাণ্ডিত্য, যুগ ও সময়োপযোগী কথা বলা ও কাজ করার যোগ্যতা ইত্যাদি। [তাবারী, ইবন কাসীর বাগভী]

(৩) অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুফরী করে তার কুফারী তার নিজের জন্য ক্ষতিকর। এতে আল্লাহর কোন ক্ষতি হয় না। তিনি অমুখাপেক্ষী। কারো কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন। কারো কৃতজ্ঞতা তাঁর সার্বভৌম কর্তৃত্বে কোন বৃদ্ধি ঘটায় না। বান্দার যাবতীয় নিয়ামত যে একমাত্র তাঁরই দান, কারো অকৃতজ্ঞতা ও কুফৱী এ জাজ্জ্বল্যমান সত্যে কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। কেউ তাঁর প্রশংসা করুক বা নাই করুক তিনি আপনা আপনিই প্রশংসিত। বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি অণু-কণিকা তাঁর পূর্ণতা ও সৌন্দর্য এবং তাঁর স্রষ্টা ও অন্নদাতা হবার সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং প্রত্যেকটি সৃষ্ট বস্তু নিজের সমগ্র সত্তা দিয়ে তাঁর প্রশংসা গেয়ে চলছে। [ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১২) আমি লুকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছিলাম[1] (আর বলেছিলাম), ‘তুমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।[2] যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে তো তা নিজেরই জন্য করে এবং কেউ অকৃতজ্ঞতা করলে নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ।’

[1] লুকমান আল্লাহর একজন নেক বান্দা ছিলেন, যাঁকে আল্লাহ তাআলা হিকমত অর্থাৎ, সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধি এবং দ্বীনী ইলমে উচ্চ স্থান দান করেছিলেন। একদা তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করল যে, ‘আপনি এই জ্ঞান-বুদ্ধি কিভাবে অর্জন করলেন?’ তার উত্তরে তিনি বললেন, ‘সত্যবাদিতা ব্যবহার করে, আমানত রক্ষা করে, বাজে কথা থেকে দূরে থেকে এবং নীরবতা অবলম্বন করে।’ তাঁর প্রজ্ঞা ও হিকমত পূর্ণ একটি ঘটনা এ রকমও প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি একজন দাস ছিলেন। একদা তাঁকে তাঁর মালিক বললেন, ‘ছাগল যবেহ করে তার মধ্য হতে সর্বোৎকৃষ্ট দুই টুকরো কেটে নিয়ে এস।’ সুতরাং তিনি জিভ ও হৃৎপিণ্ড নিয়ে এসে দিলেন। অন্য এক দিন তাঁর মালিক তাঁকে ছাগল যবেহ করে তার মধ্য হতে সব থেকে নিকৃষ্ট দুই টুকরো নিয়ে আসার আদেশ করলে তিনি পুনরায় জিভ ও হৃৎপিণ্ড নিয়ে উপস্থিত হলেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, ‘জিভ ও হৃৎপিণ্ড যদি ঠিক থাকে, তাহলে তা সর্বোৎকৃষ্ট জীব। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার চেয়ে নিকৃষ্ট জীব আর কিছু হতে পারে না। (ইবনে কাসীর)

[2] কৃতজ্ঞতা বা শুক্‌র এর অর্থ হল, আল্লাহর নিয়ামতের উপর তাঁর প্রশংসা করা এবং তাঁর আদেশ মেনে চলা।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৩ وَ اِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِهٖ وَ هُوَ یَعِظُهٗ یٰبُنَیَّ لَا تُشۡرِكۡ بِاللّٰهِ ؕؔ اِنَّ الشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۳﴾
و اذ قال لقمن لابنهٖ و هو یعظهٗ یبنی لا تشرك بالله ان الشرك لظلم عظیم ﴿۱۳﴾
• আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শিরক করো না; নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলম'।

-আল-বায়ান

• স্মরণ কর, যখন লুকমান তার ছেলেকে নসীহত ক’রে বলেছিল- হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শিরক কর না, শিরক হচ্ছে অবশ্যই বিরাট যুলম।

-তাইসিরুল

• স্মরণ কর, যখন লুকমান উপদেশাচ্ছলে তার পুত্রকে বলেছিলঃ হে বৎস! আল্লাহর সাথে কোন শরীক করনা। নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে চরম যুলম।

-মুজিবুর রহমান

• And [mention, O Muhammad], when Luqman said to his son while he was instructing him, "O my son, do not associate [anything] with Allah. Indeed, association [with him] is great injustice."

-Sahih International

১৩. আর স্মরণ করুন, যখন লুকমান উপদেশ দিতে গিয়ে তার পুত্ৰকে বলেছিল, হে আমার প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে কোন শির্ক করো না। নিশ্চয় শির্ক বড় যুলুম।(১)

(১) জ্ঞানগর্ভ বাণীসমূহের মধ্যে সর্বাগ্রে হলো আকীদাসমূহের পরিশুদ্ধিতার ব্যাপারে কথা বলা। সে জন্য লুকমানের সর্বপ্রথম কথা হলো কোন প্রকারের অংশীদারিত্ব স্থির না করে আল্লাহ কে গোটা বিশ্বের স্রষ্টা ও প্ৰভু বলে বিশ্বাস করা। সাথে সাথে আল্লাহর কোন সৃষ্ট বস্তুকে স্রষ্টার সমমর্যাদাসম্পন্ন মনে করার মত গুরুতর অপরাধ দুনিয়াতে আর কিছু হতে পারে না। তাই তিনি বলেছেন, “হে আমার প্রিয় বৎস, আল্লাহর অংশীদার স্থির করো না, অংশীদার স্থাপন করা গুরুতর যুলুম। জুলুমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, কারো অধিকার হরণ করা এবং ইনসাফ বিরোধী কাজ করা। শির্ক এ জন্য বৃহত্তর জুলুম যে, মানুষ এমন সব সত্তাকে তার নিজের স্রষ্টা, রিযিকদাতা ও নিয়ামতদানকারী হিসেবে বরণ করে নেয়, তার সৃষ্টিতে যাদের কোন অংশ নেই। তাকে রিযিক দান করার ক্ষেত্রে যাদের কোন দখল নেই এবং মানুষ এ দুনিয়ায় যেসব নিয়ামত লাভে ধন্য হচ্ছে সেগুলো প্ৰদান করার ব্যাপারে যাদের কোন ভূমিকাই নেই। এটা এত বড় অন্যায়, যার চেয়ে বড় কোন অন্যায়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। তারপর মানুষ একমাত্র তার স্রষ্টারই বন্দেগী করবে, এটা মানুষের ওপর তার স্রষ্টার অধিকার। কিন্তু সে অন্যের বন্দেগী ও পূজা-অৰ্চনা করে তাঁর অধিকার হরণ করে।

তারপর স্রষ্টা ছাড়া অন্য সত্তার বন্দেগী ও পূজা করতে গিয়ে মানুষ যে কাজই করে তাতে সে নিজের দেহ ও মন থেকে শুরু করে পৃথিবী ও আকাশের বহু জিনিস ব্যবহার করে। অথচ এ সমস্ত জিনিস এক লা-শরীক আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন এবং এর মধ্যে কোন জিনিসকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগীতে ব্যবহার করার অধিকার তার নেই। তারপর মানুষ নিজেকে লাঞ্ছনা ও দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দেবে না, তার নিজের ওপর এ অধিকার রয়েছে। কিন্তু সে স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে সৃষ্টির বন্দেগী করে নিজেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে এবং এই সঙ্গে শাস্তির যোগ্যও বানায়। এভাবে একজন মুশরিকের সমগ্র জীবন একটি সৰ্বমুখী ও সার্বক্ষণিক যুলুমে পরিণত হয়। তার কোন একটি মুহুৰ্তও যুলুমমুক্ত নয়। পক্ষান্তরে মুমিন এ ধরনের অবস্থা থেকে মুক্ত। হাদীসে এসেছে, যখন নাযিল হল “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে যুলুমের সংমিশ্রণ ঘটায়নি তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা।” [সূরা আল-আন’আম: ৮২] তখন সাহাবায়ে কিরাম অত্যন্ত ভীত হয়ে গেলেন; (কারণ তারা যুলুমের আভিধানিক অর্থ ধরে নিয়েছিলেন)। তারা বলতে লাগলেন, আমাদের কেউ কি এমন আছে যে, যার ঈমানের সাথে যুলুম নেই? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা সেই যুলুম নয় (যার ভয় তোমরা করছ)। তোমরা কি শুননি লুকমান তার ছেলেকে কি বলেছে, তিনি বলেছেনঃ নিশ্চয় শির্ক হচ্ছে বড় যুলুম। [বুখারী: ৪৭৭৬]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৩) (স্মরণ কর) যখন লুকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলেছিল, ‘হে বৎস! আল্লাহর কোন অংশী করো না।[1] আল্লাহর অংশী করা তো চরম অন্যায়।’ [2]

[1] আল্লাহ্ তাআলা লুকমান হাকীমের সর্বপ্রথম অসিয়ত এই উল্লেখ করেছেন যে, তিনি নিজ ছেলেকে শিরক করতে নিষেধ করেছিলেন। যাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পিতা-মাতার কর্তব্য হল, নিজেদের সন্তানদেরকে শিরক থেকে বাঁচানোর সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক বেশী চেষ্টা করা।

[2] অনেকের নিকট এ বাক্যাংশটি লুকমান হাকীমের উক্তি। আবার অনেকে এটিকে আল্লাহর উক্তি বলেছেন এবং তার সমর্থনে (الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ) আয়াতটি অবতীর্ণ সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। যাতে সাহাবাগণ বললেন, ‘আমাদের কে আবার যুলম করে না?’ সুতরাং তারই পরিপ্রেক্ষিতে অবতীর্ণ হল, (إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ) (বুখারী ৪৭৭৬নং) কিন্তু আসলে এতে ঐ কথা আল্লাহর উক্তি হওয়ার বা না হওয়ার কোন প্রমাণ হয় না। পক্ষান্তরে অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবাগণ তা বড় কঠিন মনে করে নবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন এবং তিনি তার উত্তরে বললেন, ‘‘তোমরা যা ধারণা করছ, তা নয়। এখানে যুলম বলতে সেই যুলমকে বুঝানো হয়েছে, যার কথা লুকমান তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, (يَا بُنَيَّ لَا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ) (বুখারী) এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ উক্তি লুকমান হাকীমেরই ছিল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৪ وَ وَصَّیۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَیۡهِ ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰی وَهۡنٍ وَّ فِصٰلُهٗ فِیۡ عَامَیۡنِ اَنِ اشۡكُرۡ لِیۡ وَ لِوَالِدَیۡكَ ؕ اِلَیَّ الۡمَصِیۡرُ ﴿۱۴﴾
و وصینا الانسان بوالدیه حملته امهٗ وهنا علی وهن و فصلهٗ فی عامین ان اشكر لی و لوالدیك الی المصیر ﴿۱۴﴾
• আর আমি মানুষকে তার মাতাপিতার ব্যাপারে (সদাচরণের) নির্দেশ দিয়েছি। তার মা কষ্টের পর কষ্ট ভোগ করে তাকে গর্ভে ধারণ করে। আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে; সুতরাং আমার ও তোমার পিতা-মাতার শুকরিয়া আদায় কর। প্রত্যাবর্তন তো আমার কাছেই।

-আল-বায়ান

• আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে, (নির্দেশ দিচ্ছি) যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (তোমাদের সকলের) প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে।

-তাইসিরুল

• আমিতো মানুষকে তার মাতাপিতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তনতো আমারই নিকট।

-মুজিবুর রহমান

• And We have enjoined upon man [care] for his parents. His mother carried him, [increasing her] in weakness upon weakness, and his weaning is in two years. Be grateful to Me and to your parents; to Me is the [final] destination.

-Sahih International

১৪. আর আমরা মানুষকে তাঁর পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। কাজেই আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।(১) ফিরে আসা তো আমারই কাছে।

(১) এখানে যখন পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালন এবং তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, তখন এর হেকমত ও অন্তর্নিহিত রহস্য এই বর্ণনা করেছেন যে, তার মা ধরাধামে তার আবির্ভাব ও অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। নয় মাস কাল উদরে ধারণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন এবং এ কারণে ক্রমবর্ধমান দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। আবার ভূমিষ্ট হওয়ার পরও দু’বছর পর্যন্ত স্তন্যদানের কঠিন ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। যাতে দিন-রাত মাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। ফলে তার দুর্বলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সন্তানের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে মাকেই যেহেতু অধিক বুকি-ঝামেলা বহন করতে হয়, সেজন্য শরীয়তে মায়ের স্থান ও অধিকার পিতার অগ্রে রাখা হয়েছে। যদি পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা না হয় তাতে আল্লাহরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয় না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ হয় না সে আল্লাহর কাছেও কৃতজ্ঞ হতে পারে না।” [আবু দাউদ: ৪৮১১, তিরমিযী: ১৯৫৪, মুসনাদে আহমাদ: ২/২৯৫]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৪) আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি।[1] জননী কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে[2] এবং তার স্তন্যপান ছাড়াতে দু বছর অতিবাহিত হয়।[3] সুতরাং তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমারই নিকট (সকলের) প্রত্যাবর্তন।

[1] তাওহীদ গ্রহণ (শিরক বর্জন) ও আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার তাকীদপূর্ণ আদেশের জন্য উক্ত নসীহতের গুরুত্ব স্পষ্ট।

[2] উদ্দেশ্য এই যে, মাতৃগর্ভে বাচ্চা যত বাড়ে, মায়ের উপর কষ্টের বোঝা তত বাড়তে থাকে, যার ফলে মা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, পিতা-মাতার অধিকার আদায় করার সময় মাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যেমন হাদীসেও সে কথা বর্ণিত হয়েছে।

[3] এতে বুঝা যায় যে, শিশুকে দুধ পান করানোর সময় হল দুই বছর, তার অধিক নয়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৫ وَ اِنۡ جَاهَدٰكَ عَلٰۤی اَنۡ تُشۡرِكَ بِیۡ مَا لَیۡسَ لَكَ بِهٖ عِلۡمٌ ۙ فَلَا تُطِعۡهُمَا وَ صَاحِبۡهُمَا فِی الدُّنۡیَا مَعۡرُوۡفًا ۫ وَّ اتَّبِعۡ سَبِیۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَیَّ ۚ ثُمَّ اِلَیَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَاُنَبِّئُكُمۡ بِمَا كُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۵﴾
و ان جاهدك علی ان تشرك بی ما لیس لك بهٖ علم فلا تطعهما و صاحبهما فی الدنیا معروفا و اتبع سبیل من اناب الی ثم الی مرجعكم فانبئكم بما كنتم تعملون ﴿۱۵﴾
• আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে শিরক করতে জোর চেষ্টা করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তখন তাদের আনুগত্য করবে না এবং দুনিয়ায় তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে। আর অনুসরণ কর তার পথ, যে আমার অভিমুখী হয়। তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, যা তোমরা করতে।

-আল-বায়ান

• তোমার পিতামাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার অংশীদার স্থির করার জন্য যার জ্ঞান তোমার নেই, তবে তুমি তাদের কথা মানবে না। কিন্তু পৃথিবীতে তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে। যে আমার অভিমুখী হয় তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তখন আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব তোমরা যা করছিলে।

-তাইসিরুল

• তোমার মাতা-পিতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সাথে শরীক করতে যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তাহলে তুমি তাদের কথা মানবেনা। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে এবং যে বিশুদ্ধ চিত্তে আমার অভিমুখি হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর, অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকট এবং তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবহিত করব।

-মুজিবুর রহমান

• But if they endeavor to make you associate with Me that of which you have no knowledge, do not obey them but accompany them in [this] world with appropriate kindness and follow the way of those who turn back to Me [in repentance]. Then to Me will be your return, and I will inform you about what you used to do.

-Sahih International

১৫. আর তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে শির্ক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই(১), তাহলে তুমি তাদের কথা মেনো না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে বসবাস করবে সদ্ভাবে(২) আর যে আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অনুসরণ কর। তারপর তোমাদের ফিরে আসা আমারই কাছে, তখন তোমরা যা করতে সে বিষয়ে আমি তোমাদেরকে অবিহিত করব।

(১) অর্থাৎ তোমার জানা মতে যে আমার সাথে শরীক নয়। অথবা তুমি আমার কোন শরীক আছে বলে জান না। তুমি তো শুধু এটাই জান যে, আমি এক, আমার কোন শরীক নেই। এমতাবস্থায় কিভাবে তুমি তোমার পিতা-মাতার কথা মানতে পার? অন্যায়কে যেন তুমি প্রশ্রয় না দাও। শির্ক গুরুতর অপরাধ হওয়ার কারণেই আল্লাহর নির্দেশ এই যে, যদিও সন্তানের প্রতি পিতা-মাতাকে মান্য করার ও তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকারের বিশেষ তাকীদ রয়েছে এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে সাথে পিতা-মাতার প্রতিও তা করার জন্যে সন্তানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু শির্ক এমন গুরুতর অন্যায় ও মারাত্মক অপরাধ যে, মাতা-পিতার নির্দেশে, এমন কি বাধ্য করার পরও কারো পক্ষে তা জায়েয হয়ে যায় না।

যদি কারো পিতা-মাতা তাকে আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপনে বাধ্য করতে চেষ্টা করতে থাকেন, এ বিষয়ে পিতা-মাতার কথাও রক্ষা করা জায়েয নয়। যেমনটি হয়েছিল, সা'দ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাথে তার মায়ের আচরণ। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে তার মা শপথ করলেন যে, যতক্ষণ তুমি আবার পূর্ববর্তী দ্বীনে ফিরে না আসবে ততক্ষণ আমি কোন খাবার গ্রহণ করবনা। কিন্তু সা’দ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার এ কথা মান্য করলেন না। তার সমর্থনেই এই আয়াত নাযিল হয়। [মুসলিম: ১৭৪৮]

(২) যদি পিতা-মাতা আল্লাহর অংশী স্থাপনে বাধ্য করার চেষ্টা করেন, তখন আল্লাহর নির্দেশ হল তাদের কথা না মানা। এমতাবস্থায় মানুষ স্বভাবতঃ সীমার মধ্যে স্থির থাকে না। এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে সন্তানের পক্ষে পিতা-মাতার প্রতি কটু বাক্য প্রয়োগ ও অশোভন আচরণ করে তাদেরকে অপমানিত করার সম্ভাবনা ছিল। ইসলাম তো ন্যায়নীতির জ্বলন্ত প্রতীক — প্রত্যেক বস্তুরই একটি সীমা আছে। তাই অংশীদার স্থাপনের বেলায় পিতা-মাতার অনুসরণ না করার নির্দেশের সাথে সাথে এ হুকুমও প্ৰদান করেছে যে, দ্বীনের বিরুদ্ধে তো তাদের কথা মানবে না, কিন্তু পার্থিব কাজকর্ম যথা শারীরিক সেবা-যত্ন বা ধন-সম্পদ ব্যয় ও অন্যান্য ক্ষেত্ৰে যেন কার্পণ্য প্রদর্শিত না হয়। তাদের প্রতি বেআদবী ও অশালীনতা প্রদর্শন করো না।

তাদের কথাবার্তার এমনভাবে উত্তর দিবে না, যাতে অহেতুক মনোবেদনার উদ্রেক করে। মোটকথা, শিরক-কুফরীর ক্ষেত্রে তাদের কথা না মানার কারণে যে মর্মপীড়ার উদ্রেক হবে, তা তো অপারগতা হেতু বরদাশত করবে, কিন্তু প্রয়োজনকে তার সীমার মধ্যেই রাখতে হবে। অন্যান্য ব্যাপারে যেন মনোকষ্টের কারণ না ঘটে সে সম্পর্কে সচেতন থাকবে। [কুরতুবী, তাবারী, সা’দী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৫) তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার অংশী করতে পীড়াপীড়ি করে, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মান্য করো না, তবে পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে সদভাবে বসবাস কর এবং যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে তার পথ অবলম্বন কর,[1] অতঃপর আমারই নিকট তোমাদের প্রত্যাবর্তন এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে অবহিত করব। [2]

[1] অর্থাৎ, (বিশ্বাসী) মুমিনের পথ।

[2] অর্থাৎ, আমার অভিমুখী বিশ্বাসীর পথ অনুসরণ এই জন্য করবে যে, অবশেষে তোমাদের সকলকেই আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে এবং আমারই পক্ষ থেকে সকলকেই তার ভাল-মন্দ কর্মের প্রতিফল দেওয়া হবে। যদি তোমরা আমার পথ অনুসরণ কর এবং আমাকে স্মরণ রেখে নিজেদের জীবন পরিচালিত কর, তাহলে কিয়ামতের দিন আমার বিচারালয়ে তোমাদের মুখ উজ্জ্বল হওয়ার আশা করা যায়। পক্ষান্তরে এর বিপরীত কর্মে আমার আযাবে গ্রেফতার হবে। কথা লুকমান হাকীমের অসিয়ত প্রসঙ্গে চলছিল। সামনে পুনরায় সেই অসিয়ত বর্ণনা করা হচ্ছে, যা তিনি আপন বৎসকে করেছিলেন। মাঝের দুটি আয়াতে পৃথকভাবে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। যার প্রথম কারণ এই বলা হয়েছে যে, লুকমান উক্ত অসিয়ত তাঁর ছেলেকে করেননি। কারণ, এতে তাঁর নিজস্ব স্বার্থ ছিল। দ্বিতীয় কারণ এই যে, যাতে এটা পরিষ্ফুটিত হয়ে যায় যে,আল্লাহর একত্ব ও ইবাদতের পর পিতা-মাতার আনুগত্য ও তাদের সেবা করা জরুরী। তৃতীয় কারণ এই যে, শিরক করা এত বড় পাপ যে, যদি পিতা-মাতা তা করার আদেশ করেন, তাহলে তাঁদের কথা মানা চলবে না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৬ یٰبُنَیَّ اِنَّهَاۤ اِنۡ تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّۃٍ مِّنۡ خَرۡدَلٍ فَتَكُنۡ فِیۡ صَخۡرَۃٍ اَوۡ فِی السَّمٰوٰتِ اَوۡ فِی الۡاَرۡضِ یَاۡتِ بِهَا اللّٰهُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَطِیۡفٌ خَبِیۡرٌ ﴿۱۶﴾
یبنی انها ان تك مثقال حبۃ من خردل فتكن فی صخرۃ او فی السموت او فی الارض یات بها الله ان الله لطیف خبیر ﴿۱۶﴾
• ‘হে আমার প্রিয় বৎস, নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষা দানার পরিমাণ হয়, অতঃপর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমানসমূহে বা যমীনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ’।

-আল-বায়ান

• হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় আর তা থাকে পাথরের ভিতরে অথবা আকাশে অথবা যমীনের নীচে, আল্লাহ তাকে এনে হাজির করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্ণদর্শী, সব কিছুর খবর রাখেন।

-তাইসিরুল

• হে বৎস! কোন কিছু যদি সরিষার দানা পরিমানও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মাটির নীচে, আল্লাহ ওটাও হাযির করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে খবর রাখেন।

-মুজিবুর রহমান

• [And Luqman said], "O my son, indeed if wrong should be the weight of a mustard seed and should be within a rock or [anywhere] in the heavens or in the earth, Allah will bring it forth. Indeed, Allah is Subtle and Acquainted.

-Sahih International

১৬. হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা থাকে শিলাগর্ভে অথবা আসমানসমূহে কিংবা যমীনে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন।(১) নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।

(১) এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আসমান ও যমীন এবং এর মাঝে যা কিছু আছে, এর প্রতিটি বিন্দুকণা আল্লাহর অসীম জ্ঞানের আওতাধীন এবং সবকিছুর উপর তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা ও আধিপত্য রয়েছে। কোন বস্তু যত গভীর আঁধার বা যবনিকার অন্তরালেই থাক না কেন - মহান আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না এবং তিনি যে কোন বস্তুকে যখন ও যেখানে ইচ্ছা উপস্থিত করতে পারেন। যাবতীয় বস্তু মহান আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার আওতাভুক্ত। আল্লাহর জ্ঞান ও তাঁর পাকড়াও এর বাইরে কেউ যেতে পারে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা তোমার দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে তা সুস্পষ্ট। আকাশ মণ্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্ন স্তরে পতিত কোন জিনিস, তোমার কাছে কোথায়, কোন অবস্থায় ও কী অবস্থায় রয়েছে, তুমি যে কোন সৎ বা অসৎ কাজই করো না কেন, তা আল্লাহর অগোচরে নয়। তিনি কেবল তা জানেন তাই নয় বরং যখন হিসেব-নিকেশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৬) ‘হে বৎস ! কোন (পাপ অথবা পুণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়[1] এবং তা যদি কোন পাথরের ভিতরে অথবা আকাশমন্ডলীতে অথবা মাটির নীচে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সকল বিষয়ে অবগত।

[1] هَا সর্বনামের ইঙ্গিত যদি خَطِيئَة এর দিকে হয়, তাহলে তার অর্থ হবে আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপকর্ম। আর যদি خَصلَة এর দিকে হয়, তাহলে তার অর্থ হবে ভাল অথবা মন্দের যে কোন অভ্যাস। উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ ভাল অথবা মন্দ কর্ম যতই গোপনে করুক না কেন, তা আল্লাহর কাছে লুক্কায়িত থাকতে পারে না; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তা উপস্থিত করে নেবেন। অর্থাৎ, তার যথাযথভাবে ভাল আমলের ভাল প্রতিদান ও মন্দ আমলের মন্দ প্রতিফল দেবেন। সরিষা দানার উদাহরণ এই জন্য দিয়েছেন যে,তা এত ছোট হয়, যার না ওজন বুঝা যায় আর না দাঁড়িপাল্লাকে ঝুঁকাতে পারে। অনুরূপ পাথর (সাধারণত বসবাসের স্থান থেকে দূরে জঙ্গল বা পাহাড়ে) একান্ত গুপ্ত ও সুরক্ষিত স্থান। এই অর্থ হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যদি কোন ব্যক্তি এমন ছিদ্রহীন পাথরেও কোন আমল করে, যার কোন দরজা বা জানালা নেই, তাহলেও আল্লাহ্ তাআলা তাও মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেবেন সে আমল যে ধরনেরই হোক না কেন।’’ (আহমদ ৩ /২৮) এই জন্য যে, আল্লাহ তাআলা সূক্ষ্মদর্শী; তিনি অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। নিতান্ত গুপ্ত বস্তুও তাঁর জ্ঞান বহির্ভূত নয় এবং তিনি সর্বজ্ঞ; রাতের অন্ধকারে পিঁপড়ের চলা-ফেরা করার খবরও তিনি রাখেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৭ یٰبُنَیَّ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ وَ اۡمُرۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ انۡهَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ وَ اصۡبِرۡ عَلٰی مَاۤ اَصَابَكَ ؕ اِنَّ ذٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ الۡاُمُوۡرِ ﴿ۚ۱۷﴾
یبنی اقم الصلوۃ و امر بالمعروف و انه عن المنكر و اصبر علی ما اصابك ان ذلك من عزم الامور ﴿۱۷﴾
• ‘হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎকাজে নিষেধ কর এবং তোমার উপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ’।

-আল-বায়ান

• হে বৎস! তুমি নামায কায়িম কর, সৎ কাজের নির্দেশ দাও আর মন্দ কাজ হতে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয় এটা দৃঢ় সংকল্পের কাজ।

-তাইসিরুল

• হে বৎস! সালাত কায়েম করবে, ভাল কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করবে এবং আপদে-বিপদে ধৈর্য ধারণ করবে, এটাইতো দৃঢ় সংকল্পের কাজ।

-মুজিবুর রহমান

• O my son, establish prayer, enjoin what is right, forbid what is wrong, and be patient over what befalls you. Indeed, [all] that is of the matters [requiring] determination.

-Sahih International

১৭. হে আমার প্রিয় বৎস! সালাত কায়েম করো, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অসৎ কাজে নিষেধ কর, আর তোমার উপর যা আপতিত হয় তাতে ধৈৰ্য ধারণ করা। নিশ্চয় এটা অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৭) হে বৎস ! যথারীতি নামায পড়, সৎকাজের নির্দেশ দাও, অসৎকাজে বাধা দান কর এবং আপদে-বিপদে ধৈর্য ধারণ কর। [1] নিশ্চয়ই এটিই দৃঢ় সংকল্পের কাজ। [2]

[1] নামায প্রতিষ্ঠা, ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান এবং মুসীবতে ধৈর্যধারণ করার কথা উল্লেখ এই জন্য করা হয়েছে যে, উক্ত তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও ভাল কাজের মূল বা ভিত্তি।

[2] অর্থাৎ, পূর্বে আলোচিত কথাগুলি ঐ সকল কর্মের অন্তর্ভুক্ত, যে বিষয়ে আল্লাহ্ তাআলা তাকীদ করেছেন এবং বান্দার উপর তা ফরয করেছেন। অথবা এ হল শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় হিম্মত সৃষ্টি করার জন্য উদ্বুদ্ধকারী। কারণ শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় হিম্মত ছাড়া উল্লিখিত নির্দেশাবলীর উপর আমল অসম্ভব। কোন কোন মুফাসসিরের মতে ذلك (এটি) বলে ধৈর্যের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইতিপূর্বে ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের অসিয়ত করা হয়েছে। যেহেতু সে পথে বিভিন্ন কষ্ট ও মানুষের কথার খোঁচা ইত্যাদি হওয়াটা স্বাভাবিক সেহেতু তার পরেই ধৈর্যধারণের কথা বলে পরিষ্কার বুঝানো হয়েছে যে, ধৈর্যধারণ করবে। কেননা, তা শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় হিম্মতের কাজ। আর তা শক্ত মনোবল ও সুদৃঢ় হিম্মত পোষণকারী সংকল্পবদ্ধ মানুষদের জন্য একটা বড় হাতিয়ার; যে হাতিয়ার ছাড়া তবলীগের কাজ করা সম্ভব নয়।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৮ وَ لَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَ لَا تَمۡشِ فِی الۡاَرۡضِ مَرَحًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ ﴿ۚ۱۸﴾
و لا تصعر خدك للناس و لا تمش فی الارض مرحا ان الله لا یحب كل مختال فخور ﴿۱۸﴾
• ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না’।

-আল-বায়ান

• অহংকারের বশবর্তী হয়ে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা কর না, আর পৃথিবীতে গর্বভরে চলাফেরা কর না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।

-তাইসিরুল

• অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করনা এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করনা। কারণ আল্লাহ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেননা।

-মুজিবুর রহমান

• And do not turn your cheek [in contempt] toward people and do not walk through the earth exultantly. Indeed, Allah does not like everyone self-deluded and boastful.

-Sahih International

১৮. আর তুমি মানুষের প্রতি অবজ্ঞাভরে তোমার গাল বাঁকা কর না(১) এবং যমীনে উদ্ধতভাবে বিচরণ কর না(২); নিশ্চয় আল্লাহ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।(৩)

(১) পঞ্চম উপদেশ সামাজিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে, বলা হয়েছে যে, লোকের সাথে সাক্ষাত বা কথোপকথনের সময় মুখ ফিরিয়ে রেখো না-যা তাদের প্রতি উপেক্ষা ও অহংকারের নিদর্শন এবং ভদ্রোচিত স্বভাব ও আচরণের পরিপন্থী। এর আরেক অর্থ হলো, মানুষের প্রতি গাল বাঁকা করে কথা বলো না। এ অর্থ অনুসারে তার প্রতি তাকিয়েও যদি গাল বাঁকা করে তাকে অপমান করা উদ্দেশ্য হয় তবে তাও নিষিদ্ধ হবে। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

(২) অর্থাৎ গর্বভরে ঔদ্ধত্যের সহিত বিচরণ করো না। আল্লাহ ভূমিকে যাবতীয় বস্তু হতে নত ও পতিত করে সৃষ্টি করেছেন। তোমাদের সৃষ্টিও এ মাটি দিয়েই। তোমরা এর উপর দিয়েই চলাফেরা করা-নিজের নিগুঢ় তত্ত্ব বুঝতে চেষ্টা কর। আত্মাভিমানীদের ধারা অনুসরণ করে অহংকারভরে বিচরণ করো না। আল্লাহ কোন অহংকারী আত্মাভিমানীকে পছন্দ করেন না। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যার অন্তরে শরিষা দানা পরিমান ঈমান আছে সে জাহান্নামে যাবে না, পক্ষান্তরে যার অন্তরে শরিষা দানা পরিমান অহংকার আছে সে জান্নাতে যাবে না।’ [মুসলিম: ১৩২] অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আর তিনজনকে আল্লাহ পছন্দ করেন না, অহংকারী, দাম্ভিক। যেমন তোমরা আল্লাহর কিতাবে পাও, তারপর আলোচ্য আয়াত তেলাওয়াত করলেন। আর দান করে খোঁটা প্রদানকারী কৃপণ ব্যক্তি; এরং শপথের মাধ্যমে বিক্রয়কারী। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৭৬]

(৩) ‘মুখতোল’ মানে হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে নিজেই নিজেকে কোন বড় কিছু মনে করে। আর ‘ফাখুর’ তাকে বলে, যে নিজের বড়াই করে অন্যের কাছে। [ইবন কাসীর] মানুষের চালচলনে অহংকার, দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের প্রকাশ তখনই অনিবাৰ্য হয়ে ওঠে, যখন তার মাথায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস ঢুকে যায় এবং সে অন্যদেরকে নিজের বড়াই ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করাতে চায়। [ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৮) মানুষের জন্য নিজের গাল ফুলায়ো না[1] এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না;[2] কারণ আল্লাহ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে ভালবাসেন না।

[1] অর্থাৎ, (অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না।) এমন অহংকার করো না, যাতে তুমি মানুষকে তুচ্ছ ভাবো ও তাকে ঘৃণা কর এবং কোন মানুষ তোমার সাথে কথা বললে তার থেকে বৈমুখ হও অথবা কথোপকথনের সময় নিজ মুখমন্ডলকে অন্য দিকে ফিরিয়ে রাখো। صعر এক প্রকার ব্যাধি, যা উটের মাথা অথবা ঘাড়ে হয় এবং যার ফলে সেই উটের ঘাড় বাঁকা হয়ে যায়। এখানে অহংকার হেতু মুখ ফিরিয়ে নেওয়া (বা মুখ বাঁকানো)র অর্থে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। (ইবনে কাসীর)

[2] অর্থাৎ, এমন বিচরণ ও চালচলন, যাতে ধন-সম্পদ, পদ বা বংশ মর্যাদা অথবা শক্তিমত্তা, ক্ষমতার বড়াই ও অহংকার ফুটে ওঠে, তা আল্লাহ পছন্দ করেন না। কারণ মানুষ একজন অক্ষম ও নগণ্য বান্দা মাত্র। তাই আল্লাহ তাআলা এটাই পছন্দ করেন যে, সে নিজের মান ও অবস্থা অনুযায়ী বিনয় ও নম্রতা বজায় রাখবে এবং তা অতিক্রম করে অহংকার প্রদর্শন করবে না। কারণ গর্ব ও অহংকার শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই শোভনীয়; যিনি সকল এখতিয়ারের মালিক এবং সকল গুণের অধিকারী। এই জন্যই হাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘আল্লাহ আয্যা অজাল্ল্ বলেন, গৌরব ও গর্ব খাস আমার গুণ। সুতরাং যে তাতে আমার অংশী হতে চাইবে, আমি তাকে শাস্তি দেব।’’ (মুসলিম ২৬২০নং) ‘‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অন্তরে সরিষার দানা সমপরিমাণ অহংকার আছে।’’ (আহমাদ ১/৪১২, তিরমিযী) ‘‘যে ব্যক্তি অহংকার হেতু নিজ (পরনের) কাপড় (মাটিতে) ছেঁচড়ে চলাফেরা করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার দিকে তাকিয়ে দেখবেন না।’’ (আহমাদ ৫/১০৯, বুখারীঃ কিতাবুল লিবাস) তা সত্ত্বেও অহংকার প্রকাশ না করে আল্লাহর নিয়ামত প্রকাশ বা ভাল পোশাক পরা ও উত্তম খাবার খাওয়া ইত্যাদি অবৈধ নয়। (বরং অহংকার প্রকাশ না করে আল্লাহর নিয়ামত প্রকাশ করাই উত্তম।)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ১৯ وَ اقۡصِدۡ فِیۡ مَشۡیِكَ وَ اغۡضُضۡ مِنۡ صَوۡتِكَ ؕ اِنَّ اَنۡكَرَ الۡاَصۡوَاتِ لَصَوۡتُ الۡحَمِیۡرِ ﴿۱۹﴾
و اقصد فی مشیك و اغضض من صوتك ان انكر الاصوات لصوت الحمیر ﴿۱۹﴾
• ‘আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ’।

-আল-বায়ান

• চলাফেরায় সংযত ভাব অবলম্বন কর এবং কণ্ঠস্বর নীচু কর। স্বরের মধ্যে নিশ্চয়ই গাধার স্বর সর্বাপেক্ষা শ্রুতিকটু।

-তাইসিরুল

• পদচারণায় মধ্য পন্থা অবলম্বন করবে এবং তোমার কন্ঠস্বর করবে নীচু; স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।

-মুজিবুর রহমান

• And be moderate in your pace and lower your voice; indeed, the most disagreeable of sounds is the voice of donkeys."

-Sahih International

১৯. আর তুমি তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর(১) এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু করো(২); নিশ্চয় সুরের মধ্যে গর্দভের সুরই সবচেয়ে অপ্ৰীতিকর।(৩)

(১) অর্থাৎ দৌড়-ধাপসহ চলো না, যা সভ্যতা ও শালীনতার পরিপন্থী। এভাবে চলার ফলে নিজেরও দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আশংকা থাকে বা অপরের দুর্ঘটনার কারণও ঘটতে পারে। আবার অত্যধিক মন্থর গতিতেও চলো না—যা সেসব গর্বস্ফীত আত্মাভিমানীদের অভ্যাস, যারা অন্যান্য মানুষের চাইতে নিজের অসার কৌলিন্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে চায়। অথবা সেসব স্ত্রীলোকদের অভ্যাস, যারা অত্যধিক লজ্জা-সংকোচের দরুন দ্রুতগতিতে বিচরণ করে না। অথবা অক্ষম ব্যাধিগ্রস্তদের অভ্যাস। প্রথমটি তো হারাম। দ্বিতীয়টি যদি নারী জাতির অনুসরণে করা হয় তাও না-জায়েয। আর যদি এ উদ্দেশ্য না থাকে, তবে পুরুষের পক্ষে এটা একটা কলঙ্ক। তৃতীয় অবস্থায় আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন—সুস্থ থাকা সত্বেও রোগগ্রস্তদের রূপ ধারণ করা। [ইবন কাসীর, কুরতুবী]

(২) অর্থাৎ তোমাদের স্বর ক্ষীণ কর। যার অর্থ স্বর প্রয়োজনীতিরিক্ত উচ্চ করো না। [ইবন কাসীর, কুরতুবী]

(৩) অর্থাৎ চতুস্পদ জন্তুসমূহের মধ্যে গাধার চীৎকারই অত্যন্ত বিকট ও শ্রুতিকটু। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৯) তুমি তোমার চলনে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর[1] এবং তোমার কণ্ঠস্বর নীচু কর;[2] স্বরের মধ্যে গাধার সবরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’

[1] অর্থাৎ চলন যেন এমন ধীর গতির না হয়, যাতে দেখে অসুস্থ মনে হয় এবং এমন দ্রুত গতিরও না হয়, যা সম্ভ্রম ও গাম্ভীর্যের পরিপন্থী হয়। এ কথাকে অন্য জায়গায় এভাবে বলা হয়েছে, (يَمْشُوْنَ عَلَى الاَرْضِ هَوْنًا) ‘‘(আল্লাহর বান্দাগণ) পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’’ (সূরা ফুরকান ৬৩ আয়াত)

[2] অর্থাৎ, উচ্চ স্বরে (চিৎকার করে) কথা বলবে না। কারণ বেশি চিৎকার করে কথা বলা যদি পছন্দনীয় হতো, তাহলে গাধার আওয়াজ সব থেকে উত্তম গণ্য হতো। কিন্তু তা হয় না, বরং গাধার আওয়াজ সর্বনিকৃষ্ট ও সকলের কাছে অপছন্দনীয়। এই জন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘গাধার চিৎকার শুনলে শয়তান থেকে (আল্লাহর নিকট) আশ্রয় প্রার্থনা করো।’’ (বুখারীঃ বাদউল খালক অধ্যায়, মুসলিম ইত্যাদি)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
৩১ : ২০ اَلَمۡ تَرَوۡا اَنَّ اللّٰهَ سَخَّرَ لَكُمۡ مَّا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ اَسۡبَغَ عَلَیۡكُمۡ نِعَمَهٗ ظَاهِرَۃً وَّ بَاطِنَۃً ؕ وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یُّجَادِلُ فِی اللّٰهِ بِغَیۡرِ عِلۡمٍ وَّ لَا هُدًی وَّ لَا كِتٰبٍ مُّنِیۡرٍ ﴿۲۰﴾
الم تروا ان الله سخر لكم ما فی السموت و ما فی الارض و اسبغ علیكم نعمهٗ ظاهرۃ و باطنۃ و من الناس من یجادل فی الله بغیر علم و لا هدی و لا كتب منیر ﴿۲۰﴾
• তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে। আর তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিআমত ব্যাপক করে দিয়েছেন; মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করে জ্ঞান, হিদায়াত ও আলো দানকারী কিতাব ছাড়া।

-আল-বায়ান

• তোমরা কি লক্ষ্য কর না যে, যা কিছু আসমানসমূহে আর যমীনে আছে, আল্লাহ সমস্তই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নি‘য়ামাতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? কতক মানুষ জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহ সম্বন্ধে বাক-বিতন্ডা করে, তাদের না আছে সঠিক পথের দিশা, আর না আছে কোন আলোপ্রদ কিতাব।

-তাইসিরুল

• তোমরা কি দেখনা যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন? মানুষের মধ্যে কেহ কেহ অজ্ঞতা বশতঃ আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে, তাদের না আছে পথ নির্দেশক আর না আছে কোন দীপ্তিমান কিতাব।

-মুজিবুর রহমান

• Do you not see that Allah has made subject to you whatever is in the heavens and whatever is in the earth and amply bestowed upon you His favors, [both] apparent and unapparent? But of the people is he who disputes about Allah without knowledge or guidance or an enlightening Book [from Him].

-Sahih International

২০. তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সবকিছুই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন?(১) আর মানুষের মধ্যে কেউ কেউ কোন জ্ঞান, কোন পথনির্দেশ বা কোন দীপ্তিমান কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে।

(১) অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের উপর তার প্রকাশ্য-অপ্ৰকাশ্য সকল প্রকারের নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। প্রকাশ্য নেয়ামত বলতে সেসব নেয়ামতকেই বোঝায়, যা মানুষ তার পঞ্চেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে অনুধাবন করতে পারে। যেমন, মনোরম আকৃতি, মানুষের সুঠাম ও সংবদ্ধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং প্রত্যেক অংগ এমন সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে তৈরী করা যেন তা মানুষের কাজে সর্বাধিক সহায়কও হয় অথচ আকৃতি-প্রকৃতিতেও কোন প্রকারের বিকৃতি না ঘটায়। অনুরূপভাবে জীবিকা, ধন-সম্পদ, জীবনযাপনের মাধ্যমসমূহ, সুস্থতা ও কুশলাবস্থা—এসবই ইন্দ্ৰিয়গ্রাহ্য নেয়ামত ও অনুকম্পাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। তদ্রুপ দ্বীন ইসলামকে সহজ ও অনায়াসলব্ধ করে দেয়া, আল্লাহ-রাসূলের অনুসরণ ও আনুগত্য প্রদর্শনের তওফীক প্ৰদান, অন্যান্য দ্বীনের উপর ইসলামের বিজয় ও প্রভাবশীলতা এবং শক্ৰদের মোকাবেলায় মুসলিমদের প্রতি সাহায্য ও সহায়তা- এসবই প্রকাশ্য নেয়ামতসমূহের পর্যায়ভুক্ত।

আর গোপনীয় নেয়ামত সেগুলো, যা মানব হৃদয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত- যথা ঈমান, আল্লাহর পরিচয় লাভ এবং জ্ঞান-বুদ্ধি, সচ্চরিত্র, পাপসমূহ গোপন করা ও অপরাধসমূহের ত্বরিৎ শাস্তি আরোপিত না হওয়া ইত্যাদি। অথবা যেসব নেয়ামত মানুষ জানে না এবং অনুভবও করে না সেগুলো গোপন নিয়ামত। মানুষের নিজের শরীরে এবং তার বাইরে দুনিয়ায় তার স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে এমন অগণিত ও অসংখ্য জিনিস রয়েছে কিন্তু মানুষ জানেও না যে, তার স্রষ্টা তার হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য, তাকে জীবিকা দান করার জন্য, তার বৃদ্ধি ও বিকাশ সাধনের জন্য এবং তার কল্যাণার্থে কত রকমের সাজ-সরঞ্জাম যোগাড় করে রেখেছেন। [দেখুন: ফাতহুল কাদীর; বাগভী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(২০) তোমরা কি দেখ না যে, আল্লাহ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন[1] এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করেছেন?[2] মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিতন্ডা করে; তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথনির্দেশ এবং না আছে কোন দীপ্তিমান গ্রন্থ।[3]

[1] تسخير এর অর্থ হল উপকার নেওয়া। এখানে তাকে কাজে লাগানো, অধীন করা বা সেবায় নিয়োজিত করার অর্থ করা হয়েছে। যেমন সৌরজগৎ; চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সকল বস্তুকে আল্লাহ তাআলা এমন নিয়মের অধীন করে দিয়েছেন যে, তারা মানুষের উপকারার্থে অবিরাম কাজ করে চলেছে এবং মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। এর দ্বিতীয় অর্থ হলঃ অধীন করে দেওয়া। সুতরাং এ পৃথিবীর বহু সৃষ্টিকে মানুষের অধীনস্থ করে দেওয়া হয়েছে; যা মানুষ নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করে থাকে। যেমন মাটি, উদ্ভিদ, জীব-জন্তু ইত্যাদি। অতএব تسخير এর অর্থ এই হল যে, আকাশ ও পৃথিবীর সকল বস্তু মানুষের উপকারে নিয়োজিত। তাতে তা মানুষের অধীনে হোক বা মানুষের অধীনের বাইরে। (ফাতহুল ক্বাদীর)

[2] প্রকাশ্য নিয়ামত ও অনুগ্রহের অর্থ হল, যা জ্ঞান ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায়। আর অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ ও নিয়ামত হল, যা মানুষের অনুভূতির বাইরে। এই উভয় প্রকার নিয়ামত এতই অসংখ্য ও বেশি যে, মানুষ তা গণনা করতে অক্ষম।

[3] অর্থাৎ, এর পরেও মানুষ আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক-ঝগড়া করে; কেউ তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে, কেউ তাঁর সাথে শরীক স্থাপন করা নিয়ে এবং কেউ তাঁর শরীয়ত ও আহকাম নিয়ে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 পরের পাতা »