بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
সূরাঃ ১২/ ইউসুফ | Yusuf | يُوسُف আয়াতঃ ১১১ মাক্কী

১২ : ১১

قَالُوۡا یٰۤاَبَانَا مَا لَكَ لَا تَاۡمَنَّا عَلٰی یُوۡسُفَ وَ اِنَّا لَهٗ لَنٰصِحُوۡنَ ﴿۱۱﴾

قالوا یابانا ما لك لا تامنا علی یوسف و انا لهٗ لنصحون ﴿۱۱﴾
তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা, কী হল আপনার, ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে নিরাপদ মনে করছেন না, অথচ আমরাই তার হিতাকাঙ্ক্ষী’?

-আল-বায়ান

তারা বলল, ‘হে আমাদের আব্বাজান! কী ব্যাপার, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদেরকে বিশ্বাস করেন না কেন, অথচ আমরা অবশ্যই তার কল্যাণকামী।

-তাইসিরুল

তারা বললঃ হে আমাদের পিতা! ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে অবিশ্বাস করছেন কেন, যদিও আমরা তার হিতাকাংখী?

-মুজিবুর রহমান

They said, "O our father, why do you not entrust us with Joseph while indeed, we are to him sincere counselors?

-Sahih International

১১. তারা বলল, হে আমাদের পিতা! আপনার কি হলো যে, ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে নিরাপদ মনে করছেন না, অথচ আমরা তো তার শুভাকাংখী?

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১১) তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা! ইউসুফের ব্যাপারে আপনি আমাদেরকে অবিশ্বাস করছেন কেন, যদিও আমরা তার হিতাকাঙ্ক্ষী?[1]

[1] এতে বুঝা যায় যে, ইতিপূর্বে ভাইরা ইউসুফ (আঃ)-কে নিজেদের সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং পিতা তাঁদের সাথে পাঠাতে অস্বীকার করেছিলেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১২

اَرۡسِلۡهُ مَعَنَا غَدًا یَّرۡتَعۡ وَ یَلۡعَبۡ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوۡنَ ﴿۱۲﴾

ارسله معنا غدا یرتع و یلعب و انا لهٗ لحفظون ﴿۱۲﴾
‘আপনি আগামী কাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন, সে সানন্দে ঘোরাফেরা করবে ও খেলবে। আর অবশ্যই আমরা তার হেফাযতকারী’।

-আল-বায়ান

তাকে আগামীকাল আমাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিন, সে আমোদ করবে আর খেলবে, আমরা তার পুরোপুরি দেখাশুনা করব।’

-তাইসিরুল

আপনি আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন, সে ফলমূল খাবে ও খেলাধুলা করবে, আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব।

-মুজিবুর রহমান

Send him with us tomorrow that he may eat well and play. And indeed, we will be his guardians.

-Sahih International

১২. আপনি আগামী কাল তাকে আমাদের সাথে পাঠান, সে সানন্দে ঘোরাফেরা করবে ও খেলাধুলা করবে(১)। আর আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণকারী হব।

(১) এ আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর কাছে আনন্দ-ভ্রমণ এবং স্বাধীনভাবে পানাহার ও খেলাধুলার অনুমতি চাওয়া হয়েছে। ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাদেরকে এ ব্যাপারে নিষেধ করেননি। তিনি শুধু ইউসুফকে তাদের সাথে দিতে ইতস্ততঃ করেছেন, যা পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত হবে। এতে বোঝা গেল যে, তাদের আনন্দ-ভ্রমণ ও খেলাধুলা শরীআতের সীমার মধ্যে ছিল। [কুরতুবী] আর খেলাধুলা বিধিবদ্ধ সীমার ভেতরে নিষিদ্ধ নয়, বরং সহীহ হাদীস থেকেও এর বৈধতা জানা যায়। তবে শর্ত এই যে, খেলাধুলায় শরীআতের সীমা লঙ্ঘন বাঞ্ছনীয় নয় এবং তাতে শরীআতের বিধান লঙ্ঘিত হতে পারে এমন কোন কিছুর মিশ্রণও উচিত নয়।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১২) আপনি আগামীকাল তাকে আমাদের সাথে প্রেরণ করুন, সে ফল-মূল খাবে ও খেলাধূলা করবে,[1] আমরা অবশ্যই তার রক্ষণাবেক্ষণ করব।’

[1] খেলাধূলা ও ভ্রমণের প্রতি আকর্ষণ মানুষের (বিশেষ করে শিশুদের) প্রকৃতিগত স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। এই জন্য আল্লাহ তাআলা কোন যুগেই বৈধ খেলা ও ভ্রমণের ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা জারী করেননি। ইসলামেও শর্ত-সাপেক্ষে তার বৈধতা আছে। অর্থাৎ, এমন খেলাধূলা ও ভ্রমণ বৈধ, যাতে শরয়ী কোন আপত্তি না থাকে অথবা তা কোন হারাম পর্যন্ত পৌঁছে না দেয়। সুতরাং ইয়াকূব (আঃ)ও খেলাধূলার ব্যাপারে কোন আপত্তি করেননি। অবশ্য এই আশঙ্কা প্রকাশ করলেন যে, তোমরা খেলাধূলায় বিভোর হয়ে যাবে, আর তাকে হয়তো নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলবে। কারণ সেই এলাকার উন্মুক্ত ময়দানে ও মরুভূমিতে সাধারণতঃ নেকড়ে বাঘ থাকত।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৩

قَالَ اِنِّیۡ لَیَحۡزُنُنِیۡۤ اَنۡ تَذۡهَبُوۡا بِهٖ وَ اَخَافُ اَنۡ یَّاۡكُلَهُ الذِّئۡبُ وَ اَنۡتُمۡ عَنۡهُ غٰفِلُوۡنَ ﴿۱۳﴾

قال انی لیحزننی ان تذهبوا بهٖ و اخاف ان یاكله الذئب و انتم عنه غفلون ﴿۱۳﴾
সে বলল, ‘নিশ্চয় এটা আমাকে কষ্ট দেবে যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশঙ্কা করি, নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলবে, যখন তোমরা তার ব্যাপারে গাফিল থাকবে’।

-আল-বায়ান

পিতা বলল, ‘তোমরা যে তাকে নিয়ে যাবে সেটা আমাকে অবশ্যই কষ্ট দেবে আর আমি ভয় করছি যে, নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে, আর তখন তার সম্পর্কে তোমরা বে-খেয়াল হয়ে থাকবে।’

-তাইসিরুল

সে বললঃ এটা আমাকে কষ্ট দিবে যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি ভয় করি, তোমরা তার প্রতি অমনোযোগী হলে তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে।

-মুজিবুর রহমান

[Jacob] said, "Indeed, it saddens me that you should take him, and I fear that a wolf would eat him while you are of him unaware."

-Sahih International

১৩. তিনি বললেন, এটা আমাকে অবশ্যই কষ্ট দেবে যে, তোমরা তাকে নিয়ে যাবে এবং আমি আশংকা করি তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে, আর তোমরা তার প্রতি অমনোযোগী থাকবে।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৩) সে বলল, ‘তোমাদের ওকে নিয়ে যাওয়াটা আমার দুশ্চিন্তার কারণ হবে। আর আমার ভয় হয় যে, তোমরা ওর প্রতি অমনোযোগী হলে ওকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলবে।’

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৪

قَالُوۡا لَئِنۡ اَكَلَهُ الذِّئۡبُ وَ نَحۡنُ عُصۡبَۃٌ اِنَّاۤ اِذًا لَّخٰسِرُوۡنَ ﴿۱۴﴾

قالوا لئن اكله الذئب و نحن عصبۃ انا اذا لخسرون ﴿۱۴﴾
তারা বলল, ‘আমরা একই দলভুক্ত থাকা সত্ত্বেও যদি নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলে তাহলে তো আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত’।

-আল-বায়ান

তারা বলল, ‘আমরা একটা দল থাকতে তাকে যদি নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলে, তাহলে তো আমরা অপদার্থই বনে যাবো।’

-তাইসিরুল

তারা বললঃ আমরা একটি সংহত দল হওয়া সত্ত্বেও যদি তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলে তাহলেতো আমরা ক্ষতিগ্রস্তই হব।

-মুজিবুর রহমান

They said, "If a wolf should eat him while we are a [strong] clan, indeed, we would then be losers."

-Sahih International

১৪. তারা বলল, আমরা একটি সংহত দল হওয়া সত্ত্বেও যদি নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলে, তবে তো আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৪) তারা বলল, ‘আমরা একটি (সংহত) দল হওয়া সত্ত্বেও যদি নেকড়ে বাঘ ওকে খেয়ে ফেলে, তাহলে তো আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’ [1]

[1] এই কথা দ্বারা পিতাকে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে যে, তা কি করে সম্ভব হতে পারে? আমাদের এতগুলো ভায়ের উপস্থিতিতে ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলবে?

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৫

فَلَمَّا ذَهَبُوۡا بِهٖ وَ اَجۡمَعُوۡۤا اَنۡ یَّجۡعَلُوۡهُ فِیۡ غَیٰبَتِ الۡجُبِّ ۚ وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡهِ لَتُنَبِّئَنَّهُمۡ بِاَمۡرِهِمۡ هٰذَا وَ هُمۡ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۱۵﴾

فلما ذهبوا بهٖ و اجمعوا ان یجعلوه فی غیبت الجب و اوحینا الیه لتنبئنهم بامرهم هذا و هم لا یشعرون ﴿۱۵﴾
অতঃপর যখন তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে কূপের গভীরে ফেলে দিতে একমত হল (তখন তারা তাই করল) এবং আমি তার নিকট ওহী প্রেরণ করলাম এই মর্মে যে,‘অবশ্যই তুমি তাদেরকে (ভবিষ্যতে) তাদের এই কর্ম সম্পর্কে জানাবে, এমতাবস্থায় যে, তারা উপলব্ধি করতে পারবে না’।*

-আল-বায়ান

অতঃপর যখন তারা তাকে নিয়ে গেল, আর তাকে অন্ধ কূপে ফেলার ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছল, এমতাবস্থায় আমি ইউসুফকে ওয়াহী করলাম- এক সময় আসবে যখন তুমি তাদেরকে তাদের এ কর্মের কথা অবশ্য অবশ্যই ব্যক্ত করবে।’ অথচ তারা (অর্থাৎ ইউসুফের ভাইয়েরা) মোটেই টের পাবে না।

-তাইসিরুল

অতঃপর যখন তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে গভীর কূপে নিক্ষেপ করতে একমত হল, এমতাবস্থায় আমি তাকে জানিয়ে দিলামঃ তুমি তাদেরকে তাদের এই কর্মের কথা অবশ্যই বলে দিবে যখন তারা তোমাকে চিনবেনা।

-মুজিবুর রহমান

So when they took him [out] and agreed to put him into the bottom of the well... But We inspired to him, "You will surely inform them [someday] about this affair of theirs while they do not perceive [your identity]."

-Sahih International

* অর্থাৎ এ অনুভূতি তাদের থাকবে না যে, তারা এরকম কান্ড ঘটিয়েছিল এবং ইউসুফকে দেখেও ভাই হিসেবে চিনতে পারবে না।

১৫. অতঃপর তারা যখন তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে একমত হল, আর এ অবস্থায় আমরা তাকে জানিয়ে দিলাম, তুমি তাদেরকে তাদের এ কাজের কথা অবশ্যই বলে দেবে; অথচ তারা তা উপলব্ধি করতে পারবে না।(১)

(১) এ আয়াতের বিভিন্ন প্রকার অর্থ করা হয়ে থাকেঃ

১) ইবনে আব্বাস বলেন, ভাইয়েরা যখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে জঙ্গলে নিয়ে গেল এবং তাকে হত্যা করার ব্যাপারে কুপের গভীরে নিক্ষেপ করতে সবাই ঐকমত্যে পৌছল, তখন আল্লাহ্ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম-কে সংবাদ দিলেন যে, একদিন আসবে, যখন তুমি ভাইদের কাছে তাদের এ কুকর্মের কথা ব্যক্ত করবে। তারা তখন তোমার অবস্থানের ব্যাপারটি সম্পর্কে কিছু কল্পনাই করতে পারবে না। [ইবন কাসীর]

২) কাতাদাহ বলেনঃ এ আয়াতের অর্থ- আল্লাহ তা'আলা ইউসুফ আলাইহিস্ সালাম-এর কাছে কুপের মধ্যে ওহী প্রেরণ করে জানালেন যে, আপনি অচিরেই তাদেরকে এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করবেন। অথচ ইউসুফের ভাইয়েরা সে ওহী সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলনা। [ইবন কাসীর]

৩) ইমাম কুরতুবী বলেনঃ এ ওহী সম্পর্কে দু'প্রকার ধারণা সম্ভবপর। (এক) কুপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তার সান্ত্বনা ও মুক্তির সুসংবাদ দানের জন্য এ ওহী আগমন করেছিল। (দুই) কুপে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তা'আলা ওহীর মাধ্যমে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে ভবিষ্যত ঘটনাবলী বলে দিয়েছিলেন। এতে আরো বলে দিয়েছিলেন যে, তুমি এভাবে ধ্বংস হওয়ার কবল থেকে মুক্ত থাকবে এবং এমন পরিস্থিতি দেখা দেবে যে, তুমি তাদেরকে তিরস্কার করার সুযোগ পাবে; অথচ তারা তোমাকে চিনবেও না যে, তুমিই তাদের ভাই ইউসুফ।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৫) অতঃপর যখন তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে গভীর কূপে নিক্ষেপ করতে একমত হল। এমতাবস্থায় আমি তাকে (ইউসুফকে) জানিয়ে দিলাম, ‘তুমি তাদেরকে তাদের এই কর্মের কথা অবশ্যই বলে দেবে; যখন তারা তোমাকে চিনবে না।’ [1]

[1] কুরআন মাজীদ অতি সংক্ষেপে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করছে। ঘটনা এই যে, যখন তাঁরা তাঁদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ইউসুফ (আঃ)-কে কূপে নিক্ষেপ করলেন, তখন আল্লাহ তাআলা ইউসুফ (আঃ)-কে সান্তনা ও সাহস দেওয়ার জন্য অহী করলেন যে, তুমি ঘাবড়ে যেয়ো না, আমি শুধু তোমার সুরক্ষাই করব না; বরং তোমাকে এমন মর্যাদার অধিকারী করব যে, তোমার সকল ভাইরা তোমার দরবারে ভিক্ষা চাওয়ার জন্য আসবে এবং তুমি তাদেরকে বলবে যে, তোমরা আপন ভায়ের সাথে এর পূর্বে পাষাণ-হৃদয়ের আচরণ করেছিলে, যা শুনে তারা আশ্চর্য হয়ে যাবে। ইউসুফ (আঃ) যদিও সেই সময় শিশু ছিলেন, কিন্তু যে শিশু নবুঅত লাভ করে, শৈশবেও তার প্রতি অহী অবতীর্ণ হয়। যেমন ঈসা ও ইয়াহইয়া (আলাইহিমাস সালাম) প্রভৃতি নবীগণের প্রতি অহী অবতীর্ণ হয়েছিল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৬

وَ جَآءُوۡۤ اَبَاهُمۡ عِشَآءً یَّبۡكُوۡنَ ؕ﴿۱۶﴾

و جآءو اباهم عشآء یبكون ﴿۱۶﴾
আর তারা রাতের প্রথম ভাগে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার নিকট আসল।

-আল-বায়ান

রাতের প্রথম প্রহরে তারা তাদের পিতার কাছে কাঁদতে কাঁদতে আসল।

-তাইসিরুল

তারা রাতে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার নিকট এলো।

-মুজিবুর রহমান

And they came to their father at night, weeping.

-Sahih International

১৬. আর তারা রাতের প্রথম প্রহরে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার কাছে আসল।

-

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৬) তারা রাতে কাঁদতে কাঁদতে তাদের পিতার নিকট এল।

-

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৭

قَالُوۡا یٰۤاَبَانَاۤ اِنَّا ذَهَبۡنَا نَسۡتَبِقُ وَ تَرَكۡنَا یُوۡسُفَ عِنۡدَ مَتَاعِنَا فَاَكَلَهُ الذِّئۡبُ ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ بِمُؤۡمِنٍ لَّنَا وَ لَوۡ كُنَّا صٰدِقِیۡنَ ﴿۱۷﴾

قالوا یابانا انا ذهبنا نستبق و تركنا یوسف عند متاعنا فاكله الذئب و ما انت بمؤمن لنا و لو كنا صدقین ﴿۱۷﴾
তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা, আমরা প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম আর ইউসুফকে রেখে গিয়েছিলাম আমাদের মালপত্রের নিকট, অতঃপর নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলেছে। আর আপনি আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না, যদিও আমরা সত্যবাদী হই’।

-আল-বায়ান

তারা বলল, ‘হে আমাদের আব্বাজান! আমরা দৌড়ের প্রতিযোগিতা করছিলাম, আর ইউসুফকে আমরা আমাদের জিনিসপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম, তখন তাকে নেকড়ে বাঘে খেয়ে ফেলল, কিন্তু আপনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না, আমরা সত্যবাদী হলেও।’

-তাইসিরুল

তারা বললঃ হে আমাদের পিতা! আমরা দৌড়ের প্রতিযোগিতা করেছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের মালপত্রের নিকট রেখে গিয়েছিলাম, অতঃপর তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু আপনিতো আমাদের বিশ্বাস করবেননা, যদিও আমরা সত্যবাদী।

-মুজিবুর রহমান

They said, "O our father, indeed we went racing each other and left Joseph with our possessions, and a wolf ate him. But you would not believe us, even if we were truthful."

-Sahih International

১৭. তারা বলল, হে আমাদের পিতা! আমরা দৌড়ের প্রতিযোগিতা করতে গিয়েছিলাম(১) এবং ইউসুফকে আমাদের মালপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম, অতঃপর নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না যদিও আমরা সত্যবাদী হই।

(১) ইবনুল আরাবী আহকামুল কুরআন গ্রন্থে বলেনঃ পারস্পরিক (দৌড়) প্রতিযোগিতা শরীআতসিদ্ধ এবং একটি উত্তম খেলা। এটা জিহাদেও কাজে আসে। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং এ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার কথা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে। তাছাড়া ঘোড়দৌড়ও প্রমাণিত রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তা করেছেন। [দেখুন, বুখারী: ২৮৭৯; মুসলিম: ১৮৭০] সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সালামা ইবনে আকওয়া জনৈক ব্যক্তির সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। [দেখুন, মুসলিম: ১৮০৭; মুসনাদে আহমাদ: ৪/৫২] উল্লেখিত আয়াত ও বর্ণনা দ্বারা আসল ঘোড়দৌড়ের বৈধতা প্রমাণিত হয়। এছাড়া সাধারণ দৌড়, তীরে লক্ষ্যভেদ ইত্যাদিতেও প্রতিযোগিতা করা বৈধ। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী পক্ষকে তৃতীয় পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করাও জায়েয। কিন্তু পরস্পর হার-জিতে কোন টাকার অংশ শর্ত করা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত, যা কুরআনুল কারীমে হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে। [আহকামুল কুরআন; অনুরূপ দেখুন, কুরতুবী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৭) তারা বলল, ‘হে আমাদের পিতা! আমরা দৌড়-প্রতিযোগিতা করছিলাম এবং ইউসুফকে আমাদের মালপত্রের নিকট রেখে গিয়েছিলাম, অতঃপর নেকড়ে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলেছে; কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে বিশ্বাস করবেন না; যদিও আমরা সত্যবাদী।’ [1]

[1] অর্থাৎ, যদিও আমরা আপনার নিকট বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী হতাম, তবুও আপনি ইউসুফ সম্পর্কে আমাদের কথা সত্য বলে বিশ্বাস করতেন না। এখন তো এমনিতেই আমাদের ব্যক্তিত্ব সন্দিগ্ধ ব্যক্তিদের মত, এখন আপনি আমাদের কথা আর কিভাবে বিশ্বাস করবেন?

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৮

وَ جَآءُوۡ عَلٰی قَمِیۡصِهٖ بِدَمٍ كَذِبٍ ؕ قَالَ بَلۡ سَوَّلَتۡ لَكُمۡ اَنۡفُسُكُمۡ اَمۡرًا ؕ فَصَبۡرٌ جَمِیۡلٌ ؕ وَ اللّٰهُ الۡمُسۡتَعَانُ عَلٰی مَا تَصِفُوۡنَ ﴿۱۸﴾

و جآءو علی قمیصهٖ بدم كذب قال بل سولت لكم انفسكم امرا فصبر جمیل و الله المستعان علی ما تصفون ﴿۱۸﴾
আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। সে বলল, ‘বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্য একটি গল্প সাজিয়েছে। সুতরাং (আমার করণীয় হচ্ছে) সুন্দর ধৈর্য। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে আল্লাহই সাহায্যস্থল’।

-আল-বায়ান

তারা তার জামায় মিছেমিছি রক্ত মাখিয়ে নিয়ে এসেছিল। পিতা বলল, ‘না, বরং তোমাদের প্রবৃত্তি তোমাদেরকে একটা কাহিনী বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ঠিক আছে, আমি পুরোপুরি ধৈর্য ধারণ করব, তোমরা যা বানিয়েছ সে ব্যাপারে আল্লাহই আমার আশ্রয়স্থল।’

-তাইসিরুল

আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লেপন করে এনেছিল। সে বললঃ না, তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে। সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল।

-মুজিবুর রহমান

And they brought upon his shirt false blood. [Jacob] said, "Rather, your souls have enticed you to something, so patience is most fitting. And Allah is the one sought for help against that which you describe."

-Sahih International

১৮. আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লেপন করে এনেছিল। তিনি বললেন, না, বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কাহিনী সাজিয়ে দিয়েছে। কাজেই উত্তম ধৈর্যই আমি গ্রহণ করব। আর তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ্ই আমার সাহায্যস্থল।(১)

(১) অর্থাৎ ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ভ্রাতারা তার জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে এনেছিল, যাতে পিতার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, বাঘই তাকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ঠিকই বুঝলেন যে, ইউসুফকে বাঘে খায়নি; বরং তোমাদেরই মন একটি বিষয় খাড়া করেছে। এখন আমার জন্য উত্তম এই যে, ধৈর্য্যধারণ করি এবং তোমরা যা বল, তাতে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করি।

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৮) আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লেপন করে এনেছিল। সে বলল, ‘বরং তোমাদের মন তোমাদের জন্য একটি কাহিনী গড়ে নিয়েছে। সুতরাং আমার পক্ষে পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়।[1] তোমরা যা বর্ণনা করছ সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল।’[2]

[1] বলা হয় যে, তাঁরা একটি ছাগল ছানা যবেহ করে ইউসুফের জামায় রক্ত লেপন করে নেন এবং এ কথা তাঁরা ভুলে যান যে, যদি ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলত, তবে অবশ্যই তাঁর জামাও ছিঁড়ে যেত। কিন্তু জামা অক্ষত অবস্থায় ছিল। যা দেখে এবং তার উপর ইউসুফ (আঃ)-এর স্বপ্ন এবং নিজ নবুঅতের জ্ঞান দ্বারা অনুমান করে ইয়াকূব (আঃ) বললেন, ঘটনা ঐরূপ ঘটেনি, যেরূপ তোমরা বর্ণনা করছ; বরং তোমরা নিজের মন থেকে সাজিয়ে এ কথা বলছ। সুতরাং যা হওয়ার ছিল তা হয়ে গেছে। কিন্তু ইয়াকূব (আঃ) ঘটনার আসল রহস্য জানতেন না, ফলে ধৈর্য ছাড়া কোন অবলম্বন এবং আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোন উপায় তাঁর ছিল না।

[2] মদীনার মুনাফেকরা যখন আয়েশা (রাঃ)  উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, তখন নবী (সাঃ) তাঁর ব্যাপারে যা বুঝেছিলেন ও বলেছিলেন তার উত্তরে তিনিও বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি আমার ও আপনাদের জন্য ইউসুফের আব্বার ঐ উদাহরণই দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং ‘‘আমার পক্ষে পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়। তোমরা যা বর্ণনা করছ, সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল।’’ অর্থাৎ আমারও ধৈর্য ধারণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ১৯

وَ جَآءَتۡ سَیَّارَۃٌ فَاَرۡسَلُوۡا وَارِدَهُمۡ فَاَدۡلٰی دَلۡوَهٗ ؕ قَالَ یٰبُشۡرٰی هٰذَا غُلٰمٌ ؕ وَ اَسَرُّوۡهُ بِضَاعَۃً ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌۢ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۱۹﴾

و جآءت سیارۃ فارسلوا واردهم فادلی دلوهٗ قال یبشری هذا غلم و اسروه بضاعۃ و الله علیم بما یعملون ﴿۱۹﴾
আর একটি যাত্রীদল আসল এবং তারা তাদের পানি সংগ্রহকারীকে প্রেরণ করল অতঃপর সে তার বালতি ফেলল। সে বলে উঠলো, ‘কী সুখবর! এ যে একটি বালক’ এবং তারা তাকে পণ্যদ্রব্য হিসেবে গোপন করে ফেলল। আর তারা যা কিছু করছিল সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক জ্ঞাত।

-আল-বায়ান

সেখানে একটা কাফেলা আসলো। তারা তাদের পানি সংগ্রহকারীকে পাঠালো। সে তার পানির বালতি নামিয়ে দিল। সে বলল, ‘কী খুশির খবর! এ যে দেখছি এক বালক!’ তারা তাকে পণ্য দ্রব্য জ্ঞানে লুকিয়ে দিল, আর তারা যা করছিল সে সম্পর্কে আল্লাহ খুবই অবহিত।

-তাইসিরুল

এক যাত্রী দল এলো, তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করল। সে তার পানির বালতি নামিয়ে দিল, সে বলে উঠলঃ কি সুখবর! এ যে এক কিশোর! অতঃপর তারা তাকে পণ্য রূপে লুকিয়ে রাখল, তারা যা করছিল সেই বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবগত ছিলেন।

-মুজিবুর রহমান

And there came a company of travelers; then they sent their water drawer, and he let down his bucket. He said, "Good news! Here is a boy." And they concealed him, [taking him] as merchandise; and Allah was knowing of what they did.

-Sahih International

১৯. আর এক যাত্রীদল আসল, অতঃপর তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে পাঠালে সে তার পানির বালতি নামিয়ে দিল। সে বলে উঠল, কী সুখবর! এ যে এক কিশোর!(১) এবং তারা তাকে পণ্যরূপে লুকিয়ে রাখল।(২) আর তারা যা করছিল সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবগত।(৩)

(১) ঘটনাচক্রে একটি কাফেলা এ স্থানে এসে যায়। কোন কোন তাফসীরে বলা হয়েছেঃ এ কাফেলা সিরিয়া থেকে মিসর যাচ্ছিল। পথভুলে এ জনমানবহীন জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়। [কুরতুবী] তারা পানি সংগ্রহকারীকে কুপে প্রেরণ করল। লোকটি এই কুপে পৌছলেন এবং বালতি নিক্ষেপ করলেন। ইউসুফ আলাইহিস সালাম সর্বশক্তিমানের সাহায্য প্রত্যক্ষ করে বালতির রশি শক্ত করে ধরলেন। পানির পরিবর্তে বালতির সাথে একটি সমুজ্জ্বল মুখমণ্ডল দৃষ্টিতে ভেসে উঠল।

এ মুখমণ্ডলের ভবিষ্যত মাহাত্ম্য থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেও উপস্থিত ক্ষেত্রেও অনুপম সৌন্দর্য ও গুণগত উৎকর্ষের নিদর্শনাবলী তার মাহত্ম্যের কম পরিচায়ক ছিল না। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে কুপের তলদেশ থেকে ভেসে উঠা এই অল্পবয়স্ক, অপরূপ ও বুদ্ধিদীপ্ত বালককে দেখে লোকটি সোল্লাসে চীৎকার করে উঠলঃ (يَا بُشْرَىٰ هَٰذَا غُلَامٌ) -আরে, আনন্দের কথা- এ তো বড় চমৎকার এক কিশোর বের হয়ে এসেছে। ইউসুফ আলাইহিস সালাম দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ‘আমি ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর সাথে সাক্ষাতের পর দেখলাম যে, আল্লাহ তা'আলা সমগ্র বিশ্বের রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেক তাকে দান করেছেন। [মুসলিমঃ ১৬২]

(২) অর্থাৎ তারা তাকে একটি পণ্যদ্রব্য মনে করে গোপন করে ফেলল। উদ্দেশ্য এই যে, শুরুতে এ কিশোরকে দেখে অবাক বিস্ময়ে চীৎকার করে উঠল; কিন্তু চিন্তা-ভাবনা করে স্থির করল যে, এটা জানাজানি না হওয়া উচিত এবং গোপন করে ফেলা দরকার, যাতে একে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ লাভ করা যায়। সমগ্র কাফেলার মধ্যে এ বিষয় জানাজানি হয়ে গেলে সবাই এতে অংশীদার হয়ে যাবে। এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ভ্রাতারা বাস্তব ঘটনা গোপন করে তাকে পণ্যদ্রব্য করে নিল। এমতাবস্থায় আয়াতের অর্থ এই হবে যে, ইউসুফ ভ্রাতারা নিজেরাই ইউসুফকে পণ্যদ্রব্য স্থির করে বিক্রি করে দিল। [তাবারী; কুরতুবী]

(৩) অর্থাৎ তাদের সব কর্মকাণ্ড আল্লাহ্ তা'আলার জানা ছিল। উদ্দেশ্য এই যে, ইউসুফ ভ্রাতারা কি করবে এবং তাদের কাছ থেকে ক্রেতা কাফেলা কি করবে, তা সবই আল্লাহ তা'আলার জানা ছিল। তিনি তাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়ারও শক্তি রাখতেন। কিন্তু বিশেষ কোন রহস্যের কারণেই আল্লাহ তা'আলা এসব পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করেননি; বরং নিজস্ব পথে চলতে দিয়েছেন। এর মধ্যে আল্লাহ্ তা'আলা তার হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এটার প্রতি ইঙ্গিত করলেন যে, আপনার কাওম আপনার উপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে তা আমার অজানা নয়, আমি এটার প্রতিকার করতে পারি। কিন্তু আমি তাদেরকে ছাড় দেই। তারপর উত্তম পরিণাম আপনার জন্যই হবে। আর তাদের বিচার আপনিই করবেন। যেমনটি ইউসুফ আলাইহিস সালামের উপর তার ভাইদের প্রাধান্য ও বিচারের ভার পড়েছিল। [ইবন কাসীর]

তাফসীরে জাকারিয়া

(১৯) এক যাত্রীদল এসে তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে প্রেরণ করল। সে তার পানির বালতি নামিয়ে দিল। সে বলে উঠল, কি সুখবর! এ যে এক কিশোর![1] অতঃপর তারা তাকে পণ্যরূপে লুকিয়ে রাখল।[2] তারা যা করছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ সবিশেষ অবগত ছিলেন। [3]

[1] وارد (পানি সংগ্রাহক) সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কাফেলা বা যাত্রীদলের জন্য পানি ইত্যাদির ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে কাফেলার আগে আগে যাত্রা করে; যাতে উপযুক্ত স্থানে কাফেলা থাকার ব্যবস্থা হয়। উক্ত পানি সংগ্রাহক যখন কূপের নিকট এল ও পানি উঠানোর জন্য বালতি নিচে নামাল, তখন ইউসুফ (আঃ) তার দড়ি ধরে নিলেন। পানি সংগ্রাহক একটি সুদর্শন শিশু দেখে তাঁকে উপরে টেনে তুলল এবং অতি আনন্দিত হল।

[2] بضاعة বাণিজ্যের পণ্যকে বলা হয়। أسروه (লুকিয়ে রাখল) এর فاعل (কর্তা) কে? অর্থাৎ ইউসুফ (আঃ)-কে ব্যবসার পণ্য হিসাবে কে লুকিয়ে রেখেছিল? এতে মতভেদ আছে। হাফেয ইবনে কাসীর (রঃ) উক্ত কর্মের কর্তা ইউসুফ (আঃ)-এর ভাইদেরকে ধরেছেন। উদ্দেশ্য এই যে, যখন বালতির সাথে ইউসুফ (আঃ) কূপ থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন সেখানে তাঁর ভাইরাও উপস্থিত ছিলেন। তারপরেও তাঁরা প্রকৃত ঘটনা লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরা এ কথা বলেননি যে, এটা আমাদের ভাই। আর ইউসুফ (আঃ)ও হত্যার ভয়ে তাঁরা যে তাঁর ভাই এ কথা প্রকাশ করেননি। বরং তাঁর ভায়েরা তাঁকে বিক্রির পণ্য বললেও তিনি নিশ্চুপ থাকলেন এবং নিজেকে বিক্রি হওয়াটাই পছন্দ করলেন। সুতরাং সেই পানি সংগ্রাহক কাফেলার লোকদেরকে সুসংবাদ শুনালো যে, একটি ছেলে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই কথা পূর্ব আলোচনার সাথে মিলে না। (বরং খাপছাড়া মনে হয়।) এর বিপরীত ইমাম শওকানী (রঃ) أسروه শব্দটির কর্তা পানি সংগ্রাহক ও তার সাথীদেরকে ধরে বলেছেন যে, তারা এ কথা প্রকাশ করেনি যে, এই ছেলেটি কূপে পাওয়া গেছে। কারণ তা প্রকাশ করলে কাফেলার সমস্ত লোকই ঐ ‘‘বাণিজ্যিক পণ্যে’’ শরীক হয়ে যেত। বরং কাফেলার লোকদের নিকট গিয়ে এ কথা বলল যে, কূপের মালিক তাদেরকে এই ছেলেটি মিশরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করার জন্য দিয়েছে। কিন্তু সব থেকে উত্তম উক্তি হল এই যে, কাফেলার লোকরা ইউসুফ (আঃ)-কে ব্যবসাপণ্য গণ্য করে লুকিয়ে নিয়েছিল, যাতে তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা তাঁর খোঁজে এখানে এসে না যায় এবং বিনা মূল্যে তাকে ফিরিয়ে দিতে না হয়। কারণ কূপে একজন ছেলে পাওয়া যাওয়া, এই কথাই প্রমাণ করে যে, সে কোন স্থানীয় কোন বাসিন্দা হবে এবং খেলাধূলা করতে করতে কূপে পড়ে গিয়ে থাকবে।

[3] অর্থাৎ ইউসুফ (আঃ)-এর সাথে যা কিছু ঘটছিল, আল্লাহ তাআলা সে সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত ছিলেন। তার পরেও আল্লাহ তাআলা এত কিছু এই জন্য হতে দিলেন, যাতে আল্লাহর লিখিত ভাগ্য বাস্তবায়িত হয়। তাছাড়া এতে নবী (সাঃ) এর জন্য সান্ত্বনা রয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা নিজ পয়গম্বর (সাঃ)-কে জানাচ্ছেন যে, তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা অবশ্যই তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে এবং আমি তা থেকে তাদেরকে বিরত রাখার ক্ষমতাও রাখি। কিন্তু আমি তাদেরকে সেইরূপ ঢিল দিচ্ছি, যেরূপ ইউসুফের ভাইদেরকে ঢিল দিয়েছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত আমি ইউসুফকে মিসরের রাজ-সিংহাসনে বসিয়েছিলাম এবং তার ভাইদেরকে অক্ষম ও অসহায় করে তার দরবারে উপস্থিত করেছিলাম। হে নবী! এমন এক সময় আসবে, যখন তোমারও এরূপ মাথা উঁচু হবে এবং এই কুরায়েশ দলপতিরা তোমার ভ্রূর ইঙ্গিত ও মুখের কথার অপেক্ষায় থাকবে। সুতরাং মক্কা বিজয়ের দিন উক্ত অবস্থা অতি সত্ত্বর এসে গিয়েছিল।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান

১২ : ২০

وَ شَرَوۡهُ بِثَمَنٍۭ بَخۡسٍ دَرَاهِمَ مَعۡدُوۡدَۃٍ ۚ وَ كَانُوۡا فِیۡهِ مِنَ الزَّاهِدِیۡنَ ﴿۲۰﴾

و شروه بثمن بخس دراهم معدودۃ و كانوا فیه من الزاهدین ﴿۲۰﴾
আর তারা তাকে অতি নগণ্য মূল্যে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল এবং তারা তার ব্যাপারে ছিল অনাগ্রহী।

-আল-বায়ান

তারা তাকে স্বল্প মূল্যে- মাত্র কয়টি দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল, তারা ছিল তাকে তুচ্ছ জ্ঞানকারী!

-তাইসিরুল

আর তারা তাকে বিক্রি করল স্বল্প মূল্যে, মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে, তারা এতে ছিল নির্লোভ।

-মুজিবুর রহমান

And they sold him for a reduced price - a few dirhams - and they were, concerning him, of those content with little.

-Sahih International

২০. আর তারা তাকে বিক্রি করল স্বল্প মূল্যে, মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে(১) এবং তারা ছিল তার ব্যাপারে অনাগ্রহী(২)।

(১) আরবী ভাষায় شَراء শব্দ ক্রয় করা ও বিক্রয় করা উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ স্থলেও উভয় অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সর্বনামকে ইউসুফ ভ্রাতাদের দিকে ফেরানো হয়, তবে বিক্রয় করার অর্থ হবে এবং কাফেলার লোকদের দিকে ফেরানো হলে ক্রয় করার অর্থ হবে। [ইবন কাসীর] উদ্দেশ্য এই যে, ইউসুফ ভ্রাতারা বিক্রয় করে দিল কিংবা কাফেলার লোকেরা ইউসুফকে খুব সস্তা মূল্যে অর্থাৎ নামে মাত্র কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করল। আয়াতে বর্ণিত بَخْسٍ এর দুটি অর্থ হতে পারেঃ (এক) খুব কম মূল্যে; [তাবারী] কারণ তারা বাস্তবিকই তাকে খুব কম মূল্যে বিক্রয় করেছিল। (দুই) অন্যায় বা নিকৃষ্ট বিক্রয় সম্পন্ন করল; কারণ তারা স্বাধীন মানুষকে বিক্রয় করেছিল। স্বাধীন মানুষকে বিক্রয় করা হারাম। [কুরতুবী] ইমাম কুরতুবী আরও বলেনঃ আরব বণিকদের অভ্যাস ছিল, তারা মোটা অঙ্কের লেন-দেন পরিমাপের মাধ্যমে করত এবং চল্লিশের উর্ধ্বে নয়, এমন লেন-দেন গণনার মাধ্যমে করত। তাই دَرَاهِمَ শব্দের সাথে مَعْدُودَةٍ (গুণাগুনতি) শব্দের প্রয়োগ থেকে বোঝা যায় যে, দিরহামের পরিমাণ চল্লিশের কম ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের বর্ণনায় এসেছে, বিশ দিরহামের বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছিল এবং দশ ভাই দুই দিরহাম করে নিজেদের মধ্যে তা বন্টন করে নিয়েছিল। [কুরতুবী]

(২) এর দুটি অর্থ হতে পারে-

(এক) ইউসুফের ভাইয়েরা ইউসুফ-এর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিল, তাই তারা এত কম দামে বিক্রয় করে দিয়েছিল। [ইবন কাসীর] ইউসুফকে কম মূল্যে বিক্রয় করার কারণ আবার দুটি হতে পারে। প্রথমতঃ এ কারণে যে, তারা এ মহাপুরুষের সঠিক মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। দ্বিতীয়তঃ তাদের আসল লক্ষ্য তার দ্বারা টাকা-পয়সা উপার্জন করা ছিল না; বরং পিতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তাই শুধু বিক্রয় করে দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা আশংকা করছিল যে, কাফেলার লোকেরা তাকে এখানেই ছেড়ে যাবে এবং অতঃপর সে কোন রকমে পিতার কাছে পৌছে আগাগোড়া চক্রান্ত ফাঁস করে দেবে। তাই তাফসীরবিদ মুজাহিদের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করল। যখন কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেল, তখন তারা কিছুদূর পর্যন্ত কাফেলার পিছনে পিছনে গেল এবং তাদেরকে বললঃ দেখ, এর পলায়নের অভ্যাস রয়েছে। একে মুক্ত ছেড়ে দিও না; বরং বেঁধে রাখ। [কুরতুবী; সাদী]

(দুই) এ আয়াতের আরেকটি অর্থ হতে পারে যে, কাফেলার লোকেরা ইউসুফের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিচ্ছিল না, কেননা, কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর মূল্য আর কতই হতে পারে? [ফাতহুল কাদীর] কাফেলা বিভিন্ন মনযিল অতিক্রম করে মিশর পর্যন্ত পৌছে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে বিক্রি করে দিল।

তাফসীরে জাকারিয়া

(২০) আর তারা তাকে স্বল্প মূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।[1] তারা ছিল এতে নির্লোভ। [2]

[1] ভাইরা অথবা অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী কাফেলার লোকেরা বিক্রি করেছিল।

[2] কারণ কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু, যা মানুষ বিনা পরিশ্রমে অর্জন করে, তা যতই দামী হোক না কেন, তার সঠিক মূল্য মানুষের নিকট পরিষ্ফুটিত হয় না।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান
দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১১১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 9 10 11 12 পরের পাতা »