৩৮ সূরাঃ সোয়াদ | Ṣād | سورة ص - আয়াত নং - ৩৩ - মাক্কী

৩৮ : ৩৩ رُدُّوۡهَا عَلَیَّ ؕ فَطَفِقَ مَسۡحًۢا بِالسُّوۡقِ وَ الۡاَعۡنَاقِ ﴿۳۳﴾

এগুলো আমার কাছে ফিরিয়ে আন। অতঃপর সে এগুলোকে পা ও গলদেশ দিয়ে যবেহ করা শুরু করল।* আল-বায়ান

(সে তার সন্ধ্যাকালীন ‘ইবাদাত সম্পন্ন করে (বলল) ওগুলোকে আমার কাছে আবার এনে হাজির কর। তখন সে তাদের পায়ে ও গলায় হাত বুলাতে লাগল। তাইসিরুল

ওগুলোকে পুনরায় আমার সামনে নিয়ে এসো। অতঃপর সে ওগুলোর পা ও গলদেশ ছেদন করতে লাগল। মুজিবুর রহমান

[He said], "Return them to me," and set about striking [their] legs and necks. Sahih International

* সুলাইমান আ. জিহাদের জন্য পালিত এসব ঘোড়া কোন এক বিকালে পরিদর্শন করতে গিয়ে অনেক কাল ক্ষেপণ করেন এবং এদিকে সূর্য ডুবে যায়। ফলে ঘোড়ার কারণে আল্লাহর যিকর থেকে এত দীর্ঘ সময় বিরত থাকলে তিনি অনুতপ্ত হন এবং ঘোড়াগুলোকে পুনরায় তার সামনে উপস্থিত করে সেগুলোকে তার শরীয়ত অনুযায়ী যবেহ করে দিলেন। আর সেগুলোর গোশ্ত সদাকা করে দিলেন।

৩৩. এগুলোকে আমার কাছে ফিরিয়ে আন। তারপর তিনি ওগুলোর পা এবং গলা ছেদন করতে লাগলেন।(১)

(১) আলোচ্য ৩০–৩৩ নং আয়াতসমূহে সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রসিদ্ধ বিবরণের সারমর্ম এই যে, সুলাইমান আলাইহিস সালাম অশ্বরাজি পরিদর্শনে এমনভাবে মগ্ন হয়ে পড়েন যে, আসরের সালাত আদায়ের নিয়মিত সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। পরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তার প্রতিকার করেন। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে তিনি সে প্রতিকার করেছিলেন? কুরআন বলছে, (فَطَفِقَ مَسْحًا بِالسُّوقِ وَالْأَعْنَاقِ) এর অর্থ বর্ণনায় বিভিন্ন মত রয়েছে,

এক. তিনি সমস্ত অশ্ব যবেহ করে দেন। কেননা, এগুলোর কারণেই আল্লাহর স্মরণ বিঘ্নিত হয়েছিল। এ সালাত নফল হলেও কোন আপত্তির কারণ নেই। কেননা, নবী-রাসূলগণ এতটুকু ক্ষতিও পুরণ করার চেষ্টা করে থাকেন। পক্ষান্তরে তা ফরয সালাত হলে ভুলে যাওয়ার কারণে তা কাযা হতে পারে। এতে কোন গোনাহ হয় না। কিন্তু সুলাইমান আলাইহিস সালাম তার উচ্চ মর্যাদার পরিপ্রেক্ষিতে এরও প্ৰতিকার করেছেন। এ তাফসীরটি কয়েকজন তাফসীরবিদ থেকে বর্ণিত হয়েছে। হাফেয ইবন কাসীরের ন্যায় অনুসন্ধানী আলেমও এই তাফসীরকে অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু এতে সন্দেহ হয় যে, অশ্বরাজি আল্লাহ প্রদত্ত একটি পুরস্কার ছিল। নিজের সম্পদকে এভাবে বিনষ্ট করা একজন নবীর পক্ষে শোভা পায় না। কোন কোন তাফসীরবিদ এর জওয়াবে বলেন যে, এ অশ্বরাজি সুলাইমান আলাইহিস সালাম-এর ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল। তার শরীআতে গরু, ছাগল ও উটের ন্যায় অশ্ব কোরবানী করাও বৈধ ছিল। তাই তিনি অশ্বরাজি বিনষ্ট করেননি; বরং আল্লাহর নামে কোরবানী করেছেন।

দুই. আলোচ্য আয়াতের আরও একটি তাফসীর আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে। তাতে ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে বর্ণনা করা হয়েছে। এই তফসীরের সারমর্ম এই যে, সুলাইমান আলাইহিস সালাম এর সামনে জেহাদের জন্যে তৈরি অশ্বরাজি পরিদর্শনের নিমিত্তে পেশ করা হলে সেগুলো দেখে তিনি খুব আনন্দিত হন। সাথে সাথে তিনি বললেনঃ এই অশ্বরাজির প্রতি আমার যে মহব্বত ও মনের টান, তা পার্থিব মহব্বতের কারণে নয়; বরং আমার পালকর্তার স্মরণের কারণেই। কারণ, এগুলো জেহাদের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। জেহাদ একটি উচ্চস্তরের ইবাদত। ইতিমধ্যে অশ্বরাজির দল তার দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে গেল। তিনি আদেশ দিলেনঃ এগুলোকে আবার আমার সামনে উপস্থিত কর। সে মতে পুনরায় উপস্থিত করা হলে তিনি অশ্বরাজির গলদেশে ও পায়ে আদর করে হাত বুলালেন। প্রাচীন তাফসীরবিদগণের মধ্যে হাফেয ইবনে জরীর, তাবারী, ইমাম রাযী প্রমুখ এ তাফসীরকেই অগ্ৰাধিকার দিয়েছেন। কেননা, এই তাফসীর অনুযায়ী সম্পদ নষ্ট করার সন্দেহ হয় না। পবিত্র কুরআনের ভাষ্যে উভয় তাফসীরের অবকাশ আছে।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহর স্মরণে শৈথিল্য হলে নিজের উপর শাস্তি নির্ধারণ করা ধর্মীয় মর্যাদাবোধের দাবী। কোন সময় আল্লাহর স্মরণে শৈথিল্য হয়ে গেলে নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্যে কোন মুবাহ (অনুমোদিত) কাজ থেকে বঞ্চিত করে দেয়া জায়েয। কোন সৎকাজের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্যে নিজের উপর এ ধরনের শাস্তি নির্ধারণ করা আত্মশুদ্ধির একটি ব্যবস্থা। এ ঘটনা থেকে এর বৈধতা বরং পছন্দনীয়তা জানা যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, একবার আবু জাহম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে একটি শামী চাদর উপহার দেন। চাদরটি ছিল কারুকার্যখচিত। তিনি চাদর পরিধান করে সালাত পড়লেন এবং ফিরে এসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, চাদরটি আবু জাহামের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দাও। কেননা, সালাতে আমার দৃষ্টি এর কারুকার্যের উপর পড়ে গিয়েছিল এবং আমার মনোনিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল ৷ [বুখারী: ৩৭৩, মুসলীম: ১৭৬] হাদীসে আরও এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “তুমি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করতে গিয়ে যা-ই ত্যাগ করবে আল্লাহ তার থেকে উত্তম বস্তু তোমাকে দিবে।” [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৭৮, ৭৯, ৩৬৩] [দেখুন: কুরতুবী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৩৩) এইগুলিকে পুনরায় আমার সম্মুখে আনো।’ অতঃপর সে ওগুলির পা ও গর্দান ছেদন করতে লাগল। [1]

[1] এই অনুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে أَحْبَبْتُ (ভালোবেসে ফেলেছি) এর অর্থ آثَرْتُ (প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছি) আর عَنْ এখানে عَلى এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে। (এর দ্বিতীয় অনুবাদ হলঃ আমি তো আমার প্রতিপালকের স্মরণ হতে বিমুখ হয়ে সম্পদ-প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি।) আর تَوَارَتْ এর স্ত্রীলিঙ্গ কর্তৃকারক হল شَمْسٌ (সূর্য), যা আয়াতে পূর্বে উল্লিখিত হয়নি; কিন্তু বাগধারায় তা অনুমেয়। এই তফসীরের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব আয়াতের (مَسْحًا بِالسُّوْقِ وَالْاَعْنَاقِ) এর অর্থও হবে যবেহ করা অর্থাৎ উদ্দেশ্য مَسْحًا بِالسَّيْفِ ।
সারমর্ম এই যে, অশ্বরাজি পরিদর্শন করতে গিয়ে সুলাইমান (আঃ) আসর নামাযের সময় অতিবাহিত করে ফেলেন অথবা তখন তিনি যে অযীফা করতেন তা ছুটে যায়। যার জন্য তিনি অনুতপ্ত হলেন এবং বলতে লাগলেন যে, আমি অশ্বরাজির মহব্বতে এমন মগ্ন হয়ে গেছি যে, সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল এবং আমি আল্লাহর স্মরণ, নামায বা অযীফা থেকে অমনোযোগী হয়ে থেকে গেলাম। সুতরাং তার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তিনি সমস্ত অশ্বরাজি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী করে দিয়েছিলেন। ইমাম শাওকানী ও ইবনে কাসীর (রঃ) উক্ত তফসীরকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কোন কোন তফসীরবিদ এর আলাদা তফসীর করেছেন। তাঁদের তফসীর অনুযায়ী عَنْ أَجَلٌ এর অর্থে ব্যবহূত হয়েছে। ِأي: لأَجَلِ ذِكْرِ رَبِّيْ অর্থাৎ আমার পালনকর্তার স্মরণের উদ্দেশ্যেই আমি এই অশ্বরাজির প্রতি মহব্বত রাখি। কারণ তার দ্বারা আল্লাহর পথে জিহাদ হয়। অতঃপর তিনি অশ্বরাজিকে দৌড়ালেন। সুতরাং তারা তাঁর দৃষ্টি থেকে উধাও হয়ে গেল। তিনি এগুলোকে পুনরায় সামনে উপস্থিত করার আদেশ দিলেন। তাঁর নিকট পুনরায় উপস্থিত করা হলে তিনি মহব্বতের সাথে তাদের গর্দানে ও পায়ে হাত বুলাতে লাগলেন। خَيْرٌ শব্দটি কুরআনে সম্পদের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু এখানে এই শব্দটি অশ্বরাজির অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। تَوَارَتْ শব্দের কর্তৃকারক অশ্বরাজি বলা হয়েছে। ইমাম ইবনে জারীর ত্বাবারী (রঃ) এই দ্বিতীয় তফসীরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং এই তফসীরই বিভিন্ন দিক দিয়ে সহীহ মনে হচ্ছে। আর আল্লাহই ভালো জানেন।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান