পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৩-[১৬] বারা’ ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুদায়বিয়ার দিন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে আমরা চৌদ্দশত ছিলাম। হুদায়বিয়াহ্ একটি কূপের নাম। উক্ত কূপ হতে পানি তুলতে তুলতে তার সবটুকু পানি আমরা নিঃশেষ করে ফেললাম। এমনকি আমরা তাতে এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট রাখিনি। অতঃপর নবী (সা.) -এর কাছে এ সংবাদটি পৌছলে তিনি (সা.) উক্ত কূপের কাছে এসে বসলেন এবং এক পাত্র পানি চেয়ে এনে উযু করলেন ও কুলি করলেন। তারপর দু’আ করলেন। অতঃপর কূপের ভিতরে উক্ত পানি ঢেলে দিয়ে বললেন, কিছু সময়ের জন্য তোমরা এই কূপ হতে পানি তোলা বন্ধ রাখ। এরপর সকলে নিজে এবং আরোহণের জানোয়ারসমূহ এ স্থান ত্যাগ করা অবধি সে পানি তৃপ্তি সহকারে ব্যবহার করলেন। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن الْبَراء بن عَازِب قا ل: كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعَ عَشْرَةَ مِائَةً يَوْمَ الْحُدَيْبِيَةِ وَالْحُدَيْبِيَةُ بِئْرٌ فَنَزَحْنَاهَا فَلَمْ نَتْرُكْ فِيهَا قَطْرَةً فَبَلَغَ النبيَّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فأتاهافجلس عَلَى شَفِيرِهَا ثُمَّ دَعَا بِإِنَاءٍ مِنْ مَاءٍ فَتَوَضَّأَ ثُمَّ مَضْمَضَ وَدَعَا ثُمَّ صَبَّهُ فِيهَا ثُمَّ قَالَ: دَعُوهَا سَاعَةً فَأَرْوَوْا أَنْفُسَهُمْ وَرِكَابَهُمْ حَتَّى ارتحلوا. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4150) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনা সম্পর্কে মিরকাত প্রণেতা বলেন যে, এ ঘটনাটির আগে জাবির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত ঘটনাটি ঘটেছে। তার মানে বুঝা যায় যে, হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর থেকে একাধিক বার মু'জিযাহ প্রকাশ পেয়েছে।
মানুষের কাছে এটি খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, তারা এই কূপটিকে সংরক্ষণও করেনি এবং ব্যাপক কল্যাণের লক্ষ্যে তার ওপর বড় কোন প্রাচীরও নির্মাণ করে রাখেনি। অথচ তা মক্কার কাছেই জিদ্দা যাওয়ার পথে অবস্থিত ছিল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৪-[১৭] ’আওফ (রহিমাহুল্লাহ) আবূ রজা’ (রহিমাহুল্লাহ) হতে এবং তিনি ’ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একবার আমরা নবী (সা.) -এর সাথে এক ভ্রমণে ছিলাম। লোকেরা তাঁর কাছে পিপাসার অভিযোগ করল। তখন তিনি (সা.) অবতরণ করলেন এবং অমুককে ডাকলেন। আবূ রজা’ তার নাম বলেছিলেন কিন্তু আওফ ভুলে গেলেন, তাই ’আলী (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, তোমরা দুজন যাও এবং পানির অনুসন্ধান কর। তারা উভয়ে রওয়ানা হলেন এবং পথিমধ্যে এমন একটি মহিলার সাক্ষাৎ পেলেন, যে একটি বাহনের (উটের পিঠে দুই দিকে পানির দু’টি মশক বা দু’টি থলে রেখে নিজে মাঝখানে বসে যাচ্ছে। তখন তারা মহিলাটিকে নবী (সা.) -এর কাছে নিয়ে আসলেন এবং লোকেরা মহিলাটিকে তার উটের পিঠ হতে নিচে নামতে বলল। অতঃপর নবী (সা.) একটি পাত্র আনালেন। তারপর মশক দুটির মুখ হতে এতে পানি ঢেলে নিলেন। আর লোকেদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা নিজেরাও পান কর এবং পশুদেরকেও পান করাও। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা চল্লিশজন পিপাসার্ত লোক পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলাম এবং আমাদের সাথে যতগুলো মশক ও অন্যান্য পাত্র ছিল সেগুলোও প্রতিটি পানি দ্বারা পরিপূর্ণ করে নিলাম।
বর্ণনাকারী ’ইমরান বলেন, আল্লাহর শপথ! যখন আমাদেরকে পানির মশক হতে পৃথক করা হলো, (অর্থাৎ পানি নেয়া শেষ হলো,) তখন আমাদের এমন মনে হচ্ছিল যেন মশকটি প্রথম অবস্থার তুলনায় আরো অনেক বেশি পূর্ণ রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن عَوْف عَن أبي رَجَاء عَن عمر بن حُصَيْن قا ل: كُنَّا فِي سَفَرٍ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم فَاشْتَكَى إِلَيْهِ النَّاسُ مِنَ الْعَطَشِ فَنَزَلَ فَدَعَا فُلَانًا كَانَ يُسَمِّيهِ أَبُو رَجَاءٍ وَنَسِيَهُ عَوْفٌ وَدَعَا عَلِيًّا فَقَالَ: «اذْهَبَا فَابْتَغِيَا الْمَاءَ» . فَانْطَلَقَا فتلقيا امْرَأَة بَين مزادتين أَو سطحتين من مَاء فجاءا بهاإلى النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فاستنزلوهاعن بَعِيرِهَا وَدَعَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِإِنَاءٍ فَفَرَّغَ فِيهِ مِنْ أَفْوَاهِ الْمَزَادَتَيْنِ وَنُودِيَ فِي النَّاسِ: اسْقُوا فَاسْتَقَوْا قَالَ: فَشَرِبْنَا عِطَاشًا أَرْبَعِينَ رَجُلًا حَتَّى رَوِينَا فَمَلَأْنَا كُلَّ قِرْبَةٍ مَعَنَا وَإِدَاوَةٍ وَايْمُ اللَّهِ لَقَدْ أَقْلَعَ عَنْهَا وإنَّهُ ليُخيّل إِلينا أنّها أشدُّ ملئةً مِنْهَا حِين ابْتَدَأَ. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (344) و مسلم (312 / 682)، (1563) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসেও হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর থেকে প্রকাশিত একটি মু'জিযার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসের শেষ অংশে ‘ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) বলেন, (وإنَّهُ ليُخيّل إِلينا أنّها أشدُّ ملئةً مِنْهَا حِين ابْتَدَأَ) অর্থাৎ আমার কাছে মনে হলো যে, পানি ব্যবহার করা শুরু করার আগে মশকে যে পরিমাণ পানি ছিল ব্যবহার করার পর দেখা গেল যে, তার থেকে বেশি পানি রয়েছে।
এ বিষয়ে মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, তারা যখন উক্ত মশক থেকে পান করা শুরু করে তখন যে পরিমাণ পানি ছিল সেখান থেকে চল্লিশজন পান করার পরেও দেখা গেল যে, তার থেকে আরো বেশি পানি ভর্তি হয়ে আছে। এটিও রাসূল (সা.)-এর বিশেষ মু'জিযাহ্। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৫-[১৮] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে যাচ্ছিলাম। চলার পথে আমরা একটি বিস্তীর্ণ ময়দানে অবতরণ করলাম। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য গেলেন, কিন্তু আড়াল করার জন্য কিছুই পেলেন না। এ সময় হঠাৎ ময়দানের এক পার্শে দুটি গাছ দেখা গেল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন তার একটির কাছে গেলেন এবং তার একটি ডাল ধরে বললেন, আল্লাহর হুকুমে তুমি আমার অনুগত হও, গাছটি তৎক্ষণাৎ এমনভাবে তার অনুগত হলো, যেমন নাকে রশি লাগানো উট তার চালকের অনুগত হয়ে থাকে। এবার তিনি (সা.) দ্বিতীয় বৃক্ষটির কাছে যেয়ে তার একটি শাখা ধরে বললেন, আল্লাহর নির্দেশে তুমি আমার অনুগত হও। অতএব বৃক্ষটি সাথে সাথেই তার প্রতি অনুরূপ ঝুঁকে পড়ল। অবশেষে যখন তিনি (সা.) উভয় বৃক্ষের মধ্যখানে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখন বললেন, আল্লাহর হুকুমে তোমরা উভয়ে আমার জন্য মিলিত হয়ে যাও। তখনই তারা মিলিত হয়ে গেল (তার আড়াল হয়ে হাজত পূরণ করলেন)। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি বসে এই বিস্ময়কর ঘটনার কথা মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম। এ অবস্থায় হঠাৎ আমি একদিকে তাকাতেই দেখি, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাশরীফ এনেছেন। আর বৃক্ষ দু’টিকেও দেখলাম তারা পুনরায় আলাদা হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকটি আপন আপন জায়গায় গিয়ে যথারীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: سِرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى نَزَلْنَا وَادِيًا أَفْيَحَ فَذَهَبَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْضِي حَاجَتَهُ فَلَمْ يَرَ شَيْئًا يَسْتَتِرُ بِهِ وَإِذَا شَجَرَتَيْنِ بِشَاطِئِ الْوَادِي فَانْطَلَقَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى إِحْدَاهُمَا فَأَخَذَ بِغُصْنٍ مِنْ أَغْصَانِهَا فَقَالَ انْقَادِي عَلَيَّ بِإِذْنِ اللَّهِ فَانْقَادَتْ مَعَهُ كَالْبَعِيرِ الْمَخْشُوشِ الَّذِي يُصَانِعُ قَائِدَهُ حَتَّى أَتَى الشَّجَرَةَ الْأُخْرَى فَأَخَذَ بِغُصْنٍ مِنْ أَغْصَانِهَا فَقَالَ انْقَادِي عَلَيَّ بِإِذْنِ اللَّهِ فَانْقَادَتْ مَعَهُ كَذَلِكَ حَتَّى إِذَا كَانَ بِالْمَنْصَفِ مِمَّا بَيْنَهُمَا قَالَ الْتَئِمَا عَلَيَّ بِإِذْنِ اللَّهِ فَالْتَأَمَتَا فَجَلَسْتُ أُحَدِّثُ نَفْسِي فَحَانَتْ مِنِّي لفتة فَإِذَا أَنَا بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُقْبِلًا وَإِذَا الشَّجَرَتَيْنِ قَدِ افْتَرَقَتَا فَقَامَتْ كُلُّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا عَلَى سَاقٍ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
رواہ مسلم (74 / 3012)، (7518) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : উক্ত হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক প্রকাশিত মু'জিযাহ্ সেখানে উপস্থিত সকল সাহাবী অবলোকন করেছেন। এমনকি তিনি (সা.) তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়োজন যখন পুরা করলেন তখন সেই গাছ দু'টি আবার চলে গেল। এ দৃশ্যটি সাহাবীগণ তাদের নিজ নিজ জায়গায় থেকে দেখেছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৬-[১৯] ইয়াযীদ ইবনু আবূ ’উবায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালামাহ্ ইবনু আকওয়া’ (রাঃ)-এর পায়ের গোছায় আঘাতের চিহ্ন দেখে প্রশ্ন করলাম, হে আবূ মুসলিম! আঘাতটি কিসের? তিনি বললেন, এ আঘাত খায়বার যুদ্ধে লেগেছিল। তখন লোকেরা বলাবলি করছিল, সালামাহ্ মৃত্যুবরণ করেছেন। সালামাহ (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি নবী (সা.) -এর কাছে আসলাম। তিনি আমার জখমের উপর তিনবার ফুঁ দিলেন, ফলে সে সময় হতে অদ্যাবধি আর আমার কোন প্রকারের কষ্ট হয়নি। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
عَن يَزِيدَ بْنِ أَبِي عُبَيْدٍ قَالَ: رَأَيْتُ أَثَرَ ضَرْبَةٍ فِي سَاقِ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ فَقُلْتُ يَا أَبَا مُسلم مَا هَذِه الضَّربةُ؟ فَقَالَ: هَذِه ضَرْبَةٌ أَصَابَتْنِي يَوْمَ خَيْبَرَ فَقَالَ النَّاسُ أُصِيبَ سَلَمَةُ فَأَتَيْتُ الْنَبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَفَثَ فِيهِ ثَلَاثَ نَفَثَاتٍ فَمَا اشْتَكَيْتُهَا حَتَّى السَّاعَة. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4206) ۔
(صَحِيح)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৭-[২০] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যায়দ (ইবনু হারিসাহ্), জাফর (ইবনু আবূ তালিব) ও (আবদুল্লাহ) ইবনু রওয়াহাহ-এর মৃত্যু সংবাদ যুদ্ধের ময়দান হতে আসার আগেই নবী (সা.) লোকেদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। রণক্ষেত্রের বর্ণনা তিনি (সা.) এভাবে দিয়েছেন- যায়দ পতাকা হাতে নিয়েছে, সে শহীদ হয়েছে। তারপর জাফর পতাকা হাতে নিয়েছে, সেও শহীদ হয়েছে। অতঃপর ’আবদুল্লাহ ইবনু রওয়াহাহ্ পতাকা ধরেছে, সেও শহীদ হয়েছে। (বর্ণনাকারী বলেন,) এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত ছিল। এরপর তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহর তরবারিসমূহের এক তরবারি [খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ)] পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের ওপর মুসলিমদের বিজয়ী করেছেন। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ نَعَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَيْدًا وَجَعْفَرًا وَابْنَ رَوَاحَةَ لِلنَّاسِ قَبْلَ أَن يَأْتِيهِ خَبَرُهُمْ فَقَالَ أَخْذَ الرَّايَةَ زِيدٌ فَأُصِيبَ ثُمَّ أَخَذَ جَعْفَرٌ فَأُصِيبَ ثُمَّ أَخَذَ ابْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيبَ وَعَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ حَتَّى أَخَذَ الرَّايَةَ سَيْفٌ من سيوف الله حَتَّى فتح الله عَلَيْهِم. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4262) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : উক্ত হাদীসে মূতার যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে সকল সেনাপতি মূতার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় থেকে তাদের সংবাদ দিয়েছেন। মিরকাত প্রণেতা বলেন, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কেউ মারা গেলে তার সংবাদ প্রচার করা বৈধ।
অষ্টম হিজরীতে তিন হাজার মুসলিম সৈন্য সিরিয়ার মূতা নামক এলাকায় তৎকালীন রোমের বাদশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। প্রতিপক্ষের সৈন্য ছিল এক লক্ষ। সেই যুদ্ধে এক এক করে তিনজন মুসলিম সেনাপতি শহীদ হন। তখন রাসূল (সা.) মদীনায় বসে থেকে তাদের মৃত্যুর সংবাদ দিচ্ছিলেন। আর তার চক্ষু দিয়ে অঝরে অশ্রু বেয়ে পড়ছিল। তিনজন সেনাপতির শাহাদাতের পর দায়িত্ব নেন খালিদ ইবনু ওয়ালীদ। তিনি জীবন বাজি রেখে বীর বিক্রমে লড়াই করে যান। সেদিন তিনি একে একে আটটি তরবারি যুদ্ধ করে ভেঙ্গে ফেলেন এবং ছিনিয়ে আনেন মুসলিমদের বিজয়। তবে বিজয়টি কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে এই বিষয়ে যে, তারা কি বিজয়ী হয়ে মুশরিকদেরকে পরাজিত করে গনীমতের মাল নিয়ে ফিরেছিলেন নাকি শুধু কেবল বীরত্ব দেখিয়ে নিরাপদে মদীনায় ফিরে এসেছিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৮-[২১] ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়নের যুদ্ধে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে শরীক ছিলাম। যখন মুসলিমগণ ময়দান হতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের বাহন খচ্চরকে তাড়া দিয়ে কাফিরদের দিকে অগ্রসর হলেন। [বর্ণনাকারী ’আব্বাস (রাঃ) বলেন] আর আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) - এর খচ্চরের লাগাম ধরে রেখেছিলাম এবং আমি তাঁকে সামনে বাড়তে বাধা দিচ্ছিলাম, যেন তা দ্রুত কাফিরদের দলের মধ্যে ঢুকে না পড়ে। আর আবূ সুফইয়ান ইবনু হারিস ধরে রেখেছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বাহনের গদি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আব্বাস! সামুরাহ গাছের নিচে বায়’আতকারীদেরকে আহ্বান করুন। আব্বাস (রাঃ) ছিলেন উচ্চৈঃস্বর বিশিষ্ট লোক। তিনি বলেন, তৎক্ষণাৎ আমি উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিয়ে বললাম, আসহাবে সামুরাগণ কোথায়? ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমার আওয়াজ (আহ্বান) শুনার সাথে সাথেই আসহাবেই সামুরাগণ এমনভাবে দৌড়িয়ে ময়দানে এসে উপস্থিত হলেন, যেমন গাভী তার বাছুরের দিকে দৌড় দেয়। আর তারা আওয়াজ দিতে থাকল-
(يَا لَبَّيْكَ يَا لَبَّيْكَ) ’ইয়া লাব্বাইক, ইয়া লাব্বাইক। আমরা উপস্থিত! আমরা উপস্থিত।
আব্বাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর মুসলিমগণ কাফিরদের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হয়ে গেল। অন্যদিকে আনসারদের মধ্যে এ ধ্বনি উচ্চারিত হয়- হে আনসার সম্প্রদায়। হে আনসার সম্প্রদায়! (শত্রু নিধনে ঝাপিয়ে পড়) ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, অতঃপর তাদের ধ্বনি (একমাত্র) বানী হারিস ইবনু খাযরাজের ওপর সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। (আনসারদের মধ্যে এ গোত্রটি ছিল সর্বাপেক্ষা বড়) এই সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ বাহন খচ্চরের উপরে থেকে মাথা উঠিয়ে যুদ্ধের অবস্থার দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনই যুদ্ধ জ্বলে উঠেছে। অতঃপর তিনি একমুষ্টি পাথর হাতে নিয়ে কাফিরদের মুখের প্রতি নিক্ষেপ করে বললেন, মুহাম্মাদের প্রভুর শপথ! কাফিরদল পরাজিত হয়েছে। [বর্ণনাকারী ’আব্বাস (রাঃ) বলেন] আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, তাদের এ পরাজয় কেবলমাত্র তাঁর [রাসূল (সা.) -এর] কঙ্কর নিক্ষেপের দ্বারাই ঘটেছে। অতঃপর আমি যুদ্ধের সমাপ্তি অবধি সর্বক্ষণ তাই দেখতে পেলাম যে, তাদের তলোয়ার ও বর্শার ধার ভোঁতা হয়ে পড়েছে এবং তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালাচ্ছে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن عَبَّاسٍ قَالَ: شَهِدْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ حُنَيْنٍ فَلَمَّا الْتَقَى الْمُسْلِمُونَ وَالْكُفَّارُ وَلَّى الْمُسْلِمُونَ مُدْبِرِينَ فَطَفِقَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَرْكُضُ بَغْلَتَهُ قِبَلَ الْكُفَّارِ وَأَنَا آخِذٌ بِلِجَامِ بَغْلَةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَكُفُّهَا إِرَادَةَ أَن لَا تسرع وَأَبُو سُفْيَان آخِذٌ بِرِكَابِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَيْ عَبَّاسُ نَادِ أَصْحَابَ السَّمُرَةِ فَقَالَ عَبَّاسٌ وَكَانَ رَجُلًا صَيِّتًا فَقُلْتُ بِأَعْلَى صَوْتِي أَيْنَ أَصْحَابُ السَّمُرَةِ فَقَالَ وَاللَّهِ لَكَأَنَّ عَطْفَتَهُمْ حِينَ سَمِعُوا صَوْتِي عَطْفَةُ الْبَقَرِ عَلَى أَوْلَادِهَا فَقَالُوا يَا لَبَّيْكَ يَا لَبَّيْكَ قَالَ فَاقْتَتَلُوا وَالْكُفَّارَ وَالدَّعْوَةُ فِي الْأَنْصَارِ يَقُولُونَ يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ قَالَ ثُمَّ قُصِرَتِ الدَّعْوَةُ عَلَى بَنِي الْحَارِثِ بْنِ الْخَزْرَجِ فَنَظَرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ عَلَى بَغْلَتِهِ كَالْمُتَطَاوِلِ عَلَيْهَا إِلَى قِتَالِهِمْ فَقَالَ حِينَ حَمِيَ الْوَطِيسُ ثُمَّ أَخَذَ حَصَيَاتٍ فَرَمَى بِهِنَّ وُجُوهَ الْكُفَّارِ ثُمَّ قَالَ انْهَزَمُوا وَرَبِّ مُحَمَّدٍ فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلَّا أَنْ رَمَاهُمْ بِحَصَيَاتِهِ فَمَا زِلْتُ أَرَى حَدَّهُمْ كَلِيلًا وَأَمْرَهُمْ مُدبرا. رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (76 / 1775)، (4612) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : হুনায়নের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল অষ্টম হিজরীর শাওয়াল মাসে হুনায়ন নামক স্থানে। ‘হুনায়ন হলো ‘আরাফার পিছনে ত্বায়িফ ও মক্কার মাঝে একটি উপত্যকার নাম। সেই যুদ্ধে মুসলিমগণ প্রথমদিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা শুরু করে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজেই তার খচ্চরে আরোহণ করে কাফিরদের সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। আকমাল বলেন, হুনায়নের যুদ্ধের দিন রাসূল (সা.) যেই খচ্চরে আরোহণ করেছিলেন সেটির নাম ছিল “দুলদুল” আর তা ফারওয়া ইবনু নাফাসা নামক ব্যক্তি তাকে হাদিয়্যাহ্ দিয়েছিল।
সে ছিল একজন মুশরিক। অতএব, উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, কোন মুশরিকের ব্যাপারে যদি ইসলাম গ্রহণের আশা করা যায় অথবা তার মাধ্যমে মুসলিমদের কোন কল্যাণের আশা করা যায় তাহলে তার থেকে হাদিয়্যাহ্ গ্রহণ করা যাবে। আর যদি তার থেকে এ ধরনের ভালো কিছু আশা করা না যায় তাহলে নিরুপায় না হলে তার থেকে কোন হাদিয়্যাহ্ গ্রহণ করা যাবে না।
(نَادِ أَصْحَابَ السَّمُرَةِ) অর্থাৎ তিনি বাবলা গাছের অধিবাসী বলে ডাক দিলেন। মিরকাত প্রণেতা বলেন, এখানে বাবলা গাছ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ঐ গাছ যে গাছের নিচে সাহাবীগণ হুদায়বিয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করে ‘উসমান হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রাসূল (সা.)-এর হাতে বায়'আত করেছিলেন।
‘আব্বাস (রাঃ) সাহাবীদেরকে এই নামে ডাক দিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে, তারা যেন সেই বায়'আতের কথা ভুলে না যান এবং দ্রুত জিহাদের ময়দানে আবার ফিরে আসেন।
তারপর আবার বিশেষভাবে বানূ হারিস ইবনু খাযরাজ-কে ডাকলেন। কারণ তারা ছিল একটি বড় গোত্রে এবং তাদের লোক সংখ্যাও ছিল বেশি। যে সকল সাহাবী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে গিয়েছিল 'আব্বাস (রাঃ) তাদেরকে ডাক দেয়ার পর তারা সকলেই আবার যুদ্ধের মাঠে ফিরে আসলো। আর নতুন করে আবার প্রচণ্ড যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল।
এদিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) কিছু কঙ্কর নিয়ে কাফিরদের চেহারার দিকে এই বলে নিক্ষেপ করলেন যে, (شَاجَبِ الْوُجُوهُ شَاهَبِ الْوُجُوهُ) অর্থাৎ তাদের চেহারা বিগড়ে যাক। তাদের চেহারা বিগড়ে যাক। তারপর কাফির সৈন্যরা পরাজিত হয়। আর মুসলিমগণ অনেক গনীমতের মাল নিয়ে বিজয়ী হয়ে ফিরে আসে।
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত হাদীস থেকে রাসূল (সা.) -এর দু’টি মু'জিযাহ্ প্রকাশিত হয়। ১) তাঁর কর্মের মাধ্যমে। যেমন- তিনি কাফির সেনাদের দিকে কঙ্কর নিক্ষেপ করেন। ২) সংবাদ দেয়ার মাধ্যমে। যেমন- তিনি এই সংবাদ দেন যে, কাফির বাহিনী পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে যাবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৯-[২২] আবূ ইসহাক (সারিয়ী) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক লোক বারা’ ইবনু ’আযিব (রাঃ) কে প্রশ্ন করল, হে আবূ উমারাহ। হুনায়নের যুদ্ধের দিন কি তোমরা কাফিরদের মোকাবিলা হতে পলায়ন করেছিলে? উত্তরে তিনি বললেন, নিশ্চয় না, আল্লাহর শপথ! রাসূলুল্লাহ (সা.) পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেননি। (অবশ্য) সাহাবীদের কতিপয় যুবক, যাদের কাছে তেমন বেশি কিছু হাতিয়ার ছিল না, তারা তীর নিক্ষেপকারী কাফিরদের মাঝে পড়ে গিয়েছিল। তারা তীরন্দাজীতে এত পটু ছিল যে, তাদের একটি তীরও জমিনে পড়ত না।
ফলে তাদের নিক্ষিপ্ত প্রতিটি তীর ঐ সকল যুবক (মুসলিম সৈনিকদের) ওপর পড়তে ভুল হত না। এ অবস্থায় (দুশমনের সামনে হতে পলায়ন করত) সে সমস্ত যুবকরা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে এসে পৌছল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর একটি সাদা বর্ণের খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন এবং আবূ সুফইয়ান ইবনু হারিস লাগাম ধরে তাঁর সামনে ছিলেন। এ সময় তিনি (সা.) খচ্চরের পৃষ্ঠ হতে নামলেন এবং বিজয়ের জন্য (আল্লাহর কাছে) মদদ ও সাহায্যের আবেদন করলেন। আর (এ পংক্তিটি) উচ্চারণ করলেন, “আমি যে নবী তা মিথ্যা নয়। আমি ’আবদুল মুত্ত্বালিব-এর সন্তান। অতঃপর তিনি মুসলিমদেরকে পুনরায় কাতারবদ্ধ করলেন। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن أبي إِسْحَق قَالَ قَالَ رَجُلٌ لِلْبَرَاءِ يَا أَبَا عُمَارَةَ فَرَرْتُمْ يَوْمَ حُنَيْنٍ قَالَ لَا وَاللَّهِ مَا وَلِيُّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَكِنْ خَرَجَ شُبَّانُ أَصْحَابِهِ لَيْسَ عَلَيْهِمْ كَثِيرُ سِلَاحٍ فَلَقَوْا قَوْمًا رُمَاةً لَا يَكَادُ يَسْقُطُ لَهُمْ سَهْمٌ فَرَشَقُوهُمْ رَشْقًا مَا يَكَادُونَ يُخْطِئُونَ فَأَقْبَلُوا هُنَاكَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى بَغْلَتِهِ الْبَيْضَاءِ وَأَبُو سُفْيَانَ بْنُ الْحَارِثِ يَقُودُهُ فَنَزَلَ وَاسْتَنْصَرَ وَقَالَ أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبَ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ ثُمَّ صفهم. رَوَاهُ مُسلم. وللبخاري مَعْنَاهُ
رواہ مسلم (78 / 1776)، (4615) و البخاری (2930) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : হুনায়নের যুদ্ধে মুসলিমগণ প্রথম দিকে কাফিরদের কাছে প্রায় পরাজিত হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বাহ্যিক কারণ হিসেবে দেখা যায়, হাওয়াযিন গোত্রের তিরন্দাজেরা অনেক মুসলিম সেনাকে তাদের টার্গেটে পরিণত করে ব্যাপক তীর নিক্ষেপ করে। এতে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং শেষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সাময়িক সময়ের জন্য পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ফাতহুল বারীতে বলা হয়েছে, হাওয়াযিন একটি বড় ‘আরব গোত্রের নাম। সেই গোত্রে অনেকগুলো শাখা-উপশাখা রয়েছে। তাদেরকে হাওয়াযিন বলা হয় হাওয়াযিন ইবনু মানসূর ইবনু ‘ইকরামাহ ইবনু খাসফাহ নামক এক ব্যক্তির দিকে সম্পৃক্ত করে।
ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) ফাতহুল বারী’তে উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় আরো কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। সেগুলোর মধ্য হতে একটি হলো, যেমন- আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মক্কা বিজয় করলাম। তারপর হুনায়নের যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হলাম। অতঃপর মুশরিকরা একেবারে দেখার মতো সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের মাঠে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে অশ্বারোহী বাহিনী। তাঁর পিছনে পদাতিক বাহিনী তার পিছনে ছিল নারীরা ও গবাদী পশু তথা মেষপাল, ছাগল, দুম্বা উট ইত্যাদি। আর আমরাও ছিলাম অনেক মানুষ। আমাদের ডান পাশে ছিল খালিদ ইবনু ওয়ালীদ-এর নেতৃত্বে আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী। সেটি আমাদের পিছনে অবস্থান করছিল। যখনই সেই বাহিনী বের হয়ে আসলো তখনই ‘আরবের মুশরিকরা পালাতে লাগল। (ফাতহুল বারী হা, ৪১১৫)
মিরাত প্রণেতা উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, (خَدَجَ شُبَّانُ أَصْحَابِهِ) অর্থাৎ তাঁর সাহাবীদের মধ্য হতে কিছু যুবক যুদ্ধের মাঠ থেকে বের হয়ে গেল। এখানে কিছু যুবক দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের মধ্য হতে এমন কিছু যুবক যাদের তেমন কোন স্থায়িত্ব বা গাম্ভীর্জ ছিল না। তারা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রমণের তীব্রতা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ না করেই ময়দান থেকে পলায়ন করে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) হুনায়নের যুদ্ধে কাফির সেনাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় খচ্চরে আরোহণ করে বলতে থাকেন (أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبَ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ) অর্থাৎ আমি নবী, যাতে কোন মিথ্যা নেই। আমি ‘আবদুল মুত্তালিব-এর সন্তান।
এই পংক্তি সম্পর্কে ইবনু তীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এখানে (لَا كَذِبَ) এবং মধ্যে যবর দিয়ে পড়তে হবে। তাহলে এটি আর তখন কোন কবিতার ছন্দ মিলে থাকবে না। ফলে এই সম্পর্কে আর কারো কোন আপত্তিও থাকবে না যে, আল্লাহ তো বলেছেন যে, ...
(وَ مَا عَلَّمۡنٰهُ الشِّعۡرَ وَ مَا یَنۡۢبَغِیۡ لَهٗ…) অর্থাৎ “আর আমি তাকে কবিতা শিক্ষা দেয়নি এবং সেটি তার জন্য শোভনীয় নয়...”- (সূরাহ্ ইয়া-সীন ৩৬ : ৬৯)।
কিন্তু যদি তা সাকিন করে (لَا كَذْبَ) পড়া হয় তাহলে তা কবিতার ছন্দে এসে যায়। এজন্য ফাতহুল বারীতে এই সম্পর্কে কয়েকটি উত্তর দেয়া হয়েছে। যেমন-
১) এটি মূলত অন্য একজন কবির ছন্দ। যা তিনি লিখেছিলেন এভাবে যে, (أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبَ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ) অর্থাৎ আপনি নবী যাতে কোন মিথ্যা নেই। আপনি ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর সন্তান। রাসূল (সা.) এখানে তুমি এর জায়গায় ‘আমি’ তথা (أَنَا) যুক্ত করেছেন।
২) এটি একটি বিশেষ ধরনের পংক্তি। এটি কোন কবিতা না। কিন্তু এই উত্তরটি গ্রহণযোগ্য নয়।
৩) এটি কবিতা হিসেবে গণ্য হবে না যতক্ষণ না তার অংশ পূর্ণ হবে। যেহেতু এটি একটি অংশবিশেষ। তাই এটি কোন কবিতা নয়।
৪) এটি কবিতার ছন্দাকারেই বলা হয়েছে। কিন্তু এর দ্বারা এখানে কবিতা উদ্দেশ্য নয়।
উক্ত পংক্তিতে তিনি নিজেকে আবদুল মুত্ত্বালিব-এর পুত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবদুল্লাহ-এর পুত্র হিসেবে উল্লেখ করেননি। কারণ হলো, তার দাদা আবদুল মুত্তালিব ছিলেন মানুষের কাছে পরিচিত এবং প্রসিদ্ধ লোক। অন্যদিকে তার পিতা আবদুল্লাহ যুবক অবস্থায় মারা যান। তাই মানুষের কাছে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাননি। তাছাড়াও নিজেকে স্বীয় পূর্বপুরুষদের নামে পরিচিত করাটা ছিল আরবদের একটি ভালো রীতির অন্তর্ভুক্ত। (ফাতহুল বারী হা. ৪৩১৫)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯০-[২৩] বুখারীর বর্ণনাতে উল্লিখিত হাদীসটির বিষয়বস্তুটি বর্ণিত হয়েছে। আর বুখারী ও মুসলিম এর উভয় বর্ণনায় আছে, বারা ইবনু আযিব (রাঃ) বলেছেন, আল্লাহর শপথ! যখন যুদ্ধ ভয়ানক আকার ধারণ করত, তখন আমরা নবী (সা.) -এর দ্বারা আত্মরক্ষা করতাম। আর আমাদের মাঝে ঐ লোকই অধিক সাহসী বলে গণ্য হত, যে লোক নবী (সা.) -এর পাশাপাশি বরাবর দাঁড়াত।
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَفِي رِوَايَةٍ لَهُمَا قَالَ الْبَرَاءُ كُنَّا وَاللَّهِ إِذَا احْمَرَّ الْبَأْسُ نَتَّقِي بِهِ وَإِنَّ الشُّجَاعَ مِنَّا لَلَّذِي يُحَاذِيهِ يَعْنِي النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم
متفق علیہ ، رواہ البخاری (لم اجدہ) و مسلم (79 / 1776)، (4616) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা : (إِذَا احْمَرَّ الْبَأْسُ) অর্থাৎ যখন যুদ্ধ লাল হলো, ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এখানে (حْمَرَّ الْبَأْسُ) তথা যুদ্ধ লাল হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধ প্রচণ্ড আকার ধারণ করা।
এখানে যুদ্ধ লাল হওয়ার কথা বলা হয়েছে রূপকভাবে। কেননা যখন যুদ্ধ প্রচণ্ড আকার ধারণ করে, তখন যুদ্ধক্ষেত্র রক্তে লাল হয়ে যায়। সে সময়ে যুদ্ধ এতটাই তীব্র হয়েছিল যে, যারা অত্যধিক সাহসী তারাই তখন যুদ্ধক্ষেত্রে কেবল কাফির বাহিনীর সামনে যেত। আর অন্যরা যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে সাময়িক সময়ের জন্য পালিয়ে ছিল। তখন সেই মুহূর্তেও রাসূল (সা.) -এর সাহস ছিল অত্যধিক এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা ছিল অনেক দৃঢ়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯১-[২৪] সালামাহ্ ইবনু আকওয়া’ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়নের যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে শরীক ছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কতিপয় সাহাবী কাফিরদের মোকাবিলা হতে যখন পলায়ন করলেন। তখন কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে চতুর্দিক হতে ঘিরে ফেলল, এমতাবস্থায় তিনি (সা.) খচ্চরের পিঠ হতে নিচে নামলেন। অতঃপর তিনি জমিন হতে এক মুষ্টি মাটি তুলে নিলেন। তারপর কাফিরদের অভিমুখে (شَاهَتِ الْوُجُوهُ) ’তোমাদের মুখ বিবর্ণ হোক’ এ অভিশাপ বাক্যটি উচ্চারণ করে তা নিক্ষেপ করলেন। (বর্ণনাকারী বলেন,) তাদের যে কোন লোককে আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন (উপস্থিত কাফিরদের) প্রত্যেকের চক্ষুদ্বয় উক্ত এক মুষ্টি মাটি দ্বারা ভর্তি হয়ে গেল। ফলে তারা ময়দান হতে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল। এভাবে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পরাজিত করলেন। পরে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের হতে লব্ধ গনীমাতের সম্পদসমূহ মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করলেন। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ قَالَ غَزَوْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حُنَيْنًا فَوَلَّى صَحَابَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا غَشُوا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَزَلَ عَنِ الْبَغْلَةِ ثُمَّ قَبَضَ قَبْضَةً مِنْ تُرَابٍ مِنَ الْأَرْضِ ثُمَّ اسْتَقْبَلَ بِهِ وُجُوهَهُمْ فَقَالَ شَاهَتِ الْوُجُوهُ فَمَا خَلَقَ اللَّهُ مِنْهُمْ إِنْسَانًا إِلَّا مَلَأَ عَيْنَيْهِ تُرَابًا بِتِلْكَ الْقَبْضَةِ فَوَلَّوْا مُدْبِرِينَ فَهَزَمَهُمْ الله عز وَجل وَقَسْمِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غنائمهم بَين الْمُسلمين رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (81 / 1777)، (4619) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: হাদীসের ব্যাখ্যায় ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কয়েকটি মু'জিযাহ্ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- মাত্র এক মুষ্টি মাটি সকলে কাফির সেনাদের চোখে পৌছে দেয়া। যা কেবল রাসূল (সা.) -এর দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। অন্য কারো দ্বারা সম্ভব নয়।
• এই অল্প পরিমাণ মাটি দিয়ে চার হাজার কাফির সেনার চক্ষু পরিপূর্ণ করে দেয়া।
• এই মাটি নিক্ষেপের কারণেই তাদের ধ্বংস অনিবার্য হওয়া।
তারপর হাদীসের শেষ অংশে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাদেরকে পরাজিত করলেন। আর রাসূল (সা.) সাহাবীদের মাঝে গনীমতের মাল বণ্টন করে দিলেন।
এখান থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা'আলা রাসূল (সা.) -এর দু'আ কবুল করেছেন এবং তাঁকে উত্তমভাবে সাহায্য করেছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯২-[২৫] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়নের যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) - এর সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম। সে যুদ্ধে তাঁর সাথে অংশগ্রহণকারী ইসলামের দাবিদার জনৈক লোক সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এ লোকটি জাহান্নামী।
যুদ্ধ শুরু হলে সে ব্যক্তি প্রাণপণ যুদ্ধ করে মারাত্মকভাবে আহত হলো। অতঃপর এক লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! লক্ষ্য করুন। আপনি যে লোকটিকে জাহান্নামী বলেছেন, সে আল্লাহর পথে প্রাণপন লড়াই করে এখন মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় আছে। এবারও তিনি বললেন, সে জাহান্নামী। (বর্ণনাকারী বলেন,) এ কথা শুনে কারো কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো। এমতাবস্থায় লোকটি ভীষণভাবে জখমের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে স্বীয় হাতখানা তীরদানের দিকে বাড়িয়ে তীর বের নিল এবং নিজের বুকের মধ্যে গেঁথে দিল (তথা আত্মহত্যা করল)। এটা দেখে মুসলিমদের কতিপয় লোক দৌড়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ তা’আলা আপনার কথাটিকে সত্যে পরিণত করেছেন। অমুক লোকটি নিজেই আত্মহত্যা করেছে। এ সংবাদ শোনামাত্রই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলে উঠলেন, ’আল্ল-হু আকবার’। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।
অতঃপর বললেন, হে বিলাল! উঠ! লোকেদের মধ্যে এ ঘোষণা দিয়ে দাও যে, পূর্ণ মুমিন ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর আল্লাহ তা’আলা (অনেক সময়) পাপী লোকের দ্বারাও এ দীন ইসলামকে শক্তিশালী করে থাকেন। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن أبي هريرةَ قَالَ شَهِدْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حُنَيْنًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِرَجُلٍ مِمَّنْ مَعَهُ يَدَّعِي الْإِسْلَامَ هَذَا مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَلَمَّا حَضَرَ الْقِتَالُ قَاتَلَ الرَّجُلُ مِنْ أَشَدِّ الْقِتَالِ وَكَثُرَتْ بِهِ الْجِرَاحُ فَجَاءَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ الله أَرأيتَ الَّذِي تحدثت أَنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ قَدْ قَاتَلَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ مِنْ أَشَدِّ الْقِتَالِ فَكَثُرَتْ بِهِ الْجِرَاحُ فَقَالَ أَمَّا إِنَّهُ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَكَادَ بَعْضُ النَّاسِ يَرْتَابُ فَبَيْنَمَا هُوَ عَلَى ذَلِكَ إِذْ وَجَدَ الرَّجُلُ أَلَمَ الْجِرَاحِ فَأَهْوَى بِيَدِهِ إِلَى كِنَانَتِهِ فَانْتَزَعَ سَهْمًا فَانْتَحَرَ بِهَا فَاشْتَدَّ رِجَالٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ صَدَّقَ اللَّهُ حَدِيثَكَ قَدِ انْتَحَرَ فُلَانٌ وَقَتَلَ نَفْسِهِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُ أَكْبَرُ أَشْهَدُ أَنِّي عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ يَا بِلَالُ قُمْ فَأَذِّنْ لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا مُؤْمِنٌ وَإِنَّ اللَّهَ لَيُؤَيِّدُ هَذَا الدينَ بِالرجلِ الْفَاجِر. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3062) [و مسلم (178 / 111)، (305)] ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, যে ব্যক্তি মহান বীরত্বের সাথে লড়াই করার পরেও আত্মহত্যা করেছিল। তার নাম ছিল 'কিরমান'। ইমাম খত্বীব আল বাগদাদী “জামিউল উসূল” গ্রন্থে বলেন, সে ছিল একজন মুনাফিক। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
কিন্তু ফাতহুল বারীতে ইবনুল জাওযী (রহিমাহুল্লাহ)-এর বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উক্ত ব্যক্তির নাম ছিল ‘কযমান আয যফরী'।
ইবনুল জাওযী (রহিমাহুল্লাহ) দৃঢ়তার সাথে বলেন, এ ঘটনাটি ঘটেছিল উহুদ যুদ্ধের সময়। সে ছিল মুসলিমদের থেকে পিছনে মহিলাদের দলের সাথে। এক পর্যায়ে সে বেরিয়ে এসে প্রথম সারিতে গিয়ে সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করা শুরু করল। তারপর সে বীরত্বের সাথে তরবারি দিয়ে লড়াই করল। অতঃপর যখন মুসলিমেরা বের হয়ে গেল তখন সে তার তরবারির হাতল ভেঙ্গে ফেলল এবং বলতে লাগল ‘পলায়ন করা থেকে আমার কাছে মৃত্যুবরণ করাই অধিক উত্তম'। তারপর কতাদাহ্ ইবনু নুমান তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় বলল, তোমার জন্য শাহাদাতের সুসংবাদ। তখন ঐ ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম, আমি দীন রক্ষার লক্ষ্যে যুদ্ধ করিনি। বরং আমি যুদ্ধ করেছি শুধু আমার সম্প্রদায়কে রক্ষা করার লক্ষ্যে। তারপর সে যখমের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে গেল এবং এক পর্যায়ে সে আত্মহত্যা করে ফেলল। (ফাতহুল বারী হা, ৪২০৩)
(لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ إِلَّا مُؤْمِنٌ) অর্থাৎ শুধুমাত্র মু'মিন ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এখানে ঐ সকল মুমিন বান্দাদের কথা বলা হয়েছে যারা সফলতার সাথে প্রথমবারেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। অতএব প্রথমবারেই সফলতার সাথে জান্নাতে প্রবেশ করতে চাইলে অবশ্যই একনিষ্ঠ, খাটি ও পূর্ণ মুমিন হতে হবে।
(وَإِنَّ اللَّهَ لَيُؤَيِّدُ هَذَا الدينَ بِالرجلِ الْفَاجِر) অর্থাৎ অবশ্যই আল্লাহ এই দীনকে পাপাচার লোকেদের মাধ্যমেও শক্তিশালী করে থাকেন।
এর ব্যাখ্যা জামি গ্রন্থে বলা হয়েছে, অবশ্যই আল্লাহ এই দীনকে এমন লোকেদের দ্বারাও শক্তিশালী করেন, যাদের জন্য ইসলামে কোন অংশ নেই। ইবনু উমার (রাঃ)-এর ব্যাখ্যায় বলেন, অবশ্যই আল্লাহ এমন লোকদের দ্বারাও ইসলামকে শক্তিশালী করেন, যারা ইসলামের অনুসারী না। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৩-[২৬] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ওপর জাদু করা হয়। ফলে তাঁর অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে, তার ধারণা হত তিনি কোন একটি কাজ করেছেন অথচ তা তিনি করেননি। এ অবস্থায় একদিন তিনি (সা.) আমার কাছে ছিলেন এবং আল্লাহর নিকট বার বার দু’আ করলেন। অতঃপর আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি কি অবগত হয়েছ, আমি যা জানতে চেয়েছিলাম আল্লাহ তা’আলা আমাকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। আমার কাছে দু’জন লোক (মানব আকৃতিতে দু’জন ফেরেশতা) আসে। তাদের একজন আমার মাথার কাছে এবং অপরজন আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল। এরপর তাদের একজন আপন সাথিকে বলল, এ লোকের অসুখটা কি? বলল, তার ওপর জাদু করা হয়েছে। প্রথমজন জিজ্ঞেস করল, কে তাকে জাদু করেছে? সে উত্তর দিল, ইয়াহুদী লাবীদ ইবনু আসাম। প্রথম লোক প্রশ্ন করল, তা কিসের সাহায্যে (করা হয়েছে?) দ্বিতীয় লোকটি বলল, চিরুনি এবং চিরুনিতে ঝরে পড়া চুলের মধ্যে এবং পুরুষ খেজুর গাছের নতুন খোলের মধ্যে। [’আয়িশাহ (রা.) বলেন,] অতঃপর নবী (সা.) তাঁর কিছু সাহাবীসহ সে কূপের কাছে গেলেন। এরপর বললেন, এটাই সেই কূপ যা আমাকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে। তার পানি মেহেদি নিংড়ানো। আর কূপের আশপাশের খেজুর গাছগুলোর মাথা যেন শয়তানের মাথার মতো। অতঃপর তা কূপ হতে বের করে ফেলেছে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ سُحِرَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى إِنَّهُ لَيُخَيَّلُ إِلَيْهِ أَنَّهُ فَعَلَ الشَّيْءَ وَمَا فَعَلَهُ حَتَّى إِذا كَانَ ذَات يَوْم وَهُوَ عِنْدِي دَعَا اللَّهَ وَدَعَاهُ ثُمَّ قَالَ أَشَعَرْتِ يَا عَائِشَةُ أَنَّ اللَّهَ قَدْ أَفْتَانِي فِيمَا استفتيته جَاءَنِي رجلَانِ فَجَلَسَ أَحَدُهُمَا عِنْدَ رَأْسِي وَالْآخَرُ عِنْدَ رِجْلِي ثُمَّ قَالَ أَحَدُهُمَا لِصَاحِبِهِ مَا وَجَعُ الرَّجُلِ قَالَ مَطْبُوبٌ قَالَ وَمَنْ طَبَّهُ قَالَ لَبِيدُ بْنُ الْأَعْصَمِ الْيَهُودِيُّ قَالَ فِي مَاذَا قَالَ فِي مُشْطٍ وَمُشَاطَةٍ وَجُفِّ طَلْعَةِ ذَكَرٍ قَالَ فَأَيْنَ هُوَ قَالَ فِي بِئْرِ ذَرْوَانَ فَذَهَبَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي أُنَاسٍ مِنْ أَصْحَابِهِ إِلَى الْبِئْرِ فَقَالَ هَذِهِ الْبِئْرُ الَّتِي أُريتها وَكَأن ماءَها نُقاعةُ الْحِنَّاء ولكأن نخلها رُءُوس الشَّيَاطِين فاستخرجه مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3268) و مسلم (43 / 2189)، (5703) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে জাদু করার কারণে তাঁর কাছে কোন কাজ করা না করা নিয়ে সন্দেহ হত। কোন সময় তিনি কোন কাজ না করেই মনে করতেন যে, তিনি তা করেছেন। এটি ছিল শুধুমাত্র তাঁর জাদুকালীন সময়ে। আর তা হয়েছিল রাসূল (সা.) -এর দুনিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে। দীন সংক্রান্ত কোন বিষয়ে হয়নি। ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূল (সা.) -কে জাদু করার বিষয়টি কেউ কেউ অস্বীকার করে এই যুক্তি দিয়ে যে, এটি তার নুবুওয়্যাতের পরিপন্থী এবং তার মর্যাদার হানী। কিন্তু এ যুক্তিটি একেবারেই বাতিল। কারণ রাসূল (সা.) -কে জাদু করার ঘটনাটি অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এতে সন্দেহ করার কিছু নেই। আর জাদু করার বিষয়টি দুনিয়া সংক্রান্ত। এর সাথে নুবুওয়্যাতের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ নুবুওয়্যাত সংক্রান্ত বিষয়গুলো আল্লাহ বিশেষভাবে হিফাযাত করেছেন।
উক্ত ঘটনা থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, তিনি ছিলেন আমাদের মতোই মাটির মানুষ। এজন্যই তার মাঝে জাদু কাজ করেছে।
কেউ কেউ বলেন, জাদুকালীন সময়ে তাঁর অনেক কিছুই ধারণা হত। কিন্তু তিনি সেগুলোকে সঠিক হিসেবে বিশ্বাস করতেন না। বরং তিনি কেবল সঠিক বিষয়কেই সঠিক বলে বিশ্বাস করতেন।
মিরকাত প্রণেতা বলেন, এটিও হতে পারে যে, তিনি দুনিয়া সংক্রান্ত বিষয়ে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দীনের বিষয় হলে তিনি সতর্ক করে সঠিক বিষয়টিই বর্ণনা করতেন।
কেউ কেউ আরো বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) শারীরিক প্রফুল্লতার কারণে মনে করতেন যে, তিনি এখন সহবাস করতে সক্ষম। কিন্তু যখন স্ত্রীর নিকটবর্তী হতেন তখন তার মাঝে জাদুর প্রভাব কাজ করত। আর তিনি তাতে সক্ষম হতেন না।
ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূল (সা.) যেসব বিষয়ে ধারণা করতেন সেগুলো হত তাঁর চোখের দেখায়। কিন্তু আকল বা জ্ঞানের মাঝে এর কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। অতএব এটা রাসূল (সা.) -এর দায়িত্বের মাঝে কোন বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।
(دَعَا اللَّهَ وَدَعَاهُ) অর্থাৎ তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করলেন এবং দু'আ করেই চললেন। ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, কোন কষ্টকর বিষয় এসে পড়লে সেখান থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ করা এবং ভালো অবস্থানের জন্য প্রার্থনা করা মুস্তাহাব।
(قَالَ فِي بِئْرِ ذَرْوَانَ) অর্থাৎ তিনি বললেন, তা আছে যারওয়ান কূপে। তবে সহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় কূপের নামটি যি-আরোয়ান নামে উল্লেখ করা হয়েছে। দুটি নামই প্রসিদ্ধ। তবে ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) যি-আরোয়ান নামটিকেই বেশি সঠিক বলেছেন। আর এটি হলো মদীনায় অবস্থিত আবূ যুরায়ক নামক এক ব্যক্তির বাগানের কূপ।
(ولكأن نخلها رُءُوس الشَّيَاطِين) অর্থাৎ যেন তার খেজুরের গাছটি শয়তানের মাথার মতো। এখানে এই উপমার মাধ্যমে উক্ত গাছের বিদঘুটে আকৃতির কথা বুঝানো হয়েছে। তাছাড়াও আরবদের মাঝে এটি প্রচলিত ছিল যে, অপ্রীতিকর কোন বিদঘুটে দৃশ্যকে তারা শয়তানের মাথা বলে আখ্যায়িত করত।
আবার কেউ কেউ বলেন, বুঝানো হয়েছে বিষাক্ত ডোরাকাটা সম্পর্কে। সর্বোপরি কথা হলো, গাছটির দৃশ্য ছিল বড়ই অপ্রীতিকর। তাই সেটিকে শয়তানের মাথা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এক ইয়াহূদী নবী (সা.)-কে বেজোড় সংখ্যক তথা এগারোটি গিট দিয়ে জাদু করে এবং তা কূপে ফেলে দেয়। এতে নবী (সা.) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারপর সূরা ফালাক ও নাস নাযিল হয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৪-[২৭] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে ছিলাম। তিনি গনীমতের সম্পদ বিতরণ করছিলেন। তখন বানী তামীম গোত্রের ’যুল খুওয়াইসিরাহ্’ নামক এক লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ইনসাফ করুন। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমার প্রতি দুঃখ! আমিই যদি ইনসাফ না করি, তাহলে ইনসাফ আর করবে কে? যদি আমি ইনসাফ না করি, তবে তো তুমি ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্তই হলে। (অর্থাৎ তুমি ঈমানদার থাকবে না) তখন ’উমার (রাঃ) বললেন, আমাকে অনুমতি দিন, আমি তার ঘাড় উড়িয়ে দেই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তাকে ছেড়ে দাও। কারণ, তার আরো কিছু সাথী আছে তোমাদের কেউ স্বীয় সালাতকে তাদের সালাতের সাথে এবং নিজের সিয়ামকে তাদের সিয়ামের সাথে তুলনা করলে নিজেদের সালাত সিয়ামকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে না। তারা দীন ইসলাম হতে এমনভাবে বের হয়ে পড়বে, যেমন তীর শিকার ছেদ করে বের হয়ে পড়ে।
অতঃপর সে (শিকারী) তীরের বাঁট হতে ধারালো মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে দেখে (কোথাও কোন কিছু লেগে আছে কিনা?) কিন্তু তাতে কিছু দেখতে পাওয়া যায়। অথচ তীরটি শিকারের নাড়িভুড়ি ও রক্ত-মাংস ভেদ করে গেছে। তাদের এক লোকের চিহ্ন হবে কালো বর্ণের, তার বাহুদ্বয়ের কোন এক বাহুর উপরে স্ত্রীলোকের স্তনের মতো ফুলা। অথবা বলেছেন, মাংসের একটি খণ্ডের মতো উঠে থাকবে, যা নাড়তে থাকবে এবং তারা উত্তম একটি দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে লিপ্ত হবে। বর্ণনাকারী আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এ কথাগুলো আমি সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে শুনেছি।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ’আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) সেই দলের খারিজীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমিও তার সাথে ছিলাম। যুদ্ধ শেষে ’আলী (রাঃ) (নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে) ঐ লোকটির খোঁজ নিতে নির্দেশ করেন। অতএব সন্ধান করে এক লোককে আনা হলো। বর্ণনাকারী আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি তাকে লক্ষ্য করে দেখেছি, ঐ লোকটির সম্পর্কে নবী (সা.) যে চিহ্নসমূহ বলেছিলেন, তার মধ্যে সে সমস্ত চিহ্নগুলো বিদ্যমান ছিল।
অপর এক বর্ণনাতে আছে- (গনীমাতের সম্পদ বণ্টনের বিষয়ে) এমন এক লোক তাঁর সম্মুখে আসলো, যার চক্ষু দুটি ছিল কোটরাগত, কপাল উঁচু- সামনের দিকে বের হয়ে রয়েছে, দাড়ি ছিল ঘন, গণ্ডদ্বয় ছিল ফুলা আর মাথা ছিল ন্যাড়া। সে বলল, হে মুহাম্মাদ। আল্লাহকে ভয় কর। উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, আমিই যদি নাফরমানি করি, তাহলে আল্লাহর আনুগত্য করবে কে? স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা আমাকে দুনিয়াবাসীর ওপর আমানতদার বানিয়েছেন। আর তোমরা কি আমাকে আমানতদার মনে করো না? এ সময় এক লোক এ লোককে হত্যা করার জন্য [নবী (সা.) -এর কাছে] অনুমতি চাইলেন; কিন্তু তিনি নিষেধ করলেন। উক্ত লোকটি যখন চলে গেল, তখন নবী (সা.) বললেন, এ লোকের পরবর্তী বংশধরের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায়ের আগমন ঘটবে, যারা কুরআন পড়বে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দীন ইসলাম হতে এমনভাবে বের হয়ে যাবে যেমন শিকার হতে তীর বের হয়ে যায়। তারা ইসলামের অনুসারীদেরেকে হত্যা করবে এবং মূর্তিপূজারীদেরকে আপন অবস্থায় ছেড়ে রাখবে। যদি আমি তাদের নাগাল পেতাম, তাহলে অবশ্যই আমি তাদের সকলকে ’আদ জাতির মতো হত্যা করতাম। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يَقْسِمُ قَسْمًا أَتَاهُ ذُو الْخوَيْصِرَة وَهُوَ رجلٌ من بني تَمِيم فَقَالَ يَا رسولَ الله اعْدِلْ فَقَالَ وَيلك وَمن يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَعْدِلْ قَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِن لم أكن أعدل فَقَالَ عمر لَهُ ائْذَنْ لي أضْرب عُنُقه فَقَالَ دَعْهُ فَإِنَّ لَهُ أَصْحَابًا يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلَاتَهُ مَعَ صَلَاتِهِمْ وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ يُنْظَرُ إِلَى نَصْلِهِ إِلَى رُصَافِهِ إِلَى نَضِيِّهِ وَهُوَ قِدْحُهُ إِلَى قُذَذِهِ فَلَا يُوجَدُ فِيهِ شَيْءٌ قَدْ سَبَقَ الْفَرْثَ وَالدَّمَ آيَتُهُمْ رَجُلٌ أَسْوَدُ إِحْدَى عَضُدَيْهِ مِثْلُ ثَدْيِ الْمَرْأَةِ أَوْ مِثْلُ الْبَضْعَةِ تَدَرْدَرُ وَيخرجُونَ على حِين فِرْقَةٍ مِنَ النَّاسِ قَالَ أَبُو سَعِيدٍ أَشْهَدُ أَنِّي سَمِعْتُ هَذَا الْحَدِيثَ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَشْهَدُ أَنَّ عَلِيَّ بْنَ أَبِي طَالِبٍ قَاتَلَهُمْ وَأَنَا مَعَهُ فَأَمَرَ بذلك الرجل فالْتُمِسَ فَأُتِيَ بِهِ حَتَّى نَظَرْتُ إِلَيْهِ عَلَى نَعْتِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الَّذِي نَعَتَهُ وَفِي رِوَايَةٍ: أَقْبَلَ رَجُلٌ غَائِرُ الْعَيْنَيْنِ نَاتِئُ الجبين كَثُّ اللِّحْيَةِ مُشْرِفُ الْوَجْنَتَيْنِ مَحْلُوقُ الرَّأْسِ فَقَالَ يَا مُحَمَّد اتَّقِ الله فَقَالَ: «فَمن يُطِيع اللَّهَ إِذَا عَصَيْتُهُ فَيَأْمَنُنِي اللَّهُ عَلَى أَهْلِ الْأَرْضِ وَلَا تَأْمَنُونِي» فَسَأَلَ رَجُلٌ قَتْلَهُ فَمَنَعَهُ فَلَمَّا وَلَّى قَالَ: «إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُونَ من الإِسلام مروق السهْم من الرَّمية يقتلُون أَهْلَ الْإِسْلَامِ وَيَدَعُونَ أَهْلَ الْأَوْثَانِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأقتلنهم قتل عَاد» . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3344) و مسلم (143 / 1064)، (2451) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (সা.) জি'রানাহ্ নামক স্থানে খায়বার যুদ্ধে পাওয়া গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তখন বানূ তামীম গোত্রের যুল খুওয়াইসারাহ্ নামক এক ব্যক্তি আসলো। সে ছিল একজন মুনাফিক এবং খাওয়ারিযদের প্রধান। সেই খাওয়ারিযদের প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল ‘আলী (রাঃ)-এর যুগে। সে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ইনসাফ করুন।
অথচ রাসূল (সা.) মানুষের অভাব বুঝে তাদের প্রয়োজন অনুপাতে ইনসাফের সাথে গনীমতের মাল বণ্টন করছিলেন। তারপরেও যখন সে আল্লাহর রাসূলকে এই কথা বলল তখন তিনি রেগে গেলেন এবং বললেন তোমার বরবাদী হোক। আমি যদি ইনসাফ না করি তাহলে কে ইনসাফ করবে।
সেই স্থানে ‘উমার (রাঃ)-ও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি অনুমতি দিন। আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে অনুমতি না দিয়ে ছেড়ে দিতে বললেন।
বেহ শারহুস্ সুন্নাহ্ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাসূল (সা.) কেন তাকে হত্যা করতে নিষেধ করলেন। অথচ তিনি বলেছেন, যদি আমি তাদেরকে পাই তাহলে অবশ্যই আমি তাদেরকে হত্যা করব।
এর উত্তরে এভাবে বলা হয়ে থাকে যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) তাদেরকে হত্যা করার ইচ্ছার কথা বলেছেন তাদেরকে হত্যা করার বৈধতা দেয়ার জন্য। আর তিনি অন্য কারণে তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দিয়েছেন। সেটি হলো যে, মুশরিকরা বলাবলি করবে যে, মুহাম্মাদ নিজের সাথিদেরকেও হত্যা করে।
আকমাল এ বিষয়টির সাথে আরো কিছু বিষয় উল্লেখ করেন। আর তা হলো, রাসূল (সা.) তাকে হত্যা না করার কারণে তার উত্তম চরিত্রের আরো ব্যাপক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কারণ তিনি নিজের জন্য কোন প্রতিশোধ নেননি। অথচ সে তাকেই হীন চোখে লক্ষ্য করে বলেছে, হে মুহাম্মাদ! আপনি ইনসাফ করুন। আপনি আল্লাহকে ভয় করুন। অপর বর্ণনায় আছে, সে বলেছেন, এই বণ্টনের মাঝে কোন ধরনের ইনসাফ করা হয়নি। একজন রসূলের ব্যাপারে এ জাতীয় কথা সত্যিই অনেক বেদনাদায়ক, যা সহ্য করার মতো নয়। তারপরেও তিনি (সা.) ধৈর্যধারণ করেছেন।
(يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ) অর্থাৎ তারা কুরআন পড়বে। এখানে বুঝানো হয়েছে তারা দীর্ঘ সময় কুরআন তিলাওয়াত করবে। মদ, মাখরাজ, তাজবীদ, তারতীল সবকিছুর প্রতিই তারা খুব বেশি লক্ষ্য রাখবে এবং এই ক্ষেত্রে তারা অতিরঞ্জন করবে।
(لَا يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ) অর্থাৎ তা তাদের কণ্ঠনালীকেও অতিক্রম করবে না। এখানে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের পঠিত বিষয় তাদের কণ্ঠনালীকে অতিক্রম করবে না। কিন্তু এখানে এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাদের ‘আমল উপরে উঠবে না এবং তাদের কুরআন তিলাওয়াত কবুলও হবে না।
কাষী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাদের কুরআন তিলাওয়াত করাটা তাদের জিহ্বাকে অতিক্রম করে হৃদয়ে পৌছবে না এবং সেই তিলাওয়াতে তাদের হৃদয়ের কোন পরিবর্তনও ঘটবে না।
(يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ....) অর্থাৎ তারা দীন থেকে বের হয়ে যাবে যেভাবে ধনুক তীর থেকে বের হয়ে যায়। এর দ্বারা দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে- (১) তারা তীরের গতিতে ইমামের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাবে। (২) তারা তীরের গতিতে মুসলিমদের দল থেকে বের হয়ে যাবে।
তাদের বের হয়ে যাওয়াকে এখানে তীরের সাথে তুলনা করা হয়েছে এটি বুঝানোর জন্য যে, তীর ধনুক থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর ধনুকে যেমন তীরের কোন চিহ্ন থাকে না। ঠিক তাদেরও ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওযার পর তাদের মাঝে ইসলামের কোন চিহ্ন থাকবে না।
(وَيخرجُونَ على حِين فِرْقَةٍ مِنَ النَّاسِ) অর্থাৎ তারা সর্বোত্তম দলের বিরুদ্ধে বের হয়ে পড়বে। মিরকাত প্রণেতা বলেন, এখানে সর্বোত্তম দল বলে বুঝানো হয়েছে ‘আলী (রাঃ) এবং তার সাথীদেরকে।
(إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا...) অর্থাৎ নিশ্চয় এই ব্যক্তির ভিতর থেকে এমন এক সম্প্রদায়... এর ব্যাখ্যায় তুরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, যারা হাদীসের এই অংশ থেকে মনে করেন যে, তার থেকে যারা জন্মগ্রহণ করবে তারাই পরবর্তীতে খাওয়ারিয হবে। তারা আসল বিষয় থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। কারণ নবী (সা.) কর্তৃক তাকে এ কথা বলার সময় থেকে খাওয়ারিযদের প্রথম প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত এটি সম্ভব নয়। কেননা খাওয়ারিযদের প্রথম প্রকাশ ঘটেছিল ‘আলী (রাঃ)-এর শাসন আমলে। অতএব, রাসূল (সা.) কর্তৃক যুল খুওয়াইসারার উদ্দেশে উক্ত কথা বলার সময় থেকে ‘আলী (রাঃ)-এর শাসন ‘আমল পর্যন্ত যে সময়ের ব্যবধান আছে সেই সময়ের মধ্যে শুধু যুল খুওয়াইসারার সন্তানদের সংখ্যা এত বেশি পরিমাণে হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে অনিবার্য কারণেই অন্য ব্যাখ্যা নিতে হবে। আর তা হলো হাদীসে তার ভিতর বলতে বুঝানো হয়েছে, তার মতাদর্শের।
অতএব যারা সর্বপ্রথম ‘আলী (রাঃ)-এর শাসন আমলে খাওয়ারিয হিসেবে বের হয়ে যায় তারা ছিল যুল খুওয়াইসারার মতাদর্শের লোক।
(يَمْرُقُونَ من الإِسلام) অর্থাৎ তারা ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। মিরকাত প্রণেতা বলেন, যারা খাওয়ারিযদের কাফির বলে তারা এ হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে। আর ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া বলতে বুঝায় পরিপূর্ণভাবে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়াকে অথবা ইমামের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়াকে।
ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এখানে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়ার অর্থ হলো ইমামের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়া।
(لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأقتلنهم قتل عَاد) অর্থাৎ যদি আমি তাদেরকে পাই তাহলে অবশ্যই আমি তাদেরকে ‘আদ জাতির মতো হত্যা করব।
মিরকাত প্রণেতা বলেন, তাদেরকে ‘আদ জাতির মতো হত্যা করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ‘আদ জাতিকে যেভাবে প্রবল বায়ু দিয়ে সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে ঠিক রাসূল (সা.) তাদেরকেও সমূলে ধ্বংস করার ইচ্ছা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর এ কথা দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, খাওয়ারিযদের হত্যা করা বৈধ। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৫-[২৮] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সর্বদা আমার মাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করতাম, কেননা তিনি ছিলেন মুশরিকা। এমনি একদিন আমি তাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করলে তিনি আমাকে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর শানে এমন কিছু শুনালেন, যা আমার কাছে বড়ই খারাপ লেগেছে। অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে আসলাম এবং কেঁদে কেঁদে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে দু’আ করুন, তিনি যেন আবূ হুরায়রাহ্-এর মাকে হিদায়াত করেন। তখন তিনি (সা.) এ দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! তুমি আবূ হুরায়রাহ্-এর মাকে হিদায়াত নসীব কর। [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন] নবী (সা.) -এর দু’আ শুনে আমি আনন্দে বের হয়ে (বাড়ির দিকে) ফিরলাম। অতঃপর আমি আমার মায়ের ঘরের দরজায় পৌছে দেখলাম, দরজাটি বন্ধ। আমার মা আমার পায়ের আওয়াজ শুনে বললেন, হে আবূ হুরায়রাহ্! তুমি তোমার স্থানে একটু অপেক্ষা কর। অতঃপর আমি পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। অতএব তিনি গোসল করে জামা-কাপড় পরিধান করলেন এবং তাড়াহুড়া করে ওড়না পরতে পরতে এসে দরজা খুলে দিলেন। অতঃপর বললেন, হে আবূ হুরায়রাহ্! ’আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত ’ইবাদত পাওয়ার যোগ্য কেউ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল। সাথে সাথে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে ফিরে আসলাম এবং খুশিতে আমি কাঁদছিলাম। তখন তিনি (সা.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন এবং কল্যাণকর কথা বললেন। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ كُنْتُ أَدْعُو أُمِّي إِلَى الْإِسْلَامِ وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فَدَعَوْتُهَا يَوْمًا فَأَسْمَعَتْنِي فِي رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا أكره فَأَتَيْتُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا أَبْكِي قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ: ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَهْدِيَ أُمَّ أَبِي هُرَيْرَةَ فَقَالَ: «اللَّهُمَّ اهْدِ أُمَّ أَبِي هُرَيْرَةَ» . فَخَرَجْتُ مُسْتَبْشِرًا بِدَعْوَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا صِرْتُ إِلَى الْبَابِ فَإِذَا هُوَ مُجَافٍ فَسَمِعَتْ أُمِّي خَشْفَ قَدَمَيَّ فَقَالَتْ مَكَانَكَ يَا أَبَا هُرَيْرَة وَسمعت خضخضة المَاء قَالَ فَاغْتَسَلَتْ فَلَبِسَتْ دِرْعَهَا وَعَجِلَتْ عَنْ خِمَارِهَا فَفَتَحَتِ الْبَابَ ثُمَّ قَالَتْ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ فَرَجَعْتُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَنَا أَبْكِي مِنَ الْفَرح فَحَمدَ الله وَأثْنى عَلَيْهِ وَقَالَ خيرا. رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (158 / 2491)، (6396) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (সা.) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) -এর মায়ের জন্য দু'আ করার পর যখন তার মা ইসলাম গ্রহণ করল তখন সে রাসূল (সা.)-এর কাছে আসলো। আসার পর তিনি আবূ হুরায়রাকে ভালো ও কল্যাণের কথা বললেন। আরো বললেন, তোমার মায়ের ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তুমিও কল্যাণ লাভ করেছ। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৬-[২৯] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি তাঁর কোন কোন সমালোচকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা বলে থাক, আবূ হুরায়রাহ নবী (সা.) হতে অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করে থাকে। অথচ আল্লাহর সামনে সকলকে উপস্থিত হতে হবে। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমার মুহাজির ভাইগণ অধিকাংশ সময় বাজারে ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর আমার আনসারী ভাইয়ের বাগানে খামারে লিপ্ত থাকতেন। আর আমি ছিলাম একজন দরিদ্র লোক। তাই আমি পেটে যা জুটে তার উপর তৃপ্ত থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে উপস্থিত থাকতাম। একদিন নবী (সা.) বললেন, আমার এ উক্তি (বিশেষ দুআ) শেষ হওয়া অবধি তোমাদের যে কেউ তার কাপড় (চাদর) প্রসারিত রাখবে এবং আমার কথা শেষ হওয়ার পর তা গুটিয়ে স্বীয় বুকের সাথে জড়িয়ে নেবে, সে আমার কোন উক্তি কখনো ভুলবে না। (আবূ হুরায়রাহ বলেন, এ কথা শুনার পর) আমি আমার চাদরখানা প্রসারিত করে দিলাম, তা ব্যতীত আমার কাছে অন্য কোন কাপড় ছিল না। পরিশেষে নবী (সা.) কথা বলা শেষ করলে আমি তাকে আমার বুকের সাথে চেপে ধরলাম। সেই মহান সত্তার শপথ! যিনি তাঁকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, সে সময় হতে আজ অবধি তাঁর কোন কথা আর আমি ভুলিনি। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعنهُ إِنَّكُمْ تَقُولُونَ أَكْثَرَ أَبُو هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاللَّهُ الْمَوْعِدُ وَإِنَّ إِخْوَتِي مِنَ الْمُهَاجِرِينَ كَانَ يَشْغَلُهُمُ الصَّفِقُ بِالْأَسْوَاقِ وَإِنَّ إِخْوَتِي مِنَ الْأَنْصَارِ كَانَ يَشْغَلُهُمْ عَمَلُ أَمْوَالِهِمْ وَكُنْتُ امْرَأً مِسْكِينًا أَلْزَمُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى مَلْءِ بَطْنِي وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا: «لَنْ يَبْسُطَ أَحَدٌ مِنْكُمْ ثَوْبَهُ حَتَّى أَقْضِيَ مَقَالَتِي هَذِهِ ثُمَّ يَجْمَعَهُ إِلَى صَدْرِهِ فَيَنْسَى مِنْ مَقَالَتِي شَيْئًا أَبَدًا» فَبَسَطْتُ نَمِرَةً لَيْسَ عَلَيَّ ثَوْبٌ غَيْرَهَا حَتَّى قَضَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَالَتَهُ ثُمَّ جَمَعْتُهَا إِلَى صَدْرِي فَوَالَّذِي بَعَثَهُ بِالْحَقِّ مَا نَسِيتُ مِنْ مقَالَته تِلْكَ إِلَى يومي هَذَا. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (2350) و مسلم (160 ، 159 / 2492)، (6397 و 6399) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: লোকেরা আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর ব্যাপারে বলাবলি করত যে, আবূ হুরায়রাহ্ নবী (সা.) থেকে বেশি বেশি বর্ণনা করে। তাই তিনি নিজেই তার বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, (وَاللَّهُ الْمَوْعِدُ) অর্থাৎ আল্লাহর কাছেই রয়েছে তার জন্য নির্ধারিত সময়। মিরকাত প্রণেতা বলেন, আবূ হুরায়রাহ্ -এর এ কথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আমি কম করি বা বেশি করি এ ব্যাপারে কিয়ামতের দিন আল্লাহই আমার থেকে হিসাব নিবেন। বিশেষ করে যদি তা আল্লাহর রসূলের ব্যাপারে হয় তাহলে তো বিষয়টি আরো কঠিন হবে।
তাছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্য হাদীসে বলেন, (مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًأْمَقْعَدَهُ مِنَ انَّارِ) অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার ব্যাপারে বানিয়ে কোন মিথ্যা বলল, সে যেন তার জায়গা জাহান্নাম বানিয়ে নিলো।
এ হাদীসে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) থেকে তিনি বেশি সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। এর কারণ হলো, অন্যান্য মুহাজির সাহাবীরা নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবসা-বাণিজ্য করত আর আনসার সাহাবীরা কৃষিকাজ করত। কিন্তু আমি এসব কোনটিই করতাম না। বরং সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর খিদমাতে পড়ে থাকতাম। আর তিনি (সা.) যখনই কোন হাদীস বলতেন আমি তা শুনে মুখস্থ করে নিতাম। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৭-[৩০] জারীর ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন, তুমি কি আমাকে যুল খলাসাহ্ (ইয়ামানের একটি মন্দির) হতে শান্তি দেবে না? আমি বললাম, হ্যাঁ নিশ্চয়। আর আমার অবস্থা এই ছিল যে, আমি ঘোড়ার পিঠে মজবুতভাবে বসতে পারতাম না। অতএব আমি এ কথাটি নবী (সা.) -এর কাছে উল্লেখ করলাম, তখন তিনি আমার বুকের উপর তার হাত মারলেন। এমনকি তাঁর আঙ্গুলের নিশানগুলো আমি আমার বুকের উপর দেখতে পেলাম। অতঃপর তিনি এই বলে আমার জন্য দু’আ করলেন, হে আল্লাহ তাকে (ঘোড়ার পিঠে) স্থির রাখ এবং তাকে হিদায়াত দানকারী ও হিদায়াত লাভকারী বানিয়ে দাও। এরপর হতে আমি আর কখনো ঘোড়া হতে পড়ে যাইনি। অতঃপর জারীর (কুরায়শ বংশীয়) আহমাস গোত্রের দেড়শত অশ্বারোহী নিয়ে রওয়ানা হলেন এবং যুল খলাসাহ্ গৃহটিকে আগুন দ্বারা পুড়ে ও ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ: قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَلَا تُرِيحُنِي مِنْ ذِي الْخَلَصَةِ؟» فَقُلْتُ: بَلَى وَكُنْتُ لَا أَثْبُتُ عَلَى الْخَيْلِ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَضَرَبَ يَدَهُ عَلَى صَدْرِي حَتَّى رَأَيْتُ أَثَرَ يَدِهِ فِي صَدْرِي وَقَالَ: «اللَّهُمَّ ثَبِّتْهُ وَاجْعَلْهُ هَادِيًا مَهْدِيًّا» . قَالَ فَمَا وَقَعْتُ عَنْ فَرَسِي بَعْدُ فَانْطَلَقَ فِي مِائَةٍ وَخَمْسِينَ فَارِسًا مِنْ أحمس فحرقها بالنَّار وَكسرهَا. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4357) و مسلم (137 ، 136 / 2476)، (6365 و 6366) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে (ذِي الْخَلَصَةِ) (যুল খলাসাহ্) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
যুল খলাসাহ্ ছিল খস'আম নামক এক ব্যক্তির ঘর। যে ঘরকে ইয়ামানের কাবাহ্ বলা হত। আর সেই ঘরে ছিল খলাসাহ্ নামক এক মূর্তি। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৮-[৩১] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.) -এর ওয়াহী লিখত। পরে সে ইসলাম হতে মুরতাদ হয়ে মুশরিকদের সাথে গিয়ে মিশলো। তখন নবী (সা.) বললেন, নিশ্চয় মাটি তাকে গ্রহণ করবে না। বর্ণনাকারী [আনাস (রাঃ) বলেন] আবূ ত্বলহাহ্ (রাঃ) আমাকে বলেছেন, ঐ লোকটি যে স্থানে মরেছে, তিনি সেখানে গিয়ে দেখতে পান, তার (মৃত দেহটি) জমিনের উপর পড়ে রয়েছে। তখন তিনি লোকজনকে প্রশ্ন করলেন, এ লোকটির এ অবস্থা কেন? তারা বলল, আমরা কয়েকবার তাকে দাফন করেছিলাম; কিন্তু জমিন তাকে গ্রহণ করেনি। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: إِنَّ رَجُلًا كَانَ يَكْتُبُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَارْتَدَّ عَنِ الْإِسْلَامِ وَلَحِقَ بِالْمُشْرِكِينَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ الْأَرْضَ لَا تَقْبَلُهُ» . فَأَخْبَرَنِي أَبُو طَلْحَةَ أَنَّهُ أَتَى الْأَرْضَ الَّتِي مَاتَ فِيهَا فَوَجَدَهُ مَنْبُوذًا فَقَالَ: مَا شَأْنُ هَذَا؟ فَقَالُوا: دَفَنَّاهُ مِرَارًا فَلَمْ تَقْبَلْهُ الأَرْض. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3617) و مسلم (14 / 2781)، (7040) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (إِنَّ رَجُلًا كَانَ يَكْتُبُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) অর্থাৎ এক ব্যক্তি নবী (সা.) -এর জন্য লেখালেখি করে দিতো। তারপর সে মুরতাদ হয়ে যায়। উক্ত ব্যক্তির নামের ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মাঝে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তার কোন নাম জানা যায় না।
আবার কেউ কেউ বলেন, তার নাম হলো ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ সারহ। কিন্তু এটি ভুল, কারণ তিনি মুসলিম অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। যদিও তিনি পূর্বে খ্রীষ্টান ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং সূরা আল বাক্বারাহ্ ও আ-লি ইমরান শিখেছেন। যে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায় সে আবার মুশরিকদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। সে আল্লাহর রাসূল (সা.) -এর ব্যাপারে এই অপবাদ দিয়েছিল যে, আমি যা লিখি মুহাম্মাদ শুধু তাই জানে। অন্য কিছু জানতে পারে না। পরে রাসূল (সা.) তার ব্যাপারে বলেন, মাটি তাকে গ্রহণ করবে না।
মিরকাত প্রণেতা বলেন, সে যখন মৃত্যুবরণ করল তখন তার লোকেরা তাকে দাফন করল। কিন্তু পরে দেখা গেল যে, জমিন তাকে উপরে তুলে রেখেছে। তখন তার লোকেরা বলল, এটি মুহাম্মাদ ও তার সাহাবীদের কাজ। তাই তারা আবারো গভীর গর্ত করে তাকে দাফন করল। কিন্তু তারপরেও দেখা গেল যে, জমিন তাকে উপরে তুলে রেখেছে।
অতঃপর তারা বুঝতে পারল যে, এটি কোন মানুষের কাজ নয়। তাই তারা তাকে মাটির উপরেই ফেলে রেখে দিলো। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৯৯-[৩২] আবূ আইয়ুব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন নবী (সা.) সূর্যাস্তের পর বাইরে আসলে একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন তিনি (সা.) বললেন, এটা ইয়াহূদীদের আওয়াজ, তাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن أبي أَيُّوب قا ل: خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَدْ وَجَبَتِ الشَّمْسُ فَسَمِعَ صَوْتًا فَقَالَ: «يَهُودُ تُعَذَّبَ فِي قبورها» . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (1375) و مسلم (69 / 2869)، (7215) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি আওয়াজ শুনলেন। সেটি কিসের আওয়াজ ছিল? তা নিয়ে মিরকাত প্রণেতা বলেন, এটি হতে পারে ‘আযাবের মালাকের (ফেরেশতার) আওয়াজ অথবা শাস্তিপ্রাপ্ত ইয়াহূদীদের আওয়াজ কিংবা ‘আযাব সংঘটিত হওয়ার আওয়াজ।
এ হাদীস থেকে কবরে শাস্তির বিষয়টিও প্রমাণিত হয়। সাথে সাথে আরেকটি বিষয় জানা যায় যে, এটি ছিল রাসূল (সা.) -এর বিশেষ মু'জিযাহ্। কারণ তাঁর কাছে ইয়াহূদীদের কবরের অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। আর সেটি হলো একটি পরজাগতিক বিষয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৯০০-[৩৩] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন নবী (সা.) কোন এক সফর হতে প্রত্যাবর্তন করলেন। তিনি মদীনার কাছাকাছি হতেই এমন প্রবলভাবে ধূলিঝড় প্রবাহিত হলো যে, আরোহীকে পুঁতে ফেলার উপক্রম হলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, কোন এক বড় মুনাফিকের মৃত্যুতেই এ ঝড় প্রবাহিত করা হয়েছে। অতঃপর মদীনার ভিতরে প্রবেশ করে জানতে পারলেন যে, মুনাফিকদের এক বড় নেতার মৃত্যু ঘটেছে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن جَابر قا ل: قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ سَفَرٍ فَلَمَّا كَانَ قُرْبَ الْمَدِينَةِ هَاجَتْ رِيحٌ تَكَادُ أَنْ تَدْفِنَ الرَّاكِبَ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «بُعِثَتْ هَذِهِ الرِّيحُ لِمَوْتِ مُنَافِقٍ» . فَقَدِمَ الْمَدِينَةَ فَإِذَا عَظِيمٌ مِنَ الْمُنَافِقين قد مَاتَ. رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (15 / 2782)، (7041) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: যে মুনাফিক মৃত্যুবরণ করেছিল তার নামের ব্যাপারে যেমন ঐতিহাসিকদের মাঝে মতানৈক্য আছে ঠিক কোন সফর থেকে আল্লাহর নবী (সা.) ফিরছিলেন তা নিয়েও মতানৈক্য আছে। কেউ কেউ বলেন, সেই মুনাফিকের নাম ছিল রিফা'আহ্ ইবনু দুরায়দ। আর সফর ছিল তাবুক যুদ্ধের সফর। আবার কেউ কেউ বলেন, সেই মুনাফিকের নাম ছিল রাফি'। আর সফর ছিল বানূ মুস্তালিক যুদ্ধের। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৯০১-[৩৪] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আমরা নবী (সা.) এর সাথে মক্কাহ হতে মদীনার উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। পরিশেষে আমরা ’উসফান নামক স্থানে পৌছলে তিনি (সা.) এখানে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। তখন লোকেরা (মুনাফিকগণ) বলল, এখানে অনর্থক আমাদের পড়ে থেকে কি লাভ? অথচ আমাদের পরিবার-পরিজন পিছনে রয়েছে। আমরা তাদের ক্ষেত্রে আশঙ্কামুক্ত নই। এ কথাটি নবী (সা.) -এর কাছে পৌছলে তিনি বললেন, সে সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! মদীনার এমন কোন রাস্তা বা গলি নেই, যেখানে তোমাদের প্রত্যাগমন অবধি দু’ দু’জন মালাক (ফেরেশতা) তাকে পাহারা দিচ্ছে না। অতঃপর তিনি (সা.) রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাই আমরা রওয়ানা হয়ে মদীনায় এসে পৌছলাম। সে সত্তার শপথ করে বলছি, যাঁর নামে শপথ করা হয়, আমরা মদীনায় প্রবেশ করে তখনো আমাদের হাওদা খুলে মাল-সামান নামিয়ে রাখিনি, এমন সময় আকস্মাৎ ’আবদুল্লাহ ইবনু গাতফান বংশধরের লোকেরা অতর্কিত আমাদের ওপর আক্রমণ করে বসল। অথচ আমাদের প্রত্যাবর্তনের পূর্বে কিছুই তাদেরকে আক্রমণের জন্য উস্কানি দেয়নি। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى قَدِمْنَا عُسْفَانَ فَأَقَامَ بِهَا لَيَالِيَ فَقَالَ النَّاس: مَا نَحن هَهُنَا فِي شَيْءٍ وَإِنَّ عِيَالَنَا لَخُلُوفٌ مَا نَأْمَنُ عَلَيْهِمْ فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا فِي الْمَدِينَةِ شِعْبٌ وَلَا نَقْبٌ إِلَّا عَلَيْهِ مَلَكَانِ يَحْرُسَانِهَا حَتَّى تَقْدَمُوا إِلَيْهَا» ثُمَّ قَالَ: «ارْتَحِلُوا» فَارْتَحَلْنَا وَأَقْبَلْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ فَوَالَّذِي يُحْلَفُ بِهِ مَا وَضَعْنَا رِحَالَنَا حِينَ دَخَلْنَا الْمَدِينَةَ حَتَّى أَغَارَ عَلَيْنَا بَنُو عَبْدِ اللَّهِ بْنِ غَطَفَانَ وَمَا يُهَيِّجُهُمْ قَبْلَ ذَلِكَ شَيْءٌ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
رواہ مسلم (475 / 1374)، (3336) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ‘উসফান' নামক জায়গাটি মক্কাহ্ থেকে দুই মঞ্জীল (স্টেশন) দূরে অবস্থিত। জনৈক ব্যাখ্যাকারী বলেন, 'উসফান হলো মদীনার নিকটবর্তী একটি জায়গা।
আযহার গ্রন্থের লেখক বলেন, এ পরিচয়টি ভুল। বরং সঠিক কথা হলো তা মক্কাহ্ থেকে দুই স্টেশন দূরে অবস্থিত একটি জায়গা। যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করলেন তখন কিছু মুনাফিক এবং দুর্বল ঈমানের অধিকারী ব্যক্তিরা বলাবলি করতে লাগল যে, আমাদের বাড়ীতে পুরুষবিহীন মহিলারা অবস্থান করছে। তাদের ব্যাপারে আমাদের আশংকা হচ্ছে।
(حِينَ دَخَلْنَا الْمَدِينَةَ حَتَّى أَغَارَ عَلَيْنَا) অর্থাৎ আমরা মদীনায় প্রবেশ করা মাত্রই বানূ ‘আবদুল্লাহ ইবনু গাতফান হামলা করে বসল। মিরকাত প্রণেতা বলেন: এখান থেকে বুঝা যায় যে, মদীনায় পুরুষদের অনুপস্থিতিকালে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) তাদের বাড়ির লোকেদেরকে পাহারা দিয়ে রেখেছিল। অতএব যখন পুরুষেরা মদীনায় পৌছল তখন মালায়িকাহ্ চলে গেলেন। তারপর বানূ ‘আবদুল্লাহ ইবনু গাত্বফান-এর লোকেরা হামলা করল। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৯০২-[৩৫] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী (সা.) -এর সময় একবার লোকেরা দুর্ভিক্ষে কবলিত হলো। এমতাবস্থায় একদিন নবী (সা.) - জুমুআর দিন খুৎবা দিচ্ছিলেন। তখন এক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! (বৃষ্টির অভাবে) ধনসম্পদ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, পরিবার-পরিজন অনাহার থাকছে, তাই আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দু’আ করুন। তখনই তিনি (সা.) (দু’আর জন্য) দু’ হাত উঠালেন, অথচ সে সময় আকাশে কোন মেঘের টুকরা আমরা দেখতে পাইনি। ঐ সত্তার শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণ! তিনি (সা.) এখনও হাত নামাননি হঠাৎ পাহাড়ের মতো মেঘমালা ছুটে আসলো। অতঃপর তিনি (সা.) তখনো মিম্বার হতে নামেননি। আমি দেখতে পেলাম তাঁর দাড়ির উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়া শুরু হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, সেদিন, তার পরের দিন, তার পরবর্তী দিন, এমনকি পরবর্তী জুমু’আহ্ অবধি একনাগাড়ে আমাদের উপর বর্ষণ হতে থাকল। অতঃপর উক্ত বেদুঈন কিংবা অন্য এক লোক দাড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঘরগুলো ভেঙ্গে পড়ছে, ধন-সম্পদসমূহ ডুবে গেছে। অতএব আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দু’আ করুন যেন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি (সা.) হাতদ্বয় উঠিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের ওপর নয়; বরং আমাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বর্ষণ করুন। এই বলে তিনি (সা.) হাত দ্বারা আকাশের যেদিকে ইশারা করলেন সাথে সাথেই সেদিকের মেঘ কেটে গেল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে সমগ্র মদীনাহ্ কুণ্ডলীর মতো একটি মেঘ-শূন্য স্থানে পরিণত হলো। আর উপত্যকার নালাসমূহ একাধারে এক মাস যাবৎ প্রবাহিত থাকল।
বর্ণনাকারী বলেন, তখন যেদিক হতে যে লোকই আসত, সে এ অত্যধিক বৃষ্টি বর্ষণের কথাই আলোচনা করত। অপর এক বর্ণনায় আছে- তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) দু’আ করতে করতে বললেন, হে আল্লাহ! আমাদের ওপর নয়; বরং আমাদের আশপাশে। হে আল্লাহ। টিলার উপরে, পাহাড়ের গায়ে, উপত্যকা এলাকায় এবং বৃক্ষের পাদদেশে বর্ষণ করুন। বর্ণনাকারী বলেন, ফলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা রৌদ্রের মাঝে (মসজিদ হতে) ফিরে গেলাম। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن أنسٍ قَالَ أَصَابَت النَّاس سنَةٌ عَلَى عَهْدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَيْنَا النَّبِيُّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسلم يخْطب فِي يَوْم جُمُعَة قَامَ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ هَلَكَ الْمَالُ وَجَاعَ الْعِيَالُ فَادْعُ اللَّهَ لَنَا فَرَفَعَ يَدَيْهِ وَمَا نَرَى فِي السَّمَاءِ قَزَعَةً فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا وَضَعَهَا حَتَّى ثَارَ السَّحَابُ أَمْثَالَ الْجِبَالِ ثُمَّ لَمْ يَنْزِلْ عَنْ مِنْبَرِهِ حَتَّى رَأَيْت الْمَطَر يتحادر على لحيته صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فمطرنا يَوْمنَا ذَلِك وَمن الْغَد وَبعد الْغَد وَالَّذِي يَلِيهِ حَتَّى الْجُمُعَةِ الْأُخْرَى وَقَامَ ذَلِكَ الْأَعْرَابِيُّ أَوْ قَالَ غَيْرُهُ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَهَدَّمَ الْبِنَاءُ وَغَرِقَ الْمَالُ فَادْعُ اللَّهَ لَنَا فَرَفَعَ يَدَيْهِ فَقَالَ اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا فَمَا يُشِيرُ بِيَدِهِ إِلَى نَاحِيَةٍ مِنَ السَّحَابِ إِلَّا انْفَرَجَتْ وَصَارَتِ الْمَدِينَةُ مِثْلَ الْجَوْبَةِ وَسَالَ الْوَادِي قَنَاةُ شَهْرًا وَلَمْ يَجِئْ أَحَدٌ مِنْ نَاحِيَةٍ إِلَّا حَدَّثَ بِالْجَوْدِ وَفِي رِوَايَةٍ قَالَ: «اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا اللَّهُمَّ عَلَى الْآكَامِ وَالظِّرَابِ وَبُطُونِ الْأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ» . قَالَ: فَأَقْلَعَتْ وَخَرَجْنَا نَمْشِي فِي الشّمسِ مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (933) و مسلم (8 ، 9 / 897)، (2078) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে উল্লেখিত (اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلَا عَلَيْنَا) অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের আশেপাশে বর্ষণ করুন। আমাদের ওপর আর বর্ষণ করবেন না।
ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) এর ব্যাখ্যায় বলেন যে, এ কথার অর্থ হলো। হে আল্লাহ! আপনি উদ্ভিদ উৎপন্ন হওয়ার জায়গায় বৃষ্টি বর্ষণ করুন। ঘর-বাড়ির উপর বর্ষণ করবেন না।
ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর অর্থ হলো, আপনি কৃষি জমিতে বর্ষণ করুন। ঘর-বাড়ির উপর বর্ষণ করবেন না।
(وَسَالَ الْوَادِي قَنَاةُ شَهْرًا) অর্থাৎ কনাহ্ উপত্যকায় দিয়ে একমাসের মতো বর্ষণ প্রবাহিত হলো। এখানে উল্লেখিত শব্দ (قَنَاةُ) এর পরিচয় নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। যেমন- কিরমানী বলেন, (قَنَاةُ) একটি জায়গার নাম।
কেউ কেউ বলেন, এটি হলো সেই উপত্যকার নাম যেখানে হামযাহ্ (রাঃ)-এর কবর রয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন, এটি হলো বর্শা পরিমাণ উঁচু একটি উপত্যকার নাম।
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, যদি বৃষ্টি এতই বেশি হয় যে, তার কারণে মানুষদের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তাহলে সেই বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ করা মুস্তাহাব। কিন্তু সেজন্য খোলা মাঠে সমবেত হয়ে একসাথে সালাত আদায় করা এবং দু'আ করা শারী'আতসম্মত নয়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)