৩৫৩৯

পরিচ্ছেদঃ ৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুরতাদ এবং গোলযোগ সৃষ্টিকারীকে হত্যা করা প্রসঙ্গে

৩৫৩৯-[৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ’উকল সম্প্রদায়ের কিছু লোক উপস্থিত হলো। অতঃপর তারা ইসলাম গ্রহণ করল। কিন্তু মদীনার আবহাওয়া তাদের জন্য অনুপযোগী হলো। অতএব তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে সাদাকার উটনীর নিকট গিয়ে তার দুধ ও প্রস্রাব পানের নির্দেশ দিলেন। ফলে তারা নির্দেশ পালনার্থে সুস্থ হয়ে উঠল। কিন্তু তারা সুস্থ হয়ে মুরতাদ হয়ে গেল এবং তারা রাখালদেরকে হত্যা করে উটগুলো হাঁকিয়ে নিল। তিনি (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ সংবাদ শুনে) তাদের পেছনে লোক পাঠালেন। অতঃপর তাদেরকে ধরে আনা হলে তাদের দু’ হাত ও দু’ পা কেটে ফেললেন এবং তাদের চোখ ফুঁড়ে দিলেন, তারপর তাদের রক্তক্ষরণস্থলে দাগালেন না, যাতে তারা মৃত্যুবরণ করে।

অপর বর্ণনাতে রয়েছে, লোকেরা তাদের চোখে লৌহ শলাকা দিয়ে মুছে দিল। অন্য বর্ণনাতে আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) লৌহ শলাকা আনার হুকুম করলেন, যাকে গরম করা হলো এবং তাদের চোখের উপর মুছে দেয়া হলো। অতঃপর তাদেরকে উত্তপ্ত মাটিতে ফেলে রাখলেন। তারা পানি চাইল কিন্তু তাদেরকে পানি পান করানো হয়নি। পরিশেষে তারা এ করুণ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ قَتْلِ أَهْلِ الرِّدَّةِ وَالسُّعَاةِ بِالْفَسَادِ

وَعَن أَنَسٍ قَالَ: قَدِمَ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَفَرٌ مِنْ عُكْلٍ فَأَسْلَمُوا فَاجْتَوَوُا الْمَدِينَةَ فَأَمَرَهُمْ أَنْ يَأْتُوا إِبِلَ الصَّدَقَةِ فَيَشْرَبُوا مِنْ أَبْوَالِهَا وَأَلْبَانِهَا فَفَعَلُوا فَصَحُّوا فَارْتَدُّوا وَقَتَلُوا رُعَاتَهَا وَاسْتَاقُوا الْإِبِلَ فَبَعَثَ فِي آثَارِهِمْ فَأُتِيَ بِهِمْ فَقَطَعَ أَيْدِيَهُمْ وَأَرْجُلَهُمْ وَسَمَلَ أَعْيُنَهُمْ ثُمَّ لَمْ يَحْسِمْهُمْ حَتَّى مَاتُوا . وَفِي رِوَايَةٍ: فَسَمَّرُوا أَعْيُنَهُمْ وَفِي رِوَايَةٍ: أَمَرَ بِمَسَامِيرَ فَأُحْمِيَتْ فَكَحَّلَهُمْ بِهَا وَطَرَحَهُمْ بِالْحَرَّةِ يَسْتَسْقُونَ فَمَا يُسْقَوْنَ حَتَّى مَاتُوا

ব্যাখ্যা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ‘উক্ল ও ‘উরায়নাহ্ গোত্রের লোকজন আগমন করলো, অতঃপর ইসলাম গ্রহণ করলো। কোনো বর্ণনায় ‘উক্ল এবং ‘উরায়নাহ্ উভয়টি উল্লেখ আছে। আবার কোনো বর্ণনায় শুধু ‘উক্ল আছে এবং কোনো বর্ণনায় শুধু ‘উরায়নাহ্ উল্লেখ আছে। যেই বর্ণনায় ‘উক্ল ও ‘উরায়নাহ্ উভয়টি অছে সেটি সর্বাধিক সঠিক।

আবূ আওয়ানাহ্ ও ত্ববারানী বর্ণনা করেন যে, তাদের চারজন ছিল ‘উরায়নাহ্ গোত্রের এবং তিনজন ছিল ‘উক্ল গোত্রের। তারা মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে তথাকার বাতাস ও পানিকে পছন্দসই মনে করলো না। অন্য বর্ণনায় আছে, তারা মদীনার আবহাওয়াকে অস্বাস্থ্যকর মনে করলো। ফলে রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাদের পেট ফুলে যায়। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১ম খন্ড, হাঃ ৭২)

তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এই অভিযোগ করলে তিনি দুগ্ধবতী সাদাকার উটের কাছে যেতে বললেন। সহীহ মুসলিম ব্যতীত অন্য বর্ণনায় রসূলের উটের কথা উল্লেখ আছে। উভয় বর্ণনাই সহীহ।

কেউ কেউ সমন্বয়ের ক্ষেত্রে দু‘টি সমাধানের পথ বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি উট ছিল যাকে এবং সাদাকার উটকে একই দিকে চরানো হতো। তাই এতদুভয়ের প্রত্যেকটিকে অন্যটির উপর বুঝানো হতো।

কেউ কেউ বলেনঃ বরং প্রত্যেকটি উটই সাদাকার উট। এখানে সম্বন্ধটি হচ্ছে অধীনতার সম্বন্ধ। কারণ তা মালিকের অধিনস্থ থাকে।

ইমাম মালিক, আহমাদ এবং সালাফীদের একটি দল গোশ্ত/গোশত ভক্ষণযোগ্য প্রাণীর মূত্র পবিত্র হওয়ার দলীল হিসেবে এই হাদীসকে পেশ করেন। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফাহ্, শাফি‘ঈ ও আর একটি দল গোশত ভক্ষণযোগ্য হোক না হোক সব প্রাণীর মূত্র অপবিত্র বলে মত পোষণ করেন। তারা এর প্রমাণ স্বরূপ আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত «اسْتَنْزِهُوا مِنَ الْبَوْلِ فَإِنَّ عَامَّةَ عَذَابِ الْقَبْرِ مِنْهُ» হাদীসকে এবং বুখারী ও মুসলিমে ইবনু ‘আব্বাস থেকে বর্ণিত, مَرَّ النَّبِيُّ ﷺ بِقَبْرَيْنِ فَقَالَ إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنَ الْبَوْل ও আবূ ইয়া‘লা থেকে বর্ণিত «إِنَّ اللّٰهَ لَمْ يَجْعَلْ شِفَاءَ أُمَّتِي فِيمَا حُرِّمَ عَلَيْهَا» হাদীসকে পেশ করেন। বর্ণিত উল্লেখিত হাদীসের উত্তরে তুহফাতুল আহওয়াযী-এর লেখক বলেন- হাদীসে الْبَوْل থেকে উদ্দেশ্য হলো মানুষের পেশাব। কেননা সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে- «كَانَ لَا يَسْتَتِرُ مِنَ بَوْلِه»তিনি শুধু মানুষের পেশাবকে উল্লেখ করেছেন। তাহলে বুঝা গেল, الْبَوْل এর الْ হচ্ছে عهد خارجى। সুতরাং এর «لَا يَسْتَتِرُ مِنَ بَوْل» অর্থ হলো মানুষের পেশাব। সব প্রাণীর পেশাব উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং যারা এটাকে ‘আম্ গণ্য করছে এই হাদীসে তাদের কোনো প্রমাণ নেই।

আর আবূ ইয়া‘লা-এর হাদীসের উত্তরে বলেনঃ এ হাদীসটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছামূলক অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। জরুরী অবস্থার ক্ষেত্রে নয়। সুতরাং বাধ্যগত অবস্থায় এটা হারাম নয়। যেমন মৃত প্রাণীর গোশত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন- قَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ ‘‘তোমাদের জন্য যা হারাম করা হয়েছে তা তোমাদের জন্য বিশদভাবে বাতলে দেয়া হয়েছে।’’ (সূরা আল আন্‘আম ৬ : ১১৯)

আরো হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- «لَا بَأْسَ بِبَوْلِ مَا يُؤْكَلُ لَحْمُه» ‘‘গোশ্ত/গোশত ভক্ষণযোগ্য প্রাণীর মূত্র দোষের কিছু নয়’’ ও জাবির-এর হাদীস «مَا أُكِلَ لَحْمُهُ فَلَا بَأْسَ بِبَوْلِه» ‘‘গোশ্ত/গোশত ভক্ষণযোগ্য প্রাণীর মূত্র দোষের কিছু নয়’’ তবে ত্ববারানী-এর এই হাদীস দু’টি য‘ঈফ। এছাড়া বকরীর আস্থাবলে সালাত আদায় করার অনুমতি হাদীসে রয়েছে। আর পেশাব যদি পবিত্র না হতো তবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্বারা চিকিৎসা নিতে বলতেন না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ১ম খন্ড, হাঃ ৭২)

কাযী ‘ইয়ায আপত্তি করে বলেনঃ মুসলিমরা ঐকমত্য করেছেন যে, যার হত্যা ওয়াজিব সে পানি চাইলে তা নিষেধ করা যাবে না। কারণ এতে শাস্তি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এর উত্তরে তিনি বলেন, আমাদের সাথীগণ বলেন- যার নিকটে পবিত্রতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি থাকে তার জন্য তৃষ্ণার কারণে মৃত্যুর ভয়ে মুরতাদ কে পানি পান করানো এবং তায়াম্মুম করা জায়িয নয়। তবে তিরস্কৃত অথবা চতুষ্পদ প্রাণীকে পানি পান করানো ওয়াজিব।

ইমাম নববী বলেনঃ যদি মুরতাদ পিপাসায় মরে যায় তবুও সে তায়াম্মুম না করে পানি ব্যবহার করবে।

খত্ত্বাবী বলেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাথে এরূপ আচরণ করেছিলেন এজন্য যে, তিনি এর দ্বারা মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন।

কেউ বলেন, তাদেরকে পিপাসায় কাতর করার রহস্য হলো তারা উটের দুধ পানের নি‘আমাতকে অস্বীকার করেছিল। যা তাদেরকে ক্ষুধামন্দা ও অস্বাস্থ্যকর থেকে রোগ মুক্তি দান করে। এর আর একটি কারণ ছিল যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিবারকে পিপাসার্ত করেছিল তাদের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদ্দু‘আ করেছিলেন। সেই ঘটনা নাসায়ীতে বর্ণিত আছে। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে, তারা যে রাত্রের স্বাভাবিক অভ্যাস অনুযায়ী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উটের দুধ পাঠানোর নিয়ম চালু করেছিল যেটাকে তারা সেই রাত্রিতে বন্ধ করে দিয়েছিল। যেমন ইবনুল সা‘দ উল্লেখ করেন যা হাফিয ফাতহুল ওয়াদূদে উল্লেখ করেন।

অথবা বলা হয় কিসাস স্বরূপ তাদের সাথে এরূপ আচরণ করা হয়েছিল। কারণ তারা এরূপ আচরণ রাখালদের সাথে করেছিল। অথবা তাদের মারাত্মক অপরাধ করার কারণে তারা ঐ শাস্তির শিকার হয়েছিল যা আবূ কাতাদাহ-এর বক্তব্যের ইঙ্গিতে বুঝা যায়। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪৩৫৬)