পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বংশগৌরব ও পক্ষপাতিত্ব

الْمُفَاخَرَةِ শব্দটি বাবে مفاعلة এর মাসদার। মূল অক্ষর فخر অর্থ গর্ব করা, গৌরব করা। এটা দু’ প্রকার : ১. নিন্দনীয়। যেমন- প্রতারণার উদ্দেশে বা পার্থিব কোন ব্যক্তির স্বার্থ চরিতার্থের জন্য মিথ্যা বংশ গৌরব করা। এটা অবৈধ। ২. প্রশংসনীয়। যেমন, কাফির মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের সময় বীরত্ব প্রকাশের উদ্দেশে গৌরবের কথা প্রকাশ করা। এটা জায়িয। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ ’’তুমি তোমার রবের নি’আমাতের কথা বর্ণনা কর।’’ (সূরাহ্ আয্ যুহা- ৯৩ : ১১)

নিন্দনীয় গর্ব করা থেকে সাবধান করতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ أَذْهَبَ عَنْكُمْ عُبِّيَّةَ الْجَاهِلِيَّةِ، وَفَخْرَهَا بِالْآبَاءِ مُؤْمِنٌ تَقِيٌّ، وَفَاجِرٌ شَقِيٌّ، أَنْتُمْ بَنُو آدَمَ وَآدَمُ مِنْ تُرَابٍ، لَيَدَعَنَّ رِجَالٌ فَخْرَهُمْ بِأَقْوَامٍ، إِنَّمَا هُمْ فَحْمٌ مِنْ فَحْمِ جَهَنَّمَ، أَوْ لَيَكُونُنَّ أَهْوَنَ عَلَى اللهِ مِنَ الْجِعْلَانِ الَّتِي تَدْفَعُ بِأَنْفِهَا النَّتِنَ

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মহান আল্লাহ তোমাদের জাহিলী যুগের মিথ্যা অহংকার ও পূর্বপুরুষদেরকে নিয়ে গর্ব করার প্রথাকে বিলুপ্ত করেছেন। মু’মিন হলো আল্লাহভীরু আর পাপী হলো দুর্ভাগা। তোমরা সকলে আদম সন্তান আর আদম (আ.) মাটির তৈরি। লোকেদের উচিত বিশেষ গোত্রেরভুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে অহংকার না করা। এখন তো তারা জাহান্নামের কয়লায় পরিণত হয়েছে। অন্যথায় তোমরা মহান আল্লাহর নিকট ময়লার সেই কীটের চেয়ে জঘন্য হবে যে তার নাক দিয়ে ময়লা ঠেলে নিয়ে যায়। (আবূ দাঊদ ৫১১৬, তিরমিযী ৪২৩৩ : হাসান)

মির্’আতুল মাফাতীহ-এর মধ্যে ’আল্লামা মুবারকপূরী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ বংশীয় বা গোত্রীয় অহংকার বলা হয়, বাপ দাদার অথবা বংশের নাম উল্লেখ করে গর্ব করাকে। এ কাজ অন্যকে ছোট করে নিজের মর্তবাকে উঁচু করে তোলার জন্য করা হয়। সেজন্য এ কাজ জায়িয নেই। অন্যের গোত্রকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এ কাজে অন্যকে ছোট করা হয় বা লজ্জায় ফেলা হয়।

আর العصبية শব্দের অর্থ হলো-স্বজনপ্রীতি বা পক্ষপাতিত্ব করা। পরিভাষায় রক্তের বন্ধনে আবদ্ধতার অনুভূতি এবং সেই অনুভূতির কারণে অন্যের প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করাকে العصبية বলা হয়। আধুনিক পরিভাষায় একে গোত্রবাদ বা সাম্প্রদায়িকতাও বলা যেতে পারে। এটি একটি জাহিলী প্রথা। এ ব্যাপারে হাদীসে রয়েছে, আল হাবিস আল আশ্’আরী হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

وَمَنْ ادَّعٰى دَعْوَى الجَاهِلِيَّةِ فَإِنَّهٗ مِنْ جُثَا جَهَنَّمَ، فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللهِ وَإِنْ صَلّٰى وَصَامَ؟ قَالَ: وَإِنْ صَلّٰى وَصَامَ، فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِي سَمَّاكُمُ المُسْلِمِينَ المُؤْمِنِينَ، عِبَادَ اللهِ

আর যে লোক জাহিলিয়্যাতের ’আমলের রীতি-নীতির দিকে আহবান করে সে জাহান্নামীদের দলভুক্ত। জনৈক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে সালাত আদায় করলেও, সিয়াম পালন করলেও? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ। সে সালাত আদায় করলেও, সিয়াম পালন করলেও। সুতরাং তোমরা সেই আল্লাহ তা’আলার ডাকেই নিজেদেরকে ডাকবে যিনি তোমাদেরকে মুসলিম, মু’মিন ও আল্লাহ তা’আলার বান্দা নাম রেখেছেন।

(তিরমিযী ২৮৬৩, মিশকাত ৩৬৯৪)

অন্য হাদীসে এসেছে-

عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: اقْتَتَلَ غُلَامَانِ غُلَامٌ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ، وَغُلَامٌ مِنَ الْأَنْصَارِ، فَنَادَى الْمُهَاجِرُ أَوِ الْمُهَاجِرُونَ، يَا لَلْمُهَاجِرِينَ وَنَادَى الْأَنْصَارِيُّ يَا لَلْأَنْصَارِ، فَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: مَا هٰذَا دَعْوٰى أَهْلِ الْجَاهِلِيَّةِ.

জাবির হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আনসার ও মুহাজিরদের দু’জন বালক মারামারি করলে মুহাজিরগণ তাদের মুহাজির ভাইদের এবং আনসারগণ তাদের আনসার ভাইদের ডাকলেন। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হয়ে এসে বললেন, এটা কি জাহিলী যুগের সেই (মারামারির) ডাকার মতো? (মুসলিম ৬২-[২৫৮৪]) [সম্পাদক]



৪৮৯৩-[১] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কে সবচেয়ে সম্মানিত? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ আল্লাহ তা’আলার নিকট সবচেয়ে সম্মানিত সে ব্যক্তি, যে সবচেয়ে আল্লাহভীরু। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)জিজ্ঞেস করলেনঃ আমরা এ দৃষ্টিকোণ থেকে জিজ্ঞেস করিনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ সকল মানুষের মধ্যে সম্মানিত ব্যক্তি ইউসুফ (আ.), যিনি আল্লাহর নবী এবং আল্লাহর নবীর পুত্র এবং আল্লাহর নবীর পৌত্র এবং আল্লাহর বন্ধু ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রপৌত্র ছিলেন। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)বললেনঃ আমরা এ দৃষ্টিকোণ থেকেও জিজ্ঞেস করিনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ ’আরবদের বংশ ও গোত্র সম্পর্কে কি জিজ্ঞেস করছ? সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)বললেনঃ জ্বী হ্যাঁ। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অন্ধকার যুগে ভালো ছিল, সে ইসলামী যুগেও ভালো, যখন সে দীন ইসলামের সম্যক অবহিত। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ الْمُفَاخَرَةِ وَالْعَصَبِيَّةِ

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَي النَّاس أكْرم؟ فَقَالَ: «أَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاهُمْ» . قَالُوا: لَيْسَ عَنْ هَذَا نَسْأَلُكَ. قَالَ: «فَأَكْرَمُ النَّاسِ يُوسُفُ نَبِيُّ اللَّهِ ابْنُ نَبِيِّ اللَّهِ ابْنِ خَلِيلِ اللَّهِ» . قَالُوا: لَيْسَ عَن هَذَا نَسْأَلك. قَالَ: «فَمِمَّنْ مَعَادِنِ الْعَرَبِ تَسْأَلُونِي؟» قَالُوا: نَعَمْ. قَالَ: فَخِيَارُكُمْ فِي الْجَاهِلِيَّةِ خِيَارُكُمْ فِي الْإِسْلَامِ إِذَا فَقُهُوا . مُتَّفق عَلَيْهِ

عن ابي هريرة قال سىل رسول الله صلى الله عليه وسلم اي الناس اكرم فقال اكرمهم عند الله اتقاهم قالوا ليس عن هذا نسالك قال فاكرم الناس يوسف نبي الله ابن نبي الله ابن خليل الله قالوا ليس عن هذا نسالك قال فممن معادن العرب تسالوني قالوا نعم قال فخياركم في الجاهلية خياركم في الاسلام اذا فقهوا متفق عليه

ব্যাখ্যাঃ (أَي النَّاس أكْرم؟) মানুষের মধ্যে কোন্ মানুষ বেশি মর্যাদার ও সম্মানের অধিকারী? ‘আল্লামা ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এ বাক্যটি দ্বারা বংশের দিকে লক্ষ্য না করে সাধারণভাবে কোন্ মানুষ আল্লাহর নিকট সম্মানের অধিকারী তা বুঝার সম্ভাবনা আছে। একজন কালো-কুৎসিত দাসও আল্লাহর নিকট সম্মানের অধিকারী হতে পারে। আবার বংশ মর্যাদাও বুঝাতে পারে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

(أَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاهُمْ) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উত্তর প্রদান করেন মহান আল্লাহর বাণী থেকেই। তা হলো :

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثٰى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ

‘‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে এক নারী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদের পরিচিতির জন্য বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মার্যাদাবান যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন।’’ (সূরাহ্ আল হুজুরাত ৪৯ : ১৩)

এখানে গোত্র ও জাতিকে মহান আল্লাহ শুধুমাত্র পরিচিতির মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করলেন। আর মর্যাদা তাকওয়া ব্যতীত হবে না। কারণ শেষ পরিণাম মুত্তাক্বীদের জন্যই। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

(إِذَا فَقُهُوا) অর্থাৎ যখন কোন ব্যক্তি শারী‘আতের আদব ও ইসলামের বিধি-বিধান আয়ত্ব করে পালন করবে, দীনে প্রবেশ করার পরে। তথা দীন শিখে তা পালন করবে। এ বাক্যটি দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন মুনাফিক ও যাদের অন্তর আকৃষ্ট হয়ে আছে।

ইসলামে (المؤلفة قلوبهم) তাদেরকে বাদ দিয়েছেন। তথা বংশ-মর্যাদার কারণে ইসলামে কেউ মর্যাদাশীল বলে গণ্য হয় না, বরং তাকে ইসলামে প্রবেশ করে জ্ঞান অর্জন করে মর্যাদা অর্জন করতে হয়। যে যত জ্ঞানী হতে পারবে তার মর্যাদা তত বেশি হবে। আর যে জ্ঞান অর্জন করতে পারবে না, তার মর্যাদা কমে যাবে, তথা স্তর নিচে নেমে যাবে। আর এই ‘ইলম ‘আমলের সাথে সম্পর্কিত তথা ‘ইলম অনুযায়ী ‘আমল করতে হবে। যার মূল কথা হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ বলেন, فَلَا تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقٰى ‘‘কে তাকওয়া অবলম্বন করে তা তিনি ভালোভাবেই জানেন’’- (সূরাহ্ আন্ নাজ্ম ৫৩ : ৩২)। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)

পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বংশগৌরব ও পক্ষপাতিত্ব

৪৮৯৪-[২] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সম্মানিত ব্যক্তি সম্মানিত ব্যক্তির পুত্র, সম্মানিত ব্যক্তির পৌত্র এবং সম্মানিত ব্যক্তির প্রপৌত্র হলেন ইবরাহীম (আ.)-এর প্রপৌত্র, ইসহক (আ.)-এর পৌত্র ও ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র ইউসুফ (আ.)। (বুখারী)[1]

بَابُ الْمُفَاخَرَةِ وَالْعَصَبِيَّةِ

وَعَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْكَرِيمُ ابْنُ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ ابْنِ الْكَرِيمِ يُوسُفُ بْنُ يَعْقُوبَ بنِ إِسحاقَ بن إِبراهيمَ» . رَوَاهُ البُخَارِيّ

وعن ابن عمر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الكريم ابن الكريم ابن الكريم ابن الكريم يوسف بن يعقوب بن اسحاق بن ابراهيم رواه البخاري

ব্যাখ্যাঃ ইউসুফ (আ.)-এর সম্মানের কারণ : ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, সম্মানিত হওয়ার মূল হলো অনেক কল্যানের মালিক হওয়া। আর নুবুওয়াতের পাশাপাশি ইউসুফ (আ.)-এর মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ গুণ একত্রিত হয়েছিল। যেমন- সচ্চরিত্র, ভদ্রচিত আচরণ, জ্ঞান, সৌন্দর্য, মর্যাদাসম্পন্ন পিতৃকুল, পরিশেষে বংশ পরম্পরায় চারজন নবীর মধ্যে চতুর্থ নবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল নবী যেমনটি সূরাহ্ ইউসুফ-এর ৮০ নং আয়াত থেকে জানা যায়। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৮ম খন্ড, হাঃ ৩১১৬)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)

পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বংশগৌরব ও পক্ষপাতিত্ব

৪৮৯৫-[৩] বারা’ ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়নের যুদ্ধের দিন আবূ সুফ্ইয়ান ইবনু হারিস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খচ্চরে লাগাম ধরে রেখেছিলেন। যখন মুশরিকরা তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলল, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খচ্চরের পৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন এবং বলতে লাগলেন, ’’আমি নবী, না মিথ্যার কোন সূত্র- আমি যে ’আবদুল মুত্ত্বালিব-এর পুত্র।’’ রাবী বলেন, সেদিন তাঁর চেয়ে অধিক বিক্রমপূর্ণ আর কাউকেও দেখা যায়নি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ الْمُفَاخَرَةِ وَالْعَصَبِيَّةِ

وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ قَالَ: فِي يَوْمِ حُنَيْنٍ كَانَ أَبُو سُفْيَانَ بْنُ الْحَارِثِ آخِذًا بِعِنَانِ بَغْلَتِهِ يَعْنِي بَغْلَةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمَّا غَشِيَهُ الْمُشْرِكُونَ نَزَلَ فَجَعَلَ يَقُولُ «أَنَا النَّبِيُّ لَا كَذِبَ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ»
قَالَ: فَمَا رُئِيَ مِنَ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ أَشَدُّ مِنْهُ. مُتَّفق عَلَيْهِ

وعن البراء بن عازب قال في يوم حنين كان ابو سفيان بن الحارث اخذا بعنان بغلته يعني بغلة رسول الله صلى الله عليه وسلم فلما غشيه المشركون نزل فجعل يقول انا النبي لا كذب انا ابن عبد المطلبقال فما رىي من الناس يومىذ اشد منه متفق عليه

ব্যাখ্যাঃ

হুনায়ন যুদ্ধ : হুনায়ন যুদ্ধ ৮ম হিজরীর শাও্ওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। হাওয়াযিন ও সাক্বীফ গোত্রের আত্মগর্বী নেতারা মক্কা হতে ‘আরাফাতের দিকে ১০ মাইলের কিছু বেশি দক্ষিণ-পূর্বে হুনায়ন উপত্যকায় মালিক ইবনু ‘আওফ-এর নেতৃত্বে ৪০০০ দুর্ধর্ষ সেনার সমাবেশ ঘটায়। ফলে মক্কা বিজয়ের ১৯তম দিনে ৬ই শাও্ওয়াল শনিবার আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার ২০০০ নওমুসলিমসহ মোট ১২,০০০ সাথী নিয়ে হুনায়ন উদ্দেশে রওয়ানা হন এবং ১০ই শাও্ওয়াল বুধবার রাতে গিয়ে উপস্থিত হন।

(আর্ রাহীক ৪১৩-১৪ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২/৪৩৭, যাদুল মা‘আদ ৩/৪০৮-১৮ পৃঃ, সীরাতুর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৫৫পৃঃ)

হুনায়ন যুদ্ধে মুসলিম পক্ষ শাহীদের সংখ্যা ছিল ৪ জন এবং কাফির পক্ষ নিহতের সংখ্যা ছিল ৭২ জন- (সীরাহ্ সহীহাহ্ ২/৫০৩-০৪)। মানসূরপুরী কাফির পক্ষ ৭১ জন নিহত ও মুসলিম পক্ষ ৬ জন শহীদ বলেছেন- (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/২০১)। হুনায়ন যুদ্ধে বিপুল গনীমাত লাভ হয়। বন্দী : ৬০০০ (নারী-শিশুসহ)। উট : ২৪,০০০। দুম্বা-বকরী : ৪০,০০০-এর অধিক। রৌপ্য : ৪০০০ উক্বিয়া। এতদ্ব্যতীত ঘোড়া, গরু, গাধা ইত্যাদির কোন হিসাব পাওয়া যায়নি। (ইবনু সা‘দ ২/১১৬ পৃঃ, সীরাতুর্ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৬৪ পৃঃ)

এ যুদ্ধে বিজয় সম্পর্কে আল্লাহ বলেনঃ ‘‘আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন অনেক স্থানে, বিশেষ করে হুনায়নের দিন। যখন তোমাদের সংখ্যাধিক্য তোমাদের গর্বিত করেছিল। কিন্তু তা তোমাদের কোনই কাজে আসেনি। বরং প্রশস্ত জমিন তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তোমরা পিঠ ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে। আল্লাহ স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করেন তার রসূল ও মু’মিনদের ওপর এবং নাযিল করেন এমন সেনাদল, যাদের তোমরা দেখেননি এবং কাফিরদের তিনি শাস্তি প্রদান করেন। আর এটি ছিল তাদের কর্মফল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, তাওবার তাওফীক দেন। বস্তুত আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’’(সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯ : ২৫-২৭)

(أَنَا النَّبِىُّ لَا كَذِبَ أَنَا ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ) যদি প্রশ্ন করা হয় : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে বললেন, আমি ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর ছেলে? তিনি নিজের পিতার নাম না বলে নিজের বংশের দিকে সম্পর্কিত করলেন যেটা জাহিলী যুগের অধিকাংশ মানুষের গর্বের প্রতি ইঙ্গিত করে? এর উত্তর হল- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দাদার নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। কারণ তার পিতা ‘আবদুল্লাহ যুবক বয়সেই মারা যান। সে কারণে তিনি বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন না। পক্ষান্তরে ‘আবদুল মুত্ত্বালিব মক্কাবাসীর নেতা হওয়ার কারণে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিলেন। সকলের নিকট তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। বহু মানুষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তার দাদার সাথে যুক্ত করে ডাকত। আর তারা এ কাজ করত দাদার প্রসিদ্ধতার কারণে। যেমন হুমাম ইবনু সা‘লাবাহ্-এর বর্ণিত হাদীসে আছে, أيكم ابْنُ عَبْدِ الْمُطَّلِبْ؟ তোমাদের মধ্যে ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর ছেলে কে? ‘আরবদের নিকট এটা প্রসিদ্ধ ছিল যে, ‘আবদুল মুত্ত্বালিব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন যে, অচিরেই তার মান-মর্যাদা বিরাট হবে। এও কথিত আছে যে, ‘আবদুল মুত্ত্বালিব রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর এটা ‘আরবদের নিকট সুপ্রসিদ্ধ ছিল। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখিত কথাটি বলে তাদেরকে সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার ইচ্ছা করলেন যে, আমিই সেই সত্য নবী। আমিই সেই ‘আবদুল মুত্ত্বালিব-এর স্বপ্নের সুসংবাদপ্রাপ্ত সত্য নবী, এতে মিথ্যার কিছু নেই। (শারহুন নাবাবী ১২শ খন্ড, হাঃ ৭৮-[১৭৭৬])


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)

পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বংশগৌরব ও পক্ষপাতিত্ব

৪৮৯৬-[৪] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হে সৃষ্টির সেরা! রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ সৃষ্টির সেরা ব্যক্তি ছিলেন ইবরাহীম (আ.)। (মুসলিম)[1]

بَابُ الْمُفَاخَرَةِ وَالْعَصَبِيَّةِ

وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا خَيْرَ الْبَرِيَّةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «ذَاكَ إِبْرَاهِيم» . رَوَاهُ مُسلم

وعن انس قال جاء رجل الى النبي صلى الله عليه وسلم فقال يا خير البرية فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم ذاك ابراهيم رواه مسلم

ব্যাখ্যাঃ ইবরাহীম (আ.)-কে (خَيْرَ الْبَرِيَّةِ) বলার কারণ : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম (আ.)-কে সৃষ্টির সেরা বলে আখ্যায়িত করার কারণ কি? এ বিষয়ে ‘উলামাগণ বলেনঃ

১. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় বিনয় ও শিষ্টাচার প্রদর্শনার্থে এরূপ বলেছেন। মহান ব্যক্তিবর্গ অন্য কোন মহান ব্যক্তির উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করে থাকেন। এতদ্ব্যতীত ইবরাহীম (আ.) ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদি পিতা ও ঊর্ধ্বতন পুরুষ। অতএব, পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে এরূপ বলা হয়েছে।

২. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ উক্তির মর্মার্থ এটাও হতে পারে যে, ইব্রাহীম (আ.) সমসাময়িক যুগের (خَيْرَ الْبَرِيَّةِ) বা সেরা ও উত্তম মানুষ ছিলেন।

৩. এও বলা হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম سَيِّدُ وَلَدِ آدَمَ তথা ‘আদম সন্তানদের নেতা’ এ কথা জানার পূর্বে ইবরাহীম (আ.) (خَيْرَ الْبَرِيَّةِ) বা সৃষ্টির সেরা মানুষ ছিলেন। (শারহুন নাবাবী ১৫শ খন্ড, হাঃ ১৫০-[২৩৬৯])


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)

পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বংশগৌরব ও পক্ষপাতিত্ব

৪৮৯৭-[৫] ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ খ্রিষ্টানরা মারইয়াম-এর পুত্র ’ঈসা (আ.)-এর প্রশংসায় যেভাবে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা সেভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। আমি তো আল্লাহর বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা এবং আল্লাহর রসূল বলো। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ الْمُفَاخَرَةِ وَالْعَصَبِيَّةِ

وَعَنْ عُمَرَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا: عبدُ الله ورسولُه . مُتَّفق عَلَيْهِ

وعن عمر قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تطروني كما اطرت النصارى ابن مريم فانما انا عبده فقولوا عبد الله ورسوله متفق عليه

ব্যাখ্যাঃ (كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ) নাসারাগণ তথা খ্রিষ্টানগণ ‘ঈসা (আ.)-কে আল্লাহর বান্দা ও রসূল হিসেবে না মেনে আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র হিসেবে মান্য করত। এটা তারা করত সম্মান ও ভক্তির ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার কারণে। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু’মিনদেরকেও সতর্ক ও সাবধান করে বলেন, নাসারাগণ যেভাবে মারইয়াম-এর পুত্র ‘ঈসা (আ.)-কে নিয়ে প্রশংসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরাও এভাবে আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। বরং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল বল। (ফাতহুল বারী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ৩৪৪৫)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)

পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বংশগৌরব ও পক্ষপাতিত্ব

৪৮৯৮-[৬] ’ইয়ায ইবনু হিমার আল মুজাশি’ঈ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আমাকে ওয়াহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন যেন তোমরা পরস্পর বিনয়ী হও। এমনকি এক ব্যক্তি যেন অন্য ব্যক্তির ওপর গৌরব না করে এবং এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির ওপর অত্যাচার না করে। (মুসলিম)[1]

بَابُ الْمُفَاخَرَةِ وَالْعَصَبِيَّةِ

وَعَن عياضِ بن حمارٍ المجاشعيِّ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ أَوْحَى إِلَيَّ: أَنْ تَوَاضَعُوا حَتَّى لَا يَفْخَرَ أَحَدٌ عَلَى أَحَدٍ وَلَا يبغيَ أحدٌ على أحد . رَوَاهُ مُسلم

وعن عياض بن حمار المجاشعي ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ان الله اوحى الي ان تواضعوا حتى لا يفخر احد على احد ولا يبغي احد على احد رواه مسلم

ব্যাখ্যাঃ (وَلَا يَبْغِىَ أَحَدٌ عَلٰى أَحَدٍ) অহংকারী ব্যক্তি বলা হয় ঐ ব্যক্তিকে, যে নিজেকে সকলের চেয়ে বড় ভাবে। সকলের চেয়ে তার মান-সম্মান উপরে মনে করে। আর সে কারো আনুগত্য করে না। কাউকে পরোয়া করে না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২৫: শিষ্টাচার (كتاب الآداب)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৬ পর্যন্ত, সর্বমোট ৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে