দ্বিতীয়ত: দা'ওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমসমূহ

দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যম বলা হয় ঐ সকল বিষয় বা বৈধ জিনিস যার দ্বারা দায়ী তার দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে সহযোগিতা গ্রহণ করেন। যে সকল মাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ﷺ করেছেন বা মুসলিমগণ যার দ্বারা সাফল্য অর্জন করেছেন সেগুলো বৈধ অসিলা। তবে হারামের কারণ পাওয়া গেলেই হারাম বিবেচিত হবে। দাওয়াতের মাধ্যম ব্যবহারের শরিয়তের কোন সীমা রেখা নেই। নিষেধ না থাকলেই ব্যবহার বৈধ। আর যে সকল মাধ্যম আল্লাহ হারাম করেছেন তার ব্যবহার হারাম। যেমন: মানুষকে উৎসাহ বা ভয় প্রদর্শনের জন্য মিথ্যা কেসসা-কাহিনী ও গাল গল্প ও জাল হাদীস বর্ণনা ইত্যাদি যা শরিয়তে সম্পূর্ণ নিষেধ। দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমসমূহ প্রধানত দু'প্রকার যথা:

(ক) বাহ্যিক মাধ্যম।

(খ) আভ্যন্তরীণ মাধ্যম।

বাহ্যিক মাধ্যম:

বাহ্যিক মাধ্যম ঐ সকল মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা সরাসরি দা'ওয়াত ও তাবলীগ করা হয় না বরং যার দ্বারা দা'ওয়াত ও তাবলীগের কাজে সহযোগিতা নেওয়া হয়।

ইহা তিনভাবে হতে পারে যথা :

(১) সতর্কতা অবলম্বন করা।

(২) অন্যের সহযোগিতা গ্রহণ করা।

(৩) নিয়ম-নীতিমালার অনুসরণ করা। সতর্কতা অবলম্বন করা প্রশংসনীয় কাজ। আল্লাহ তা'য়ালা যুদ্ধক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে নির্দেশ করেছেন। রসূলুল্লাহ ﷺ হিজরত ও অন্যান্য সময় সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

সতর্কতার প্রয়োজন:

নিঃসন্দেহে প্রতিটি দা'য়ীর জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা ওয়াজিব। বিশেষ করে কুফুরি সমাজে। কেননা এর দ্বারা যে উপকার পাওয়া যায় তা অবর্ণনীয়। ইহা ব্যতীত নিজেকে ধ্বংসে পতিত করা ছাড়া আর কি হতে পারে?

সতর্কতা ও আল্লাহর প্রতি ভরসা একই সাথে হতে হবে। শুধুমাত্র সতর্ক থাকলে বা ভরসা করে বসে থাকলেই চলবে না।

সতর্কতার প্রকার:

(১) পাপ থেকে সতর্ক থাকা।

(২) স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি ও দুনিয়ার বেড়াজাল হতে সতর্ক থাকা।

(৩) নফস তথা প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে সতর্ক থাকা।

(৪) মুনাফেক ও কাফেরদের হতে সতর্কতা অবলম্বন করা।

সতর্কতার মাধ্যম ও পদ্ধতিঃ

(১) দুশমনদের হতে সতর্ক থাকার নিমিত্তে বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে দাওয়াতের কাজ শুরু করা।

(২) গোপনীয়তা অবলম্বন করা। যেমন: হিজরতের সময় রসূলুল্লাহ ﷺ ও আবু বকর [রাঃ] গারে সাওরে আত্মগোপন করে ছিলেন।

(৩) প্রয়োজনে জাতি হতে দূরে একাকী গোপনে অবস্থান করা যেমনঃ কাহাফ বাসীর ঘটনা। [সূরা কাহাফ: ৯-২৬]

(৪) নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া। যেমন: সাহাবায়ে কেরাম আবিসিনিয়ায় হিজরত করে ছিলেন।

(৫) মুসলিমের ইসলাম প্রকাশ না করা। যেমন: ফেরাউনের জাতির এক মুসলিম ব্যক্তি তাঁর ইসলাম গোপন করে রেখেছিলেন।

(৬) একত্রে না হয়ে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা। যেমন: ইয়াকুব [আঃ] তাঁর ছেলেদের আদেশ করেছিলেন। [সূরা ইউসুফ: ৬৭]

(৭) প্রয়োজনে দায়ীর মহান উদ্দেশ্যকে গোপন রাখা।

অন্যের সহযোগিতা গ্রহণ:

দায়ী তার দাওয়াত যে কোন বৈধ উপায়ে মানুষের নিকট পৌঁছাবার জন্য বড়ই আগ্রহী হবেন। তাই যে কোন বৈধ মাধ্যম গ্রহণ করবেন। এর মধ্য হতে অন্যের সহযোগিতা নেওয়া বড়ই উপকারী। মূসা [আঃ] তার ভাই হারুন [আঃ] এর সহযোগিতা চেয়ে আল্লাহর নিকট দু'য়া করেছিলেন। [সূরা ত্বহা : ২৯-৩৫]

দায়ীর নিজেকে হেফাজতের জন্য মুসলিমদের দ্বারা সহযোগিতা নেওয়া জায়েয। রসূলুল্লাহ ﷺ মিনার বড় আকাবার বায়েতে ইয়াছরেবের (মদীনার) নও মুসলিমদের নিকট সহযোগিতা চেয়েছিলেন। প্রয়োজনে দায়ী শর্ত করে বিধর্মীদের সহযোগিতাও নিতে পারেন।

(১) যেমন রসুলুল্লাহ ﷺ দাওয়াতের কাজে আবু তালেবের সহযোগিতা নিয়েছিলেন।

(২) সহযোগিতার জন্য নবী ﷺ তায়েফে গিয়েছিলেন।

(৩) রসূলুল্লাহ ﷺ তয়েফ হতে ফিরে এসে মুত্ব'ইম ইবনে আদীর নিকট নিরাপত্তা নিয়েছিলেন।

(৪) মুসলিমগণ হাবাশা (আবিসিনিয়া) হতে ফিরে এসে মুশরেকদের নিকট হতে নিরাপত্তা গ্রহণ করেছিলেন।

(৫) আবু বকর ইবনু দাগেনার দ্বারা নিরাপত্তা গ্রহণ করেছিলেন।

অমুসলিমদের সহযোগিতা নেয়ার শর্ত হলো:

(১) ইসলামের স্বার্থে যেন না হয়।

(২) ইসলামের কোন প্রকার ছাড় যেন না হয়। যেমন রসূলুল্লাহ ﷺ বলেন: যদি তোমরা এক হাতে সূর্য আর অন্য হাতে চন্দ্র এনে দাও তবুও আমি আমার কাজ হতে এক মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকব না। অনুরূপ আবু বকর [রাঃ] ইবনু দাগেনাকে বলেছিলেন।

এর কিছু ব্যাপারে অমুসলিমের সহযোগিতা:

দায়ীর জন্য দাওয়াতের কাজে প্রয়োজনে অমুসলিমের সহযোগিতা নেওয়া বৈধ। যেমন:

(১) হিজরতের সময় আবু বকর মুশরিক আব্দুল্লাহ ইবনে ফুহাইরার পথ প্রদর্শক হিসাবে সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন।

(২) মিনার বায়েতে কুবরায় রসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালেবকে (তখন তিনি কাফের ছিলেন) সাথে নিয়েছিলেন।

নিয়ম-কানুন:

নিয়ম-শৃঙ্খলা যে কোন কাজের জন্য অতি প্রয়োজন, ইহা ব্যতীত কোন কাজ সঠিকভাবে আনজাম দেওয়া সম্ভব নয়। জামাতে সালাত আদায়, হজ্ব, সিয়াম ও জাকাত ইত্যাদিতে আমাদের নিয়মতান্ত্রিকতার শিক্ষা দেয়।

সময় মানুষের জীবন। অতএব, দায়ী তাঁর সময়কে বিন্যাস করে প্রতিটি কাজের জন্য আলাদা আলাদা সময় ভাগ করবে। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, এবাদতের জন্য, দা'ওয়াত ইত্যাদির জন্য। মনে রাখতে হবে আজ ও কাল যেন সমান সমান না হয় এবং আজ থেকে আগামী কাল যেন কিছুটা হলেও ভাল হয় এবং কোন ক্রমেই যেন একটি মুহূর্ত অপচয় না হয়। সময় দুনিয়ার কাজে অথবা আখেরাতের কাজে ব্যয় হতে হবে এ ছাড়া তৃতীয় কোন অবস্থা নেই। মানুষ মরণশীল তাই চেষ্টা করতে হবে যেন প্রতিটি মিনিট ভাল কাজে লাগে।

দাওয়াতের কাজ কখনো একাকী আবার কখনো জামাতবদ্ধভাবে হতে পারে। আবার দা'ওয়াত ব্যক্তির জন্যে হতে পারে কিংবা জামাতের জন্যে। অনেক সময় একক ব্যক্তির জন্য যা করা সম্ভব নয় তা জামাতবদ্ধভাবে করা সম্ভব। কথায় বলে দশের লাঠি একের বোঝা। দা'ওয়াত যখন জামাতবদ্ধভাবে হবে তখন বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলা অতি জরুরি যথা:

১. পরামর্শের ভিত্তিতে একজন আমীর নির্বাচন করা।

২. আমীরের কথা মত চলা যাতে করে সুষ্ঠভাবে কাজ পরিচালিত হয়।

৩. আল্লাহর নাফরমানি করে কারো কথা মান্য করা চলবে না। তাতে সে যেই হোক না কেন।

৪. আমীর পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।

৫. আমীরকে সবার সঙ্গে নরম ও ভদ্রসুলভ ব্যবহার করতে হবে।

৬. আমীরকে যার মাঝে যে যোগ্যতা আছে তা নির্ণয় ও মূল্যায়ন করতে হবে।

৭. আমানতদারী এবং যোগ্যতা ও শারীরিক শক্তির ভিত্তিতে দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে।