শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অদৃশ্য বা গায়েব সম্পর্কে জানতেন বলে বিশ্বাস করা :

আমাদের দেশে এমন বহু মুসলিম রয়েছেন যারা নিজেদেরকে প্রকৃত সুন্নী বলে দাবী করে থাকেন। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞান ও তাঁর মান মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তাঁর ব্যাপারে এ বিশ্বাস পোষণ করেন যে, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যাবতীয় অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন, বর্তমানেও তিনি সর্বত্র হাজির ও নাজির আছেন। সুদূর মদীনায় থেকেও তিনি সর্বত্র বিরাজমান ও সব কিছু অবলোকন করছেন। দেশের চট্রগ্রাম, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার অনেক মুসলিম এ চিন্তাধারা লালন করে থাকেন। কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার আবু বকর সিদ্দিক নামের জনৈক পীর সাহেবও এ ধরনের দাবী করেন বলে পত্রিকান্তরে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।[1]

অনুরূপভাবে এ বিশ্বাস সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতুলী পীর সাহেব এবং তাঁর সকল ভক্ত অনুরক্তরাও পোষণ করে থাকেন। এ ধরনের বিশ্বাস যে জ্ঞানগত শির্কের অন্তর্গত, এর প্রমাণ আমরা প্রথম অধ্যায়ে যাবতীয় তথ্য প্রমাণাদিসহ উপস্থাপন করেছি। সেখানে প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, কারো পক্ষেই নিজ থেকে গায়েব সম্পর্কে জানার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই আল্লাহ তা‘আলার অধিকারভুক্ত বিষয়। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাঁর রেসালতের দায়িত্ব যথাযথভাবে আদায় করার প্রয়োজনে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কিছু অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত করেছিলেন, এর বাইরে তিনি নিজ থেকে আর কিছুই জানতেন না বা জানতে পারতেন না।

গায়েব সম্পর্কে জানার যেমন তাঁর জন্মগত কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না, তেমনি রেসালত লাভের পরেও তাঁর মধ্যে এমন কোনো বৈশিষ্ট্য দান করা হয় নি। তা না দেয়ার কারণ হলো : এটি আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী তাঁর একটি বিশেষ গুণ, যা তিনি (আল্লাহ) ব্যতীত তাঁর কোনো সৃষ্টির জন্য শোভা পায় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় যে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারেন না, তাঁর তিরোধানের পরেও তিনি সে বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারেন না।

যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার চিন্তাধারা লালন করেন তারা নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ এর দল বলে দাবী করে থাকেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যে সকল সাহাবীগণ সর্বপ্রথম নিজেদেরকে এ নামে পরিচয় দান করেছিলেন, তাঁরাতো তাঁর জন্য এ জাতীয় কোনো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার ধারণায় আদৌ বিশ্বাসী ছিলেন না। এ ভ্রান্ত শির্কী বিশ্বাস পোষণকারীগণ হয়তোবা এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অসীম জ্ঞানের অধিকারী ও মর্যাদাবান বলে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চান; কিন্তু তাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এ জাতীয় বিশ্বাসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অধিক সম্মান প্রদর্শন করার অর্থ হচ্ছে- অধিক মাত্রায় শির্কে নিমজ্জিত হওয়া ও ইসলাম থেকে পূর্ণমাত্রায় বেরিয়ে যাওয়ার শামিল।[2] এ জাতীয় শির্ককারীদের ব্যাপারে মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী বলেন :

‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-গায়েব জানতেন এ জাতীয় বিশ্বাস পোষণ করা প্রকাশ্য শির্ক।’’[3]

মাওলানা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী এ জাতীয় চিন্তাধারা সম্পর্কে বলেন :

‘‘আল্লাহ তা‘আলার উলূহিয়্যাতের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদির ক্ষেত্রে এ ধারণা পোষণ করা যে, নবীগণ গায়েব জানেন, তাঁরা সকল স্থান থেকে মানুষের আহ্বান শ্রবণ করেন, এ জাতীয় আক্বীদা-বিশ্বাস ভ্রান্ত ও শির্ক।’’[4]

আমাদের দেশে এ-জাতীয় শির্কী চিন্তাধারা ও বিশ্বাস ভ্রান্ত তরীকত পন্থী এবং আহমদ রেজা ব্রেলভী (১৮৫৬-১৯২১ খ্রি.) এর অনুসারীদের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করেছে; কেননা, মা‘রিফাতের দাবীদার ভ্রান্ত তরীকতপন্থীরা এ জাতীয় ধারণা শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারেই পোষণ করে না, তারা ওলিদের ব্যাপারেও উপর্যুক্ত ধারণা পোষণ করে। আহমদ রেজা ব্রেলভীও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে এ জাতীয় শির্কী চিন্তাধারা পোষণ করত এবং তার ও তার অনুসারীদের দ্বারাই এ চিন্তাধারা পাকিস্তান, ভারত ও আমাদের দেশে অধিকমাত্রায় অনুপ্রবেশ করেছে। সে কারণেই ভারত মহাদেশের বিশিষ্ট আলেমগণকে আহমদ রেজা ব্রেলভী এর ভ্রান্ত চিন্তাধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর দেখতে পাওয়া যায়। তার চিন্তাধারার মুখোশ উন্মোচন কল্পেই লিখিত হয়েছে بريلوي مذهب أور إسلام এবং بريلوي مذهب كي نيا روب এ নামের দু’টি কিতাব।[5]

২. ভাগ্য সম্পর্কে জানার জন্য জ্যোতির্বিদদের নিকট গমন করা এবং তাদের কথায় বিশ্বাস করা :আমাদের দেশে বর্তমানে প্রফেসর হাওলাদারসহ[6] আরো অনেক জ্যোতির্বিদ রয়েছেন যারা তারকার গতিবিধি লক্ষ্য করে এর ফলাফল দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় প্রকাশ করে থাকেন। এর দ্বারা তারা জনগণকে তাদের ভাগ্য সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে আগাম সতর্ক করেন। রাশি ফলের এ জাতীয় প্রচারণা আমাদের দেশে এখন একটি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। রাজধানী ঢাকাতে তাদের অনেকের চেম্বার রয়েছে। সাধারণ লোকেরা তাদের নিকট নিজ নিজ ভাগ্যে ভাল বা মন্দ কী অপেক্ষা করছে, তা আগাম জানার জন্য গমন করে।

যারা ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়েছে, তারা ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য পরামর্শ নেয়ার উদ্দেশ্যে তাদের নিকট গমন করে। অথচ তারা জানে না যে, ইসলাম জ্যোতির্বিদদের মানুষের ভাগ্য সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীকে স্বীকার করে না এবং নিম্নজগতের প্রাণীর ভাগ্যে উর্ধ্ব জগতের গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকার প্রভাব আছে বলে দীর্ঘকাল থেকে মানুষের মাঝে যে বিশ্বাস গড়ে উঠেছে, সেটাকে ইসলাম শির্কী চিন্তাধারা হিসেবে গণ্য করে; কেননা, বিশ্বজগত এককভাবে মহান আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর পরিকল্পনানুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। আমাদের ন্যায় সকল গ্রহ, নক্ষত্র ও তারকারাজী আল্লাহরই সৃষ্টি। এগুলোকে আমাদের ভাগ্যের ভাল বা মন্দের উপর প্রভাব বিস্তার করার জন্য সৃষ্টি করা হয় নি। এ সব একান্তই আবহমান কালের মানুষের কল্পনা ও ধারণাপ্রসূত কথা বৈ আর কিছুই নয়। এ সব বিশ্বাসের ফলেই একবার মানুষ তারকার কাল্পনিক মূর্তি বানিয়ে এর পূজা করতে অভ্যস্ত হয়েছিল।

>
[1]. দেখুন : সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, (শুক্রবার, ৪/৮/২০০০ খ্রি.), পৃ.৬।

[2]. শেখ সুলাইমান ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুনি‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৩১।

[3]. দেখুন : রশীদ আহমদ গাংগুহী, ফতাওয়া রশীদিয়্যাহ; ২/১০।

[4]. শাহ ‘আব্দুল ‘আযীয আদ-দেহলভী, তাফসীরে ফাতহুল আযীয; পৃ. ৫৩।

[5]. মাওলানা নূর কেলীম কর্তৃক উর্দু ভাষায় লিখিত ‘ব্রেলভী মাযহাব আওর ইসলাম’ কিতাবটি পাকিস্তানের ফয়সলাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এবং মাওলানা মোঃ ‘আরিফ সম্বহলী কর্তৃক লিখিত ‘ব্রেলভী ফিৎনা কি নয়া রূপ’ কিতাবটি পাকিস্তানের লাহোর থেকে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে।

[6]. প্রফেসর হাওলাদার দেশের একজন প্রখ্যাত জ্যোতিষ। প্রত্যেক সপ্তাহে তার রাশিচক্রের বর্ণিত ফলাফল পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।