আল-ফিকহুল আকবর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৫৭ টি
আল-ফিকহুল আকবর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৫৭ টি

প্রশংসা মহান আল্লাহর নিমিত্ত। সালাত ও সালাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, তাঁর প্রিয়তম মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিজন, সহচর ও অনুসারীদের উপর।

‘এহইয়াউস সুনান’ ও ‘ইসলামী আকীদা’ গ্রন্থদ্বয়ে আকীদা ও সুন্নাত বিষয়ক বিভিন্ন প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহুর বক্তব্য উদ্ধৃত করে উল্লেখ করেছি যে, আমাদের সমাজের অনেকে তাঁর অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এ সকল বিষয়ে তাঁর মতের সাথে সাংঘর্ষিক মত পোষণ করেন। এ সকল বক্তব্য অনেক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অনেকে ঈমান, আকীদা, সুন্নাত, বিদআত ইত্যাদি বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রদের মত জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন: আমরা তো ফিকহী বিষয়ে হানাফী, আকীদায় আশআরী বা মাতুরিদী ও তরীকায় কাদিরী, চিশতী বা নকশবন্দী। আমরা কি ফিকহ, আকীদা ও তরীকা সকল বিষয়ে হানাফী হতে পারি না? ইমাম আবূ হানীফার কি কোনো আকীদা ও তরীকা ছিল না? থাকলে তা কী ছিল?

প্রকৃতপক্ষে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) আকীদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। আমরা দেখব যে, তিনি ফিকহ বিষয়ে কোনো গ্রন্থ রচনা না করলেও আকীদা বিষয়ে কয়েকটি পুস্তিকা রচনা করেছেন, আকীদা বিষয়ক জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ ফিকহ বা ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং ফিকহী বিষয়ে ইজতিহাদ ও মতভেদের অনুমতি দিয়েছেন কিন্তু আকীদা বিষয়ে ইজতিহাদ ও মতভেদ নিষেধ করেছেন।

ইমাম আযমের (রাহ) রচনাবলির মধ্যে আকীদা বিষয়ক ৫টি পুস্তিকা প্রসিদ্ধ। তন্মধ্যে ‘আল-ফিকহুল আকবার’ পুস্তিকাটির দুটি ভাষ্য। একটি ‘আল-ফিকহুল আকবার’ এবং অন্যটি ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ নামে প্রসিদ্ধ। কোনো কোনো গবেষক দ্বিতীয় পুস্তিকাটি, অর্থাৎ ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ নামে পরিচিত পুস্তিকাটিই মূল ‘আল-ফিকহুল আকবার’ বলে মত প্রকাশ করেছেন। ‘ইমাম আবূ হানীফার রচনাবলি’ পরিচ্ছেদে আমরা দেখব যে, সনদ ও মতনে প্রথম পুস্তিকাটিও ‘আল-ফিকহুল আকবার’ হিসেবে প্রমাণিত। আমরা এ পুস্তিকাটিকেই অনুবাদের জন্য মূল হিসেবে গ্রহণ করেছি। কারণ এ পুস্তিকাটিতে ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ ও তাঁর রচিত সবগুলো পুস্তিকার আলোচ্য বিষয়ের সার-সংক্ষেপ সহজ ভাষায় আলোচিত। ইসলামী আকীদার বিভিন্ন দিকের সামগ্রিক আলোচনা এ পুস্তিকায় যেভাবে বিদ্যমান তাঁর রচিত অন্যান্য পুস্তিকায় সেভাবে নেই। এজন্য আমি এ পুস্তিকাটি অনুবাদ করার এবং এর ভিত্তিতে ইসলামী আকীদার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। পাশাপাশি ‘আল-ফিকহুল আবসাত’ ও অন্যান্য পুস্তিকা থেকে প্রাসঙ্গিক সকল বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি।

আল-ফিকহুল আকবারের ব্যাখ্যায় আকীদা বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর মত জানতে তাঁর লেখা পুস্তিকাগুলো ছাড়া আরো দুটি গ্রন্থের উপর নির্ভর করেছি:

(১) তৃতীয়-চতুর্থ শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবূ জাফর আহমদ ইবন সালামা তাহাবী (২৩৮-৩২১ হি) রচিত ‘আল-আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ’। এ পুস্তিকাটি তিনি ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদ্বয়ের আকীদা বর্ণনায় রচনা করেন।

(২) চতুর্থ-পঞ্চম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ ইমাম আবুল আলা সায়িদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন আহমদ নাইসাপূরী (৩৪৩-৪৩২ হি) রচিত আল-ই’তিকাদ। এ গ্রন্থটিতে তিনি ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বিষয়ক বক্তব্যগুলো সংকলন করেছেন।

ফিকহুল আকবার গ্রন্থের একটি বৈশিষ্ট আলোচ্য বিষয়ের বৈচিত্র। আকীদার পরিচিত আলোচ্য বিষয়গুলো ছাড়াও তারাবীহ, রিয়া, উজব, কিয়ামতের আলামত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সমত্মানদের পরিচয় ইত্যাদি অনেক বিষয় তিনি আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ক আলোচনা ও ব্যাখ্যা আমাদের এ বইটির কলেবর কিছুটা বৃদ্ধি করেছে।

আল-ফিকহুল আকবারের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করতে যেয়ে দেখলাম যে, মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির উৎস ও বিষয়বস্ত্ত দ্বিতীয় শতকে যা ছিল বর্তমানেও প্রায় তা-ই রয়েছে। খারিজীগণের ‘তাকফীর’ ও জিহাদ নামের উগ্রতা, জাহমী-মুরজিয়াদের মারিফাত ও ঈমান বিষয়ক প্রান্তিকতা, শীয়াগণের অতিভক্তি ও বাতিনী ইলমের নামে অন্ধত্ব এবং মুতাযিলীগণের বুদ্ধিবৃত্তিকতার নামে ওহীর অবমূল্যায়ন বর্তমান যুগেও একইভাবে উম্মাতের সকল ফিতনার মূল বিষয়। এগুলোর সাথে বর্তমান যুগে যোগ হয়েছে তাওহীদ বিষয়ক অজ্ঞতা ও শিরকের ব্যাপকতা। এ সকল ফিতনার সমাধানে সে যুগে ইমাম আবূ হানীফা ও অন্যান্য ইমাম যা বলেছেন বর্তমান যুগেও সেগুলোই আমাদের সমাধানের পথ দেখাবে। এ জন্য এ সকল বিষয়ে ফিকহুল আকবারের বক্তব্য ছাড়াও ইমাম আবূ হানীফা ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যান্য ইমামের বক্তব্য বিস্তারিত আলোচনা করেছি। স্বভাবতই এতে ব্যাখ্যার কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে।

আল-ফিকহুল আকবারের অন্যতম আলোচ্য মহান আল্লাহর বিশেষণ। এ বিষয়টি আমাদের অনেকের জন্যই সম্পূর্ণ নতুন বা ভিন্ন আঙ্গিকের। আমাদের সমাজে প্রচলিত অনেক আকীদা এক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রদের আকীদার সম্পূর্ণ উল্টো। যেমন, ‘মহান আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’-এ আকীদাকে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রগণ জাহমী ফিরকার কুফরী আকীদা এবং সর্বেশ্বরবাদেরই ভিন্নরূপ বলে গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে আমাদের সমাজের অনেক মুসলিম এ আকীদা পোষণ করেন। বিষয়টি জটিল হওয়াতে আমি একটু বিস্তারিতভাবে তা পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি।

এ বইটিকে আমি দুটি পর্বে ভাগ করেছি। প্রথম পর্ব তিনটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। প্রথম পরিচ্ছেদে ইমাম আবূ হানীফার জীবনী ও মূল্যায়ন, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে ইমাম আবূ হানীফার রচনাবলি ও তৃতীয় পরিচ্ছেদে ইলমুল আকীদা ও ইলমুল কালাম বিষয়ে আলোচনা করেছি।

দ্বিতীয় পর্ব আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা। তাবিয়ী যুগের আলিমগণ পরবর্তী যুগের মত অধ্যায় বিন্যস্ত গ্রন্থ রচনা করেন নি। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যগুলো অনেকটা অবিন্যস্তভাবে সংকলন করেছেন। অথবা তাঁরা মুখে বলেছেন এবং ছাত্ররা তা লিখেছে। এজন্য ‘আল-ফিকহুল আকবার’ পুস্তিকাটির আলোচ্য বিষয় পরবর্তী যুগের গ্রন্থাদির মত সুবিন্যস্ত নয়। একই বিষয় বিভিন্ন স্থানে আলোচনা করা হয়েছে। এজন্য এর আলোচ্য বিষয়কে বিষয়ভিত্তিক পরিচ্ছেদে বিভক্ত করা কঠিন। বিন্যাসের সুবিধার জন্য আমি আল-ফিকহুল আকবার গ্রন্থের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে অনুবাদ ও ব্যাখ্যাকে পাঁচটি পরিচ্ছেদে ভাগ করেছি। প্রত্যেক পরিচ্ছেদে ইমাম আযমের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় আলোচ্য বিষয় ব্যাখ্যা করেছি।

আকীদা বিষয়ক ও সুন্নাহ নির্ভর সকল আলোচনা ও গ্রন্থ রচনায় আমার প্রেরণার উৎস ছিলেন আমার শ্বশুর ফুরফুরার পীর শাইখ আবুল আনসার সিদ্দিকী (রাহ)। সুন্নাহ ভিত্তিক বিশুদ্ধ আকীদা গ্রহণে ও প্রচারে তিনি ছিলেন আপোষহীন। আমাদেরকেও আপোষহীন হতে প্রেরণা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাঁর ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করুন, তাঁর নেক আমলগুলো কবুল করুন, আমাদের ও উম্মাতের পক্ষ থেকে তাঁকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করুন এবং আখিরাতের অনন্ত জীবনে আমাদেরকে জান্নাতে একত্রিত করুন।

‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর অনুবাদ ও ব্যাখ্যা রচনায় আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়েছেন ভাই শামসুল আরিফিন খালিদ। শুরু থেকেই তিনি উৎসাহ দিয়েছেন এবং বারবার পাণ্ডুলিপি দেখে বিভিন্ন গঠনমূলক পরামর্শ দিয়েছেন। ইমাম আবূ হানীফা, চার ইমাম ও সালাফ সালিহীনের (রাহিমাহুমুল্লাহ) বক্তব্যের আলোকে বিশুদ্ধ সুন্নাহ নির্ভর আকীদার প্রচার এবং আকীদা বিষয়ক বিতর্ক, হানাহানি ও প্রান্তিকতার অবসানে তাঁর আন্তরিক আবেগ, পরামর্শ ও প্রচেষ্টা মহান আল্লাহ কবুল করুন ও তাঁকে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা দান করুন।

আমার প্রিয়জনেরা গ্রন্থটির রচনায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। বিশেষত আস-সুন্নাহ ট্রাস্টে আমার সহকর্মীগণ ড. শুআইব আহমদ, মুফতি শহীদুল্লাহ, শাইখ যাকারিয়া, শাইখ মুশাহিদ আলী, ভাই আব্দুর রহমান ও অন্যান্য সকলেই বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন। প্রফেসর ড. অলী উল্যাহ, ডা. আব্দুস সালাম সুমন ও মাওলানা ইমদাদুল হক প্রুফ দেখেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন। আল্লাহ তাঁদেরকে এবং অন্যান্য উলামায়ে কিরাম যারা আমাকে বিভিন্ন গঠনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সকলকেই উত্তম পুরস্কার দান করুন।

এ বইয়ের মধ্যে অগণিত ইমাম, আলিম ও বুজুর্গের নাম বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেকের নামের সাথে প্রত্যেক স্থানে দুআর ইঙ্গিত হিসেবে (রাহ) লেখা সম্ভব হয় নি। পাঠকের প্রতি অনুরোধ, সকল আলিমের নামের সাথে ‘রাহিমাহুল্লাহ’ বলে তাঁদের জন্য দুআ করবেন। তাঁদের মাধ্যমেই আমরা দীন পেয়েছি এবং তাঁদের জন্য দুআ করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। মহান আল্লাহ এ গ্রন্থে উল্লেখকৃত সকল আলিমকে এবং মুসলিম উম্মাহর সকল আলিমকে অফুরন্ত রহমত দান করুন। আমীন।

তথ্যসূত্র প্রদানে পাদটীকায় গ্রন্থকারের নাম, গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা উল্লেখ করেছি। গ্রন্থ বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য বইয়ের শেষে ‘গ্রন্থপঞ্জীর’ মধ্যে উল্লেখ করেছি। অনেক ক্ষেত্রে ‘আল-মাকতাবাতুশ শামিলা’-র উপর নির্ভর করেছি।

আল-ফিকহুল আকবার-এর ব্যাখ্যা সাধারণ বাঙালী পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য করার চেষ্টা করেছি। এজন্য অনেক বিষয়ে বিস্তারিত বিতর্ক, আলোচনা বা উদ্ধৃতি পরিহার করেছি। ফলে অনেক সময় আলিমগণের নিকট বিষয়টি অসম্পূর্ণ বা ত্রম্নটিপূর্ণ মনে হতে পারে। এছাড়া বিষয়বস্ত্তর জটিলতা ও আমার ইলমী সীমাবদ্ধতার কারণে বইয়ের মধ্যে ভুলভ্রান্তি থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। সম্মানিত কোনো পাঠক যদি ভুলভ্রান্তিগুলো জানিয়ে দেন তবে তা আমার প্রতি বড় ইহসান হবে। মহান আল্লাহ তাঁকে পুরস্কৃত করবেন। এছাড়া তথ্যগত ও উপস্থাপনাগত যে কোনো পরামর্শ আমরা সাদরে গ্রহণ করব। আমরা পরবর্তী সংস্করণে ভুলগুলো সংশোধন করব, ইনশা আল্লাহ।

ইসলামী ইলমের সকল শাখার উদ্দেশ্য মুমিনের জীবনকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে পরিচালিত করা। ইলমুল ফিকহ-এর উদ্দেশ্য মুমিনের ইবাদত, মুআমালাত ও সকল কর্মকান্ড যেন অবিকল রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের আদলেই পালিত হয়। ইলমুত তাযকিয়া বা তাসাউফের উদ্দেশ্য মুমিনের হৃদয়ের অবস্থা যেন অবিকল তাঁদের পবিত্র হৃদয়গুলোর মত হয়ে যায়। ইলমুল আকীদার উদ্দেশ্য মুমিনের বিশ্বাসের সকল বিষয় যেন হুবহু তাঁদের বিশ্বাসের সাথে মিলে যায়। আমরা বিশ্বাস করি, আকীদা বিষয়ে সুন্নাতে নববীর পুনরুজ্জীবনের জন্যই ইমাম আবূ হানীফা কলম ধরেছিলেন। আমাদের অনুবাদ ও ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যও একই। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে দুআ করি, আমাদের এ নগণ্য প্রচেষ্টাকে তাঁর প্রিয়তমের সুন্নাতের পুনরুজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠায় কবুল করে নিন। আমাদের সকলের হৃদয়কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাতের অনুগত করে দিন। ঈমানে, আকীদায়, ফিকহে, তাযকিয়ায় ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে সুন্নাত জানতে, মানতে, প্রচার করতে ও সুন্নাতের জন্য সুন্নাতের ব্যতিক্রম সকল কিছুকে অকাতরে বিসজর্ন দিতে আমাদের হৃদয়গুলোকে শক্তি দান করুন। আমীন।

মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন দয়া করে আমার এ গ্রন্থটির ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করে এটি কবুল করে নেন। একে আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী-পরিজন, শুভাকাঙ্খীগণ ও সকল পাঠকের নাজাতের ওসীলা বানিয়ে দেন। আমীন! সালাত ও সালাম আল্লাহর খালীল মুহাম্মাদ (ﷺ), তাঁর পরিজন ও সহচরগণের উপর।

আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

ইমাম আবূ হানীফার জীবনী প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাম্বালী ফকীহ আল্লামা যাহাবী (৭৪৮ হি) প্রসিদ্ধ একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:


الإمامة في الفقه ودقائقه مسلمة إلى هذا الامام. وهذا أمر لا شك فيه.


وليس يصح في الاذهان شئ : إذا احتاج النهار إلى دليل


‘‘ইলমুল ফিকহ ও এর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে নেতৃত্বের মর্যাদা এ ইমামের জন্য সংরক্ষিত। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। ‘‘যদি দিবসকে প্রমাণ করতে দলিলের প্রয়োজন হয় তবে আর বুদ্ধি-বিবেক বলে কিছুই থাকে না’’।[1]

অর্থাৎ দিবসের দিবসত্বে সন্দেহ করা বা দিবসকে দিবস বলে প্রমাণ করতে দলিল দাবি করা যেমন নিশ্চিত পাগলামি, তেমনি ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদার বিষয়ে সন্দেহ করা বা তাঁর মর্যাদা প্রমাণের জন্য বিস্তারিত আলোচনা করাও জ্ঞান জগতের পাগলামি বলে গণ্য হওয়া উচিত। তারপরও কিছুটা ‘পাগলামি’ করতে বাধ্য হলাম।

আমার একান্ত প্রিয়ভাজন কয়েকজন আলিম ও সচেতন মানুষ আমাকে অনুরোধ করলেন ইমাম আবূ হানীফার মূল্যায়ন বিষয়টি একটু বিস্তারিত আলোচনা করতে। কারণ ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থটি ইসলামী আকীদা বিষয়ে লিখিত সর্বপ্রথম মৌলিক গ্রন্থ। এ গ্রন্থটির বিষয়বস্ত্ত আলোচনার পূর্বে লেখকের মূল্যায়ন বিষয়ক অভিযোগ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। বর্তমান যুগেও আরবী, বাংলা ও অন্যান্য ভাষার গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফার গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে বিতর্ক উত্থাপিত হচ্ছে। অনেক অনুসন্ধিৎসু পাঠকের মনে এ বিষয়ক অস্পষ্টতা বা প্রশ্ন থাকতে পারে। এজন্য তাঁর জীবনী অতি সংক্ষেপে আলোচনা করে তাঁর মূল্যায়ন বিতর্কটি বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করলাম।

[1] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩।

মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ চার মুজতাহিদ ফকীহের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা (৮০-১৫০ হি) প্রথম। তিনি ছিলেন তাবিয়ী প্রজন্মের। ইমাম মালিক ইবন আনাস (৯৩-১৭৯ হি) ও ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস শাফিয়ী (১৫০-২০৪ হি) উভয়ে তাবি-তাবিয়ী প্রজন্মের। আর ইমাম আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাম্বাল (১৬৪-২৪১হি) ছিলেন তাবি-তাবিয়ীদের ছাত্র পর্যায়ের। রাহিমাহুমুল্লাহু: মহান আল্লাহ তাঁদেরকে রহমত করুন। বস্ত্তত তাবিয়ী যুগের ফকীহগণের মধ্যে একমাত্র ইমাম আবূ হানীফাই এরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন।

৪১ হিজরী সালে মুআবিয়া (রা)-এর খিলাফত গ্রহণের মাধ্যমে উমাইয়া যুগের শুরু। ৬০ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়া প্রায় চার বৎসর শাসন করেন (৬০-৬৪ হি)। তার মৃত্যুর পর কয়েক মাস তার পুত্র মুআবিয়া এবং বৎসর খানেক মারওয়ান ইবনুল হাকাম রাজত্ব করেন (৬৪-৬৫ হি)। তার পর তার পুত্র আব্দুল মালিক প্রায় ২১ বৎসর রাজত্ব করেন (৬৫-৮৬ হি)। ১৩২ হিজরী পর্যন্ত পরবর্তী প্রায় ৪৬ বৎসর আব্দুল মালিকের পুত্র, পৌত্র, ভাতিজাগণ রাজত্ব পরিচালনা করেন। ৯৯ থেকে ১০১ হিজরী সাল: প্রায় তিন বৎসর উমার ইবন আব্দুল আযীয খিলাফত পরিচালনা করেন। তাঁর শাসনামল ‘‘খিলাফাতে রাশেদার’’ পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য।

৯৯ হিজরী সাল থেকেই ‘‘নবী-বংশের রাজত্ব’’ শ্লোগানে গোপনে আববাসী আন্দোলন শুরু হয়। ১২৭ হিজরী থেকে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও যুদ্ধ শুরু হয়। ১৩২ হিজরীতে উমাইয়া খিলাফতের পতন ঘটে ও আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথম আববাসী খলীফা আবুল আব্বাস সাফ্ফাহ প্রায় চার বৎসর (১৩২-১৩৬ হি) এরপর আবূ জাফর মানসূর প্রায় ২২ বৎসর (১৩৬-১৫৮ হি) রাজত্ব করেন। রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতন, অস্থিরতা ও পরিবর্তনের পাশাপাশি ধর্মীয় বিশ্বাস ও কর্মেও নানা দল-উপদল জন্ম নেয় এ সময়েই। আভ্যন্তরীণ সমস্যাদি সত্ত্বেও মুসলিম রাষ্ট্র তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। চীন, রাশিয়া ও ভারতের কিছু অংশ থেকে উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন পর্যন্ত- তৎকালীন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি- মুসলিম রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও জ্ঞানচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ইমাম আবূ হানীফার জন্মের পূর্বেই আলী (রা)-এর খিলাফতের সময়ে খারিজী ও শীয়া দুটি রাজনৈতিক-ধর্মীয় ফিরকার জন্ম হয়। উমাইয়া যুগের মাঝামাঝি সময় থেকে কাদারিয়া, মুরজিয়া, জাহমিয়া, মুতাযিলা প্রভৃতি ফিরকার উদ্ভব ঘটে। এ সময়েই উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিকের রাজত্বকালে ইমাম আবূ হানীফার জন্ম ও আববাসী খলীফা মানসূরের সময়ে তাঁর ওফাত।

২. ১. বংশ ও জন্ম

ইমাম আবূ হানীফার (রাহ) পূর্ণ নাম ‘আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত ইবন যূতা। তাঁর পৌত্র ইসমাঈল তাঁর বংশ বর্ণনায় বলেন, আমি ইসমাঈল ইবন হাম্মাদ ইবন নুমান ইবন সাবিত ইবন নুমান ইবন মারযুবান। আমরা পারস্য বংশোদ্ভূত এবং কখনো দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হই নি। আমার দাদা ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। সাবিত শৈশবকালে আলী (রা)-এর নিকট উপস্থিত হন এবং তিনি তাঁর ও তাঁর বংশের মঙ্গলের জন্য দুআ’ করেছিলেন । আমরা আশা করি তাঁর ঐ দুআ নিষ্ফল হয় নি।[1]

তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে কেউ ৬০ হি. এবং কেউ ৭০ হি. সাল উল্লেখ করেছেন। তবে অধিকাংশের মতে তিনি ৮০হি. (৬৯৯ খৃ.) সালে জন্ম গ্রহণ করেন।[2]
২. ২. শিক্ষাজীবন ও উস্তাদগণ

ইমাম আবূ হানীফা তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরুতে কুরআন কারীম মুখস্থ করেন। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কুরআন কারীমের প্রসিদ্ধ ৭ কারীর অন্যতম কারী আসিম ইবন আবিন নাজূদ (১২৮ হি)-এর নিকট ইলমুল কিরাআত শিক্ষা করেন।[3] পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বুৎপত্তি অর্জন করেন।

আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফা ৮০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সাহাবীদের কেউ কেউ ১১০ হিজরী সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। কাজেই ইমাম আবূ হানীফার জন্য কোনো কোনো সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করা ও শিক্ষা গ্রহণ করা খুবই সম্ভব ছিল। বাস্তবে কতজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে। হানাফী জীবনীকারগণ দাবি করেছেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। পক্ষান্তরে দু-একজন বিরোধী দাবি করেছেন যে, কোনো সাহাবীর সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি। এ প্রসঙ্গে সপ্তম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও শাফিয়ী ফকীহ ইবন খাল্লিকান আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম (৬০৮-৬৮১ হি) বলেন:


وأدرك أبو حنيفة أربعة من الصحابة، رضوان الله عليهم وهم: أنس بن مالك وعبد الله بن أبي أوفى بالكوفة، وسهل بن سعد الساعدي بالمدينة، وأبو الطفيل عامر بن واثلة بكمة، ولم يلق أحداً منهم ولا أخذ عنه، وأصحابه يقولون: لقي جماعة من الصحابة وروى عنهم، ولم يثبت ذلك عند أهل النقل.


‘‘আবূ হানীফা চার জন সাহাবীর (রা) সময় পেয়েছিলেন: (১) (বসরায়) আনাস ইবন মালিক (৯২ হি), (২) কূফায় আব্দুল্লাহ ইবন আবী আওফা (৮৭ হি), (৩) মদীনায় সাহল ইবন সা’দ সায়িদী (৮৮ হি) এবং (৪) মক্কায় আবুত তুফাইল আমির ইবন ওয়াসিলা (১১০ হি)। তাঁদের কারো সাথেই তাঁর সাক্ষাৎ হয় নি এবং কারো থেকেই তিনি কিছু শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তাঁর অনুসারীরা বলেন যে, কয়েকজন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং তিনি তাঁদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণের নিকট এ বিষয় প্রমাণিত হয় নি।’’[4]

হানাফী জীবনীকারগণের বর্ণনায় ৭ জন সাহাবীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল:

(১) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন হারাম আনসারী খাযরাজী মাদানী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৭০ হিজরীর পর)

(২) আব্দুল্লাহ ইবন উনাইস. রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৫ হি বা তাঁর পূর্বে)

(৩) ওয়াসিলা ইবনুল আসকা ইবন কা’ব ইবন আমির লাইসী শামী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৫ হি)

(৪) আব্দুল্লাহ ইবন আবী আওফা: আলকামা ইবন খালিদ ইবনুল হারিস আসলামী কূফী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৭ হি)

(৫) আবুল হারিস আব্দুল্লাহ ইবনুল হারিস ইবন জুয ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মা’দীকারিব যাবীদী মিসরী, রাদিয়াল্লাহু আনহু (৮৮ হি)

(৬) আনাস ইবন মালিক ইবনুন নাদর ইবন দামদাম ইবন যাইদ হারাম আনসারী নাজ্জারী মাদানী, রাদিয়াল্লাহ আনহু (৯২/৯৩ হি)

(৭) আয়েশা বিনত আজরাদ। তাঁর মৃত্যু তারিখ এবং অন্যান্য পরিচয় জানা যায় না। তিনি ইবন আব্বাস ও অন্যান্য সাহাবী থেকে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক ও রিজালবিদগণ তাঁকে তাবিয়ী হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ তাঁকে সাহাবী বলে গণ্য করেছেন।[5]

এ প্রসঙ্গে নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও হানাফী ফকীহ আল্লামা মাহমূদ ইবন আহমদ বদরুদ্দীন আইনী (৭৬২-৮৫৫ হি) বলেন: জাবির ইবন আব্দুল্লাহ (রা)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাতের বর্ণনাটি বাহ্যতই সঠিক নয়। তবে অন্যান্যদের সাথে তাঁর সাক্ষাতের সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। যেহেতু তাঁর জীবনীকারগণ তা উল্লেখ করেছেন সেহেতু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া তা অস্বীকার করা অযৌক্তিক পক্ষপাতমূলক আচরণ বলে গণ্য।[6]

বাস্তবে প্রায় সকল জীবনীকার, রিজালবিদ ও ঐতিহাসিক একমত যে সাহাবী আনাস ইবন মালিক (রা)-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। আল্লামা আইনী বলেন:


كان أبو حنيفة، رضى الله عنه، من سادات التابعين، رأى أنس بن مالك، ولا يشك فيه إلا جاهل وحاسد. قال ابن كثير فى تاريخه: أبو حنيفة .... أدرك عصر الصحابة، ورأى أنس بن مالك، قيل: وغيره. وذكر الخطيب فى تاريخ بغداد أن أبا حنيفة رأى أنس بن مالك. وذكر المزى فى التهذيب أنه رأى أنس بن مالك، وكذا ذكر الذهبى فى الكاشف، وغيرهم من العلماء،


‘‘আবূ হানীফা (রহ.) তাবিয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। এ বিষয়ে একমাত্র কোনো মুর্খ বা হিংসুক ছাড়া কেউ সন্দেহ করেন নি। ইবন কাসীর তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে বলেন: আবূ হানীফা ... সাহাবীদের যুগ পেয়েছিলেন। তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। বলা হয় যে তিনি অন্য সাহাবীকেও দেখেছেন। খাতীব বাগদাদী তারীখ বাগদাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, আবূ হানীফা আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। মিয্যী তাঁর তাহযীবুল কামাল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আনাস ইবন মালিককে দেখেছেন। যাহাবী তাঁর ‘আল-কাশিফ’ গ্রন্থে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য আলিমও একই কথা লিখেছেন।’’[7]

এছাড়া আবূ হানীফা (রাহ) তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের, বিশেষত ইরাকের সকল প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম থেকে ইসলামী জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আযমের শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। তাঁর বর্ণিত হাদীসগুলির সংকলন ‘‘মুসনাদ আবী হানীফা’’ গ্রন্থের মধ্যে তাঁর তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী উস্তাদগণের সংখ্যা প্রায় ২০০।[8]

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, রিজালবিদ ও শাফিয়ী ফকীহ ইমাম ইউসূফ ইবন আব্দুর রাহমান আবুল হাজ্জাজ মিয্যী (৭৪২ হি) সিহাহ-সিত্তাহ গ্রন্থগুলোর রাবীগণের জীবনীমূলক ‘তাহযীবুল কামাল’ গ্রন্থে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ)-এর হাদীসের উসতাদগণের মধ্যে ৭৭ জনের নাম উল্লেখ করেছেন, যাদের সূত্রে বর্ণিত ইমাম আবূ হানীফার হাদীস বিভিন্ন গ্রন্থে সংকলিত। তাঁদের অধিকাংশই তাবিয়ী। কেউ কেউ ইমাম আযমের সমসাময়িক এবং কেউ কেউ তাবি-তাবিয়ী। এদের অধিকাংশই তৎকালীন যুগের সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও হাদীসের ইমাম বলে গণ্য ছিলেন। এদের অধিকাংশের বর্ণিত হাদীস বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সুপ্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থে সংকলিত।[9]
২. ৩. অধ্যাপনা ও ছাত্রগণ

উস্তাদদের জীবদ্দশাতেই ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত ফিকহে তাঁর প্রধান উস্তাদ প্রসিদ্ধ তাবিয়ী হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান (১২০ হি)-এর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং কূফার শ্রেষ্ঠ ফকীহ হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পরবর্তী ত্রিশ বৎসর তিনি গবেষণা ও অধ্যাপনায় অতিবাহিত করেন। ইমাম আবূ হানীফার মূল্যায়ন বিষয়ক পরিচ্ছেদে আমরা দেখব যে, ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মত তাঁর জীবদ্দশাতেই মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তাবিয়ী যুগের আর কোনো ফকীহ এরূপ প্রসিদ্ধি লাভ করেন নি। স্বভাবতই মুসলিম বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করতে আসতেন। তাঁর ৯৭ জন মুহাদ্দিস ছাত্রের একটি তালিকা পেশ করেছেন ইমাম মিয্যী। তাঁদের অধিকাংশই সে যুগের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ছিলেন এবং তাঁদের বর্ণিত হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থসমূহে সংকলিত। এছাড়া ইমাম আবূ হানীফার এ সকল ছাত্রের অনেকেই পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবৎ কূফা, বসরা, বাগদাদ, শীরায, ওয়াসিত, রাই, খুরাসানসহ মুসলিম বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ জনপদের বিচারক বা কাযির দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের সকলেই ১৫০ থেকে ২৩০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন।[10]

আল্লামা আইনী এ সকল ছাত্রের বাইরে আরে ২৬০ জন ছাত্রের নাম উল্লেখ করেছেন যারা ইমাম আযম থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা করেছিলেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের তৎকালীন প্রসিদ্ধ প্রতিটি শহরের নাম উল্লেখ করে তথাকার কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিমের নাম উল্লেখ করেছেন যারা ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা করে এ সকল শহর ও নগরে ইলম প্রচারে রত থেকেছেন। তাঁদের অনেকেই এ সকল শহরের বিচারপতি, ইমাম বা প্রসিদ্ধ আলিম ছিলেন। এভাবে দেখা যায় যে, তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি শহরেই ইমাম আবূ হানীফার অনেক প্রসিদ্ধ ছাত্র ছিলেন।[11]
২. ৪. আখলাক

ইমাম আবূ হানীফার আখলাক ও ইবাদত সে মুবারক যুগের নেককারদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করত। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আরবী ভাষায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্য প্রতিভা ও প্রাঞ্জল ভাষার অধিকারী ছিলেন। তাঁর বক্তব্য শ্রোতাকে আকর্ষণ করত। যখন কথা বলতেন তখন মনে হতো সকল মানুষের মধ্যে তিনিই সবেচেয়ে ভাল কথা বলতে পারেন এবং তাঁর কথাই সবচেয়ে সুমিষ্ট। সহজেই তিনি নিজের বক্তব্য শ্রোতাকে বুঝাতে পারতেন। তাঁর দেহের রঙ ছিল সুন্দর এবং কিছুটা বাদামী। মুখমণ্ডল ও অবয়ব ছিল সুন্দর ও আকর্ষণীয়। তিনি সুন্দর ও পরিপাটি পোশাক পরিধান করতেন এবং সর্বদা সুগন্ধময় থাকতেন। এমনকি তিনি যখন বাড়ি থেকে বেরোতেন তখন তাঁকে দেখার আগেই তাঁর সুগন্ধির মাধ্যমে তার আগমন বুঝা যেত। তাঁর ছাত্র আবূ ইউসুফ তার বর্ণনা দিয়ে বলেন:


كان أبو حنيفة ربعا من الرجال، ليس بالقصير ولا بالطويل، وكان أحسن الناس منطقا وأحلاهم نغمة، وأنبههم على ما يريد


‘‘আবূ হানীফা ছিলেন মাঝারি আকৃতির মানুষ, বেঁটেও নন এবং বেশি লম্বাও নন। মানুষদের মধ্যে কথাবার্তায় তিনি ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর, তাঁর কথার মাধুর্য্য ছিল সবচেয়ে বেশি এবং তিনি তাঁর মনের উদ্দেশ্য সবার চেয়ে ভাল বুঝাতে পারতেন।’’[12]

তাঁর বিষয়ে উমার ইবনু হাম্মাদ বলেন:


إن أبا حنيفة كان طوالا، تعلوه سمرة، وكان لبسا، حسن الهيئة، كثير التعطر يعرف بريح الطيب إذا أقبل وإذا خرج من منزله قبل أن تراه


‘‘আবূ হানীফা কিছুটা লম্বা ছিলেন। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কিছুটা বাদামী। তিনি পরিপাটি পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ ও অবয়ব ছিল সুন্দর। তিনি আতর ব্যবহার খুবই পছন্দ করতেন। তিনি যখন কোথাও যেতেন বা বাড়ি থেকে বের হতেন তখন তাঁকে দেখার আগেই সুগন্ধি থেকেই তাঁর আগমন বুঝা যেত।’’[13]

হাইসামী বলেন: লম্বা হওয়া ও মাঝারি হওয়ার মধ্যে মূলত বৈপরীত্য নেই। এ দুটি বর্ণনার সমন্বয় হলো যে, তিনি বেশি লম্বা ছিলেন না, কাজেই তাকে মাঝারিই বলতে হবে। তবে মাঝারিদের মধ্যে তিনি লম্বা বলে বিবেচিত ছিলেন।[14]

তাঁর অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক বলেন:


كان حسن السمت، حسن الوجه، حسن الثوب


‘‘তাঁর বাহ্যিক প্রকাশ ও অবয়ব ছিল সুন্দর, মুখমণ্ডল ছিল সুন্দর এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল সুন্দর।’’[15]

তাঁর অন্য ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ নুআইম ফাদল ইবনু দুকাইন বলেন:


كان أبو حنيفة حسن الوجه، والثوب، والنعل، وكثير البر والمؤاساة لكل من أطاف به


‘‘আবূ হানীফার মুখন্ডল, পোশাক, জুতা সবই ছিল সুন্দর। তাঁর আশেপাশে যারা থাকতেন তাদের প্রত্যেকের উপকার, কল্যাণ ও সহমর্মিতায় তিনি সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।’’[16]

ইমাম আবূ হানীফা বড় ব্যবসায়ী ও ধনী ছিলেন। আর তাঁর ধনসম্পদ মানুষের জন্য, বিশেষত আলিমদের জন্য ব্যয় করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন উদারহস্ত। তিনি নিজের পরিবারের জন্য যেভাবে খরচ করতেন সেভাবেই খরচ করতেন আলিম, তালিবুল ইলম ও ছাত্রদের জন্য।। নিজের জন্য কাপড় কিনলে তাদের জন্যও কিনতেন। ফলমূল বা খাদ্যাদি ক্রয় করলে তিনি আলিম ও ছাত্রদের জন্য আগে ক্রয় করে তারপর নিজের পরিবারের জন্য ক্রয় করতেন। আর হাদীয়া, দান, অনুদান ও পরোপকারের জন্য যখন কিছু ক্রয় করতেন তখন তাঁর সর্বোচ্চ সাধ্যানুসারে তা ক্রয় করতেন। নিজের বা পরিবারের জন্য কিছু নিম্নমানের দ্রব্য ক্রয় করলেও অন্যদের জন্য তা করতেন না। আর ছাত্রদের তিনি নিজেই ভরণপোষণ করতেন। এমনকি অনেক দরিদ্র ছাত্র তার সাহচার্যে এসে সচ্ছল হয়ে যায়। তাঁর প্রিয় ছাত্র আবূ ইউসুফ ও তার পরিবারকে তিনি দশ বৎসর প্রতিপালন করেন।[17]

তৎকালীন সুপ্রসিদ্ধ আলিম ও বুজুর্গ ফুদাইল ইবনু ইয়াদ (১৮৭ হি) বলেন:


كان أبو حنيفة معروفا بكثرة الأفعال، وقلة الكلام وإكرام العلم وأهله


‘‘আবূ হানীফা অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি কাজ বেশি করতেন এবং কথা কম বলতেন। তিনি ইলম এবং আলিমগণকে অত্যন্ত সম্মান করতেন।’’[18]

তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল অসাধারণ ইবাদত, তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল্লাইল।[19] পাশাপাশি তিনি ছিলেন হক্কের বিষয়ে আপোষহীন। ইমাম আবূ হানীফার প্রকৃতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন ইমাম আবূ ইউসূফ। খলীফা হারূন রাশীদ (খিলাফাত ১৭০-১৯৩ হি) বিচারপতি আবূ ইউসুফকে বলেন: আবূ হানীফার আখলাক ও প্রকৃতির একটি বিবরণ আমাকে বলনু তো। তখন ইমাম আবূ ইউসুফ বলেন:


أنه كان شديد الذب عن محارم الله أن تؤتى، شديد الورع أن ينطق في دين الله بما لا يعلم، يحب أن يطاع الله ولا يعصى، مجانبا لأهل الدنيا في زمانهم، لا ينافس في عزها، طويل الصمت، دائم الفكر، على علم واسع، لم يكن مهذارا، ولا ثرثارا، إن سئل عن مسألة كان عنده فيها علم، نطق وأجاب فيها بما سمع، وإن كان غير ذلك قاس على الحق واتبعه، صائنا نفسه ودينه، بذولا للعلم والمال، مستغنيا بنفسه عن جميع الناس، لا يميل إلى طمع، بعيدا عن الغيبة، لا يذكر أحدا إلا بخير


‘‘আল্লাহর দীন বিরোধী সকল কিছুকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপোষহীন। তিনি অত্যন্ত পরহেযগার ও আল্লাহভীরু ছিলেন। দীনের বিষয়ে না জেনে কিছুই বলতেন না। তিনি চাইতেন যে, আল্লাহর আনুগত্য করা হোক এবং তার অবাধ্যতা না হোক। তিনি তাঁর যুগের দুনিয়ামুখি মানুষদেরকে পরিহার করে চলতেন। জাগতিক সম্মান-মর্যাদা নিয়ে তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন না। গভীর জ্ঞানের অধীকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং চিন্তা-গবেষণায় রত থাকতেন। বেশি কথা বলা বা বাজে কথা বলার কোনো স্বভাব তাঁর ছিল না। কোনো মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শ্রুতি বা হাদীসের ভিত্তিতে তার জবাব দিতেন। সে বিষয়ে কোনো শ্রুতি না থাকলে সঠিক কিয়াসের মাধ্যমে উত্তর দিতেন ও তা অনুসরণ করতেন। তিনি তাঁর নিজেকে ও তাঁর দীনকে সংরক্ষণ করতেন। তাঁর জ্ঞান ও সম্পদ তিনি অকাতরে খরচ করতেন। তিনি সকল মানুষের থেকে নিজেকে অমুখাপেক্ষী রাখতেন। কোনো লোভ তাকে স্পর্শ করতো না। তিনি গীবত বা পরচর্চা থেকে দূরে থাকতেন। কারো কথা উল্লেখ করলে শুধু ভাল কথাই বলতেন।’’[20]

তাঁর আপোষহীনতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন ছিল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও ক্ষমতা গ্রহণে অস্বীকৃতি। শত চাপাচাপি ও নির্যাতন সত্ত্বেও তিনি এ সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেন নি। কারণ তিনি কারো মুখ চেয়ে বিচার করতে বা অন্যায় বিচারের দায়ভার নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাযির হতে রাযি ছিলেন না। রাবী ইবনু আসিম বলেন, উমাইয়া সরকারের গভর্নর ইয়াযিদ ইবনু উমার ইবনু হুবাইরা (১৩২ হি)-এর নির্দেশে আবি আবূ হানীফাকে তার কার্যালয়ে নিয়ে আসি। তিনি তাকে বাইতুল মালের দায়িত্ব গ্রহণ করতে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু আবূ হানীফা তা অস্বীকার করেন। একারণে ইবনু হুবাইরা তাকে ২০ টি বেত্রাঘাত করেন। ইবন হুবাইরা তাঁকে বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করলে তিনি তাও প্রত্যাখ্যান করেন।[21]

এ ঘটনা ঘটে ১৩০ হিজরী সালের দিকে, যখন তাঁর বয়স প্রায় ৫০ বৎসর। আববাসী খিলাফত প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় আববাসী খলীফা মানসূর ১৫০ হিজরীতে ইমাম আবূ হানীফাকে বাগদাদে ডেকে বিচারপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। তিনি অস্বীকার করলে ক্রুদ্ধ খলীফা তাকে কারারুদ্ধ করেন এবং কারাগারেই তাঁর মৃত্যু হয়।[22]

ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল হৃদয়ের প্রশস্ততা। তিনি বলতেন:


اللهم من ضاق بنا صدره فان قلوبنا قد اتسعت له


‘‘হে আল্লাহ, আমাদের বিষয়ে যার অন্তর সংকীর্ণ হয়েছে, তার বিষয়ে আমাদের অন্তর প্রশস্ত হয়েছে।’’[23]

আব্দুস সামাদ ইবনু হাস্সান বলেন:


كان بين سفيان الثوري وأبى حنيفة شئ فكان أبو حنيفة أكفهما لسانا


‘‘সুফইয়ান সাওরী ও আবূ হানীফার মধ্যে বিরোধ-সমস্যা ছিল। এক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে আবূ হানীফা অধিক বাকসংযমী ছিলেন।’’[24]

ইয়াযিদ ইবনু হারূন বলেন:


ما رأيت أحداً أحلم من أبي حنيفة... إن إنساناً استطال على أبي حنيفة وقال له: يا زنديق، فقال أبو حنيفة: غفر الله لك هو يعلم مني خلاف ما تقول


‘‘আমি আবূ হানীফার চেয়ে অধিক স্থিরচিত্ত ও প্রশস্তহৃদয় আর কাউকে দেখিনি। .... একবার এক ব্যক্তি তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তাঁকে বলে: হে যিন্দীক। তিনি উত্তরে বলেন: আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন, তিনি জানেন যে তুমি যা বলেছ আমি তা নই।’’[25]
২. ৫. মৃত্যু

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ১৫০ হিজরী সালের মধ্য শাবানের রজনীতে বাগদাদের কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। বাগদাদের খাইযুরান কবরস্থানে তাঁর দাফন হয়। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বৎসর।[26]

[1] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ ওয়া আসহাবিহী, পৃ. ১৫-১৬; ইবন হাজার হাইতামী, আল-খাইরাতুল হিসান ফী মানাকিবি আবী হানীফাহ নুমান, পৃ. ৩০।

[2] সম্পাদনা পরিষদ, ইসলামী বিশ্বকোষ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৭২-১৭৭।

[3] শীরাযী, আন-নুকাতু ফিল মাসায়িলিল মুখতালাফ ফীহা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৮।

[4] ইবন খাল্লিকান, ওয়াফাইয়াতুল আ’ইয়ান, খ ৫/পৃ ৪০৬।

[5] ইবনুল আসীর, উসদুল গাবা ফী মারিফাতিস সাহাবা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৩৮৫; ইবন হাজার আসকালানী, লিসানুল মীযান, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২২৭।

[6] আইনী, বাদরুদ্দীন, মাগানীল আখইয়ার ফী শারহি আসামী মা‘আনীর আসার খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩৮-১৪০।

[7] আইনী, মাগানীল আখইয়ার, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৩৬।

[8] আইনী, মাগানীল আখইয়ার, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৪১।

[9] মিয্যী, আবুল হাজ্জাজ ইউসুফ ইবন যাকী, তাহযীবুল কামাল, খন্ড ২৯, পৃষ্ঠা ৪১৮-৪২০।

[10] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল, খন্ড ২৯, পৃষ্ঠা ৪২০-৪২২।

[11] আইনী, মাগানীল আখইয়ার, খন্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৫৪।

[12] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ, খন্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৩০-৩৩১।

[13] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ, খন্ড ১৩/৩৩১।

[14] ড. খুমাইয়িস, মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রাহমান, উসূলুদ্দীন ইনদাল ইমাম আবী হানীফা, পৃষ্ঠা ৬৬।

[15] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ৩।

[16] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ২।

[17] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃষ্ঠা ৪৮, ৪৯।

[18] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফ, পৃ. ৫০।

[19] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ খন্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৫৪।

[20] সাইমারী, আখবারু আবূ হানীফা, পৃষ্ঠা ৩১, ৩২।

[21] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ৫৭- পৃ. ৫৮।

[22] ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইনতিকা ফী ফাদায়িলিস সালাসাতিল আয়িম্মা, পৃষ্ঠা ১৭১; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ, খন্ড ১২, পৃষ্ঠা ১৬৮; খন্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩২৮; নববী, আবূ যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনু শারাফ, তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, পৃষ্ঠা ৭৯৪; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, খন্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪০১।

[23] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৫২।

[24] ইবনু আদী, আল-কামিল ৭/৬।

[25] যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৯/৩১০।

[26] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১৭১।
৩. মর্যাদা ও মূল্যায়ন: গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা

কোনো মানুষের ইমাম বা ওলী-বুজুর্গ হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তিনি নির্ভুল বা মানবীয় দুর্বলতার ঊর্দ্ধে। মানবীয় দুর্বলতায় কেউ কোনো ভুল বা অন্যায় কথা বলেছেন প্রমাণিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, তিনি ওলী বা ইমাম নন, অথবা তাঁর সব কথাই ভুল।

ইসলামী বিশ্বাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরে আর কেউই মাসূম অর্থাৎ নিষ্পাপ বা অভ্রান্ত নন। সকল আলিম, ইমাম ও ওলী মানবীয় দুর্বলতার অধীন ছিলেন। ক্রোধান্বিত হয়ে, ভুল বুঝে একে অপরের বিরুদ্ধে বলেছেন, এমনকি যুদ্ধও করেছেন। কখনো ভুল বুঝতে পারলে বা ক্রোধ দূরীভূত হলে ক্ষমা চেয়েছেন বা ভুল স্বীকার করেছেন। কখনো তিনি ভুল বুঝতে পারেন নি। তাঁরা আল্লাহর দীন, ওহীর ইলম ও সুন্নাতের পালন ও প্রচারে নিজেদের জীবন অকাতরে ব্যয় করেছেন, তাঁদের ইজতিহাদ অনুসারে যা সত্য, সঠিক বা হক্ক বলে বুঝতে পেরেছেন তা রক্ষায় কোনো আপোস করেন নি। পাশাপাশি কখনো কখনো তাঁরা ইজতিহাদে ভুল করেছেন।

মুহাদ্দিসগণ এবং জারহ-তাদীলের ইমামগণ অন্যান্য মুহাদ্দিস ও হাদীসের রাবীদের মূল্যায়নে সর্বাত্মক নিরপেক্ষতার সাথে সচেষ্ট থেকেছেন। একজন মুহাদ্দিসের বর্ণিত হাদীসগুলো অন্যান্য মুহাদ্দিসদের বর্ণনার সাথে তুলনা ও নিরপেক্ষ নিরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মূল্যায়ন করেছেন। নিজের পিতা, সন্তান বা উস্তাদের বিরুদ্ধেও তাঁরা মত ব্যক্ত করেছেন। আবার কখনো কখনো মানবীয় দুর্বলতায় আক্রান্ত হয়ে কারো অল্প ভুলকে বড় করে দেখেছেন বা কারো অনেক ভুলকে হালকা করে দেখেছেন। পূর্ববর্তী কারো সিদ্ধান্ত ভুল বা পক্ষপাতদুষ্ট হলে তা পরবর্তীগণ উল্লেখ করেছেন। হাদীস, ফিকহ, আকীদা কোনো বিষয়েই মুসলিম উম্মাহর আলিমগণ পূর্ববর্তী আলিমগণকে নিষ্পাপ বা নির্ভুল বলে গণ্য করেন নি এবং অবমূল্যায়নও করেন নি। তাঁদের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন ও শ্রদ্ধা-সহ তাঁদের কোনো সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রতীয়মান হলে তাঁরা তা উল্লেখ করেছেন। আমার লেখা ‘‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’’ এবং ‘‘বুহূসুন ফী উলূমিল হাদীস’’ পাঠ করলে পাঠক মুহাদ্দিসগণের সমালোচনার মূলনীতি জানতে পারবেন।

অনেক প্রসিদ্ধ আলিম ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে বলেছেন। আমরা তাঁদের বক্তব্য সমর্থন বা খন্ডন করব। সমর্থন অর্থ অন্ধ সমর্থন নয়। আবার খন্ডনের অর্থ এ নয় যে, আমরা উক্ত আলিমের ইলম, তাকওয়া বা খিদমতের প্রতি কটাক্ষ করছি। কক্ষনো নয়! আমরা উম্মাতের সকল আলিম, ইমাম ও বুজুর্গকে ভালবাসি। আমরা তাঁদেরকে তাঁদের ব্যক্তিত্বের জন্য নয়, বরং আল্লাহর জন্য ভালবাসি। আমরা ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম বুখারী বা অন্য কাউকে হক্ক-বাতিলের মানদন্ড হিসেবে গ্রহণ করছি না। বরং সবাইকে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। আমরা বিশ্বাস করি যে, তাঁরা ইসলামের জন্য, কুরআন ও হাদীসের ইলমের জন্য তাঁদের জীবনকে কুরবানি করেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই আমরা দীন পেয়েছি। আল্লাহ তাঁদের সকলকে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। তবে তাদের কাউকে আমরা নিষ্পাপ বা নির্ভুল মনে করি না। তাঁদের কোনো সিদ্ধান্ত ভুল বলে প্রমাণিত হলে তা উল্লেখ করায় তাঁদের অবমূল্যায়ন হয় না।

৪. দ্বিতীয় শতকের মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে আবূ হানীফা

হিজরী দ্বিতীয় শতকে মুসলিম বিশ্ব ছিল তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের বরকতময় যুগ। হাদীস, ফিকহ ও অন্যান্য সকল ইসলামী জ্ঞানে পারদর্শী ইমামগণের বিচরণে পরিপূর্ণ ছিল মক্কা, মদীনা, কুফা, বসরা, দামিশক, বাগদাদ ও সে যুগের অন্যান্য জনপদ। এ সকল প্রসিদ্ধ আলিমগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা ও প্রসিদ্ধি আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যখন আমরা দেখি যে, উমাইয়া ও আববাসীয় উভয় সরকার তাঁকে বিচারক পদে পেতে উদগ্রীব ছিল। উমাইয়া খিলাফতের শেষ দিকে, যখন ইমাম আবূ হানীফার বয়স ৫০-এর কোঠায় তখনই তাঁর প্রসিদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে ইরাকের উমাইয়া গভর্নর ইবন হুবাইরা (১৩২ হি) তাঁকে বিচারক পদ গ্রহণের জন্য পীড়াপীড়ি করেন। আববাসী খিলাফাত প্রতিষ্ঠার পর খলীফা মানসূর (রাজত্ব ১৩৬-১৫৮ হি) তাঁর খিলাফাতের মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য ইমাম আবূ হানীফাকে বিচারপতির দায়িত্ব প্রদানের জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে বাধ্য করতে চেষ্টা করেন এবং কারারুদ্ধ করেন।

দ্বিতীয় একটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আবূ হানীফার পক্ষের ও বিপক্ষের সকল মতের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও গবেষক একমত যে, ইমাম আবূ ইউসূফ (১১৩-১৮২ হি) তৎকালীন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহ, নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম মুসলিম বিশ্বে ‘‘কাযিল কুযাত’’, অর্থাৎ ‘প্রধান বিচারপতি’ উপাধি লাভ করেন। তিনজন আববাসী খলীফা মাহদী, হাদী ও হারূন রশীদের শাসনামলে প্রায় ২৪ বৎসর তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন এবং দায়িত্বরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এ যুগশ্রেষ্ঠ আলিম নিজেকে আবু হানীফার ছাত্র হিসেবে গৌরবান্বিত মনে করতেন এবং তাঁর মতের পক্ষে ফিকহী ও উসূলী অনেক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। এ থেকেও আমরা ইমাম আবূ হানীফার মর্যাদা খুব সহজেই অনুভব করতে পারি।

তৃতীয় আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। ইমাম আবূ হানীফা কূফার মানুষ ছিলেন। খলীফা মানসূরের ডাকে তিনি বাগদাদের গমন করেন। বিচারপতির দায়িত্ব পালনের বিষয়ে খলীফার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলে তাঁকে কারাগারে রাখা হয় এবং সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তৎকালীন পরিবেশে কুফা ও বাগদাদ সম্পূর্ণ পৃথক দুটি দেশের মত। এজন্য কুফায় তাঁর জনপ্রিয়তা থাকলেও বাগদাদে নবাগত ও খলীফা কর্তৃক কারারুদ্ধ এরূপ ব্যক্তির জনপ্রিয়তা থাকার কথা নয়। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর সালাতুল জানাযায় এত প্রচন্ড ভীড় হয় যে, ছয় বার তাঁর জানাযা পড়া হয়। দাফনের পর খলীফা মনসূর নিজে কবরের পাশে জানাযা পড়েন। এরপর প্রায় ২০ দিন মানুষেরা কবরের পাশে সালাতুল জানাযা আদায় করে।[1]

ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধি ও জনপ্রিয়তা তাঁর মৃত্যুর পূর্বেই তাঁর নিজ দেশ ছাড়িয়ে কিভাবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তা আমরা এ ঘটনা থেকে অনুভব করতে পারছি। এরপরও আমরা তাঁর সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ কতিপয় আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি।
(১) মুগীরাহ ইবন মিকসাম দাববী কূফী (১৩৬ হি)


ইমাম আবূ হানীফার শিক্ষক পর্যায়ের সুপ্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ মুগীরাহ ইবন মিকসাম। তিনি কুফার বাসিন্দা ছিলেন। বুখারী ও মুসলিমসহ সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বিচারপতি জারীর ইবন আব্দুল হামীদ দাববী (১৮৮ হি)। বুখারী, মুসলিম ও সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। সাইমারী, যাহাবী, ইবন হাজার ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁদের সনদে তাঁর থেকে উদ্ধৃত করেছেন:


قال لي مغيرة: جالس أبا حنيفة تفقه فإن إبراهيم النخعي لو كان حياً لجالسه. ... والله يحسن أن يتكلم في الحلال والحرام


‘‘আমাকে মুগীরাহ বলেন: তুমি আবূ হানীফার মাজলিসে বসবে, তাহলে ফিকহ শিখতে পারবে। কারণ (কুফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ, মুগীরার উস্তাদ) ইবরাহীম নাখয়ী (৯৫ হি) যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তিনিও আবূ হানীফার মাজলিসে বসতেন। ... আল্লাহর কসম! হালাল ও হারামের বিষয়ে সে ভালভাবে কথা বলার যোগ্যতা রাখে।’’[2]
(২) সুলাইমান ইবন মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৮ হি)


কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তাবিয়ী সুলাইমান ইবন মিহরান আল-আ’মাশ (১৪৮ হি)। ইমাম আবূ হানীফা তাঁর নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা করেন। তিনি অনেক সময় ইমাম আবূ হানীফাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি এ মাসআলাটি কোন দলিলের ভিত্তিতে বলেছ? আবূ হানীফা উত্তর করতেন, আপনার বর্ণিত অমুক হাদীসটির ভিত্তিতে। তখন তিনি অবাক হয়ে বলতেন,


يا معشر الفقهاء أنتم الأطباء ونحن الصيادلة


‘‘হে ফকীহগণ! তোমরা ডাক্তার আর আমরা ফার্মাসিস্ট!’’[3]

আ’মাশ যখন হজ্জে যান তখন তিনি তাঁর ছাত্র আলী ইবন মুসহিরকে বলেন, আবূ হানীফার কাছ থেকে আমাদের জন্য হজ্জের নিয়মকানুন লিখে আন। তাঁকে ফিকহী মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলতেন:


إنما يحسن الجواب فى هذا ومثله النعمان بن ثابت الخزاز وأراه بورك له فى علمه


‘‘এগুলোর উত্তর তো কেবল কাপড় ব্যবসায়ী নুমান ইবন সাবিতই বলতে পারে। আমার ধারণা তার ইলমে বরকত প্রদান করা হয়েছে।’’[4]
(৩) মিসআর ইবন কিদাম ইবন যাহীর কূফী (১৫৫ হি)


ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কুফার সুপ্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ইমাম মিসআর ইবন কিদাম। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল ইমাম তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তিনি ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে বলেন:


ما أحسد أحدا بالكوفة إلا رجلين أبو حنيفة في فقهه والحسن بن صالح في زهده ... من جعل أبا حنيفة بينه وبين الله رجوت أن لا يخاف ولا يكون فرط في الاحتياط لنفسه


‘‘কূফার দু ব্যক্তি ছাড়া কাউকে আমি ঈর্ষার যোগ্য বলে মনে করি না: আবূ হানীফাকে তাঁর ফিকহের জন্য এবং হাসান ইবন সালিহকে তাঁর যুহদের জন্য। ... যদি কোনো ব্যক্তি তার ও আল্লাহর মাঝে আবূ হানীফাকে রাখে- অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতের জন্য আবূ হানীফার ফিকহী মতের উপর নির্ভর করে- তাহলে আমি আশা করি যে, তাকে ভয় পেতে হবে না এবং সে আত্মরক্ষার সাবধানতায় অবহেলাকারী বলে গণ্য হবে না।’’[5]
(৪) শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ (১৬০ হি)


আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস নামে প্রসিদ্ধ দ্বিতীয় হিজরী শতকের জারহ-তা’দীলের শ্রেষ্ঠতম ইমাম শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ। তিনি ইমাম আবূ হানীফাকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর প্রশংসায় তিনি কবিতা পাঠ করতেন:


إذا ما الناس يوما قايسونا بآبدة من الفتوى طريفـــة
اتيناهم بمقياس صلــيب مصيب من طراز أبى حنيفة


‘‘মানুষেরা যখন আমাদেরকে কোনো কঠিন কিয়াসের ফাতওয়া দিয়ে আটকায় আমরা তখন তাদেরকে আবূ হানীফার পদ্ধতির সুদৃঢ় বিশুদ্ধ কিয়াসের শর দিয়ে আঘাত করি।’’[6]

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে শুবা বলেন:


كان والله حسن الفهم جيد الحفظ


‘‘আল্লাহর কসম! তাঁর অনুধাবন সুন্দর এবং তাঁর মুখস্থ শক্তি ভাল ছিল।’’[7]

আবূ হানীফার নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে শুবা ইবনুল হাজ্জাজের মতামত ব্যাখ্যা করে ইমাম ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (২৩৩ হি) বলেন:


هذا شعبة بن الحجاج يكتب إليه أن يحدث، وشعبة شعبة".


‘‘এই তো শুবা ইবনুল হাজ্জাজ তিনি হাদীস বর্ণনার অনুরোধ করে আবূ হানীফাকে পত্র লিখেছেন। আর শু’বা তো শু’বাই।’’[8]

ইমাম আবূ হানীফার ওফাতের খবর পেয়ে শুবা বলেন:


لقد ذهب معه فقه الكوفة تفضل الله علينا وعليه برحمته


‘‘তাঁর সাথে কূফার ফিকহও চলে গেল, আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে রহমত করুন।’’[9]


(৫) ইসরাঈল ইবন ইউনূস ইবন আবী ইসহাক সাবীয়ী (১৬০ হি)


ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও সমালোচক ইসরাঈল ইবন ইউনূস। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


كان نعم الرجل النعمان ما كان أحفظه لكل حديث فيه فقه وأشد فحصه عنه وأعلمه بما فيه من الفقه وكان قد ضبط عن حماد فأحسن الضبط عنه فأكرمه الخلفاء والأمراء والوزراء


‘‘নুমান খুবই ভাল মানুষ ছিলেন। যে সকল হাদীসের মধ্যে ফিকহ রয়েছে সেগুলি তিনি খুব ভালভাবে ও পরিপূর্ণভাবে মুখস্থ রাখতেন, সেগুলির বিষয়ে সর্বোচ্চ অনুসন্ধান করতেন এবং সেগুলির মধ্যে বিদ্যমান ফিকহী নির্দেশনাও তিনি সবেচেয়ে ভাল জানতেন। এ বিষয়ে তাঁর স্মৃতি, অনুসন্ধান ও জ্ঞান ছিল অবাক করার মত। তিনি হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান থেকে ফিকহ সংরক্ষণ করেন এবং খুব ভালভাবেই সংরক্ষণ করেন। ফলে খলীফাগণ, আমীরগণ ও উযীরগণ তাঁকে সম্মান করেছেন।’’[10]
(৬) হাসান ইবন সালিহ (১০০-১৬৯ হি)


কূফার অন্য প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী হাসান ইবন সালিহ (১০০-১৬৯ হি)। বুখারী (আদাব গ্রন্থে), মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তাঁর ছাত্র প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবন আদম (২০৩ হি) বলেন, হাসান ইবন সালিহ বলেন:


كان النعمان بن ثابت فهما عالما متثبتا فى علمه اذا صح عنده الخبر عن رسول الله ﷺ لم يعده إلى غيره


‘‘নুমান ইবন সাবিত বিজ্ঞ আলিম ছিলেন, ইলমের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ে সচেতন ছিলেন। কোনো বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে কোনো হাদীস সহীহ বলে প্রমাণিত হলে তিনি তা পরিত্যাগ করে অন্য দিকে যেতেন না।’’[11]
(৭) আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক (১১৮-১৮১ হি)


দ্বিতীয় শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, যাহিদ ও ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক খুরাসানী (১১৮- ১৮১ হি)। তিনি ইমাম আবূ হানীফার ছাত্র ছিলেন, তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং ফিকহী বিষয়ে তাঁর মত অনুসরণ করতেন। ইসমাঈল ইবন দাউদ বলেন:


كان ابن المبارك يذكر عن أبى حنيفة كل خير ويزكيه... ويثنى عليه


ইবনুল মুবারাক আবূ হানীফা সম্পর্কে সবসময়ই ভাল বলতেন, তাঁর বিশ্বস্ততা ও বুজুর্গির কথা বলতেন এবং তাঁর প্রশংসা করতেন।’’[12]

আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক বলতেন:


لا نكذب الله في أنفسنا إمامنا في الفقه أبو حنيفة وفي الحديث سفيان فإذا اتفقا لا أبالي بمن خالفهما. ... لولا أن أغاثني الله بأبي حنيفة وسفيان كنت كسائر الناس. ... أبو حنيفة أفقه الناس.


‘‘আমাদের নিজেদের বিষয়ে আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! ফিকহের বিষয়ে আমাদের ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসের বিষয়ে আমাদের ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর যখন দুজন কোনো বিষয়ে একমত হন তখন আমরা তাঁদের বিপরীতে আর কাউকে পরোয়া করি না।’’... ‘‘আল্লাহ যদি আমাকে আবূ হানীফা এবং সুফইয়ান সাওরী দ্বারা উদ্ধার না করতেন তাহলে আমি সাধারণ মানুষই থাকতাম।’’ ‘‘আবূ হানীফা মানুষদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফকীহ।’’[13]

ইমাম সুফইয়ান (ইবন সাঈদ ইবন মাসরূক) সাওরী (৯৭-১৬১ হি) ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক কূফার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফকীহ। দুজনের মধ্যে আকীদা ও ফিকহী অনেক বিষয়ে মতভেদ ছিল এবং অনেক ভুল বুঝাবুঝিও ছিল। ইবনুল মুবারক দুজনেরই ছাত্র এবং দুজনের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট তিনি এভাবে তুলে ধরেছেন।
(৮) কাযী আবূ ইউসূফ ইয়াকূব ইবন ইবরাহীম (১১৩-১৮২ হি)


আমরা বলেছি যে, আবূ ইউসূফ তাঁর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ও ফকীহ ছিলেন বলে সকলেই স্বীকার করেছেন। হাদীস বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফার জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা বর্ণনা করে তিনি বলেন:


ما رأيت أحدا أعلم بتفسير الحديث ومواضع النكت التي فيه من الفقه من أبي حنيفة ... ما خالفت أبا حنيفة في شيء قط فتدبرته إلا رأيت مذهبه الذي ذهب إليه أنجى في الآخرة وكنت ربما ملت إلى الحديث وكان هو أبصر بالحديث الصحيح مني ... إني لأدعو لأبي حنيفة قبل أبوي ولقد سمعت أبا حنيفة يقول إني لأدعو لحماد مع أبوي.


‘‘হাদীসের ব্যাখ্যায় এবং হাদীসের মধ্যে ফিকহের যে সকল নির্দেশনা রয়েছে তা অনুধাবন করায় আবূ হানীফার চেয়ে অধিক জ্ঞানী ও পারদর্শী আমি কাউকে দেখি নি। .... যে বিষয়েই আমি আবূ হানীফার সাথে বিরোধিতা করেছি সে বিষয়েই আমি পরে চিন্তা করে দেখেছি যে, আবূ হানীফার মতই আখিরাতে নাজাতের অধিক উপযোগী। অনেক সময় আমি হাদীসের দিকে ঝুঁকে পড়েছি, কিন্তু তিনি সহীহ হাদীসের বিষয়ে আমার চেয়ে অধিক সমঝদার ছিলেন। .... আমি আমার পিতামাতার জন্য দুআ করার আগে আবূ হানীফার জন্য দুআ করি। আর আমি শুনেছি, আবূ হানীফা বলতেন, আমি আমার পিতামাতার সাথে হাম্মাদের জন্য দুআ করি।’’[14]
(৯) ফুদাইল ইবন ইয়াদ (১৮৭ হি)


তৎকালীন সময়ের অন্যতম প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, সমালোচক ও বুজুর্গ ইমাম ফুদাইল ইবন ইয়াদ খুরাসানী মাক্কী (১৮৭হি)। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন:


كان أبو حنيفة رجلا فقيها معروفا بالفقه مشهورا بالورع واسع المال معروفا بالأفضال على كل من يطيف به صبورا على تعليم العلم بالليل والنهار حسن الليل كثير الصمت قليل الكلام حتى ترد مسألة في حلال أو حرام فكان يحسن ان يدل على الحق هاربا من مال السلطان ... وكان إذا وردت عليه مسألة فيها حديث صحيح أتبعه وإن كان عن الصحابة والتابعين وإلا قاس وأحسن القياس.


‘‘আবূ হানীফা সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ছিলেন। তাঁর তাকওয়া ছিল অতি প্রসিদ্ধ। তিনি সম্পদশালী ছিলেন এবং বদান্যতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। রাতদিন সার্বক্ষণিক ইলম শিক্ষা দানে তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। রাতের ইবাদতে মাশগুল থাকতেন। অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন এবং কম কথা বলতেন। তবে যখন হালাল-হারামের কোনো মাসআলা তাঁর কাছে আসত তখন তিনি কথা বলতেন এবং খুব ভালভাবেই হক্ক প্রমাণ করতে পারতেন। তিনি শাসকদের সম্পদ থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। ... যখন তাঁর কাছে কোনো মাসআলা আসত তখন তিনি সে বিষয়ে সহীহ হাদীস থাকলে তা অনুসরণ করতেন, অথবা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মত। তা না হলে তিনি কিয়াস করতেন এবং তিনি সুন্দর কিয়াস করতেন।’’[15]
(১০) হাফস ইবন গিয়াস (১৯৫হি)


কূফার অন্য একজন প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও ফকীহ হাফস ইবন গিয়াস নাখয়ী কূফী (১৯৫হি) তিনি প্রথমে কূফা ও পরে বাগদাদের কাযীর দায়িত্ব পালন করেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


كلام أبي حنيفة في الفقه أدق من الشعر لا يعيبه إلا جاهل.


‘‘ফিকহের বিষয়ে আবূ হানীফার বক্তব্য চুলের চেয়েও সুক্ষ্ম। জাহিল-মুর্খ ছাড়া কেউ তাঁকে খারাপ বলে না।’’[16]
(১১) আবূ মুআবিয়া দারীর মুহাম্মাদ ইবন খাযিম (১১৩-১৯৫ হি)


কূফার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবন খাযিম আবূ মুআবিয়া দারীর। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


حب أبي حنيفة من السنة


‘‘সুন্নাতপন্থী হওয়ার একটি বিষয় আবূ হানীফাকে ভালবাসা।’’[17]
(১২) ইয়াহইয়া ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (১৯৭ হি)


শুবা ইবনুল হাজ্জাজের পরে দ্বিতীয় শতকের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্যতম দুই দিকপাল: ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ আল-কাত্তান ও ইবন মাহদী। উভয়েই বসরার অধিবাসী ছিলেন। কাত্তান বলেন:


لا نكذب الله ما سمعنا أحسن من رأى أبى حنيفة، وقد أخذنا بأكثر أقواله. قال يحيى بن معين: وكان يحيى بن سعيد يذهب في الفتوى إلى مذهب (قول) الكوفيين ويختار قوله من أقوالهم ويتبع رأيه من بين أصحابه.


‘‘আল্লাহকে মিথ্যা বলব না! আবূ হানীফার মতের চেয়ে উত্তম মত আমি শুনি নি। অধিকাংশ বিষয়ে আমরা তাঁর মত অনুসরণ করি। (তাঁর ছাত্র) ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন: ইয়াহইয়া ইবন সায়ীদ ফাতওয়ার বিষয়ে কূফীদের মাযহাব অনুসরণ করতেন, কূফীদের মধ্য থেকে আবূ হানীফার বক্তব্য পছন্দ করতেন এবং তাঁর মত অনুসরণ করতেন।’’[18]
(১৩) ওকী ইবনুল জার্রাহ ইবন মালীহ (১৯৭ হি)


কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ওকী ইবনুল জার্রাহ। ইমাম আহমদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও হাফিযুল হাদীস বলে গণ্য করেছেন। তাঁর ছাত্র ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন বলেন:


ما رأيت أحدا أقدمه على وكيع، وكان يفتي برأي أبي حنيفة، وكان يحفظ حديثه كله، وكان قد سمع من أبي حنيفة حديثا كثيرا.


আমি ওকী-এর উপরে স্থান দেওয়ার মত কোনো মুহাদ্দিস দেখি নি। তিনি আবূ হানীফার মত অনুসারে ফাতওয়া দিতেন। তিনি তাঁর সব হাদীস মুখস্থ রাখতেন। তিনি আবূ হানীফা থেকে অনেক হাদীস শুনেন।[19]

এ থেকে জানা যায় যে, ইমাম ওকী শুধু ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মতই অনুসরণ করতেন না, উপরন্তু তিনি তাঁকে হাদীসের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করতেন এবং তাঁর সকল হাদীস মুখস্থ রাখতেন।
(১৪) আব্দুর রাহমান ইবন মাহদী (১৩৫-১৯৮ হি)


এ সময়ের ইলম হাদীস ও জারহ-তাদীলের অন্য দিকপাল ইবন মাহদী। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ লিখেছেন, আমি আমার পিতার মুখে শুনেছি, তাঁর উস্তাদ ইবন মাহদী বলতেন:


من حسن علم الرجل أن ينظر في رأي أبي حنيفة


‘‘একজন মানুষের ইলমের সৌন্দর্য এই যে, সে আবূ হানীফার ‘রায়’ বা মাযহাব অধ্যয়ন করবে।’’[20]

[1] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪৪৪; আইনী, মাগানীল আখইয়ার ৫/১৬৫।

[2] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ৭৯; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৪০৩; তারীখুৃল ইসলাম ৯/৩১২।

[3] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ২৭; বাজী, সুলাইমান ইবন খালাফ, আত-তা’দীলু ওয়াত- তাজরীহ ১/২৮; ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৭।

[4] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১২৬; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩;

[5] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৯।

[6] ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৭-৯।

[7] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ২৩।

[8] মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪১৭-৪৪৪; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯০-৪০৩; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪০১-৪০২।

[9] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা ১/১২৬-১২৭।

[10] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৯।

[11] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১২৮।

[12] ইবন আব্দুল বার্র, আল-ইনতিকা, পৃ. ১৩৩।

[13] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফা, পৃ. ১৪০; খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৩৭; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯৮।

[14] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৪০; সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ২৫।

[15] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩৪০।

[16] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩।

[17] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৪০১; তারীখুল ইসলাম ৯/৩১০।

[18] দূরী, তারীখ ইবন মায়ীন ৩/৫১৭; ৪/২৮৩; মিয্যী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪১৭-৪৪৪; যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৬/৩৯০-৪০৩; ইবন আদী, আল-কামিল ৭/৯; ইবন হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪০১-৪০২।

[19] ইবন আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলম ২/২৯০-২৯১; আল-ইনতিকা, পৃ. ১৩৬।

[20] আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, আস-সুন্নাহ ১/১৮০।

এ যুগের আরো অনেক ফকীহ, মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ থেকে ইমাম আবূ হানীফার প্রশংসা বর্ণিত। আমরা এখানে শুধু প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীলের ইমামগণের বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম। এ থেকে আমরা দেখলাম যে, তাঁর সমসাময়িক, তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন বা জেনেছেন এমন সকল ফকীহ, মুহাদ্দিস, আবিদ ও আলিম তাঁর যোগ্যতা ও মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁর ফিকহী মতের অসাধারণত্বের পাশাপাশি হাদীসের বর্ণনায় তাঁর নির্ভরযোগ্যতা ও ফিকহী হাদীসসমূহে তাঁর পান্ডিত্য ও হাদীসের ফিকহী নির্দেশনা অনুধাবনে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার সাক্ষ্য তাঁরা দিয়েছেন।

এ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কেউ দুটি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন: (১) ফিকহী বিষয়ে গভীর মনোযোগের কারণে তিনি কম হাদীস বর্ণনা করেন এবং (২) কিছু ফিকহী বিষয়ে তৎকালীন কতিপয় ফকীহের সাথে তাঁর মতভেদ ছিল।
৫. ১. হাদীসের ময়দানে তাঁর পদচারণা কম


উম্মাতের ফকীহগণ হাদীস বর্ণনার চেয়ে হাদীসের আলোকে ফিকহী মাসআলা নির্ধারণের জন্য সদা চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। পক্ষান্তরে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের সনদ ও মতনের শব্দ, বাক্য, বর্ণনার পার্থক্য, এগুলির হুবহু বর্ণনা ইত্যাদি নিয়ে সদা চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। এজন্য ফকীহগণ হাদীস বর্ণনা করতেন কম। মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো এ বিষয়ে ফকীহগণকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করতেন। ইমাম আবূ হানীফা প্রসঙ্গে ইবনুল মুবারাকের নিম্নের কথাটিও এ জাতীয়:


كان أبو حنيفة مسكينا في الحديث


‘‘আবূ হানীফা হাদীসের বিষয়ে মিসকীন ছিলেন।’’[1]

ইবনুল মুবারাকের এ কথাটিকে অনেকেই হাদীস বর্ণনায় আবূ হানীফার দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য মোটেও তা নয়। সুফইয়ান ইবন উয়াইনা (১৯৮ হি) বলেন:


كنا إذا رأينا طالبا للحديث يغشى ثلاثة ضحكنا منه ربيعة ومحمد بن أبي بكر بن حزم وجعفر بن محمد، لانهم كانوا لا يتقنون الحديث ولا يحفظونه.


‘‘আমরা যখন কোনো হাদীসের ছাত্রকে তিন ব্যক্তির কারো কাছে যেতে দেখতাম তখন আমরা হাসতাম: রাবীয়াহ, মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর ইবন হাযম, জাফর ইবন মুহাম্মাদ; কারণ তারা কেউই হাদীস ভাল পারতেন না এবং মুখস্থও রাখতেন না।’’[2]

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক এ তিন ফকীহের পরিচয় দেখুন:

(১) মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম রাবীয়াহ ইবন আবী আব্দুর রাহমান ফার্রূখ (১৪২ হি)। তিনি ‘‘রাবীয়াহ আর-রাই’’ অর্থাৎ কিয়াসপন্থী রাবীয়াহ বলে প্রসিদ্ধ। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে নির্ভরযোগ্য রাবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

(২) মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও মদীনার কাযী মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন হাযম (৬০-১৩২ হি)। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

(৩) ইমাম জাফর সাদিক ইবন মুহাম্মাদ বাকির (৮০-১৪৮)। নবী-বংশের অন্যতম ইমাম ও মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ। ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, এ তিনজনকেই মুহাদ্দিসগণ নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। ইবনুল মুবারাক তো ইমাম আবূ হানীফাকে মিসকীন বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে দুর্বল বলেন নি। পক্ষান্তরে সুফইয়ান ইবন উয়াইনা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ‘এরা তিনজন হাদীস ভাল পারতেন না এবং মুখস্থ রাখতে পারতেন না।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুহাদ্দিসগণ তাঁর কথাকে এঁদের দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করলেন না কেন?

কারণ এ কথার অর্থ হলো, এ তিনজন মূলত ফিকহ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁরা কম হাদীস জানতেন। ফিকহী হাদীসগুলি নিয়েই তাঁরা বেশি সময় কাটাতেন। এছাড়া ফিকহী ব্যস্ততার কারণে হাদীসের সনদ ও মতন রাতদিন চর্চা করার সময় তাঁদের হতো না। ফলে মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁরা এক্ষেত্রে কিছু বেশি ভুল করতেন।

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাকের কথার অর্থ হুবহু এক। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ইবনুল মুবারাক বারবার বলেছেন যে, ফিকহে তাঁর ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসে তাঁর ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর এ অর্থেই তিনি বলেছেন যে, মুহাদ্দিসগণের তুলনায় তিনি হাদীস কম জানতেন বা কম বলতেন। কাজেই ইবনুল মুবারাকের এ বক্তব্যকে যারা ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার সাক্ষ্য বলে গণ্য করেছেন তারা বিষয়টি ভুল বুঝেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ আমাদেরকে ও উম্মাতের সকল আলিমকে ক্ষমা করুন।
৫. ২. ফিকহ ও আকীদা বিষয়ে তাঁর মতের বিরোধিতা


সে যুগের অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহের সাথে ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মতপার্থক্য ছিল। পাশাপাশি আকীদার খুটিনাটি কয়েকটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল। এগুলির অন্যতম ঈমানের সংজ্ঞা। অধিকাংশ মুহাদ্দিস আমলকে ঈমানের অংশ গণ্য করতেন। পক্ষান্তরে কিছু মুহাদ্দিস ও ফকীহ আমলকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক গণ্য করতেন। ইমাম আবূ হানীফা ছিলেন এদের মধ্যে। অনেক মুহাদ্দিস ও ফকীহ এজন্য তাঁকে ‘মুরজিয়া’ বলে কটাক্ষ করেছেন।

সমসাময়িক যারা এভাবে তাঁর প্রতি কটাক্ষ করেছেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন (১) কুফার তাবিয়ী মুহাদ্দিস শরীক ইবন আব্দুল্লাহ (১৪০ হি), (২) কুফার তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম সুফইয়ান সাওরী (৯৭-১৬১ হি), এবং (৩) সিরিয়ার প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম আওযায়ী (১৫৭ হি)। তাঁরা এবং আরো কতিপয় সমসাময়িক ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ। এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে ২য় শতকের এ সকল মুহাদ্দিস বা ফকীহের খুব কম বক্তব্যই সহীহ বা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। সমসাময়িক আলিমদের এরূপ মতবিরোধ বা শত্রুতা খুবই স্বাভাবিক। প্রসিদ্ধ চার ইমাম এবং সকল প্রসিদ্ধ আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহের বিষয়েই এরূপ কঠিন বিরূপ মন্তব্য করেছেন তৎকালীন কোনো কোনো প্রসিদ্ধ আলিম।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম যে, ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক ও নিকটবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুহাদ্দিস, আবিদ, ও জারহ-তাদীলের সমালোচক ইমামগণ তাঁকে ফিকহের ইমাম, শ্রেষ্ঠতম ফকীহ এবং হাদীস বর্ণনায় বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর ফিকহী মত সহীহ হাদীস নির্ভর বলেও তাঁরা বারবার মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি কয়েকজন আলিম তাঁকে মুরজিয়া বলেছেন বা তাঁর ফিকহী মতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

এ জাতীয় বিরূপ মন্তব্য সম্ভবত খুবই কম ছিল অথবা তৎকালীন মুসলিমদের মধ্যে তা কোনোরূপ গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। কারণ, বাস্তবে আমরা দেখি যে, ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মত হাদীস ও ফিকহের সে স্বর্ণযুগে দ্রুত প্রসার লাভ করে। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ দিক থেকেই হানাফী ফিকহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত ফিকহী মতে পরিণত হয়। এ বিষয়ে কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ সুফইয়ান ইবন উয়াইনা (১০৭-১৯৮ হি) বলেন:


شيئان ما ظننتهما يجاوزان قنطرة الكوفة: قراءة حمزة، وفقه أبي حنيفة، وقد بلغا الآفاق


‘‘দুটি বিষয়ে আমি কল্পনা করি নি যে, তারা কুফার সেতু পার হবে; হামযার কিরাআত ও আবূ হানীফার ফিকহ; অথচ ইতোমধ্যেই এ দুটি বিষয় সকল দিগন্তে পৌঁছে গিয়েছে।’’[3]

[1] ইবন আবী হাতিম, আল-জারহ ওয়াত তাদীল ২/১/৪৫০

[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৯১; তারীখুল ইসলাম ৮/৪২৩; ইবন মানযূর, মুখতাসার তারীখ দিমাশক ৩/১৪৭।

[3] যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৯/৩১২।
৬. তৃতীয় শতাব্দীর প্রথমাংশের সমালোচকদের মূল্যায়ন

এ ছিল হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ পর্যন্ত ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে আলিমগণের অভিমত ও তাঁর ফিকহী মতের প্রসারতা। কিন্তু হিজরী তৃতীয় শতক থেকে চিত্র পরিবর্তন হতে লাগল। এ সময় থেকে অনেক আলিম ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠিন অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগের ধারা শতাব্দীর পর শতাব্দী চলতে থাকে। বস্ত্তত মুসলিম উম্মাহর প্রসিদ্ধ ইমামগণের মধ্যে ইমাম আবূ হানীফা যত আক্রমণ ও চরিত্র হননের শিকার হয়েছেন তেমন বোধ হয় অন্য কেউ হন নি। এ বিষয়ে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ইয়াহইয়া ইবন মায়ীন (২৩৩ হি) বলেন:

أصحابنا يفرطون في أبي حنيفة وأصحابه.

আমাদের সাথীরা, অর্থাৎ মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফা ও তাঁর সাথীদের বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করেন।’’[1]

কেন এ সীমালঙ্ঘন তা পর্যালোচনার আগে ইমাম আবূ হানীফা সম্পর্কে তৃতীয় শতকের প্রথমাংশের বা প্রথম দশকের কয়েকজন মুহাদ্দিস, ফকীহ ও সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন আলোচনা করব।
(১) ইমাম শাফিয়ী মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস (১৫০-২০৪ হি)


ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইদরীস শাফিয়ী ইমাম আবূ হানীফার পরের শ্রেষ্ঠতম ফকীহ। দ্বিতীয় হিজরী শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বিভিন্ন উসূলী ও ফিকহী বিষয়ে তিনি ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর ছাত্রদের মতামত প্রত্যাখ্যান করেন। ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবূ হানীফার শ্রেষ্ঠত্ব ও গুরুত্ব বিষয়ে তিনি বলেন:


الناس في الفقه عيال على أبي حنيفة.


‘‘ফিকহের ক্ষেত্রে মানুষেরা আবূ হানীফার উপর নির্ভরশীল।’’[2]
(২) ইয়াযিদ ইবন হারূন (১১৭-২০৬ হি)


এ সময়ের প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী মুহাদ্দিস ও আবিদ ইয়াযিদ ইবন হারূন ওয়াসিতী। ইমাম আহমদ তাঁকে হাফিযুল হাদীস বলতেন। ইবনুল মাদীনী বলেন, তাঁর চেয়ে বড় হাফিযুল হাদীস আমি দেখি নি। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য সকল মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


كان أبو حنيفة تقيا نقيا زاهدا عالما صدوق اللسان أحفظ أهل زمانه سمعت كل من أدركته من أهل زمانه يقول إنه ما رأى أفقه منه


‘‘আবূ হানীফা আল্লাহ-ভীরু, পবিত্র ও সংসারবিরাগী আলিম ছিলেন। তিনি সত্যপরায়ণ এবং তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় হাফিযে হাদীস ছিলেন। তাঁর যুগের যত মানুষকে আমি পেয়েছি সকলকেই বলতে শুনেছি: তিনি ফিকহের বিষয়ে আবূ হানীফার চেয়ে অধিক পারদর্শী আর কাউকে দেখেন নি।’’[3]
(৩) আব্দুল্লাহ ইবন দাউদ আল-খুরাইবী (১২৬-২১৩ হি)


দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রসিদ্ধ নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিস ও আবিদ আবূ আব্দুর রাহমান আব্দুল্লাহ ইবন দাউদ ইবন আমির কূফী। ইমাম বুখারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর বর্ণনা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন:


من أراد ان يخرج من ذل العمى والجهل ويجد لذة الفقه فلينظر في كتب أبي حنيفة. ما يقع في أبي حنيفة إلا حاسد أو جاهل. ينبغي للناس أن يدعوا في صلاتهم لابي حنيفة، لحفظه الفقه والسنن عليهم.


‘‘যদি কেউ অন্ধত্ব ও মুর্খতার লাঞ্ছনা থেকে বের হতে চায় এবং ফিকহের স্বাদ লাভ করতে চায় তবে তাকে আবূ হানীফার বইগুলো পড়তে হবে। হিংসুক অথবা জাহিল এ দুয়ের একজন ছাড়া কেউ আবূ হানীফার বিষয়ে মন্দ বলে না। মানুষদের উচিত তাদের সালাতের মধ্যে আবূ হানীফার জন্য দুআ করা; কারণ তিনিই মানুষদের জন্য ফিকহ এবং সুন্নাহ (হাদীস) সংরক্ষণ করেছেন।’’[4]

[1] ইবন আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদলিহী ২/২৯০।

[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩।

[3] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৪৮।

[4] সাইমারী, আখবারু আবী হানীফাহ, পৃ. ৮৫; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০২; ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১০/১১৪।
৭. ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষাপট

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, তৃতীয় শতকে ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে প্রচারণা ব্যাপকতা লাভ করে। বিশেষত মুতাযিলী শাসনের অবসানের পরে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়। বাহ্যত এর কারণগুলি নিম্নরূপ:
৭. ১. প্রসারতা ও ক্ষমতার ঈর্ষা

আমরা আগেই বলেছি যে, তাবিয়ী যুগের অন্য কোনো ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার মত প্রসিদ্ধি ও মর্যাদা লাভ করেন নি। তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর মত প্রসিদ্ধি লাভ করে। আববাসী খলীফা মাহদীর যুগ (১৫৮-১৬৯হি) থেকে হানাফী ফিকহ রাষ্ট্রীয় ফিকহে পরিণত হয়। এ ফিকহে পারদর্শীগণই বিভিন্ন বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। পরবর্তী শতাব্দীর পর শতাব্দী এ নেতৃত্বের ও কর্তৃত্বের ধারা অব্যাহত থাকে। হানাফী বিরোধীদের ক্ষোভ এতে বাড়তে থাকে এবং তাঁদের বৈরী প্রচারণাও ব্যাপক হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ প্রচারণা হানাফী ফিকহের বিরুদ্ধে না হয়ে ব্যক্তি আবূ হানীফার চরিত্র হননের দিকে ধাবিত হয়।
৭. ২. মুতাযিলী ফিতনা ও সম্পৃক্তি

২০০ হিজরীর দিকে আববাসী খলীফা মামুন (রাজত্ব ১৯৮-২১৮ হি) মুতাযিলী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তী খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ (২১৮-২২৭ হি) ও ওয়াসিক বিল্লাহ (২২৮-২৩২ হি) এ মতবাদ অনুসরণ করেন। গ্রীক দর্শন নির্ভর এ মতবাদে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের সাথে সুস্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন বিশ্বাস বিদ্যমান। এ সকল বিশ্বাসের মধ্যে রয়েছে ‘‘কুরআন সৃষ্ট বা মাখলূক’’। এ ছাড়া মুতাযিলীগণ আল্লাহর ‘‘বিশেষণগুলো’’ ব্যাখ্যা করে অস্বীকার করেন। এ মত প্রতিষ্ঠায় এ তিন খলীফা ছিলেন অনমনীয়। এ মত গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আলিমদেরকে গ্রেফতার করে তাঁরা অবর্ণনীয় অত্যাচার করতে থাকেন। পরবর্তী শাসক মুতাওয়াক্কিল (২৩২-২৪৭ হি) এ অত্যাচারের অবসান ঘটান। সকলেই স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও পালনের সুযোগ পান।

প্রায় ত্রিশ বৎসরের মুতাযিলী শাসনের সময়ে স্বভাবতই প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায় হানাফী ফকীহগণ ছিলেন। তাঁদের অনেকেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মুতাযিলীদের সাথে সহযোগিতা করেছেন বা তাদের মত গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষত খলীফা মামুনের মুতাযিলী ফিতনার মূল স্থম্ভ বিশর আল-মারীসী: বিশর ইবন গিয়াস ইবন আবী কারীমা আব্দুর রাহমান (২১৮ হি) এবং বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুওয়াদ (আবী দাউদ) ইবন জারীর (১৬০-২৪০ হি) উভয়েই ফিকহী মতে ইমাম আবূ হানীফার অনুসারী হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন। মুতাযিলী মতের প্রচার-প্রসার, দেশের সকল আলিমকে খলীফার দরবারে ডেকে মুতাযিলী মত গ্রহণে বাধ্য করা এবং ইমাম আহমদ ও মুতাযিলা মতবিরোধী অন্যান্য প্রসিদ্ধ ইমামগণের উপর নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের মূল হোতা ছিলেন তাঁরা।[1]

মুতাযিলী অত্যাচারের অবসানের পরেও হানাফী ফকীহগণ বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। এছাড়া মুতাযিলীগণ ‘হানাফী’ নামের ছত্রছায়ায় তাদের মত প্রচার করতে থাকেন। অপরদিকে হানাফী বিরোধীগণ আহলুস সুন্নাতের নামে, বিদআত বিরোধিতা বা মুতাযিলী বিরোধিতার নামে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন। অনেকে এ বিষয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নিতে থাকেন। অনেক সরলপ্রাণ প্রাজ্ঞ আলিমও এরূপ অপপ্রচারে প্রভাবিত হন।
৭. ৩. বিচার ও শাসন বনাম ইলম ও কলম

আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ দিক থেকেই হানাফী ফিকহ রাষ্ট্রীয় ফিকহে পরিণত হয়। হানাফী ফকীহগণ ফিকহ ও বিচারিক দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তৃতীয় হিজরী শতক থেকে হাদীস চর্চায় হানাফী ফকীহগণের সম্পৃক্তি কমতে থাকে। এছাড়া ফিকহী বিষয়ে অতিরিক্ত মনোসংযোগের কারণে হাদীস বিষয়ে তাদের দুর্বলতা বাড়তে থাকে। এভাবে তাদের সাথে মুহাদ্দিসগণের দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে।
৭. ৪. মাযহাবী গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ

চতুর্থ হিজরী শতক থেকে মাযহাবী গোঁড়ামি ও বিদ্বেষ ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। এ সময়ে তিনটি মাযহাব প্রসিদ্ধ ছিল: হানাফী, মালিকী ও শাফিয়ী। মালিকী মাযহাব উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে বিস্তার লাভ করে। মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র মিসর, ইরাক ও পারস্যে হানাফী-শাফিয়ী দ্বন্ধ ব্যাপক রূপ গ্রহণ করে। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও প্রসারতা ছিল হানাফীদের বেশি। কিন্তু হাদীস চর্চা ও লিখনীতে শাফিয়ীগণ অগ্রগামী ছিলেন। মুহাদ্দিসগণের মধ্যে শাফিয়ী মাযহাব প্রসার লাভ করে। কোনো কোনো মুহাদ্দিস হানাফীদের ‘ঘায়েল’ করার জন্য তাদের ইমামকে ছোট করতে চেষ্টা করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে সত্য, মিথ্যা, জাল-বানোয়াট সবকিছু সংকলন করেন।

এ প্রচারণার কারণে তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি থেকে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে তাঁর প্রতি কঠোর আপত্তি ও বিদ্বেষের ভাব জন্ম নিতে থাকে। এ সময়ে ‘‘আহলুস সুন্নাহ’’ ও মুহাদ্দিসদের মধ্যে বিদ্যমান অনুভূতি অনেকটা নিম্নরূপ: যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীস অস্বীকার করত!! হাদীসের বিপরীতে নিজের মত দিয়ে দীন তৈরি করত!!! সকল বিদআতী আকীদার প্রচারক ছিল!! সে কিভাবে এত প্রসিদ্ধি লাভ করল? তার মত কেন এত প্রসার লাভ করল? কোনো অজুহাতেই তাকে সহ্য করা যায় না!!!!

হানাফীগণ এ সকল অভিযোগ খন্ডন করেছেন। তবে মুহাদ্দিসগণের সাথে দূরত্বের কারণে তাঁদের মধ্যে তা তেমন প্রভাব বিস্তার করে নি। এছাড়া হানাফীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে অনেক সময় ইলমী প্রতিবাদের চেয়ে শক্তির প্রতিবাদ বেশি জোরদার হয়েছে। কখনো বা ইমামের বিরুদ্ধে অভিযোগ খন্ডন করতে যেয়ে প্রতিপক্ষকে ছোট করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। কখনো তাঁর মর্যাদা প্রমাণ করার নামে তাঁর নামে প্রচলিত সবকিছু নির্ভুল ও নির্বিচারে গ্রহণযোগ্য বলে দাবি করা হয়েছে। পক্ষের-বিপক্ষের সকলেই আবেগ ও বাড়াবাড়িতে আক্রান্ত হয়েছেন।

আমরা জানি, ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বলা আর তাঁর অন্ধ অনুসরণকে হক্ক বলা এক নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বলার অর্থ তাঁকে নিষ্পাপ বা নির্ভুল বলা নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে ভাল বলতে যেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যারা আপত্তিকর কথা বলেছেন তাদেরকে মন্দ বলাও ঠিক নয়। ইমাম আবূ হানীফাকে হক্ক বাতিলের মাপকাঠি বানিয়ে দেওয়াও ঠিক নয়।

এভাবে অভিযোগ ও প্রতিবাদ প্রক্রিয়া মাযহাবী আক্রোশের গন্ডি থেকে বের হতে পারে নি। হিজরী ৫ম শতক থেকে অন্য মাযহাবের কতিপয় আলিম এ সব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। এদের অন্যতম প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুল বার্র (৩৬৮-৪৬৩ হি)। তিনি ‘‘আল-ইন্তিকা ফী ফাদায়িলিল আয়িম্মাতিস সালাসাহ’’ নামক গ্রন্থে তিন ইমাম: আবূ হানীফা, মালিক ও শাফিয়ীর মর্যাদা ব্যাখ্যা করেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার জ্ঞানবৃত্তিকভাবে খন্ডন করেন।

পরবর্তীকালে অন্যান্য মাযহাবের কতিপয় ফকীহ, মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও জারহ-তাদীল বিশেষজ্ঞ নিরপেক্ষ বিচার ও পর্যালোচনার চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ও মুজতাহিদ শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া আহমদ ইবন আব্দুল হালীম (৬৬১-৭২৮ হি), তাঁর তিন ছাত্র: প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইউসূফ ইবন আব্দুর রাহমান, আবুল হাজ্জাজ আল-মিয্যী (৬৫৪-৭৪২ হি), প্রসিদ্ধ শাফিয়ী-হাম্বালী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম যাহাবী: মুহাম্মাদ ইবন আহমদ (৬৭৩-৭৪৮ হি), প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকহী ও মুহাদ্দিস আবুল ফিদা ইসমাঈল ইবন উমার ইবন কাসীর (৭০১-৭৭৪ হি) এবং অষ্টম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবন হাজার আসকালানী: আহমদ ইবন আলী (৭৭৩-৮৫২ হি)।

[1] কুরাশী, আব্দুল কাদির ইবন আবিল ওয়াফা, তাবাকাতুল হানাফিয়্যাহ: আল-জাওয়াহিরুল মুদীআহ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১১৭, ১৬৪-১৬৬; গায্যী (তাকীউদ্দীন ইবন আব্দুল কাদির তামীমী), তারাজিমুল হানাফিয়্যাহ: আত-তাবাকাতুস সানিয়্যাহ, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৮৫।
৮. ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ সংকলন

তৃতীয় হিজরী শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমতে থাকে। অনেকেই এ সকল অভিযোগ সংকলন করেছেন। তাঁদের অন্যতম:
৮. ১. আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ ইবন হাম্বাল (২১৩-২৯০ হি)


ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ (রাহিমাহুমাল্লাহু) তৃতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ আলিম। তিনি ‘আস-সুন্নাহ’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থের বিষয় ‘‘আহলুস সুন্নাত’’ বা ‘‘সুন্নী’’ আকীদা ব্যাখ্যা করা। এ গ্রন্থের প্রথম দিকের একটি অধ্যায়: (ما حفظت عن أبي وغيره من المشايخ في أبي حنيفة): ‘‘আবূ হানীফার বিষয়ে আমি আমার পিতা ও অন্যান্য মাশায়িখ থেকে যা মুখস্থ করেছি।’’ এ অধ্যায়ে তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের বিভিন্ন আবিদ, ফকীহ ও মুহাদ্দিস থেকে ইমাম আবূ হানীফার নিন্দায় ১৮২টি বক্তব্য সংকলন করেছেন। এ সকল বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য তাঁর আকীদার বিভ্রান্তি ও তাঁর দীন ও ইলম সম্পর্কে কটাক্ষ।
৮. ২. খতীব বাগদাদী (৩৯২- ৪৬৩ হি)


৫ম হিজরী শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ঐতিহাসিক ও শাফিয়ী ফকীহ আহমদ ইবন আলী খতীব বাগদাদী (রাহ)। ফিকহ, হাদীস, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর রচিত অনেক গ্রন্থ এখনো ইলমুল হাদীস, জারহ-তাদীল ও ইতিহাস বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর অন্যতম তথ্যসূত্র। তাঁর রচিত ‘‘তারীখ বাগদাদ’’ গ্রন্থে তিনি বাগদাদের ইতিহাস ছাড়াও বাগদাদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় ৮ হাজার মানুষের জীবনী সংকলন করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় জীবনী ইমাম আবূ হানীফার ১৩১ পৃষ্ঠা ব্যাপী। প্রথমে প্রায় ১২ পৃষ্ঠা তিনি তাঁর জীবনী আলোচনা করেন। এরপর প্রায় ৩৫ পৃষ্ঠা তিনি ইমাম আবূ হানীফার প্রশংসায় পূর্ববর্তী আলিমদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। এরপর প্রায় ৮৫ পৃষ্ঠা ব্যাপী তিনি ইমাম আবূ হানীফার নিন্দায় বর্ণিত পূর্ববর্তী আলিমদের বক্তব্য সংকলন করেন। এ সকল বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য ইমাম আবূ হানীফার আকীদার ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি, ফিকহী দুর্বলতা এবং ব্যক্তিগত চরিত্র হনন।[1]

আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, খতীব বাগদাদী ও অন্যান্যদের সংকলিত এ সকল অভিযোগ ও নিন্দা সম্পর্কে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

(ক) সনদ যাচাই ছাড়া এ বক্তব্যগুলো গ্রহণ করলে একজন মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন যে, ইমাম আবূ হানীফার মত ইসলামের এত বড় শত্রু ও এত বড় বিভ্রান্ত মানুষ বোধহয় কখনোই জন্ম গ্রহণ করেন নি!! শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া বলেন, যারা মুসলিম উম্মাহর কোনো ইমামের বিরুদ্ধে এ সকল কথা বলেন তারা মূলত মুসলিম উম্মাহকেই বিভ্রান্ত বলে প্রমাণ করতে চান। আমরা তাঁর বক্তব্য পরে আলোচনা করব।

(খ) এ সকল বর্ণনার অধিকাংশই সনদ বিচারে জাল, বাতিল বা অত্যন্ত দুর্বল। এমনকি ইমাম ইবন হিববান ও খতীব বাগদাদী নিজে যাদেরকে জালিয়াত বলে উল্লেখ করেছেন, তাদের অনেকের বর্ণনা এক্ষেত্রে সংকলন করেছেন।

(গ) দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতকের ফকীহ বা মুহাদ্দিসদের যে বক্তব্যগুলো সনদ বিচারে গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয় সেগুলোর অধিকাংশ মূলত তাঁর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আলিমের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ প্রকাশ। যেমন, তিনি কাফির, ইসলামের শত্রু, ইসলাম ধ্বংস করতেন, তিনি অভিশপ্ত, ক্রীতদাস ইত্যাদি। এগুলো মূলত আবূ হানীফা নুমান ইবন সাবিতের মর্যাদাহানী করে নি; বরং যারা এসব কথা বলেছেন তাদের ঈমানী, ইসলামী ও আখলাকী দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।

(ঘ) ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়: (১) আকীদা বিষয়ক, (২) হাদীস বিষয়ক এবং (১) ফিকহ বিষয়ক।

[1] খতীব বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ ১৩/৩২৩-৪৫৩।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৫৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 23 24 25 26 পরের পাতা »