আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)

এ যুগের আরো অনেক ফকীহ, মুহাদ্দিস ও বুজুর্গ থেকে ইমাম আবূ হানীফার প্রশংসা বর্ণিত। আমরা এখানে শুধু প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুহাদ্দিস ও জারহ-তাদীলের ইমামগণের বক্তব্য উদ্ধৃত করলাম। এ থেকে আমরা দেখলাম যে, তাঁর সমসাময়িক, তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন বা জেনেছেন এমন সকল ফকীহ, মুহাদ্দিস, আবিদ ও আলিম তাঁর যোগ্যতা ও মর্যাদার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁর ফিকহী মতের অসাধারণত্বের পাশাপাশি হাদীসের বর্ণনায় তাঁর নির্ভরযোগ্যতা ও ফিকহী হাদীসসমূহে তাঁর পান্ডিত্য ও হাদীসের ফিকহী নির্দেশনা অনুধাবনে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার সাক্ষ্য তাঁরা দিয়েছেন।

এ সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কেউ দুটি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন: (১) ফিকহী বিষয়ে গভীর মনোযোগের কারণে তিনি কম হাদীস বর্ণনা করেন এবং (২) কিছু ফিকহী বিষয়ে তৎকালীন কতিপয় ফকীহের সাথে তাঁর মতভেদ ছিল।
৫. ১. হাদীসের ময়দানে তাঁর পদচারণা কম


উম্মাতের ফকীহগণ হাদীস বর্ণনার চেয়ে হাদীসের আলোকে ফিকহী মাসআলা নির্ধারণের জন্য সদা চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। পক্ষান্তরে মুহাদ্দিসগণ হাদীসের সনদ ও মতনের শব্দ, বাক্য, বর্ণনার পার্থক্য, এগুলির হুবহু বর্ণনা ইত্যাদি নিয়ে সদা চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। এজন্য ফকীহগণ হাদীস বর্ণনা করতেন কম। মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো এ বিষয়ে ফকীহগণকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করতেন। ইমাম আবূ হানীফা প্রসঙ্গে ইবনুল মুবারাকের নিম্নের কথাটিও এ জাতীয়:


كان أبو حنيفة مسكينا في الحديث


‘‘আবূ হানীফা হাদীসের বিষয়ে মিসকীন ছিলেন।’’[1]

ইবনুল মুবারাকের এ কথাটিকে অনেকেই হাদীস বর্ণনায় আবূ হানীফার দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য মোটেও তা নয়। সুফইয়ান ইবন উয়াইনা (১৯৮ হি) বলেন:


كنا إذا رأينا طالبا للحديث يغشى ثلاثة ضحكنا منه ربيعة ومحمد بن أبي بكر بن حزم وجعفر بن محمد، لانهم كانوا لا يتقنون الحديث ولا يحفظونه.


‘‘আমরা যখন কোনো হাদীসের ছাত্রকে তিন ব্যক্তির কারো কাছে যেতে দেখতাম তখন আমরা হাসতাম: রাবীয়াহ, মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর ইবন হাযম, জাফর ইবন মুহাম্মাদ; কারণ তারা কেউই হাদীস ভাল পারতেন না এবং মুখস্থও রাখতেন না।’’[2]

ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক এ তিন ফকীহের পরিচয় দেখুন:

(১) মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম রাবীয়াহ ইবন আবী আব্দুর রাহমান ফার্রূখ (১৪২ হি)। তিনি ‘‘রাবীয়াহ আর-রাই’’ অর্থাৎ কিয়াসপন্থী রাবীয়াহ বলে প্রসিদ্ধ। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁকে নির্ভরযোগ্য রাবী হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

(২) মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ ও মদীনার কাযী মুহাম্মাদ ইবন আবী বাকর ইবন মুহাম্মাদ ইবন আমর ইবন হাযম (৬০-১৩২ হি)। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

(৩) ইমাম জাফর সাদিক ইবন মুহাম্মাদ বাকির (৮০-১৪৮)। নবী-বংশের অন্যতম ইমাম ও মদীনার সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ। ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস তাঁর হাদীস গ্রহণ করেছেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, এ তিনজনকেই মুহাদ্দিসগণ নির্ভরযোগ্য বলে গণ্য করেছেন। ইবনুল মুবারাক তো ইমাম আবূ হানীফাকে মিসকীন বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে দুর্বল বলেন নি। পক্ষান্তরে সুফইয়ান ইবন উয়াইনা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ‘এরা তিনজন হাদীস ভাল পারতেন না এবং মুখস্থ রাখতে পারতেন না।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও মুহাদ্দিসগণ তাঁর কথাকে এঁদের দুর্বলতা বা অগ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করলেন না কেন?

কারণ এ কথার অর্থ হলো, এ তিনজন মূলত ফিকহ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁরা কম হাদীস জানতেন। ফিকহী হাদীসগুলি নিয়েই তাঁরা বেশি সময় কাটাতেন। এছাড়া ফিকহী ব্যস্ততার কারণে হাদীসের সনদ ও মতন রাতদিন চর্চা করার সময় তাঁদের হতো না। ফলে মুহাদ্দিসদের তুলনায় তাঁরা এক্ষেত্রে কিছু বেশি ভুল করতেন।

ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাকের কথার অর্থ হুবহু এক। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ইবনুল মুবারাক বারবার বলেছেন যে, ফিকহে তাঁর ইমাম আবূ হানীফা এবং হাদীসে তাঁর ইমাম সুফইয়ান সাওরী। আর এ অর্থেই তিনি বলেছেন যে, মুহাদ্দিসগণের তুলনায় তিনি হাদীস কম জানতেন বা কম বলতেন। কাজেই ইবনুল মুবারাকের এ বক্তব্যকে যারা ইমাম আবূ হানীফার দুর্বলতার সাক্ষ্য বলে গণ্য করেছেন তারা বিষয়টি ভুল বুঝেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। আল্লাহ আমাদেরকে ও উম্মাতের সকল আলিমকে ক্ষমা করুন।
৫. ২. ফিকহ ও আকীদা বিষয়ে তাঁর মতের বিরোধিতা


সে যুগের অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহের সাথে ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মতপার্থক্য ছিল। পাশাপাশি আকীদার খুটিনাটি কয়েকটি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মতভেদ ছিল। এগুলির অন্যতম ঈমানের সংজ্ঞা। অধিকাংশ মুহাদ্দিস আমলকে ঈমানের অংশ গণ্য করতেন। পক্ষান্তরে কিছু মুহাদ্দিস ও ফকীহ আমলকে ঈমানের অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক গণ্য করতেন। ইমাম আবূ হানীফা ছিলেন এদের মধ্যে। অনেক মুহাদ্দিস ও ফকীহ এজন্য তাঁকে ‘মুরজিয়া’ বলে কটাক্ষ করেছেন।

সমসাময়িক যারা এভাবে তাঁর প্রতি কটাক্ষ করেছেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন (১) কুফার তাবিয়ী মুহাদ্দিস শরীক ইবন আব্দুল্লাহ (১৪০ হি), (২) কুফার তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম সুফইয়ান সাওরী (৯৭-১৬১ হি), এবং (৩) সিরিয়ার প্রসিদ্ধ তাবি-তাবিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইমাম আওযায়ী (১৫৭ হি)। তাঁরা এবং আরো কতিপয় সমসাময়িক ফকীহ ইমাম আবূ হানীফার বিষয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা ক্রোধ ও ক্ষোভের প্রকাশ। এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে ২য় শতকের এ সকল মুহাদ্দিস বা ফকীহের খুব কম বক্তব্যই সহীহ বা নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। সমসাময়িক আলিমদের এরূপ মতবিরোধ বা শত্রুতা খুবই স্বাভাবিক। প্রসিদ্ধ চার ইমাম এবং সকল প্রসিদ্ধ আলিম, মুহাদ্দিস ও ফকীহের বিষয়েই এরূপ কঠিন বিরূপ মন্তব্য করেছেন তৎকালীন কোনো কোনো প্রসিদ্ধ আলিম।

উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম যে, ইমাম আবূ হানীফার সমসাময়িক ও নিকটবর্তী যুগের প্রসিদ্ধ ফকীহ, মুহাদ্দিস, আবিদ, ও জারহ-তাদীলের সমালোচক ইমামগণ তাঁকে ফিকহের ইমাম, শ্রেষ্ঠতম ফকীহ এবং হাদীস বর্ণনায় বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর ফিকহী মত সহীহ হাদীস নির্ভর বলেও তাঁরা বারবার মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি কয়েকজন আলিম তাঁকে মুরজিয়া বলেছেন বা তাঁর ফিকহী মতের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

এ জাতীয় বিরূপ মন্তব্য সম্ভবত খুবই কম ছিল অথবা তৎকালীন মুসলিমদের মধ্যে তা কোনোরূপ গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। কারণ, বাস্তবে আমরা দেখি যে, ইমাম আবূ হানীফার ফিকহী মত হাদীস ও ফিকহের সে স্বর্ণযুগে দ্রুত প্রসার লাভ করে। হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষ দিক থেকেই হানাফী ফিকহ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত ফিকহী মতে পরিণত হয়। এ বিষয়ে কূফার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ সুফইয়ান ইবন উয়াইনা (১০৭-১৯৮ হি) বলেন:


شيئان ما ظننتهما يجاوزان قنطرة الكوفة: قراءة حمزة، وفقه أبي حنيفة، وقد بلغا الآفاق


‘‘দুটি বিষয়ে আমি কল্পনা করি নি যে, তারা কুফার সেতু পার হবে; হামযার কিরাআত ও আবূ হানীফার ফিকহ; অথচ ইতোমধ্যেই এ দুটি বিষয় সকল দিগন্তে পৌঁছে গিয়েছে।’’[3]

[1] ইবন আবী হাতিম, আল-জারহ ওয়াত তাদীল ২/১/৪৫০

[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৯১; তারীখুল ইসলাম ৮/৪২৩; ইবন মানযূর, মুখতাসার তারীখ দিমাশক ৩/১৪৭।

[3] যাহাবী, তারীখুল ইসলাম ৯/৩১২।