সাফিয়্যাহর সঙ্গে বিবাহ (الزَّوَاجُ بِصَفِيَّةَ):

পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, সাফিয়্যাহর স্বামী কিনানাহ বিন আবিল হুক্বাইক্ব স্বীয় অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে মুসলিমগণের হাতে নিহত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী সাফিয়্যাহকে বন্দী মহিলাদের দলভুক্ত করা হয়। এরপর যখন এ বন্দী মহিলাদের একত্রিত করা হয় তখন দাহয়াহ বিন খলীফা কালবী (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর নাবী! বন্দী মহিলাদের থেকে আমাকে একটি দাসী প্রদান করুন।’

নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏خُذْ جَارِيَةً مِّنَ السَّبِيِّ غَيْرِهَا‏)‏ ‘তাদের মধ্য থেকে একজনকে মনোনীত করে নিয়ে যাও।’ তিনি সেখানে গিয়ে তাদের মধ্যে থেকে সাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াইকে মনোনীত করেন। এ প্রেক্ষিতে এক ব্যক্তি নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! বনু কুরাইযাহ ও বনু নাযীর গোত্রের সাইয়েদা সাফিয়্যাহকে আপনি দাহয়াহর হাতে সমর্পণ করলেন, অথচ সে শুধু আপনার জন্য শোভনীয় ছিল।

নাবী (ﷺ) বললেন, ‘সাফিয়্যাহসহ দেহয়াকে এখানে আসতে বল।’

দাহয়াহ যখন সাফিয়্যাহকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হলেন তখন তিনি বললেন, ‘বন্দী মহিলাদের মধ্য থেকে তুমি অন্য একজনকে দাসী হিসেবে গ্রহণ কর।’

অতঃপর নাবী (ﷺ) নিজে সাফিয়্যাহর নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁকে মুক্ত করে দিয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। তাঁর এ মুক্ত করাকে বিবাহে তাঁর জন্য মাহর নির্ধারণ করা হয়।

মদীনা প্রত্যাবর্তন কালে সাদ্দে সাহবা নামক স্থানে পৌঁছলে সাফিয়্যাহ (রাঃ) হালাল হয়ে গেলেন। তখন উম্মু সুলাইম (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর জন্য তাঁকে সাজগোজ ও শৃঙ্গার সহকারে প্রস্তুত করে দিলেন এবং বাসর রাত্রি যাপনের জন্য প্রেরণ করলেন। দুলহা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সকাল পর্যন্ত অবস্থান করলেন। অতঃপর খেজুর, ঘী এবং ছাতু একত্রিত করে ওয়ালীমা খাওয়ালেন এবং রাস্তায় দুলহা দুলহানের রাত্রি যাপন হিসেবে তিন দিন তাঁর সঙ্গে অবস্থান করলেন।[1] ঐ সময় নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর মুখমণ্ডলের উপর শ্যামল চিহ্ন দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কী?

তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার খায়বার আগমনের পূর্বে আমি স্বপ্নযোগে দেখেছিলাম যে, চাঁদ তার কক্ষচ্যুত হয়ে এসে পড়ল আমার কোলের উপর। আল্লাহ তা‘আলাভ জানেন, আপনার সম্পর্কে আমার কোন কল্পনাও ছিল না। কিন্তু আমার স্বামীর নিকট যখন এ স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করলাম তখন তিনি আমার মুখে এক চপেটাঘাত করে বললেন, ‘মদীনার বাদশাহর প্রতি তোমার মন আকৃষ্ট হয়েছে।[2]

[1] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৪ পৃঃ, ২য় খন্ড ৬০৪-৬০৬ পৃঃ,, যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৭ পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৭ পৃঃ, ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩৬ পৃঃ।
বিষাক্ত বকরির ঘটনা (أَمْرُ الشَّاةِ الْمَسْمُوْمَةِ):

খায়বার বিজয়ের পর যখন রাসূলে কারীম (ﷺ) নিরাপদ হলেন এবং তৃপ্তিবোধ করলেন তখন সালাম বিন মুশরিকের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারিস উপঢৌকন হিসেবে বকরির ভূনা মাংস তাঁর নিকট প্রেরণ করে। সে বিভিন্ন সূত্র থেকে জিজ্ঞাসার মাধ্যমে জেনে নিয়েছিল যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বকরির মাংসের কোন কোন অংশ অধিক পছন্দ করেন। তাকে বলা হয়েছিল যে, তিনি রানের মাংস অধিক পছন্দ করেন। এ জন্য সে রানের মাংসগুলো ভাল ভাবে বিষ মিশ্রিত করেছিল এবং অবশিষ্ট অন্যগুলোতেও বিষ প্রয়োগ করেছিল। অতঃপর সে মাংসগুলো নাবী কারীম (ﷺ)-এর সামনে এনে রাখা হলে নাবী কারীম (ﷺ) রানের মাংসের টুকরোটি উঠিয়ে তার কিছু অংশ চিবুনোর পর মুখ থেকে বের করে তা ফেলে দিলেন এবং বললেন,‏ (‏إِنَّ هٰذَا الْعَظْمُ لَيُخْبِرُنِيْ أَنَّهُ مَسْمُوْمٍ‏)‏‘এ হাড্ডি আমাকে বলছে যে এর সঙ্গে বিষ মিশ্রিত করা হয়েছে।’

এরপর নাবী কারীম (ﷺ) যায়নাবকে ডাকিয়ে নিয়ে তাকে যখন বিষয়টি জিজ্ঞেস করলেন তখন সে বিষ প্রয়োগের কথা স্বীকার করল। তিনি তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এমন কাজ করলে কেন? সে উত্তরে বলল, ‘আমি চিন্তা করলাম যে, এ ব্যক্তি যদি বাদশাহ হন তাহলে আমরা তাঁর থেকে নিস্কৃতি লাভ করব, আর যদি তিনি নাবী হন তাহলে তাঁকে এ সংবাদ জানিয়ে দেয়া হবে এবং তিনি বেঁচে যাবেন। তার এ কথা শুনে নাবী কারীম (ﷺ) তাকে ক্ষমা করলেন। এ সময় নাবী (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিলেন বিশর বিন বারা’ বিন মারুর (রাঃ)। তিনি এক গ্রাস গিলে ফেললেন। ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।

এ মহিলাকে নাবী (ﷺ) ক্ষমা করেছিলেন কিংবা হত্যা করেছিলেন সে ব্যাপারে বর্ণনাকারীগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। মত পার্থক্যের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) প্রথমে মহিলাকে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু যখন বিশর (রাঃ)-এর মৃত্যু সংঘটিত হয়ে গেল তখন তাকে হত্যার বিনিময়ে হত্যা করা হল।[1]

[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৩৯-১৪০ পঃ, ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৯৭ পৃঃ, মূল ঘটনা সহীহুল বুখারীতে বিস্তারিত এবং সংক্ষিপ্ত দুভাবে বর্ণিত হয়েছে ১ম খন্ড ৪৪৯ পৃঃ, ২য় ৬১০ ও ৮৬০ পৃ: ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩৭ ও ৩৩৮ পৃঃ।
খায়বার যুদ্ধে দু’দলের প্রাণহানি (قَتْلٰى الْفَرِيْقَيْنِ فِيْ مَعَارِكِ خَيْبَرَ):

খায়বারের বিভিন্ন সংঘর্ষে সর্ব মোট শহীদ মুসলিমগণের সংখ্যা ছিল ষোল জন। বনু কুরাইশের চার জন, বনু আশজা’র এক জন, বনু আসলামের এক জন, খায়বার অধিবাসীদের মধ্যে হতে এক জন এবং বাকীরা অন্যান্য আনসার গোত্রের। তাছাড়া আঠার জনের কথাও বলা হয়ে থাকে। আল্লামা মানসুরপুরী ঊনিশ জনের কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি লিখেছেন যে, আমি অন্বেষণ করে তেইশ জনের নাম পেয়েছি। যানীফ বিন ওয়ায়েলার নাম শুধু ওয়াক্বিদী উল্লেখ করেছেন। তাবারী বলেছে্ন শুধু যানীফ বিন হাবীবের নাম। বিশর বিন বারা বিন মারুরের মৃত্যু হয়েছিল যুদ্ধশেষে সে বিষ মিশ্রিত মাংস খাওয়ার ফলে যা যায়নাব ইহুদীয়া পাঠিয়েছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট উপঢৌকনস্বরূপ। বিশর বিন আব্দুল মুনযির সম্পর্কে দুটি বর্ণনা রয়েছে। ১. তিনি বদর যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, ২. খায়বার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। আমার মতে প্রথম মতটি অধিক শক্তিশালী ও সমর্থনযোগ্য।[1] অন্য পক্ষ অর্থাৎ ইহুদীগণের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল তিরানব্বই।

[1] রহমাতুল্লিল আলামীন ২য় খন্ড ২৬৮-২৭০ পৃঃ।

খায়বারে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য মুহায়্যিসা বিন মাসউদকে ফাদাক অঞ্চলে ইহুদীদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন। ফাদাকবাসীগণ মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে প্রথমত ইসলাম গ্রহণের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করে নি। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যখন খায়বারের ইহুদীদের উপর মুসলিমগণকে বিজয় দান করলেন তখন তারা মনে প্রাণে ভীত হয়ে পড়ল এবং রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর নিকট লোক পাঠিয়ে খায়বারবাসীগণের চুক্তির অনুরূপ ফাদাকের উৎপাদনের অর্ধেক দেয়ার প্রতিশ্রুতিসহ সন্ধিচুক্তির প্রস্তাব করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সানন্দে এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন যার ফলে অত্যন্ত সহজভাবে ফেদাকের উপর মুসলিমগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। এ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিমগণকে ঘোড়া, উট কিংবা তরবারীর ব্যবহার করতে হয় নি।[1]

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৩৭ ও ৩৫৩ পৃঃ।

খায়বার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মনের দিক দিয়ে যখন কিছুটা মুক্ত হলেন তখন ওয়াদিল কুরা বা কুরা উপত্যকায় গমন করলেন। সেখানে ইহুদীদের একটি দলের বসবাস ছিল। এক পর্যায়ে আরবদের একটি দল গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

মুসলিমগণ যখন কোরা উপত্যকায় অবতরণ করলেন তখন ইহুদীগণ তাঁদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে আক্রমণ করল। তারা পূর্ব হতেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। তাদের এ আক্রমণে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একজন দাস মৃত্যুমুখে পতিত হল। লোকজনেরা বললেন, ‘তার জন্য জান্নাত বরকতময় হোক। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,

(‏كَلَّا، وَالَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ، إِنَّ الشَّمْلَةَ الَّتِيْ أَخَذَهَا يَوْمَ خَيْبَرَ مِنْ الْمَغَانِمِ، لَمْ تُصِبْهَا الْمَقَاسِمَ، لَتَشْتَعِلُ عَلَيْهِ نَارًا‏)

‘কখনই না। সে সত্তার শপথ! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন, খায়বার যুদ্ধে এ ব্যক্তি যুদ্ধ লব্ধ মাল হতে বন্টনের পূর্বেই যে চাদর খানা চুরি করেছিল তা আগুনে পরিবর্তিত হয়ে ওর জন্য দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) এ কথা শুনে একটি ফিতা, দুটি ফিতা কিংবা যিনি যে জিনিস গোপনে নিয়ে গিয়েছিলেন সে সব রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর খিদমতে এনে হাজির করলেন। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏شِرَاكٌ مِّنْ نَّارٍ أَوْ شِرَاكَانِ مِنْ نَّارٍ‏)‏‏ ‘এ একটি কিংবা দুটি ফিতা ছিল আগুনের।’’[1]

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের উপযোগী সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ করলেন। সমগ্র বাহিনীর পতাকা সা‘দ বিন উবাদাহর হাতে সমর্পণ করলেন। একটি পতাকা দিলেন হুবাব বিন মুনযিরকে এবং তৃতীয় পতাকা দিলেন উবাদাহ বিন বিশরকে। এরপর ইহুদীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। এ দাওয়াত গ্রহণ না করে তাদের এক ব্যক্তি যুদ্ধের জন্য ময়দানে অবতরণ করল। আল্লাহর নাবী (ﷺ)-এর পক্ষে যুবাইর বিন ‘আউওয়াম (রাঃ) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করলেন। অতৎপর ইহুদীদের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। যুবাইর (রাঃ) তাকেও হত্যা করলেন। এরপর তাদের পক্ষ থেকে তৃতীয় ব্যক্তি ময়দানে অবতরণ করলেন। এর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আলী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে হত্যা করলেন। এভাবে একে একে তাদের ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। যখন একজন নিহত হতো তখন নাবী কারীম (ﷺ) অবশিষ্ট ইহুদীগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

ঐ দিন যখন সালাতের সময় হতো তখন সাহাবাদের নিয়ে নাবী কারীম (ﷺ) সালাত পড়তেন। সালাতের পর পুনরায় ইহুদীদের সামনে ফিরে যেতেন এবং তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন।

এভাবে যুদ্ধ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন সকালে পুনরায় গমন করলেন। তখনো সূর্য বর্শা বরাবর উপরে ওঠেনি এমন সময় তাদের হাতে যা কিছু ছিল তা সম্পূর্ণ নাবী কারীম (ﷺ)-এর হাতে সমর্পণ করে দিল। অর্থাৎ নাবী (ﷺ) শক্তি দিয়ে বিজয় অর্জন করেন এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পদসমূহের সবটুকুই নাবী কারীম (ﷺ)-এর হাতে গণীমত হিসেবে প্রদান করেন। বহু সাজ-সরঞ্জামাদি সাহাবীগণ (রাযি.)-এর হস্তগত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওয়াদিল কুরা নামক স্থানে চার দিন অবস্থান করেন এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সাহাবীগণ (ﷺ)-এর মধ্যে বন্টন করে দেন। তবে জমিজমা খেজুরের বাগানগুলো ইহুদীদের হাতেই ছেড়ে দেন এবং খায়বারবাসীগণের অনুরূপ ওয়াদিল কোরাবাসীগণের সঙ্গেও একটি চুক্তি সম্পাদন করেন।[2]

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬০৮ পৃঃ।

[2] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৬ পৃঃ।

তাইমার ইহুদীগণ যখন খায়বার, ফাদাক এবং ওয়াদিল কুরার অধিবাসীদের পরাভূত হওয়ার খবর পেল তখন তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে শক্তির মহড়া প্রদর্শন ছাড়াই সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দূত প্রেরণ করল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের সন্ধি প্রস্তাব গ্রহণ করে সম্পদাদি সহ বসবাসের অনুমতি দেন।[1] অতঃপর তাদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন যার ভাষা ছিল নিম্নরূপ:

‘এ দলিল লিখিত হল আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ থেকে বনু আদিয়ার জন্য। তাদের উপর কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হল এবং মুসলিমগণ তাদের জিম্মাদা হলেন। তাদের উপর কোন প্রকার অন্যায় করা হবে না এবং দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করা হবে না। রাত্রি হবে তাদের সাহায্যকারী এবং দিন হবে পূর্ণতা প্রদান কারী (অর্থাৎ এ চুক্তি হবে স্থায়ী ব্যবস্থা) এ চুক্তি লিপিবদ্ধ করেন খালিদ বিন সাঈদ।[2]

[1] যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৭ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৪০ পৃঃ। এ ঘটনা বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ এবং সাধারণ হাদীস পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৭ পৃঃ।
মদীনা প্রত্যবর্তন (الْعَوْدَةُ إِلَى الْمَدِيْنَةِ):

তাইমায়াবাসীগণের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর নাবী কারীম (ﷺ) মদীনা প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। প্রত্যাবর্তনকালে লোকজনেরা একটি উপত্যকার নিকট পৌঁছে সকলে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকেন ‏(‏اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ‏)‏ ‘আল্লাহ আকবর, আল্লাহ আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। তা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‏(‏إِرْبَعُوْا عَلٰى أَنْفُسِكُمْ، إِنَّكُمْ لاَ تَدْعُوْنَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا، إِنَّكُمْ تَدْعُوْنَ سَمِيْعًا قَرِيْبًا‏)‏‏ ‘স্বীয় আত্মার প্রতি কোমলতা প্রদর্শন কর। তোমরা কোন বধির কিংবা অনুপস্থিতকে আহবান করছ না, বরং সে সত্তাকে আহবান করছ যিনি শ্রবণ করছেন এবং নিকটে রয়েছেন।[1]

পথ চলার সময় একবার রাত্রি বেলা দীর্ঘ সময় যাবত চলার পর রাত্রির শেষভাগে পথের মধ্যে কোন এক জায়গায় শিবির স্থাপন করলেন এবং শয্যা গ্রহণের সময় বিলাল (রাঃ)-কে এ বলে তাগাদা দিয়ে রাখলেন যে, ‘রাত্রিতে আমাদের প্রতি খেয়াল রেখ (অর্থাৎ প্রত্যুষে আমাদের জাগিয়ে দিও)।’ কিন্তু বিলাল (রাঃ) ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তিনি পূর্ব দিকে মুখ করে নিজ সওয়ারীর উপর হেলান দিয়ে বসেছিলেন এবং সে ভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। রাত্রি শেষে সকলের গায়ে রোদের অাঁচ লাগলেও কেউই ঘুম থেকে জাগতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সর্ব প্রথম ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং সকলকে ঘুম থেকে জাগ্রত করেন। নাবী (ﷺ) সে উপত্যকা হতে বাহির হয়ে সামনের দিকে কিছুদূর অগ্রসর হন। অতঃপর লোকজনদের ফজরের সালাতের ইমামত। বলা হয়ে থাকে যে, এ ঘটনাটি অন্য কোন সফরে ঘটেছিল।[2]

খায়বার সংঘর্ষের বিস্তারিত বিবরণাদি লক্ষ্য করলে জানা যায় যে, নাবী কারীম (ﷺ)-এর মদীনা প্রত্যাবর্তন হয় ৭ম হিজরী সফর মাসের শেষ ভাগে কিংবা রবিউল আওয়াল মাসে।

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৬০৫ পৃঃ।

[2] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৩৪০ পৃঃ। এ ঘটনা বিশেষ ভাবে প্রসি্দ্ধ এবং সাধারণ হাদীস পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে। যাদুল মা‘আদ ২য় খন্ড ১৪৭ পৃঃ।
সারিয়্যায়ে আবান বিন সা’ঈদ (سَرِيَّةُ أبَانِ بْنِ سَعِيْدٍ):

সেনাধ্যক্ষগণের তুলনায় নাবী কারীম (ﷺ) অধিক গুরুত্বের সঙ্গে এ কথা বলতেন, যে হারাম মাসগুলো শেষ হওয়ার পর মদীনাকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রাখা কোন ক্রমেই দূরদর্শিতা কিংবা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মদীনার আশেপাশে এমন সব বেদুঈনদের অবস্থান ছিল যারা লুটতরাজ এবং ডাকাতি করার জন্য সব সময় মুসলিমগণের অমনোযোগিতাজনিত সুযোগের অপেক্ষায় থাকত। এ কারণে তাঁর খায়বার অভিযানের প্রাক্কালে বেদুঈনদের ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আবান বিন সাঈদের (রাঃ) নেতৃত্বে নাজদের দিকে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। আবান বিন সাঈদ তার উপর আরোপিত দায়িত্ব পালন শেষে প্রত্যাবর্তন করলে খায়বারে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়। ঐ সময় খায়বার বিজয় পর্ব শেষ হয়েছিল। অধিকতর বিশুদ্ধ তথ্য হচ্ছে, অভিযান ৭ম হিজরীর সফর মাসে প্রেরণ করা হয়েছিল। সহীহুল বুখারীতে এর উল্লেখ রয়েছে।[1] হাফেজ ইবনু হাজার লিখেছেন, ‘এ অভিযানের অবস্থা আমি জানতে পারিনি।’’[2]

[1] সহীহুল বূখারী যুদ্ধের অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য, ২য় খন্ড ৬০৮-৬০৯ পৃঃ।

[2] ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৪৯১ পৃঃ।
দেখানো হচ্ছেঃ ২১ থেকে ২৮ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3