বর্ণিত ক্ষেত্রে মুসলিমদের পদস্খলনের কারণ:

প্রথম কারণ: উসীলা গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলিমদের একটি বিরাট অংশের এই দুঃখজনক পদস্খলনের অন্যতম কারণ হলো ‘তাকলীদ’। তাকলীদ অর্থ হলো, কারো এমন কোনো কথার অনুসরণ করা, যার পক্ষে বক্তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এই ধরনের অনুসরণ শরী‘আতে নিষিদ্ধ। আর মুকাল্লিদ হলো, ঐ ব্যক্তি যে কোনো সুনির্দিষ্ট আলিম অনুসরণ করে ও তার মতামতের বাইরে যায় না। যদিও শরী‘আতের প্রমাণাদি তার মতামতের বিপরীত হয়।

আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের অনুসরণের নিন্দা করেছেন। আর আল-কুরআনের বহু আয়াতে তা থেকে নিষেধ করেছেন,

﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ بَلۡ نَتَّبِعُ مَآ أَلۡفَيۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ أَوَلَوۡ كَانَ ءَابَآؤُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَايَهۡتَدُونَ ١٧٠﴾ [البقرة: ١٧٠]

“আর যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন, তার অনুসরণ করো, তারা বলে, ‘না, আমরা বরং অনুসরণ করি তার, যার ওপর আমাদের পিতৃপুরুষদের দেখেছি। তারা কি তাদের পিতৃপুরুষদের (অন্ধ) অনুসরণ করবে, যদিও তারা ছিল অজ্ঞ এবং পথনির্দেশ কিছুই গ্রহণ করে নি?” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৭০]

পূর্ববর্তী বিজ্ঞ আলিম সমাজ ও মুজতাহিদগণও অন্ধ তাকলীদ করতে নিষেধ করে গেছেন। কারণ, অন্ধ তাকলীদ মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক দ্বন্ধ ও দুর্বলতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যে কোনো বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তি। এ কারণেই আমরা সাহাবীদের মধ্যে কাউকেই যাবতীয় বিষয়ে কোনো বিশেষ কারো অনুসরণ করতে দেখি না। তদ্রূপ চার ইমামের কাউকেও তাদের কাছে ভিন্ন কোনো মতের সত্যতা প্রকাশের পর নিজের মতের ওপরই অবিচল থাকতেও দেখি না। নিজেদের মতের বিপরীত যদি হাদীসের কোনো প্রমাণ তারা পেতেন, তো নির্বিবাদে তা গ্রহণ করে নিতেন। তাছাড়া অন্যদেরকেও তারা কোনো দলীল-প্রমাণ না বুঝে অন্ধের মতো তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করতেন। তারা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত বাণীটি সম্পর্কে সম্মকরূপে অবগতই ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [الاعراف: ٣]

“তোমাদের রবের কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অনুসরণ করো। আর তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই মনে রাখো।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩]

দ্বিতীয় কারণ: এই ভ্রষ্টতার দ্বিতীয় কারণ হলো, আয়াতে কুরআন বা হাদীসে রাসূলের কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জন। এর ফলে তারা নিজেদের মতামতের পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ পেশ করতে তো সক্ষম হচ্ছেই না, বরং ক্ষেত্র বিশেষে কুরআনের সঠিক মর্ম ও তাফসীরও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয়াতের প্রকৃত মর্ম থেকে সরে গিয়ে সুদূরতম কোনো অপব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেদের মত প্রমাণের অপচেষ্টা করছে। সে রকমই একটি আয়াত হলো:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائ‍دة: ٣٥]

“ওহে যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করো এবং তার দিকে উসীলা অন্বেষণ করো”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩৫]

এখানে উসীলা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এমন আমল দ্বারা তার নৈকট্য অর্জন করা। এ তাফসীর বিষয়ে তাফসীরবিদদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এখন এই আয়াত দিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার বৈধতা দানের চেষ্টা করা মূল বিষয় থেকে ‘তাহরীফ’ তথা কুরআনের মর্ম বিকৃতির চেষ্টা ছাড়া আর কী হতে পারে? তাহলে বুঝা গেল যে আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যে উসীলার নির্দেশ দিয়েছেন তা হচ্ছে, সৎকাজ ও যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এমন কাজের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য প্রার্থনা করা। এ তাফসীরের ব্যাপারে তাফসীরকারগণের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।

অনুরূপভাবে আরও যে বিশুদ্ধ হাদীসটি বুঝার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে তা হচ্ছে, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দো‘আর উসীলা গ্রহণের বিষয়টি, যার বর্ণনা পূর্বে চলে গেছে। প্রতিপক্ষ এ সম্পর্কে বলতে চায়, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণেই উমার তার উসীলা গ্রহণ করেছিলেন। তাদের উত্তরে আমরা বলবো, মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যে বৃষ্টির জন্য ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ আল-জুরাশীর মতো ব্যক্তির উসীলা গ্রহণ করেছিলেন, সেটা কোন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে? অথচ জুরাশী দো‘আও করেছিলেন এবং সেই দো‘আ কবুলও হয়েছিল এবং আল্লাহ বৃষ্টিও বর্ষণ করেছিলেন।

আরো আছে, এক অন্ধের হাদীস। যেই অন্ধ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তার জন্য দো‘আর আবেদন করে বলেছিলো, ‘আপনি আমার জন্য দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে সুস্থতা দান করেন।’ জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘তুমি চাইলে আমি দো‘আ করবো, আর চাইলে তুমি ধৈর্যও ধারণ করতে পারো। সেটাই হবে তোমার জন্য উত্তম।’ লোকটি বললো, আপনি আমার জন্য দো‘আই করুন। ফলে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তমরূপে অযু করে আসতে বললেন। তারপর এইভাবে দো‘আ করতে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার রহমতের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বারা আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি। হে মুহাম্মদ! আমি আপনার দ্বারা আমার প্রয়োজন পূরণের জন্য আমার রবের সামনে মুখ ফিরাচ্ছি। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ ফলে লোকটি এমনভাবে ফিরে আসলো যে, তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে।

এই হাদীসের মর্ম খুবই স্পষ্ট। লোকটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার জন্য দো‘আ করার আবেদন জানিয়েছে এবং পাশাপাশি আল্লাহর কাছে এই দো‘আও করেছে, যেন তিনি তাঁর রাসূলের দো‘আ কবুল করেন। কারণ লোকটি বলেছিল, “হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করুন”।

তৃতীয় কারণ: এই জাতীয় ভ্রষ্টতার তৃতীয় কারণ হলো, দুর্বল ও বানোয়াট হাদীসের ওপর আমল। যে হাদীসগুলোর কোনো ভিত্তি নেই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মূল দ্বীনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে আমরা তার দু’একটি উল্লেখ করছি:

যেমন, একটি হাদীস এরকম বলা হয়, ‘তোমরা আমার উচ্চ মর্যাদার উসীলা গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমার মর্যাদা অনেক সুউচ্চ।’

আরেকটি হাদীস এ রকম বর্ণনা করা হয়েছে, ‘আদম আ. যখন ভুল করে ফেললেন, তিনি আল্লাহর নিকট এই বলে ক্ষমা চাইলেন, ‘হে রব! আমি আপনার নিকট মুহাম্মাদের উসীলা দিয়ে ক্ষমা চাইছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন তাকে বলা হলো, আমি তো মুহাম্মাদকে সৃষ্টিই করি নি, তুমি তার কথা জানলে কী করে? তখন আদম আ. বললেন, হে রব! যখন আপনি আমাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন এবং আমার দেহে আপনার রূহ ফুঁকে দিলেন, আমি মাথা উঠিয়ে দেখতে পেলাম, আপনার ‘আরশের পায়ায় লিপিবদ্ধ রয়েছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আপনার নিকট অত্যাধিক প্রিয় না হলে এই নামটি আপনি আপনার নামের সঙ্গে জুড়ে দিতেন না। তখন আল্লাহ বললেন, ‘যদিও আমি এখনও মুহাম্মদকে সৃষ্টি করি নি, তবুও তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।’

ইমাম যাহাবী রহ. উপরোক্ত বর্ণনাটি সম্পর্কে বলেছেন, এটা একটি বাতিল ও মাওদু‘ হাদীস।

আরো একটি বর্ণনা আছে, ‘যে ব্যক্তি সালাতের জন্য বাড়ি থেকে বের হলো এবং বললো:

اللهم إني أسألك بحق السائلين عليك، وأسألك بحق ممشاي هذا ...

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা ও ইমাম যাহাবী এই হাদীসটিকে দুর্বল বলে মত ব্যক্ত করেছেন।

সর্বশেষ আমাদের বক্তব্য হলো, তওহীদপন্থী সকলের কর্তব্য হচ্ছে উসীলার এমন সব পদ্ধতি বর্জন করে চলা, যেগুলো অবলম্বন করলে কোনটি দ্বারা ‘শির্কে আকবর’ (বড় শির্ক), কোনটি দ্বারা ‘শির্কে আসগর’ (ছোট শির্ক) বা কোনটির কারণে হারাম বিদ‘আতের শিকার হতে হয়। তাছাড়া তা দো‘আতে সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। আর এ কারণেই আমাদের অনেক দো‘আ নিষ্ফল হয়ে থাকে। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তো কেবল শরী‘আত সম্মত দো‘আই কবুল করেন।

অনুরূপভাবে প্রত্যেক তাওহীদবাদী মুসলিমের উচিৎ কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত শব্দ ও বাক্য দিয়েই দো‘আ করা। কেননা, সেসব দো‘আই গ্রহণযোগ্য হবার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে এবং ঐসব বাক্য দ্বারা দো‘আ করার ফলে পূণ্য ও সাওয়াব পাওয়ারও আশা রয়েছে।