দুনিয়ার জীবনে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উসীলায় দু‘আ করা

নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উসীলায় দু‘আ করার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। কেননা দু‘আকারী কখনো বলে, হে আল্লাহ! তোমার নাবী বা অমুকের অধিকারের উসীলায় তোমার কাছে দু‘আ করছি। অথবা কোনো সৃষ্টির দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে থাকে। দু’কারণে এরূপ বলা নিষিদ্ধ।

(১) এটি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কসম খাওয়ার অন্তর্ভুক্ত।

(২) এটি এমন বিশ্বাসের কারণে হয়ে থাকে যে, আল্লাহ তা‘আলার উপর কারো হক রয়েছে। আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে কসম করা জায়েয নয়। আর আল্লাহ তা‘আলার উপর কারো কোনো হক নেই। তবে তিনি নিজের উপর যা আবশ্যক করেছেন সে কথা ভিন্ন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ

‘‘মুমিনদেরকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য’’। (সূরা আর রূম: ৫৫)

এমনি ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয বিন জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে বলেছেন, (মুআয তখন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে একই বাহনে বসা ছিলেন) হে মুআয! তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহর হক কী? মুআয বলেন, আমি বললাম, আল্লাহ এবং তার রসূলই এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো, তারা একমাত্র তার ইবাদত করবে এবং তার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি জানো উপরোক্ত কাজ করলে আল্লাহর উপর বান্দার হক কী? মুআয বললেন, আল্লাহ এবং তার রসূলই এ বিষয়ে সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। তিনি তখন বললেন, তারা উপরোক্ত কাজটি করলে তাদের জন্য আল্লাহর উপর হক হলো, তাদেরকে শাস্তি না দেয়া। এটি সত্য। আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ কালেমার দাবি এবং তার সত্য ওয়াদার দাবি অনুপাতে এ হক আল্লাহ তা‘আলা নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছেন। তবে এমনটি নয় যে, বান্দা নিজেই আল্লাহর উপর কোনো কিছু আবশ্যক করে দিয়েছে। যেমন এক মাখলুক অন্য মাখলুকের উপর আবশ্যক করে দেয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে সকল প্রকার কল্যাণ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু তার অনুগত বান্দাদেরকে শাস্তি না দেয়ার ওয়াদা করেছেন, তাই সেই ওয়াদা অনুপাতে আল্লাহর উপর তাদের হক সাব্যস্ত হয়েছে। তাদেরকে শাস্তি না দেয়ার অর্থ এ নয় যে, তা দ্বারা কসম খাওয়া যাবে, আল্লাহর কাছে তা দ্বারা কোনো কিছু চাওয়া যাবে এবং উহার উসীলা দিয়ে দুআ করা যাবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যেসব বিষয়কে নাজাতের মাধ্যম বানিয়েছেন, তাই নাজাতের মাধ্যম হয়েছে। মুসনাদে আহমাদে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে যে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে, তার কথাও অনুরূপ। সেখানে ছবলাতের উদ্দেশ্যে গমনকারীর কথা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, (أسألك بحق ممشايّ هذا وبحق السائلين عليك) ‘‘হে আল্লাহ! ছ্বলাতের উদ্দেশ্যে আমার এ গমনের উসীলায় এবং তোমার নিকট দু‘আকারীর হকের উসীলায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি।[1] কবি খুব সুন্দর বলেছেন,

مَا لِلْعِبَادِ عَلَيْهِ حَقٌّ وَاجِبٌ+ كَلَّا وَلَا سَعْيٌ لَدَيْهِ ضَائِعُ

إِنْ عُذِّبُوا فَبِعَدْلِهِ، أَوْ نُعِّمُوا+ فَبِفَضْلِهِ وَهُوَ الْكَرِيمُ الوَاسِع

‘‘আল্লাহর উপর বান্দার কোনো হক নেই। এটি হতেই পারে না। তবে তার নিকট কারো আমল বিনষ্ট হয় না। বান্দাদেরকে শাস্তি দেয়া হলে তার ইনসাফের কারণেই দেয়া হবে অথবা যদি তাদেরকে নেয়ামত দেয়া হয়, তাহলে তার ইনসাফের কারণেই। আর আল্লাহ তা‘আলা দয়ালু দাতা ও প্রাচুর্যের অধিকারী।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় দু‘আকারীর কথা, بحق السائلين عليك এবং بحق نبيك এ দুই বাক্যের মধ্যে পার্থক্য কী? এর জবাব হলো بحق السائلين عليك এ কথার অর্থ হলো হে আল্লাহ! তুমি তো দু‘আকারীদের সাথে ওয়াদা করেছো যে, তুমি তাদের দ‘ুআ কবুল করবে। আমি তো সে দু‘আকারীদের দলভুক্ত। সুতরাং আমার দু‘আ কবুল করো। এটি بحق فلان বা অমুকের হকের উসীলায় আমার দু‘আ কবুল করো, এ কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা আল্লাহ তা‘আলার সত্য ওয়াদার কারণে কারো জন্য আল্লাহর উপর হক থাকলেও তার মাঝে এবং দু‘আকারীর দু‘আ কবুলের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। যে ব্যক্তি দু‘আর মধ্যে অন্যকে উসীলা দেয়, তার কথা এরূপ যে, সে যেন বলছে, হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি যেহেতু আপনার সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত, তাই আমার দু‘আ কবুল করো। দু‘আ কবুল করার সাথে এভাবে কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ করার সম্পর্ক কী? দু‘আর মধ্যে কোনো ব্যক্তির নাম উল্লেখ করলেই দু‘আ কবুল হওয়া আবশ্যক হয় কিভাবে? এটি দু‘আর মধ্যে যুলুম ও সীমালংঘন করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ

‘‘তোমাদের রবকে ডাকো কান্নাজড়িত কণ্ঠে ও চুপে চুপে। অবশ্যই তিনি সীমালংঘন কারীদেরকে পছন্দ করেন না’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ৫৫)

এভাবে দু‘আর মধ্যে কারো নাম উল্লেখ করে দু‘আ করা বিদআতী দু‘আর অন্তর্ভুক্ত। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এভাবে দু‘আ করার কথা বর্ণিত হয়নি। এমনকি ছাহাবী, তাবেঈ কিংবা কোনো ইমাম থেকেও এভাবে দু‘আ করার কথা বর্ণিত হয়নি। মূর্খ ও সুফীরা তাবীজ -কবজ এবং দর্গা ও মাজারের মধ্যে এগুলো লিখে রাখে। দু‘আ হলো সর্বোত্তম ইবাদত। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো তাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা হবে। বিদ‘আত ও প্রবৃত্তির উপর নির্ভর করে কোনো ইবাদত করা যাবে না।

কারো হকের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া নিষিদ্ধ। সুতরাং কিভাবে স্রষ্টার উপর কারো হক আছে বলে দাবি করা যেতে পারে? রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, «مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ أَشْرَك» ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে শির্ক করল’’।[2]

ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ এবং তার সাথীদ্বয় বলেছেন, দুআকারীর এ কথা বলা মাকরুহ যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অমুকের হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি, তোমার নাবী-রসূলদের হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি, পবিত্র কাবা ঘরের সম্মানের উসীলায় প্রার্থনা করছি, পবিত্র স্থানসমূহের হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি অথবা অনুরূপ অন্য কিছুর হকের উসীলায় প্রার্থনা করছি। দু‘আর মধ্যে ইত্যাদি কথা বলা মাকরুহ। ইমাম আবু হানীফা এবং মুহাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ দু‘আকারীর এ কথা অপছন্দ করেছেন যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার আরশের সম্মানের উসীলায় প্রার্থনা করছি। কিন্তু ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ ইহাকে অপছন্দ করেননি। কারণ এ বিষয়ে হাদীছ রয়েছে।[3]

মুর্খরা কখনো কখনো দু‘আর মধ্যে এভাবে বলে থাকে যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অমুকের সম্মানের উসীলায় প্রার্থনা করছি। কেউ কেউ বলে থাকে, হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে তোমার নাবী-রসূলদের এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলায় প্রার্থনা করছি। এতে দু‘আকারী যেন বলছে, হে আল্লাহ! অমুক লোক তোমার কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান এবং শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। সুতরাং তুমি আমার দু‘আ কবুল করো। এভাবে দু‘আ করাও নিষিদ্ধ।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় ছাহাবীগণ যে উসীলা দিতেন, তা যদি হুবহু এ উসীলা হতো, তাহলে তার মৃত্যু বরণের পরও তারা তার উসীলা দিতেন। ছাহাবীগণ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তার দু‘আর উসীলা দিতেন। তারা নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তাদের জন্য দু‘আ করার আবেদন করতেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু‘আ করতেন এবং ছাহাবীগণ তার দু‘আয় আমীন বলতেন। যেমন বৃষ্টি প্রার্থনা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করার পর যখন তারা বৃষ্টি প্রার্থনার জন্য বের হতেন তখন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,

«اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِيَنَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا، قَالَ: فَيُسْقَوْنَ»

‘‘হে আল্লাহ! আমাদের নাবী জীবিত থাকতে আমরা তার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করলে তুমি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করতে। এখন আপনার নাবীর চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা করছি। তুমি আমাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করো। অতঃপর তাদের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করা হত’’।[4]

এখানে নাবীর মাধ্যমে বা নাবীর চাচার মাধ্যমে বৃষ্টি চাওয়ার অর্থ হল বৃষ্টির জন্য দু’আ করার আবেদন করা এবং তার কাছে সুপারিশ করা ও বৃষ্টি চাওয়ার আবেদন করা। অর্থ এটি নয় যে, আববাসের হকের মাধ্যমে জোর দিয়ে তোমার কাছে বৃষ্টি চাচ্ছি। অথবা তাদের উদ্দেশ্য এটি ছিল না যে, আমরা তোমার নিকট আববাসের সম্মান ও মর্যাদার উসীলা দিয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করছি। এটি যদি উদ্দেশ্য হতো, তাহলে আল্লাহর নিকট আববাসের সম্মান ও মর্যাদার চেয়ে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মান ও মর্যাদা যেহেতু বেশী, তাই তারা কখনো রসূলকে বাদ দিয়ে আববাসের দিকে যেতেন না। কেননা মৃত্যু বরণের কারণে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মর্যাদা কমে যায়নি।

দু‘আকারী কখনো বলে থাকে, হে আল্লাহ! আমি তোমার রাসূলের আনুগত্য করি, তাকে ভালোবাসি, তার প্রতি ঈমান এনেছি, তোমার সকল নাবী-রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি, তাদের সকলকে সত্যায়ন করেছি এবং অনুরূপ অন্যান্য কথা বলে থাকে। দু‘আ করা, উসীলা দেয়া এবং শাফা‘আত চাওয়ার মধ্যে এ ধরণের কথা খুবই উত্তম।

কিন্তু কারো ব্যক্তি সত্তার উসীলা দেয়া এবং তার মাধ্যমে দু‘আ করার মধ্যে যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। এর অর্থ যারা বুঝেনি তারা মারাত্মক ভুল করেছে। কোনো দু‘আকারী যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে দু‘আর মধ্যে উল্লেখ করে এ কারণে যে, সে আল্লাহর নিকট তার জন্য দু‘আ করছে, সুপারিশ করছে আর এটি জীবিত থাকা কালেই সম্ভব অথবা এ জন্য উল্লেখ করে যে, দু‘আকারী সেই ব্যক্তিকে ভালোবাসে, তার আনুগত্য করে এবং তাকে আদর্শ মনে করে, কারণ সে ভালোবাসা পাওয়ার হকদার, আনুগত্যের যোগ্য ও অনুসরণীয়, এমন ব্যক্তির উসীলা দেয়ার অর্থ হলো, তার দু‘আ এবং শাফাআতের উসীলা দেয়া। অথবা তার ভালোবাসা এবং অনুসরণ করার উসীলা দেয়া।

তবে কাউকে দু‘আর মধ্যে উল্লেখ করা দ্বারা যদি তার ব্যক্তিসত্তার উসীলা দেয়া উদ্দেশ্য হয় অথবা আল্লাহর কাছে তার অধিকার আছে বলে জোর দিয়ে দাবি করা হয়, তাহলে এ পদ্ধতিকে আলেমগণ অপছন্দ করেছেন এবং নিষেধ করেছেন। কোনো ভালো কাজের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া দ্বারা কখনো উক্ত ইবাদতকে উদ্দেশ্য হাসিলের কারণ মনে করা হয়। আবার কখনো দু‘আ করার সময় কোনো জিনিস উল্লেখ করে জোর দাবি জানানো হয়।

প্রথম প্রকারের উদাহরণ স্বরূপ এখানে তিন ব্যক্তির হাদীছকে উল্লেখ করা যেতে পারে। হাদীছটি খুব প্রসিদ্ধ। বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য কিতাবে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। তারা যখন গুহায় প্রবেশ করলো, তখন একটি পাথর গুহার মুখ বন্ধ করে দিলো। তারা তাদের খালেস সৎ আমলগুলোর উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলো। তাদের প্রত্যেকেই বলেছিল, হে আল্লাহ! আমি যদি এ আমলটি তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে বিপদে পড়েছি, তা থেকে উদ্ধার করো। এতে করে পাথরটি সরে গেল। তারা গুহা থেকে বের হয়ে এলো। এরা আল্লাহর নিকট সৎ আমল তুলে ধরে দুআ করেছিল। তারা এভাবে দুআ করেনি যে, হে আল্লাহ! অমুক বান্দার হকের মাধ্যমে তোমার কাছে দু‘আ করছি কিংবা তারা এটি বলেনি যে, হে আল্লাহ! আমাদের মাঝে অমুক অমুক অলী ও নেক বান্দা রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে উদ্ধার করো। কেননা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করার জন্য বান্দার সৎ আমল হলো সর্বোত্তম মাধ্যম। বান্দা সৎআমলের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করবে, তার কাছে প্রার্থনা করবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদার ও সৎ আমলকারীদের সাথে ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাদের ডাকে সাড়া দিবেন এবং নিজের পক্ষ হতে অতিরিক্ত পুরস্কার দান করবেন।

মোটকথা আল্লাহর নিকট সুপারিশ করা এক মানুষের নিকট অন্য মানুষের সুপারিশ করার মত নয়। কেননা মানুষের নিকট সুপারিশকারী, সুপারিশ প্রার্থী এবং সুপারিশকে নিজের সাথে যুক্ত করে নেয়। অর্থাৎ সুপারিশ প্রার্থী প্রথমে থাকে একা বা বেজোড়। এখন তার সাথে আরেকজন যোগদান করার মাধ্যমে দুই বা জোড়ে পরিণত হয়েছে। এখন সুপারিশকারী ও তার সুপারিশ প্রার্থী একই বস্তু প্রার্থনা করছে। অর্থাৎ শাফা‘আত তলবকারী এবং শাফা‘আতকারী উভয়ে মিলে জোড় সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা বেজোড়। কেউ তাকে জোড় করতে পারে না। কোনো মানুষ যখন রাজা-বাদশাহর নিকট থেকে প্রয়োজন পুরণ করতে চায়, তখন রাজা-বাদশাহদের সাথে তার পরিচয় না থাকার কারণে সে একটি শক্তিশালী মাধ্যম বা সুপারিশকারী খুuঁজ। এভাবে মানুষ দুইজনের মাধ্যমে প্রয়োজন পুরণ করে। শাফা‘আতকারী এবং যার নিকট শাফা‘আত করা হয়। কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ পদ্ধতি প্রযোজ্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা একাই সৃষ্টি করা, আদেশ দেয়া, রিযিক দেয়া, কল্যাণ-অকল্যাণ এবং সমস্ত ভান্ডারের মালিক। আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া কেউ তার নিকট সুপারিশ করতে পারে না। সমস্ত বিষয়ের মালিক একমাত্র তিনি। কোনো অবস্থাতেই তার কোনো শরীক নেই।

শাফা‘আতকারীদের সর্দার কিয়ামতের দিন যখন সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করবেন, তখন তিনি তাকে বলবেন, হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। কথা বলো, তোমার কথা শ্রবণ করা হবে। তুমি চাও, তোমাকে প্রদান করা হবে এবং সুপারিশ করো। তোমার সুপারিশ কবুল করা হবে। অতঃপর তার জন্য একটি পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। তিনি তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সবকিছুই আল্লাহর মালিকানাধীন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ

‘‘তাদেরকে বলে দাও, সমস্ত বিষয়ের অধিকার রয়েছে একমাত্র আল্লাহর হাতে’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৫৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

ليس لك من الأمر شيئ

‘‘এ বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১২৮) আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে আরো বলেন,

أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘সৃষ্টি জগতের প্রতিপালক মহান আল্লাহরই রয়েছে সৃষ্টি করা ও হুকুম করার ক্ষমতা’’।

আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া তার নিকট কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। তিনি যাকে এবং যার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন, তিনি কেবল তার জন্যই আল্লাহর নিকট সুপারিশ করতে পারবেন। তবে আল্লাহ তা‘আলা শাফা‘আতকারীর শাফা‘আত কবুল করার মাধ্যমে সম্মানিত করবেন। যেমন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«اشْفَعُوا تُؤْجَرُوا وَيَقْضِي اللَّهُ عَلَى لِسَانِ نَبِيِّهِ مَا يَشَاءُ»

‘‘তোমরা শাফা‘আত করো, তোমাদেরকে এর বিনিময় প্রদান করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীর জবানের মাধ্যমে যা ইচ্ছা ফায়ছালা করেন’’।[5]


ছহীহ বুখারীতে নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

يَا بَنِي عَبْدِ مَنَافٍ لاأملك لكم من الله شيئا أُغْنِي عَنْكُمْ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَيَا صَفِيَّةُ عَمَّةَ رَسُولِ اللَّهِ لا أملك لك مِنَ اللَّهِ شَيْئًا يَا عَبَّاسُ عم رسول الله لا أملك لك مِنَ اللَّهِ شَيْئًا

‘‘হে বনী আবদে মানাফ! আমি তোমাদেরকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারব না। হে রাসূলের ফুফু সাফীয়া! আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারবো না। হে রাসূলের চাচা আববাস! আমি তোমাকে আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পারবো না’’।[6] ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لا أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَى رَقَبَتِهِ بَعِيرٌ لَهُ رُغَاءٌ، شَاةٌ لَهَا يعار أو رقاع تخفق فيَقُولُ: أَغِثنِي أغثني فَأَقُولُ: قد أبلغت لَا أَمْلِكُ لَكَ من الله من شَيْئٍ

আমি কিয়ামতের দিন তোমাদের কাউকে এমন অবস্থায় দেখতে চাইনা যে, সে তার ঘাড়ে একটি চিৎকাররত উট রয়েছে অথবা সে চিৎকাররত ছাগল কিংবা ঘোড়া বহন করছে। সে আমাকে ডেকে বলছে, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন!! আমাকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন। তখন আমি বলবো: আমি আমার দায়িত্ব পৌঁছিয়ে দিয়েছি। আজ আমি আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার কোন উপকার করতে পারবো না’’।[7]

সৃষ্টির সেরা মানব এবং সর্বোত্তম শাফা‘আতকারী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিকটতম মানুষকে যেখানে উপরোক্ত কথা বলেছেন যে, তিনি তাদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেন না, তাহলে অন্যদের ক্ষেত্রে কিভাবে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, তারা কিয়ামতের দিন মানুষের বিপদা-পদ দূর করতে সক্ষম হবেন?দু‘আকারী যখন আল্লাহর নিকট দুআ করে, শাফা‘আতকারী যখন তার নিকট শাফা‘আত করে, তখন আল্লাহ তা‘আলা দু‘আ শ্রবণ করেন এবং সুপারিশ কবুল করেন। তবে দু‘আ এবং শাফা‘আত আল্লাহ তা‘আলার মধ্যে কোনো প্রভাব খাটাতে পারে না। যেমন এক মাখলুক অন্য মাখলুকের উপর প্রভাব খাটাতে পারে। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই কাউকে দু‘আ করার তাওফীক দেন এবং তিনিই শাফা‘আত করার প্রতি অনুপ্রেরণা জাগান। তিনিই বান্দাদের কর্মের স্রষ্টা। তিনিই বান্দাকে তাওবা করার তাওফীক দেন, তিনিই তাওবা কবুল করেন। তিনিই তাদেরকে আমল করার তাওফীক দেন। অতঃপর তিনিই ছাওয়াব দান করেন। তিনিই দু‘আ করার তাওফীক দেন এবং তিনিই তা কবুল করেন। তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি অনুসারে এটিই সঠিক কথা। আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুর স্রষ্টা।

[1]. হাদীছটি যঈফ। দেখুন: শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২১২।

[2]. ছহীহ: আবূ দাউদ হা/৩২৫১, মুসনাদে আহমাদ হা/৬০৭৩।

[3]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি বানোয়াট। দেখুন শাইখ আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২১৪।

[4]. ছহীহ বুখারী হা/১০১০।

[5]. ছহীহ বুখারী হা/ ১৪৩২।

[6]. ছহীহ বুখারী হা/২৭৫৩, ছহীহ মুসলিম হা/২০৬।

[7]. ছহীহ বুখারী হা/৩০৭৩, ছহীহ মুসলিম হা/১৮৩১।