রাহে বেলায়াত পঞ্চম অধ্যায় - মাজলিসে যিকর ও যিকরের মাজলিস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আপনি যে সকল কাজকে বিদ‘আত বা খেলাফে সুন্নাত বলছেন যুগযুগ ধরে আল্লাহর ওলীগণ তো সে কাজই করে আসছেন। এ সকল কাজের মাধ্যমেই তারা বেলায়াত, কারামত, হালাত ও ফয়েযের উচ্চমার্গে আরোহণ করেছেন। এখনো দেশে দেশে এ সকল কর্মের মাধ্যমে অগণিত মানুষ বেলায়াত, কারামত, হালাত, ফয়েয ইত্যাদি লাভ করছেন। আপনার কথা ঠিক হলে তা কিভাবে সম্ভব হলো? এগুলি কি প্রমাণ করে না যে, আপনার কথা ভুল?

নিম্নের বিষগুলি পাঠককে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে সাহায্য করবে:


১. সকল বুজুর্গই মাসনূন ইবাদত পালন ও প্রচার করেছেন

যুগ যুগ ধরে আল্লাহর ওলীগণ কখনোই এ সকল সুন্নাত বিরোধী কাজ করেন নি। সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের যুগের আবিদ, যাকির ও সূফী-দরবেশগণের জীবনের কর্ম, যিকর ও যিকরের মাজলিসের পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বেলায়াত ও তাযকিয়ার পথে তাঁদের কর্মগুলি ছিল একান্তই মাসনূন কর্ম। এই গ্রন্থে যা কিছু লিখা হয়েছে তা তাঁদের জীবনী ও কর্মের আলোকেই লিখা হয়েছে। ৫ম হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও সূফী আল্লামা আবু নু’আইম ইসপাহানী (৪৩০ হি) “হিলয়্যাতুল আউলিয়া” গ্রন্থে সাহাবীগণের যুগ থেকে তাঁর যুগ পর্যন্ত সূফী, দরবেশ, বুজুর্গ ও যাহিদগণের জীবনী বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাদের যিকর ও যিকরের মাজলিসের আলোচনা করেছেন। এ সকল আলোচনায় আমরা দেখছি যে, তাঁদের যিকরের মাজলিস ছিল ঈমান বৃদ্ধিকারক, দুনিয়ার মোহ, লোভ, লালসা, হিংসা, অহংকার ইত্যাদি থেকে হৃদয়কে মুক্ত -করা বিষয়ক ও হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহর ভয়, তাওবা ও ইসতিগফারের প্রেরণা দানকারী আলোচনা ও আলোচনা সাথে ইস্তিগফার, ক্রন্দন ইত্যাদি। পাঠককে অনুরোধ করছি “হিলয়্যাতুল আউলিয়া”, “সিফাতুস সাফওয়া”, “সিয়ারু আ’লামিন নুবালা” ইত্যাদি প্রথম যুগের ও নির্ভরযোগ্য জীবনী গ্রন্থে তাঁদের জীবনী পাঠ করতে।


বস্তুত, ওলী-আল্লাহদের নামে অগণিত মিথ্যা কথা সমাজে প্রচলিত। মুহাদ্দিসগণের অতন্দ্র প্রহরা ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ডের ন্যায় কঠিন শাস্তি সত্ত্বেও হাদীসের নামে অগণিত মিথ্যা ও জাল কথা প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। ওলীদের নামে জাল কথা প্রচারের ক্ষেত্রে কোনো প্রহরা ও শাস্তির ব্যবস্থাই ছিল না। একারণে জালিয়াতগণ এ ক্ষেত্রে বেশি সফল হয়েছে। আমি ‘হাদীসের নামে জালিয়াতি’ গ্রন্থে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, শাইখ আব্দুল কাদির জীলানী, মঈনুদ্দীন চিশতী, নিযামুদ্দীন আউলিয়া (রহঃ) প্রমখু বুজুর্গের নামে লিখিত গ্রন্থাদির মধ্যে এমন সব তথ্য বিদ্যমান যা নিশ্চিত করে যে, তাঁদের যুগের পরে জালিয়াতগণ তাদের নামে এ সকল পুস্তক রচনা করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রচিত পুস্তকাদির মধ্যে অনেক মিথ্যা কথা ঢুকিয়েছে।


এর পরেও আমরা এ সকল বুজুর্গের লেখা পুস্তকাদির মধ্যে মাসনূন ইবাদত ও যিকরের কথাই দেখতে পাই। শাইখ আব্দুল কাদির জীলানীর (রহঃ) গুনিয়াতুত তালিবীন ও অন্যান্য গ্রন্থ, শাইখ মুঈনুদ্দীন চিশতীর (রহঃ) আনিসুল আরওয়াহ, মুজাদ্দিদে আলফে সানীর মাকতুবাত ও অন্যান্য গ্রন্থ, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবীর হুজ্জাতুল বালিগার ‘ইহসান ও তাসাউফ’ অংশ, তাঁর রচিত কাশফুল খাফা গ্রন্থের উমার (রাঃ)-এর তরীকা ও তাসাউফ বিষয়ক অংশ, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবীর ‘সেরাতে মুস্তাকিম’ গ্রন্থ পাঠ করতে পাঠককে অনুরোধ করছি। এই পুস্তকে পাঠক যা কিছু দেখেছেন উপর্যুক্ত পুস্তকগুলিতে প্রায় তাই দেখতে পাবেন।


২. নিয়মিত ইবাদত বনাম সাময়িক অনুশীলন

আমরা দেখেছি যে, খেলাফে সুন্নাত সকল কর্মই বিদ‘আত বলে গণ্য হয় না। বরং খেলাফে সুন্নাত কর্মকে দীনের অংশ মনে করলে, সাওয়াবের মূল উৎস মনে করলে বা সুন্নাতের মত রীতিতে পরিণত করলে তা বিদ‘আতে পরিণত হয়। জায়েয বিষয় কিভাবে বিদ‘আতে পরিণত হতে পারে তার একটি উদাহারণ এই বই থেকে প্রদান করছি। সকাল সন্ধ্যার যিকর আলোচনার সময়ে আমি অনেক প্রকারের যিকর উল্লেখ করেছি। এগুলি সবই মাসনূন যিকর। এগুলিকে লিখার জন্য স্বভাবতই আমাকে একটির পরে একটি লিখতে হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে সাজাতে হয়েছে। এই ক্রমানুসারে সাজানোটা সুন্নাত নয়, আমার নিজের তৈরি। সুন্নাত এই যিকরগুলি পালন করা। যিকর পালন করতে গেলে অবশ্যই একটি ক্রম প্রয়োজন। একটির পর একটি তো করতে হবে। সাজানোর বিষয়টি রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন। যাকির নিজের সুবিধামতো যিকরগুলি সাজিয়ে নেবেন। আমার ক্রমটিও এই প্রকারের। এই সাজানো নিঃসন্দেহে জায়েয ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু যদি কোনো যাকির সুন্নাতের নির্দেশনা ছাড়া মনে করেন যে, এই যিকরটি আগে ও এই যিকরটি পরে দিতেই হবে, বা এই নির্দিষ্ট ক্রমান্বয় মেনে চলাটা একটি ইবাদত, বা এই নিয়মের মধ্যে বিশেষ সাওয়াব আছে তাহলে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে।


যিকর বিষয়ক অধিকাংশ বিদ‘আত এইরূপ ভুল ধারণা থেকে এসেছে। পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন আলিম ও নেককার মানুষ তাঁদের ছাত্র বা মুরীদকে সুন্নাতের আলোকে কিছু যিকর বেছে দিয়েছেন, সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, ক্বলবের অমনোযোগিতা বা আলসেমী দূর করতে বা মনোযোগ অর্জনের জন্য কিছু সাময়িক নিয়মকানুন বলে দিয়েছেন। যেমন, কাউকে জোরে যিকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কাউকে নির্জনবাসের নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যিকর করার নিয়ম করেছেন। কেউ নির্দিষ্ট ভঙ্গিতে বসে পায়ের নির্দিষ্ট রগ চেপে ধরে অথবা দেহের নির্দিষ্ট স্থানে আঘাতের কল্পনা করে যিকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলি সবই ছিল সাময়িক ও বিশেষ পরিস্থিতির আলোকে তাদের ব্যক্তিগত ইজতিহাদ মাত্র। কিন্তু পরবর্তীকালে অনেকেই সেগুলি দীনের অংশ মনে করেছেন। কেউ ভেবেছেন, এভাবে বসা বা এভাবে যিকর করা একটি বিশেষ ইবাদত। এভাবে না বসলে বা এভাবে যিকর না করলে সাওয়াব বা বরকত কম হবে। কেউ ভেবেছেন, এই পদ্ধতিতে না হলে আজীবন মাসনূন যিকর করলেও বেলায়াত বা তাযকিয়া অর্জন হবে না। এভাবে তাঁরা বিদআতের মধ্যে নিপতিত হয়েছেন।


৩. ক্রমান্বয় অবনতি ও সংশোধন

বুজুর্গদের শেখানো ইবাদত ও রিয়াযতের পদ্ধতিও তাঁদের মৃত্যুর পরে অনুসারীদের হাতে ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। মুজাদ্দিদ-ই- আলফ-ই সানী (৯৭১-১০৩৪হি)-র মাকতূবাত শরীফ অধ্যয়ন করলে বিষয়টি ভালভাবে অনুভব করা যায়। তাঁর মাত্র ২০০ বৎসর পূর্বে বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (৭৯১ হি) নকশবন্দীয়া তরীকার উদ্ভাবন করেন। এই ২০০ বৎসরের মধ্যে নকশবন্দীয়া তরীকার মধ্যে অনেক বিদ‘আত প্রবেশ করে বলে তিনি তাঁর মাকতূবাতের বিভিন্ন পত্রে আফসোস করেছেন।

আমাদের সমাজের দিকে তাকালেও আমরা তা বুঝতে পারব। কাদিরীয়া , চিশতীয়া, নকশবন্দীয়া, মুজাদ্দিদীয়া ইত্যাদি তরীকার দাবিদার বিভিন্ন দরবারে গেলে আপনি দেখবেন যে, একেক দরবারের যিকর, ওযীফা ও কর্ম পদ্ধতি একেক রকম, অথচ সকলেই একই তরীকা দাবি করছেন। আবার এদের অনেকেই মাত্র দুই বা তিন ধাপ পূর্বে একই পীর বা উস্তাদের শিষ্যত্ব দাবি করছেন, অথচ তাদের কর্ম পদ্ধতি এক নয়।


৪. তোমাদের জন্য রাসূলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে

একজন বুজুর্গ বেলায়াত অর্জন করেন তার সামগ্রিক কর্মের ভিত্তিতে। হাজার হাজার নেক আমলের পাশে দু একটি ভুলভ্রান্তির কারণে তাদের বুজুর্গী নষ্ট করে না। বরং কুরআনের বাণী অনুসারে অনেক নেকীর কারণে এ সকল ভুল বা অন্যায় ক্ষমা হয়ে যায়। পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের মধ্যে বিভিন্ন ভুলত্রুটি রয়েছে। কখনো বিশেষ হালতে, কখনো অনুশীলনের জন্য, কখনো ব্যক্তিগত ইজতিহাদে তাঁরা ভুল কর্ম করেছেন। এ সকল কর্মের ফলে যেমন তাদের বুজুর্গী নষ্ট হয় না, তেমনি তাঁরা করেছেন বলে এগুলি আমাদের জন্য করণীয় আদর্শ হতে পারে না। কোনো বুজুর্গ গান-বাজনা করেছেন এবং নেচেছেন, কেউ বা ধুমপান করেছেন, কেউ পীরকে সাজদা করেছেন এরূপ অগণিত বিষয় রয়েছে। এজন্য সুন্নাতে প্রত্যাবর্তন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ বুজুর্গদের নামে অনেক কিছুই দাবি করা হচ্ছে, কোনটি সঠিক তা বাছাই করার কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। অনুরূপভাবে কোন্ কর্মটি তাঁরা ইবাদত হিসেবে করেছেন এবং কোন্টি সাময়িক অনুশীলন অথবা ব্যক্তিগত ইজতিহাদের কারণে করেছেন তাও স্পষ্টরূপে জানার কোনো উপাই নেয়। পক্ষান্তরে সুন্নাতের ক্ষেত্রে সহীহ ও বানোয়াট জানার মাপকাঠি রয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সকল কিছুই আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। বুজুর্গগণের বুজুর্গী ও বেলায়াতের জন্য তাঁদেরকে সম্মান করতে হবে এবং ভালবাসতে হবে। কিন্তু অনুকরণীয় পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে। তাঁর সুন্নাত অনুসরণের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ সাহাবীগণ। বুজুর্গগণকে নির্ভুল, নিষ্পাপ ও সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের মতের অযুহাতে সহীহ সুন্নাতে নববী বা সুন্নাতে সাহাবী অস্বীকার বা অমান্য করার পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।


বুজুর্গগণের কর্ম অনুসরণ করে আমরা সাওয়াব ও বেলায়াত আশা করি। আর সাহাবীগণের হুবহু অনুসরণ করলে পঞ্চাশ জন সাহাবীর সমান মর্যাদা ও পুরস্কার পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। তিনি বলেন, “তোমাদের সামনে রয়েছে ধৈর্যের সময়, এখন তোমরা যে কর্মের উপর আছ সে সময়ে যে ব্যক্তি অবিকল তোমাদের পদ্ধতি আকড়ে ধরে থাকবে, সে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন ব্যক্তির সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর নবী, আমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সাওয়াব না তাদের মধ্যকার? তিনি বলেন, “না, বরং তোমাদের মধ্যকার ৫০ জনের সমপরিমাণ সাওয়াব।”[1]


৫. কারামত, হালাত, ফয়েয বনাম বেলায়াত ও তাযকিয়া

এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো বুজুর্গ কে? কে কতবড় আল্লাহর ওলী তা কিভাবে আমরা জানতে পারব? ইরানে, আরবে ও অন্যান্য দেশে শিয়াদের মধ্যে অগণিত পীর-দরবেশ বিদ্যমান যাদের কারামত ও কাশফের কথা লক্ষকোটি মানুষের মুখে মুখে। অথচ সুন্নীগণ তাদের মুসলমান বলে মানতেই নারায। এভাবে প্রত্যেক দলই দাবি করছেন যে, তাদের নেতৃবৃন্দ সর্বোচ্চ পর্যায়ের ওলীআল্লাহ। তাদের কাশফ, কারামত ও ফয়েযের অগণিত গল্প তাদের মুখে মুখে। পক্ষান্তরে অন্য দল এদেরকে কাফির, ফাসিক, ওহাবী, বিদ‘আতী ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছে।

বস্তুত, বুজুর্গী চেনার জন্য কাশফ, কারামত ইত্যাদির উপর নির্ভর করাই সকল বিভ্রান্তির মূল। মুসলিম উম্মাহর সকল বুজুর্গই বলেছেন যে, বুজুর্গী চেনার জন্য এগুলির উপর নির্ভর করা যাবে না, বরং সুন্নাতের উপরে নির্ভর করতে হবে। সুন্নাতের অনুসরণের পূর্ণতার উপরেই বুজুর্গীর পূর্ণতা নির্ভর করবে। সাহাবীগণের মত যিনি সকল ইবাদত বন্দেগি পালন করতে চেষ্টা করেন, তাঁদেরই মত হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, গীবত, গালাগালি ইত্যাদি পরিহার করেন, তাঁদেরই মত বিনয় ও সুন্দর আচরণ করেন, তাকে আপনি বুজুর্গ বলে মনে করতে পারেন। সুন্নাতের অনুসরণ যত বেশি হবে বুজুর্গীও তত বেশি হবে।

অলৌকিক কর্ম করা, মনের কথা বলা ইত্যাদি কাশফ-কারামত হতে পারে, আবার শয়তানী ইসতিদরাজ হতে পারে। কোনটি রাব্বানী এবং কোনটি শয়তানী তা চেনার একমাত্র উপায় সুন্নাতের অনুসরণ। মুজাদ্দিদে আলফে সানী, সাইয়িদ আহমদ ব্রেলবী ও অন্যান্য বুজুর্গ উল্লেখ করেছেন যে, কাফির-মুশরিকও রিযয়াত-অনুশীলন করলে কাশফ, কারামত ইত্যাদি অর্জন করতে পারে। এছাড়া শিরক বা বিদ‘আতে লিপ্ত করতে শয়তান মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। স্বপ্নে, কাশফে বা জাগ্রত অবস্থায় সে আল্লাহকে বা ওলীদেরকে বারংবার দেখতে পায়।


রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি স্বপ্নে আমাকে দেখল, সে প্রকৃতই আমাকে দেখল, কারণ শয়তান আমার রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না।”[2] এ জন্য মুসলিম উম্মাহ একমত যে, শয়তান রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না। তবে অন্য কোনো আকৃতিতে এসে নিজেকে নবীজি বলে দাবি করতে পারে কি না সে বিষয়ে আলিমদের মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন যে, শয়তান যেমন তাঁর রূপ পরিগ্রহণ করতে পারে না, তেমনি সে অন্য রূপে এসেও নিজেকে নবীজি বলে দাবি করতে পারে না। অন্য অনেকে বলেন যে, শয়তানের জন্য অন্য আকৃতিতে এসে নিজেকে নবীজি বলে দাবি করা অসম্ভব নয়; কারণ কোনো হাদীসে তা অসম্ভব বলা হয় নি। উপরন্তু মানুষ শয়তান যেমন জাল হাদীস বানাতে পারে, তেমনি জিন শয়তানও স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে জালিয়াতি করতে পারে। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সাহাবী ইবনু আব্বাস অনুরূপ মত পোষণ করতেন। ইমাম বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ও স্বপ্ন বিশারদ মুহাম্মাদ ইবনু সিরীনও (১১০হি) অনুরূপ মতামত পোষণ করতেন।[3]


বাস্তব অনেক ঘটনা দ্বিতীয় মতটি সমর্থন করে। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের ভাই ‘মারফতী নাড়ার ফকীর’ দলে যোগ দেন। তিনি তার বাড়িতে রাতভর গানবাজনা করে যিকরের আয়োজন করেন। এতে গ্রামবাসীরা আপত্তি করলে তিনি দাবি করেন যে, তিনি যখন এভাবে গানবাজনাসহ যিকরের মাজলিসে বসেন, তখন তার মৃত পিতামাতা কবর থেকে উঠে তাদের মাজলিসে যোগ দেন। উপরন্তু স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বপ্নে তাকে এভাবে গানবাজনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একজন প্রসিদ্ধ বুজুর্গ পীর সাহেব ধুমপান করতেন। তাঁর নিকটতম একজন খলীফা জানান যে, স্বপ্নে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়েই তিনি ধুমপান করতেন। আগের যুগের কোনো কোনো গ্রন্থেও অনুরূপ ঘটনার কথা পাওয়া যায়। এরা ভুল দেখেছেন, মিথ্যা বলেছেন, না বাস্তবেই শয়তান এরূপ স্বপ্ন দেখিয়েছে তা আল্লাহই ভাল জানেন।


সর্বোপরি কাশফ, ফয়েয, হালাত ইত্যাদি ইবাদত কবুল না হওয়ার লক্ষণ হতে পারে। সহীহ সুন্নাত-সম্মত ইবাদতে লিপ্ত হলে শয়তান আবিদের মনে ওয়াসওয়াসা দিয়ে মনোযোগ নষ্ট করতে চেষ্টা করে। যেন মুমিন ইবাদতে মজা না পেয়ে ইবাদত পরিত্যাগ করে বা অন্তত সাওয়াব কম পায়। পক্ষান্তরে ইবাদতের নামে বিদ‘আতে রত থাকলে শয়তান কখনোই মনোযোগ নষ্ট করে না, বরং তার মনোযোগ ও হালত বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হয়। কারণ উক্ত মুমিন তো সাওয়াব পাচ্ছেই না, বরং গোনাহ অর্জন করছে, কাজেই তাকে যত বেশি উক্ত কর্মে রত রাখা যায় ততই শয়তানের লাভ। এজন্যই অনেকে ধার্মিক মানুষকে দেখবেন, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর সালাত আদায়ে তাড়াহুড়ো করছেন। অথচ বিদ‘আত মিশ্রিত যিকর-ওযীফার মধ্যে মহা আনন্দে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাহাজ্জুদে বা কুরআন তিলাওয়াতে ক্রন্দন আসছে না। কিন্তু বিদ‘আত মিশ্রিত যিকর বা দু‘আয় অঝোরে কাঁদছেন। অনেকে সালাতের মধ্যে কিছু খেলাফে সুন্নাত নিয়ম পদ্ধতি বা যিকর যোগ করে সালাতে মনোযোগ ও মজা পাচ্ছেন। কিন্তু বিশুদ্ধ সুন্নাত-সম্মতভাবে সালাত আদায় করলে সেরূপ মজা পাচ্ছেন না। এভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কাশফ, ফয়েয, হালাত, মজা, ক্রন্দন, স্বপ্ন এগুলি কোনোটিই ইবাদত কবুলের আলামত নয়, বেলায়াতের আলামত হওয়া তো দূরের কথা।

৬. বেলায়াত-তাযকিয়ার দাবি-দাওয়া বনাম বাস্তবতা

বেলায়াত ও তাযকিয়ার দাবি সকলেই করছে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখতে পাই? হিংসা, ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা, লোভ, অহঙ্কার, ক্রোধ, অসদাচরণ, গালাগালি, বান্দার হক্ক বিনষ্ট করা ইত্যাদি অগণিত কর্মে লিপ্ত দেখতে পাই এ সকল মানুষদের। অথচ তাঁরা তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত, যিকর ও অন্যান্য তাযকিয়ার কর্মে লিপ্ত! এর কারণ ঔষধের বিকৃত প্রয়োগ। তাযকিয়া ও বেলায়াতের নামে ইসলামের আংশিক কিছু শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে এবং তা অর্জনের ক্ষেত্রে কাশফ, কারামত, হালাত ইত্যাদিকে মানদন্ড হিসেবে পেশ করা হচ্ছে। ফলে সত্যিকার তাকওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি হচ্ছে না। উপরন্তু অগণিত হারামে লিপ্ত থেকেই ‘ওলী’ হয়ে গিয়েছি বলে আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কার হৃদয়কে গ্রাস করছে।


৭. নবীপ্রেম ও ওলীপ্রেমের দাবি-দাওয়া বনাম বাস্তবতা

নবীপ্রেম বা আশেকে রাসূল (সা.) হওয়ার দাবি অনেকেই করছেন। ওলীআল্লাহগণের মহব্বত ও অনুসরণের দাবি করছেন সকলেই। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাচিছ? এ সকল প্রেমিককে যেয়ে বলুন, আপনার মতামত, পোশাক, যিকর, মীলাদ, দরুদ ইত্যাদির সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.) বা সাহাবীগণের পুরো মিল হচ্ছে না, একটু মিলিয়ে নিন। তাঁরা ঠিক এভাবে যিকর করেছেন, এভাবে মীলাদ পড়েছেন, অমুক বিষয়ে ঠিক একথা বলেছেন, কাজেই আপনি ঠিক অবিকল তাঁদের মত চলুন। আপনি দেখবেন যে, সেই প্রেমিক আপনার কথা মানছেন না। আপনার কথাগুলি বাতিল বা হাদীসে নেই সেকথা তিনি দাবি করবেন না। আপনার কথাগুলির বিপরীতে তার মতের পক্ষে কোনো সুস্পষ্ট সহীহ হাদীসও তিনি পেশ করতে পারবেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তা গ্রহণ করবেন না। বিভিন্ন ওযুহাত দেখাবেন। একেবরে অপরাগ হলে বলবেন, এগুলি ওহাবী মত বা বিভ্রান্ত মত! তিনি যে কর্ম বা মতামত পোষণ করছেন সেটিই একমাত্র সঠিক বা সুন্নী মত। কাজেই কোনো দলিল ছাড়াই সকল হাদীস ও সুন্নাত বাতিল হয়ে গেল।

অনেকের কাছেই নবীর (সা.) সুন্নাত এভাবে উড়িয়ে দেওয়া সহজ, তবে ওলী-আল্লাহগণের মতামত উড়িয়ে দেওয়া অনেক কঠিন! রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন বা বলেছেন বললে তাঁরা সহজেই একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বা বিনা ব্যাখ্যাতেই তা উড়িয়ে দিতে পারেন। কিন্তু বুজুর্গদের কথা বা কর্ম অত সহজে উড়িয়ে দিতে পারেন না। তা সত্ত্বেও আমরা দেখি যে, অবস্থার পরিবর্তন হয় না। উক্ত ওলী-প্রেমিককে বলুন, আপনি যে, কাজটি করছেন তার বিরুদ্ধে বা যাকে আপনি নিন্দা করছেন তার পক্ষে শাইখ আব্দুল কাদির জিলানী, মুঈন উদ্দীন চিশতী, মুজাদ্দিদে আলফে সানী, শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী, সাইয়েদ আহমদ ব্রেলবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বা অন্য অমুক বুজুর্গ অমুক গ্রন্থে লিখেছেন, তখন একই ভাবে তিনি বিভিন্ন অযুহাতে তা মানতে অস্বীকার করবেন। কোনো অবস্থাতেই তিনি তাঁর মত বা কর্ম পরিবর্তন করতে রাযি হবেন না! যে বুজুর্গের নামে তিনি চলছেন স্বয়ং সেই বুজুর্গের মতামতও যদি তার মতের বিরুদ্ধে পেশ করা হয় তবুও তিনি তার একটি ব্যাখ্যা করবেন, কিন্তু নিজের মত বা কর্ম পরিবর্তন করবেন না।


অন্তরের সবচেয়ে বড় রোগ এটি। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির নিকট হক্ক এবং বাতিলের একটিই মাপকাঠি রয়েছে, তা হলো তার নিজের পছন্দ। হাদীস-কুরআন বা বুজুর্গদের মতামত তার পছন্দকে প্রমাণ করার জন্য, পছন্দকে উল্টানোর জন্য নয়। যা তার পছন্দ হয় না তা বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে বাতিল করে দেন। আরবীতে এই মাপকাঠিটির নাম (ﻫﻮﻯ)। বাংলায় প্রবৃত্তি বা ‘ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ’ বলা হয়। কুরআন-হাদীসে বারংবার এই ভয়ঙ্কর রোগ সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। এক স্থানে ইরশাদ করা হয়েছে: “আপনি কি তাকে দেখেছেন যে তাঁর নিজের পছনদ অপছনদ বা নিজের নফসের খাহেশাতকে নিজের মা’বুদ বানিয়ে নিয়েছে ? আপনি কি তার উকিল হবেন?”[4] রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “তিনটি বিষয় মানুষকে ধ্বংস করে: অপ্রতিরোধ্য লোভ-কৃপণতা, নিজ প্রবৃত্তির ভালোলাগা মন্দলাগার আনুগত্য, মানুষের তার নিজ মতামতের প্রতি তৃপ্তি ও আস্থা।”[5]

এই রোগ থেকে মুক্তির একটিই পথ, নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ভাললাগা ও মন্দলাগাকে সুন্নাতের অধীন করা। ব্যাখ্যা দিয়ে সুন্নাতকে বাতিল না করে ব্যাখ্যা দিয়ে নিজের মত বা বুজুর্গদের মতকে বাতিল করে সুন্নাতকে হুবহু গ্রহণ করা। এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসে অনেক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

[1] মুহাম্মাদ ইবনু নাসর, আল-মাওয়াযী, আস-সুন্নাহ, পৃ. ১৪, তাবারানী, আল-মু’জাম আল-কাবীর ১০/১৮২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৭/২৮২, আলবানী, সহীহাহ ১/৮৯২-৮৯৩।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/৫২, ৫/২২৯০, ৬/২৫৬৭, মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৭৫।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৬৭; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১২/৩৮৩-৩৮৪।

[4] সূরা ফুরকানঃ ৪৩।

[5] মুনযিরী, আত-তারগীব ১/২৩০, আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৯৭।