রাহে বেলায়াত পঞ্চম অধ্যায় - মাজলিসে যিকর ও যিকরের মাজলিস ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

উপরের আলোচনা থেকে আমরা যিকরের মাজলিসের গুরুত্ব, মর্যাদা, সাওয়াব, প্রভাব, পদ্ধতি ও যিকরের ধরন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। ঈমান বৃদ্ধি, ইলম বৃদ্ধি, যিকরের আনন্দ বৃদ্ধি, আন্তরিকতা বৃদ্ধি, মাগফিরাত লাভ, আল্লাহর পথে চলার প্রেরণা ও জ্ঞান লাভের জন্য যিকরের মাজলিস মুমিনের জীবনে অপরিহার্য।

আমাদের দৈনন্দিন সাংসারিক ও জাগতিক কাজকর্ম, সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে আমাদের সংমিশ্রণ, লেনদেন ও কথাবার্তা আমাদের হৃদয়গুলিকে কঠিন করে তোলে। মৃত্যুর চিন্তা, আখিরাতের চিন্তা, তাওবার চিন্তা ইত্যাদি কল্যাণময় অনুভূতি একটু দূরে সরে যায়। নিয়মিত ও সার্বক্ষণিক ব্যক্তিগত যিকরের পাশাপাশি যিকরের মাজলিস আমাদের হৃদয়গুলিকে পবিত্র ও আখিরাতমুখী করার জন্য খুবই উপকারী। হৃদয়ের কাঠিন্য দূর করতে, হৃদয়কে আখিরাতমুখী করতে, আল্লাহ তা’লা ও তাঁর মহান রাসূল (সা.)-এর মহব্বত দিয়ে হৃদয়কে পূর্ণ করতে, আল্লাহর স্মরণের ও তাঁর ভয়ে চোখের পানি দিয়ে হৃদয়কে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করতে যিকরের মাজলিস অতীব প্রয়োজনীয়। যিকরের মাজলিসে একজন পরিচালক বা আলোচক থাকতে পারেন। আবার মাজলিসের প্রত্যেকেই কিছু কিছু আলোচনা করতে পারেন।


‘যিকরের মাজলিসের’ ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলির লক্ষণীয়:

১. যিকরের মাজলিসের সাথী ও নেতা

(ক) নেককার মানুষদের সাহচার্য দীনের পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অনেক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমি ‘এহইয়াউস সুনান’ গ্রন্থে বেলায়াতের পথে পীর-মুরিদীর সুন্নাত-সম্মত গুরুত্ব ও পদ্ধতি আলোচনা করেছি। সকল মুমিনেরই প্রয়োজন এমন কিছু মানুষের সাহচার্য গ্রহণ করা যাঁদের মধ্যে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান ও তাকওয়া আছে। যাঁদের মধ্যে ইলম ও আমলের সমন্বয় আছে। যাঁদেরকে দেখলে ও যাঁদের কাছে বসলে আল্লাহর পথে চলার, আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর পথে চলার এবং তাঁর সুন্নাত অনুসরণের প্রেরণা পাওয়া যায়।


(খ) এ ধরনের সঙ্গী নির্বাচনে সুন্নাতের দিকে খুবই লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন। পূর্ববর্তী সকল বুজুর্গই ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’ বা সুন্নাত প্রেমিক মানুষদের সাহচার্য গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে সকলেই ‘আহলুস সুন্নাত’ বা সুন্নী বলে দাবি করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) এদের পরিচয় দিয়ে বলেছেন, “আমি ও আমার সাহাবীগণ যার উপরে রয়েছি, তার উপরে যারা থাকবে তারাই’ মুক্তিপ্রাপ্ত দল। কাজেই যারা তাঁদের অন্তরকে মহিমান্বিত আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল (সা.)-কে প্রদান করেছেন, যাঁরা নিজেদের প্রবৃত্তি ও পছনদ অপছনদকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতের অধীন করে দিয়েছেন, যাঁরা তাঁর সুন্নাতের জন্য অন্য সবকিছু ত্যাগ করতে রাজি, তাঁদেরকে সঙ্গী হিসাবে নির্বাচিত করুন। যারা সুন্নাতে রাসূল (সা.) ও সুন্নাতে সাহাবার বাইরে কর্ম করতে পছনদ করেন, সুন্নাতের মধ্যে থেকে বেলায়াত অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন, বিভিন্ন অজুহাতে, ওসীলায়, যুক্তিতে যারা বিদ‘আত বহাল রাখতে আগ্রহী হন, যারা বিদ‘আতে হাসানার নামে সুন্নাত-বিরোধী কাজ করতে চান বা যারা সুন্নাতের চেয়ে বিদ‘আতে হাসানাকে বেশি মহব্বত করেন তাঁরা নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাত’ বলে দাবি করলেও তাদের কর্ম তাদের কথা মিথ্যা বলে প্রমাণ করে। এদের সঙ্গ পরিত্যাগ করুন। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, তাঁর উম্মাতের মধ্যে এরূপ মানুষ আসবে, যারা মুখে যা দাবি করবে কর্মে তা করবে না, আর এমন কর্ম করবে যে কর্ম করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় নি। এদের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না।


(গ) এভাবে নির্বাচিত আলিম, পথপ্রদর্শক বা সঙ্গীকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য ভালবাসুন। তাঁদের সাথে নিয়মিত যিকরের মাজলিসে বসার ব্যবস্থা করুন। সপ্তাহে বা মাসে নির্ধারিত বা অনির্ধারিতভাবে মাঝে মাঝে এঁদের সাথে বসে নির্ধারিত বা অনির্ধারিত সময় ইলম ও ঈমান বৃদ্ধির জন্য আল্লাহর যিকরে রত থাকুন।


২. যিকরের মাজলিসের বিষয় ও যিকর-আযকার

(ক) উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখেছি যে, যিকরের মাজলিস মূলত ঈমান ও ইলম বৃদ্ধির মাজলিস। এই মাজলিসের মূল বিষয় আলোচনা ও ওয়ায। আমরা সাধারণত মনে করি যে, যিকরের মাজলিস অর্থ একাকী পালনীয় যিকর আযকারগুলি একত্রে পালন করার মাজলিস। ধারণাটি ভুল ও সুন্নাতের খেলাফ।


আমরা দেখেছি যে, যিকর মূলত দুই প্রকার - প্রথমত, স্মরণ করা এবং দ্বিতীয়ত, স্মরণ করানো। যিকরের মাজলিসের অন্যতম প্রধান যিকর স্মরণ করানো বা ওয়ায আলোচনা। আমাদের বুঝতে হবে যে, তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি যিকর মুমিন একাকী পালন করতে পারেন। কিন্তু ইলম, তাকওয়া ও আল্লাহর পথে চলার আগ্রহ বৃদ্ধিমূলক আলোচনা একা করা যায় না বা করতে অসুবিধা। যিকরের মাজলিসে এই বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। যিকরের মাজলিসে ঈমান ও ইলম বৃদ্ধিমূলক আলোচনা করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তাসবীহ, তাহলীল, সালাত, সালাম ইত্যাদি যিকর পালন করতে হবে।


আলোচক মানুষের জীবনে আল্লাহর অগণিত নিয়ামত, বিশেষ করে হেদায়াতের নিয়ামত আলোচনা করে উপস্থিতির মনের মধ্যে হামদ ও শুকুরের (কৃতজ্ঞতা) অনুভূতি জাগ্রত করলেন। উপস্থিত সকলে আবেগ ও ভালবাসার সাথে কিছুক্ষণ আল্লাহর হামদ ও সানা করবেন ও কিছুক্ষণ প্রত্যেকে নিজে নিজে মনে মনে বা মৃদু স্বরে “আল-‘হামদু লিল্লাহ” ও আল্লাহর প্রশংসা ও মর্যাদা প্রকাশক অন্যান্য মাসনূন বাক্য দ্বারা যিকর করবেন। তিনি মানুষের পরিণতি, মৃত্যু ও আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করবেন। দুনিয়ার জীবনের অনিশ্চয়তা, ক্ষণস্থায়িত্ব, আখিরাতের স্থায়িত্ব, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর আগমন, পাপের পরিণতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে হৃদয়গুলিকে আখিরাতমুখী করবেন।

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের কিভাবে ভালবাসেন, আর বান্দা তাঁকে ভালবেসে কী মহান নিয়ামত পেতে পারে সে বিষয়ে আলোচনা করবেন। হৃদয়কে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য পার্থিব বিষয়ের লোভ ও ভালবাসায় জড়ানোর পরিণতি আলোচনা করবেন। আল্লাহর দ্বীন জানতে, পালন করতে, প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা ও এর সুমহান পুরস্কার বিষয়ে আলোচনা করবেন। আলোচক ও উপস্থিতি আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মনের আবেগ অনুসারে “লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” ও অন্যান্য মাসনূন যিকর পালন করবেন। প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে।

পাপের ক্ষতি ও ভয়াবহতা, তাওবা ও ইস্তেগফারের প্রয়োজনীয়তা, ফযীলত, গুরুত্ব ইত্যাদি আলোচনা করে হৃদয়ের মধ্যে তাওবার প্রেরণা সৃষ্টি করবেন। সবাই নিজের মতো আবেগ সহকারে তাওবা করবেন ও ইস্তেগফারের যিকর করবেন। কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন তাওবার ঘটনা এবং এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীস আলোচনা ও চিন্তা করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে কত বড় নিয়ামত দিলেন, তিনি [নবী (সা.)] আমাদের জন্য কত কষ্ট করলেন, আমাদেরকে কত ভালবসাতেন এবং তাঁর প্রতি আমাদের কত বেশি ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন তা আলোচনা করবেন। এ বিষয়ক কুরআন ও হাদীস আলোচনা করবেন। আলোচনার মধ্যে সকলে আবেগ, ভক্তি ও ভালবাসার সাথে প্রত্যেকে নিজের মতো মনে মনে বা মৃদুস্বরে সালাত ও সালাম পাঠ করবেন। আলোচক ও উপস্থিতি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত আলোচনা ও তার অর্থ চিন্তা করবেন। এ সকল আয়াতের, ভাব ও মর্মকে হৃদয়ের মধ্যে গেঁথে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। পূর্ববর্তী যুগের নেককার বুজুর্গগণ, বিশেষত সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ ও কুরআন ও সহীহ হাদীসে বর্ণিত নবীগণ ও পূর্ববর্তী যুগের বুজুর্গগণের আল্লাহর প্রেম, তাওবা, জিহাদ, যুহদ, তাকওয়া, সবর ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করবেন। এ সকল আলোচনার ফাঁকে মনের আবেগ ও প্রেরণা অনুসারে মাসনূন বাক্যদ্বারা মাসনূনভাবে আল্লাহর যিকর করবেন। সকল মুসলমানের জন্য প্রাণখুলে দু‘আ করবেন। পূর্ববর্তী সকল মুসলিম, বিশেষত নেককার বান্দাদের জন্য মাগফিরাত ও মহব্বত প্রার্থনা করবেন। উম্মতে মুহাম্মাদীর হেদায়াত, বিজয় ও দুনিয়া- আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করবেন।


(খ) বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা দরকার যে, এ সকল মাজলিসের আলোচনা যেন মহান আল্লাহর দিকে প্রেরণাদায়ক, আখিরাতমুখী, নিজেদের গোনাহ ও অপরাধের স্মারক ও ক্রন্দন উদ্দীপক হয়। বিতর্ক, উপস্থিত বা অনুপস্থিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সমালোচনা, অহঙ্কার, বিদ্বেষ ইত্যাদি কেন্দ্রিক সকল আলোচনা পরিহার করা প্রয়োজন।


(গ) সকল প্রকার আলোচনা কুরআন কারীম ও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস কেন্দ্রিক হতে হবে। মিথ্যা, বানোয়াট, অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা, গল্প, কাহিনী ইত্যাদি সতর্কতার সাথে পরিহার করতে হবে।


(ঘ) সকল আলোচনা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ কেন্দ্রিক হওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। বানোয়াট, অনির্ভরযোগ্য ঘটনা বা কাহিনী অথবা পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের জীবনী আলোচনা না করে নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত নির্ভযোগ্য গন্থ থেকে সংগৃহীত সীরাত, সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবনী, তাঁদের বুজুর্গী, কারামত, তাকওয়া, বেলায়াত ইত্যাদি আলোচনা করা উচিত। এতে দ্বিবিধ উপকার হয়।

প্রথমত, আমাদের অন্তরগুলি ক্রমান্বয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের মহব্বত বেশি বেশি অর্জন করতে থাকে। আর তাঁদের মহব্বত যেমন ঈমানের অংশ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদত, তেমনি সকল বেলায়াত, কামালাত ও বুজুর্গীর অন্যতম মাধ্যম।

দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরে তাঁর সাহাবীগণ আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ। তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী যুগের মানুষদের প্রশংসা তিনি নিজে করেছেন। এদের পরবর্তী যুগের বুজুর্গগণের কাহিনী আলোচনা করলে অনেক সময় ভুল বুঝার অবকাশ থাকে। এ সব যুগের অনেক বুজুর্গ তাঁদের বুজুর্গী সত্ত্বেও ভুলবশত বিভিন্ন বিতর্কিত বা সুন্নাত বিরোধী কর্মে নিপতিত হয়েছেন। - কেউ সামা কাওয়ালী করেছেন, কেউ খেলাফে সুন্নাতভাবে নির্জনবাস করেছেন। কেউ কেউ খেলাফে সুন্নাত বিভিন্ন আবেগী কথা বিভিন্ন হালতে বলেছেন। এ সব কথা সাধারণ শ্রোতা বুঝতে নাও পারেন। এজন্য সর্বদা নবীজী (সা.)-এর জীবন কেন্দ্রিক ও সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবন কেন্দ্রিক আলোচনা করা উচিত।


৩. কুরআন কেন্দ্রিক যিকর

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, কুরআন কারীম তিলাওয়াত ও আলোচনা যিকরের মাজলিসের অন্যতম যিকর। কুরআন কেন্দ্রিক ‘যিকরের মাজলিস’ বা ‘হালকায়ে যিকর’ বিভিন্ন রকম হতে পারে। প্রথম প্রকার যিকর - একজন তিলাওয়াত করবেন আর অন্য যাকিরগণ মহব্বতের সাথে শুনবেন। এ ধরনের ‘হালাকায়ে যিকর’-এ কোনো ভালো নেককার হাফিজকে কুরআন তিলাওয়াতের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। না হলে যাকিরগণের মধ্য থেকে যিনি আলিম বা ভালো ক্বারী তিনি তিলাওয়াত করবেন। কুরআন কারীম তিলাওয়াত ও শোনা উভয়ই অত্যন্ত বড় ইবাদত ও যিকর। তবে যতক্ষণ মহব্বত ও আবেগ থাকবে ততক্ষণ এভাবে যিকর করতে হবে। মাইকে তিলাওয়াত করানো, যাদের কুরআন শোনার মহব্বত ও আবেগ নেই তাদেরকে শোনানো, রাতারাতি খতম করা ইত্যাদি কর্মগুলি সুন্নাতের খেলাফ ও কুরআনের সাথে বেয়াদবীমূলক কর্ম। প্রয়োজনে মাজলিসের উপস্থিত ব্যক্তিগণের জন্য মাইক বা সাউন্ড বক্স ব্যবহার করা যাবে।

কুরআন কেন্দ্রিক যিকরের মাজলিসের দ্বিতীয় প্রকার - অর্থ আলোচনা করা। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত তিলাওয়াত করে তার অর্থ ও শিক্ষা আলোচনা করে ঈমান ও মহব্বত বৃদ্ধি করতে হবে। কুরআন কেন্দ্রিক যিকরের মাজলিসের তৃতীয় প্রকার- হৃদয়ে অর্থ অনুধাবন ও অর্থ অনুসারে হৃদয়কে আলোড়িত করার চেষ্টা। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে বারবার পাঠ করে এগুলির অর্থ ‘মুরাকাবা’ বা হৃদয়ের মধ্যে জাগরুক করে অর্থের আলোকে ও অর্থের প্রেরণা অনুসারে আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা, ইস্তিগফার ইত্যাদি করা। এ সময়ে প্রত্যেকে নিজের অন্তরের দিকে লক্ষ্য রেখে আদবের সাথে নিজের মতো যিকর করতে হবে।


৪. রাসূলুল্লাহর (সা.) জীবন কেন্দ্রিক যিকর

যিকরের মাজলিসের অন্যতম একটি বিষয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সহীহ সীরাত, শামায়েল ও তাঁর জীবন ও কর্ম সংক্রান্ত সকল বিষয়। আমরা ইতঃপূর্বে আলোচনা করেছি যে, সাহাবীগণের যিকরের মাজলিসের মূল বিষয়গুলির অন্যতম ছিল ঈমান বৃদ্ধিকারক ও আল্লাহর নিয়ামত সংক্রান্ত আলোচনা করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) কেনিদ্রক যে কোনো আলোচনা তাঁর প্রতি আমাদের মহব্বত বৃদ্ধি করবে, যা আমাদের ঈমানের অন্যতম অংশ। এছাড়া আমাদের জীবনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিয়ামত তাঁর মহান নবীর উম্মত হওয়ার সৌভাগ্য। এগুলি সর্বদা আলোচনা করা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।


সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবন আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁদের জীবনের অধিকাংশ মাজলিসই ছিল রাসূলুল্লাহ (সা.) কেন্দ্রিক। বিভিন্ন কাজে তাঁর সুন্নাত, তাঁর রীতি, তাঁর কর্ম, তাঁর জীবনী, তাঁর বাণী, তাঁর শিক্ষা, তাঁর মুবারাক আকৃতি, তাঁর উঠা-বসা, শোওয়া, তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ, তাঁর জন্ম, তাঁর ওফাত, তাঁর পরিবার পরিজন ইত্যাদি তাঁদের সকল মাজলিসের অন্যতম বিষয় ছিল। এগুলি আলোচনা করতে তাঁরা চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন, আবেগ ও মহব্বতে হৃদয়কে পূর্ণ করেছেন। আমাদের জীবনের নিয়মিত যিকরের মাহফিলের অন্যতম বিষয় এগুলি হতে হবে। এ সকল আলোচনার সময় স্বভাবতই বারবার তাঁর উপর প্রত্যেক যাকির নিজনিজভাবে মহব্বত ও আবেগসহ সালাত ও সালাম পাঠ করবেন। আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, সালাত-সালাম যিকরের মাহফিলের অন্যতম যিকর।


এখানে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে এই ধরনের যিকরের মাহফিল সাধারণভাবে মীলাদ মাহফিল নামে পালিত ও পরিচিত। মীলাদ মাহফিলের পরিচয়, উদ্ভাবন ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আমি “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি

যে, মীলাদ অনুষ্ঠানে অনেকগুলি মাসনূন ইবাদত পালন করা হয়, যেগুলির মধ্যে রয়েছে উপরের মাসনূন যিকর : রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বেলাদাত, ওফাত, জীবনী, কর্ম ইত্যাদি আলোচনা, সালাত, সালাম, তাঁর প্রতি মহব্বত বৃদ্ধি ইত্যাদি। অপরদিকে এগুলি পালনের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগতভাবে আমরা কিছু খেলাফে সুন্নাত কাজ করি।

প্রথমত, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এবং পরবর্তী যুগে সাহাবী-তাবেয়ীগণ এসকল ইবাদতকে ‘যিকরের মাহফিল’, ‘সুন্নাতের মাহফীল’, ‘হাদীসের মাজলিস’, ‘সীরাতের মাজলিস’ ইত্যাদি নামে করতেন। “মীলাদ” নামে কোনো মাহাফিল, অনুষ্ঠান আচার, উদযাপন তাদের মধ্যে ছিল না। নাম বা পরিভাষার চেয়ে বিষয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবুও নাম ও পরিভাষার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণের মধ্যে প্রচলিত নাম ও পরিভাষা ব্যবহার উত্তম। বাধ্য না হলে কেন আমরা তাঁদের রীতি, নীতি বা সুন্নাতের বাইরে যাব?


দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র মীলাদ বা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম আলোচনা ও উদযাপনের জন্য মাজলিস করা, সালাত বা সালাম পাঠের জন্য উঠে দাঁড়ানো, সমস্বরে ঐক্যতানে সালাত বা সালাম পাঠ করা ইত্যাদি সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সুন্নাতে সাহাবার খেলাফ। এই প্রকারের যিকরের মাজলিসে আলোচক সহীহ হাদীসের উপর নির্ভর করে আদব ও মহব্বতের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুবারক আকৃতি, কর্ম ও জীবনীর বিভিন্ন দিক, তাঁর প্রেরণের মাধ্যমে আল্লাহর মহান নিয়ামতের আলোচনা করবেন। আলোচনার মধ্যে তিনি এবং যাকিরগণ যিকরের সকল আদবসহ পরিপূর্ণ মহব্বত, ভয়, ভক্তি ও বিনয়ের সাথে অনুচ্চস্বরে প্রত্যেকে নিজের মতো করে সালাত ও সালাম পাঠ করতে হবে। আর এই ‘মীলাদ’-এর সুন্নাত সম্মত রূপ।


তৃতীয়ত, খেলাফে-সুন্নাত পদ্ধতির সবচেয়ে মারাত্মক দিক দলাদলি ও হানাহানি। বস্তুত, মুসলিম উম্মাহর সকল দলাদলি- হানাহানির অন্যতম কারণ মাসনূন ইবাদতের জন্য ‘খেলাফে সুন্নাত’ পদ্ধতির উদ্ভাবন। সাহাবীগণের যুগ থেকে প্রায় ৬০০ বৎসর মুসলিম উম্মাহ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম, জীবনী, শিক্ষা, মহব্বত ইত্যাদি আলোচনা করেছেন এবং সালাত-সালাম পাঠ করেছেন। কখনোই এ বিষয়ে মতভেদ ঘটেনি। কারণ বিষয়টি উন্মুক্ত ছিল, প্রত্যেকেই তাঁর সুবিধামত তা পালন করেছেন। যখনই এ সকল ইবাদত পালনের জন্য ‘মীলাদ’ নামক পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটল তখনই মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো। এরপর প্রায় ৪০০ বৎসর পরে যখন ‘কিয়াম’-এর উদ্ভাবন ঘটল তখন আবার ‘মীলাদ’-এর পক্ষের মানুষদের মধ্যে নতুন করে মতভেদ ও বিচ্ছিন্নতা শুরু হলো। ক্রমান্বয়ে ‘পদ্ধতি’ই ইবাদতে পরিণত হলো। এখন যদি কেউ সারাদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্ম, জীবনী, মুজিযা, মহব্বত ইত্যাদি আলোচনা করেন এবং সালাত-সালাম পাঠ করেন, কিন্তু মীলাদের পদ্ধতিতে কিয়াম না করেন, তবে মীলাদ-কিয়ামের পক্ষের মানুষেরা তাকে পছন্দ করবেন না। এই পর্যায় থেকে আমাদের অবশ্যই আত্মরক্ষা করতে হবে।


৫. যিকরের মাজলিসের বিদ‘আত ও পাপ

যিকরের মাজলিসের প্রকার, প্রকৃতি, পদ্ধতি ও শব্দাবলী সবকিছু সুন্নাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সকল প্রকার বিদ‘আত, বিশেষত আমাদের দেশে ‘যিকরের মাজলিস’ নামের অনুষ্ঠানের বিদ‘আতগুলি বর্জন করতে হবে। এ সকল খেলাফে সুন্নাত কর্মের মধ্যে রয়েছে: সমবেতভাবে ঐক্যতানে যিকর, উচ্চৈঃস্বরে যিকর, বিশেষ পদ্ধতিতে শব্দ করে যিকর, যিকরের নিয়্যাত, ‘ইল্লাল্লাহ’ যিকর, ‘ইয়া রাহমাতুল্লিল আলামীন’ ইত্যাদি বাক্যের যিকর, গজল বা গান গেয়ে বা গানের তালে যিকর, শরীর দুলিয়ে, হেলেদুলে, লাফালাফি করে বা নাচানাচি করে যিকর ইত্যাদি অগণিত খেলাফে সুন্নাত, বিদ’আত বা শিরকমূলক শব্দ, বাক্য ও পদ্ধতি আমাদের দেশে যিকর নামে পরিচিত।


আমারা যিকর বলতে এসকল খেলাফে সুন্নাত ও বিদ‘আত কর্মগুলিই বুঝি যে যত বেশি খেলাফে সুন্নাত বা বিদ‘আতভাবে যিকর করছে সেই ততবড় যাকির ও তত বেশি মারেফাতের অধিকারী। আর যে যত সুন্নাত অনুসারে সাহাবীগণের মতো যিকর করছে সে ‘ওহাবী’ অথবা নীরস আলিম; কোনো মারেফাত তার নেই। যত মারেফাতের উৎস মনে হয় বিদ‘আত। দেখে শুনে মনে হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের কোনো মারেফাতই ছিল না। বিদ‘আত উদ্ভাবনের পরেই মারেফাতের সুভ সূচনা এবং বিদ‘আতেই সকল মারিফাত! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!


মুহতারাম পাঠক, এ সকল বড় বড় ফাঁকা বুলিতে ধোঁকাগ্রস্ত হবেন না। উপরে একাধিকবার আমরা আলোচনা করেছি যে, ‘ইত্তেবায়ে সুন্নাত’ বা সুন্নাতের অনুসরণ ছাড়া কোনো ইবাদত হয় না, বেলায়েত হয় না, মারেফত হয় না। সুন্নাতের বাইরে ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নেই, তা যতই চকচক করুক বা চমকদার হোক।

যিকর সংক্রান্ত খেলাফে সুন্নাত কর্ম দুই প্রকারের: যিকরের শব্দের মধ্যে উদ্ভাবন ও যিকরের পদ্ধতিতে উদ্ভাবন। পদ্ধতিগত খেলাফে সুন্নাত কর্মের মধ্যে রয়েছে - বিশেষ পদ্ধতিতে বসে, মাথা বা শরীর ঝাঁকিয়ে, শরীরের বিভিন্ন স্থানে যিকরের শব্দ দ্বারা ধাক্কা বা আঘাতের কল্পনা করে, বিশেষ পদ্ধতিতে উচ্চারণ করে, গান বা গজলের তালে তালে, সমস্বরে ঐক্যতানে, উচ্চৈঃস্বরে বা চিৎকার করে, লাফালাফি করে বা নেচে নেচে যিকর করা।


এগুলি সবই খেলাফে সুন্নাত। কেউ কোনোভাবে একটি হাদীসও খুঁজে পাবেন না যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বা তাঁর সাহাবীগণ এভাবে যিকর করেছেন। বিভিন্ন সাধারণ যুক্তি ও বিশেষভাবে মনোযোগ সৃষ্টির যুক্তিতে এগুলি করা হয়। আমরা ইতঃপূর্বে এ সকল বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, শিক্ষা, অনুশীলন বা মনোযোগের জন্য কোনো জায়েয পদ্ধতি ব্যক্তিগতভাবে কিছু সময়, প্রয়োজনমতো বা মাঝে মাঝে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এগুলিকে নিয়মিত রীতিতে পরিণত করলে বা ইবাদতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করলে তা সুন্নাতের বিপরীতে বিদ‘আতে পরিণত হয় এবং এর ফলে মূল সুন্নাত পদ্ধতি ‘মৃত্যুবরণ করে’ বা সমাজ থেকে উঠে যায়।

পদ্ধতিগত খেলাফে সুন্নাতের চেয়েও মারাত্মক শব্দগত খেলাফে সুন্নাত যিকর। একজন যাকির মাসনূন শব্দে যিকর করতে করতে আবেগে হয়ত মাথা নাড়াতে পারে বা যিকরের আবেগ তার নড়াচড়ায় প্রকাশ পেতে পারে। ব্যক্তিগত ও সাময়িকভাবে তা অনেক সময় জায়েয, যদিও সুন্নাত নয়। কিন্তু একজন মুমিন কেন এমন শব্দ ব্যবহার করে যিকর করবেন যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যবহার করেননি? এ

ক্ষেত্রে ওযর খুঁজে বের করা আরো কষ্টকর। কী প্রয়োজন আমার বিভিন্ন যুক্তি ও ‘অকাট্য দলিল’ দিয়ে কষ্ট করে এমন একটি যিকর পালন করা এবং প্রচলন করা যা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ করেননি এবং যা করলে কী পরিমাণ সাওয়াব হবে তা আমাদের মোটেও জানা নেই?