রমযান মাসের ৩০ আসর ষোড়শ আসর শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ২ টি

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি পদস্খলন মিটিয়ে দেন ও উপেক্ষা করেন, ক্ষমা করেন আবোল-তাবোল কথা ও ছাড় দেন। যে কেউ তাঁর কাছে আশ্রয় চায় সে সফল হয়, যে কেউ তার সাথে লেন-দেন করে সেই লাভবান হয়, তিনি আকাশকে বিনা খুঁটি উপরে উঠিয়েছেন সুতরাং তুমি চিন্তা কর এবং খাঁটি ও স্বচ্ছ হও। তিনি নাযিল করেছেন বৃষ্টি ফলে ফসলাদিকে দেখা যায় পানিতে সাতরাতে। প্রাচুর্যও প্রদান করেন আবার দারিদ্র্যতাও দেন, কখনও কখনও দারিদ্র্যতা হয় বান্দার জন্য উপযোগী। এমন বহু প্রাচুর্যশীল রয়েছে, যার প্রাচুর্য তাকে গর্ব অহংকারের খুব নিকৃষ্টতম পর্যায়ে নিপতিত করেছে। এ তো ‘কারূন’ অনেক কিছুরই সে মালিক হয়েছিল, কিন্তু সে সামান্যের ব্যাপারে ছাড় দিতে রাযী ছিল না, তাকে সাবধান করা হয়েছিল কিন্তু সে জাগ্রত হয় নি, তাকে তিরস্কার করা হয়েছিল কিন্তু তিরস্কার তার কাজে আসে নি, বিশেষ করে যখন তার জাতির লোকেরা তাকে বলেছিল, ‘তুমি বেশি খুশি হয়ো না। আমি তাঁর প্রশংসা করি যতক্ষণ পর্যন্ত দিন গড়িয়ে বিকেল হবে, আর রাত পেরিয়ে হবে সকাল।

আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি অমুখাপেক্ষী, দানবীর, প্রশস্ত দান করার মাধ্যমে দয়া করেছেন এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি আল্লাহর জন্য তাঁর জান ও মাল ব্যয় করেছেন, সত্যকে করেছেন স্পষ্ট ও প্রকাশিত।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর সালাত পেশ করুন, আর তার সাথী আবু বকরের উপর, যিনি সফরে ও অবস্থানস্থল সর্বদা তার সাথে ছিলেন, কখনও তাকে পরিত্যাগ করেন নি। অনুরূপ উমারের উপর, যিনি দিনের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে ছিলেন সদা সচেষ্ট। আর উসমানের উপর, যিনি আল্লাহর রাস্তায় বহু খরচ করেছেন এবং সংশোধন করেছেন। তদ্রূপ আলীর উপর, যিনি ছিলেন রাসূলের চাচাতো ভাই, তার ব্যাপারে যারা বাড়াবাড়ি কিংবা সম্মানহানি থেকে তাদের থেকে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ মুক্ত; অনুরূপভাবে বাকী সাহাবীগণের উপর এবং যারা সুন্দরভাবে তাদেরকে অনুসরণ করেছেন তাদেরও উপর। আর আল্লাহ তাদের উপর যথাযথ সালামও পেশ করুন।

প্রিয় ভাইয়েরা!

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥ ﴾ [البينة: ٥]

‘তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা নিবিষ্ট মনে একান্তভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং যাকাত প্রদান করব। আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।’ (সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত: ৫)

* আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَقۡرِضُواْ ٱللَّهَ قَرۡضًا حَسَنٗاۚ وَمَا تُقَدِّمُواْ لِأَنفُسِكُم مِّنۡ خَيۡرٖ تَجِدُوهُ عِندَ ٱللَّهِ هُوَ خَيۡرٗا وَأَعۡظَمَ أَجۡرٗاۚ وَٱسۡتَغۡفِرُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمُۢ ٢٠ ﴾ [المزمل: ٢٠]

‘আর সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আল-মুযযাম্মিল, আয়াত: ২০)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن رِّبٗا لِّيَرۡبُوَاْ فِيٓ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرۡبُواْ عِندَ ٱللَّهِۖ وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن زَكَوٰةٖ تُرِيدُونَ وَجۡهَ ٱللَّهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُضۡعِفُونَ ٣٩ ﴾ [الروم: ٣٩]

‘আর তোমরা যে সূদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলত আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত।’ (সূরা আর-রূম, আয়াত: ৩৯)

এ ছাড়াও যাকাত ফরয হওয়ার বিধান সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে।

হাদীসের আলোকে যাকাতের বিধান:

* ‘আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন:

«بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسَةٍ، عَلَى أَنْ يُوَحَّدَ اللهُ، وَإِقَامِ الصَّلَاةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَصِيَامِ رَمَضَانَ، وَالْحَجِّ» ، فَقَالَ رَجُلٌ: الْحَجُّ، وَصِيَامُ رَمَضَانَ، قَالَ: «لَا، صِيَامُ رَمَضَانَ، وَالْحَجُّ»

‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি, যথা- এ কথার সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্যিকারের মাবুদ নেই। সালাত আদায় করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের সিয়াম পালন করা ও হজ আদায় করা। এ কথা শুনে একব্যক্তি বললেন, হজ তারপর কি রমযানের সিয়াম? তিনি বললেন, না বরং প্রথমে রমযানের সিয়াম তারপর হজ। এ ধারাবাহিকতায় আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি।’[1]

* অন্য বর্ণনায় রয়েছে: (ইসলামের ভিত্তি হলো) এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে ‘এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল’। তারপর পূর্বোক্ত হাদীসের অনুরূপ।[2]

সুতরাং বোঝা গেল, যাকাত ইসলামের একটি রুকন ও মৌলিক ভিত্তিগুলোর একটি।

আর কুরআনের বহু জায়গায় সালাতের পাশাপাশি যাকাতের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

ইজমা:

সকল মুসলিম অকাট্যভাবে একমত যে, যাকাত একটি ফরয বিধান। সুতরাং যাকাত ফরয জেনেও যদি কোনো ব্যক্তি তা অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে।আর যে যাকাত প্রদানে কৃপণতা করবে বা পরিমানের চেয়ে কম দেবে, সে লাঞ্ছনা ও কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে।

[1] মুসলিম: ১৬।

[2] বুখারী: ৮; মুসলিম: ১৬

প্রথম প্রকার: ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্য ও ফল-ফলাদী

* কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَنفِقُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا كَسَبۡتُمۡ وَمِمَّآ أَخۡرَجۡنَا لَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِۖ ﴾ [البقرة: ٢٦٧]

‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমরা তোমাদের জন্য ভুমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় কর।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৬৭)

* অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَءَاتُواْ حَقَّهُۥ يَوۡمَ حَصَادِهِۦۖ ﴾ [الانعام: ١٤١]

‘আর তোমরা ফসল কাটার সময় তার হক (যাকাত) আদায় কর।’ (সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৪১)

আর সম্পদের সবচেয়ে বড় হক হচ্ছে যাকাত।

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«فِيمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا العُشْرُ، وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ العُشْرِ»

‘আসমান ও ঝর্ণার পানিতে কিংবা স্বেচ্ছা উৎপাদিত ফসলের মধ্যে এক দশমাংশ আর যা সেচের মাধ্যমে আবাদ হয় তার মধ্যে বিশভাগের এক ভাগ যাকাত প্রদেয়।’[1]

ফসলের ওপর যাকাত ফরয হওয়ার নির্ধারিত পরিমাণ হলো পাঁচ ওসক। কারণ,

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لَيْسَ فِي حَبٍّ وَلَا ثَمَرٍ صَدَقَةٌ، حَتَّى يَبْلُغَ خَمْسَةَ أَوْسقٍ»

‘শস্য বা ফলমুলের ওপর যাকাত ফরয হবে না। যতক্ষণ তা পাঁচ ওসক পরিমাণ না হয়।’[2]

আর ওসকের পরিমাণ হলো; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যবহৃত সা‘ এর ৬০ সা‘ সমপরিমাণ। তাহলে নিসাব হলো, তিনশ সা‘, আর এক সা‘র পরিমাণ হলো ২০৪০ গ্রাম (দুই কেজি চল্লিশ গ্রাম)। সুতরাং নিসাবের পরিমাণ দাঁড়ালো ৬১২ কেজি। তাই এর কমে যাকাত ফরয নয়। ওই নিসাবে বিনাশ্রমে প্রাপ্ত ফসলের যাকাতের পরিমাণ হলো এক দশমাংশ আর শ্রম ব্যয়ে প্রাপ্ত ফসলের এক বিশমাংশ।

ফলমূল, শাক-সবজি, তরমুজ ও জাতীয় ফসলের ওপর যাকাত ফরয নয়।

* কেননা ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘শাক-সবজিতে যাকাত নেই’।

* তেমনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘আপেল বা এ জাতীয় ফলের ওপর যাকাত ফরয নয়।

* তাছাড়া যেহেতু এগুলো (নিত্যপ্রয়োজনীয়) খাবার জাতীয় শস্য বা ফল নয়, তাই এর ওপর যাকাত নেই। তবে যদি এসব টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তাহলে মূল্যের ওপর নিসাব পূর্ণ হয়ে এক বছর অতিক্রান্ত হবার পর যাকাত ফরয হবে।

দ্বিতীয় প্রকার: যে সকল প্রাণীর ওপর যাকাত ফরয হয়

তাহলো: উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। যদি এ সকল প্রাণী ‘সায়েমা’ হয় তথা মাঠে চরে চষে খায় এবং এগুলোকে বংশ বৃদ্ধির জন্য পালন করা হয় এবং তা নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে এদের যাকাত দিতে হবে। উটের নিসাব ন্যূনতম ৫টি, গরুর ৩০টি, আর ছাগলের ৪০টি।

‘সায়েমা’ ওই সকল প্রাণীকে বলে, যেগুলো সারা বছর বা বছরের অধিকাংশ সময় চারণভূমিতে ঘাস খেয়ে বেড়ায়। যদি এসব প্রাণী সায়েমা না হয়, তবে এর ওপর যাকাত ফরয নয়। কিন্তু যদি এগুলো দ্বারা টাকা-পয়সা কামাই করার উদ্দেশ্য থাকে; যেমন বেচা-কেনা, স্থানান্তর ইত্যাদির মাধ্যমে টাকা-পয়সা আয় করা, তাহলে তা ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে; আর তখন সেগুলো সায়েমা কিংবা মা‘লুফাহ (যাকে ঘাস কেটে খাওয়ানো হয়) যা-ই হোক না কেন তাতে ব্যবসায়িক পণ্যের যাকাত আসবে; যদি তা স্বয়ং নিসাব পরিমাণ হয় অথবা এসবের মূল্য অন্য ব্যবসায়িক সম্পদের সঙ্গে যুক্ত করলে নিসাব পরিমাণ হয়।


তৃতীয় প্রকার: স্বর্ণ-রৌপ্যের ওপর (নিসাব পরিমাণ হলে) সর্বাবস্থায় যাকাত ফরয। কারণ,

* আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ ٣٥﴾ [التوبة: ٣٤، ٣٥]

‘আর যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে অথচ তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করে না (যাকাত দেয় না)। আপনি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ প্রদান করুন। কিয়ামত দিবসে ওই সোনারূপাকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ ও পৃষ্ঠে ছেকা দেয়া হবে এবং বলা হবে এ হলো তোমাদের সে সকল ধন-সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে। সুতরাং আজ জমা করে রাখার স্বাদ গ্রহণ কর।’ (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৪-৩৫)

আয়াতে ‘জমা করে রাখা’ বলতে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করা বুঝানো হয়েছে। আর আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে, যাকাতে ব্যয় করা।

* তাছাড়া সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلَا فِضَّةٍ، لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحُ مِنْ نَارٍ، فَأُحْمِيَ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ، فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ، كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ »

‘যে সকল সোনা-রূপার মালিকগণ তাদের সম্পদ থেকে নির্ধারিত হক (যাকাত) আদায় না করে, কিয়ামত দিবসে তার জন্য কতগুলো আগুনের পাত প্রস্তুত করে তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দ্বারা ওই লোকদের ললাট ও পিঠে চেপে ধরা হবে। তাপ কমে গেলে উত্তপ্ত করে পুনরায় চেপে ধরা হবে। পঞ্চাশ বছর দীর্ঘ সময় বান্দাদের হিসাব-নিকাশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে শাস্তি চলতেই থাকবে।’[3]

* ‘সোনা-রূপার হক’ আদায় না করার অর্থ, যাকাত আদায় না করা। যা অন্য বর্ণনায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। যেখানে এসেছে,

«ما من صاحب كنز لا يؤدي زكاته»

‘যে সকল সোনা-রূপার মালিকগণ তাদের সম্পদের যাকাত আদায় না করে....’।

সোনা-রূপার যাবতীয় প্রকারে যাকাত ফরয হবে। চাই তা হোক টাকা পয়সা, চাকা বা টুকরা, পরিধেয় অলংকার বা ধার দেওয়ার মত অলংকার অথবা অন্য প্রকার সোনা-রূপা এসব কিছুর ওপর যাকাত ফরয। কারণ সোনা-রূপার উপর যাকাত ফরয করে বর্ণিত সকল আয়াত বা হাদীস ব্যাপকভাবে এর উপর প্রমাণবহ।

* ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবন ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- وَمَعَهَا ابْنَةٌ لَهَا وَفِى يَدِ ابْنَتِهَا مَسَكَتَانِ غَلِيظَتَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهَا « أَتُعْطِينَ زَكَاةَ هَذَا ». قَالَتْ لاَ. قَالَ «أَيَسُرُّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللَّهُ بِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ ». قَالَ فَخَلَعَتْهُمَا فَأَلْقَتْهُمَا إِلَى النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- وَقَالَتْ هُمَا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ.

‘একদা একজন মহিলা তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সম্মুখে এলেন। ওই মেয়ের হাতে স্বর্ণের দুটি ভারি ও মোটা বালা ছিলো। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি এসবের যাকাত দাও? মেয়েটি বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে কিয়ামতের দিন আল্লাহ এসবের দ্বারা দুটি আগুনের চুড়ি বানিয়ে তোমার হাতে পরিয়ে দেবেন? মেয়েটি এ কথা শুনে বালা দুটি খুলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে বলল, এসব আল্লাহর রাস্তায় দান করলাম।’[4]

* অন্য এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دَخَلَ عَلَىَّ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَرَأَى فِى يَدِى فَتَخَاتٍ مِنْ وَرِقٍ فَقَالَ « مَا هَذَا يَا عَائِشَةُ ». فَقُلْتُ صَنَعْتُهُنَّ أَتَزَيَّنُ لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ «أَتُؤَدِّينَ زَكَاتَهُنَّ ». قُلْتُ لاَ أَوْ مَا شَاءَ اللَّهُ. قَالَ «هُوَ حَسْبُكِ مِنَ النَّارِ ».

‘একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছে এলেন, তখন আমার হাতে কয়েকটি বড় বড় রূপার আংটি ছিল। তিনি বললেন, এসব কী? আমি বললাম, আপনার সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য এগুলো তৈরি করেছি। তিনি বললেন, তুমি কি এসবের যাকাত প্রদান করো? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তোমার জাহান্নামে যাওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।’[5]

হাদীসটি আবু দাউদ সংকলন করেছেন। অনুরূপ বাইহাকী ও হাকেম, আর তিনি সেটাকে সহীহ বলেছেন এবং আরও বলেছেন যে, এটি বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী।

ইবন হাজার ‘আত-তালখীস’ গ্রন্থে বলেন, এটি বুখারী শর্ত অনুযায়ী।

ইবন দাকীকিল ‘ঈদ বলেন, এটি মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী।


সোনার নিসাব পূর্ণ না হলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না। আর সে নিসাব হলো, ২০ দিনার। কারণ,

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোনার ব্যাপারে বলেছেন,

«وَلَيْسَ عَلَيْكَ شَىْءٌ حَتَّى يَكُونَ لَكَ عِشْرُونَ دِينَارًا»

‘(স্বর্ণের যাকাত হিসেবে) তোমার ওপর কিছুই ওয়াজিব হবে না যাবৎ তোমার কাছে বিশ দিনার পরিমাণ স্বর্ণ না হবে।’[6]

* দিনার বলতে ইসলামী দিনার উদ্দেশ্য যার ওজন এক মিছকাল। মিছকাল সমান সোয়া চার গ্রাম। সে হিসাবে সোনার নিসাব হলো ৮৫ গ্রাম। যা সা‘উদী মাপে এগার জুনাইহ ও এক জুনাইহ এর তিন সপ্তমাংশ।[7]

রূপার নিসাব পূর্ণ না হলে তাতে যাকাত ফরয নয়। আর তার নেসাব হলো: পাঁচ ওকিয়্যা। কারণ,

* রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسِ أَوَاقٍ صَدَقَةٌ»

‘পাঁচ ওকিয়্যার কম রূপার ওপর যাকাত নেই।’[8]

এক ওকিয়্যা সমান ৪০ ইসলামী দিরহাম।

সে মতে রূপার হিসাব হলো: ২০০ দিরহাম।

আর এক দিরহাম হলো, এক মিসকালের সাত দশমাংশ। এর মোট ওজন ১৪০ মিসকাল, যার বর্তমান প্রচলিত ওজন হলো: ৫৯৫ গ্রাম।[9] যা আরবী ৫৬ রৌপ্য রিয়াল মুদ্রা।

রৌপ্য ও স্বর্ণের যাকাতের পরিমাণ হচ্ছে, চার দশমাংশ বা ৪০ ভাগের এক ভাগ।

কাগজের তৈরি নোট (টাকা) এর ওপরও যাকাত ফরয; কারণ নোটগুলো রূপার বদলেই চলমান। সুতরাং এসব রূপার স্থলাভিষিক্ত হবে এবং এর মূল্যমান রূপার নিসাবের সমপরিমাণ হলে তাতে যাকাত ফরয হবে।

সোনা-রূপা ও কাগজের নোট ইত্যাদি ওপর সর্বাবস্থায় যাকাত ফরয। চাই তা হাতে মজুদ থাকুক বা অন্য কারো যিম্মাদারীতে থাকুক।

এ থেকে বুঝা যায়, সব ধরনের ঋণ, চাই তা কর্জ হোক বা বিক্রয়কৃত বস্তুর মূল্য হোক কিংবা ভাড়া বা এ ধরনের যা-ই হোক না কেন, তার ওপর যাকাত ফরয। তারপর যদি সে ঋণ এমন লোকের কাছে থাকে যে সচ্ছল এবং সহজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন সে প্রতি বছর অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে সঙ্গে এসবের যাকাত দিবে, অথবা সে ঋণ আদায় করা পর্যন্ত দেরী করে যত বছর যাকাত দেয় নি তত বছরের যাকাত হিসেব করে আদায় করবে।

আর যদি দরিদ্র বা ঋণ আদায়ে টালবাহানাকারী লোককে ঋণ দেয়া থাকে, যার কাছ থেকে সেটা আদায় করা কঠিন হয়ে পড়ে তাহলে ঋণ আদায় হওয়ার পর শুধু ওই ঋণ উসুল করা বছরের যাকাত প্রদান করবে; পূর্ববর্তী বছরগুলোর যাকাত দিতে হবে না।

সোনা-রূপা ছাড়া অন্য সকল খনিজ পদার্থ যদিও তা আরও মূল্যবান হয়, তাতে যাকাত ফরয নয়। তবে তা যদি ব্যবসার পণ্য হয়ে থাকে; তাহলে নিসাব পূর্ণ হলে অবশ্যই ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে যাকাত দিতে হবে।


চতুর্থ প্রকার: ব্যবসায়ী পণ্য

ব্যবসায়ী পণ্য বলতে বুঝায়: এমন যাবতীয় বস্তু যা দ্বারা মুনাফা অর্জন কিংবা ব্যবসার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে। যেমন, জমি, জীব-জন্তু, খাবার, পানীয় ও গাড়ী ইত্যাদি সব ধরনের সম্পদ।

সুতরাং বছরান্তে সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে তার চার দশমাংশ বা ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। চাই সেটার মূল্যমান ক্রয়মূল্যের সমপরিমান হোক, অথবা কম হোক অথবা বেশি হোক।

মুদি দোকানদার, মেশিনারি দোকানদার বা খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রেতা ও এ জাতীয় ব্যবসায়ীদের কর্তব্য হলো, ছোট বড় সকল অংশের মূল্য নির্ধারণ করে নেবে, যাতে কোনো কিছু বাদ না পড়ে। পরিমাণ নির্ণয়ে যদি জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে সতর্কতামূলক বেশি দাম ধরে যাকাত আদায় করবে, যাতে সে সম্পূর্ণভাবে দায়িত্বমুক্ত হতে পারে।

মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু যথা খাবার, পানীয়, বিছানা, আসবাবপত্র, থাকার ঘর, বাহন, গাড়ী, পোশাকের (ব্যবহার্য সোনা-রূপা ছাড়া) ওপর যাকাত নেই। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« لَيْسَ عَلَى الْمُسْلِمِ فِى عَبْدِهِ وَلاَ فَرَسِهِ صَدَقَةٌ ».

‘মুসলিমের দাস-দাসী, ঘোড়ার ওপর যাকাত নেই।’[10]

অনুরূপভাবে ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্য যেমন জমি-জমা, গাড়ী ইত্যাদির ওপর যাকাত আসবে না। তবে সেসব থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর বছর পূর্তির পর সেটা দ্বারা স্বয়ং নিসাব পূর্ণ হোক বা এ জাতীয় অন্য সম্পদের সাথে মিশে নিসাব পূর্ণ হোক তাতে যাকাত দেয়া ফরয হবে।


প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! তোমরা তোমাদের সম্পদের যাকাত যথাযথভাবে আদায় কর, আর এতে তোমাদের মন যেন খুশী থাকে। বস্তুত এটা লাভজনক, জরিমানামূলক নয়। মুনাফাস্বরূপ, ক্ষতিস্বরূপ নয়। তোমরা তোমাদের সকল যাকাতযোগ্য সম্পদ ভালোকরে হিসেব কর। আর আল্লাহর কাছে যা তোমরা ব্যয় কর তা কবুল করার জন্য এবং যা তোমাদের কাছে অবশিষ্ট রেখেছ তাতে বরকত দেওয়ার জন্য প্রার্থনা কর।

আর সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।আল্লাহ সালাত ও সালাম পেশ করুন আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তার পরিবার-পরিজন ও সকল সাহাবীর উপর।

[1] বুখারী: ১৪৮৩।

[2] মুসলিম: ৯৭৯।

[3] মুসলিম: ৯৮৭।

[4] আহমাদ ২/১৭৮; আবু দাউদ: ১৫৬৩; নাসাঈ ৫/৩৭; তিরমিযী: ৬৩৭। ইবনুল কাত্তান এটাকে সহীহ হাদীস বলেছেন। শাইখ উসাইমীন এর সনদকে ‘শক্তিশালী’ বলেছেন।

[5] আবু দাউদ: ১৫৬৫; বাইহাকী ৪/১৩৯; হাকেম ১/৩৮৯-৩৯০। হাকেম বলেছেন বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী, ইমাম যাহাবী তার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। শাইখ মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আল-আলবানী তার ইরওয়াউল গালীল গ্রন্থে (৩/২৯৭) বলেছেন, হাদিসটি তারা দু’জন যেমন বলেছেন তেমনই।

[6] আবু দাউদ: ১৫৭৩।

[7] এ দেশীয় মাপে ৭.৫ ভরি হয়। [অনুবাদক ও সম্পাদক]

[8] বুখারী: ১৪৫৯; মুসলিম: ৯৭৯।

[9] যা এ দেশীয় মাপে ৫২.৫ ভরি। [অনুবাদক ও সম্পাদক]

[10] বুখারী: ১৪৬৪; মুসলিম: ৯৮২।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে