৩১৯. ইলাহী তাকদীর বা স্বর্গীয় পূর্বনির্ধারিত বিধান (ও ৩২০. মৃত্যু)

সিরিয়া থেকে প্রকাশিত ‘আলকাসীম’ নামক পত্রিকায় এক যুবক সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। যুবকটি বিদেশ ভ্রমণের জন্য ফ্লাইটে একটি সিট বুকিং করেছিল। সে তার মাকে ফ্লাইটের সময়ের কথা জানিয়ে অনুরোধ করেছিল বিমান ছেড়ে যাওয়ার কিছু আগে তাকে জাগিয়ে দিতে। সে ঘুমিয়ে পড়ার পর তার মা রেডিওতে সংবাদ শুনল যে, আবহাওয়ার অবস্থা খুব খারাপ ও প্রচণ্ডভাবে ঝঞা বায়ু বইছে। তার একমাত্র সন্তানের জন্য তার মায়া হলো তাই সে তাকে জাগাল না এ আশায় যে, যাতে সে ফ্লাইট মিস করে (ফ্লাইট ধরতে না পারে)। যখন সে নিশ্চিত হলো যে বিমান ছেড়ে গেছে তখন সে তার ছেলেকে জাগাতে গেল। ছেলের ঘরে ঢুকে মা ছেলেকে বিছানায় মৃত শায়িত পেল। (ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!)

৩২০. মৃত্যু

শাইখ আলী আত-তানতাবী বর্ণনা করেছেন যে, এক লোক সিরিয়াতে ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন যাত্রীকে পার করে দেয়ার জন্য ট্রাকে তুলে নিলেন। যাত্রীটি পিছনে বসলেন যেখানে না ছিল কোন ছাদ আর না ছিল কোন ঢাকনা। সেখানে মৃতকে বহনের জন্য প্রস্তুতকৃত একটি খাটিয়া ছিল। তখন বৃষ্টি হতে শুরু করল আর লোকটি লক্ষ্য করে দেখল যে খাটিয়াটি বেশ বড়সর তাই সে এটার ভিতরে আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আরেকটি যাত্রীও ট্রাকের পিছনের খোলা যায়গায় উঠল। তখনও বৃষ্টি চলছিল। তাই সেও খাটিয়ার ভিতরে বসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল।

দ্বিতীয় যাত্রীটি ভেবেছিল সে ট্রাকে একাই (সুতরাং এ কাজ করতে কেউ তাকে দেখবে না)। কিন্তু, বৃষ্টি কমেছে কিনা তা যাচাই করার জন্য প্রথম ব্যক্তিটি কোন রূপ সর্তকসংকেত ছাড়াই (দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বিক্ষিত করে দিয়ে) খাটিয়া থেকে তার একটি হাত বের করল। এটা দেখে দ্বিতীয় যাত্রী একথা ভেবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেল যে, মৃত ব্যক্তিটি জীবিত হচ্ছে। মূহুর্তের মধ্যে চরম আতংকে লোকটি হোচট খেয়ে ট্রাক থেকে পিছন দিকে রাস্তায় পড়ে গেল। এবং তার মাথা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। সে সাথে সাথে মারা গেল। এ অপ্রত্যাশিত মৃত্যু সেভাবেই ঘটল যেভাবে আল্লাহ এ লোকটির জন্য লিখে রেখেছিলেন।

একজন কবি বলেন-

كل شيء بقضاء وقدر ٭ والمنايا عبر اي عبر

ভাবাৰ্থঃ “তাকদীরের ফয়সালা অনুসারেই সব কিছু ঘটে, আর অন্যদের মৃত্যুর মাঝে রয়েছে শিক্ষা।” (ইংরেজি পুস্তক অনুসারে অনুবাদ করা হলো।)

আমাদেরকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে, মৃত্যু আমাদের মাথার উপরে (চিলের মতো) ঘুরে বেড়াচ্ছে। দিনে-রাতে যে কোন সময় মৃত্যু আসতে পারে। আলী (রাঃ) অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় মৃত্যুর বাস্তবতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন-

ان الاٰخرة قد ارتحلت مقبلة وان الدنيا قد ارتحلت مدبرة

كونوا من أبناء الآخرة ولا تكونوا من أبناء الدنيا

فإن اليوم عمل ولاحساب وغدا حساب ولا عمل

ভাবাৰ্থঃ “আখেরাত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে আর দুনিয়া আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তাই আখেরাতমুখী হও এবং দুনিয়ামুখী হয়ে না। কেননা, দুনিয়া আমলের জায়গা, হিসাব বা বিচারের জায়গা নয়, আর আখেরাত হিসাব বা বিচারের জায়গা, আমলের জায়গা নয়।”

এ বাণী থেকে বুঝতে পারি যে, আমাদেরকে উন্নত করা, নতুনভাবে তওবা করা এবং পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে আমরা লেন-দেন করছি একথা বুঝা কতটা বাধ্যতামূলক। মৃত্যু আসার পূর্বে না কারো অনুমতি চায় আর এটা যে পথে আসে (অর্থাৎ আসছে) এ বিষয়ে কাউকে না কোন সতর্ক সংকেত দেয়।

وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ

“কেউ জানেনা যে, সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে আর কেউ জানেনা যে, সে কোন ভূমিতে মরবে।” (৩১-সূরা লোকমানঃ আয়াত-৩৪)

لَّكُم مِّيعَادُ يَوْمٍ لَّا تَسْتَأْخِرُونَ عَنْهُ سَاعَةً وَلَا تَسْتَقْدِمُونَ

“তোমাদের জন্য রয়েছে এক নির্ধারিত দিনের সাক্ষাৎকার- যেটাকে তোমরা না পারবে এক মুহুর্ত বিলম্বিত করতে আর না পারবে এক মুহুর্তে ত্বরান্বিত করতে।” (৩৪-সূরা আস সাবাঃ আয়াত-৩০)

আত্‌-তানতাবী আরো একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যা সমভাবেই মৃত্যুর অপ্রত্যাশিততাকে ব্যাখ্যা করে। একটি যাত্রীভরা বাস চলতে ছিল; এমন সময় ড্রাইভার হঠাৎ করে ব্রেক করল। কী সমস্যা হয়েছিল যাত্রীরা তাকে তা জিজ্ঞেস করল। সে উত্তর দিল, “এই যে বৃদ্ধ লোকটি বাসে উঠার জন্য হাত নাড়াচ্ছেন তার জন্য আমি বাস থামাচ্ছি। তারা সবাই বিম্মিত হয়ে বলল “আমরা তো কাউকে দেখছি না। সে বলল, ঐ যে ওখানে তার দিকে তাকান।” আবারও তারা বলেন যে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “এখন দেখুন, সে বাসে উঠার জন্য আসছে।” তখন তো অবস্থা বিস্ময়তাকেও ছাড়িয়ে গেছে, আর তারা বিস্ময়ে চিৎকার করে বলল, “আল্লাহর কসম, আমরা কাউকে দেখছি না।” তারপর, এক মুহুর্তের মধ্যেই, ড্রাইভার তার আসনে মারা গেল। এভাবে মৃত্যু তার নিকট সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত ও অপ্রত্যাশিত আকারে আসল।

“যখন তাদের শেষ মুহুর্ত ঘনিয়ে আসবে তখন তারা না পারবে এটাকে এক মূহুর্ত পিছাতে আর না পারবে এক মুহুর্ত আগাতে।” (৭-সূরা আ'রাফঃ আয়াত-৩৪)

বিপদের সম্মুখীন হলে মানুষ ভীরু হয়ে যায়; যখন মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন তার হার্টবিট বেড়ে যায় বা বুক ধড়ফড় করতে থাকে এবং তখন কোনরূপ পূর্ব-সতর্কসংকেত ছাড়াই এক নিরাপদ মুহুর্তে সে মারা যায়।

“তারাই ঘরে বসে ছিল, অথচ (পরে) তাদের মৃত ভাইদের সম্বন্ধে বলেছিল- “যদি তারা আমাদের কথা শুনতো তবে তারা মারা যেত না।”

(হে মুহাম্মদ!) আপনি বলুন, “যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকে তবে তোমরা তোমাদের নিজেদের থেকে মৃত্যুকে হাটিয়ে দাও।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৬৮)

অদ্ভুত বিষয় হলো এই যে, আমরা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের কথা ভাবি না বা এ জীবনের ক্ষনস্থায়ী প্রকৃতির কথা ভাবি না।