শরীয়তের দু’টি প্রধান ও প্রতিষ্ঠিত বৈশিষ্ট্য হলো শিথিলতা ও সরলতা। এ দুটি গুণ মুসলমানকে তার ইবাদতে এবং কাজ-কর্মে-আচার-আচরণে সাহায্য করে।

وَأَنَّهُ هُوَ أَضْحَكَ وَأَبْكَىٰ

“আর তিনিই (যাকে ইচ্ছা) হাসান আর (যাকে ইচ্ছা) কাদান।” (৫৩-সূরা আন নাজমঃ আয়াত-৪৩)

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসা ও কৌতুক করা এই উভয় কাজই করতেন। কিন্তু সত্য ছাড়া অন্য কিছু (তথা মিথ্যা) বলতেন না। তিনি আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন এবং তিনি স্পষ্ট ভাষায় কৃত্রিমতা ও কঠোরতা নিষেধ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, কেউ যখন ধর্ম খুব বেশি কঠিন করে ধর্ম তখন তাকে অসহায় করে ফেলবে।

অন্য একটি হাদীসে আমাদেরকে অবগত করা হয়েছে যে, ধর্ম দৃঢ়। অতএব ধীরে ধীরে আমাদেরকে গভীরে প্রবেশ করতে হবে। আমাদেরকে এ কথাও জানানো হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের জীবনী শক্তির একটি স্তর আছে এবং যে ব্যক্তি অতি কঠোর সে অবশ্যই ও অবশেষে ভেঙ্গে পড়বে। সে মটকে যাবে (মট করে ভেঙ্গে যাবে) এ কারণে যে, সে শুধুমাত্র বর্তমান অবস্থাটা দেখে এবং সেসব অবস্থা সে দেখে না, যে অবস্থাতে সে ভবিষ্যতে থাকতে পারে। সে তার মনোভাবের দীর্ঘকালীন প্রভাব ও অতিরিক্ত কঠোরতার ফলে সৃষ্ট বিরক্তির কথা ভুলে যায়। অধিকতর জ্ঞানী তিনিই, যিনি সর্বদা অল্প পরিমাণ কাজ করে যান, পরিবেশ পরিস্থিতি যাই হোক না কেন (তিনি কাজ বাদ দেন না)। হঠাৎ যদি তিনি কোন নির্দিষ্ট দিনে বেশি উৎসাহী হয়ে যান, তবে তিনি অতিরিক্ত কাজ করেন। কিন্তু যদি তিনি দুর্বল হয়ে যান তবে কমপক্ষে তিনি তার দৈনিক রুটিনের অংশ বিশেষ হলেও সম্পাদন করেন (তবুও একেবারে কাজ ছেড়ে দেন না)।

একজন সাহাবী (রাঃ)-এর নিম্নোক্ত কথার সম্ভবত এটাই অর্থ- “আত্মা এক সময়ে আগে বাড়ে, এক সময়ে পিছু হটে। যে সময় এটা আগে বাড়ে, তখন সুবিধা ভোগ কর আর যখন এটা পিছু হটে তখন এটাকে একা ছেড়ে দাও।”

আমি এমন অনেক লোক দেখেছি, যারা ভালো নিয়্যতে অত্যধিক পরিমাণে নফল সালাত পড়েছে এবং তাদের ধর্ম-কর্মে চরম বাড়াবাড়ি করেছে। কিন্তু যা হোক অবশেষে তারা তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বোধ করার পূর্বে যে (স্বাভাবিক) অবস্থায় ছিল তার চেয়েও অধিকতর দুর্বল অবস্থায় পৌছে গিয়েছিল। অনেকে যে বিষয়টি উপেক্ষা করে তা হলো ধর্ম মূলতঃ মানুষের নিকট সুখ-সমৃদ্ধি বয়ে আনার জন্যই এসেছে।

مَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْقُرْآنَ لِتَشْقَىٰ

“(হে মুহাম্মদ!) তোমার ওপর আমি কুরআন এজন্য নাযিল করিনি যাতে তুমি কষ্ট পাও।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-২)

যারা নিজেদের উপর সাধ্যাতিত বোঝা চাপায়, আল্লাহ তাদেরকে তিরস্কার করেন। নিজেদেরকে বাস্তব জগৎ থেকে সরিয়ে নেয়ার কারণে তারা তাদের পূর্বকৃত ওয়াদা থেকে ফিরে গিয়ে শেষ হয়ে যায়।

وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ فَمَا رَعَوْهَا حَقَّ رِعَايَتِهَا

“আর সন্ন্যাসবাদ বা বৈরাগ্যবাদ, তারা একে আবিষ্কার করেছিল, আমি তাদের ওপর এ বিধান দেইনি। তবে তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এটা পালন করত। কিন্তু এটাকেও তারা যথাযথভাবে পালন করেনি।” (৫৭-সূরা আল হাদীদঃ আয়াত-২৭)

ইসলাম দেহ-মনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার কারণে, ইহ-পরকালের পাথেয় যোগান দেয়ার কারণে এবং সকলের নিকট স্বাভাবিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত করার কারণে অন্যান্য ধর্ম থেকে ব্যতিক্রমধর্মী।

“সেটিই সঠিক ধর্ম।” (৯-সূরা তাওবাঃ আয়াত-৩৬)

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন “একজন মরুবাসী আরব এসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! কোন লোক সর্বাপেক্ষা উত্তম? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তর দিলেন-

مؤمن مجاهد بنفسه وماله في سبيل الله ثم رجل معتزل فى شعب من الشعاب يعبد ربه

যে মু’মিন নিজের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে সে-ই উত্তম। পরবর্তী স্তরের লোক হলো সে, যে তার প্রভুর ইবাদত করার জন্য কোন উপত্যকায় (বা গিরিপথে) থেকে একাকী বাস করে।

অন্য একটি বর্ণনায় আছে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন-

يَتَّقِي اللَّهَ وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ

“সে ব্যক্তি (উত্তম), যে নাকি আল্লাহকে ভয় করে এবং তার ক্ষতি থেকে নিরাপদ রাখার জন্য লোকদেরকে ছেড়ে চলে যায়।”

আবু সাঈদ (রাঃ) নিম্নোক্ত হাদীসটিও বর্ণনা করেছেন-

يُوشِكُ أَنْ يَكُونَ خَيْرَ مَالِ الْمُسْلِمِ غَنَمٌ يَتْبَعُ بِهَا شَعَفَ الْجِبَالِ وَمَوَاقِعَ الْقَطْرِ يَفِرُّ بِدِينِهِ مِنْ الْفِتَن

ভাবার্থঃ “অচিরেই মুসলমানের উত্তম সম্পদ হবে ভেড়া-ছাগল-বকরী। তা নিয়ে সে পাহাড়ের পাদদেশে চারণভূমিতে ও বৃষ্টিবহুল স্থানে ঘুরে বেড়াবে। সে ফেতনা-ফাসাদের ভয়ে তার ধর্ম (রক্ষার্থে তা) নিয়ে পালিয়ে বেড়াবে।”

উমর (রাঃ) বলেছেন- خذوا بحظكم من العزلة

ভাবার্থঃ “নিঃসঙ্গ জীবনের যে অংশ তোমার ভাগে আছে তা গ্রহণ কর।”

যুনাইদ (রহঃ) কত সুন্দরই বলেছেন-

مكابدة العزلة أيسر من مداراة الخلطة

ভাবার্থঃ “মানুষের তোষামোদের চেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন ভোগ করা সহজ।”

খাত্তাবী বলেছেন- “একাকী জীবন যাপনের অর্থ যদি গৌরব থেকে নিরাপদ থাকা হয় এবং সে সব মন্দ কাজ দূরে থাকা হয়, যার পরিবর্তন সাধন করা আপনার সাধ্যাতীত। তবে এটা খুব উপকারী কোন কিছু।”

হাকীম (রহঃ) তার ‘মুছতাদরাক’ কিতাবে আবু যর (রাঃ) থেকে এমন একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার সাথে শেষোক্ত খাত্তাবীর কথার অর্থের মিল আছে আর তাহলো—

الْوِحْدَةُ خَيْرٌ مِنْ جَلِيسِ السُّوءِ

ভাবাৰ্থঃ “মন্দ সাথীর চেয়ে একাকিত্ব ভালো।”

এ হাদীসের সনদ হাসান। খাত্তাবী (রহঃ) বুঝাতে চান যে, আমাদের ধর্মের তথা ইসলাম ধর্মে সন্ন্যাসবাদ ও সামাজিকতার বিধান নির্ভর করে পরিবেশ পরিস্থিতির উপর। ওহীর মাধ্যমে আমাদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে- বিশেষ উদ্দেশ্যে মানুষের সাথে মিলে থাকতে, জ্ঞানী লোকদের অনুসরণ করতে এবং ধর্মীয় ব্যাপারে সমাজের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে। যে ব্যক্তি নিজের ধর্ম রক্ষায় এবং সম্পদ অর্জনে নিজেই যথেষ্ট, তার জন্য একাকিতুই উত্তম। তবে প্রয়োজনের সময় ও ভালোকাজে অন্যদের সাথে মেশা দরকার। তা সত্ত্বেও তাকে জরুরি কাজগুলো অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে; যেমন- জামায়াতে সালাত আদায়, সালামের উত্তর প্রদান, রোগী দেখতে যাওয়া, জানাযার সালাতে হাজির হওয়া ইত্যাদি। যা দরকার তা হলো অতিমাত্রায় সামাজিক না হওয়া।

কেননা, এমন অতি মাত্রায় সামাজিক হওয়ার ফলে সময় নষ্ট হবে এবং অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অবহেলা করা হবে। দেহের জন্য পানাহারের প্রয়োজন যেমন, সমাজের অন্যদের সাথে মিলামিশা করা তেমন। উভয় ক্ষেত্রেই যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু গ্রহণ করা উচিত। এটাই দেহ-মনের জন্য পবিত্রতর আর আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন। কুশাইরী (রহঃ) একাকীত্ব বিষয়ে তার গবেষণামূলক প্রবন্ধে বলেছেন, যে নিঃসঙ্গতা অন্বেষণ করে তার একথা মনে (ধারণা) করা উচিত যে, সে এ কাজ করছে তার ক্ষতি থেকে জনগণকে বাঁচানোর জন্য এবং এর বিপরীতটা নয় (অর্থাৎ, জনগণের ক্ষতি থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়)। এর কারণ এই যে, প্রথমজন নিজের সম্বন্ধে বিনয়ী মনোভাব পোষন করে (জনগনকে নিজের চেয়ে ভাল মনে করছে)- যা ধর্ম (দ্বীন) চায়। দ্বিতীয়জন অন্যদের উপর নিজের বড়ত্ব আরোপ করেছে (জনগণকে নিজের চেয়ে খারাপ মনে করেছে)- যা মুমিনের চরিত্রে গ্রহণযোগ্য নয়।

এ বিষয়ে জনগণকে (মানুষকে) তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। দু’টি বিপরীত (পরস্পর বিপরীতধর্মী) আর তৃতীয়টি সে দুটির মাঝামাঝি অবস্থানে আছে। প্রথমে শ্রেণীর লোকেরা নিজেদেরকে লোকজন থেকে এতটাই আলাদা করে রাখে যে, তারা জুময়ার সালাতে হাজির হয় না। জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করে না এবং কল্যাণকর সমাবেশে যেমন ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেয় না। ঐ শ্রেণীর লোকেরা স্পষ্টভাবে ভ্রান্ত। দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা এতটাই সামাজিক যে, তারা মন্দ সমাবেশে অংশগ্রহণ করে- যেখানে নাকি মিথ্যা গুজব ও সময়ের অপচয়ই বেশি। এরাও ভ্রমে পতিত। মধ্যমপন্থী (তৃতীয় শ্রেণীর) লোকেরা যে সব ইবাদত অবশ্যই জামায়াতে আদায় করতে হয় সেসব ইবাদতের ব্যাপারে অন্যদের সাথে একত্রিত হয়। ধর্ম প্রচারে, পুরস্কার অর্জনে এবং আরো বেশি ব্যাপকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়- আল্লাহকে সন্তুষ্ট করতে তারা অন্যদের সাথে অংশগ্রহণ করে। যে সব সমাবেশে শয়তানী, মিথ্যা ও অপচয় বেশি তারা সে সব সমাবেশকে এড়িয়ে চলে।

“এরূপে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি।” (২-সূরা বাকারাঃ আয়াত-১৪৩)