হজ সফরে সহজ গাইড উমরাহ মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান ১ টি
মসজিদুল হারামে প্রবেশ ও কা‘বা তাওয়াফ
  • এবার তাওয়াফের জন্য প্রস্তুতি নিন। তাওয়াফের পূর্বে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া আবশ্যক। সকল প্রকার নাপাকী থেকে পবিত্র হতে হবে। মক্কার আসার পরে ও তাওয়াফের পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব। তবে শুধু ওযু করলেও চলবে। ওযু ছাড়া বা হায়েয নেফাস অবস্থায় তাওয়াফ করা জায়েয নয়। ইহরামের বিধি-নিষেধ স্মরণ রাখবেন এবং বেশি বেশি তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকবেন।
  • মসজিদুল হারামের যাওয়ার রাস্তায় কিছু স্থান চিহ্নিত করুন ও সেখানে যাওয়ার পথ চিনে রাখতে চেষ্টা করুন। এতে করে আপনি যদি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন অথবা হারিয়ে যান তাহলে সহজেই বাসা বা হোটেলে ফিরে আসতে পারবেন।
  • আপনি যে কোনো গেট দিয়েই প্রবেশ করতে পারেন। তবে তাওয়াফ শুরু করার জায়গায় সহজে পৌছানোর জন্য সাফা পাহাড়ের পাশের গেট দিয়ে প্রবেশ করলে সহজ হয়। মসজিদে প্রবেশের আগে সেন্ডেল খুলে শেলফে রাখুন অথবা সঙ্গে ছোট ব্যগে নিয়ে নিতে পারেন।

  • ডান পা দিয়ে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করুন এবং এ দো‘আ পাঠ করুন: بسم الله والصلاة والسلام على رسول الله اَللهم افْتَحْ لِيْ أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ

‘‘বিসমিল্লাহি ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাফ তাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা’’।

‘‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।

হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দিন’’।

  • উমরাহর নিয়তে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলে ‘তাহিয়াতুল মসজিদ’ সালাত আদায় করার প্রয়োজন নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারামে প্রবেশ করে সরাসরি তাওয়াফ করেছেন। কিন্তু অন্য কোনো সময়ে মসজিদে প্রবেশ করলে দু’রাকাত তাহিয়্যাতুল মসজিদ সালাত আদায় না করে মসজিদে যেন কেউ না বসেন; তবে কোনো সালাতের ইকামত হয়ে গেলে সেই সালাতে শামিল হয়ে যাবেন। এ নিয়ম সকল মসজিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।[1]
  • মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে কা‘বার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকুন। যখনই কা‘বা শরীফ চোখে পড়বে তখনই তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে তাওয়াফের প্রস্তুতি নিন ও তাওয়াফের নিয়ত করুন। কা‘বা শরীফ চোখে পড়া মাত্রই জোরে তাকবির দেওয়া বা দু হাত তুলে দো‘আ করা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তাওয়াফের শুরুতে মনে মনে নিয়ত করবেন। নিয়তের জন্য মুখে কিছু বলতে হয় না, কোনো কাজের জন্য দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করাই হচ্ছে নিয়ত। এ তাওয়াফ করা উমরাহর ফরয কাজ।
  • তাওয়াফ শুরুর স্থানে (হাজরে আসওয়াদ কর্নার) যাওয়ার আগে শুধু পুরুষরা তাদের ইহরামের কাপড়ের এক প্রান্ত ডান বগলের নিচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধের উপর দিবেন এবং ডান কাঁধ ও বাহু উন্মুক্ত করে দিবেন। একে বলা হয় ‘ইদতিবা‘’। সাত চক্বরেই এমনটি করা সুন্নাত। মেয়েদের কোনো ইদতিবা‘ নেই। এ ইদতিবা‘ শুধুমাত্র (তামাত্তু হাজীর) উমরাহর তাওয়াফ এবং (ক্বিরান ও মুফরিদ হাজীর) তাওয়াফে কুদুমের সময় করতে হয়। আর অন্য কোনো তাওয়াফের সময়ের জন্য ইদতিবা‘ করা প্রযোজ্য নয়।
  • এবার তাওয়াফ শুরুর স্থানে তাওয়াফকারীদের স্রোতে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করুন। স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। কারণ এতে বিপরীত দিক থেকে আসা লোকের স্রোতে আঘাত পেতে পারেন ও আপনি তাওয়াফকারীদের তাওয়াফে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারেন।
  • তাওয়াফকারীদের সাথে চলতে চলতে হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে লক্ষ্য করুন হাজরে আসওয়াদ এর কোণ/কর্নার বরাবর মাসজিদুল হারামের দেওয়ালে সবুজ রংয়ের আলোর বাতি দেওয়া আছে। এ সবুজ বাতি ও হাজরে আসওয়াদের কোণ বরাবর পৌছলে বা তার একটু আগেই সম্ভব হলে একটু থেমে বা চলতে চলতেই হাজরে আসওয়াদ এর দিকে মুখ করে ডান হাত উচু করে হাজরে আসওয়াদের দিকে সোজা ধরে বলুন: بِسْمِ اللهِ اَللهُ أَكْبَرُ ‘‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’’।
  • তাকবীর বলার পর আপনার ডান হাত নিচে নামিয়ে নিন ও রমল (দ্রুত পদক্ষেপে বীরত্ব প্রকাশ) করে চলতে শুরু করুন। হাতে কোনো চুমু খাবেন না। অনেককে লক্ষ্য করবেন এক/দুই হাত উচু করে তাকবীর বলছেন ও হাতে চুমু খাচ্ছেন, এমনটি করা সঠিক সুন্নাত নিয়ম নয়।[2]
  • হাজরে আসওয়াদ পাথর চুম্বন করে তাওয়াফ শুরু করা উত্তম ও এমনটি করা সুন্নাত। তবে যদি চুমু খেতে না পারেন তাহলে ডান হাত দিয়ে পাথরটি স্পর্শ করে আপনার হাতে চুমু দিয়ে তাওয়াফ শুরু করতে পারেন। কিন্তু হজ মৌসুমে অতিরিক্ত ভিড় ও ধাক্কাধাক্কির কারণে হাজরে আসওয়াদ এর ধারে কাছেই যাওয়া যায় না, তাই আপনাকে দূর থেকে ইশারা করেই তাওয়াফ শুরু করার পরামর্শ দিব। পরবর্তীতে আপনি যখন নফল তাওয়াফ করবেন তখন যতদূর সম্ভব ধাক্কাধাক্কি না করে ও কাউকে কষ্ট না দিয়ে হাজরে আসওয়াদ পাথর চুম্বন করার চেষ্টা করতে পারেন।
  • হাজরে আসওয়াদ পাথর স্পর্শের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, এ পাথর স্পর্শ করলে গুনাহসমূহ (সগীরা গুনাহ) সমূলে মুছে যায় ও এ পাথর হাশরের ময়দানে সাক্ষী দিবে যে ব্যক্তি তাকে স্পর্শ করেছে।[3]
  • এবার কা‘বাকে আপনার বাম দিকে রেখে আবর্তন/চক্কর দিতে শুরু করুন। হাজারে আসওয়াদ কর্নার এর সবুজ বাতি থেকে শুরু করে কা‘বা ঘরের ইরাকি কর্নার, হাতিম, সামি কর্নার, ইয়েমেনি কর্নার পার করে ফের হাজরে আসওয়াদ কর্নার এর সবুজ বাতি পর্যন্ত হাঁটা শেষ হলে এক চক্কর গণনা করা হয়। এভাবে আরও ছয় চক্কর দিতে হবে। এ সাত চক্কর সম্পন্ন হলে তাওয়াফ শেষ হয়ে যাবে।
  • শুধুমাত্র পুরুষেরা চক্করের শুরুতে দৃঢ়তার সাথে বীর বেশে কাঁধ হেলিয়ে প্রথম তিন চক্কর সম্পন্ন করবেন অর্থাৎ; একটু দ্রুত ও ক্ষুদ্র কদমে বুক টান করে জগিং করে/হেঁটে ‘রমল’ করে চক্কর সম্পন্ন করবেন, এমনটি করা সুন্নাত। তবে ভিড়ের কারণে রমল করা সম্ভব না হলে কোনো সমস্যা নেই, আপনি স্বাভাবিকভাবেই হাঁটবেন। এ রমল করা শুধুমাত্র (তামাত্তু হাজীর) উমরাহর তাওয়াফ ও (অন্যান্য হাজীর) তাওয়াফে কুদূমের জন্য প্রযোজ্য। আর অন্য কোনো তাওয়াফের সময় রমল করতে হয় না। চতুর্থ চক্কর থেকে আপনি আবার স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে শুরু করবেন এবং এ ধারা বজায় রাখবেন সপ্তম চক্কর পর্যন্ত। মহিলাদের কোনো রমল নেই।
  • তাওয়াফের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দো‘আ নেই। কিছু কিছু বইতে দেখবেন; প্রথম চক্রের দো‘আ, দ্বিতীয় চক্রের দো‘আ.. লেখা থাকে। কুরআন হাদীসে এধরনের চক্রভিত্তিক দো‘আর কোনো দলীল নেই। তাওয়াফরত অবস্থায় আপনি ইচ্ছে করলে কুরআন তিলাওয়াত, দো‘আ, যিকির, ইসতিগফার করতে পারেন আপনার নিজের ইচ্ছা মত। আল্লাহর প্রশংসা করুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরূদ পড়ুন। সব দো‘আ যে আরবীতে করতে হবে তার কোনো নিয়ম নেই, যে ভাষা আপনি ভালো বোঝেন ও আপনার মনের ভাব প্রকাশ পায় সে ভাষাতেই দো‘আ করুন। তবে মনে রাখবেন; আওয়াজ করে, জোরে শব্দ করে বা দলবদ্ধ হয়ে কোনো দো‘আ পাঠ করা সুন্নাত নিয়ম এর অন্তর্ভুক্ত নয়। এতে অন্যদের মনোযোগও নষ্ট হয়। দো‘আ করবেন আবেগ ও মিনতির সাথে মনে মনে। তাওয়াফের সময় তাওহীদকে জাগ্রত করুন। তাওয়াফের সময় এদিক ওদিক তাকাতাকি ও ঘুরাঘুরি না করে একাগ্রচিত্তে বিনয় এর সাথে তাওয়াফ করাই উত্তম। খুব বেশি প্রয়োজন ব্যাতিরেকে তাওয়াফের সময় কথা না বলাই শ্রেয়। এ বইয়ের শেষে কুরআন ও হাদীস থেকে বেশ কিছু দো‘আ সংযোজন করা হয়েছে যা তাওয়াফের সময় পড়তে পারেন।
  • তাওয়াফ করার সময় পুরুষ ও মহিলা একত্রিত হয়ে একই জায়গায় তাওয়াফ করতে হয়, তাই তাওয়াফ করার সময় বেগানা পুরুষ মহিলার গায়ের সাথে ধাক্কা লাগা বা স্পর্শ লাগতে পারে তাই আপনাকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে এবং এ বিষয়গুলো সর্বাত্নক এড়িয়ে চলতে হবে। অবস্থা বুঝে একটু ভিড় এড়িয়ে তাওয়াফ করা উত্তম। কিছু লোক বা দল তাওয়াফের সময় একে অন্যের হাত ধরে ব্যারিকেড/বৃত্ত বানিয়ে সেই বৃত্তের মাঝে মহিলাদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেন যাতে তারা হারিয়ে না যান। এমন করা ঠিক নয় কারণ এতে অন্যদের তাওয়াফ ব্যাহত হয়। দলনেতা একটি ছোট পতাকা বা ছাতা নিয়ে সামনে থাকতে পারেন এবং অন্যরা তাকে অনুসরণ করতে পারেন অথবা একে অন্যের হাত ধরে ছোট ছোট দল করে তাওয়াফ করতে পারেন।
  • তাওয়াফরত অবস্থায় প্রতি চক্করে ইয়েমেনী কর্নারে পৌঁছানোর পর আপনি ডান হাত অথবা দুই হাত দিয়ে কা‘বার ইয়েমেনী কর্নার শুধু স্পর্শ করবেন (এমনটি করা সুন্নাত), তবে ভিড়ের কারণে এটা করা সম্ভব না হলে কোনো সমস্যা নেই। আপনি চক্কর চালিয়ে যাবেন। দূর থেকে হাত উঠিয়ে ইশারা করবেন না বা চুম্বন করবেন না কিংবা আল্লাহু আকবারও বলবেন না।
  • প্রত্যেক চক্করে ইয়েমেনী কর্নার থেকে হাজারে আসওয়াদ কর্নার এর মাঝামাঝি স্থানে থাকাকালে এ দো‘আ পাঠ করা মুস্তাহাব ও সুন্নাত:

رَبَّنَا اٰتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَّفِي الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّقِنَا عَذَابَ النَّارِ

‘‘রাববানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাহ, ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাহ, ওয়াক্বিনা আযাবান নার’’।

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ

দান করুন এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন”।[4]

  • প্রথম এক চক্কর শেষ করে হাজরে আসওয়াদ কর্নার পৌঁছার পর আবার আগের মতো করে দূর থেকে ডান হাত উচু করে তাকবীর দিয়ে দ্বিতীয় চক্কর শুরু করবেন। এক্ষেত্রে শুধু মনে রাখবেন ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ না বলে শুধু বলবেন ‘আল্লাহু আকবার’। এমনটি পরবর্তী সকল চক্কর এর শুরুতে বলবেন।
  • উপরোক্ত নিয়মানুযায়ী সাত চক্কর শেষ করবেন। এভাবে আপনার তাওয়াফ সম্পন্ন করবেন। তাওয়াফ শেষে মাতাফ থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে কোনো ফাঁকা স্থানে অবস্থান গ্রহন করুন।

তাওয়াফ শেষ হওয়া মাত্রই পুরুষরা তাদের ডান কাঁধ ইহরামের কাপড় দিয়ে ঢেকে দেবেন। এবার আপনি ‘ইদতিবা‘’ থেকে মুক্ত হয়ে গেলেন।

[1] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬৫৫

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬০৭

[3] ইবন খুযাইমাহ, হাদীস নং ২৭২৯

[4] সূরা আল-বাকারা: ২:২০১