উপরের বক্তব্যে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) প্রথমে হেদায়াত ও গোমরাহি বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন:

‘‘আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে যাকে ইচ্ছা সুপথ প্রদর্শন করেন। আর তিনি ন্যায়পরায়ণতা পূর্বক যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন। বিভ্রান্ত করার অর্থ সাহায্য পরিত্যাগ করা। সাহায্য পরিত্যাগের ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ সে বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক প্রদান করেন না। বিষয়টি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। অনুরূপভাবে যে পাপীকে তিনি পাপ ও অবাধ্যতার কারণে পরিত্যাগ করেছেন তার পাপের কারণে শাস্তি প্রদানও তাঁর ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। আমাদের জন্য এ কথা বলা বৈধ নয় যে, শয়তান জবরদস্তি করে বা জোর করে মুমিন বান্দার ঈমান কেড়ে নেয়। বরং আমরা বলি: বান্দা তার ঈমান পরিত্যাগ করে, তখন শয়তান তা তার থেকে ছিনিয়ে নেয়।’’

মহান আল্লাহ কুরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন বা পথভ্রষ্ট করেন। এ বিষয়ক কয়েকটি আয়াত আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে তাকদীর প্রসঙ্গে দেখেছি। এ অর্থে আরো কয়েকটি আয়াত:


وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ فَيُضِلُّ اللَّهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ


‘‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়; অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’’[1]


فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإِسْلامِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ


‘‘আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান তার বক্ষকে সংকীর্ণ-সংকুচিত করে দেন; যেন সে আকাশে-ঊর্ধ্বে আরোহণ করছে। এভাবেই আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর যারা ঈমান আনে না।’’[2]

পাশাপাশি কুরআনে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঈমান আনয়ন বা সত্য গ্রহণ মানুষের নিজের ইচ্ছাধীন কর্ম। মহান আল্লাহ বলেন:


وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ شَاءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَاءَ فَلْيَكْفُرْ


‘‘আর বল, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্য; কাজেই যে ইচ্ছা করে সে ঈমান গ্রহণ করুক এবং যে ইচ্ছা করে সে কুফরী করুক।’’[3]

অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:


إِنَّ هَذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَنْ شَاءَ اتَّخَذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلا


‘‘নিশ্চয় এ এক উপদেশ; অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ গ্রহণ করুক।’’[4]

উপরের সকল আয়াতের সমন্বিত অর্থ ইমাম আবু হানীফা এখানে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কথার সারমর্ম হলো, মানুষকে আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছা ব্যবহার করে কি করবে তিনি তা জানেন। তিনি ইচ্ছা করলে তার ইচ্ছা ও কর্মে বাধা দিতে পারেন বা তার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি তাঁর কোনো বান্দার ইচ্ছা বা কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অতিরিক্ত তাওফীক কল্যাণের সহায়তা প্রদান করেন। আর এ অর্থেই তিনি বলেছেন: ‘‘যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তিনি হেদায়াত করেন।’’ তার হেদায়াত অর্থ তাঁর তাওফীক, যা তাঁর পক্ষ থেকে অতিরিক্ত করুণা। পক্ষান্তরে যার ইচ্ছা ও কর্মে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তাকে এরূপ তাওফীক বা মঙ্গলের সহায়তা প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন; বরং তাকে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন। তখন সে স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে বিপথগামী হয়। এ অর্থেই তিনি বলেছেন: ‘‘যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে পথভ্রষ্ট করেন।’’ কাউকে তার ইচ্ছা ও কর্মের কারণে অতিরিক্ত করুণা ও তাওফীক প্রদান থেকে বিরত থাকা ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়। এরূপ ব্যক্তির ইচ্ছা ও কর্মের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়াও ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়।

[1] সূরা (১৪) ইবরাহীম: ৪। সূরা (১৬) নাহল: ৯৩; সূরা (৩৫) ফাতির: ৮; সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ৩১।

[2] সূরা ৬ আনআম: ১২৫ আয়াত।

[3] সূরা (১৮) কাহাফ: ২৯ আয়াত।

[4] সূরা (৭২) মুযাম্মিল: ১৯ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৭৪) মুদ্দাস্সির: ৫৫-৫৬ আয়াত; সূরা (৭৬) দাহর (ইনসান): ২৯ আয়াত; সূরা (৭৮) নাবা: ৩৯ আয়াত; সূরা (৮০) আবাসা: ১১-১২ আয়াত।