আল-ফিকহুল আকবর আল-ফিকহুল আকবারের বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি

আরবী ভাষায় ‘ওসীলা’ শব্দের নৈকট্য। মহান আল্লাহ বলেন:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ


‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর ওসীলা (নৈকট্য) সন্ধান কর এবং তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’’[1]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু জারীর তাবারী (৩১০ হি) বলেন:


وابتغوا إليه الوسيلة يقول واطلبوا القربة إليه ومعناه بما يرضيه والوسيلة هي الفعلية من قول القائل توسلت إلى فلان بكذا بمعنى تقربت إليه


‘‘তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর। এর অর্থ: তাঁর দিকে নৈকট্য সন্ধান কর, অর্থাৎ যে কর্ম করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা কর। ওসীলা শব্দটি ‘তাওয়াস্সালতু’ কথা থেকে ‘ফায়ীলাহ’ ওযনে গৃহীত ইসম। বলা হয় ‘তাওয়াস্সালতু ইলা ফুলান বি-কাযা, অর্থাৎ আমি অমুক কাজ করে অমুকের নিকটবর্তী হয়েছি।’’[2]

কুরআন-হাদীস নির্দেশিত সকল নেক আমলই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের ওসীলা বা উপকরণ। নেককার মানুষের সাহচর্যে গমনও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের কর্ম। তবে ‘ওসীলা’ বলতে মধ্যস্থ মনে করা শিরকের রাজপথ। এ বিষয়ক শিরক সম্পর্কে ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’ গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।[3] এখানে দুআর মধ্যে কারো ওসীলা প্রদান প্রসঙ্গে ইমাম আবূ হানীফার মত আলোচনা করব।

মহান আল্লাহর পবিত্র নামের ওসীলা দিয়ে, নিজের নেক আমলের ওসীলা দিয়ে বা কোনো ব্যক্তির দুআর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করার নির্দেশনা হাদীস শরীফে বিদ্যমান। যেমন: হে আল্লাহ, আপনার রহমান-রহীম নামের ওসীলায় বা আমার দরুদ পাঠের ওসীলায় আপনি আমার দুআ কবুল করুন। হে আল্লাহ, অমুক ব্যক্তি আমার জন্য দুআ করেছেন, আপনি তার দুআর ওসীলায় আমার দুআ কবুল করুন।

তবে কোনো ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ চাওয়া, অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ, অমুক ওলী বা বুজুর্গ ব্যক্তির ওসীলায় আমার দুআ কবুল করুন’- এভাবে দুআ করা যাবে কিনা সে বিষয়ে আলিমগণ মতভেদ করেছেন। কারণ এরূপ দুআর নির্দেশনা কুরআন বা হাদীসে নেই। ইমাম আবূ হানীফা এরূপ ওসীলা প্রদান নিষেধ করেছেন। ইমাম আবূ ইউসূফ বলেন, আবূ হানীফা বলেছেন:


لا ينبغي لأحد أن يدعو الله إلا به والدعاء المأذون فيه المأمور به ما استفيد من قوله تعالى (ولله الأسماء الحسنى فادعوه بها) ... وكره قوله بحق رسلك وأنبيائك وأوليائك


‘‘আল্লাহকে তাঁর নিজের (ওসীলা) দ্বারা ছাড়া অন্য কারো (ওসীলা) দ্বারা ডাকা বা দুআ করা কারো জন্য বৈধ নয়। দুআর অনুমোদিত ও নির্দেশিত পদ্ধতি মহান আল্লাহর নিম্নের বাণী থেকে জানা যায়: ‘‘এবং আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ বিদ্যমান; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামের (ওসীলা) দ্বারা ডাক। ... আপনার রাসূলগণের, আপনার নবীগণের, আপনার ওলীগণের হক্কে (ওসীলায়) বলা তিনি মাকরূহ বলেছেন।’’[4]

আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবন মাহমূদ মাউসিলী হানাফী (৬৮৩ হি) বলেন:


قال: (ويكره أن يدعو الله إلا به) فلا يقول أسألك بفلان أو بملائكتك أو بأنبيائك ونحو ذلك لأنه لا حق للمخلوق على الخالق


‘‘তিনি বলেন: ‘মহান আল্লাহকে তাঁর নিজের (ওসীলা) দ্বারা ছাড়া অন্য কারো (ওসীলা) দ্বারা ডাকা বা দুআ করা মাকরূহ।’ কাজেই একথা বলা যাবে না যে, ‘অমুকের ওসীলা দিয়ে আপনার নিকট প্রার্থনা করছি’, অথবা ‘আপনার ফিরিশতাগণ ও নবীগণের ওসীলা দিয়ে আপনার নিকট প্রার্থনা করছি’। এ জাতীয় কোনো দুআ করবে না; কারণ স্রষ্টার উপর কোনো সৃষ্টির কোনো অধিকার বা দাবি নেই।’’[5]

বস্ত্তত তাওহীদের মর্যাদা সমুন্নত করতেই ইমাম আযম এ ধরনের ওসীলা প্রদান নিষেধ করেছেন। কারো স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা কবরের পাশে দুআ-ইবাদত করা এবং বরকতের জন্য কোনো গাছের নিকট দুআ করা, গাছে সুতা, কাপড় বা অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখার মতই এরূপ ওসীলা মনের অজান্তে মুমিনকে শিরকের পথে ধাবিত করে। কবর বা গাছের পাশে ইবাদত বা প্রার্থনাকারী মূলত মহান আল্লাহকেই ডাকছেন; কিন্তু উক্ত নবী বা ওলীর কবর বা স্মৃতির ওসীলায় বা বরকতময় গাছটির ওসীলায় আল্লাহর কবুলিয়াত আশা করছেন। দরগা বা গাছে সুতা, পোশাক বা অস্ত্র রাখার মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি মূলত মহান আল্লাহর নিকট থেকেই বরকত আশা করছেন। তিনি উক্ত গাছ বা দরগাকে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের মাধ্যম বা ওসীলা বলে গণ্য করছেন। অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে প্রার্থনাকারীও মূলত আল্লাহকেই ডাকছেন। তবে তিনি মনে করছেন যে, উক্ত ব্যক্তির নাম মহান আল্লাহর রহমত ও কবুলিয়াত পাওয়ার মাধ্যম বা উপকরণ। তার মনে ক্রমান্বয়ে ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে যে, এ সকল মাধ্যম, উপকরণ বা ওসীলা ছাড়া সরাসরি মহান আল্লাহর রহমত-বরকত লাভ অসম্ভব বা দুষ্কর। এভাবে বান্দার মন মহান আল্লাহর পরিবর্তে উক্ত ওসীলা বা মাধ্যমকে কেন্দ্র করে অধিক আবর্তিত হতে থাকে। কখনো তিনি তাদেরকে আল্লাহর ভান্ডারের মালিক, অংশীদার বা বণ্টনকারী মনে করেন। কখনো তাদের সন্তুষ্টি ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব নয় বলে মনে করেন। এভাবে মূলত তিনি জেনে বা মনের অজান্তে উক্ত ব্যক্তি বা বস্ত্তকে মহান আল্লাহর রহমত, বরকত ও কবুলিয়্যাতের অংশীদার বানিয়ে নেন।

দু ব্যক্তির কথা চিন্তা করুন! এক ব্যক্তি মনের গভীরতম আস্থায় বিশ্বাস করেন যে, মহান আল্লাহ বান্দার নিকটতম, তিনি তার সকল কথা জানছেন ও শুনছেন, তার ভালমন্দ তিনিই সবচেয়ে বেশি জানেন এবং তার রহমত, বরকত বা কবুলিয়্যাতের সিদ্ধান্ত তিনিই গ্রহণ করেন। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কেউ কোনো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারে না। শয়নে, জাগরণে, স্বপ্নে, বিচরণে আনন্দে ও বেদনায় সর্বদা একমাত্র মহান আল্লাহকেই স্মরণ করেন এবং তাঁরই সাথে কথা বলেন। আনন্দে তাঁরই প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর হৃদয় পূর্ণ হয় এবং তাঁকেই শুকরিয়া জানান। বেদনা ও কষ্টে তাঁকেই ডাকেন এবং তাঁরই কাছে মনের আবেগ-আহাজারি পেশ করেন। দীন, আমল ও ইলম শিখতে তিনি আলিম, পীর ও বুজুর্গদের কাছে যান। তবে প্রার্থনা, দুআ, চাওয়া-পাওয়া ও তাওয়াক্কুল নির্ভরতার জন্য তিনি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কথাই চিন্তা করেন না।

অন্য ব্যক্তিও বিশ্বাসে কর্মে উপরের মানুষটির কাছাকাছি। তবে তিনি কোনো ব্যক্তি বা বস্ত্তকে মহান আল্লাহর রহমত, বরকত বা কবুলিয়ত লাভের জন্য ওসীলা, মাধ্যম বা উপকরণ হিসেবে বিশ্বাস করেন। আনন্দে ও প্রাপ্তিতে তার হৃদয় মূলত উক্ত ‘মাধ্যম’-এর প্রতি কৃতজ্ঞতায় সিক্ত হয়- অমুকের ওসীলাতেই আমি এটা পেয়েছি। বিপদে-কষ্টে উক্ত ওসীলার প্রতিই তার হৃদয় ধাবিত হয়। তাকে খুশি করে আল্লাহর রহমত অর্জনের জন্য তিনি সচেষ্ট হন। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় ব্যক্তির তাওয়াক্কুল, নির্ভরতা, আশা, ভয় ইত্যাদি ইবাদত ক্রমান্বয়ে উক্ত ওসীলা বা মাধ্যমকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে থাকবে। আর শিরকের এ দরজা বন্ধ করতেই ইমাম আযম কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে বা ওসীলায় মহান আল্লাহর কাছে দুআ করতে নিষেধ করেছেন।

[1] সূরা (৫) মায়িদা: ৩৫ আয়াত।

[2] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ৬/২২৬।

[3] খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা, পৃ ৪৬৭-৪৮৪।

[4] হাসকাফী, আদ-দুর্রুল মুখতার (বৈরুত, দারুল ফিকর, ১৩৮৬ হি) ৬/৩৯৬-৩৯৮।

[5] আব্দুল্লাহ ইবন মাহমূদ মাউসিলী, আল-ইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার ৪/১৭৫।