আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ৫৬ টি
প্রতিশোধমূলক যুদ্ধের জন্যে কুরাইশদের প্রস্তুতি (اِسْتِعْدَادُ قُرَيْشٍ لِمَعْرِكَةٍ نَاقِمَةٍ):

বদরের যুদ্ধে মক্কাবাসীগণের পরাজয় ও অপমানের যে গ্লানি এবং তাদের সম্ভ্রান্ত ও নেতৃস্থানীয় লোকদের হত্যার যে দুঃখভার বহন করতে হয়েছিল তারই কারণে তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও প্রতিহিংসার অনলে দগ্ধীভূত হচ্ছিল। এমনকি তারা তাদের নিহতদের জন্যে শোক প্রকাশ করতেও নিষেধ করে দিয়েছিল এবং বন্দীদের মুক্তিপণ আদায়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতেও নিষেধ করেছিল, যাতে মুসলিমরা তাদের দুঃখ যাতনার কাঠিন্য সম্পর্কে ধারণা করতে না পারে। অধিকন্তু তারা বদর যুদ্ধের পর এ বিষয়ে সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিল যে, মুসলিমগণের সঙ্গে এক ভীষণ যুদ্ধ করে নিজেদের কলিজা ঠান্ডা করবে এবং নিজেদের ক্রোধ ও প্রতিহিংসার প্রক্ষোভ প্রশমিত করবে। এ প্রেক্ষিতে কালবিলম্ব না করে যুদ্ধের জন্য তারা সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণও শুরু করে দেয়। এ কাজে কুরাইশ নেতৃবর্গের মধ্যে ইকরামা ইবনু আবূ জাহল, সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া, আবূ সুফইয়ান ইবনু হারব এবং আব্দুল্লাহ ইবনু রাবীআহ খুব বেশী উদ্যোগী ও অগ্রগামী ছিল।

তারা এ ব্যাপারে প্রথম যে কাজটি করে তা হচ্ছে, আবূ সুফইয়ানের যে কাফেলা বদর যুদ্ধের কারণ হয়েছিল এবং যেটাকে আবূ সুফইয়ান বাঁচিয়ে বের করে নিয়ে যেতে সফলকাম হয়েছিল, তার সমস্ত ধনমাল সামরিক খাতে ব্যয় করার জন্যে আটক করে রাখা। ঐ মালের মালিকদের সম্বোধন করে তারা বলেছিল, ‘হে কুরাইশের লোকেরা, মুহাম্মাদ (ﷺ) তোমাদের ভীষণ ক্ষতি সাধন করেছে এবং তোমাদের বিশিষ্ট নেতাদের হত্যা করেছে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে যু্দ্ধ করার জন্যে এ মালের মাধ্যমে সাহায্য কর। সম্ভবত আমরা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারব।’ কুরাইশরা তাদের এ কথা সমর্থন করে। সুতরাং সমস্ত মাল, যার পরিমাণ ছিল এক হাজার উট এবং পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তা সবই বিক্রয় করে দেয়া হয়।

এ ব্যাপারেই আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেন:

‏(‏إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَن سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ‏)‏ ‏[‏الأنفال‏ :‏ 36‏]‏

‘যে সব লোক সত্যকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে তারা আল্লাহর পথ হতে (লোকেদেরকে) বাধা দেয়ার জন্য তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে থাকে, তারা তা ব্যয় করতেই থাকবে, অতঃপর এটাই তাদের দুঃখ ও অনুশোচনার কারণ হবে। পরে তারা পরাজিতও হবে।’ [আল-আনফাল (৮) : ৩৬]

অতঃপর তারা স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এ ঘোষণা দিল, ‘যে কোন সেনা ‘কিনানাহ’ এবং ‘তেহামাহ’র অধিবাসীদের মধ্য হতে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে চায় সে যেন কুরাইশদের পতাকা তুলে সমবেত হয়।’

এ ছাড়া আরবের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন বংশ ও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে প্রতিনিধি পাঠিয়ে তাদেরকে উত্তেজিত করে তুলতে লাগল। এ জন্য তারা মক্কায় দু’জন কবিকে বিশেষভাবে নিয়োজিত করল। তাদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিল আবূ আযযা। এ নরাধম বদরের যুদ্ধে মুসলিমগণের হাতে বন্দী হয়েছিল। অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দয়ায় বিনা মুক্তিপণে মুক্তি পেয়েছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল যে, আর কখনো মুসলিমগণের বিরুদ্ধাচরণ করবে না। কিন্তু মক্কায় পৌঁছামাত্র সে খুব জোরালো কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে কেমন ঠকিয়ে এসেছি।’ যা হোক, এ নরাধম কুরাইশের অন্যতম কবি মুসাফে’ ইবনু আবদে মানাফ জুমাহির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন গোত্রের আরবদের নিকট উপস্থিত হয়ে নিজেদের দুষ্ট প্রতিভা ও শয়তানী শক্তির প্রভাবে হিজাযের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রচারণার আগুন জ্বালিয়ে দিল। এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য সাফওয়ান ইবনু উমাইয়া আবূ আয্যাহকে প্রতিশ্রুতি দিল যে, সে যদি নিরাপদে যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয় তাহলে ধন সম্পদ দিয়ে তাকে ধনবান করে দেবে। অন্যথায় তার কন্যাদের লালন-পালনের জামিন হয়ে যাবে।

অধিকন্তু, ধর্মের অপমান, ধর্ম মন্দিরের অপমান, ঠাকুর-দেবতার অপমান ইত্যাদি বিষয়ে মুখরোচক ও অপ-প্রচারণা চালিয়ে সর্বত্র তারা এমনই উত্তেজনা সৃষ্টি করে দিল যে, অল্পকালের মধ্যেই নানা স্থান হতে বহু দুর্ধর্ষ আরব যোদ্ধা এসে মক্কায় সমবেত হল এবং দেখতে দেখতে প্রায় তিন সহস্র সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মদীনা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।

এদিকে আবূ সুফইয়ান ‘গাযওয়ায়ে সাভীক’ থেকে অকৃতকার্য হয়ে সমস্ত ধন সম্পদ ফেলে দিয়ে পলায়ন করে এসেছিল। সে সম্পর্কেও মুসলিমগণের বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করল।

এ ছাড়াও সারিয়্যায়ে যায়দ বিন হারিসার ঘটনাটি কুরাইশদের যে আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছিল এবং তাদের যে দুঃখ কষ্টের কারণ হয়েছিল- এ ঘটনাও যেন কাটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটার মতো হল এবং মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এক ফায়সালাকারী যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।

কুরাইশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম এবং কামান (قَوَامُ جَيْشِ قُرَيْشٍ وَقِيَادَتِهِ):

বছর পূর্ণ হতে না হতেই কুরাইশের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেল। তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনীর সঙ্গে ১৫ জন মহিলা গেল। কুরাইশ নেতৃবর্গের ধারণায় মেয়েদেরকে সঙ্গে রাখলে তাদের মান-সম্ভ্রম রক্ষাহেতু বেশী করে বীরত্ব প্রকাশ করার ও ‘আমরণ লড়ে যাওয়ার প্রেরণা লাভ করা যাবে।

সওয়ারীর জন্য তাদের সঙ্গে ছিল তিন হাজার উট এবং যুদ্ধের জন্য ছিল দু’শটি ঘোড়া।[1] ঘোড়াগুলোকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখার জন্য ওগুলোর পিঠে আরোহণ করা হয়নি। প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে সাত’শটি ছিল লৌহবর্ম। পুরো বাহিনীর জন্য আবূ সুফইয়ানকে সেনাপতি নির্বাচন করা হয় এবং খালিদ ইবনু ওয়ালীদকে ঘোড়সওয়ারী বাহিনীর সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়, আর ইকরামা ইবনু আবূ জাহলকে তার সহকারী বানানো হয়। প্রথা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পতাকা বনু আবিদ্দার গোত্রের হস্তে সমর্পণ করা হয়।

[1] যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৯২ পৃ: এটাই বিখ্যাত কথা । কিন্তু ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৪৬ পৃষ্ঠাতে ঘোড়ার সংখ্যা একশ‘ বলা হয়েছে।
মক্কা বাহিনীর যুদ্ধ যাত্রা (جَيْشُ مَكَّةَ يَتَحَرَّكُ):

এরূপ সম্পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের পর মক্কাবাহিনী এমন অবস্থায় মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করল যে, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে ক্রোধ, প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধ গ্রহণের উত্তেজনা তাদের অন্তরে অগ্নিশিখার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত ছিল, যা অচিরেই এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইঙ্গিত বহন করছিল।

আব্বাস (রাঃ) কুরাইশের এ উদ্যোগ আয়োজন ও যুদ্ধ প্রস্তুতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং এতে তিনি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছিলেন। সুতরাং তিনি এর বিস্তারিত সংবাদ সম্বলিত একখানা পত্রসহ জনৈক বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে মদীনায় প্রেরণ করেন। আব্বাস (রাঃ)-এর দূত অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মদীনার পথে এগিয়ে চললেন। মক্কা হতে মদীনা পর্যন্ত প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার পথ মাত্র তিন দিনে অতিক্রম করে তিনি ঐ পত্রখানা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাতে অর্পণ করেন। ঐ সময় তিনি মসজিদে কুবাতে অবস্থান করছিলেন।

উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) পত্রখানা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে পাঠ করে শুনালেন। তিনি এগুলোর গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন এবং খুব দ্রুত গতিতে মদীনায় আগমন করে আনসার ও মুহাজিরদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে সলা-পরমার্শ করেন।

আকস্মিক যুদ্ধাবস্থা মোকাবেলার প্রস্তুতি (اِسْتِعْدَادُ الْمُسْلِمِيْنَ لِلطَّوَارِئْ):

এরপর মদীনায় সাধারণ সামরিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে গেল। যে কোন আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে জনগণ সদাসর্বদা রণসাজে সজ্জিত হয়ে থাকতে লাগলেন। এমনকি সালাতের সময়েও তাঁরা অস্ত্র-শস্ত্র সরিয়ে রাখতেন না।

এদিকে আনসারদের এক ক্ষুদ্র বাহিনী, যাদের মধ্যে সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ), উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) এবং সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) ছিলেন, এরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত হয়ে যান।

তারা অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘরের দরজার উপর অবস্থান নিয়ে রাত্রি অতিবাহিত করতেন।

আরো কিছু সংখ্যক বাহিনী মদীনার বিভিন্ন প্রবেশ পথে নিয়োজিত হয়ে যান এ আশঙ্কায় যে, না জানি অসতর্ক অবস্থায় আকস্মিক কোন আক্রমণের শিকার হতে হয়।

অন্য কিছু সংখ্যক বাহিনী শত্রুদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্যে গোয়েন্দাগিরির কাজ শুরু করে দেন।

মদীনার প্রান্তদেশে মক্কা সেনা বাহিনী (الْجَيْشُ الْمَكِّيْ إَلٰى أَسْوَارِ الْمَدِيْنَةِ):

এদিকে মক্কা সেনাবাহিনী সুপ্রসিদ্ধ রাজপথ দিয়ে চলতে থাকে। যখন তারা আবওয়া নামক স্থানে পৌঁছে তখন আবূ সুফইয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতু ‘উতবাহ এ প্রস্তাব দেয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাতার সমাধি উৎপাটন করা হোক। কিন্তু এর দরজা খুলে দেয়ার কঠিন পরিণামের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনী তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখান করে।

এরপর এ সেনাবাহিনী তাদের সফর অব্যাহত রাখে এবং শেষ পর্যন্ত মদীনার নিকটবর্তী হয়ে প্রথমে ‘আকীক, নামক উপত্যকা অতিক্রম করে। তারপর কিছুটা ডান দিকে বাঁকিয়ে উহুদের নিকটবর্তী ‘আয়নাইন’ নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে, যা মদীনার উত্তরে ‘কানাত’ উপত্যকার ধারে অবস্থিত, এটা ছিল তৃতীয় হিজরীর ৬ই শাওয়াল, শুক্রবারের ঘটনা।

মদীনার প্রতিরক্ষা হেতু পরামর্শ সভার বৈঠক (الْمَجْلِسُ الْاِسْتِشَارِيْ لِأَخْذِ خُطَّةِ الدِّفَاعِ):

মদীনার গোয়েন্দা বাহিনী মক্কা সেনাবাহিনীর এক একটি করে খবর মদীনায় পৌঁছে দিচ্ছিল। এমনকি তাদের শিবির স্থাপন করার শেষ সংবাদটিও তাঁরা পৌঁছে দেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি পরামর্শ করার ইচ্ছা করেছিলেন। ঐ সভায় তিনি নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথাও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,

‏‏(‏إِنِّيْ قَدْ رَأَيْتُ وَاللهِ خَيْراً، رَأَيْتُ بَقَراً يُذْبَحُ، وَرَأَيْتُ فِيْ ذُبَابٍ سَيْفَيْ ثُلْماً، وَرَأَيْتُ أَنِّيْ أَدْخَلْتُ يَدِيْ فِيْ دِرْعٍ حَصِيْنَةٍ‏)

‘আল্লাহর শপথ! আমি একটি ভাল জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে, কতগুলো গাভী যবেহ করা হচ্ছে। আরো দেখি যে, আমার তরবারীর মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাতখানা একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে ঢুকিয়েছি।’ তারপর তিনি গাভীর এ তা’বীর ব্যাখ্যা করেন যে, কিছু সাহাবা (রাঃ) নিহত হবেন। আর তরবারীর ভঙ্গুরতার এ তা’বীর করেন যে, তার বাড়ির কোন লোক শহীদ হবেন এবং সুরক্ষিত বর্মের এ তা’বীর করেন যে, এর দ্বারা মদীনা শহরকে বুঝানো হয়েছে।

অতঃপর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ)-এর সামনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রতিরোধমূলক কর্মসূচী সম্পর্কে এ মত পেশ করেন যে, এবার নগরের বাইরে গমন করা কোন মতেই সঙ্গত হবে না, বরং নগরের অভ্যন্তরে থেকে যুদ্ধ করাই সঙ্গত হবে। কেননা, মদীনা একটি সুরক্ষিত শহর। সুতরাং শত্রু-সৈন্য নগরের নিকটবর্তী হলে মুসলিমরা সহজেই তাদের ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হবে। আর মহিলারা ছাদের উপর থেকে তাদেরকে ইট পাটকেল ছুঁড়বে। এটাই ছিল সঠিক মত। আর মুনাফিক্বদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইও এ মত সমর্থন করে। সে এ পরামর্শ সভায় খাযরাজ গোত্রের একজন প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল। সে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ মত সমর্থন করেনি, বরং যুদ্ধ থেকে দূরে থাকাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। কারণ এর ফলে সে যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতেও পারছে, আবার কেউ এর টেরও পাচ্ছে না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। তিনি চেয়েছিলেন যে, এ লোকটি তার সঙ্গীসাথীসহ সর্ব সম্মুখে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হোক এবং তার কপটতার উপর যে পর্দা পড়ে ছিল তা অপসৃত হয়ে যাক। আর মুসলিমরা তাদের চরম বিপদের সময় যেন এটা জানতে পারে যে, তাদের জামার আস্তিনের মধ্যে কত সাপ চলাফেরা করছে।

কিন্তু বিশিষ্ট সাহাবীগণের একটি দল এ প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করলেন। তারা সবিনয় নিবেদন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! আমরা এ প্রস্তাব সমর্থন করতে পারছি না। কারণ আমাদের মতে, এভাবে নগরে অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে শত্রুপক্ষের সাহস বেড়ে যাবে। তারা মনে করবে যে, আমরা তাদের বলবিক্রম দর্শনে ভীত হয়ে পড়েছি। আমরা শত্রুপক্ষকে দেখাতে চাই যে, আমরা দুর্বল নই কিংবা কাপুরুষও নই। আজ যদি আমরা অগ্রসর হয়ে আক্রমণ করতে পারি তবে ভবিষ্যতে মক্কাবাসীগণ আমাদেরকে আক্রমণ করতে এত সহজে সাহসী হতে পারবে না।’ এরই মধ্যে আবার কেউ কেউ তো বলে উঠলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (ﷺ)! আমরা তো এ দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমরা আল্লাহর কাছে এ মুহূর্তের জন্যই দু‘আ করেছিলাম তিনি তা গ্রহণ করেছেন। এটাই ময়দানে যাওয়ার উপযু্ক্ত সময়।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পিতৃতুল্য বীরকেশরী হামযাহ (রাঃ) এতক্ষণ চুপ করে এ সব আলোচনা শ্রবণ করে যাচ্ছিলেন। এতক্ষণে তিনি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘এটাই তো কথার মতো কথা। আমরা সত্যের সেবক মুসলিম। সত্যের সেবায় প্রাণ বিলিয়ে দেয়াই আমাদের পার্থিব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সফলতা। জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে এবং জীবন মরণ তাঁরই অধিকারে। এ ধরণের চিন্তা করার কোন দরকার আমাদের নেই। হে আল্লাহর সত্য নাবী (ﷺ), যিনি আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন তাঁর শপথ! মদীনার বাইরে গিয়ে তাদের সাথে যুদ্ধ না করে আমি খাবার স্পর্শ করব না।’[1]

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অধিকাংশের এ মতের সামনে নিজের মত পরিত্যাগ করলেন এবং মদীনার বাইরে গিয়েই শত্রু বাহিনীর সঙ্গে যু্দ্ধ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল।

[1] সীরাতে হালবিয়্যাহ ২য় খন্ড ১৪ পৃঃ।
ইসলামী সেনাবাহিনীর বিন্যাস এবং যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা (تَكْتِيْبُ الْجَيْشِ الْإِسِلاَمِيْ وَخُرُوْجِهِ إِلٰى سَاحَةِ الْقِتَالِ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুম’আর সালাতে ইমামত করেন। খুতবা দান কালে তিনি জনগণকে উপদেশ দেন, সংগ্রামের প্রতি উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে, ‘ধৈর্য্য ও স্থিরতার মাধ্যমেই বিজয় লাভ সম্ভব হতে পারে। এছাড়া তিনি তাদেরকে এ নির্দেশও দান করেন যে, তারা যেন মোকাবালার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়।’ তাঁর এ নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে জনগণের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।

অতঃপর আসরের সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যক্ষ করেন যে, লোকেরা জমায়েত হয়েছে এবং আওয়ালীর অধিবাসীগণও এসে পড়েছে। অতঃপর তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন, তাঁর সাথে আবূ বাকর (রাঃ) এবং উমারও (রাঃ) ছিলেন। তাঁরা তাঁর মাথায় পাগড়ী বেঁধে দিলেন ও দেহে পোষাক পরিয়ে দিলেন। তিনি উপরে ও নীচে দুটি লৌহ বর্ম পরিধান করলেন, তরবারী ধারণ করলেন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জনগণের সামনে আগমন করলেন।

জনগণ তাঁর আগমনের অপেক্ষায় তো ছিলেনই, কিন্তু তাঁর আগমনের পূর্বে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) এবং উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) জনগণকে বলেন, ‘আপনারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে জোর করে ময়দানে বের হতে উত্তেজিত করেছেন। সুতরাং এখন ব্যাপারটা তাঁর উপরই ন্যস্ত করুন।’ এ কথা শুনে জনগণ লজ্জিত হলেন এবং যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বের হয়ে আসলেন তখন তাঁরা তাঁর নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনার বিরোধিতা করা আমাদের মোটেই উচিত ছিল না। সুতরাং আপনি যা পছন্দ করেন তাই করুন। যদি মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করাই আপনি পছন্দ করেন তবে সেখানেই অবস্থান করুন, আমরা কোন আপত্তি করব না।’ তাঁদের এ কথার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘কোন নাবী যখন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যান তখন তাঁর জন্যে অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলা সমীচীন নয়, যে পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ও শত্রুদের মধ্যে ফায়সালা করে না দেন।’[1]

এরপর নাবী কারীম (ﷺ) সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন:

  1. মুহাজিরদের বাহিনী। এর পতাকা মুসআব ইবনু উমায়ের আবদারী (রাঃ)-কে প্রদান করেন।
  2. আউস (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা উসায়েদ ইবনু হুযাযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
  3. খাযরাজ (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা হাববাব ইবনু মুনযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।

মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার, যাদের মধ্যে একশ জন ছিলেন বর্ম পরিহিত এবং পঞ্চাশ জন ছিলেন ঘোড়সওয়ার।[2] আবার এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঘোড়সওয়ার একজনও ছিল না।

যারা মদীনাতেই রয়ে গেছে সেসব লোকদেরকে সালাত পড়ানোর কাজে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দেন এবং মুসলিম বাহিনী উত্তর মুখে চলতে শুরু করে। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) ও সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) বর্ম পরিহিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগে আগে চলছিলেন।

‘সানিয়্যাতুল বিদা’ হতে সম্মুখে অগ্রসর হলে তাঁরা এমন বাহিনী দেখতে পান, যারা অত্যন্ত উত্তম অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ছিল এবং পুরো সেনাবাহিনী হতে পৃথক ছিল। তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন যে, তারা খাযরাজের মিত্র ইহুদী[3] যারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা মুসলিম হয়েছে কি?’ জনগণ উত্তরে বলেন, ‘না’। তখন তিনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।

[1] মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী, হা’কিম ও ইবনু ইসহাক্ব।

[2] এ কথাটি ইবনু কাইয়্যেম যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার বলেন, এটা ভুল কথা। মুসা ইবনু উক্ববা জোর দিয়ে বলেন, উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের সাথে কোন ঘোড়াই ছিল না। ওয়াক্বিদী বলেন, শুধু দু’টি ঘোড়া ছিল। একটি ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এবং আরেকটি ছিল আবূ বুরদাহ (রাঃ)-এর নিকট। (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃ:)

[3] এ ঘটনাটি ইবনু সা‘দ বর্ণনা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, তারা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রের ইহুদী ছিল। (২য় খন্ড ৩৪ পৃঃ)। কিন্তু এটা সঠিক কথা নয়। কেননা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রকে বদর যুদ্ধের অল্প কিছু দিন পরেই নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।
সৈন্য পর্যবেক্ষণ (اِسْتِعْرَاضُ الْجَيْشِ):

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘শায়খান’ নামক স্থানে পৌঁছে সৈন্যবাহিনী পরিদর্শন করেন। যারা ছোট ও যুদ্ধের উপযুক্ত নয় বলে প্রতীয়মান হল তাদেরকে তিনি ফিরিয়ে দিলেন। তাদের নাম হচ্ছে, আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ), উসামাহ ইবনু যায়দ (রাঃ), উসাইদ ইবনু যুহাইর (রাঃ), যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ), যায়দ ইবনু আরক্বাম (রাঃ), আরাবাহ ইবনু আউস (রাঃ), ‘আমর ইবনু হাযম (রাঃ), আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ), যায়দ ইবনু হারিসাহ আনসারী (রাঃ) এবং সা‘আদ ইবনু হাব্বাহ (রাঃ)।

এ তালিকাতেই বারা ইবনু আযিব (রাঃ)-এর নামও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সহীহুল বুখারীতে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তা দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হয় যে, তিনি উহুদের যুদ্ধে শরীক ছিলেন। অবশ্যই অল্প বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) এবং সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রাঃ) যুদ্ধে অংশগ্রহণের অনুমতি লাভ করেন। এর কারণ ছিল, রাফি ইবনু খাদীজ (রাঃ) বড়ই সুদক্ষ তীরন্দাজ ছিলেন। যখন তাকে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি দেয়া হলো তখন সামুরাহ ইবনু জুনদুর (রাঃ) বললেন, ‘আমি রাফি (রাঃ) অপেক্ষা বেশী শক্তিশালী। আমি তাঁকে কুস্তিতে পরাস্ত করতে পারি।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে এ সংবাদ দেয়া হলে তিনি তাদের দুজনকে কুস্তি লাগিয়ে দেন এবং সত্যি সত্যিই সামুরাহ (রাঃ) রাফি (রাঃ)-কে পরাস্ত করে দেন। সুতরাং তিনিও যুদ্ধে অংশ গ্রহণের অনুমতি পেয়ে যান।

উহুদ ও মদীনার মধ্যস্থলে রাত্রি যাপন (الْمَبِيْتُ بَيْنَ أُحُدٍ وَالْمَدِيْنَةِ):

এ জায়গায় পৌঁছে সন্ধা হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ স্থানে মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করেন এবং এখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাহারার জন্যে পঞ্চাশ জন সাহাবী (রাঃ)-কে নির্বাচন করেন, যারা শিবিরের চার পাশে টহল দিতেন। তাদের পরিচালক ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা আনসারী (রাঃ)। এ ব্যক্তি হচ্ছেন সেই যিনি কা‘ব ইবনু আশরাফির হত্যাকারি দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাফওয়ান ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু ক্বায়স (রাঃ) নির্দিষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পাশে পাহারা দিচ্ছিলেন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 পরের পাতা »