আর-রাহীকুল মাখতূম হুনাইন যুদ্ধ (غَزْوَةُ حُنَيْنٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
জি‘রানা নামক স্থানে গণীমত বন্টন (قِسْمَةُ الْغَنَائِمِ بِالجِعْرَانَةِ):

ত্বায়িফ অবরোধ পর্ব সমাপনান্তে নাবী কারীম (ﷺ) ফিরে আসেন। গণীমত বন্টন ব্যতিরেকেই জি’রানা নামক স্থানে অবস্থান করতে থাকেন। এ বিলম্বের কারণ ছিল হাওয়াযিন গোত্রের প্রতিনিধিদল ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করবে এবং তাদের সম্পদাদি ফেরত নিয়ে যাবে। কিন্তু সদিচ্ছা প্রণোদিত বিলম্ব করা সত্ত্বেও তাদের পক্ষ থেকে কেউ যখন আগমন করল না রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন গণীমতের মাল বন্টন শুরু করে দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল গণীমতের ব্যাপারে বিভিন্ন গোত্রের নেতা এবং মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের যারা সন্দিগ্ধ চিত্ত ছিল এবং অনর্থক কথাবার্তা বলাবলি করে বেড়াত তাদের মুখ বন্ধ করা। মুওয়াল্লাফাতুল কলুবগণই[1] সর্বপ্রথম প্রাপ্ত হলো। তাঁদেরকে বড় বড় অংশ দেয়া হল।

আবূ সুফইয়ান বিন হারবকে চল্লিশ উকিয়া (ছয় কিলো হতে কিছু কম) রৌপ্য এবং একশ উট প্রদান করা হল। তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে ইয়াযীদ?’ নাবী কারীম (ﷺ) ইয়াযীদকেও অনুরূপ অংশ প্রদান করলেন। তিনি বললেন, ‘আমার ছেলে মু’আবিয়া?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকেও অনুরূপ অংশ প্রদান করলেন, (অর্থাৎ তাঁর ছেলেদের সহ শুধু আবূ সুফইয়ানকে আনুমানিক আঠার কিলো রৌপ্য) এবং তিনশ উট দেয়া হয়েছিল।

হাকীম বিন হিযামকে একশ উট দেয়া হয়েছিল। তিনি আরও একশ উটের জন্য আবেদন জানালে পুনরায় তাঁকে একশ উট দেয়া হয়েছিল। অনুরূপ ভাবে সাফওয়ান বিন উমাইয়াকে একশ উট, দ্বিতীয় দফায় আরও একশ উট এবং তৃতীয় দফায় আবারও একশ উট (মোট তিনশ উট) দেয়া হয়েছিল।[2]

হারিস বিন কুলাদাহকেও একশ উট দেয়া হয়েছিল। কিছু সংখ্যক অতিরিক্ত কুরাইশ এবং অন্যান্য নেতাগণকেও কয়েক শ’ উট দেয়া হয়েছিল। অধিকন্তু, অন্যান্য কিছু সংখ্যক নেতাকেও পঞ্চাশ এবং চল্লিশ চল্লিশ করে উট দেয়া হয়েছিল। এমনকি জনগণের মাঝে প্রচার হয়ে গেল যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) এমনভাবে দান খয়রাত করছেন যে, তাদের আর পরমুখাপেক্ষী হওয়ার কোন ভয় নেই। কাজেই, অর্থ সাহায্য গ্রহণের জন্য বেদুঈনদের দল নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট ভিড় জমাতে থাকল। অতিরিক্ত ভিড় এড়ানোর কারণে একটি বৃক্ষের দিকে সরে পড়তে তিনি বাধ্য হলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে তাঁর চাদর খানা বৃক্ষের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। তখন তিনি বললেন :

‏(‏أَيُّهَا النَّاسُ، رُدُّوْا عَلٰى رِدَائِيْ، فَوَ الَّذِيْ نَفْسِيْ بِيَدِهِ لَوْ كَانَ عِنْدِيْ عَدَدَ شَجَرٍ تِهَامَةٍ نَعَمًا لَقَسَّمْتُهُ عَلَيْكُمْ، ثُمَّ مَا أَلْفَيْتُمُوْنِيْ بَخِيْلاً وَلَا جُبَاناً وَلَا كَذَّابًا)‏‏

ওহে লোক সকল! আমার চাদর ফিরিয়ে দাও। সুতরাং সেই সত্ত্বার কসম যাঁর হাতে আমার প্রাণ, আমার নিকট যদি তুহামাহ বৃক্ষের সমপরিমাণ চতুষ্পদ জন্তু থাকে তবু তা তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দেব। তারপর তোমরা দেখবে যে, আমি কৃপণ নই, ভীতও নই আর মিথ্যাবাদীও নই।

তারপর তিনি তাঁর স্বীয় উটের নিকট গিয়ে দাঁড়ালেন এবং এবং খানিকটা লোম উপড়ে নিয়ে হাত উপরে তুলে বললেন,

‏(‏أَيُّهَا النَّاسُ، وَاللهِ مَالِىْ مِنْ فَيْئِكُمْ وَلَا هٰذِهِ الْوَبَرَةُ إِلَّا الْخُمُسَ، وَالْخُمُسُ مَرْدُوْدٌ عَلَيْكُمْ‏)

‘ওহে জনগণ! আল্লাহর কসম! তোমাদের ফাই সম্পদের মধ্যে আমার জন্য কিছুই নেই। এমনকি এ লোমগুলোর পরিমাণও নেই। শুধু এক পঞ্চমাংশ আছে এবং সেটুকুও তোমাদের হাতেই ফিরিয়ে দেয়া হবে।

মুওয়াল্লাফাতুল কুলবুকে দেয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ বিন সাবেতকে নির্দেশ প্রদান করলেন সৈন্যদের মধ্যে গণীমত বন্টনের জন্য হিসাব কিতাব তৈরি করতে। তিনি যে হিসাব তৈরি করলেন তাতে দেখা গেল যে, প্রত্যেক সাধারণ সৈনিকের অংশে এসেছে চারটি করে উট এবং চল্লিশটি করে বকরি। ঘোড়সওয়ারদের প্রত্যেকের অংশে এসেছে বারটি উট এবং একশ বিশটি বকরি।

এ বন্টনের ভিত্তি ছিল এক কৌশলময় রাজনীতি। কারণ, পৃথিবীতে এমন অনেক লোক আছে যাদের সত্যের পথে আনা হয় বিবেক বুদ্ধির পথ ধরে নয়, বরং পেটের পথ ধরে। অর্থাৎ তৃণভোজী পশুর সামনে এক গুচ্ছ সতেজ ঘাস ধরলে সে যেমন লাফ দিয়ে অগ্রসর হয়ে সেস্থানে পৌঁছে যায়, অনুরূপ ধারায় উল্লেখিত ধরণের লোকজনদের আকৃষ্ট করার প্রয়োজন রয়েছে। যাতে তারা ঈমানের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে তার জন্য আগ্রহী ও উদ্যমী হতে পারে।[3]

[1] যারা নতুন ভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল ইসলামের প্রতি তাদের মনে আরও অধিক পরিমাণে আকর্ষণ সৃষ্টি এবং ইসলামের উপর তারা যাতে শক্তভাবে বসে যায় তার জন্য সাহায্য করা হয়েছিল।

[2] কাযী আয়ায, আশ শিফা বেতা’রিফি হকুকিল মোস্তফা ১ম খন্ড ৮৬ পৃঃ।

[3] মুহাম্মাদ গাজ্জালী, ফিক্বহুস সীরাহ ২৯৮ ও ২৯৯ পৃঃ।