আর-রাহীকুল মাখতূম হুনাইন যুদ্ধ (غَزْوَةُ حُنَيْنٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি

প্রকৃতপক্ষে এ যুদ্ধ ছিল হুনাইন যুদ্ধেরই বিস্তরণ। যেহেতু হাওয়াযিন ও সাক্বীফ গোত্রের অধিক সংখ্যক পরাস্ত ফৌজ মুশরিক বাহিনীর কমান্ডার মালিক বিন আওফ নাসরীর সঙ্গে পলায়ন করে ত্বায়িফে গিয়েছিল এবং সেখানেই দূর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। সেহেতু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুনাইনের ব্যস্ততা থেকে অবকাশ লাভের পর ত্বায়িফের প্রতি মনোনিবেশ করলেন এবং এ ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাসেই ত্বায়িফের উদ্দেশ্যে এক বাহিনী প্রেরণের মনস্থ করলেন।

প্রথমে খালিদ বিন ওয়ালীদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্যর এক তেজস্বী বাহিনী প্রেরণ করলেন। অতঃপর নাবী (ﷺ) নিজেই ত্বায়িফ অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পথের মধ্যে নাখলা, ইয়ামানিয়া, কারনে মানাযিল, লিয়াহ প্রভৃতি স্থানের উপর দিয়ে গমন করেন। লিয়াহ নামক স্থানে মালিক বিন আওফের একটি দূর্গ ছিল। নাবী কারীম (ﷺ) দূর্গটি ভেঙ্গে ফেলেন। অতঃপর ভ্রমণ অব্যাহত রেখে ত্বায়িফে গিয়ে পৌঁছেন এবং ত্বায়িফের দূর্গের নিকটবর্তী স্থানে শিবির স্থাপন করে দূর্গ অবরোধ করে রাখলেন। অবরোধ ক্রমে ক্রমে দীর্ঘায়িত হতে থাকে। সহীহুল মুসলিমের হাদীসে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, এ অবরোধ চল্লিশ দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কোন কোন চরিতকার এ অবরোধের সময়সীমা বিশ দিন বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদের মধ্য থেকে কেউ কেউ দশ দিনের অধিক, কেউ কেউ আঠার দিন এবং কেউ কেউ পনের দিন বলে উল্লেখ করেছেন।[1]

অবরোধ চলাকালে উভয় পক্ষ হতে তীর নিক্ষেপ এবং প্রস্তরখন্ড নিক্ষেপের মতো ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটতে থাকে। প্রথমাবস্থায় মুসলিমগণ যখন অবরোধ শুরু করেন তখন দূর্গের মধ্য থেকে তাঁদের উপর এত অধিক সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করা হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল যেন টিড্ডী দল ছায়া করেছে। এতে কিছু সংখ্যক মুসলিম আহত হন এবং বার জন শহীদ হন। কবর উঠিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে বর্তমান ত্বায়িফের মসজিদের নিকট নিয়ে যেতে হয়।

এ পরিস্থিতি হতে নিস্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলে কারীম (ﷺ) ত্বায়িফবাসীদের উপর মিনজানিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে একাধিক গোলা নিক্ষেপ করেন। যার ফলে দূর্গের দেয়ালে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়ে যায় এবং মুসলিমগণের একটি দল দাবাবার মধ্যে প্রবেশ করে আগুন জ্বালানোর জন্য দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে যান। কিন্তু শত্রুগণ তাঁদের উপর লোহার উত্তপ্ত টুকরো নিক্ষেপ করতে থাকে, ফলে কিছু সংখ্যক মুসলিম শহীদ হয়ে যান।

শত্রুদের ঘায়েল করার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের ভিন্নতর কৌশল হিসেবে আঙ্গুর ফলের বৃক্ষ কর্তন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন, কিন্তু মুসলিমগণ অধিক সংখ্যক বৃক্ষ কর্তন করে ফেললে সাক্বীফ গোত্র আল্লাহ ও আত্মীয়তার বরাত দিয়ে বৃক্ষ কর্তন বন্ধ করার জন্য আবেদন জানালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তা মঞ্জুর করেন।

অবরোধ চলা কালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ঘোষক ঘোষণা দেন যে, যে গোলাম দূর্গ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিকট আত্ম সমর্পণ করবে সে মুক্ত বা স্বাধীন বলে বিবেচিত হবে। এ ঘোষণার প্রেক্ষিতে তেইশ ব্যক্তি দূর্গ থেকে বের হয়ে এসে মুসলিমগণের দলভুক্ত হয়।[2] এদের মধ্যেই ছিলেন আবূ বাকরাহ (রাঃ)। তিনি দূর্গ হতে দেয়ালের উপর উঠে চরকার সাহায্যে (যার মাধ্যমে কূয়া হতে পানি উত্তোলন করা হয়) ঝুলে পড়ে নীচে নামতে সক্ষম হন। যেহেতু ঘুর্ণিকে আরবী ভাষায় বাকরাহ বলা হয়, সেহেতু নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর নাম রেখেছিলেন আবূ বাকরাহ। এ সকল গোলামকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুক্ত করে দিয়ে এক একজনকে এক একজন মুসলমানের নিকট সমর্পণ করেন। এরূপ করার উদ্দেশ্য ছিল তারা তাদের প্রয়োজনের জিনিস পরস্পরকে পৌঁছে দেবে। এ ঘটনা ছিল দূর্গওয়ালাদের জন বড়ই দুর্বলতার পরিচায়ক।

অবরোধ দীর্ঘায়িত হতে থাকল এবং দূর্গ আয়ত্ত করার কোন সম্ভাবনা দৃষ্টিগোচর হল না, অথচ মুসলিমগণের উপর তীর এবং উত্তপ্ত লোহার আঘাত আসতে থাকল। উপরন্তু দূর্গাবাসীগণ পুরো এক বছরের জন্য পানীয় এবং খাদ্য সম্ভার মজুদ করে নিয়েছিল। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নওফাল বিন মু’আবিয়া দোয়েলীর পরামর্শ তলব করলেন। তিনি বললেন, ‘খেঁকশিয়াল নিজ গর্তে প্রবেশ করেছে। আপনি যদি এ অবস্থার উপর অটল থাকেন তাহলে তাদের ধরে ফেলতে পারবেন, আর যদি ছেড়ে চলে যান তাহলেও তারা আপনাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।’

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবরোধ শেষ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন এবং উমার বিন খাত্তাব (রাঃ)-এর মাধ্যমে ঘোষণা করে দিলেন যে, আগামী কাল মক্কা প্রত্যাবর্তন করতে হবে। কিন্তু এ ঘোষণায় সাহাবীগণ (রাঃ) সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তাঁরা বলতে লাগলেন, ‘ত্বায়িফ বিজয় না করেই আমরা প্রত্যাবর্তন করব?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‏ ‏(‏اُغْدُوْا عَلَى الْقِتَالِ‏)‏ ‘তাহলে আগামী কাল সকালে যুদ্ধ শুরু করতে হবে।’ কাজেই, দ্বিতীয় দিবস মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের জন্য গেলেন। কিন্তু আঘাত খাওয়া ছাড়া কোনই সুবিধা করা সম্ভব হল না। এ প্রেক্ষিতে নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, ‏(‏إِنَّا قَافِلُوْنَ غَداً إِنْ شَاءَ اللهُ‏)‏ ‘ইন-শা-আল্লাহ আমরা আগামী কাল প্রত্যাবর্তন করব।’

নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ প্রস্তাবে সকলেই আনন্দিত হলেন এবং কোন আলাপ আলোচনা ব্যতিরেকেই প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দিলেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃদু হাসতে থাকলেন। এরপর লোকজনেরা যখন তাঁবুর খুঁটি উঠিয়ে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন যে, তোমরা বলতে থাক, (‏آيِبُوْنَ تَائِبُوْنَ عَابِدُوْنَ، لِرَبِّنَا حَامِدُوْنَ‏) আমরা প্রত্যাবর্তনকারী, তাওবাকারী, উপাসনাকারী এবং স্বীয় প্রতিপালকের প্রশংসাকারী।

বলা হল যে, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সাকিফদের বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করুন। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,‏ (‏اللّٰهُمَّ اهْدِ ثَقِيْفًا، وَائْتِ بِهِمْ‏)‏ ‘হে আল্লাহ, সাকিফদের হিদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো।’

[1] ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৪৫ পৃঃ।

[2] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ২৬০ পৃঃ।