আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
যুদ্ধের কেন্দ্রস্থল এবং পতাকাবাহকদের প্রাণনাশ (ثُقْلُ الْمَعْرِكَةِ حَوْلَ اللِّوَاءِ وَإِبَادَةُ حَمْلَتِهِ):

এরপর চতর্দিক হতে যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে এবং সারাটা ময়দানে ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। মুশরিকদের পতাকা প্রতিষ্ঠিত ছিল যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রস্থলে। বনু আবদিদ্দার নিজেদের কমান্ডার ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহর হত্যার পর একের পর এক পতাকাধারণ করতে থাকে। কিন্তু তারা সবাই নিহত হয়। সর্বপ্রথম ত্বালহাহর ভাই উসমান ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উঠিয়ে নেন এবং নিম্নের ছন্দ পাঠ করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হয় :

إنَّ عَلٰى أهْل اللوَاء حقــاً ** أن تُخْضَبَ الصَّعْدَة أو تَنْدَقَّا

অর্থ : ‘পতাকাধারীদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে, তাদের পতাকা রক্তে রঞ্জিত হবে অথবা ছিঁড়ে যাবে।’

এ ব্যক্তিকে হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) আক্রমণ করেন এবং তাঁর কাঁধে এমন জোরে তরবারীর আঘাত করেন যে, ওটা তার হাতসহ কাঁধ কেটে দেয় এবং দেহ ভেদ করে নাভি পর্যন্ত পৌঁছে যায়, এমন কি ফুসফুসও দেখতে পাওয়া যায়।

এরপর আবূ সা‘দ ইবনু আবী ত্বালহাহ ঝান্ডা উঠিয়ে নেয়। তার উপর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) তীর চালিয়ে দেন এবং ওটা ঠিক তার গলায় লেগে যায়, ফলে তার জিহবা বেরিয়ে আসে এবং তৎক্ষণাৎ সে মৃত্যুবরণ করে।

কিন্তু কোন কোন জীবনী লেখকের উক্তি হল, আবূ সা‘দ বাইরে বেরিয়ে এসে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ডাক দেয় এবং আলী (রাঃ) অগ্রসর হয়ে তার মোকাবালা করেন। উভয়ে একে অপরের উপর তরবারীর আঘাত করে। কিন্তুু আলী (রাঃ)-এর তরবারীর আঘাতে আবূ সা‘দ নিহত হয়।

এরপর মুসাফে‘ ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উঠিয়ে ধরে। কিন্তু আ’সিম ইবনু সা’বিত ইবনু আবী আফলাহ (রাঃ) তাঁকে তীর মেরে হত্যা করেন। তারপর তার ভাই কিলাব ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ ঝান্ডা তুলে ধরে। কিন্তু যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ) তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং তার প্রাণ নাশ করেন। অতঃপর ঐ দুজনের ভাই জিলাস ইবনু ত্বালহাহ ইবনু আবী ত্বালহাহ পতাকা উত্তোলন করে। কিন্তু ত্বালহাহ ইবনু উবাইদুল্লাহ (রাঃ) তীর মেরে তার জীবন শেষ করে দেন। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, আ’সিম ইবনু সাবিত ইবনু আবী আফলাহ (রাঃ) তীর মেরে তাকে খতম করে দেন।

এরা একই পরিবারের ছয় ব্যক্তি ছিল। অর্থাৎ সবাই আবূ ত্বালহাহ আব্দুল্লাহ ইবনু উসমান ইবনু আবদিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র ছিল, যারা মুশরিকদের ঝান্ডার হিফাযত করতে গিয়ে মারা পড়ল। এরপর বনু আবদিদ্দার গোত্রের আরতাত ইবনু শুরাহবীল নামক আর একটি লোক পতাকা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু আলী ইবনু আবূ ত্বালিব (রাঃ) এবং মতান্তরে হামযাহ ইবনু আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর শুরাইহ ইবনু ক্বারিয পতাকা তুলে ধরে। কিন্তু কুযমান তাতে হত্যা করে। কুযমান মুনাফিক্ব ছিল এবং ইসলামের পরিবর্তে গোত্রীয় মর্যাদা রক্ষার উত্তেজনায় যুদ্ধ করতে এসেছিল।

শুরাইহর পর আবূ যায়দ ‘আমর ইবনু আবদি মানাফ আবদারী পতাকা সামলিয়ে নেয়। কিন্তু তাকেও কুযমান হত্যা করে ফেলে। তারপর শুরাহবীল ইবনু হাশিম আবদারীর এক পুত্র ঝান্ডা উঠিয়ে নেয়। কিন্তু কুযমানের হাতে সেও মারা পড়ে।

বনু আবদিদ্দার গোত্রের এ দশ ব্যক্তি, যারা মুশরিকদের পতাকা উঠিয়েছিল, সবাই মারা গেল। এরপর গোত্রের কোন লোকই জীবিত থাকল না যে পতাকা উঠাতে পারে। কিন্তু ঐ সময় ‘সওয়াব’ নামক তাদের এক হাবসী গোলাম লাফিয়ে গিয়ে পতাকা উঠিয়ে নেয় এবং তার পূর্ববর্তী পতাকাবাহী মনিবদের চেয়েও বেশী বল বিক্রমে যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত এক এক করে তার হাত দ’ুটি কর্তিত হয়। কিন্তু এর পরেও সে পতাকা পড়তে দেয় নি। বরং নিজের হাঁটুর ভরে বসে বক্ষ ও কাঁধের সাহায্য পতাকা খাড়া করে রাখে। অবশেষে সে কুযমানের হাতে নিহত হয়। ঐ সময়েও সে বলছিল, ‘হে আল্লাহ! এখন তো আমি কোন ওযর বাকী রাখি নি!’ ঐ গোলাম অর্থাৎ সওয়াব নিহত হওয়ার পর পতাকা ভূমির উপর পড়ে যায় এবং ওটা উঠাতে পারে এমন কেউই বেঁচে রইল না। এ কারণে ওটা পড়েই রইল।