আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি

এখানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেনাবাহিনীর শ্রেণী-বিন্যাস করেন এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে কয়েকটি সারিতে বিভক্ত করে নেন। সুনিপুণ তীরন্দাযদের একটি দলও নির্বাচন করা হয়। তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় পঞ্চাশ জন। আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের ইবনু নু’মান আনসারী দাওসী বাদরী (রাঃ) এ দলের অধিনায়ক পদে নিয়োজিত হন। তাঁর দলকে কানাত উপত্যকার দক্ষিণে ইসলামী সৈন্যদের শিবির থেকে পূর্ব-দক্ষিণে একশ পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে একটি ছোট পাহাড়ের ধারে অবস্থান গ্রহণের দির্দেশ দেয়া হয়। ঐ পাহাড়টি এখন ‘জবলে রুমাত’ নামে প্রসিদ্ধ। ঐ পর্বতমালার মধ্যে একটি গিরিপথ ছিল। শত্রু সৈন্যরা যাতে পশ্চাৎ দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে এ জন্য এ পঞ্চাশ জন তীরন্দাযকে ঐ গিরিপথ রক্ষা করার জন্য নিযুক্ত করা হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এদের অধিনায়ককে সম্বোধন করে বলেন,

‏‏(‏اِنْضَحِ الْخَيْلَ عَنَّا بِالنَّبْلِ، لَا يَأْتُوْنَا مِنْ خَلْفِنَا، إِنْ كَانَتْ لَنَا أَوْ عَلَيْنَا فَاثْبُتْ مَكَانَكَ، لَا نُؤْتِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ‏)

‘ঘোড়সওয়ারদেরকে তীর মেরে আমাদের নিকট থেকে দূরে রাখবে। তারা যেন পিছন থেকে কোন ক্রমেই আমাদেরকে আক্রমণ করতে না পারে। সাবধান, আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমাদের দিক থেকে যেন আক্রমণ না হয়।’’[1]

তারপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পুনরায় অধিনায়ককে সম্বোধন করে বললেন, ‘তোমরা আমাদের পিছন দিক রক্ষা করবে। যদি তোমরা দেখ যে, আমরা মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছি তবুও তোমরা আমাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসবে না। আর যদি দেখতে পাও যে, আমরা গণীমতের মাল একত্রিত করছি তবে তখনও তোমরা আমাদের সাথে শরীক হবে না।[2] আর সহীহুল বুখারীর শব্দ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছিলেন,

‏‏(‏إِنْ رَأَيْتُمُوْنَا تَخْطَفْنَا الطَّيْرُ فَلَا تَبْرَحُوْا مَكَانَكُمْ هٰذَا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ، وَإِنْ رَأَيْتُمُوْنَا هَزَمَنَا الْقَوْمَ وَوَطَأْنَاهُمْ فَلَا تَبْرَحُوْا حَتّٰى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ‏)

‘তোমরা যদি দেখ যে, পাখিগুলো আমাদেরকে ছোঁ মারছে, তবুও তোমরা নিজেদের জায়গা ছাড়বে না, যে পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ডেকে না পাঠাই।’

আর যদি তোমরা দেখতে পাও যে, আমরা শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেছি এবং তাদেরকে পদদলিত করেছি, তবুও তোমরা নিজেদের জায়গা হতে সরবে না, যে পর্যন্ত আমি তোমাদেরকে ডেকে না পাঠাই।[3]

এ কঠিনতম সামরিক নির্দেশাবলী ও হিদায়াতসহ এ বাহিনীকে তিনি ঐ পাহাড়ের গিরিপথে মোতায়েন করে দেন, যে পথ দিয়ে মুশরিকবাহিনী পিছন দিক থেকে মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার খুবই আশঙ্কা ছিল।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অবশিষ্ট সৈন্যের শ্রেণীবিন্যাস এভাবে করেন যে, দক্ষিণ বাহুর উপর মুনযির ইবনু ‘আমর (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন এবং বাম বাহুর উপর নিযুক্ত করেন, যুবাইর ইবনু ‘আউওয়াম (রাঃ)-কে আর মিক্বদাদ ইবনু আসওয়াদ (ﷺ)-কে তার সহকারীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। যুবাইর (রাঃ)-এর উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয় যে, তিনি খালিদ ইবনু ওয়ালিদের (যিনি তখনও মুসলিম হন নি) ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। এ শ্রেণীবিন্যাস ছাড়াও সারির সম্মুখভাগে এমন বাছাইকৃত মুসলিম বীর মুজাহিদদেরকে নিযুক্ত করা হয় যাদের বীরত্বের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যাদের প্রত্যেককে হাজারের সমান মনে করা হতো।

রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর এ শ্রেণীবিন্যাস ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও কৌশলপূর্ণ এবং এর দ্বারা তাঁর সামরিক দক্ষতা প্রমাণিত হয়। কোন কমান্ডার, সে যতই দক্ষ ও যোগ্য হোক না কেন, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) অপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ণ ও নিপুণ পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে না। কেননা, দেখা যায় যে, তিনি যদিও শত্রুবাহিনীর পরে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছেন, তথাপি তিনি স্বীয় সেনাবাহিনীর জন্যে এমন স্থান নির্বাচন করেছেন যা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের সবচেয়ে উত্তম স্থান ছিল। অর্থাৎ তিনি পাহাড়কে আড়াল করে নিয়ে পিছন ও দক্ষিণ বাহু রক্ষিত করে নেন এবং যে গিরি পথ দিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণের আশঙ্কা ছিল ওটা তিনি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। আর শিবির স্থাপনের জন্যে একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। কারণ, যদি আল্লাহ না করুন পরাজয় বরণ করতে হয় তবে যেন পলায়নের পরিবর্তে শিবিরের মধ্যেই আশ্রয় নিতে পারা যায়। যদি শত্রুরা শিবির দখল করার জন্যে এগিয়ে আসে তবে যেন তাদেরকে ভীষণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অপর পক্ষে তিনি শত্রুু বাহিনীকে তাদের শিবির স্থাপনের জন্যে এমন নীচু জায়গা গ্রহণ করতে বাধ্য করেন যে, তারা জয় লাভ করলেও যেন তেমন কোন সুবিধা লাভ করতে না পারে। আর যদি মুসলিমরা জয়যুক্ত হন তবে যেন তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের হাত থেকে তারা রক্ষা না পায়। এভাবে তিনি বাছাই করা বীর পুরুষদের একটি দল গঠন করে সামরিক সংখ্যার স্বল্পতা পুরণ করে দেন। এটাই ছিল নাবী কারীম (ﷺ)-এর সেনাবাহিনীর শ্রেণীবিন্যাস যা তৃতীয় হিজরীর শাওয়াল মাসের ৭ তারিখের শনিবার কার্যকর হয়েছিল।

[1] ইবনু হিশাম ২য় খন্ড ৬৫৩ ও ৬৬ পৃঃ।

[2] মুসনাদে আহমাদ, তাবারানী ও হা’কিম, ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত , ফাতহুল বারী ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃঃ।

[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড, কিতাবুল জিহাদ ৪২৬ পৃঃ।