আর-রাহীকুল মাখতূম উহুদ যুদ্ধ (غَزْوَةُ أُحُدٍ) আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহঃ) ১ টি
ইসলামী সেনাবাহিনীর বিন্যাস এবং যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা (تَكْتِيْبُ الْجَيْشِ الْإِسِلاَمِيْ وَخُرُوْجِهِ إِلٰى سَاحَةِ الْقِتَالِ):

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জুম’আর সালাতে ইমামত করেন। খুতবা দান কালে তিনি জনগণকে উপদেশ দেন, সংগ্রামের প্রতি উৎসাহিত করেন এবং বলেন যে, ‘ধৈর্য্য ও স্থিরতার মাধ্যমেই বিজয় লাভ সম্ভব হতে পারে। এছাড়া তিনি তাদেরকে এ নির্দেশও দান করেন যে, তারা যেন মোকাবালার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়।’ তাঁর এ নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে জনগণের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।

অতঃপর আসরের সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রত্যক্ষ করেন যে, লোকেরা জমায়েত হয়েছে এবং আওয়ালীর অধিবাসীগণও এসে পড়েছে। অতঃপর তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন, তাঁর সাথে আবূ বাকর (রাঃ) এবং উমারও (রাঃ) ছিলেন। তাঁরা তাঁর মাথায় পাগড়ী বেঁধে দিলেন ও দেহে পোষাক পরিয়ে দিলেন। তিনি উপরে ও নীচে দুটি লৌহ বর্ম পরিধান করলেন, তরবারী ধারণ করলেন এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জনগণের সামনে আগমন করলেন।

জনগণ তাঁর আগমনের অপেক্ষায় তো ছিলেনই, কিন্তু তাঁর আগমনের পূর্বে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) এবং উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ) জনগণকে বলেন, ‘আপনারা রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-কে জোর করে ময়দানে বের হতে উত্তেজিত করেছেন। সুতরাং এখন ব্যাপারটা তাঁর উপরই ন্যস্ত করুন।’ এ কথা শুনে জনগণ লজ্জিত হলেন এবং যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বের হয়ে আসলেন তখন তাঁরা তাঁর নিকট আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আপনার বিরোধিতা করা আমাদের মোটেই উচিত ছিল না। সুতরাং আপনি যা পছন্দ করেন তাই করুন। যদি মদীনার অভ্যন্তরে অবস্থান করাই আপনি পছন্দ করেন তবে সেখানেই অবস্থান করুন, আমরা কোন আপত্তি করব না।’ তাঁদের এ কথার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘কোন নাবী যখন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যান তখন তাঁর জন্যে অস্ত্রশস্ত্র খুলে ফেলা সমীচীন নয়, যে পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ও শত্রুদের মধ্যে ফায়সালা করে না দেন।’[1]

এরপর নাবী কারীম (ﷺ) সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করেন:

  1. মুহাজিরদের বাহিনী। এর পতাকা মুসআব ইবনু উমায়ের আবদারী (রাঃ)-কে প্রদান করেন।
  2. আউস (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা উসায়েদ ইবনু হুযাযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।
  3. খাযরাজ (আনসার) গোত্রের বাহিনী। এর পতাকা হাববাব ইবনু মুনযির (রাঃ)-কে প্রদান করা হয়।

মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার, যাদের মধ্যে একশ জন ছিলেন বর্ম পরিহিত এবং পঞ্চাশ জন ছিলেন ঘোড়সওয়ার।[2] আবার এ কথাও বলা হয়েছে যে, ঘোড়সওয়ার একজনও ছিল না।

যারা মদীনাতেই রয়ে গেছে সেসব লোকদেরকে সালাত পড়ানোর কাজে তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দেন এবং মুসলিম বাহিনী উত্তর মুখে চলতে শুরু করে। সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) ও সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ) বর্ম পরিহিত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগে আগে চলছিলেন।

‘সানিয়্যাতুল বিদা’ হতে সম্মুখে অগ্রসর হলে তাঁরা এমন বাহিনী দেখতে পান, যারা অত্যন্ত উত্তম অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ছিল এবং পুরো সেনাবাহিনী হতে পৃথক ছিল। তাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারেন যে, তারা খাযরাজের মিত্র ইহুদী[3] যারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘এরা মুসলিম হয়েছে কি?’ জনগণ উত্তরে বলেন, ‘না’। তখন তিনি মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।

[1] মুসনাদে আহমাদ, নাসায়ী, হা’কিম ও ইবনু ইসহাক্ব।

[2] এ কথাটি ইবনু কাইয়্যেম যাদুল মা‘আদ, ২য় খন্ডের ৯২ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। ইবনু হাজার বলেন, এটা ভুল কথা। মুসা ইবনু উক্ববা জোর দিয়ে বলেন, উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগণের সাথে কোন ঘোড়াই ছিল না। ওয়াক্বিদী বলেন, শুধু দু’টি ঘোড়া ছিল। একটি ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট এবং আরেকটি ছিল আবূ বুরদাহ (রাঃ)-এর নিকট। (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড ৩৫০ পৃ:)

[3] এ ঘটনাটি ইবনু সা‘দ বর্ণনা করেছেন, তাতে বলা হয়েছে যে, তারা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রের ইহুদী ছিল। (২য় খন্ড ৩৪ পৃঃ)। কিন্তু এটা সঠিক কথা নয়। কেননা বনু ক্বাইনুক্কা’ গোত্রকে বদর যুদ্ধের অল্প কিছু দিন পরেই নির্বাসন দেয়া হয়েছিল।