লেখক হাদিসের প্রকার উল্লেখ করার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেননি। মারফূ‘র পর দ্বিতীয় পর্যায়ে মাওকুফের আলোচনা করা যথাযথ ছিল, কারণ মাকতু‘র সম্পর্ক তাবে‘ঈর সাথে, মাওকুফের সম্পর্ক সাহাবির সাথে। তাই এ প্রকার পড়ার পূর্বে ১৫-নং পঙক্তি থেকে মাওকুফ পড়ে নেওয়া উত্তম।

‏‏مقْطوعُ‏‏ এর আভিধানিক অর্থ কর্তিত, বলা হয়, العضو المقطوع ‘কর্তিত বা বিচ্ছিন্ন অঙ্গ’। এ থেকে তাবে‘ঈদের কথা ও কর্মকে মাকতু‘ বলা হয়, কারণ তাদের বাণী ও কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিদের কথা ও কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন।

‘মাকতু’র পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রসঙ্গে লেখক বলেন: “তাবে‘ঈর সাথে সম্পৃক্ত কথা ও কর্মকে মাকতু‘ বলা হয়”। তাবে‘ঈর কথা ও কর্মে যদি মারফূ‘ বা মাওকুফের আলামত থাকে, তাহলে হুকমান মারফূ‘ বা মাওকুফ হবে, যেমন তাবে‘ঈ বললেন: من السنة كذا ‘এটা সুন্নত’। এ প্রসঙ্গে হুকমান মারফূ‘র অধীনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

লেখক রাহিমাহুল্লাহর নিকট তাবে‘ঈর সমর্থন মাকতু‘ কিনা স্পষ্ট নয়, প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত কারো সমর্থন বা নীরবতা দলিল নয়, বিশেষ করে তাবে‘ঈর সমর্থন বা নীরবতা, তাই সেগুলো মাকতু‘ নয়। উসুলে হাদিসের গ্রন্থসমূহে তাবে‘ঈর কথা বা কর্মকে মাকতু‘ বলা হয়, তবে বারদীজী, শাফে‘ঈ, তাবরানি, হুমাইদি ও দারাকুতনি প্রমুখ ইমামগণ মাকতু‘কে মুনকাতি‘ বলেছেন।

সাহাবির সাক্ষাত লাভকারী তাবে‘ঈ, যদিও তার সাহচর্য গ্রহণ না করেন। অধিকাংশ ইমাম এ মত গ্রহণ করেছেন। কারো নিকট তাবে‘ঈর জন্য সাহাবির সাক্ষাত ও সাহচর্য গ্রহণ করা জরুরি। সাহাবির সাক্ষাত লাভের সময় তাবে‘ঈর ঈমান শর্ত নয়, কাফের অবস্থায় সাহাবিকে দেখে ঈমান গ্রহণ করলে তাবে‘ঈ হবে। অনুরূপ তাবে‘ঈর জন্য সাহাবি থেকে শ্রবণ করা কিংবা তাকে দেখার সময় সাবালক হওয়া জরুরি নয়, সাক্ষাতের সময় তার মধ্যে ভালো-মন্দের জ্ঞান থাকা যথেষ্ট। শিশুর সাক্ষাত তাবে‘ঈ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, তবে সাহাবি হওয়ার জন্য যথেষ্ট, যদিও তাদের বর্ণনা মুরসাল।

মাকতু‘ ও মুনকাতি‘ এর মধ্যে পার্থক্য

১. তাবে‘ঈর কথা ও কর্মকে মাকতু‘ বলা হয়, আর সনদ থেকে একজন রাবি বা বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক রাবি বাদ পড়লে মুনকাতি‘ বলা হয়।

২. ‘মাকতু’র সম্পর্ক মতনের সাথে, ‘মুনকাতি‘’র সম্পর্ক সনদের সাথে। অতএব উভয় এক নয়।

৩. মুনকাতি‘ এর সম্পর্ক করা হয় রাসূলের সাথে, পক্ষান্তরে মাকতূ‘ এর সম্পর্ক করা হয় তাবে‘ঈ এর সাথে।

৪. সনদ তাবে‘ঈ পর্যন্ত মিলিত থাকলেও সেটি মাকতু‘, পক্ষান্তেরে মুনকাতে‘ অর্থই হচ্ছে সনদ কর্তিত বা মিলিত নয়।

জ্ঞাতব্য: মাকতু‘ মুত্তাসিল হলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিস মাকতু‘ মুত্তাসিল বলতে বারণ করেন। কারণ, মাকতু অর্থ কর্তিত আর মুত্তাসিল অর্থ মিলিত, এক হাদিসকে মাকতু‘ ও মুত্তাসিল বলা মানে দুই বিপরীত বস্তুকে এক জায়গায় জমা করা, যা ভাষাগত দিক থেকে শ্রুতিকটু ও বেমানান, তাই এ জাতীয় ব্যবহার পরিহার করা শ্রেয়, তবে নির্দিষ্টভাবে কারো সাথে সম্পৃক্ত করে বলা যায়, যেমন: "هذا متصل إلى سعيد بن المسيب" এ মাকতু‘ সায়িদ ইব্‌ন মুসাইয়্যেব পর্যন্ত মুত্তাসিল।

১- কখনো তাবে‘ঈর কথা বা কর্ম দ্বারা মারফূ‘ হাদিসের ইল্লত জানা যায়, যেমন কোনো হাদিস এক সনদে মারফূ‘ ও অপর সনদে মাকতু‘ বর্ণিত, তবে মারফূ‘ অপেক্ষা মাকতুর সনদ অধিক বিশুদ্ধ, তখন মাকতু‘র কারণে মারফূ‘ মু‘আল্‌ হবে।

২- তাবে‘ঈর বাণী কখনো হুকমান মারফূ‘ হয়, যেমন কোনো তাবে‘ঈ বলল: “এরূপ করা সুন্নত”; অথবা বললেন: “আমাদেরকে এরূপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে”, অথবা কোনো গায়েবি বিষয়ে সংবাদ দিলেন, যেখানে গবেষণার সুযোগ নেই। তাদের এ জাতীয় সংবাদ মারফূ‘ মুরসাল, যা ‘শাহিদ’ দ্বারা শক্তিশালী হয়ে মাকবুল পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়। কেউ তাবে‘ঈর এ জাতীয় সংবাদকে মাওকুফ বলেন; মাওকুফ কখনো দলিল হয়, সামনে তার বর্ণনা আসছে।

৩- সাহাবিদের ন্যায় তাবে‘ঈগণ আমাদের আদর্শ পুরুষ, আমরা তাদের অনুসরণ করে কুরআন ও সুন্নাহ বুঝি। অতএব কারো কথা ও ইজতিহাদ কোনো তাবে‘ঈর কথা ও ইজতিহাদের ন্যায় হলে ইজতিহাদ মজবুত হয় যে, অমুক তাবে‘ঈ তার মত বলেছেন। যার কথা ও ইজতিহাদ আদর্শ পুরুষদের কথা ও ইজতিহাদের মত নয়, আমরা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করব।

৪- তাবে‘ঈদের বাণী ও কর্ম সংরক্ষণ করার ফলে তাদের ইখতিলাফ তথা মতপার্থক্য ও ইত্তিফাক তথা মতৈক্য জানা যায়। আমরা তাদের ইত্তিফাক থেকে বের হব না, আর তাদের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে দলিল ও উসুলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধ অভিমত গ্রহণ করব। নতুন কোনো মত সৃষ্টি করব না এবং তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হব না।

৫- তাবে‘ঈদের ইখতিলাফ (মতপার্থক্য) থেকে মুজতাহিদ সঠিক মত গ্রহণ করতে সক্ষম হন। কোনো মুজতাহিদ কোনো তাবে‘ঈর মত গ্রহণ করে জমহুর বা একাধিক আলেমের বিপরীত অবস্থান নিলে তাকে কাফের, ফাসেক বা গোমরাহ বলা যাবে না, কারণ তার স্বপক্ষে তাবে‘ঈ রয়েছে এবং বিষয়টি ইজতিহাদ ও গবেষণাধর্মী। শায়খুল ইসলাম ইব্‌ন তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ্ এ জাতীয় অনেক ইখতিলাফ করেছেন।

৬- কখনো মাকতু দ্বারা মারফূ‘র অর্থ জানা যায়।

জ্ঞাতব্য: ইমাম যারকাশি রাহিমাহুল্লাহ্ মাকতু‘কে হাদিসের প্রকার বলার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন। তিনি বলেন: মাকতু‘কে হাদিস বলা ভুল, কারণ তাবে‘ঈর বাণী ও মাযহাব হাদিস নয়।

তার আপত্তির উত্তর: একটি হাদিস মারফূ‘ ও মাকতু উভয় সনদে বর্ণিত হলে শক্তিশালী সনদের ভিত্তিতে ফয়সালা করা হয়, যদি মাকতু‘কে হাদিসের প্রকার হিসেবে সংরক্ষণ করা না হয়, তাহলে এটা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত তাবে‘ঈর কতক বাণী মারফূ‘র হুকুম রাখে, এ হিসেবে মাকতু‘কে হাদিসের প্রকার গণ্য করা যথাযথ। এ বিষয়টি যারকাশি নিজেও স্বীকার করেছেন। তৃতীয়ত অনেক মুহাদ্দিস এ প্রকারকে হাদিস বলেছেন, তাই তাকে হাদিস গণ্য করা যথাযথ”।[1]

>
[1] আল-জাওয়াহির: (১৪৪)। তবে আমি মনে করি তাবে‘ঈদের সকল কথা ও কাজকে ঢালাওভাবে হাদীস নাম দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ, সকল তাবে‘ঈ সিকাহ ছিলেন না। তাবে‘ঈদের মধ্যে অনেক খারাপ আকীদাসম্পন্ন লোকও বিদ্যমান ছিল। সুতরাং ঢালাওভাবে সেগুলোকে হাদীস না বলে কোনো মারফু‘ কিংবা মাওকূফ হাদীসের সাথে যদি তাবে‘ঈদের কথা ও কাজ মিলে যায় সেটাকে উপরোক্ত মারফূ‘ বা মাওকূফ হাদীসের জন্য শাহেদ ও শক্তিবর্ধক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অথবা হাদীসটি কি মারফূ, নাকি মাওকূফ তা নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। সুতরাং ঢালাওভাবে সকল মাকতূ‘কে হাদীস বলার কোনো সুযোগ নেই। [সম্পাদক] 
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে