‘ইলমুর রিওয়াইয়াহ’: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ইলমুর রিওয়াইয়া’র সূচনা করেন। অতঃপর প্রয়োজনের তাগিদে ধীরে ধীরে তার পরিসর বর্ধিত হয়। এ ইলমের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«بَلِّغُوا عَنِّى وَلَوْ آيَة»

“একটি আয়াত হলেও আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দাও”।[1] অন্যত্র তিনি বলেন:

«لِيُبَلِّغْ الشَّاهِدُ مِنْكُمُ الْغَائِبَ»

“তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে পৌঁছে দেয়”।[2] অন্যত্র তিনি বলেন:

«تَسْمَعُونَ مِنِّى، وَيُسْمَعُ مِنْكُمْ، وَيُسْمَعُ مِمَّنْ يَسْمَعُ مِنْكُمْ»

“তোমরা আমার নিকট শ্রবণ কর, তোমাদের থেকে শ্রবণ করা হবে এবং যারা তোমাদের থেকে শ্রবণ করে তাদের থেকেও শ্রবণ করা হবে”।[3]

সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রকাশিত কথা, কর্ম, সমর্থন ও তার গুণগান হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত দ্বিতীয় স্তরের রাবি বা বর্ণনাকারীদের নিকট বর্ণনা করবে। অতঃপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও পরবর্তী স্তরের রাবিগণ তাদের পরবর্তী রাবিদের নিকট হ্রাস, বৃদ্ধি ও বিকৃতি ব্যতীত পূর্ববৎ বর্ণনা করবে। দীনকে চলমান ও অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এ ধারা অব্যাহত রাখা জরুরি, অন্যথায় দীন বিকৃত ও মৌলিকত্ব হারাতে বাধ্য। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বৃদ্ধি থেকে বারণ করেছেন, কখনো হ্রাস থেকে সতর্ক করেছেন, কখনো বিকৃতির উপর কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন, যেমন:

দীনে বৃদ্ধি করা নিষেধ:

দীনে যেন বৃদ্ধি না ঘটে, এ জন্য বক্তা ও শ্রোতা উভয়কে পৃথক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বক্তাকে সত্যের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও মিথ্যা থেকে বারণ করা হয়েছে, আর শ্রোতাকে বক্তার সংবাদ যাচাই পূর্বক গ্রহণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বক্তাকে উদ্দেশ্য করে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّداً فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ»

“যে আমার উপর মিথ্যা বলল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়”।[4] মিথ্যাবাদী বক্তার পরিণতি জাহান্নাম। এ কথা তিনি বারবার বলেছেন, প্রায় সত্তুরজন সাহাবি থেকে এ হাদিস বর্ণিত, জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবি যাদের মধ্যে অন্যতম। তাই এ হাদিসকে আহলে ইলম মুতাওয়াতির বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ ٦﴾ [الحجرات: ٦]

“হে ইমানদারগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও”।[5] এ আয়াতে আল্লাহ শ্রোতাদের সতর্ক করেছেন, যেন তারা বক্তাদের কথা যাচাই ব্যতীত গ্রহণ না করে।

সাহাবিগণ মিথ্যা বলতেন না, তখন আরবের কাফেরদের মধ্যেও মিথ্যা বলার প্রবণতা ছিল না, মিথ্যাকে তারা ঘৃণা করত। জনৈক কাফের সম্পর্কে আছে, সে তার মরুভূমির তৃষ্ণার্ত বোবা উটের সাথেও মিথ্যা বলেনি, সে মিথ্যা না-বলার কারণ সম্পর্কে বলেছিল:

أُرِيدُ أُمَنِّيكِ الشَّرَابَ لِتَهْدَئِي وَلَكِنَّ عَارَ الْكَاذِبِينَ يَحُولُ

‘আমার ইচ্ছা হয় তোমাকে পানীয় বস্তুর আশা দেই, যেন তুমি শান্ত হও, কিন্তু মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অপবাদ প্রতিবন্ধক হয়েছে’। মরুভূমিতে একটি উটকে পানি পান করানোর মিথ্যা আশ্বাস দিতে বিব্রত বোধ করেছেন জনৈক মুশরিক! আবু সুফিয়ানের ঘটনা তো প্রসিদ্ধ। বাদশাহ হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ সম্পর্কে আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করার প্রাক্কালে তার সাথীদের বলে দেন: “আমি তাকে মুহাম্মদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছি, সে যদি আমাকে মিথ্যা বলে তোমরা তাকে মিথ্যা বলবে”। আবু সুফিয়ান বলেন: ‘আল্লাহর শপথ, আমার উপর মিথ্যার অপবাদ আরোপ করা হবে এ লজ্জা যদি না হত, তাহলে অবশ্যই আমি তার সম্পর্কে মিথ্যা বলতাম’।[6] সে সময় আবু সুফিয়ান নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিপক্ষ ছিল, সে জানত মিথ্যা বললেও তার সাথীরা হিরাক্লিয়াসের সামনে তাকে মিথ্যারোপ করবে না, কারণ তারা সবাই কাফের, তবুও আবু সুফিয়ান অপবাদের ভয়ে মিথ্যা বলেনি।

>
[1] বুখারি: (৬/৪৯৬), হাদিস নং: (৩৪৬১), হাদিসটি আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আমর ইব্‌ন আস রা. থেকে বর্ণিত।

[2] বুখারি: (১/১৯৯), হাদিস নং: (১০৫), হাদিসটি আবু বাকরাহ নুফাই ইব্‌ন হারেস রা. থেকে বর্ণিত।

[3] আবু দাউদ: (৩/৩২১), হাদিস নং: (৩৬৫৯), ইব্‌ন আব্বাস রা. থেকে সহি সনদে বর্ণিত।

[4] বুখারি: ((৩/১৬০), হাদিস নং: (১২৯১), হাদিস নং: (১১০), মুসলিম: (১/১০), এ হাদিস বুখারি ও মুসলিম একাধিক সাহাবি থেকে একাধিক স্থানে বর্ণনা করেছেন, যেমন মুগিরাহ ইব্‌ন শু‘বাহ, আবু হুরায়রাহ, আলি ইব্‌ন আবি তালিব, জুবায়ের ইব্‌নুল ‘আউআম, আনাস ইব্‌ন মালেক, সালামাহ ইব্‌ন আকওয়া‘ প্রমুখ সাহাবিগণ।

[5] সূরা হুজুরাত: (৪৯/৬)

[6] বুখারি: (১/৩১), হাদিস নং: (৬)