কিতাবুত তাওহীদ ১ হতে ৬৭ তম অধ্যায় মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহহাব ৬৭ টি

১। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

‘‘আমি জিন এবং মানব জাতিকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’’ (যারিয়াত . ৫৬)।

২। আল্লাহ তা‘আলা আরো এরশাদ করেছেন,

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ (النحل: 36)

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। [তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি] তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো।’’ (নাহল: ৩৬)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র এরশাদ করেছেন,

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا (الإسراء: 23)

৩। ‘‘তোমার রব এ নির্দেশ দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো ইবাদত করো না। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (ইসরা: ২৩)

৪। সূরা নিসাতে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا (النساء: 36)

‘‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। আর তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না।’’ (নিসা: ৩৬)

৫। সূরা আনআমে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন,

قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا (الأنعام: 151)

‘‘হে মুহাম্মদ বলো, [হে আহলে কিতাব] তোমরা এসো তোমাদের রব তোমাদের জন্য যা হারাম করে দিয়েছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হচ্ছে এই, ‘‘তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না।’’ (আনআম: ‘১৫১)

৬। ইবনে মাসউদ (রা:) বলেছেন,

من أراد ان ينظر إلى وصية محمد صلى الله عليه وسلم التى عليها خاتمه فليقرأ قوله تعالى قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا..... وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا﴿153﴾

‘‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোহরাঙ্কিত অসিয়ত দেখতে চায়, সে যেন আল্লাহ তাআলার এ বাণী পড়ে নেয়, ‘‘হে মুহাম্মদ বলো, তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হলো, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না . . . . আর এটাই হচ্ছে আমার সরল, সোজা পথ’’।

৭। সাহাবী মুআয বিন জাবাল (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে একটি গাধার পিঠে বসে ছিলাম। তিনি আমাকে ডাক দিয়ে বললেন,’’

يا معاذ أتدري ما حق الله على العباد، وما حق العباد على الله؟ قلت الله ورسوله أعلم، قال: حق الله على العباد أن يعبدوه ولا يشركوا به شيئا وحق العباد على الله أن لا يعذب من لا يشرك به شيئا، قلت يا رسول الله أفلا أبشر الناس؟ قال: لا تبشرهم فيتكلوا (أخرجاه في الصحيحين)

‘‘হে মুআয, তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে? আর আল্লাহর উপর বান্দার কি হক আছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে ‘‘যারা তার সাথে

কাউকে শরিক করবে না, তাহলে তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না।’’ আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি কি এ সুসংবাদ লোকদেরকে জানিয়ে দেব না? তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এ সুসংবাদ দিওনা, তাহলে তারা ইবাদত ছেড়ে দিয়ে [আল্লাহর উপর ভরসা করে] হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। (বুখারি ও মুসলিম)

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়:

১। জ্বিন ও মানব জাতি সৃষ্টির রহস্য।

২। ইবাদতই হচ্ছে তাওহীদ। কারণ এটা নিয়েই বিবাদ।

৩। যার তাওহীদ ঠিক নেই, তার ইবাদতও ঠিক নেই। এ কথার মধ্যে

ولا أنتم عابدون ما أعبد এর অর্থ নিহিত আছে।

৪। রাসূল পাঠানোর অন্তর্নিহিত হিকমত বা রহস্য।

৫। সকল উম্মতই রিসালতের আওতাধীন ছিল।

৬। আম্বিয়ায়ে কেরামের দীন এক ও অভিন্ন।

৭। মূল কথা হচ্ছে, তাগুতকে অস্বীকার করা ব্যতীত ইবাদতের মর্যাদা অর্জন করা যায় না।

৮। আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত আর যারই ইবাদত করা হয়, সেই তাগুত হিসেবে গণ্য।

৯। সালাফে-সালেহীনের কাছে সূরা আনআমের উল্লেখিত তিনটি মুহকাম আয়াতের বিরাট মর্যাদার কথা জানা যায়। এতে দশটি বিষয়ের কথা রয়েছে। এর প্রথমটিই হচ্ছে; শিরক নিষিদ্ধ করণ।

১০। সূরা ইস্রায় কতগুলো মুহকাম আয়াত রয়েছে। এবং তাতে আঠারোটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বিষয়গুলোর সূচনা করেছেন তাঁর বাণী- لا تجعل مع الله إلها آخر فتقعد مذموما مخذولا এর মাধ্যমে, আর সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন তাঁর বাণী-

ولا تجعل مع الله إلها آخر فتلقى في جهنم ملوما مدحوراً

এর মাধ্যমে। সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়টির সুমহান মর্যাদাকে উপলব্ধি করার জন্য তাঁর বাণী,

ذلك مما أوحى إليك ربك من الحكمة এর মাধ্যমে আমাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন।

১১। সূরা নিসার ‘আল- হুকুকুল আশারা’ [বা দশটি হক] নামক আয়াতের কথা জানা গেলো। যার সূচনা হয়েছে আল্লাহ তাআলার বাণী,

واعبدوا الله ولا تشركوا به شيئا

এর মাধ্যমে। যার অর্থ হচ্ছে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, আর তাঁর সাথে কাউকে শরিক করো না।

১২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অন্তিমকালের অসিয়তের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন।

১৩। আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।

১৪। বান্দা যখন আল্লাহর হক আদায় করবে, তখন আল্লাহ তাআলার উপর বান্দার হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।

১৫। অধিকাংশ সাহাবিই এ বিষয়টি জানতেন না।

১৬। কোন বিশেষ স্বার্থে এলেম (জ্ঞান) গোপন রাখার বৈধতা।

১৭। আনন্দদায়ক বিষয়ে কোন মুসলিমকে খোশখবর দেয়া মুস্তাহব।

১৮। আল্লাহর অপরিসীম রহমতের উপর ভরসা করে আমল বাদ দেয়ার ভয়।

১৯। অজানা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির الله ورسوله أعلم [অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন] বলা।

২০। কাউকে বাদ রেখে অন্য কাউকে জ্ঞান দানে বিশেষিত করার বৈধতা।

২১। একই গাধার পিঠে পিছনে আরোহণকারীর প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দয়া ও নম্রতা প্রদর্শন।

২২। একই পশুর পিঠে একাধিক ব্যক্তি আরোহণের বৈধতা।

২৩। মুআয বিন জাবাল (রা:) এর মর্যাদা।

২৪। আলোচিত বিষয়টির মর্যাদা ও মোহত্ব।

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ (الأنعام:82)

‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানকে জুলুম [শিরক] এর সাথে মিশ্রিত করেনি’’ [তাদের জন্যই রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা] (আনআম : ৮২)

২। সাহাবী উবাদা ইবনে সামেত (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল (স:) এরশাদ করেছেন,

من شهد أن لا اله إلا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله وأن عيسى عبد الله ورسوله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه، والجتة حق والنار حق أدخله الله الجنة على ما كان من العمل. (أخرجاه)

‘‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দান করল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরিক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি তাঁর এমন এক কালিমা যা তিনি মরিয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত রুহ বা আত্মা। জান্নাত সত্য জাহান্নাম

সত্য। সে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেন। (বুখারি ও মুসলিম)

সাহাবী ইতবানের হাদিসে বর্ণিত আছে, ইমাম বুখারি ও মুসলিম হাদিসটি সংকলন করেছেন,

فإن الله حرم على النار من قال لا إله إلاالله يبتغى بذلك وجه الله

‘‘আল্লাহ তা’আলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে।’

৩। প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রা:) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন, মূসা (আঃ) বললেন,

يارب علمني شيئا أذكرك وأدعوك به قال: قل يا موسى لا إله إلا الله، قال: كل عبادك يقولون هذا؟ قال يا موسى لو أن السموات السبع وعامرهن غيري والأرضين السبع في كفة ولا إله إلاالله فى كفة مالت بهن لا إله إلا الله (رواه ابن حبان والحاكم وصححه)

‘‘হে আমার রব, আমাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করবো এবং আপনাকে ডাকবো। আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা, তুমি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো। মূসা বললেন, ‘‘আপনার সব বান্দাই তো এটা বলে।’’ তিনি বললেন, ‘‘হে মূসা, আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা, আর সাত তবক যমীন যদি এক পাল্লায় থাকে আরেক পাল্লায় যদি শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ থাকে, তাহলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর পাল্লাই বেশী ভারী হবে।’’

(ইবনে হিববান, হাকিম)

৪। বিখ্যাত সাহাবী আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘আমি রাসূল (স:) কে এ কথা বলতে শুনেছি,

قال الله تعالى يابن آدم لو أتيتني بقراب الأرض خطايا ثم لقيتني لا تشرك بى شيئا لأتيتك بقرابها مغفرة. (ترمذي و حسنه)

‘‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘‘হে আদম সন্তান, তুমি দুনিয়া ভর্তি গুনাহ নিয়ে যদি আমার কাছে হাজির হও, আর আমার সাথে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করো, তাহলে আমি দুনিয়া পরিমাণ

মাগফিরাত নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবো’’। (তিরমিজী)

এ অধ্যায় থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ-

১। আল্লাহর অসীম করুণা।

২। আল্লাহর নিকট তাওহীদের অপরিসীম সওয়াব।

৩। গুনাহ সত্ত্বেও তাওহীদের দ্বারা পাপ মোচন।

৪। সূরা আন আনআমের ৮২ নং আয়াতের তাফসীর।

৫। উবাদা বিন সামেতের হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়া।

৬। উবাদা বিন সামেত এবং ইতবানের হাদীসকে একত্র করলে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং ধোকায় নিপতিত লোকদের ভুল সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।

৭। ইতবান (রা:) হতে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখিত শর্তের ব্যাপারে সতর্কী করণ।

৮। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ফজীলতের ব্যাপারে সতর্কীকরণের প্রয়োজনীয়তা নবীগণের জীবনেও ছিলো।

৯। সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় এ কালেমার পাল্লা ভারী হওয়ার ব্যাপারে সতর্কীকরণ, যদিও এ কলেমার অনেক পাঠকের পাল্লা ইখলাসের সাথে পাঠ না করার কারণে হালকা হয়ে যাবে।

১০। সপ্তাকাশের মত সপ্ত যমীন বিদ্যমান থাকার প্রমাণ।

১১। যমীনের মত আকাশেও বসবাসকারীর অস্তিত্ব আছে।

১২। আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীকে ইতিবাচক বলে সাব্যস্ত করা যা আশআরী সম্প্রদায়ের চিন্তা ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত।

১৩। সাহাবী আনাস (রাঃ) এর হাদীস সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর ইতবান (রা:) এর হাদীসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী।

فإن الله حرم على النار من قال لا إله إلا الله يبتغي به وجه الله

এর মর্মার্থ হচ্ছে শিরক বর্জন করা। শুধু মুখে বলা এর উদ্দেশ্য নয়।

১৪। নবী ঈসা (আঃ) এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ই আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল হওয়ার বিষয়টি গভীর ভাবে চিন্তা করা।

১৫। ‘‘কালিমাতুল্লাহ’’ বলে ঈসা (আঃ) কে খাস করার বিষয়টি জানা।

১৬। হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে রুহ (পবিত্র) আত্মা হওয়া সম্পর্কে অবগত হওয়া।

১৭। জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনার মর্যাদা।

১৮। আমল যাই হোক না কেন, এ কথার মর্মার্থ উপলব্ধি করা।

১৯। মিজানের দুটি পাল্লা আছে এ কথা জানা।

২০। আল্লাহার চেহারার উল্লেখ আছে, এ কথা জানা।

৩ - তাওহীদের উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে

১। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন,

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ﴿النحل:120﴾

‘‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মত বিশেষ। এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না।’’ (নাহলঃ১২০)

২। আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেছেন,

وَالَّذِينَ هُمْ بِرَبِّهِمْ لَا يُشْرِكُونَ ﴿المؤمنون : 59﴾

‘‘আর যারা তাদের রবের সাথে শিরক করে না’’ (মুমিনুনঃ ৫৯)

৩। হুসাইন বিন আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, একবার আমি সাঈদ বিন জুবাইরের কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, গতকাল রাত্রে যে নক্ষত্রটি ছিটকে পড়েছে তা তোমাদের মধ্যে কে দেখতে পেয়েছে? তখন বললাম, ‘‘আমি’’। তারপর বললাম, ‘বিষাক্ত প্রাণী কর্তৃক দংশিত হওয়ার কারণে আমি নামাজে উপস্থিত থাকতে পারিনি’। (তিনি বললেন, ‘তখন তুমি কি চিকিৎসা করেছ?

বললাম ‘‘ঝাড় ফুঁক করেছি’’ তিনি বললেন, কিসে তোমাকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? [অর্থাৎ তুমি কেন এ কাজ করলে?] বললাম, ‘একটি হাদীস’ [এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে] যা শা’বী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। তিনি বললেন, তিনি তোমাদেরকে কি বর্ণনা করেছেন? বললাম ‘তিনি বুরাইদা বিন আল হুসাইব থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, চোখের দৃষ্টি বা চোখ লাগা এবং জ্বর ব্যতীত অন্য কোন রোগে ঝাড়- ফুঁক নেই।’ তিনি বললেন, ‘সে ব্যক্তিই উত্তম কাজ করেছে, যে শ্রুত জিনিস শেষ পর্যন্ত আমল করতে পেরেছে’। কিন্তু ইবনে আববাস (রাঃ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

عرضت علي الأمم فرأيت النبي ومعه الرهط والنبي ومعه الرجل والرجلان والنبي وليس معه أحد، إذ رفع لي سواد عظيم، فظننت أنهم أمتي فقيل لي هذا موسى وقومه، فنظرت فإذا سواد عظيم، فقيل لي : هذه أمتك، ومعهم سبعون ألفا يدخلون الجنة بغير حساب ولا عذاب.

‘‘আমার সম্মুখে সমস্ত জাতিকে উপস্থাপন করা হলো। তখন আমি এমন একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে। এরপর আরো একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে মাত্র দু’জন লোক রয়েছে। আবার এমন একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেই। ঠিক এমন সময় আমার সামনে এক বিরাট জনগোষ্ঠী পেশ করা হলো। তখন আমি ভাবলাম, এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হলো এরা হচ্ছে মূসা (আঃ) এবং তাঁর জাতি।

এরপর আরো একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর দিকে আমি তাকালাম। তখন আমাকে বলা হলো, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তুর হাজার লোক রয়েছে যারা বিনা হিসেবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। একথা বলে তিনি দরবার থেকে উঠে বাড়ীর অভ্যন্তরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা ঐ সব ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করে দিলো। কেউ বললো, তারা বোধ হয় রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহচার্য লাভকারী ব্যক্তিবর্গ। আবার কেউ বললো, তারা বোধ হয় ইসলাম পরিবেশে অথবা মুসলিম মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে তারা কাউকে শরিক করেনি। তারা এ ধরনের আরো অনেক কথা বলাবলি করলো। অতঃপর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে উপস্থিত হলে বিষয়টি তাঁকে জানানো হলো। তখন তিনি বললেন,

هم الذين لا يسترقون ولا يتطيرون ولا يكتون وعلى ربهم يتوكلون

‘‘তারা হচ্ছে ঐ সব লোক যারা ঝাড়-ফুক করে না। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করে না। শরীরে সেক বা দাগ দেয় না। আর তাদের রবের উপর তারা ভরসা করে।’’ একথা শুনে ওয়াকাশা বিন মুহসিন দাড়িয়ে বললো, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভূক্ত করে নেন। তিনি বললেন, আমি দোয়া করলাম, ‘‘তুমি তাদের দলভুক্ত’’। অতঃপর অন্য একজন লোক দাড়িয়ে বললো, আল্লাহর কাছে আমার জন্যও দোয়া করুন যেন তিনি আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে নেন। তিনি বললেন, ‘‘তোমার পূর্বেই ওয়াকাশা সে সুযোগ নিয়ে গেছে।’’

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১। তাওহীদের ব্যাপারে মানুষের বিভিন্ন স্তরে অবস্থান সম্পর্কিত জ্ঞান।

২। নবী ইবরাহীম (আ:) মুশরিক ছিলেন না বলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা।

৩। বড় বড় বুজুর্গ ব্যক্তিগণ শিরক মুক্ত ছিলেন বলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা।

৪। ঝাড়-ফুঁক এবং আগুনের দাগ পরিত্যাগ করা তাওহীদপন্থী হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমান।

৫। আল্লাহর উপর ভরসা বা তাওয়াক্কুলই বান্দার মধ্যে উল্লেখিত গুণ ও স্বভাবসমূহের সমাবেশ ঘটায়।

৬। বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশকারী সৌভাগ্যবান লোকেরা কোন আমল ব্যতীত উক্ত মর্যাদা লাভ করতে পারেননি, এটা জানার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের জ্ঞানের গভীরতা।

৭। মঙ্গল ও কল্যাণের প্রতি তাঁদের অপরিসীম আগ্রহ।

৮। সংখ্যা ও গুণাবলরি দিক থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর ফজিলত।

৯। নবী মূসা (আঃ) এর সাহাবীদের মর্যাদা।

১০। সব উম্মতকে রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।

১১। প্রত্যেক উম্মতই নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথকভাবে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে।

১২। নবীগণের আহবানে সাড়া দেয়ার মত লোকের স্বল্পতা।

১৩। যে নবীর দাওয়াত কেউ গ্রহণ করেনি তিনি একাই হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন।

১৪। এ জ্ঞানের শিক্ষা হচ্ছে, সংখ্যাধিক্যের দ্বারা ধোকা না খাওয়া আবার সংখ্যাল্পতার কারণে অবহেলা না করা।

১৫। চোখ-লাগা এবং জ্বরের চিকিৎসার জন্য ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি।

১৬। সালাফে সালেহীনের জ্ঞানের গভীরতা।

قد أحسن من انتهى إلى ما سمع

‘‘সে ব্যক্তিই ভাল কাজ করেছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শুনেছে তাই আমল করেছে’’ এ কথাই এর প্রমাণ পেশ করে। তাই প্রথম হাদীস দ্বিতীয় হাদিসের বিরোধী নয়।

১৭। মানুষের মধ্যে যে গুণ নেই তার প্রশংসা থেকে সালাফে সালেহীন বিরত থাকতেন।

১৮। أنت منهم (তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত) ওয়াকাশার ব্যাপারে একথা নবুওয়তেরই প্রমাণ পেশ করে।

১৯। ওয়াকাশা (রা:) এর মর্যাদা ও ফজিলত।

২০। কোন কথা সরাসরি না বলে হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করা।

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন-

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ (النساء: ৪৮)

‘‘আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করা গুনাহ মাফ করবেন না। শিরক ছাড়া অন্যান্য যে সব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা মাফ করে দিবেন।’’ (নিসাঃ৪৮)

২। ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার কাছে এ দোয়া করেছিলেন,

وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ (إبراهيم: ৩৫)

‘‘আমাকে এবং আমার সন্তানদের মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা কর’’ (ইবরাহীম . ৩৫)

৩। এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন,

.أخوف ما أخاف عليكم، الشرك الأصغرও فسئل عنه فقال : الرياء

‘‘ আমি তোমাদের জন্য সে জিনিসটি সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হচ্ছে শিরকে আসগার অর্থাৎ ছোট শিরক। তাকে শিরকে আসগার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, (ছোট শিরক হচ্ছে) ‘‘রিয়া’’।

৪। ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

من مات وهو يدعوا لله ندا دخل النار (رواه البخاري)

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’ (বুখারি)

৫। সাহাবী জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’ (মুসলিম)

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায় .

১। শিরককে ভয় করা।

২। রিয়া শিরকের মধ্যে শামিল।

৩। রিয়া হল ছোট শিরকের অন্তর্ভূক্ত।

৪। জান্নাত ও জাহান্নাম কাছাকাছি হওয়া।

৫। জান্নাত ও জাহান্নাম নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি একই হাদীসে বর্ণিত হওয়া।

৬। আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক বানিয়ে মৃত্যু বরণ করলে মৃত ব্যক্তি যত বড় আবেদই হোক না কেন সে জাহান্নামে যাবে।

৭। ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর দোয়ার প্রধান বিষয় হচ্ছে, তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা তথা শিরক থেকে রক্ষা করা।

৮। رب أنهن أضللن كثيرا من الناس ‘‘হে আমার রব, এমূর্তিগুলো বহু লোককে গুমরাহ করেছে’’ এ কথা দ্বারা ইবরাহীম (আঃ) বহু লোকের অবস্থা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করেছেন।

৯। এখানে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর তাফসীর রয়েছে যা ইমাম বুখারি বর্ণনা করেছেন।

১০। শিরক মুক্ত ব্যক্তির মর্যাদা।

৬ - ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর প্রতি সাক্ষ্যদানের আহবান

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ (يوسف: 108)

‘‘(হে মুহাম্মদ) আপনি বলে দিন, এটাই আমার পথ। পূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাই।’’ (ইউসুফঃ ১০৮)

২। সাহাবী ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূল (স:) যখন মুআ’য বিন জাবাল (রাঃ) কে ইয়ামানের শাসনকর্তা নিয়োগ করে পাঠালেন তখন [রাসূল (স:) মুআ’যকে লক্ষ্য করে] বললেন,

أنك تأتي قوما من أهل الكتاب فليكن أول ما تدعوهم إليه شهادة أن لا إله إلا الله فإن هم أطاعوك لذلك فاعلمهم إن الله افترض عليهم خمس صلوات فى كل يوم وليلة فإن هم أطاعوك لذلك فاعلمهم إن الله افترض عليهم صدقة تؤخذ من أغنياءهم فترد على فقراءهم فإن هم أطاعوك لذلك فإياك وكرائم أموالهم واتق دعوة المظلوم. فإنه ليس بينها وبين الله حجاب (أخرجاه)

‘‘তুমি এমন এক কাওমের কাছে যাচ্ছ যারা আহলে কিতাব। [যারা কোন আসমানী কিতাবে বিশ্বাসী] সর্ব প্রথম যে জিনিসের দিকে তুমি তাদেরকে আহবান জানাবে তা হচ্ছে, ‘‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহুর সাক্ষ্য দান’’। অন্য বর্ণনায় আছে, আল্লাহর ওয়াহদানিয়্যাত বা একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদান। এ বিষয়ে তারা যদি তোমার আনুগত্য করে তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয় তবে তাদেরকে জানিয়ে দিও যে, আল্লাহ তাআলা তাদের উপর যাকাত ফরজ করে দিয়েছেন, যা বিত্তশালীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদেরকে দেয়া হবে। তারা যদি এ ব্যাপারে তোমার আনুগত্য করে তবে তাদের উৎকৃষ্ট মালের ব্যাপারে তুমি খুব সাবধানে থাকবে। আর মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করে চলবে। কেননা মজলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তাআলার মাঝখানে কোন পর্দা নেই।’’ (বুখারি ও মুসলিম)

৩। সাহাল বিন সাআদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (স:) খাইবারের [যুদ্ধের] দিন বললেন,

"‏ لأعطين الراية غدا رجلا يفتح على يديه، يحب الله ورسوله، ويحبه الله ورسوله ‏"‏‏.‏ فبات الناس ليلتهم أيهم يعطى فغدوا كلهم يرجوه فقال ‏"‏ أين علي ‏"‏‏.‏ فقيل يشتكي عينيه، فبصق في عينيه ودعا له، فبرأ كأن لم يكن به وجع، فأعطاه فقال أقاتلهم حتى يكونوا مثلنا‏.‏ فقال ‏"‏ انفذ على رسلك حتى تنزل بساحتهم، ثم ادعهم إلى الإسلام، وأخبرهم بما يجب عليهم، فوالله لأن يهدي الله بك رجلا خير لك من أن يكون لك حمر النعم ‏"‏‏.‏

‘‘আগামীকাল এমন ব্যক্তির কাছে আমি ঝান্ডা প্রদান করবো যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাকে ভালবাসে। তার হাতে আল্লাহ তাআলা বিজয় দান করবেন। কাকে ঝান্ডা প্রদান করা হবে এ উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতার মধ্যে লোকজন রাত্রি যাপন করলো। যখন সকাল হয়ে গেলো তখন লোকজন রাসূল (স:) এর নিকট গেলো তাদের প্রত্যেকেই আশা পোষণ করছিলো যে ঝান্ডা তাকেই দেয়া হবে, তখন তিনি বললেন, আলী বিন আবি তালিব কোথায়? বলা হলো, তিনি চক্ষুর পীড়ায় ভোগছেন। তাদেরকে

এ অধ্যায় থেকে নিম্বোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়,

১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণকারীর নীতি ও পথ হচ্ছে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহবান করা।

২। ইখলাসের ব্যাপারে শতর্কতা অবলম্বন করা। কেননা অনেক লোক হকের পথে মানুষকে আহবান জানালেও মূলতঃ তারা নিজের নফস বা স্বার্থের দিকেই আহবান জানায়।

৩। তাওহীদের দাওয়াতের জন্য অন্তর দৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অপরিহার্য্য।

৪। উত্তম তাওহীদের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার প্রতি গাল-মন্দ আরোপ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র থাকা।

৫। আল্লাহ তাআলার প্রতি গাল-মন্দ আরোপ করা নিকৃষ্ট এবং শিরকের অন্তর্ভূক্ত।

৭। তাওহীদই হচ্ছে সর্ব প্রথম ওয়াজিব।

৮। সর্বাগ্রে এমন কি নামাযেরও পূর্বে তাওহীদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।

৯। আল্লাহর ওয়াহদানিয়াতের অর্থ হচ্ছে, ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ এর সাক্ষ্য প্রদান করা। অর্থাৎ ‘‘আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কোন ইলাহ নেই’’ এ ঘোষণা দেয়া।

১০। একজন মানুষ আহলে কিতাবের অন্তর্ভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও সে তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে কিংবা তাওহীদের জ্ঞান থাকলেও তা দ্বারা আমল নাও করতে পারে।

১১। শিক্ষা দানের প্রতি পর্যায়ক্রমে গুরুত্বারোপ।

১২। সর্ব প্রথম অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শুরু করা।

১৩। যাকাত প্রদানের খাত সম্পর্কিত জ্ঞান।

১৪। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রের সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উন্মোচন করা বা নিরসন করা।

১৫। যাকাত আদায়ের সময় বেছে বেছে উৎকৃষ্ট মাল নেয়ার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।

১৬। মজলুমের বদ দোয়া থেকে বেঁচে থাকা।

১৭। মজলুমের ফরিয়াদ এবং আল্লাহ তাআলার মধ্যে কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকার সংবাদ।

১৮। সাইয়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বড় বড় বজুর্গানে দ্বীনের উপর যে সব দুঃখ- কষ্ট এবং কঠিন বিপদাপদ আপতিত হয়েছে তা তাওহীদেরই প্রমাণ পেশ করে।

১৯। ‘‘আমি আগামীকাল এমন একজনের হাতে পতাকা প্রদান করবো যার হাতে আল্লাহ বিজয় দান করবেন।’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ উক্তি নবুয়তেরই একটি নিদর্শন।

২০। আলী রা. এর চোখে থু থু প্রদানে চোখ আরোগ্য হয়ে যাওয়াও নবুয়্যতের একটি নিদর্শন।

২১। আলী রা. এর মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ।

২২। আলী রা. এর হাতে পতাকা তুলে দেয়ার পূর্বে রাতে পতাকা পাওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের উদ্বেগ ও ব্যাকুলতার মধ্যে রাত্রি যাপন এবং বিজয়ের সুসংবাদে আশ্বস্ত থাকার মধ্যে তাদের মর্যাদা নিহিত আছে।

২৩। বিনা প্রচেষ্টায় ইসলামের পতাকা তথা নেতৃত্ব লাভ করা আর চেষ্টা করেও তা লাভে ব্যর্থ হওয়া, উভয় অবস্থায়ই তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখা।

২৪। ‘‘বীর পদক্ষেপে এগিয়ে যাও’’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ উক্তির মধ্যে ভদ্রতা ও শিষ্ঠাচার শিক্ষা দানের ইঙ্গিত রয়েছে।

২৫। যুদ্ধ শুরু করার পূর্বে ইসলামের দাওয়াত পেশ করা।

২৬। ইতিপূর্বে যাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে এবং যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়েছে তাদেরকেও যুদ্ধের আগে ইসলামের দাওয়াত দিতে হবে।

২৭। أخبرهم بمايجب عليهم রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী হিকমত ও কৌশলের সাথে দাওয়াত পেশ করার ইঙ্গিত বহন করে।

২৮। দীন ইসলামে আল্লাহর হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।

২৯। আলী রা. এর হাতে একজন মানুষ হেদায়াত প্রাপ্ত হওয়ার সওয়াব।

৩০। ফতোয়ার ব্যাপারে কসম করা।

৫ - তাওহীদ এবং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্য দানের ব্যাখ্যা

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ (الاسراء: 57)

‘‘এসব লোকেরা যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় অসীলার অনুসন্ধান করে (আর ভাবে) কোনটি সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী।’’ (ইসরাঃ ৫৭)

২। আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেছেন,

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُونَ ﴿26﴾ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي (الزخرف: 26-27)

‘‘সে সময়ের কথা স্মরণ করো যখন ইবরাহীম তার পিতা ও কওমের লোকদেরকে বলেছিলেন, তোমরা যার ইবাদত করো তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আর আমার সম্পর্ক হচ্ছে কেবল মাত্র তাঁরই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’ (যুখরুফঃ ২৬)

৩। আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে ঘোষণা করেছেন,

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ (التوبة: 31)

‘‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও দরবেশ লোকদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে’’ (তাওবাঃ ৩১)

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ (البقرة:165)

‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অপর কোন শক্তিকে আল্লাহর অংশীদার বা সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাকে এমনভাবে ভালবাসে যেমনিভাবে একমাত্র আল্লাহকেই ভালবাসা উচিৎ।’’ (বাকারা : ১৬৫)

৫। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাললাম এরশাদ করেছেন,

من قال لا إله إلا الله وكفر بما يعبد من دون الله حرم ماله ودمه وحسابه على الله عز وجل.

‘‘যে ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ [আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই] বলবে, আর আল্লাহ ব্যতীত যারই ইবাদত করা হয় তাকেই অস্বীকার করবে তার জান ও মাল হারাম [অর্থাৎ মুসলমানদের কাছে সম্পূর্ণ নিরাপদ] গোপন তৎপরতা ও অন্তরের কুটিলতা বা মুনাফিকির জন্য] তার শাস্তি আল্লাহর উপরই ন্যস্ত।’’

পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে তাওহীদ এবং

শাহাদাতের তাফসীর। কয়েকটি সুস্পষ্ট বিষয়ের মাধ্যমে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমনঃ

(ক) সূরা ইসরার আয়াত, এ আয়াতে সে সব মুশরিকদের সমুচিত জওয়াব দেযা হয়েছে যারা বুজুর্গ ও নেক বান্দাদেরকে (আল্লাহকে ডাকার মত] ডাকে। আর এটা যে ‘শিরকে আকবার’ এ কথার বর্ণনাও এখানে রয়েছে।

(খ) সূরা তাওবার আয়াত। এতে আহলে কিতাব অর্থাৎ ইহুদি খৃষ্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আলেম ও দরবেশ ব্যক্তিরদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। আরো বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়নি। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অন্যায় ও পাপ কাজে আলেম ও আবেদদের আনুগত্য করা যাবে না। তাদের কাছে দোয়াও করা যাবে না।

(গ) কাফেরদেরকে লক্ষ্য করে ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর কথা

إنى براء مما تعبدون إلا الذي فطرني

দ্বারা তাঁর রবকে যাবতীয় মা’বুদ থেকে আলাদা করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এখানে এটাই বর্ণনা করেছেন যে [বাতিল মা’বুদ থেকে] পবিত্র থাকা আর প্রকৃত মাবুদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ব্যাখ্যা। তাই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

جعلها كلمة باقية فى عقبه لعلهم يرجعون

‘‘আর ইবরাহীম এ কথাটি পরবর্তীতে তার সন্তানের মধ্যে রেখে গেলো, যেন তারা তার দিকে ফিরে আসে।’’

(ঘ) সূরা বাকারার কাফেরদের বিষয় সম্পর্কিত আয়াত। যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন, وماهم بخارجين من النار

‘‘তারা কখনো জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।’’

এখানে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকরা তাদের শরীকদেরকে [যাদেরকে তারা আল্লাহর সমকক্ষ বা অংশীদার মনে করে] আল্লাহকে ভালবাসার মতই ভালবাসে।

এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা আল্লাহকে ভালবাসে, কিন্তু এ ভালবাসা তাদেরকে ইসলামে দাখিল করতে পারেনি। তাহলে আল্লাহর শরীককে যে ব্যক্তি আল্লাহর চেয়েও বেশী ভালবাসে সে কিভাবে ইসলামকে গ্রহণ করবে। আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র শরীককেই ভালবাসে। আল্লাহর প্রতি তার কোন ভালবাসা নেই তার অবস্থাই বা কি হবে?

(ঙ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী .

من قال لا إله إلا الله وكفر بما يعبد من دون الله حرم ماله ودمه وحسابه على الله.

‘‘যে ব্যক্তি লা- ইলাহ ইল্লাল্লাহু বলবে আর আল্লাহ ব্যতীত যারই

ইবাদত করা হয় তাকেই অস্বীকার করবে, তার ধন-সম্পদ ও রক্ত পবিত্র।’’ [অর্থাৎ জান, মাল, মুসলমানের কাছে নিরাপদ] এ বাণী হচ্ছে লা-ইলাহা ইললাল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা। কারণ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর শুধুমাত্র মৌখিক উচ্চারণ, শব্দসহ এর অর্থ জানা, এর স্বীকৃতি প্রদান, এমনকি শুধুমাত্র লা- শারীক আল্লাহকে ডাকলেই জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাথে গাইরুল্লাহর ইবাদত তথা মিথ্যা মা’বুদগুলোকে অস্বীকার করার বিষয়টি সংযুক্ত না হবে। এতে যদি কোন প্রকার সন্দেহ, সংশয় কিংবা দ্বিধা সংকোচ পরিলক্ষিত হয় তাহলে জান-মাল ও নিরাপত্তার কোন নিশ্চয়তা নেই। অতএব, এটাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়, সুস্পষ্ট বর্ণনা ও অকাট্য দলীল।

৭ - বালা মুসীবত দূর করা অথবা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে রিং, তাগা [সূতা] ইত্যাদি পরিধান করা শিরক

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ (الزمر: 38)

[হে রাসূল] ‘‘আপনি বলে দিন, তোমরা কি মনে করো, আল্লাহ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে চান তাহলে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে ডাকো, তারা কি তাঁর [নির্ধারিত] ক্ষতি হতে আমাকে রক্ষা করতে পারবে?’’ (ঝূমারঃ ৩৮)।

২। সাহাবী ইমরান বিন হুসাইন (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা:) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এটা কি?’’ লোকটি বললো, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য দেয়া হয়েছে। তিনি বললেন, ‘‘এটা খুলে ফেলো। কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকেই শুধু বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তবে তুমি কখনো সফলকাম

হতে পারবে না।’’ (আহমাদ)

৩। উকবা বিন আমের রা. হতে একটি ‘‘মারফু’’ হাদীসে বর্ণিত আছে,

من تعلق تميمة فلا أتم الله له ومن تعلق ودعة فلا ودع الله له

‘‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলায় (পরিধান করে) আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। যে ব্যক্তি কড়ি, শঙ্খ বা শামুক ঝুলায় তাকে যেন আল্লাহ রক্ষা না করেন।’’ অপর একটি বর্ণনায় আছে,

من تعلق تميمة فقد أشرك

‘‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলালো সে শিরক করলো।’’

৪। ইবনে আবি হাতেম হুযাইফা থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘‘জ্বর নিরাময়ের জন্য হাতে সূতা বা তাগা পরিহিত অবস্থায় তিনি একজন লোককে দেখতে পেয়ে তিনি সে সূতা কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন,

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ (يوسف: ১০৬) (ইউসুফঃ ১০৬)

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়,

১। রিং (বালা) ও সূতা ইত্যাদি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে পরিধান করার ব্যাপারে অত্যাধিক কঠোরতা।

২। স্বয়ং সাহাবীও যদি এসব জিনিস পরিহিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তাহলে তিনিও সফলকাম হতে পারবেন না। এতে সাহাবায়ে কেরামের এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ছোট শিরক কবিরা গুনাহর চেয়েও মারাত্মক।

৩। অজ্ঞতার অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।

৪। لا تزيدك إلا وهنا ইহা তোমার দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করবে না।’’ এ কথা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে রিং বা সূতা পরিধান করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই বরং অকল্যাণ আছে।

৫। যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজ করে তার কাজকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

৬। এ কথা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি (রোগ নিরাময়ের জন্য কোন কিছু [রিং সূতা] শরীরে লটকাবে তার কুফল তার উপরই বর্তাবে।

৭। এ কথাও সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে তাবিজ ব্যবহার করলো সে মূলতঃ শিরক করলো।

৮। জ্বর নিরাময়ের জন্য সূতা পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

৯। সাহাবী হুযাইফা কর্তৃক কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম শিরকে আসগরের দলীল হিসেবে ঐ আয়াতকেই পেশ করেছেন যে আয়াতে শিরকে আকবার বা বড় শিরকের কথা রয়েছে। যেমনটি ইবনে আববাস (রাঃ) বাকারার আয়াতে উল্লেখ করেছেন।

১০। নজর বা চোখ লাগা থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য শামুক, কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদি লটকানো বা পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

১১। যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করে তার উপর বদ দোয়া করা হয়েছে, ‘আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন।’ আর যে ব্যক্তি শামুক, কড়ি বা শঙ্খ (গলায় বা হাতে) লটকায় তাকে যেন আল্লাহ রক্ষা না করেন।

১। আবু বাসীর আনসারী রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সফর সঙ্গী ছিলেন। এ সফরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি নির্দিষ্ট এলাকায় একজন দূত পাঠালেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কোন উটের গলায় যেন ধনুকের কোন রজ্জু লটকানো না থাকে অথবা এ জাতীয় রজ্জু যেন কেটে ফেলা হয়। (বুখারি)

২। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘‘আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একথা বলতে শুনেছি,

أن الرقى والتمائم والتولة شرك (رواه أحمد وأبو داؤد)

‘‘ঝাড়-ফুঁক ও তাবিক- কবজ হচ্ছে শিরক’’ (আহমাদ, আবু দাউদ)

৩। আবদুল্লাহ বিন উকাইম থেকে মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে,

من تعلق شيئا وكل اليه (رواه أحمد والترمذي)

‘‘যে ব্যক্তি কোন জিনিস [অর্থাৎ তাবিজ- কবজ] লটকায় সে উক্ত জিনিসের

দিকেই সমর্পিত হয়’’। [অর্থাৎ এর কুফল তার উপরই বর্তায়] (আহমাদ, তিরমিজি)

تمائم বা তাবিজ হচ্ছে এমন জিনিস যা চোখ লাগা বা দৃষ্টি লাগা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সন্তানদের গায়ে ঝুলানো হয়। ঝুলন্ত জিনিসটি যদি কুরআনের অংশ হয় তাহলে সালাফে সালেহীনের কেউ কেউ এর অনুমতি দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ অনুমতি দেননি বরং এটাকে শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয় বলে গণ্য করতেন। ইবনে মাসউদ রা. এ অভিমতের পক্ষে রয়েছেন। আর رقى বা ঝাড়-ফুঁককে عزائم নামে অভিহিত করা হয়। যে সব ঝাড়-ফুঁক শিরক মুক্ত তা দলিলের মাধ্যমে খাস করা হয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাললাম চোখের দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্ছুর বিষের ব্যাপারে ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি দিয়েছেন।

تولة এমন জিনিস যা কবিরাজদের বানানো। তারা দাবী করে যে, এ জিনিস [কবজ] দ্বারা স্ত্রীর অন্তরে স্বামীর ভালবাসা আর স্বামীর অন্তরে স্ত্রীর ভালবাসার উদ্রেক হয়। সাহাবী রুআইফি থেকে ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেন, তিনি [রুআইফি] বলেছেন, ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

يا رويفع لعل الحياة تطول بك فاخبر الناس أن من عقد لحيته أو تقلد وترا أو استنجى برجيع فإن محمدا برئ عنه

‘‘হে রুআইফি, তোমার হায়াত সম্ভবত দীর্ঘ হবে। তুমি লোকজনকে জানিয়ে দিও, ‘‘যে ব্যক্তি দাড়িতে গিরা দিবে, অথবা গলায় তাবিজ- কবজ ঝুলাবে অথবা পশুর মল কিংবা হাড় দ্বারা এস্তেঞ্জা করবে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জিম্মাদারী থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।’’

সাঈদ বিন জুবাইর থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন,

من قطع تميمة من إنسان كان كعدل رقبة (رواه وكيع)

‘‘যে ব্যক্তি কোন মানুষের তাবিজ- কবজ ছিড়ে ফেলবে বা কেটে ফেলবে সে ব্যক্তি একটি গোলাম আযাদ করার মত কাজ করলো।’’ (ওয়াকী)

ইবরাহীম থেকে বর্নিত হাদীসে তিনি বলেন, তাঁরা সব ধরনের তাবীজ- কবজ অপছন্দ করতেন, চাই তার উৎস কুরআন হোক বা অন্য কিছু হোক।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১। ঝাড়-ফুঁক ও তাবিজ-কবজের ব্যাখ্যা।

২। (تولة) ‘‘তাওলাহ’’ এর ব্যাখ্যা।

৩। কোন ব্যাতিক্রম ছাড়াই উপরোক্ত তিনটি বিষয় শিরক এর অন্তর্ভূক্ত।

৪। সত্যবাণী তথা কুরআনের সাহায্যে [চোখের] দৃষ্টি লাগা এবং সাপ বিচ্ছুর বিষ নিরাময়ের জন্য ঝাড়-ফুঁক করা শিরকের অন্তর্ভূক্ত নয়।

৫। তাবিজ- কবজ কুরআন থেকে হলে তা শিরক হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

৬। খারাপ দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য পশুর রশি বা অন্য কিছু বুঝলানো শিরকের অন্তর্ভূক্ত।

৭। যে ব্যক্তি ধনুকের রজ্জু গলায় ঝুলায় তার উপর কঠিন অভিসম্পাত।

৮। কোন মানুষের তাবিজ- কবজ ছিড়ে ফেলা কিংবা কেটে ফেলার ফজিলত।

৯। ইবরাহীমের কথা পূর্বোক্ত মতভেদের বিরোধী নয়। কারণ এর দ্বারা আব্দুল্লাহর সঙ্গী- সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে।

৯ - গাছ, পাথর ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাসিল করা

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

أَفَرَأَيْتُمُ اللَّاتَ وَالْعُزَّى ﴿১৯﴾

‘‘ তোমরা কি [পাথরের তৈরী মুর্তি] ‘লাত’ আর ‘‘উয্যা’’ দেখেছো?’’ (আন নাজমঃ ১৯)।

২। আবু ওয়াকিদ আল-লাইছী রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হুনাইনের [যুদ্ধের] উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমরা তখন সবেমাত্র ইসলাম গ্রহণ করেছি [নও মুসলিম]। একস্থানে পৌত্তুলিকদের একটি কুলগাছ ছিল যার চারপাশে তারা বসতো এবং তাদের সমরাস্ত্র ঝুলিয়ে রাখতো। গাছটিকে তারা ذات أنواط [যাত আনওয়াত] বলতো। আমরা একদিন একটি কুলগাছের পার্শ্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল মুশরিকদের যেমন ‘‘যাতু আনওয়াত’’ আছে আমাদের জন্যও অনুরূপ ‘‘যাতু আনওয়াত’’ [অর্থাৎ একটি গাছ] নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

ألله أكبر إنها السنن قلتم والذي نفسي بيده كما قالت بنوا إسرائيل لموسى:اجْعَلْ لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آَلِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ ﴿১৩৮﴾ (الأعراف: ১৩৮)

‘‘আল্লাহু আকবার, তোমাদের এ দাবীটি পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতি ছাড়া আর কিছুই নয়। যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা এমন কথাই বলেছো যা বনী ইসরাইল মূসা আ. কে বলেছিলো। তারা বলেছিলো, ‘‘হে মূসা, মুশরিকদের যেমন মা’বুদ আছে আমাদের জন্য তেমন মা’বুদ বানিয়ে দাও। মুসা আ. বললেন, তোমরা মূর্খের মতো কথা বার্তা বলছো’’ (আরাফঃ ১৩৮)। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের রীতি-নীতিই অবলম্বন করছো। (তিরমিজি হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয় গুলো জানা যায়ঃ-

১। সূরা নাজম এর أفرايتم اللات والعزى এর তাফসীর।

২। সাহাবায়ে কেরামের কাংখিত বিষয়টির পরিচয়।

৩। তারা [সাহাবায়ে কেরাম] শিরক করেননি।

৪। তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চেয়েছিলেন এ কথা ভেবে যে, আল্লাহ তা [কাংখিত বিষয়টি] পছন্দ করেন।

৫। সাহাবায়ে কেরামই যদি এ ব্যাপারে অজ্ঞ থাকেন তাহলে অন্য লোকেরা তো এ ব্যাপারে আরো বেশী অজ্ঞ থাকবে।

৬। সাহাবায়ে কেরামের জন্য যে অধিক সওয়াব দান ও গুনাহ মাফের ওয়াদা রয়েছে অন্যদের ব্যাপারে তা নেই।

৭। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের কাছে অপারগতার কথা বলেননি বরং তাঁদের কথার শক্ত জবাব এ কথার মাধ্যমে দিয়েছেনঃ

ألله أكبر إنها السنن لتتبعن سنن من كان قبلكم

‘‘আল্লাহু আকবার নিশ্চয়ই এটা পূর্ববর্তী লোকদের নীতি। তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের নীতি অনুসরণ করছো।’’ উপরোক্ত

তিনটি কথার দ্বারা বিষয়টি অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে।

৮। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘‘উদ্দেশ্য’’। এখানে এ কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরামের দাবী মূলতঃ মূসা (আঃ) এর কাছে বনী ইসরাইলের মা’বুদ বানিয়ে দেয়ার দাবীরই অনুরূপ ছিল।

৯। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক না সূচক জবাবের মধ্যেই তাঁদের জন্য ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর’’ মর্মার্থ অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে নিহিত আছে।

১০। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফতোয়া দানের ব্যাপারে ‘‘হলফ’’ করেছেন।

১১। শিরকের মধ্যে ‘আকবার’ ও ‘আসগার’ রয়েছে। কারণ, তাঁরা এর দ্বারা দীন থেকে বের হয়ে যাননি।

১২। ‘‘আমরা কুফরী যমানার খুব কাছাকাছি ছিলাম’’ [অর্থাৎ আমরা সবেমাত্র মুসলমান হয়েছি] এ কথার দ্বারা বুঝা যায় যে অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম এ ব্যাপারে অজ্ঞ ছিলেন না।

১৩। আশ্চর্যজনক ব্যাপারে যারা ‘আল্লাহু আকবার’ বলা পছন্দ করে না, এটা তাদের বিরুদ্ধে একটা দলীল।

১৪। পাপের পথ বন্ধ করা।

১৫। জাহেলী যুগের লোকদের সাথে নিজেদের সামঞ্জস্যশীল করা নিষেধ।

১৬। শিক্ষাদানের সময় প্রয়োজন বোধে রাগ করা।

১৭। إنها السنن ‘‘এটা পূর্ববর্তী লোকদের নীতি’’ এ বাণী একটা চিরন্তন নীতি।

১৮। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সংবাদ বলেছেন, বাস্তবে তাই ঘটেছে। এটা নবুয়তেরই নিদর্শন।

১৯। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইহুদী ও খৃষ্টানদের চরিত্র সম্পর্কে যে দোষ-ত্রুটির কথা বলেছেন, তা থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যই বলেছেন।

২০। তাদের [আহলে কিতাবের] কাছে এ কথা স্বীকৃত যে ইবাদতের ভিত্তি হচ্ছে [আল্লাহ কিংবা রাসুলের] নির্দেশ। এখানে কবর সংক্রান্ত বিষয়ে শর্তকতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে।

من ربك [তোমার রব কে?] দ্বারা যা বুঝানো হয়েছে তা সুস্পষ্ট। [অর্থাৎ আল্লাহ শিরক করার নির্দেশ না দেয়া সত্বেও তুমি শিরক করেছো। তাহলে তোমার রব কে যার হুকুমে শিরক করেছো?]। من نبيك [ তোমার নবী কে] এটা নবী কর্তৃক গায়েবের খবর [অর্থাৎ কবরে কি প্রশ্ন করা হবে এ কথা নবী ছাড়া কেউ বলতে পারেনা। এখানে এ কথার দ্বারা বুঝানো হচ্ছে কে তোমার নবী? তিনি তো শিরক করার কথা বলেননি। তারপর ও তুমি শিরক করেছো। তাহলে তোমার শিরক করার নির্দেশ দাতা নবী কে?]

ما دينك [তোমার দীন কি] এ কথা তাদের إجعل لنا آلهة [আমাদের জন্যও ইলাহ ঠিক করে দিন) এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন করা হবে। [অর্থাৎ তোমার দ্বীনতো শিরক করার নির্দেশ দেয়নি তাহলে তোমাকে শিরকের নির্দেশ দান কারী দ্বীন কি?]

২১। মুশরিকদের রীতি- নীতির মত আহলে কিতাবের [অর্থাৎ আসমানী কিতাব প্রাপ্তদের] রীতি-নীতিও দোষনীয়।

২২। যে বাতিল এক সময় অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো তা পরিবর্তনকারী একজন নওমুসলিমের অন্তর পূর্বের সে অভ্যাস ও স্বভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। ونحن حدثاء عهد بكفر [আমরা কুফরী যুগের খুব নিকটবর্তী ছিলাম বা নতুন মুসলমান ছিলাম] সাহাবীদের এ কথার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়।

১৪ - গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করা

১। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ﴿162﴾ لَا شَرِيكَ لَهُ (الأنعام: 162-163)

‘‘আপনি বলুন, ‘‘আমার সালাত, আমার কোরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ [সবই] আল্লাহ রাববুল আলামীনের উদ্দেশ্যে নিবেদিত, যার কোন শরিক নেই’’ (আনআম : ১৬২)

২। আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেছেন,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ﴿2﴾ (الكوثر: 2)

‘‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানী করুন। (আল-কাউসারঃ ২)

৩। আলী (রাঃ) থেকে বর্নিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘‘রাসূল (স:) চারটি বিষয়ে আমাকে অবহিত করেছেন,

(ক) لعن الله من ذبح لغير الله

‘‘যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে (পশু) যবেহ করে তার উপর আল্লাহর লা’নত।’’

(খ) لعن الله من لعن والديه

‘‘যে ব্যক্তি নিজ পিতা- মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত।’’

(গ) لعن الله من آوى محدثا

‘‘যে ব্যক্তি কোন বিদআতীকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত।’’

(ঘ) لعن الله من غير منار الأرض

‘‘যে ব্যক্তি জমির সীমানা [চিহ্ণ] পরিবর্তন করে তার উপর আল্লাহর লা’নত’’। (মুসলিম)

৪। তারিক বিন শিহাব কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন :

دخل الجنة رجل فى ذباب ودخل النار رجل فى ذباب قالوا وكيف ذلك يا رسول الله قال: مر رجلان على قوم لهم صنم لا يجوزه أحد حتى يقرب له شيئا فقالوا لاحدهما : قرب قال: ليس عندي شئ أقرب، قالوا له: قرب ولو ذباب فقرب ذباب فخلوا سبيله فدخل النار، وقالوا للآخر: قرب، قال ما كنت أقرب شيئا دون الله عز وجل فضربوا عنقه فدخل الجنة. (رواه احمد)

‘‘এক ব্যক্তি একটি মাছির ব্যাপারে জান্নাতে প্রবেশ করেছে। আর এক ব্যক্তি একটি মাছির ব্যাপারে জাহান্নামে গিয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এমনটি কিভাবে হলো? তিনি বললেন, ‘দু’জন লোক এমন একটি কওমের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল যার জন্য একটি মূর্তি নির্ধারিত ছিল। উক্ত মূর্তিকে কোন কিছু নযরানা বা উপহার না দিয়ে কেউ সে স্থান অতিক্রম করতোনা। উক্ত কওমের লোকেরা দু’জনের একজনকে বললো, ‘মূর্তির জন্য তুমি কিছু নযরানা পেশ করো’। সে বললো,

‘নযরানা দেয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই’ তারা বললো, ‘অন্ততঃ একটা মাছি হলেও নযরানা স্বরূপ দিয়ে যাও’। অতঃপর সে একটা মাছি মূর্তিকে উপহার দিলো। তারাও লোকটির পথ ছেড়ে দিলো। এর ফলে মৃত্যুর পর সে জাহান্নামে গেলো। অপর ব্যক্তিকে তারা বললো, ‘‘মূর্তিকে তুমিও কিছু নযরানা দিয়ে যাও। সে বললো, ‘একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নৈকট্য লাভের জন্য আমি কাউকে কোন নযরানা দেইনা’ এর ফলে তারা তার গর্দান উড়িয়ে দিলো। [শিরক থেকে বিরত থাকার কারণে] মৃত্যুর পর সে জান্নাতে প্রবেশ করলো।’’ (আহমদ)

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয় গুলো জানা যায়ঃ

১। قل إن صلاتي ونسكي এর তাফসীর।

২। فصل لربك وانحر এর তাফসীর।

৩। প্রথম অভিশপ্ত ব্যক্তি হচ্ছে গাইরুল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু যবেহকারী।

৪। যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত। এরমধ্যে এ কথাও নিহিত আছে যে তুমি কোন ব্যক্তির পিতা- মাতাকে অভিশাপ দিলে সেও তোমার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দিবে।

৫। যে ব্যক্তি বিদআতীকে আশ্রয় দেয় তার উপর আল্লাহর লা’নত। বিদআতী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে দ্বীনের মধ্যে এমন কোন নতুন বিষয় আবিস্কার

বা উদ্ভাবন করে, যাতে আল্লাহর হক ওয়াজিব হয়ে যায়। এর ফলে সে এমন ব্যক্তির আশ্রয় চায় যে তাকে উক্ত বিষয়ের দোষ ত্রুটি বা অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে।

৬। যে ব্যক্তি জমির সীমানা বা চিহ্ণ পরিবর্তন করে তার উপর আল্লাহর লা’নত। এটা এমন চিহ্ণিত সীমানা যা তোমার এবং তোমার প্রতিবেশীর জমির অধিকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। এটা পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে, তার নির্ধারিত স্থান থেকে সীমানা এগিয়ে আনা অথবা পিছনে নিয়ে যাওয়া।

৭। নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপর লা’নত এবং সাধারণভাবে পাপীদের উপর লা’নতের মধ্যে পার্থক্য।

৮। এ গুরুত্বপূর্ণ কাহিনীটি মাছির কাহিনী হিসেবে পরিচিত।

৯। তার জাহান্নামে প্রবশে করার কারণ হচ্ছে ঐ মাছি, যা নযরানা হিসেবে মূর্তিকে দেয়ার কোন ইচ্ছা না থাকা সত্বেও কওমের অনিষ্টতা হতে বাঁচার উদ্দেশ্যেই সে [মাছিটি নযরানা হিসেবে মূর্তিকে দিয়ে শিরকী] কাজটি করেছে।

১০। মোমিনের অন্তরে শিরকের [মারাত্মক ও ক্ষতিকর] অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ। নিহত [জান্নাতী] ব্যক্তি নিহত হওয়ার ব্যাপারে কি ভাবে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তাদের দাবীর কাছে সে মাথা নত করেনি। অথচ তারা তার কাছে কেলমাত্র বাহ্যিক আমল ছাড়া আর কিছুই দাবী করেনি।

১১। যে ব্যক্তি জাহান্নামে গিয়েছে সে একজন মুসলমান। কারণ সে যদি কাফের হতো তাহলে এ কথা বলা হতোনা دخل النار فى ذباب একটি মাছির ব্যাপারে সে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে। [অর্থাৎ মাছি সংক্রান্ত শিরকী ঘটনার পূর্বে সে জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য ছিল]

১২। এতে সেই সহীহ হাদিসের পক্ষে সাক্ষ্য পাওয়া যায়, যাতে বলা হয়েছে, الجنة اقرب إلى أجدكم من شراك نعله والنار مثل ذلك

‘‘জান্নাত তোমাদের কোন ব্যক্তির কাছে তার জুতার ফিতার চেয়েও নিকটবর্তী। জাহান্নামও তদ্রুপ নিকটবর্তী।’’

১৩। এটা জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, অন্তরের আমলই হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য। এমনকি মূর্তি পূজারীদের কাছেও এ কথা স্বীকৃত।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৬৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 পরের পাতা »