কিতাবুত তাওহীদ ১ হতে ৬৭ তম অধ্যায় মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহহাব ১ টি
২০ - নেককার বুজুর্গ ব্যক্তির কবরের পাশে ইবাদত করার ব্যাপারে যেখানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখানে ঐ নেককার ব্যক্তির উদ্দেশ্যে ইবাদত কিভাবে জায়েয হতে পারে?

১। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, উম্মে সালামা রা. হাবশায় যে গীর্জা দেখতে পেয়েছিলেন এবং তাতে যে ছবি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে উল্লেখ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,

اولئك إذا مات فيهم الرجل الصالح أو العبد الصالح بنوا على قبره مسجدا وصوروا فيه تلك الصور أولئك شرار الخلق عند الله.

‘‘তাদের মধ্যে কোন নেককার বুজুর্গ ব্যক্তির মৃত্যু বরণ করার পর তার কবরের উপর তারা মসজিদ তৈরী করতো এবং মসজিদে ঐ ছবিগুলো অংকন করতো। [অর্থাৎ তুমি সে জাতীয় ছবিগুলোই দেখেছ]। তারা হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট।’’ তারা দুটি ফেতনাকে একত্রিত করেছে। একটি হচ্ছে কবর পুজার ফেতনা। অপরটি হচ্ছে মূর্তি পূজার ফেতনা। (বুখারি)

২। সহীত বুখারি ও মুসলিমে আয়েশা রা. থেকে আরো একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যু

ঘনিয়ে আসলো, তখন তিনি নিজের মুখমণ্ডলকে স্বীয় চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলতে লাগলেন। আবার অস্বস্তিবোধ করলে তা চেহারা থেকে সরিয়ে ফেলতেন। এমন অবস্থায়ই তিনি বললেন,

لعنة الله على اليهود والنصارى اتخذوا قبور أنبياءهم مساجد

‘‘ইয়াহুদী নাসারাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত। তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়েছে’’ তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সতর্ক করে দিয়েছেন। কবরকে ইবাদত খানায় পরিণত করার আশংকা না থাকলে তাঁর কবরকে উন্মুক্ত রাখা হতো। (বুখারি ও মুসলিম)

৩। জুনদুব বিন আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে এ কথা বলতে শুনেছি, ‘‘তোমাদের মধ্য থেকে কাউকে আমার খলীল [বন্ধু] হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে মুক্ত। কেননা আল্লাহ তাআলা আমাকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেমনিভাবে তিনি ইবরাহীম আ.কে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আর আমি যদি আমার উম্মত হতে কাউকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করতাম তাহলে অবশ্যই আবু বকরকে খলীল হিসেবে গ্রহণ করতাম।’’

ألا وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبياءهم مساجد ألا فلا تتخذوا القبور مساجد فاني أنهاكم عن ذلك.

‘‘সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। সাবধান, তোমরা কবরকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি।’’

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্তেও এ কাজ [কবরকে মসজিদে পরিণত] করতে নিষেধ করেছেন। আর এ কাজ যারা করেছে (তাঁর কথার ধরন দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে) তাদেরকে তিনি লানত করেছেন। কবরের পাশে মসজিদ নির্মিত না হলেও সেখানে নামায পড়া রাসূল এর এ লানতের অন্তর্ভূক্ত।

خشي أن يتخذ مسجدا

এ বাণীর দ্বারা এ মর্মার্থই বুঝানো হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম নবীর কবরের পাশে মসজিদ বানানোর মত লোক ছিলেন না। যে স্থানকে নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হয়েছে সে স্থানকেই মসজিদ হিসেবে গণ্য করা হয়। বরং এমন প্রতিটি স্থানের নামই মসজিদ যেখানে নামায আদায় হয়। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন,

جعلت لي الأرض مسجدا وطهورا

‘‘পৃথিবার সব স্থানকেই আমার জন্য মসজিদ বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পবিত্র করে দেয়া হয়েছে।’’ (মুসলিম)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘জীবন্ত অবস্থায় যাদের উপর দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে, আর যারা কবরকে মসজিদে পরিণত করে তারাই হচ্ছে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। (মুসনাদে আহমাদ, আবু হাতিম এ হাদীসটি তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছে।)

এ অধ্যায় থেকে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১। যে ব্যক্তি নেককার ও বুজুর্গ লোকের কবরের পাশে আল্লাহর ইবাদত করার জন্য মসজিদ বানায় নিয়ত সহীহ হওয়া সত্বেও তার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্তি।

২। মূর্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কঠোরতা অবলম্বন।

৩। কবরকে মসজিদ না বানানোর বিষয়টি তিনি প্রথমে কিভাবে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে তিনি তা বারবার বলেছেন। তারপর কবর পূজা সম্পর্কিত কথাকে তিনি যথেষ্ট মনে করেননি। [যার ফলে মৃত্যুর পূর্বেও এ ব্যাপারে উম্মতকে সাবধান করে দিয়েছেন] অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক এ ব্যাপারে অত্যাধিক গুরুত্ব প্রদানের মধ্যেই শিক্ষা ও উপদেশ নিহিত রয়েছে।

৪। নিজ কবরের অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই তাঁর কবরের পাশে এসব কাজ অর্থাৎ কবর পূজাকে নিষেধ করেছেন।

৫। নবীদের কবর পূজা করা বা কবরকে ইবাদত খানায় পরিণত করা ইহুদী নাসারাদের রীতি-নীতি।

৬। এ জাতীয় কাজ যারা করে তাদের উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অভিসম্পাত।

৭। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবরের ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধান করে দেয়া।

৮। তাঁর কবরকে উন্মুক্ত না রাখার কারণ এ হাদীসে সুস্পষ্ট।

৯। কবরকে মসজিদ বানানোর মর্মার্থ।

১০। যারা কবরকে মসজিদে পরিণত করে এবং যাদের উপর দিয়ে কিয়ামত সংঘটিত হবে এ দু’ধরনের লোকের কথা একই সাথে উল্লেখ করেছেন। অতঃপর একজন মানুষ কোন পথ অবলম্বনে শিরকের দিকে ধাবিত হয় এবং এর পরিণতি কি সেটাও উল্লেখ করেছেন।

১১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ইন্তেকালের পাঁচ দিন পূর্বে স্বীয় খুতবায় বিদআতী লোকদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট দু’টি দলের জবাব দিয়েছেন। কিছু সংখ্যক জ্ঞানী ব্যক্তিরা এ বিদআতীদেরকে ৭২ দলের বহির্ভূত বলে মনে করেন। এসব বিদআতীরা হচ্ছে ‘‘রাফেজী’’ ও জাহমিয়্যা’’। এ রাফেজী দলের কারণেই শিরক এবং কবর পূজা শুরু হয়েছে। সর্বপ্রথম কবরের উপর তারাই মসজিদ নির্মাণ করেছে।

১২। মৃত্যু যন্ত্রণার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে পরীক্ষা করা হয়েছে তা জানা যায়।

১৩। ‘খুল্লাত’ বা বন্ধুত্বের মর্যাদা ও সম্মান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেয়া হয়েছে।

১৪। খুল্লাতই হচ্ছে মুহাববত ও ভালবাসার সর্বোচ্চ স্থান।

১৫। আবু বকর ছিদ্দিক রা. সর্ব শ্রেষ্ঠ সাহাবী হওয়ার ঘোষণা।

১৬। তাঁর [আবুবকর রা.] খিলাফতের প্রতি ইঙ্গিত প্রদান।