হাদীসের নামে জালিয়াতি ভাষা, পেশা ইত্যাদি বিষয়ক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৩ টি

ইসলাম সকল যুগের, সকল ভাষার, সকল সমাজের মানুষদের জন্য আল্লাহর মনোনীত ধর্ম, দীন বা জীবন ব্যবস্থা। এখানে ভাষা, দেশ, বর্ণ, গোত্র, বংশ, যুগ ইত্যাদির কারণে কোনো মর্যাদার আধিক্য বা কমতি নেই। কুরআন ও হাদীসে একথা বারংবার বলা হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে জাতিগত, ভাষাগত, পেশাগত ইত্যাদি বিভেদের সুযোগ নিয়ে অনেক জালিয়াত কারো পক্ষে ও কারো বিপক্ষে বিভিন্ন হাদীস বানিয়েছে। আরবী ভাষার পক্ষে ও ফার্সীর বিপক্ষে কেউ কথা বানিয়েছে। কেউ উল্টো করেছে। অনুরূপভাবে আরব, পার্সিয়ান, তুর্কি, নিগ্রো, রোমান, গ্রীক, আফ্রিকান... বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে। স্বর্ণকার, তাতি, জেলে, নাপিত... ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীস বানানো হয়েছে।

সনদ বিচার ও নিরীক্ষায় এগুলোর জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এছাড়া এগুলো ইসলামী মূল্যবোধের বিরোধী। মানুষের মর্যাদার একমাত্র মাপকাঠি ‘তাকওয়া’ বা সততা। পেশা, ভাষা, বর্ণ, গোত্র, বংশ ইত্যাদির ভিত্তিতে কাউকে নিন্দা করা বা কাউকে কারো থেকে ছোট বলা কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট নির্দেশনার বিরোধী। এ জাতীয় জাল হাদীসগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১. আরব জাতিকে তিনটি কারণে ভালবাসবে

আরবী কুরআনের ভাষা এবং রাসুলুল্লাহ ()-এর ভাষা। এজন্য স্বভাবতই সকল মুমিন আরবী ভাষাকে ভালবাসেন। ভাষার প্রতি এ স্বাভাবিক ভালবাসাকে কেন্দ্র করে জালিয়াতগণ আরব জাতিকে ভালবাসার ফযীলতে অনেক হাদীস বানিয়েছে। এ অর্থে একটি প্রচলিত হাদীস:

أَحِبُّوْا الْعَرَبَ لِثَلاثٍ؛ لأَنِّيْ عَرَبِيٌُّ، وَالْقُرْآنُ عَرَبِيٌّ، وَلِسَانُ أَهْلِ الْجَنَّةِ عَرَبِيٌّ

‘‘তিনটি কারণে আরব জাতিকে (আরবদেরকে) ভালবাসবে: আমি আরবী, কুরআনের ভাষা আরবী এবং জান্নাতের ভাষা আরবী।’’

এ কথাকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস বানোয়াট এবং কেউ কেউ যয়ীফ হিসাবে গণ্য করেছেন। সনদ বিচারে কথাটি বানোয়াট বলেই বুঝা যায়।[1]

[1] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৯৭-৯৮; ইবনুল জাওযী, আল-মাউযূ‘আত ১/৩৪৮; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৪২; সাখাবী, আল- মাকাসিদ, পৃ: ৪৫-৪৬; আলবানী, যায়ীফাহ ১/২৯৩।

ফাসী ভাষা আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ভাষা অর্থে জাল হাদীসের কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি। ফার্সী ভাষায় কথা বলার নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক অনেক হাদীস বানিয়েছে জালিয়াতগণ। হাকিম নাইসাপূরী তার ‘মুসতাদরাক’ গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ () থেকে নিম্নের হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন:

مَنْ تَكَلَّمَ بِالْفَارِسِيَّةِ زَادَتْ فِيْ خُبْثِهِ وَنَقَصَتْ مِنْ مُرُوْءَتِهِ

‘‘যদি কেউ ফার্সী ভাষায় কথা বলে, তবে তা তার নোংরামি-পাপ বৃদ্ধি করবে এবং তার মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তিত্ব কমিয়ে দেবে।’’

এ হাদীসের একমাত্র বর্ণনাকারী তালহা ইবনু যাইদ রুক্কী। তিনি দাবি করেন যে, ইমাম আউযায়ী তাকে হাদীসটি ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাসীর থেকে আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন। এ ব্যক্তিকে মুহাদ্দিসগণ পরিত্যক্ত ও অত্যন্ত আপত্তিকর বলে উল্লেখ করেছেন। এজন্য ইবনুল জাওযী, যাহাবী প্রমুখ ইমাম হাদীসটিকে বানোয়াট ও মিথ্যা বলে গণ্য করেছেন। ইমাম সুয়ূতী একাধিক সমার্থক হাদীসের ভিত্তিতে হাদীসটিকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। এখানে লক্ষণীয় যে, সনদগত দুর্বলতার পাশাপাশি অর্থ ইসলামী মূল্যবোধের বিরোধী হওয়ায় হাদীসটি বাতিল বলেই গণ্য।[1]

[1] ইবনু আদী, আল-কামিল ৪/১০৮-১১০; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৯৮; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/২৬৫-২৬৬; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৩/৪৬৩-৪৬৪; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/২৮১; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/২৯১।

যে সকল জাল হাদীস আমাদের সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ঘৃণ্য প্রভাব রেখেছে সেগুলোর অন্যতম হলো, তাঁতি, দর্জি, কর্মকার, নাপিত ইত্যাদি পেশার মানুষদের বিরুদ্ধে বানানো বিভিন্ন জাল হাদীস। ইসলামে শ্রম, কর্ম ও পেশাকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। সকল প্রকার পেশা ও কর্মকে প্রশংসা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এ সকল জালিয়াত রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বিভিন্ন পেশার নিন্দায় হাদীস বানিয়েছে। যেমন, তাঁতিগণ বা নাপিতগণ অন্য মুসলমানদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের সমমর্যাদা সম্পন্ন নয়। কর্মকার বা স্বর্ণকারগণ সবচেয়ে বেশি মিথ্যাবাদি। তাঁতিরাই দাজ্জালের অনুসারী হবে। পশু-ব্যবসায়ী, কসাই বা শিকারীর নিন্দা।[1]

এ সকল জাল হাদীসের প্রচলন মুসলিম সমাজে বিভিন্ন পেশার প্রতি ঘৃণা, কর্মের প্রতি ঘৃণা ইত্যাদি ইসলাম বিরোধী মানসিকতা সৃষ্টি করেছে।

[1] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৭/১৩৪-১৩৫; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৮৯; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/১৬২-১৬৩; যাহাবী, মীযানুল ই’তিদাল ৫/১৭৪-১৭৬; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ৩/১৬৪; আদ-দিরাইয়াহ ২/৬৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/২০১-২০২; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ১/২৫৪-২৫৫; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৯৮-১৯৯; আলবানী, যায়ীফুল জামি, পৃ. ৫৬২-৫৬৩।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৩ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে